এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

বিশ্বরূপ চক্রবর্তী



ছোটগল্প



অন্ধকূপ

শান্তিপুর। পুরুলিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রাম।জায়গাটা ভারি অদ্ভুত। এই গ্লোবালাইজেশনের যুগেও বিন্দু মাত্র বদলায় নি।প্রকৃতি যেন নিজ্ব বক্ষে আঁকড়ে রেখে গ্রামটাকে। গ্রামের বেশির ভাগ পরিবার ই অত্যন্ত গরিব। টেনে টুনে সংসার চলে যায় এদের। গ্রামেই থাকত গোবিন্দ ও মঞ্জুরি। এদের মেয়ে স্নেহাশ্রী। আদর করে সবাই স্নেহা বলেই ডাকে। কী আদুরে আর দুষ্টু মেয়ে! সারাদিন এই দিক ওই দিক করে সময় চলে যায়। তেমন বুদ্ধিমতী এই মেয়ে।গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার মদনমোহন বাবু সব সময় প্রশংসা করেন এই বছর দশের এই মেয়ের। খেতের জমির মাঝে আলগুলো দিয়ে স্নেহা খেলত, ঘুরত।
"স্নেহা মা ওরকম করে না। লেগে যাবে!" আদরের মেয়েকে বার বার মঞ্জুরি বারণ করত। টেনে টুনে সংসার চালানো এই গোবিন্দ মেয়েকে খুব ভালোবাসত।
"আমাদের মেয়েকে অনেক বড়ো করতে হবে।
পারবি তো তুই স্নেহা!"
স্নেহা মাথা নাড়ত। মন দিয়ে পড়াশোনা করত। একদিন সে তার প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার মদনমোহন বাবুকে জিগেস করে,
"স্যার কিভাবে আমি আমার বাবা মায়ের কষ্ট মুছে ফেলব!"
"এত ছোট মেয়ের মুখে এ কি কথা!ভালো করে পড়াশোনা কর। অনেক বড়ো হবি তুই!"
সময় চলতে থাকে। একদিন ক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে মাটিতে মাথা ঘুরিয়ে পরে যায় গোবিন্দ। সবাই ধরে বেঁঁধে বাড়িতে নিয়ে আসে।
"কি হয়েছে বাবা?"
"ও কিছু নয়।"
"মা বাবা কে ডাক্তার দেখাবে না?"
"হ্যা দেখাবো। কি হল সুস্থ মানুষটার!"
এলাকায় ফিরেছে জিতেন। কলকাতায় কাজ করে এই জিতেন। কি কাজ সেটা অবশ্য কেউ জানে না। এলাকায় ধনী বলতে জিতেন কে সবাই বলত। বাড়িতে বাবা, মা আছে। ছেলেকে নিয়ে বেশ গর্ব তাদের। এবার দিন পনেরো থাকবে।গোবিন্দদার অসুখ শুনে সে কিছু টাকা দিয়ে আসে। ডাক্তার দেখানো হয়। তিনি কিছু টেস্ট দেয়।
সরকারি হাসপাতালে গিয়ে সেগুলো করানো হয়।
বাড়িতে আসে স্নেহা। ঘরে লোকজন ভর্তি। মায়ের চোখে জল। বাবা বিছানায় শুয়ে আছে।
"কি হয়েছে মা!"
"কিছু হয় নি। তুই যা! "
কেউ কিছু বলতে চাইছে না। যে স্যার তাকে সব উত্তর দেন, তিনিও আজ চুপ। ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মনমরা হয়ে স্নেহা।বাইরে জিতেন দা বিড়ি খাচ্ছে।
"ও জিতেন দা!"
"আরে পুচকি! কেমন আছিস?"
"তুমি বলো না বাবা কেমন আছে?"
"তোকে কেউ কিছু বলে নি। অবশ্য তুই এত ছোট!"
"আমায় বলো না!"
"তোর বাবার ক্যানসার হয়েছে। উনি আর বেশি দিন...."
মনে পরে যায় স্নেহাশ্রীর স্যারের কথা।
"ক্যানসার হল সব থেকে মারণ রোগ। প্রথমত ঠিক মত নিরাময়ের ওষুধ নেই, আর যা আছে তা আমাদের সাধ্যর বাইরে।"
বছর দশের স্নেহার চোখে জল চলে আসে।দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে।
"বাবা তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো!"
"না রে যাব না।" হেসে উত্তর দেয় গোবিন্দ।স্নেহা আজ স্কুলে প্রথম হয়েছে পরিক্ষায়, এত আনন্দের দিনটা যে তার জীবন এর সব থেকে খারাপ দিনে পরিণত হয়ে যাবে, সে জানতই না। আজকাল সে আর দুষ্টুমি করে না। বাবার শরীর খারাপ, মাকে সংসার চালাতে হয়। তাকে দেখার জন্য যে মা নেই সে বুঝে গেছে। পাশের পুকুড়ে গিয়ে বসে চুপ করে বসে ঢিল ছুড়ত।
"কিরে স্নেহা? এখানে একা একা?"
"না এমনি! জিতুদা।"
"কি এত ভাবছিস!"
"অনেক কিছু!"
"কি আমিও শুনি!"
"আমি যদি বড়ো হতাম, বাবাকে ডাক্তার দেখিয়ে ভালো করে তুলতাম। মাকে এত কস্ট করতে হত না। ঠিক তোমার মত!"
মাথা নাড়িয়ে বলে স্নেহাশ্রী।
"টাকা রোজগার করবি?"
"আমি বাচ্চা মেয়ে কিভাবে করবো!"
"কলকাতা যাবি? "
"কিন্তু জিতুদা আমি পারব? আমার ভয়...."
ককিয়ে ওঠে স্নেহা।
খানিকক্ষণ ভেবে আবার বলে, "মা আমাকে যেতে দেবে না মনে হয়।"
জিতু যেন কি সব ভেবে নেয়।
"আরে এই সব ছোট সমস্যা নিয়ে না চিন্তা করে চল। অনেক টাকা পাবি, পড়াশোনা করবি। তুই ও ভালো থাকবি, তোর বাবাও!"
"আমায় পড়াশোনা করতে দেবে? সত্যি বলছ জিতু দা?"
"হ্যা রে সত্যি বলছি। অনেক ভালো থাকবি।এই গ্রামে থেকে কিছু হবে না।"
স্নেহাশ্রীর মনে পরে যায় মদনমোহনবাবুর কথা।
"জানিস স্নেহা, যারা ভালো পড়াশোনা করে, তারা এখান থেকে কলকাতায় বড়ো বড়ো জায়গায় পড়তে চলে যায়। আমার বিশ্বাস, তুই ও যাবি! "
স্বপ্নপূরণ যে এত সোজা ভাবতেই পারছে না ও। জিতুদা কে যেন তার জাদুকর মনে হচ্ছে। সব সমস্যার সমাধান সে কয়েক মুহুর্তে করে দিতে পারে।
"তাহলে কালই বেরোব। কাউকে বলবি না।তাহলে যেতে দেবে না।"
"কিন্তু মাকে একবার...
"
"না একদম নয়। বউদির এমনি মন মেজাজ খারাপ আর তুই....! ভরসা রাখ আমার উপর!"
"এখন বাড়ি যাচ্ছি। কাল তাহলে চলে যাব। "
আনমনে বাড়ির দিকে এগোছে থাকে ছোট স্নেহা। চেনা পুকুর, ক্ষেতের মাঝের আলগুলোকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না তার। কিন্তু না, বাবার জন্য তাকে যে যেতেই হবে।অনেক পড়াশোনা করতে হবে, টাকা পাঠাতে হবে। বাচ্চা মেয়েটি এক দিকে যেন বেশ আনন্দ পাচ্ছিল, অন্য দিকে কষ্ট পাচ্ছিল প্রচন্ড। বাড়িতে ঢুকতেই মায়ের চিৎকার,
"কিরে! এত ক্ষণ কোথায় ছিলিস! খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে যাচ্ছি! "
"মা, একটু খেলছিলাম..."
"যা স্নান করে আয়। খাইয়ে দেব।"
ছোট স্নেহার কান্না কান্না পায়। মা বেশ আদর করে খাইয়ে দেয়। কিছুক্ষন পর মায়ের আচলে শুয়ে ঘুমিয়ে পরে স্নেহা।
সকালে উঠে পড়ে। বাবা ঘুমাচ্ছে। মা কাজে গেছে। চটপট জামাকাপড় গোছাতে থাকে।মা, বাবার একটা ছবিও নিয়ে নেয় পুটলিতে। এক দৌড় দেয়। বাঁশবাগানে দাঁড়িয়ে ছিল জিতু।
"আরে চলে এসেছিস? চল চল। বাস ধরতে হবে যে!"
"মা, বাবার জন্য মন খারাপ করছে!"
"আরে তুই তো কাজ করতে যাচ্ছিস। তোর বাবা, মা গর্ব করবে জানলে। আমার কথা কাউকে বলেছিস?"
"মাকে বলা হয় নি। মা খুব কাঁদবে। "
"আমি বউদিকে বলে দেব। এবার চল দেরি হয়ে গেল।"
হাটতে থাকে দুজন। ঘন্টাখানেক হেটে আসে মেন রোডের ধারে।
"চল ওঠ! "
এই প্রথম বাসে উঠল স্নেহা। কোনো দিন যে গ্রামের বাইরে যায়নি।
বেশ আনন্দ হচ্ছে তার।
সিটে বসে।
"কিরে গলা শুকিয়ে গেছে? "
"হুম জল আছে তোমার কাছে?"
"এই নে!"
বাস এগোতে থাকে দ্রুত গতিতে। ঘুমিয়ে পরে স্নেহা।
"হ্যালো?"
"কোথায় জিতু?"
"আসছি বাসে। তুই শিয়ালদাতে দাঁঁড়াবি।আমি পৌঁঁছে যাব। "
"মাল ভালো তো?"
"একদম কচি! আমার ভালো দাম চাই!"
"সে সব নিয়ে কখনও চিন্তা হয়েছে তোর! সব রেডি!"
ফোনটা কেটে দেয় জিতু। মুখে চওড়া হাসি।বাস থেকে নেমে ট্যাক্সি নেয় জিতু।
"দাদা শিয়ালদহ স্টেশন!"
"জিতুদা আমরা কোথায়! কী সুন্দর সুন্দর গাড়ি! কত বড়ো বাড়ি গো! কী দারুণ রাস্তা ঘাট! সব তো বইতে পড়েছিলাম। "
"আমি বলেছিলাম না! আচ্ছা একটু জল খেয়ে নে!"
জল খায় স্নেহাশ্রী। মাথাটা ঝিমাচ্ছে। ঘুমিয়ে পরে আবার। জলের বোতলে বেশ ভালো করেই ঘুমের ওষুধ মিশিয়েছিল জিতু।
গন্তব্য শিয়ালদহ চলে আসে। নামতেই দেখা হয় সুবোধের সাথে!
"আরে ভাই!"
আলিঙ্গন করে দুজন।
"উফ এ তো বিষন কচি!"
"টাকা দে মাল নে!"
"এই নে।"
কুড়ি হাজার টাকা জিতু কে দেয় সুবোধ।
জিতু স্নেহা কে ডাকে।
"এই কাকুর সাথে যা। আমি আসছি!"
চলে যায় জিতু, ভিড়ের মাঝে কোথায় যেন!
বাচ্চা মেয়ে, তারপর ওষুধ! কিছু বলার আগেই এত কিছু হয়ে যায়।
একটা ট্যাক্সি নেয় সুবোধ।
"দাদা শোভাবাজার!"
"আমরা কোথায় যাচ্ছি! "
"তোমার জিতু দাদার কাছে! নাও জলটা খেয়ে নাও।"
এক প্রকার জোর করেই, জলটা খাইয়ে দেয় স্নেহাকে। রাস্তা যে দেখতে দেওয়া যাবে না।
শোভাবাজার আসতে নেমে যায় ওরা।স্নেহাশ্রীকে জোর করে উঠিয়ে দেয়।
"কাকু আমি আর পারছি না!"
"আর এক্কটু চল। চলে এসেছি।"
মাথা ঘুরছে, সারাদিনের ক্লান্তি আর পারছে না স্নেহা। গ্রামের কথা যে বড্ড মনে পড়ছে।
চার দিকে এত বড়ো বড়ো বাড়ি। গাছ পালা নেই বললেই চলে। কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে শ্নেহাশ্রীর। একটা থেকে আর একটা গলি, টানতে টানতে সুবোধ নিয়ে যাচ্ছে স্নেহাশ্রীকে।
"আহ লাগছে! হাতটা..."
শোনেই না সুবোধ। হঠাৎ একটা বাড়িতে ঢুকে যায়। বাড়িটা দেখে কেমন ভয় ভয় লাগছে স্নেহার। কত মেয়েকে দেখছে কেউ তার দিদির বয়সি তো কেউ মায়ের! সুবোধ একজন বয়স্ক মহিলার কাছে নিয়ে গেল।
"একদম টাটকা মাল আছে!"
বয়স্ক মহিলা তাকালো স্নেহাশ্রীর দিকে।
"ওই ছোকরি নাম কি?"
"স্নেহা।"
"আমার পছন্দ হয়েছে। অর্জুন সুবোধ কে হিসাব মিটিয়ে দে!"
"কোথায় যাচ্ছ সুবোধ কাকু? জিতু দা কোথায়?"
"এখানে অনেক টাকা পাবি? এরা পড়াশোনা করাবে। ভালো থাকিস!"
খুব তাড়াতাড়ি বলে চলে যায় সুবোধ।
"চল ছোকরি।"
একটা ছোট ঘুপচি ঘরে ঢুকিয়ে দেয় স্নেহাকে।
"শোন তোকে চুলবুলি বলে ডাকব। অভ্যাস করে নে!"
"কিন্তু..."
"কিছু কিন্তু নয়। ওই রেশমি নতুন মাল। কাজ বলে দে, শিখিয়ে দে। কাল থেকে কাস্টমার দেব। সাজিয়ে দিবি।"
"এ যে খুব বাচ্চা! "
"যত কচি, তত দাম বেশি। তুই বেশি কথা বললে এবার!"
বেরিয়ে যায় বয়স্ক মহিলা।
"আমি কাজ করব! "বেশ আনন্দ পায় স্নেহা।
বাচ্চা মেয়েটাকে দেখে বেশ মায়া লাগছিল রেশমির।
"তুই খুব খারাপ জায়গায় এসে পড়েছিস।হয়ত আর কোনো দিন!"
"কি হয় এখানে?"
সন্ধ্যা হয়েছে। সাজিয়ে দিয়েছে রেশমি স্নেহাকে। সে খুব খুশি। এত সাজেনি কোনো দিন।
"রেশমি বেরো!"
বয়স্ক ভদ্রমহিলা একজন ভদ্রলোক নিয়ে ঘরে ঢুকে যায়।
"এ যে খুব বাচ্চা!"
"আপনি আপনার মত কাজ করে নিন না!"
হেসে বলে বয়স্ক মহিলা। তারপর বেরিয়ে যায়।
ভেতরে চলে মানবতার ধর্ষন! রেশমি দাঁড়িয়ে ছিল বাইরে, সে নিরুপায়। কাস্টমার বেড়িয়ে গেলে সে ঘরে ছুটে যায়। নগ্ন বাচ্চা মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে।
"আমার খুব লাগছিল দিদি! কাঁদতে থাকে স্নেহা।
নিজের উপর খুব রাগ হয় রেশমির।
"আজকে রাতে এখান থেকে বের করে দেব তোকে। পালিয়ে যাবি যত দূর পারিস!"
বাইরে থেকে আওয়াজ আসে।
"রেশমি তোর কাস্টমার.।"
রেশমি চলে যায়। রাত ঘনিয়ে আসে।
"এই ওঠ স্নেহা। চল চটপট!"
স্নেহা তৈরী হয়ে নেয়।
একের পর এক ঘর পার হচ্ছে রেশমি স্নেহাকে কোলে নিয়ে। সামনেই দরজা। আর কয়েক পা বাড়ালেই মুক্তি।
কোল থেকে নামাতে যাবে রেশমি স্নেহাকে, সেই সময়,
"খুব কষ্ট হচ্ছে না রেশমি!"
সপাটে চড় মারে বয়স্ক মহিলাটি।
"সুমন ওকে নিয়ে যা রেশমিকে। বড্ড বার বেড়েছে!"
টানতে টানতে নিয়ে চলে যায় রেশমিকে সুমন। ভাড়াটে গুন্ডা তো।
"এই শোন ছোকরি। অনেক টাকায় তোকে কিনেছি। পালাতে আর পারবি না!"
অন্ধকার গ্রাস করেছে। যে আলোকে মনে হল এই ছুঁয়ে ফেলছি, সেটা যেন উধাও হয়ে যায়। ওকে টানতে টানতে নিয়ে ঘরে বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর কোনো দিন রেশমিদিকে দেখতে পারে নি স্নেহা। প্রথম প্রথম খুব কস্ট হত। দিনের পর দিন চলে গেছে, বছরের বছর নেমে এসেছে। কিছুই পালটায়নি। ছোটোবেলার স্মৃতিগুলো এখন আবছা। আজ যে সে সমাজের অপরাধী, দাগী বেশ্যা! অপরাধ কি করেছিল? স্বপ্ন দেখেছিল? বাবা কে বাঁচাতে চেয়েছিল?পড়াশোনা করতে চেয়েছিল? না দোষ ওর নয় আমাদের সমাজের! আমরাই আসল অপরাধী। বার বার ভুলে যাই এরাও মানুষ, এদের ও জীবন আছে। না হয় আজ নিজেই বদলাই, কাল অন্যদের বলবো!

(সমাপ্ত)

শুভংকর পাল



ছোটগল্প


মৈথুন

'কপাল' ব'লে আপাত অদৃশ্য হ'লেও কিছু যে একটা আছে, এই কথাটা কিছুতেই মানতো না রিয়ান। ও যখন ক্লাস টেন্-এ পড়ে, কোচিং-এ যাতায়াতের সূত্রে ওই কোচিংয়েরই ক্লাস নাইনের একটি মেয়েকে ভালো লেগে গেছিলো ওর। কিছু কিছু খবর হাওয়ায় ওড়ে। এই খবরটিও তেমনই ছড়িয়ে পড়েছিলো সারা পাড়ায়। নিমেষেই। মেয়েটির দাদা একদিন রিয়ানকে রাস্তায় পেয়ে রীতিমতো শাসিয়ে দিয়ে গেলো — ওর বোনের সঙ্গে যেন ও আর কোনোদিনও না মেশে।

সবই কি মামাবাড়ির আবদার নাকি? তোর বোনওতো আমাকে ভালোবাসে। কথাগুলো ওর দাদাকে ব'লেই ফেলেছিলো রিয়ান। ওর দাদা জবাবে ব'লেছিল — ঠিক আছে, বোন তোকে 'না' ব'লে দেবে।

তখন বিশ্বাস হয়নি ওর এই কথা। কিন্তু সত্যিসত্যিই একদিন এক বন্ধু-মারফত রিয়ানের ডাক প'ড়লো ওর প্রেমিকার বাড়িতে। রিয়ানকে চেয়ারে বসিয়ে সঞ্জয়, ওর দিদি ও মা দাঁড়িয়ে আছে ড্রয়িং রুমে। সঞ্জয় ডাক দিলো দোলা-কে। গুটিসুটি পায় দোলা ওর বেডরুম থেকে বেরিয়ে এলো। এসে রিয়ানের সামনেই কিছুটা দূরত্বে দাঁড়ালো। সঞ্জয় ওকে নির্দেশ দিলো — বল্।

দোলা মুখে কিছুই ব'ললো না। চুপটি ক'রেই দাঁড়িয়ে আছে। ওর দাদা চিৎকার পারলো — কি রে? বল্।

দোলা তবুও কিছু না বলায় সঞ্জয় একটা খাতা আর পেন এগিয়ে দিলো ওর কাছে। ব'ললো — মুখে না ব'লতে পারলে এখানে লিখে দে।

দোলা এবার মুখ খুললো। মুখ দিয়ে যতো কম ভলিয়্যুম বের করা যায়, তেমন ক'রেই ব'ললো — বাড়ির তরফ থেকে কেউ যেহেতু রাজি নয়, আমি আর এ সম্পর্ক চাই না।

রিয়ান ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলো। ও আন্দাজ ক'রলো — যে কোনো সম্পর্কের জন্য আর্থিক স্বচ্ছন্দতাটাই আসল। ওদের বাড়িটা দোলাদের বাড়ির চেয়েও আরেকটু বাহাদুরি রকমের হ'লে বোধহয় এমনটি না-ও ঘ'টতে পারতো।

কিন্তু কি অদ্ভুত ! কলেজে পড়ার সময়েও কিন্তু রিয়ান কোনো বান্ধবীই জোগাড় ক'রতে পারলো না ওর প্রেমিকা হিসেবে। অথচ ওর কোনো বড়লোক বান্ধবীও যে সে তুলনায় অসচ্ছল বন্ধুর প্রেমে পড়েনি — এমনটা নয়।

চারপাশের এই বিষয়ক ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় — এই বড়োলোক মেয়েটিও একদিন কেটে পড়বে। মাঝখান থেকে কিছুদিন ওই ছেলেটির সঙ্গে জাস্ট এনজয় ক'রে যাচ্ছে ! সেক্সুয়াল এনজয়মেন্ট! ইয়েস্। যাস্ট্ এনজয়মেন্ট। অথবা বলা যায় — টাইম্ পাস্।

অতএব, রিয়ান বুঝে যায়, হস্তমৈথুনই শ্রেয়। এই বয়সের এই উত্তেজনাকে প্রশমিত করার জন্য একমাত্র হস্তমৈথুনই সহায়ক। বাথরুমে বেশিক্ষণ ধরে স্নান ক'রতে ভালোবাসতে শুরু করে রিয়ান। অন্যকে ভালবাসার ভিতর তেমন কিছু নেই। তেমন কিছু পাবারও নেই। নিজেকে ভালোবাসাই আসল। নিজেকে সুন্দর ক'রে গ'ড়ে তোলাটাই আসল। তখন অন্যরা এমনিতেই আকৃষ্ট হ'তে আসবে। মৌমাছিরা, প্রজাপতিরা মধু খেতে আসবে। কিন্তু ওরাওতো আত্মসাৎ ক'রতেই আসবে। তার মানে কী নিজেকে বা নিজের সবকিছুই অন্যকে উজাড় ক'রে দেবার জন্যই? এসব ভাবতে ভাবতেই রিয়ান গায় সাবান মাখে। ঝিঙের খোসা দিয়ে গা ঘসে। সারা গায়, মুখে, হাতে, পায়। শ্যাম্পু করে চুলে। গায় আর একটুও ময়লা নেই। সব পরিষ্কার। এবার বাম হাতের তালুতে একটু সাবান মাখিয়ে নিয়ে লিঙ্গে মাখায়। এতে হাত ও লিঙ্গের মাঝখানটা পিচ্ছিল হয়। রাস্তায় টাঙানো কোনো বিজ্ঞাপনের কোনো অর্ধনগ্ন মহিলার দৃশ্যটি মনে মনে কল্পনা করে। কনডমের বিজ্ঞাপন। বা ব্রেস্ট্ ম্যাসাজ্ অয়েলের বিজ্ঞাপন। খবরের কাগজেও ওই দৃশ্য থাকে। ওগুলো ভালো কামোদ্দীপক। ধীরে ধীরে লিঙ্গটি শক্ত হ'য়ে ওঠে। নরম পেশী কি সুন্দর কঠোর হ'য়ে যায়। হাতের তালুতে লিঙ্গটি রেখে আর কয়েকবার নাড়াতেই বীর্য ছিটকে বেরিয়ে এসে প'ড়লো দেয়ালে। আহ্। নিজেকে এবার হাল্কা লাগে রিয়ানের। কাম আর নেই। দোলাকে এখন আর মনে ক'রতে ইচ্ছে হয় না রিয়ানের। যা হ'য়েছে ভালোই হ'য়েছে। শুধু তো যৌনসুখের জন্যই মেয়েদেরকে দরকার হয়। ওরা আর কোনো কাজে লাগে? লাগে না। রান্না? সেও শিখে নেবো। ওরাওতো শুধু স্বামীর সবকিছু ভোগ করার জন্যই বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়। ব্যতিক্রম আর কজন? আর সন্তান? গর্ভ ভাড়া পাওয়া যায়। ও নিয়েও চিন্তা নেই।

কতো বিচিত্র হয় এই সম্পর্কগুলো। যতো ভাবতে যায় রিয়ান, ততোই জটিলতায় ঢুকে যায়। তাই এতো বেশি না ভাবাই ভালো। স্নানঘর থেকে বেরিয়ে আসে ও।

অবশ্য রিয়ানের এ সঙ্গিনীহীন জীবনের জন্য রিয়ান নিজেকেও কিছুটা দায়ী করে। ক'রবেই বা না কেনো? ও একটু লাজুকই। মেয়েদের সঙ্গে কিছুতেই এগিয়ে গিয়ে গায় পড়তে পারে না ও। কলেজের রঞ্জনকে দেখেও ও আজ অবদি কিচ্ছুটি শিখে উ'ঠতে পারলো না। প্রতিমার সঙ্গে রঞ্জন কী না ক'রেছে? প্রতিমাও রঞ্জনকে সাফ্ ব'লে দিয়েছে — ও রঞ্জনকে বিয়ে করবে না। অনার্স কমপ্লিট্ হ'য়ে গেলে কোনো প্রবাসী চাকুরিজীবী ছেলে জুটিয়ে দিব্বি ফরেনে গিয়ে উ'ঠবে। সেদিনই তো প্রতিমা কতো ক'রেই না অনুরোধ ক'রলো রঞ্জনকে। প্রতিমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য। প্রতিমার বাবা মা দু'জনই প্রফেসর। তাই বাড়ি তো ফাঁকাই প'ড়ে থাকে। এ সময় রঞ্জনকে পেলে তো ভালোই লাগে। রঞ্জনও দু'টো কনডম কিনে নিয়ে প্রতিমার হাত ধ'রে চ'লে গেছিলো ওদের বাড়ি। এ সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে? পাগলেও করে না। যদি একে দোষ ব'লে আখ্যা দেয়া যায়, রিয়ানের এই একটাই দোষ — ও কিছুতেই এমন ক'রে কারো পেছনে লেগে প'ড়তে পারে না। যে সম্পর্কের কোনো স্থায়িত্ব নেই, এমন সম্পর্ক করে কী লাভ? রিয়ান ভাবে। আর এমন ভাবে ব'লেই ওর দ্বারা আজ অবদি কিছু হ'লো না।

কাউকে ঠকানো ওর ধাতে নেই। সৌম্যদর্শন সুমনকে সবাই কানাঘুসোয় মেয়েবাজ ব'লেই জানে। ও হলো গিয়ে বড়োলোকের ব্যাটা। ও যে ওই গরীব মেয়েটাকে পটিয়েছে, ও কি ওকে কোনোদিনও বিয়ে ক'রবে? ক'রবে না। রিয়াকে ও কখনোই বিয়ে ক'রবে না। রিয়া টেরও পায় না। রিয়ার মধুর হাঁড়ি চেটেপুটে সাফ্ ক'রে তবেই ও ওকে ছাড়বে।

সে যাই হোক, খেয়ে দেয়ে কলেজে বেরোয় রিয়ান। যেতে যেতে ভাবে, প্রসূনেরও তো ওর মতোই অবস্থা। যে মেয়েটিকে সে ভালোবাসতো, মেয়েটি এখন অন্য একটি ছেলের সঙ্গ নিয়েছে। বাইকের পিছনে বসে পিছন থেকে ছেলেটিকে জড়িয়ে ধ'রে যাচ্ছে — এমন অবস্থায় কতোবার দেখেছে প্রসূন! এতোসব দেখে রিয়ানের আর সাধ হয় না - ও এমনই কোনো এক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। সম্পর্ক গড়ে তোলা মানেই সেটা তাগিদ ফুরোলে ভেঙে প'ড়বেই, সেই অনিচ্ছা দু’জনের মধ্যে যে কোনো একজনের তরফ থেকেই আসতে পারে। আর এই ভাঙনের মূলে মাপকাঠি হ'লো এই টাকা! টাকার প্রয়োজনেই একজন আরেকজনের কাছে হস্তান্তরিত হয়। আর যার এ রকমের কোনো উপায়ান্তর থাকে না, সেই একমাত্র ওই সম্পর্কে আজীবন কাটিয়ে দেয়। কাটাতে বাধ্যও হয়।

টিফিন টাইমে রিয়ান প্রসূনকে ডেকে নিয়ে যায় ক্যান্টিনের পিছনে। কলেজ ক্যাম্পাসে ওদের এই একমাত্র আবিস্কৃত জায়গা, যেখানে অন্য আর কেউ এসে ভিড় বাড়ায় না এবং নিরালায় ক্ষণিক কাটিয়ে দেয়া যায়। দু’জনে লুকিয়ে সিগারেট ধরায়। লম্বা সুখটান দেয় আর দুটো ঠোঁট সরু ক'রে ওই ফাঁক দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে — আকাশের দিকে। মনে প'ড়ে যায়, এখানেই একদিন রিয়ান ও প্রসূন এরকমই এক টিফিনের সময় দু’জন মিলেই হস্তমৈথুন ক'রেছিলো। বাজি রেখেছিলো — যার বীর্য তুলনায় বেশি দূরে যাবে, সে জিতবে এবং হেরো-কে সেদিন দু’জনেরই ক্যান্টিনে টিফিনের খরচ দিতে হবে।

জিতেছিলো প্রসূন। রিয়ান সেদিন প্রসূনকে পেট ভরে পরোটা আর কষা আলুর দম খাইয়েছিলো। নিজেও খেয়েছিলো। মজাও পেয়েছিলো। দারুণ।

মনে পড়ে, ওকে নিয়েই একদিন কলেজ কাট্ ক'রে দক্ষিণ কলকাতার যুবকমহলের সেই সুপরিচিত সিনেমা হলটিতে গিয়েছিলো। পিঠে বইখাতার ব্যাগ নিয়েই। সিনেমা হলটা বেশ নিচু রাস্তার চেয়ে। বেশি বৃষ্টি হ'লে পাশের খালের জলও ঢুকে যায় ভেতরে। তখন মেঝে থেকে পা দুটো ওপরে তুলে নিতে হয়। সে এক হ্যাপা। যাই হোক, ওরা যখন হলে ঢুকেছে, সিনেমা শুরু হ'য়ে গেছে। একজন ওদের টিকিট চেক্ ক'রলে দরজাটা ফাঁক ক'রে ঢোকার সময়ই দেখলো, শুধুমাত্র সামনের সারিতেই চারটে সিট্ খালি পড়ে আছে। দরজা বন্ধ হ'য়ে গেলে ঘুটঘুটে অন্ধকার। পর্দায় হিন্দি ছবির ডায়ালগ। ওই আলো অনুসরণ ক'রেই সিটে ব'সতে গিয়ে রিয়ান দেখে — প্লাসটিকের চেয়ারের ওপর একদলা শাদা বীর্যের মতো কি যেন পড়ে আছে। ঘেন্না ঘেন্না ক'রে ওরা পাশের চেয়ারে ব'সলো। একটু পরেই পর্দায় লীলাখেলা শুরু হ'য়ে গেছে। বিবস্ত্র তরুণ তরুণীর রমণের দৃশ্য। বিশেষ সিনেমা চলাকালীন মাঝেমধ্যে ওই রকম কোনো কোনো ভিডিও-ক্লিপ্ ঢুকিয়ে দেয়া হয়। দর্শক তৃপ্ত হয়। সিটের ওপর বীর্য তো পড়ারই কথা!

রিয়ানের মাথায় পোকাটা ঢুকেছে এখান থেকেই। ওর এরকমই একটা বড়ো হলঘর চাই। হস্তমৈথুনের জন্য।

এই যে প্রতিদিন খবরের কাগজ খু'ললেই রেপ্-এর ছড়াছড়ি, পরকীয়া সম্পর্কের জেরে খুনোখুনি — কারো কি হেলদোল আছে এসবের প্রশমনে? রথী মহারথীদের কিছু শুধু বাতেলাই আছে। তারপর যে কে সেই। চ'লছে। আর এরপরেও কারো কোনো ভ্রূক্ষেপ না থাকলে এ তো চ'লতেই থাকবে। উঠতি বয়সে কাম উদ্দীপনা লাঘবের জন্য এই ছেলেরা যদি এই মৈথুনে নিজেদেরকে চালনা করার চেষ্টা করে — সেন্ট্ পারসেন্ট্ না হ'লেও এই ধর্ষণ অনেকটাই কমে যেতে পারে। ব্রিটেন ও অস্ট্রলিয়াতে ২৮শে মে ইন্টারন্যাশনাল মাস্টারবেসন ডে পালন করা হয় এবং জেনারেল সার্জন জয়সেলিন এল্ডার্স-এর সম্মানে ১৯৯৫ এর ১৪ই মে দিনটিকে প্রথম মাস্টারবেসন দিবস হিসেবে দেখা গিয়েছিলো। তিনি স্কুলে ছাত্রদের সেক্স এডুকেশনে এই মাস্টারবেসনকেই অন্তর্ভুক্তির জন্য মত জানিয়েছিলেন এবং সেজন্য বিল ক্লিনটন তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলে। এই কথাগুলো ভুলে যায় নি রিয়ান। আমরা এটাকে ফলো আপ্ ক'রে এগিয়েই নিয়ে যেতে পারি না। কি আর করা যাবে! রিয়ান ভাবতেই থাকে। কিছু একটা ক'রতেই হবে। যে ক'রেই হোক।

ছেলে মেয়ের সাংখ্যিক অনুপাত সমান না হ'লে এ বৈষম্য থাকবেই। আর যেহেতু মুষ্টিমেয় কয়েকটা জায়গা বাদ দিলে সবখানেই পুরুষের জনসংখ্যার হার বেশি, তাই এই বাড়তি পুরুষের যৌন-তৃষ্ণা কে মেটাবে? নিঃস্ব কখন চুরি করে? অভাবে। তাই ছেলেমানুষ কামের বাসনায় মেয়েমানুষকে প্রত্যাশা ক'রে যদি তাকে না পায় — তারা কোথায় যাবে? অতএব ধর্ষণই শ্রেয়। অন্তত তাদের কাছে।

কিন্তু যে পোকাটা রিয়ানের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, ওটাকে বাস্তবায়িত করার জন্যও চাই টাকা। কিন্তু সবকিছুর জন্যই তো বাবার কাছে হাত পাতা যায় না, এ উদ্দেশ্য পূরণ রিয়ানকেই ক'রতে হবে। জোরকদমে পড়াশোনা করে ইংলিশে অনার্স উতরোল ও। তারপর বিএড। পিএসসি দিয়ে হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে চাকরিটাও হ'য়ে গেলো। পোস্টিং অবশ্য ক্যানিং-এ। সে হোক, ঢাকুরিয়া থেকে আরামসে ট্রেনে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করাই যায়। প্রসূনের চাকরিটা হ'লো না, ভাইভা-তে আটকে গেছে। ওর ক্ষেত্রে আট লাখ টাকা চেয়েছিলো, ঘুষ হিসেবে। চাকরিটা পাইয়ে দেবে। কিন্তু এতো টাকা কোথায়? ও মনস্থির ক'রলো — পরেরবার আবার পরীক্ষায় ব'সবে।

এদিকে চাকরির ইনকাম্ দেখিয়ে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এইচ্-ডি-এফ্-সি থেকে একটা হোম্ লোন পেয়ে গেলো রিয়ান। যাদবপুরের কাছেই একটা ফ্ল্যাট রিসেলে কিনলো। স্বপ্নপূরণ হ'তে চ'লেছে। সত্যিই।

ফ্ল্যাটটা গ্রাউন্ড ফ্লোরে হওয়াতে সুবিধেই হ'য়েছে একদিক থেকে। সিঁড়ি ভেঙে কাউকে ওপরে উ'ঠতে হবে না। রান্নাঘর বাদ দিয়ে ড্রয়িং রুম ও যে দু’খানা বেডরুম আছে, সেগুলোকে যোগ ক'রলে একটা আয়তাকার ক্ষেত্র। রিয়ান ঠিক ক'রলো, রান্নাঘর আর ড্রয়িং রুমটা যেমন আছে তেমনই থাক। বেডরুম দু’টোর কমন্ ওয়াল-টা ভেঙে দিলেই একটা বড়ো হলঘর হ'য়ে যাবে। আর ওখানকার মেঝের টাইল্ তুলে ও টয়লেটের টাইল্ তুলে কমন্ জলের লাইন ক'রতে হবে ইনলেট্ ও আউটলেটের জন্য। এই হলঘরের লম্বালম্বি মাঝ-বরাবর একটা পাঁচ ফুট্ হাইটের ডিভাইডার দিয়ে দিলেই ভালো হয়। ওই ডিভাইডারটা কোনো দেয়ালকেই স্পর্শ ক'রবে না। ফলে উভয় দিক থেকেই হলের যে কোনো জায়গায় যাওয়া সম্ভব। আর ডিভাইডার দেয়ালের ওপর দেয়ালের দুই পারেই পরপর ওয়াল হ্যাংগিং ইউরিনাল্ লাগিয়ে দিতে হবে পাবলিক শৌচালয়ের মতো। ব্যস্। খেল্ খতম্। কিন্তু এ কাজ যে মিস্ত্রীকে দিয়ে করাবে, সে তো সারা বিশ্বে এ খবর ছড়িয়ে দেবে! বেডরুমের ভিতর টয়লেট্! কেলেঙ্কারি হ'য়ে যাবে!

যাই হোক, সে মিস্ত্রীর মুখ বন্ধ করিয়েই শেষ পর্যন্ত সব কাজ সুসম্পন্ন হলো। এদিকে বাড়িতে বাবা বা মা-কে কিছুই জানায় নি এতো সবের খবর। বাবা-মাকে বলা যায় এসব? হস্তমৈথুনের জন্য হলঘর! জানলেই বাড়িছাড়া ক'রবে। অবশ্য একদিন তো জানবেই। তখনই দেখা যাবে।

ওর তো ক্যানিং-এ স্কুল। তাই প্রসূন যেহেতু ফ্রি আছে, ওকেই এসবের তদারকির দায়িত্ব দিলো রিয়ান। কুইকার্-এ একটা অ্যাড্ দিয়ে দিলো — মাস্টারবেসন হাব্। সঙ্গে রিয়ান ও প্রসূনের অল্টারনেটিভ্ মোবাইল নম্বর।

তিন দিন পর চারজন ছেলে এসে খোঁজখবর নিয়ে গেলো। এর মধ্যে প্রসূন একটা গিফ্টের আয়োজনও ক'রে ফেললো। এন্ট্রি ফি — পাঁচ টাকা। দেয়ালে দেয়ালে ডিসপ্লে করে রাখা আছে হস্তমৈথুনের উপকারিতা, অপকারিতা এবং গাইডলাইন্স। লিঙ্গ ইরেক্ট্ করার জন্য বেশ কিছু স্টিল্ নেকড্ মেয়ের ছবি রাখা হ'লো। সবাই বেশি সময় নিয়েই বীর্য ফেলতে চাইবে। তাই যে সবচেয়ে কম সময় নিয়ে বীর্যপাত ক'রে কাউন্টারে আসবে, সবার রেকর্ড রাখা হবে এবং সপ্তাহের সেরা প্রথম তিনজনকে পুরস্কৃত করা হবে।

ধীরে ধীরে লোক সমাগম হ'তে শুরু হ'য়ে গেছে। যারা আসছে তারা সবাই খুশি এ রকম একটা জায়গা পাওয়ায়। সবাই ফিডব্যাক্ ফর্মে এই হাবের আরো উন্নয়নের জন্যও বিভিন্ন দিক তু'লে ধ'রছে। কেউ কেউ এজন্য ডোনেশন দিতেও রাজি আছে। কিন্তু এ সবের মাঝেই হঠাৎ একদিন একদল পুলিশ এসে হাজির। ধরপাকড় শুরু হ'য়ে গেল।



******
Subhankar Paul,
7/149, Mukundapur,
Mukundapur Sub-Post-Office,
P.S.- Purba Jadavpur,
Kolkata – 700099.
(Mobile) – 8420020161
(E-Mail) – spsubhankarpaul@gmail.com

জুই দাশগুপ্ত



ছোট গল্প



শেষ রাত্রি

নিউ টাউনের কাছে দু কামরার এই ফ্ল্যাটে আজই প্রথম দিন কৃতিকার। অফিসের কাছাকাছি বাড়িটা হওয়ায় সাত পাঁচ কিছু না ভেবেই বাড়িটি ভাড়া নিতে রাজি হয়ে যায় সে। আজ সারাটা দিন বাড়ি গোছাতে লেগে যাবে বলে অফিস থেকে একদিনের ছুটি চেয়ে নিয়েছে সে। গৃহপ্রবেশের জন্যে একটা ছোট্ট পুজোর আয়োজন । পুজো ছোট হলে কি হবে আয়োজন সারতে সারতে অনেক বেলা হয়ে গেল, এতক্ষণ সে খেয়ালই করেনি যে  ঠাকুরমশাই, যাকে কাল সে বলে এসেছিল পুজোর কথা তিনি এখনো এসে পৌঁছাননি। এদিকে অতিথিরা একে-একে আসতে শুরু করেছেন, আর অপেক্ষা করা উচিত হবেনা ভেবে নিজেই পুরোহিতের গৃহের উদ্দেশ্যে রওনা হয় কৃতিকা, পুরোহিতের বাড়ি পৌঁছে জানতে পারে তিনি গত রাত থেকেই আশ্চর্যজনক ভাবে নিখোঁজ। তার বাড়ির লোকজন এমনকি প্রতিবেশীরাও কোনো খোঁজ দিতে পারলেন না। হতাশ হয়ে সেখানের থেকে ফিরে আসতে হয় কৃতিকাকে, অদ্ভুত ভাবে আর কোনো পুরোহিতই তার বাড়ি যেতে সম্মত হচ্ছিলেন না।অবশেষে একজনকে কে বেশি দক্ষিণার লোভ দিয়ে রাজি করিয়ে তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে কৃতিকা, পূজো শুরু হয়, দরজার কাছে মঙ্গল ঘট রেখে আসে কৃতিকা, এরপর পূজো শেষ হলে একে একে সকলে বাড়ি চলে যেতে থাকে। পুরোহিত মহাশয় ও নিজের প্রাপ্য বুঝে নিয়ে প্রস্থান করলেন।শুধু কৃতিকার এক বান্ধবী নীরা থেকে যায় কৃতিকার সাথে, দুজনে মিলে খাওয়া দাওয়া সারতে সারতে বেশ রাত হয়ে গেল। এত রাতে নীরার একা বাড়ি ফেরা নিরাপদ হবেনা বলে কৃতিকাই তাকে নিজের গাড়িতে বাড়ি ছেড়ে আসার প্রস্তাব দেয়। নীরা তাতে রাজি হয়ে দরজার কাছে গিয়ে, হঠাত্ই তার চোখে পড়ে বাড়ির বাইরে নেইম প্লেট এ লেখা নামটায় ,সে কৃতিকাকে ডেকে নামটা দেখায়, কৃতিকাও বেশ অবাক হল এই ঘটনায়, কারন তার স্পষ্ট মনে আছে আজ সকালেই এখানে নিজের নামের নেইম প্লেট লাগিয়ে ছিল সে। নীরা বললো "সারা দিনের ব্যস্ততার কারনে হয়তো নেইম প্লেট পাল্টাতে ভুলে গিয়েছো"। কথাটা মন থেকে কিছুতেই মানতে পারলো না কৃতিকা। তার খুব ভালো করেই মনে আছে সবকিছু, কিন্তু সেই মুহূর্তে কথা বাড়ানো টা ঠিক হবে না তাই, 'হয়ত'  বলে পা বাড়ালো গাড়ির দিকে, নীরা অনুসরণ করলো তাকে। নীরাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে একাই বাড়ি ফিরছিল কৃতিকা, ফাঁকা রাস্তা পেয়ে গাড়ির গতি বেশ দ্রুতই রেখেছিল সে, আচমকা বৃষ্টি শুরু হল, ধীরে ধীরে গতি বাড়তে থাকল, সাথেই আরম্ভ হল ঝড়, সম্ভবত কালবৈশাখী। গাড়ির সামনের কাচ বেশ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল, কিছুই দেখা যাচ্ছিল না, গাড়ির গতি কমানোর চেষ্টা করেও কোনো লাভ হলো না, সামনে কোনো এক বস্তুকে সজোরে ধাক্কা মেরে গাড়িটা, থেমে গেল কৃতিকা দ্রুত গাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলো, কিন্তু সামনে কিছুই দেখতে পেল না। তবে কিসের সাথে ধাক্কা লাগলো গাড়ির? রাস্তায় মানুষ জন তো দূরের কথা একটা গাছ অবধি নেই ,শুধুই লম্বা ফাঁকা রাস্তা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ  তখন হঠাত্ই থেমে গেল, গাড়িতে ফিরে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল, কিছুতেই আর স্টার্ট হলো না গাড়ি। নেমে গেল যদি কোনো সাহায্য পাওয়া যায়। কিন্তু সেখানে জনবসতি আছে বলে তো মনে হলো না, আর কে আসবে তাহলে এখানে এত রাতে? এতসব চিন্তা করছিল তখনই বাইক নিয়ে এক যুবক কে তার দিকে আসতে দেখে কৃতিকা হাত দেখাল, বাইকটা তার কাছে এসে থেমে গেল  কৃতিকা এগিয়ে গিয়ে সাহায্য চাইলো, সেই যুবক ও সম্মত হলো তাকে বাড়ি পৌছে দিতে, নাম জানতে চাওয়াতে যুবকটি তার পরিচয় দিয়ে বললো তার নাম শুভায়ু। পরিচয় পর্ব সমাপ্তির পর তারা যাত্রা শুরু করলো। এতক্ষণে কৃতিকা লক্ষ্য করলো এই কিছুক্ষণ আগের বৃষ্টিতে সে নিজে পুরো ভিজে গিয়েছে অথচ যুবকটির পোশাকে সেই চিহ্ন সামান্যতম ও নেই। এও কি সম্ভব? কৃতিকার বাড়ির সামনে বাইক থামতেই শুভায়ু চলে গেল, ধন্যবাদ টুকু বলার সময় অবধি দিল না। কৃতিকার অবাক হওয়ার পালা তো সবে শুরু হয়েছিল, কারন তখনই ওর খেয়াল হলো নিজের বাড়ির ঠিকানা সে বলেইনি ওই অচেনা যুবককে, বাড়ির গেটের বাইরে সেই নেম প্লেট টা চোখে পড়লো, খুলে নিয়ে নামটা পড়ার চেষ্টা করলো, সম্ভবত খুব পুরোনো হওয়ার কারনে নামটি একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কিছুই পড়তে পারলো না। দরজা খুলতে গিয়ে মাটিতে পায়ের কাছে একটা কিছু অনুভব করতে পারলো। তুলে নিয়ে দেখলো তার নেম প্লেট টা, কিন্তু একি! এতো রক্ত লেগে, তাজা রক্ত তখনো জমাট বাধেনি। দুটো নেম প্লেট ই একসাথে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল সে। সকালের সেই মঙ্গলঘট তখন দরজার কাছে উল্টে পড়ে রয়েছে। কৃতিকা ঘরে যেতেই দরজা টা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেল। ঘরে ঢুকতেই সে টের পেল এক মিষ্টি সুগন্ধে ভরে রয়েছে ঘরটা, খানিকটা আতরের মত গন্ধ, কিছুক্ষণ আগের সেই যুবক, তার কাছেও এরকম সুগন্ধি অনুভব করেছিল, মনে পড়ে কৃতিকার। হঠাত্ই অজানা কোনো আশঙ্কা চেপে ধরে তাঁকে। অন্ধকার ঘরে  দেওয়াল হাতড়ে খুঁজতে থাকল সুইচবোর্ড । সুইচবোর্ড খুঁজে পেতেই লাইট জ্বালানোর চেষ্টা করতেই সুইচবোর্ডের উপর অন্য একটি হাতের ঠান্ডা স্পর্শ অনুভব করল সে।ভয়ে হাত পা অবশ হয়ে আসছিল তার, কোনো মতে নিজেকে সামলে নিয়ে দরজার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলো সে, কিন্তু কই দরজা? এখানেই তো থাকার কথা। দেওয়াল হাতড়ে দরজা খুঁজে যেতে থাকলো সে, কিন্তু পেল না, চারিদিকে যেন শুধুই ইটের দেওয়াল।মরিয়া হয়ে ছুটে পালাতে চাইলো সে, কিন্তু কিসে যেন ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল , ঘুটঘুটে অন্ধকার চারিদিকে, কিছুই চোখে পড়ে না। এদিক ওদিক হাতড়ে বোঝার চেষ্টা করছিল, তখনই একটা ঠান্ডা হাত তার হাত টাকে শক্ত করে ধরে ফেললো। প্রাণপণে চেষ্টা করছিল কৃতিকা নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার, কিন্তু কোন লাভ হল না ।

অদৃশ্য সেই হাতে অসম্ভব জোর তার

হাত ক্রমশ অবশ হয়ে আসছিল, তারপর চেতনা হারালো সে।ক্রমাগত কাঁচে ঠক ঠক করার মতো শব্দে চোখ মেলে তাকায় কৃতিকা, আশ্চর্য হয়ে দেখলো নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে সে, কিভাবে এখানে এলো ভাবতে ভাবতে চোখ গেল ঘরের জানালার দিকে, সব কটি জানালাই কাঠের, তবে সেই শব্দ কিসের ছিল? আবার সেই কাঁচে ঠক ঠক করার শব্দ পেল সে, শব্দটা অনুসরণ করতেই তাঁর সমস্ত শরীর হিম হয়ে এলো,  শব্দটা আসছিল ঘরের আয়না থেকে। আয়নার দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সে, আয়নার কাছে পৌঁছাতেই সেখানে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল , শব্দটা তখন ধীরে ধীরে কমছে। ফিরে আসছিল তখনই একটা শব্দে আবার থমকে দাঁড়ালো কৃতিকা, কেউ যেন ডাকছে। কাছে গিয়ে দেখলো ওর নিজের প্রতিবিম্বই ওকে ডাকছে, কিছু বলতে চাইছে। এগিয়ে গিয়ে আয়নায় হাত রাখতেই প্রচন্ড শব্দে তা ভেঙে গিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো কাঁচের টুকরো। ভয়ে আর্তচিৎকার করে উঠলো সে। কৃতিকা নিজের খুব কাছে সেই সুগন্ধির উপস্থিতি টের পাচ্ছিল। গন্ধটা যেন ক্রমে আরও কাছে আসছিল তার, এরপর একটা ঠান্ডা নিশ্বাস অনুভব করলো নিজের কাঁধের উপর।..পরদিন সকালে নীরা আসে কৃতিকার বাড়ি, একসাথে অফিস যাবে বলে, অনেক ডাকাডাকির পরও কোনো সাড়া না পাওয়ায় লোক জড়ো করে নীরা, দরজা ভাঙ্গা হয়, বাড়ির ভিতর বিছানার উপর পড়েছিল কৃতিকার নিথর দেহটি।দরজার বাইরে নেম প্লেটে তখন উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে একটা নাম "শুভায়ু ব্যানার্জি"।

(শেষ)

জুঁই দাশগুপ্ত

মৈনাক চক্রবর্ত্তী



ছোট গল্প



বসন্তের পলাশ
                   
               বাড়ির পলাশ গাছটা বেশ বড় হয়েছে, এবার বোধয় ফুল ফুটবে গাছে। গাছটা আজকের নয়, তা প্রায় বছর দশেক হল, গাছটা বুবু পুতে ছিলো। বুবু আমার পিসততো বোন। বুবু এখন আর আমাদের সাথে থাকেনা। বুবু তখন কলেজে পড়ত, দ্বিতীয় বর্ষ। কলেজে এডুকেশনাল এক্সকার্সনে বুবুদের পুরুলিয়া নিয়ে গেছিল সেবার। সেখান থেকেই ও গাছটা নিয়ে আসে। দিনটা এখনও মনে পড়ে, কী একটা পূজো ছিলো বড়িাতে, বুবু দৌড়ে আমার ঘরে ঢুকে
-দেখ দাভাই তোর জন্য কী এনেছি...
-কী আনলি? কই দেখা?
-কী বলত এটা?
-পলাশ.....,কোথায় পেলি এটা?
-পুরুলিয়া থেকে এনেছি, একজন দিয়ে বলল খুব কাছের কাউকে দিতে।
-ও কাছের কেউ আমি নাকি ....
-তুইতো আমার সোনা দাভাই। তোর জন্যই এটা।
-ন্যাকামো করিস না।  আমি সব জানি, ট্রুরে যাবার আগে কার সাথে হেসে হেসে ঘুরছিলিস সেদিন? আমি দেখিনি ভাবছিস।
-আরে ও নীলান্তন। খুব ভালো ছেলে, আমার খুব ভালো বন্ধু।  আমার সাথে এক কলেজে পড়ে।
-তাইনা রে। তুই ও তো ভালো মেয়ে; একদিন পরিচয় করা।
-তুই পারিস ও দাভাই, ওর একটা প্রেমিকা আছে। তার জন্যই একটা কানের দুল কিনতে গেছিলাম আজ
-যা কি হবে তালে....
-কিসের আবার কি হবে?
-আমি ভাবলাম হেব্বি একটা ব্যাপার চলছে তোদের মধ্যে। সব ভেসতে দিলি....
-শোন দাভাই আমার পিছনে লাগলে আমিও কিন্তু তোর সব কথা বলে দেবো....
-কী আর বলবি?
-তাইনা। কি বলব শুনবি? সৃজিতা নামে একটি মেয়ে আছে। যাকে আমি দিদি বলে ডাকি। তার সাথে আমার এক মাত্র দাভাই গভীর প্রণয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। এটা মামি কে বলে আসি যাই। মামি.... ও মামি....
-এই বুবু কি করছিস দাড়া দাড়া, আচ্ছা আমি আর বলবো না। এই কান মুলছি, নাক মুলছি দাড়া...
-হাহাহাহা কানমোল ভালো করে তাহলে বলবোনা।  
-তবেরে দাড়া দেখাচ্ছি তোকে........
           বুবু এক দৌড়ে পালিয়ে গেল। সৃজিতা আমার বান্ধবী, বুবুর থেকে বছর ছয়েকের বড়, ওকে পড়াতে আসত, সেই সূত্রে আমার সাথে পরিচয়। সৃজিতা যে শুধু আমার বান্ধবী তা বললে ভুল হবে। আমার আর সৃজিতার সম্পর্কটা তেমন কেউ জানেনা, এক মাত্র জানে বুবু। দিনকতক হলো ও এতো শয়তান হয়েছে সুযোগ পেলেই আমাকে আর সৃজিতাকে নিয়ে ইয়ার্কী করবে। দুর্ভাগ্যের বসে ও যে কার সাথে প্রেম করে বা কার সাথে ওর মনের টানাপোড়েন শুরু হয়েছে সেটা জানিনা। সেটা যদি জানতে পারতাম, তাহলে প্রতিদিনের ইয়ার্কীর মধ্যে নিজেকে অসহায় মন হতো না।
            বুবু প্রেম করে কি করেনা তা স্পষ্ট জানা নেই। তবে কারোর প্রতি মনে একটা টানাপোড়েন আছে সেটা বিলক্ষন খেয়াল করি। ওর বয়স এখন কুড়ি, ওর বয়সে জীবন প্রেম আসাটা অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু ছেলেটা কে সেটা বুঝে উঠতে পারিনা। বুবু আমার থেকে বছর আটের ছোট, তবুও ওর উপস্থিত বুদ্ধি প্রচুর, ওর বুদ্ধির কাছে এখনও আমাকে মাঝে মাঝে নাস্তানাবুদ হতে হয়। অসলে একটা প্রেমের গল্প শুনতে ভালো লাগে। কার না একটা প্রেমিক প্রেমিকার খুনশুটি দেখতে ভালো লাগেনা। আর সেই তাগিদেই ওর প্রেমিকের অস্তিত্বের সন্ধান করা। এই নিয়ে আমাদের জীবন ভালোই চলে যাচ্ছে। আমরা পিঠপিঠী ভাইবোন না, কিন্তু তাতে আমাদের ইয়ার্কীর কোন ভাটা পড়ত না। সৃজিতা আর আমার সম্পর্কের সূচনায় ছিলো বুবু। আমাদের যখন ঝগড়া হয় তখন সেই ঝগড়া মিটিয়ে মিলমিশ করায় বুবু। আসলে বুবু সৃজিতাকে ভীষণ ভালোবাসে, ভীষণ ভাবে চায় আমার আর সৃজিতার সম্পর্কটা এগিয়ে চলুক। বুবুর মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি আছে, ও মানুষকে সুখী হতে দেখলে এক অকৃত্তিম আনন্দে ওর মনটা নেচে উঠত।
         বেশ কিছু দিন হলো বুবুর দেখা নেই। কী যে করছে বাড়িতে বসে বসে কে জানে। ওকে ফোন করলাম। ফোনটা দু-তিনবার ধরে বেজে গেলো, কেউ ধরলো না। ফলে ওকে একটা মেসেজ পাঠালাম
-তোর দেওয়া চারাটা পুঁতেছিলাম, মন হয় গাছটা বেঁচে গেছে। এসে দেখে যাস গাছটাকে।
সন্ধ্যে হয়ে এলো।  এখনও বুবুর কোন উত্তর পেলামনা। অনেক দিন ধরেই কেমন যেন রহস্যময় হয়ে পড়েছে বুবু। প্রেমে পড়েছে বোধয়, এবার দেখা হোক একবার যেভাবেই হোক জানতে হবে কী ব্যাপার। এত দিন খুব ইয়ার্কী মেরছে এবার আমার পালা।
বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল বুবুর ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারিনা। ব্যাপারটা এবার একটু সিরিয়াস মনে হচ্ছে, একদিন বুবুর সাথে দেখা করতে হবে। দিন দুয়েক পরে বিকেলের দিকে ঠিক করলাম বুবুর বাড়ি যাই। এই ভেবে সবে বাড়ি থেকে বের হয়েছি হঠাৎ দেখি বুবু, আমাদের বাড়ির দিকেই আসছে। আমি অনেকক্ষন বুবুর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলাম। এটা কী বুবু নাকি অন্য কেউ, ফুলের মতো মেয়েটার এ কী অবস্থা হয়েছে; চোখে কালসিটে, মুখ শুকিয়ে গেছে, দেখে মনে হচ্ছে অনেক দিন ধরে ঘুমোয়নি। বুবু তখন ও বাড়ির কাছে আসেনি তখনই আমি উদগ্রীব হয়ে বলে উঠলাম ...
-কিরে বুবু কি হয়েছে তোর? চোখ মুখের এ কি হাল করেছিস?
বুবু কোন উত্তর দিলনা। এতটাই অন্যমনস্ক ভাবে হেটে আসছিলো আমার কথাটা শুনতে পেল কিনা বুঝতে পারলাম না। আমি আর বুবু এক সাথেই বড় হয়েছি; খাওয়া-নাওয়া-ঘোড়া সব ক্ষেত্রেই বুবু আর আমি ছিলাম চির সঙ্গী, ওর প্রতি একটা অসীম স্নেহ কাজ করত আমার। যে মেয়েটা সবার মুখে হাসি ফোটায় তার এই অবস্থা দেখে নিজেকে খুব অসহায় লাগল। বুবু কাছে আসতেই বুবুর হাতটা বেশ জোড়ে নাড়া দিয়ে, বেশ ধমক দিয়েই বললাম...
-কিরে কি হয়েছে? নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিস নাকি?
ওর চোখটা ছলছল করছে আমি বুঝলাম সিরিয়াস কিছু, ওর হাতটা ধরে বললাম
-আয় ঘরে আয়....
ঘরে ঢোকার মুখে ছোট্ট এক টুকরো বাগান আছে, সেখানেই পালাশের চারাটা পুঁতেছিলাম। ঘরে ঢুকতে গিয়ে বুবু অনেক্ষন গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে আমি বলে উঠলাম
-দেখ তোর দেওয়া গাছটা, বেঁচে গেছে, ছোট ছোট দুটো নতুন পাতা গজিয়েছে দেখ।  
-হম, যে বেঁচে উঠতে চায় তাকে কী আটকানো যায়....
-মান টা কী? কে আবার বেঁচে উঠল....
-না কেউ না।
কথাটা বলেই বুবু ঘরের দিকে হাটতে হাটতে চলে গেল। আমার ঘরটাতে ঢুকে, আমার বিছানার একটা ধারে বসল বুবু। হতাশা আর অন্য মনস্কতায় মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে আছে। আমি ওর কাছে এসে বললাম
-বলত এবার কি হয়েছে তোর? কিরে চুপ কেন, কি হয়েছে?
-হ্যাঁ দাভাই বল কি বলছিস?
-এই কি হয়েছে রে তোর? তখন থেকে দেখছি অন্যমনস্ক।
-আমিই কেন বলত সব সময় ভুল করি দাভাই, সবাইকে ভালো রাখতে চাই সবাইকে খুশি রাখতে চাই তবুও আমার হাতেই অন্যকেউ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কেন আমার সাথেই এমনটা ঘটে সব সময়। কেন এমন অবস্থার সম্মুখীন হই আমি যার নিয়ত্রন আমার জানা নেই।
এতক্ষন পর বুবুর মনের মেঘ গুলো যেন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়ল। আমি এবারে বেশ কিছুটা ভয় পেলাম, কিন্তু বুবুকে বুঝতে দিলাম না। শুধু বললাম
-কেনরে কি করলি তুই আবার? বাড়িতে কিছু হয়েছে? নাকি কলেজের ঝামেলা।
-এই ঝামেলা অনেক দিনের, তোকে বলা হয়ে ওঠেনি। মনের মধ্যে পুষে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম ঠিক নিজেকে সামলাতে পারবো কিন্তু পারছি নারে। তোর নীলান্তনকে মনে পড়ে?
-নীলান্তন...নীলান্তন...হ্যাঁ মনে পড়েছে। ঐতো সেই ছেলেটা যার সাথে তোকে দেখেছিলাম। হম মনে পড়েছে ওর একটা প্রেমিকা আছেনা..
বুবুর দু চোখ বেয়ে অনবরত জল ঝড়ে পড়ছে। দু হাত দিয়ে চোখের জল মুছে বুবু বলে উঠল,
-হ্যাঁ, আছে, সেই নীলান্তন।
-কেনরে? কি করল সে?
-ঘটনাটা অনেক দিনের, এবার কলেজের এক্সকার্সনে পুরুলিয়া গেলাম মনে পড়ে।
-হ্যাঁ, ওখান থেকেই তো গাছটা এনে দিলি।
বুবু গাছের কথাটা এরিয়ে গিয়ে বলল-
-ওখানে কখনো গেছিস দাভাই।
-না, কেন?
-ওখানের বাতাসে একটা অনৈতিক মাদকতা আছে জানিস। কেমন একটা মতাল করা গন্ধে, মন অনৈতিক আবদারে সারা দয়ে। মন যেন কীসের এক প্রহর গোনে।
-তা সেখানে তোর মন কোন অনৈতিক আবদারে সারা দিলো?
-জানিস দাভাই চাইনি এটা হোক। একটা মেয়েকে ঠকাতে মন সায় দেয়নি।
-মানে? কী বলছিস? কেন মেয়ের কী করলি তুই?
-নীলান্তরের প্রেমিকার কথা বলছি।
-কেন কি হলো ওর? আর তাতে তোর সম্পর্ক কি?
বুবুর মুখটা কেমন শুখনো হয়ে উঠল, মনে হলো সারাটা আকাশ ওর মুখে ভেঙে পড়েছে। নাক টানতে টানতে আবারও বলতে শুরু করল বুবু
-বললাম না ঐ জায়গায় মনটা মাতালের মতো হয়ে পড়ে। কোন স্বাভাবিক জ্ঞান থাকেনা। চারাদিকে শাল মহুয়া আর পলাশের বন। জানিস দাভাই বনটার একটা গন্ধ ছিলো, শাল মহুয়ার গন্ধ। সেই গন্ধে সব ইন্দ্রিয় গুলো প্রখর হয়ে ওঠে। নিজেকে আর আটকাতে পারিনিরে আর তাই নীলান্তনকেও আর বাধা দিতে পারিনি।
-মানে? মানেটা কী? কী বাধা দিতে পারিসনি...
-সেদিন কেন জানিনা ভুলে গেলাম নীলান্তনের অন্যকারোর প্রতি দায়বদ্ধতা আছে।
-শোন বুবু আমার মাথায় কিছু ঢুকছেনা, সোজা কথায় বলবি কি হয়েছে....
-দাভাই তুই আমায় ভুল বুঝবিনাতো। তুই পাশে থাকবিতো আমার।
বুঝলাম প্রচন্ড কোন আঘাত পেয়ে একটা হতাশায় ভুগছে। ওকে ভরসা দেবার জন্য বলে উঠলাম
-আমি আছি, বল কী হয়েছে..
কাঁদতে কাঁদতে বুবু যা বলল-
-একটা পুরুষ আর নারী ঠিক যতটা কাছাকাছি আসতে পারে ঠিক ততটা কাছে এসেছিলাম আমরা। আমি আর নীলান্তন।
-মানে.....কী যা তা বলছিস? তুই জ্ঞানে আছিসতো। মাথা ঠিক আছেতো তোর।
-হ্যারে দা ভাই, জ্ঞানেই আছি। কেন জানিনি সেদিন এমন হলো, তীব্র সর্বনাসের মুহুর্ত ছিলো সেদিন। পঞ্চভূত যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছিলো। চারিদিকে বন আর বন মাঝ খানে আমি আর নীলান্তন, দিনের বেলাতও সেখানে ঝিঁঝিঁ ডাকছিলো। জানিনা কী করে এত কিছু করে বসলাম...
-ওর প্রেমিকা জানে কিছু?
-সেখানেই তো সমস্যা আরো বেড়েছে। নীলান্তন একটা তীব্র অপরাধ বোধে কিছু বলতে পারছে না, সেই এক আবস্থা আমারও। কী বলবে ও মেয়ে টাকে। আর সবে জেনে মেয়েটাইবা ওকে কেন মেনে নেবে।
-দেখ বুবু শান্ত হয়ে আমার কথাটা একটু শোন।
-পারছি নারে দাভাই। নিজের দিকে তাকাতেও ঘেন্না লাগছে। ইচ্ছা করছিলো মরে যাই কিন্তু পারিনি। ভেবেছি তুই বুঝবি আমার মনের আবস্থা। তোর একটা কথা খুব কানে বাজে রে 'মরে গিয়ে কোন লাভ নেই, এই সমাজ তোমার মৃত্যুতে তোমার উপর ফুল ছেটাবে কিন্তু দুদিন পর আবার সব আগের মত হয়ে যাবে'
-কি চাইছিস তুই? তুই কি নীলান্তনকে নিয়ে বাঁচতে চাইছিস...
-তোকে মিথ্যা বলবনা দা ভাই, প্রথম দিকটায় যে তা চাইনি সেটি নয়। তবে পরে অনেক ভাবলাম ঐ মেয়েটিকে কাঁদিয়ে আমি কখনো সুখী হবো নারে দাভাই।
-শোন বুবু তুই যদি মনে করিস এই কথা গুলো জানলে ওর প্রেমিকা কষ্ট পাবে, ওদের সম্পকর্টা ভেঙে যাবে তবে এই স্মৃতি ভুলে যা। অন্যায় করেছিস ঠিকই, তুইও এবং নীলান্তনও, কিন্তু যে ভুল ব্যক্ত হলে তিনটে জীবন নষ্ট হবে তার থেকে সেই ভুল মনে না করাই ভালো। শোন বুবু আমাদের শরীর যন্ত্র নয়। মাথা আর মন দুটো এক সাথে চলেনা। তাই মাথা হয়ত ভুলে সারা দেয়নি কিন্তু মন দিয়েছে। ভুলে যা বুবু...
-কিন্তু দাভাই ভুলতো বেড়েই চলছে...
- কেন আবার কি?
-আমি এখন না পারছি নীলান্তনকে ভুলতে না পারছি ওর কথা ভাবতে। যখন সেই দিনের কথা মনে পড়ছে তখনই ওর প্রেমিকার মুখটা মনে পড়ছে। আবার নীলান্তন যখন ওর প্রেমিকার সাথে দেখা করছে বা সময় কাটাচ্ছে আমি অসম্ভব ঈর্শায় ভুগছি। মনের ভেতরটা কেমন উথাল পাতাল খাচ্ছে...
-দেখ বুবু বাস্তবে ফিরে আয়। কী সব বলছিস পাগলের মতো। তুই শ্রেফ যৌনঈর্শাতে ভুগছিস বুবু। ভুলতো তুই একা করিসনি, ও নিজেও এই ভুলের অংশীদার। তোর জীবের সম্পূর্ণটা পড়ে আছে, কত রঙীন স্বপ্ন দেখবি তুই, কেন এত উল্টোপাল্টা ভাবছিস। শোন বুবু সময় এক মুল্যবান বন্ধু, একটু অপেক্ষা কর সময় সব ঠিক করে দেবে।
-ঠিক কিছুই হবেনা দাভাই...
-সব ঠিক হবে। আমি বলছি, আমাকে ভরসা করিসতো নাকি, আমার উপর একটু ভরসা রাখ।
বুবু খুব ফর্সা কাঁদতে কাঁদতে ওর নাকটা লাল হয়ে গেছে। আবারও কাঁদো গলায় বলল-
-জানিস দাভাই খুব চাইতাম একটা ভালো ছেলো আমাকে প্রপোজ করুক। তার সাথে জমিয়ে প্রেম করব। কিন্তু দেখ প্রেম যেদিন এলো সেদিনই চলে গেল...
-সৃজিতা জানে কিছু..
বুবু বলল-
-না।
-আমি জানাব কিছু..
বুবু কোন উত্তর দিলোনা। দুই হাত দিয়ে চোখটা ডলতে লাগল। আমি এই মুহুর্তে সৃজিতার উপস্থিতি খুব প্রয়োজন মনে করলাম। বুবুর এখন যা অবস্থা তাতে ওর মানষিক বলের প্রয়োজন। তার জন্য একটা মেয়ের উপস্থিতি প্রয়োজন। ফোনটা হাতে নিয়ে সৃজিতাকে ফোন করলাম। বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হলোনা, কয়েকবার রিং হবার পরেই ফোন ধরল সৃজিতা। ওকে সংক্ষেপে যতটা বলা যায় বললাম, সৃজিতা আসবে বলাতে ফোন কেটে দিলাম। আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয় কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল
-ঐ পলাশ গাছটা ও দিয়েছিলো জানিস....
-শোন বুবু আমার মনে হয় এই মুহুর্তে ওর সব চিহ্ন মুছে ফেলা প্রয়োজন। নইলে এই এক চিন্তা তোকে তারা করে বেড়াবে।
-তুই আর সৃজিতা দি কখনও ঘনিষ্ট মুহুর্ত কাটিয়েছিস?
আমি বেশ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। আমার উত্তরের প্রতীক্ষা না করেই ও বলে উঠল
-তাহলে কখনও ভুলতে পারবিনা। পলাশ যেমন প্রকৃতিকে বসন্তের সাজে সাজায় তোমনি দেখ এই পলাশ আমার সব বসন্ত কেড়ে নিলো
-আমি যদি আগে জানতাম বুবু কোন দিন এই গাছটা পুঁততাম না। ফেলে দিতাম। আমি আজই গাছটা ফেলে দেবো।
-না দাভাই আমাকে ছুঁয়ে কথা দে তুই এটা করবিনা। আমাদের সম্পর্কের প্রথম চিহ্ন ও। ওকে নষ্ট করবিনা তুই।
-কিন্তু বুবু এতে তোর কষ্ট বাড়বে বই কমবে না...
-না দা ভাই এই গাছটা যদি থাকে তালে আমিও ভালো থাকবো...
বুবুর মানসিক অবস্থা খুব খারাপ, সৃজিতা এখনো এলনা, ও আসলে বুবু একটু বল পেত..ওর মানষিক অবস্থা বুঝে  বললাম-
-আচ্ছা কথা দিলাম গাছটার কোন ক্ষতি হতে দেবোনা।  
এর মধ্যেই সৃজিতা ঘরে ঢুকলো,
-কি হয়েছে,
-আয় ঘরে আয় বস এখানে..
এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে বুবু। সৃজিতা ওর পাশে বসল, সমস্থটা আমার মুখ থেকে শোনার পর বুবুকে অনেক বোঝাল। সৃজিতার মধ্যে একটা পরিনত সত্তা আছে যা এতদিন চোখে পড়েনি আমার, ও বুবুকে বুকে জাপটে ধরে, চোখের ইশারায় আমাকে শান্ত হতে বলল, আমার উৎকন্ঠা যাতে কিছুটা দুর হয়। উৎকন্ঠা দুর হয়নি তবে সৃজিতা আসাতে বেশ নিশ্চিন্ত হয়েছি। অনেকক্ষন পর বুবু জড়ানো গলায় বলে উঠল
-দাভাই যেদিন পলাশ গাছটায় ফুলফুটবে সেদিন ভাববি আমার নীলান্তন আবার আমার কাছে ফিরে আসবে।
সঙ্গে সঙ্গে সৃজিতা বলে উঠল-
-এখন এসব থাক। চলো বুবু তোমাকে বাড়ি পৌছে আমিও বাড়ি যাই। রাত হচ্ছে চলো..
তারপর অনেকটা সময় কেটে গেছে, বুবু এখন ব্যাঙ্গালুরুতে থাকে, এখনো বিয়ে করেনি। এখনো নীলান্তনের স্বপ্নে ডুবে থাকে। এখনো ভাবে ও ফিরে আসবে। আমার আর সৃজিতার বিয়ে হয়ে গেছে। বুবুর সাথে কথা হয় রোজ, টেলিফোনে। নীলান্তনের কোন খোজ নেই। জানিনা কোথায় আছে; হয়ত বুবুও ওর খবর কিছু জানে না..
          এত বছর হয়ে গেল পলাশ গাছটা অনেক বড় হয়েছে, কিন্তু এক কাকতালীয় ব্যপার গাছটায় ফুল ফোটেনি এখনো। প্রতি শীতের শেষে যখন সব পাতা পড়ে যায় তখন ভাবি এবার হয়ত ফুল ফুটবে গাছে, বুবু হয়ত দৌড়ে এসে বলবে; 'দেখেছিস দাভাই, আমি বলেছিলাম না ও আসবে'। কিন্তু ফুল ফোটেনি কোন বসন্তে। গাছটার বসন্ত যেমন চুরি হয়ে গেছে, তেমনি আমার বুবুর বসন্তও চুরি হয়ে গেছে। কবে ফিরবে বসন্ত বুবুর জীবনে। আবারও এক অধীর প্রতীক্ষা আরো এক বসন্তের। এখন শুধু কিছু মুহুর্তের অপেক্ষা বুবুর জীবনের চুরি হওয়া বসন্ত ফিরিয়ে দেয় কিনা এই পলাশ গাছটা। শুধু প্রতীক্ষা, সেই প্রতীক্ষায় সারাটা দিন গাছটার দিকে চেয়ে থাকি কবে আসবে সেই বসন্ত।

মৈনাক চক্রবর্ত্তী

( গণিত স্নাতকোত্তর বিভাগের ছাত্র, দমদম মতিঝিল কলেজ, পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়)
ঠিকানা: ১৯১|৪ অশোকনগর, পোষ্ট অশোকনগর, থানা অশোকনগর, উত্তর চব্বিশ পরগনা, পিন:৭৪৩২২২