এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

আর্যতীর্থ



ছন্দ-কবিতা




।চোখ।

মুখ নয়, কথা বোলো চোখে চোখ রেখে,
মুখ আর জিভ শুধু লুকোতেই শেখে।
ভঙ্গীরা ঢেকে যায় নানান মুখোশে ,
গুমকরা চুপকথা চোখ শুধু দেখে।

হাতের স্পর্শ নয়, চোখ দেখো শুধু,
চোখ থেকে লালা ঝরে, চোখ থেকে মধু।
চোখ ঠিক বলে দেয় কতখানি কান্নায়
অনুপাতে মিশে থাকে কত বালি ধু ধু।

চোখ পড়ে নিতে শেখো বাঁচার তাগিদে
জিভেরা অধুনা নয় তত সাদাসিধে
বাড়ানো গোলাপ ফুঁড়ে চোখ বলে দেবে
কোন প্রেমে লকলকে জান্তব খিদে।

চোখ ভেজে চোখ জ্বলে চোখ হাসে রোজ
বস্তুত ভাবনারা চোখের যমজ।
ঠোঁটেরা যখন বলে মধুমাখা কথা,
চোখ ঠিক দিয়ে দেবে ছুরিটার খোঁজ।

কালো চশমায় যদি কোনো চোখ ঢাকে
জেনো সে নিজের কথা বলে না তোমাকে
তোমারও কি দায় আছে যেচে আলাপের
পড়তে দিওনা তাকে তোমার ভাষাকে।

মুখের কথার থেকে মনকে বাঁচিয়ে
বন্ধু শত্রু চিনে নিও চোখ দিয়ে।




।নাক।

শুঁকছি হাওয়া , শুঁকছি হাওয়া, তোমার গন্ধ যাচ্ছে পাওয়া,
আবিষ্ট হই, নিবিষ্ট হই, তোমার নেশায় আকাশ ছাওয়া,
তোমার সুবাস মানেই জানি বসন্তকাল ধরতে পাওয়া।

দিন কেটে যায় বারুদ শুঁকে, সন্দেহরা সকাল সন্ধে গন্ধ ছড়ায়
রক্তে কাদের ভিজছে মাটি, কারা যেন ভালো থাকার আশা পোড়ায়,
আতরমাখা রুমাল চাপি, ব্যর্থতাদের বিষাদ তবু উপচে পড়ে দোরের গোড়ায়।

বাতাস শুঁকছে গুপ্তচরও, কোথায় কোথায় গন্ধ জড়ো রাজদ্রোহের,
কোথায় লোকে ফেলছে বুঝে, ধুপ জ্বলেছে দুর্গন্ধ ঢাকতে যতেক ধর্মমোহের,
কোথায় কোথায় ভোটের প্রতি অভক্তিতে, সুগন্ধীতে হয় না পুজো সে বিগ্রহের।

এমনতর দ্রোহকালে, আজ সকালে এই কপালে তোমার সুবাস,
আহা ক'যুগ পরে, এ বুক ভরে, স্বপ্ন নিলো প্রাণপণে শ্বাস,
বসন্তদিন আসন্ন তাই তোমার কথাই বলছে বাতাস।



।ত্বক।

কতটা পৃথুল হলে ত্বক, বীতশোক হয়ে সব সহ্য করা যাবে,
সে ব্যাপারে সরকারী আদমসুমারি করা হোক ।
তাহলেই চুকে যাবে ল্যাঠা, মুচড়ে উঠবেনা কলজেটা,
প্রতি শিশুধর্ষণ শুনে। পাশ ফিরে ঘুম দেওয়া যাবে ধর্মের নামে হওয়া খুনে।
ইদানিং ভালো থাকে তারা, যারা সব সয়ে নিতে পারে।শাসকের তালে তাল দেয়, পুতুলের মতো মাথা নাড়ে।
ঘরের দরজাগুলো এঁটে, সমকাল রাখছে পকেটে, কালো আস্তরণে মুড়ে লকারের এককোণে রেখে দেয় যুক্তিবিচার,
আখের গোছাতে গিয়ে মানুষেরা হয়ে পড়ে ক্রমে গণ্ডার।
বেড়ে যায় সহ্যসীমানা, পুরু চামে দ্রোহিতা অজানা,
তার কাছে জোলো লাগে গোরক্ষা খুন কিংবা কোথায় চাষী
মরে ফলিডলে,
কটা গ্র্যান্ডস্ল্যাম শেষে ফেডেরার জিতে নেবে তাই নিয়ে আলোচনা চলে।
যাবতীয় জীবনের দাবী, রোজকার সাজানো রেকাবি, ভরে থাকে নিজস্ব যাপন,
বেডরুম পার করে বারান্দার গ্রিল ,সেটুকুর পরেই পাঁচিল,
ভাবনারও কাজ সমাপন।
আজকাল চলছে এটাই, ভালোভাবে বেঁচে যেতে চাই ত্বকের চর্বি হওয়া মোটা,
ভুল হাওয়া যদি পড়ে ঢুকে, পোড়ো না হে দ্রোহের অসুখে,
বুঝোনা মোটেই গল্পটা।



। জিভ।

জিভে লোভ, জিভে লালা, জিভে লেগে কথা,
জিভ নিয়ে চারদিকে মহা জটিলতা।
বিষ আর অমৃত জিভে লেগে থাকে
ধর্ম জিরাফে জিভ দুটোতেই থাকে।

জিভেরা সলতে হয় জ্বালাতে আগুন
প্রখর গ্রীষ্মে পারে আনাতে ফাগুন
দ্রোহকালে জিভ হয় ঋজু প্রতিবাদী
জিভ দোষারোপী হয় জিভ ফরিয়াদী।

চাটুকার জিভ পা লালাতে ভেজায়
বোকা সাজে কিছু জিভ ,ধূর্ত বেজায়
ষড় করে কিছু জিভ নিতে পারে প্রাণ
ফিসফিস কানে বিষ বানাতে শ্মশান।

কখনো ধ্বংস ডাকে জিভেদের লোভ
চেটেপুটে খেতে চায় যা আছে সব।
জিভই আবার দেয় সাম্যের ডাক
তোমার আমার দেশ দুজনেরই থাক।

কখনো জিভ বাঁচে আড়ষ্ট হয়ে,
কিছু সে সুবিধাবাদী, কিছু চুপ ভয়ে
শাসকের জিভ যদি নেয় মৌনতা
প্রশ্রয় ভাবে তাকে দলের জনতা

জিভে লোভ, জিভে লাভ, জিভে কত কথা
জিভে থাকে বিষবাণ, জিভে সরলতা।



। কান।

হে মহামহিমগণ , পেতে আছি কান
কত আগে যাবে দেশ আমাকে শোনান।
সাদা হওয়া কালো টাকা স্নেহের বাতাস পেয়ে ফড়ফড় ওড়ে,
সে ডানার সশব্দ আস্ফালন শুনে,
তালা লেগে যায় আজ সবিনয় ট্যাক্সদেওয়া কর্ণকুহরে।

আমাকে শোনান আজও কোন কোন স্থানে,
শাঁখের আওয়াজ এসে নিশ্চিন্তে মিশে যায় সাঁঝের আজানে,
গাভীর নিরীহস্বর কোথায় করেনা কোনো যুদ্ধঘোষণা,
প্রার্থনা যেইখানে ঘৃণাবিহরিত,
আমাকে শোনান সেই মন্দ্র উপাসনা।

হে মহামহিমগণ, চাইছি তো বলি দেশ বেহাগের সুরে রোজ বাজো
এ কানের চারপাশে বেসুরে কাঁদছে কারা আজও?
সাঁই সাঁই শব্দতে আগামীর ট্রেন চায় রেসিং কারের বেগ ছুঁতে
ফাঁসি দেওয়া চাষীদেহ ঘিরে কাঁদে পরিবার ,
যতদিন বয়ে যায়, সমবেত হাহাকার রোল ওঠে আরও উঁচুতে।

আমাকে শোনান আজ ভরপেট ভাতে দেশ তোলে উদগার,
শ্লোগানের শ্লাঘা নয়, কাজ শেষে আড্ডায় সশব্দে হেসে ওঠে পূর্ব বেকার।
সব হাতে কাজ হলে ধর্ম কেমন করে জোরে নাক ডাকে,
কান পেতে আছি প্রভু, সে মধুর ঘড়ঘড় শোনান আমাকে।

হে মহামহিমগণ, এমন শব্দ যদি শুনতে না পাই,
অনুমতি দিন তবে, দুই কানে তুলো গুঁজে নির্বাসনে যাই।



। শ্রোতা।

সন্ধেটা ভালোই জমেছে, ঠুংঠাং টুংটাং পেয়ালা আওয়াজে,
সফেন বিয়ার ,অভিজাত হুইস্কি আর ভ্রাম্যমান কাবাবের প্লেট,
গুজগুজ ফুসফুস নানান টেবিলে, কিছু মাথা মুঠোফোনে হেঁট,
এর মাঝে, অনাহুত অতিথির মতো, মৃদুস্বরে বেহালাটা বাজে।

হলটার এককোণে, যেন প্রায় ভুলে গিয়ে, ফুটউঁচু মঞ্চ বানানো,
আঁধারে লেপ্টে বসে এক আসবাব হয়ে বেহালাবাদক ছড় টানে
এরকম পার্টিতে শচীন বা সলিলকে কেউ শুনবেনা সেটা জানে,
তবুও বাজাতে আসে ,কিছুটা নেশাই বটে, রয়েছে পেটের কিছু টানও।

দু একটা রবিগান বাজিয়েছে অভ্যাসে, জনতা গপ্পো করে খালি.
এইবার ধরলো সে ' অজীব দস্তাঁ ইয়ে' , বড় প্রিয় গান তার এটা,
চোখ বুজে ডুবে গিয়ে সুর তাল লয়ে দেয় পারলে নিংড়ে কলজেটা,
অন্তরা শেষ করে শেষ টান দিলো ছড়ে, তখনই, হঠাৎ...হাততালি!

কোণের টেবিলে বসা সদ্যপ্রবীণ এক, দৃষ্টি তখনও তার দিকে,
তালে তাল দিচ্ছেন আঙুলে, মাথা দোলে, মুগ্ধ দু চোখ,
মুছে যায় হলঘর, মুঠোফোনী দাসদাসী, যাবতীয় অরসিক লোক,
বেহালা বাজতে থাকে তন্নিষ্ঠ প্রেমিকের মতো, ভোলাতে একক শ্রোতাটিকে।


আর্যতীর্থ