ছোটগল্প
অন্ধকূপ
শান্তিপুর। পুরুলিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রাম।জায়গাটা ভারি অদ্ভুত। এই গ্লোবালাইজেশনের যুগেও বিন্দু মাত্র বদলায় নি।প্রকৃতি যেন নিজ্ব বক্ষে আঁকড়ে রেখে গ্রামটাকে। গ্রামের বেশির ভাগ পরিবার ই অত্যন্ত গরিব। টেনে টুনে সংসার চলে যায় এদের। গ্রামেই থাকত গোবিন্দ ও মঞ্জুরি। এদের মেয়ে স্নেহাশ্রী। আদর করে সবাই স্নেহা বলেই ডাকে। কী আদুরে আর দুষ্টু মেয়ে! সারাদিন এই দিক ওই দিক করে সময় চলে যায়। তেমন বুদ্ধিমতী এই মেয়ে।গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার মদনমোহন বাবু সব সময় প্রশংসা করেন এই বছর দশের এই মেয়ের। খেতের জমির মাঝে আলগুলো দিয়ে স্নেহা খেলত, ঘুরত।
"স্নেহা মা ওরকম করে না। লেগে যাবে!" আদরের মেয়েকে বার বার মঞ্জুরি বারণ করত। টেনে টুনে সংসার চালানো এই গোবিন্দ মেয়েকে খুব ভালোবাসত।
"আমাদের মেয়েকে অনেক বড়ো করতে হবে।
পারবি তো তুই স্নেহা!"
স্নেহা মাথা নাড়ত। মন দিয়ে পড়াশোনা করত। একদিন সে তার প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার মদনমোহন বাবুকে জিগেস করে,
"স্যার কিভাবে আমি আমার বাবা মায়ের কষ্ট মুছে ফেলব!"
"এত ছোট মেয়ের মুখে এ কি কথা!ভালো করে পড়াশোনা কর। অনেক বড়ো হবি তুই!"
সময় চলতে থাকে। একদিন ক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে মাটিতে মাথা ঘুরিয়ে পরে যায় গোবিন্দ। সবাই ধরে বেঁঁধে বাড়িতে নিয়ে আসে।
"কি হয়েছে বাবা?"
"ও কিছু নয়।"
"মা বাবা কে ডাক্তার দেখাবে না?"
"হ্যা দেখাবো। কি হল সুস্থ মানুষটার!"
এলাকায় ফিরেছে জিতেন। কলকাতায় কাজ করে এই জিতেন। কি কাজ সেটা অবশ্য কেউ জানে না। এলাকায় ধনী বলতে জিতেন কে সবাই বলত। বাড়িতে বাবা, মা আছে। ছেলেকে নিয়ে বেশ গর্ব তাদের। এবার দিন পনেরো থাকবে।গোবিন্দদার অসুখ শুনে সে কিছু টাকা দিয়ে আসে। ডাক্তার দেখানো হয়। তিনি কিছু টেস্ট দেয়।
সরকারি হাসপাতালে গিয়ে সেগুলো করানো হয়।
বাড়িতে আসে স্নেহা। ঘরে লোকজন ভর্তি। মায়ের চোখে জল। বাবা বিছানায় শুয়ে আছে।
"কি হয়েছে মা!"
"কিছু হয় নি। তুই যা! "
কেউ কিছু বলতে চাইছে না। যে স্যার তাকে সব উত্তর দেন, তিনিও আজ চুপ। ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মনমরা হয়ে স্নেহা।বাইরে জিতেন দা বিড়ি খাচ্ছে।
"ও জিতেন দা!"
"আরে পুচকি! কেমন আছিস?"
"তুমি বলো না বাবা কেমন আছে?"
"তোকে কেউ কিছু বলে নি। অবশ্য তুই এত ছোট!"
"আমায় বলো না!"
"তোর বাবার ক্যানসার হয়েছে। উনি আর বেশি দিন...."
মনে পরে যায় স্নেহাশ্রীর স্যারের কথা।
"ক্যানসার হল সব থেকে মারণ রোগ। প্রথমত ঠিক মত নিরাময়ের ওষুধ নেই, আর যা আছে তা আমাদের সাধ্যর বাইরে।"
বছর দশের স্নেহার চোখে জল চলে আসে।দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে।
"বাবা তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো!"
"না রে যাব না।" হেসে উত্তর দেয় গোবিন্দ।স্নেহা আজ স্কুলে প্রথম হয়েছে পরিক্ষায়, এত আনন্দের দিনটা যে তার জীবন এর সব থেকে খারাপ দিনে পরিণত হয়ে যাবে, সে জানতই না। আজকাল সে আর দুষ্টুমি করে না। বাবার শরীর খারাপ, মাকে সংসার চালাতে হয়। তাকে দেখার জন্য যে মা নেই সে বুঝে গেছে। পাশের পুকুড়ে গিয়ে বসে চুপ করে বসে ঢিল ছুড়ত।
"কিরে স্নেহা? এখানে একা একা?"
"না এমনি! জিতুদা।"
"কি এত ভাবছিস!"
"অনেক কিছু!"
"কি আমিও শুনি!"
"আমি যদি বড়ো হতাম, বাবাকে ডাক্তার দেখিয়ে ভালো করে তুলতাম। মাকে এত কস্ট করতে হত না। ঠিক তোমার মত!"
মাথা নাড়িয়ে বলে স্নেহাশ্রী।
"টাকা রোজগার করবি?"
"আমি বাচ্চা মেয়ে কিভাবে করবো!"
"কলকাতা যাবি? "
"কিন্তু জিতুদা আমি পারব? আমার ভয়...."
ককিয়ে ওঠে স্নেহা।
খানিকক্ষণ ভেবে আবার বলে, "মা আমাকে যেতে দেবে না মনে হয়।"
জিতু যেন কি সব ভেবে নেয়।
"আরে এই সব ছোট সমস্যা নিয়ে না চিন্তা করে চল। অনেক টাকা পাবি, পড়াশোনা করবি। তুই ও ভালো থাকবি, তোর বাবাও!"
"আমায় পড়াশোনা করতে দেবে? সত্যি বলছ জিতু দা?"
"হ্যা রে সত্যি বলছি। অনেক ভালো থাকবি।এই গ্রামে থেকে কিছু হবে না।"
স্নেহাশ্রীর মনে পরে যায় মদনমোহনবাবুর কথা।
"জানিস স্নেহা, যারা ভালো পড়াশোনা করে, তারা এখান থেকে কলকাতায় বড়ো বড়ো জায়গায় পড়তে চলে যায়। আমার বিশ্বাস, তুই ও যাবি! "
স্বপ্নপূরণ যে এত সোজা ভাবতেই পারছে না ও। জিতুদা কে যেন তার জাদুকর মনে হচ্ছে। সব সমস্যার সমাধান সে কয়েক মুহুর্তে করে দিতে পারে।
"তাহলে কালই বেরোব। কাউকে বলবি না।তাহলে যেতে দেবে না।"
"কিন্তু মাকে একবার...
"
"না একদম নয়। বউদির এমনি মন মেজাজ খারাপ আর তুই....! ভরসা রাখ আমার উপর!"
"এখন বাড়ি যাচ্ছি। কাল তাহলে চলে যাব। "
আনমনে বাড়ির দিকে এগোছে থাকে ছোট স্নেহা। চেনা পুকুর, ক্ষেতের মাঝের আলগুলোকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না তার। কিন্তু না, বাবার জন্য তাকে যে যেতেই হবে।অনেক পড়াশোনা করতে হবে, টাকা পাঠাতে হবে। বাচ্চা মেয়েটি এক দিকে যেন বেশ আনন্দ পাচ্ছিল, অন্য দিকে কষ্ট পাচ্ছিল প্রচন্ড। বাড়িতে ঢুকতেই মায়ের চিৎকার,
"কিরে! এত ক্ষণ কোথায় ছিলিস! খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে যাচ্ছি! "
"মা, একটু খেলছিলাম..."
"যা স্নান করে আয়। খাইয়ে দেব।"
ছোট স্নেহার কান্না কান্না পায়। মা বেশ আদর করে খাইয়ে দেয়। কিছুক্ষন পর মায়ের আচলে শুয়ে ঘুমিয়ে পরে স্নেহা।
সকালে উঠে পড়ে। বাবা ঘুমাচ্ছে। মা কাজে গেছে। চটপট জামাকাপড় গোছাতে থাকে।মা, বাবার একটা ছবিও নিয়ে নেয় পুটলিতে। এক দৌড় দেয়। বাঁশবাগানে দাঁড়িয়ে ছিল জিতু।
"আরে চলে এসেছিস? চল চল। বাস ধরতে হবে যে!"
"মা, বাবার জন্য মন খারাপ করছে!"
"আরে তুই তো কাজ করতে যাচ্ছিস। তোর বাবা, মা গর্ব করবে জানলে। আমার কথা কাউকে বলেছিস?"
"মাকে বলা হয় নি। মা খুব কাঁদবে। "
"আমি বউদিকে বলে দেব। এবার চল দেরি হয়ে গেল।"
হাটতে থাকে দুজন। ঘন্টাখানেক হেটে আসে মেন রোডের ধারে।
"চল ওঠ! "
এই প্রথম বাসে উঠল স্নেহা। কোনো দিন যে গ্রামের বাইরে যায়নি।
বেশ আনন্দ হচ্ছে তার।
সিটে বসে।
"কিরে গলা শুকিয়ে গেছে? "
"হুম জল আছে তোমার কাছে?"
"এই নে!"
বাস এগোতে থাকে দ্রুত গতিতে। ঘুমিয়ে পরে স্নেহা।
"হ্যালো?"
"কোথায় জিতু?"
"আসছি বাসে। তুই শিয়ালদাতে দাঁঁড়াবি।আমি পৌঁঁছে যাব। "
"মাল ভালো তো?"
"একদম কচি! আমার ভালো দাম চাই!"
"সে সব নিয়ে কখনও চিন্তা হয়েছে তোর! সব রেডি!"
ফোনটা কেটে দেয় জিতু। মুখে চওড়া হাসি।বাস থেকে নেমে ট্যাক্সি নেয় জিতু।
"দাদা শিয়ালদহ স্টেশন!"
"জিতুদা আমরা কোথায়! কী সুন্দর সুন্দর গাড়ি! কত বড়ো বাড়ি গো! কী দারুণ রাস্তা ঘাট! সব তো বইতে পড়েছিলাম। "
"আমি বলেছিলাম না! আচ্ছা একটু জল খেয়ে নে!"
জল খায় স্নেহাশ্রী। মাথাটা ঝিমাচ্ছে। ঘুমিয়ে পরে আবার। জলের বোতলে বেশ ভালো করেই ঘুমের ওষুধ মিশিয়েছিল জিতু।
গন্তব্য শিয়ালদহ চলে আসে। নামতেই দেখা হয় সুবোধের সাথে!
"আরে ভাই!"
আলিঙ্গন করে দুজন।
"উফ এ তো বিষন কচি!"
"টাকা দে মাল নে!"
"এই নে।"
কুড়ি হাজার টাকা জিতু কে দেয় সুবোধ।
জিতু স্নেহা কে ডাকে।
"এই কাকুর সাথে যা। আমি আসছি!"
চলে যায় জিতু, ভিড়ের মাঝে কোথায় যেন!
বাচ্চা মেয়ে, তারপর ওষুধ! কিছু বলার আগেই এত কিছু হয়ে যায়।
একটা ট্যাক্সি নেয় সুবোধ।
"দাদা শোভাবাজার!"
"আমরা কোথায় যাচ্ছি! "
"তোমার জিতু দাদার কাছে! নাও জলটা খেয়ে নাও।"
এক প্রকার জোর করেই, জলটা খাইয়ে দেয় স্নেহাকে। রাস্তা যে দেখতে দেওয়া যাবে না।
শোভাবাজার আসতে নেমে যায় ওরা।স্নেহাশ্রীকে জোর করে উঠিয়ে দেয়।
"কাকু আমি আর পারছি না!"
"আর এক্কটু চল। চলে এসেছি।"
মাথা ঘুরছে, সারাদিনের ক্লান্তি আর পারছে না স্নেহা। গ্রামের কথা যে বড্ড মনে পড়ছে।
চার দিকে এত বড়ো বড়ো বাড়ি। গাছ পালা নেই বললেই চলে। কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে শ্নেহাশ্রীর। একটা থেকে আর একটা গলি, টানতে টানতে সুবোধ নিয়ে যাচ্ছে স্নেহাশ্রীকে।
"আহ লাগছে! হাতটা..."
শোনেই না সুবোধ। হঠাৎ একটা বাড়িতে ঢুকে যায়। বাড়িটা দেখে কেমন ভয় ভয় লাগছে স্নেহার। কত মেয়েকে দেখছে কেউ তার দিদির বয়সি তো কেউ মায়ের! সুবোধ একজন বয়স্ক মহিলার কাছে নিয়ে গেল।
"একদম টাটকা মাল আছে!"
বয়স্ক মহিলা তাকালো স্নেহাশ্রীর দিকে।
"ওই ছোকরি নাম কি?"
"স্নেহা।"
"আমার পছন্দ হয়েছে। অর্জুন সুবোধ কে হিসাব মিটিয়ে দে!"
"কোথায় যাচ্ছ সুবোধ কাকু? জিতু দা কোথায়?"
"এখানে অনেক টাকা পাবি? এরা পড়াশোনা করাবে। ভালো থাকিস!"
খুব তাড়াতাড়ি বলে চলে যায় সুবোধ।
"চল ছোকরি।"
একটা ছোট ঘুপচি ঘরে ঢুকিয়ে দেয় স্নেহাকে।
"শোন তোকে চুলবুলি বলে ডাকব। অভ্যাস করে নে!"
"কিন্তু..."
"কিছু কিন্তু নয়। ওই রেশমি নতুন মাল। কাজ বলে দে, শিখিয়ে দে। কাল থেকে কাস্টমার দেব। সাজিয়ে দিবি।"
"এ যে খুব বাচ্চা! "
"যত কচি, তত দাম বেশি। তুই বেশি কথা বললে এবার!"
বেরিয়ে যায় বয়স্ক মহিলা।
"আমি কাজ করব! "বেশ আনন্দ পায় স্নেহা।
বাচ্চা মেয়েটাকে দেখে বেশ মায়া লাগছিল রেশমির।
"তুই খুব খারাপ জায়গায় এসে পড়েছিস।হয়ত আর কোনো দিন!"
"কি হয় এখানে?"
সন্ধ্যা হয়েছে। সাজিয়ে দিয়েছে রেশমি স্নেহাকে। সে খুব খুশি। এত সাজেনি কোনো দিন।
"রেশমি বেরো!"
বয়স্ক ভদ্রমহিলা একজন ভদ্রলোক নিয়ে ঘরে ঢুকে যায়।
"এ যে খুব বাচ্চা!"
"আপনি আপনার মত কাজ করে নিন না!"
হেসে বলে বয়স্ক মহিলা। তারপর বেরিয়ে যায়।
ভেতরে চলে মানবতার ধর্ষন! রেশমি দাঁড়িয়ে ছিল বাইরে, সে নিরুপায়। কাস্টমার বেড়িয়ে গেলে সে ঘরে ছুটে যায়। নগ্ন বাচ্চা মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে।
"আমার খুব লাগছিল দিদি! কাঁদতে থাকে স্নেহা।
নিজের উপর খুব রাগ হয় রেশমির।
"আজকে রাতে এখান থেকে বের করে দেব তোকে। পালিয়ে যাবি যত দূর পারিস!"
বাইরে থেকে আওয়াজ আসে।
"রেশমি তোর কাস্টমার.।"
রেশমি চলে যায়। রাত ঘনিয়ে আসে।
"এই ওঠ স্নেহা। চল চটপট!"
স্নেহা তৈরী হয়ে নেয়।
একের পর এক ঘর পার হচ্ছে রেশমি স্নেহাকে কোলে নিয়ে। সামনেই দরজা। আর কয়েক পা বাড়ালেই মুক্তি।
কোল থেকে নামাতে যাবে রেশমি স্নেহাকে, সেই সময়,
"খুব কষ্ট হচ্ছে না রেশমি!"
সপাটে চড় মারে বয়স্ক মহিলাটি।
"সুমন ওকে নিয়ে যা রেশমিকে। বড্ড বার বেড়েছে!"
টানতে টানতে নিয়ে চলে যায় রেশমিকে সুমন। ভাড়াটে গুন্ডা তো।
"এই শোন ছোকরি। অনেক টাকায় তোকে কিনেছি। পালাতে আর পারবি না!"
অন্ধকার গ্রাস করেছে। যে আলোকে মনে হল এই ছুঁয়ে ফেলছি, সেটা যেন উধাও হয়ে যায়। ওকে টানতে টানতে নিয়ে ঘরে বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর কোনো দিন রেশমিদিকে দেখতে পারে নি স্নেহা। প্রথম প্রথম খুব কস্ট হত। দিনের পর দিন চলে গেছে, বছরের বছর নেমে এসেছে। কিছুই পালটায়নি। ছোটোবেলার স্মৃতিগুলো এখন আবছা। আজ যে সে সমাজের অপরাধী, দাগী বেশ্যা! অপরাধ কি করেছিল? স্বপ্ন দেখেছিল? বাবা কে বাঁচাতে চেয়েছিল?পড়াশোনা করতে চেয়েছিল? না দোষ ওর নয় আমাদের সমাজের! আমরাই আসল অপরাধী। বার বার ভুলে যাই এরাও মানুষ, এদের ও জীবন আছে। না হয় আজ নিজেই বদলাই, কাল অন্যদের বলবো!
"স্নেহা মা ওরকম করে না। লেগে যাবে!" আদরের মেয়েকে বার বার মঞ্জুরি বারণ করত। টেনে টুনে সংসার চালানো এই গোবিন্দ মেয়েকে খুব ভালোবাসত।
"আমাদের মেয়েকে অনেক বড়ো করতে হবে।
পারবি তো তুই স্নেহা!"
স্নেহা মাথা নাড়ত। মন দিয়ে পড়াশোনা করত। একদিন সে তার প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার মদনমোহন বাবুকে জিগেস করে,
"স্যার কিভাবে আমি আমার বাবা মায়ের কষ্ট মুছে ফেলব!"
"এত ছোট মেয়ের মুখে এ কি কথা!ভালো করে পড়াশোনা কর। অনেক বড়ো হবি তুই!"
সময় চলতে থাকে। একদিন ক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে মাটিতে মাথা ঘুরিয়ে পরে যায় গোবিন্দ। সবাই ধরে বেঁঁধে বাড়িতে নিয়ে আসে।
"কি হয়েছে বাবা?"
"ও কিছু নয়।"
"মা বাবা কে ডাক্তার দেখাবে না?"
"হ্যা দেখাবো। কি হল সুস্থ মানুষটার!"
এলাকায় ফিরেছে জিতেন। কলকাতায় কাজ করে এই জিতেন। কি কাজ সেটা অবশ্য কেউ জানে না। এলাকায় ধনী বলতে জিতেন কে সবাই বলত। বাড়িতে বাবা, মা আছে। ছেলেকে নিয়ে বেশ গর্ব তাদের। এবার দিন পনেরো থাকবে।গোবিন্দদার অসুখ শুনে সে কিছু টাকা দিয়ে আসে। ডাক্তার দেখানো হয়। তিনি কিছু টেস্ট দেয়।
সরকারি হাসপাতালে গিয়ে সেগুলো করানো হয়।
বাড়িতে আসে স্নেহা। ঘরে লোকজন ভর্তি। মায়ের চোখে জল। বাবা বিছানায় শুয়ে আছে।
"কি হয়েছে মা!"
"কিছু হয় নি। তুই যা! "
কেউ কিছু বলতে চাইছে না। যে স্যার তাকে সব উত্তর দেন, তিনিও আজ চুপ। ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মনমরা হয়ে স্নেহা।বাইরে জিতেন দা বিড়ি খাচ্ছে।
"ও জিতেন দা!"
"আরে পুচকি! কেমন আছিস?"
"তুমি বলো না বাবা কেমন আছে?"
"তোকে কেউ কিছু বলে নি। অবশ্য তুই এত ছোট!"
"আমায় বলো না!"
"তোর বাবার ক্যানসার হয়েছে। উনি আর বেশি দিন...."
মনে পরে যায় স্নেহাশ্রীর স্যারের কথা।
"ক্যানসার হল সব থেকে মারণ রোগ। প্রথমত ঠিক মত নিরাময়ের ওষুধ নেই, আর যা আছে তা আমাদের সাধ্যর বাইরে।"
বছর দশের স্নেহার চোখে জল চলে আসে।দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে।
"বাবা তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো!"
"না রে যাব না।" হেসে উত্তর দেয় গোবিন্দ।স্নেহা আজ স্কুলে প্রথম হয়েছে পরিক্ষায়, এত আনন্দের দিনটা যে তার জীবন এর সব থেকে খারাপ দিনে পরিণত হয়ে যাবে, সে জানতই না। আজকাল সে আর দুষ্টুমি করে না। বাবার শরীর খারাপ, মাকে সংসার চালাতে হয়। তাকে দেখার জন্য যে মা নেই সে বুঝে গেছে। পাশের পুকুড়ে গিয়ে বসে চুপ করে বসে ঢিল ছুড়ত।
"কিরে স্নেহা? এখানে একা একা?"
"না এমনি! জিতুদা।"
"কি এত ভাবছিস!"
"অনেক কিছু!"
"কি আমিও শুনি!"
"আমি যদি বড়ো হতাম, বাবাকে ডাক্তার দেখিয়ে ভালো করে তুলতাম। মাকে এত কস্ট করতে হত না। ঠিক তোমার মত!"
মাথা নাড়িয়ে বলে স্নেহাশ্রী।
"টাকা রোজগার করবি?"
"আমি বাচ্চা মেয়ে কিভাবে করবো!"
"কলকাতা যাবি? "
"কিন্তু জিতুদা আমি পারব? আমার ভয়...."
ককিয়ে ওঠে স্নেহা।
খানিকক্ষণ ভেবে আবার বলে, "মা আমাকে যেতে দেবে না মনে হয়।"
জিতু যেন কি সব ভেবে নেয়।
"আরে এই সব ছোট সমস্যা নিয়ে না চিন্তা করে চল। অনেক টাকা পাবি, পড়াশোনা করবি। তুই ও ভালো থাকবি, তোর বাবাও!"
"আমায় পড়াশোনা করতে দেবে? সত্যি বলছ জিতু দা?"
"হ্যা রে সত্যি বলছি। অনেক ভালো থাকবি।এই গ্রামে থেকে কিছু হবে না।"
স্নেহাশ্রীর মনে পরে যায় মদনমোহনবাবুর কথা।
"জানিস স্নেহা, যারা ভালো পড়াশোনা করে, তারা এখান থেকে কলকাতায় বড়ো বড়ো জায়গায় পড়তে চলে যায়। আমার বিশ্বাস, তুই ও যাবি! "
স্বপ্নপূরণ যে এত সোজা ভাবতেই পারছে না ও। জিতুদা কে যেন তার জাদুকর মনে হচ্ছে। সব সমস্যার সমাধান সে কয়েক মুহুর্তে করে দিতে পারে।
"তাহলে কালই বেরোব। কাউকে বলবি না।তাহলে যেতে দেবে না।"
"কিন্তু মাকে একবার...
"
"না একদম নয়। বউদির এমনি মন মেজাজ খারাপ আর তুই....! ভরসা রাখ আমার উপর!"
"এখন বাড়ি যাচ্ছি। কাল তাহলে চলে যাব। "
আনমনে বাড়ির দিকে এগোছে থাকে ছোট স্নেহা। চেনা পুকুর, ক্ষেতের মাঝের আলগুলোকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না তার। কিন্তু না, বাবার জন্য তাকে যে যেতেই হবে।অনেক পড়াশোনা করতে হবে, টাকা পাঠাতে হবে। বাচ্চা মেয়েটি এক দিকে যেন বেশ আনন্দ পাচ্ছিল, অন্য দিকে কষ্ট পাচ্ছিল প্রচন্ড। বাড়িতে ঢুকতেই মায়ের চিৎকার,
"কিরে! এত ক্ষণ কোথায় ছিলিস! খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে যাচ্ছি! "
"মা, একটু খেলছিলাম..."
"যা স্নান করে আয়। খাইয়ে দেব।"
ছোট স্নেহার কান্না কান্না পায়। মা বেশ আদর করে খাইয়ে দেয়। কিছুক্ষন পর মায়ের আচলে শুয়ে ঘুমিয়ে পরে স্নেহা।
সকালে উঠে পড়ে। বাবা ঘুমাচ্ছে। মা কাজে গেছে। চটপট জামাকাপড় গোছাতে থাকে।মা, বাবার একটা ছবিও নিয়ে নেয় পুটলিতে। এক দৌড় দেয়। বাঁশবাগানে দাঁড়িয়ে ছিল জিতু।
"আরে চলে এসেছিস? চল চল। বাস ধরতে হবে যে!"
"মা, বাবার জন্য মন খারাপ করছে!"
"আরে তুই তো কাজ করতে যাচ্ছিস। তোর বাবা, মা গর্ব করবে জানলে। আমার কথা কাউকে বলেছিস?"
"মাকে বলা হয় নি। মা খুব কাঁদবে। "
"আমি বউদিকে বলে দেব। এবার চল দেরি হয়ে গেল।"
হাটতে থাকে দুজন। ঘন্টাখানেক হেটে আসে মেন রোডের ধারে।
"চল ওঠ! "
এই প্রথম বাসে উঠল স্নেহা। কোনো দিন যে গ্রামের বাইরে যায়নি।
বেশ আনন্দ হচ্ছে তার।
সিটে বসে।
"কিরে গলা শুকিয়ে গেছে? "
"হুম জল আছে তোমার কাছে?"
"এই নে!"
বাস এগোতে থাকে দ্রুত গতিতে। ঘুমিয়ে পরে স্নেহা।
"হ্যালো?"
"কোথায় জিতু?"
"আসছি বাসে। তুই শিয়ালদাতে দাঁঁড়াবি।আমি পৌঁঁছে যাব। "
"মাল ভালো তো?"
"একদম কচি! আমার ভালো দাম চাই!"
"সে সব নিয়ে কখনও চিন্তা হয়েছে তোর! সব রেডি!"
ফোনটা কেটে দেয় জিতু। মুখে চওড়া হাসি।বাস থেকে নেমে ট্যাক্সি নেয় জিতু।
"দাদা শিয়ালদহ স্টেশন!"
"জিতুদা আমরা কোথায়! কী সুন্দর সুন্দর গাড়ি! কত বড়ো বাড়ি গো! কী দারুণ রাস্তা ঘাট! সব তো বইতে পড়েছিলাম। "
"আমি বলেছিলাম না! আচ্ছা একটু জল খেয়ে নে!"
জল খায় স্নেহাশ্রী। মাথাটা ঝিমাচ্ছে। ঘুমিয়ে পরে আবার। জলের বোতলে বেশ ভালো করেই ঘুমের ওষুধ মিশিয়েছিল জিতু।
গন্তব্য শিয়ালদহ চলে আসে। নামতেই দেখা হয় সুবোধের সাথে!
"আরে ভাই!"
আলিঙ্গন করে দুজন।
"উফ এ তো বিষন কচি!"
"টাকা দে মাল নে!"
"এই নে।"
কুড়ি হাজার টাকা জিতু কে দেয় সুবোধ।
জিতু স্নেহা কে ডাকে।
"এই কাকুর সাথে যা। আমি আসছি!"
চলে যায় জিতু, ভিড়ের মাঝে কোথায় যেন!
বাচ্চা মেয়ে, তারপর ওষুধ! কিছু বলার আগেই এত কিছু হয়ে যায়।
একটা ট্যাক্সি নেয় সুবোধ।
"দাদা শোভাবাজার!"
"আমরা কোথায় যাচ্ছি! "
"তোমার জিতু দাদার কাছে! নাও জলটা খেয়ে নাও।"
এক প্রকার জোর করেই, জলটা খাইয়ে দেয় স্নেহাকে। রাস্তা যে দেখতে দেওয়া যাবে না।
শোভাবাজার আসতে নেমে যায় ওরা।স্নেহাশ্রীকে জোর করে উঠিয়ে দেয়।
"কাকু আমি আর পারছি না!"
"আর এক্কটু চল। চলে এসেছি।"
মাথা ঘুরছে, সারাদিনের ক্লান্তি আর পারছে না স্নেহা। গ্রামের কথা যে বড্ড মনে পড়ছে।
চার দিকে এত বড়ো বড়ো বাড়ি। গাছ পালা নেই বললেই চলে। কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে শ্নেহাশ্রীর। একটা থেকে আর একটা গলি, টানতে টানতে সুবোধ নিয়ে যাচ্ছে স্নেহাশ্রীকে।
"আহ লাগছে! হাতটা..."
শোনেই না সুবোধ। হঠাৎ একটা বাড়িতে ঢুকে যায়। বাড়িটা দেখে কেমন ভয় ভয় লাগছে স্নেহার। কত মেয়েকে দেখছে কেউ তার দিদির বয়সি তো কেউ মায়ের! সুবোধ একজন বয়স্ক মহিলার কাছে নিয়ে গেল।
"একদম টাটকা মাল আছে!"
বয়স্ক মহিলা তাকালো স্নেহাশ্রীর দিকে।
"ওই ছোকরি নাম কি?"
"স্নেহা।"
"আমার পছন্দ হয়েছে। অর্জুন সুবোধ কে হিসাব মিটিয়ে দে!"
"কোথায় যাচ্ছ সুবোধ কাকু? জিতু দা কোথায়?"
"এখানে অনেক টাকা পাবি? এরা পড়াশোনা করাবে। ভালো থাকিস!"
খুব তাড়াতাড়ি বলে চলে যায় সুবোধ।
"চল ছোকরি।"
একটা ছোট ঘুপচি ঘরে ঢুকিয়ে দেয় স্নেহাকে।
"শোন তোকে চুলবুলি বলে ডাকব। অভ্যাস করে নে!"
"কিন্তু..."
"কিছু কিন্তু নয়। ওই রেশমি নতুন মাল। কাজ বলে দে, শিখিয়ে দে। কাল থেকে কাস্টমার দেব। সাজিয়ে দিবি।"
"এ যে খুব বাচ্চা! "
"যত কচি, তত দাম বেশি। তুই বেশি কথা বললে এবার!"
বেরিয়ে যায় বয়স্ক মহিলা।
"আমি কাজ করব! "বেশ আনন্দ পায় স্নেহা।
বাচ্চা মেয়েটাকে দেখে বেশ মায়া লাগছিল রেশমির।
"তুই খুব খারাপ জায়গায় এসে পড়েছিস।হয়ত আর কোনো দিন!"
"কি হয় এখানে?"
সন্ধ্যা হয়েছে। সাজিয়ে দিয়েছে রেশমি স্নেহাকে। সে খুব খুশি। এত সাজেনি কোনো দিন।
"রেশমি বেরো!"
বয়স্ক ভদ্রমহিলা একজন ভদ্রলোক নিয়ে ঘরে ঢুকে যায়।
"এ যে খুব বাচ্চা!"
"আপনি আপনার মত কাজ করে নিন না!"
হেসে বলে বয়স্ক মহিলা। তারপর বেরিয়ে যায়।
ভেতরে চলে মানবতার ধর্ষন! রেশমি দাঁড়িয়ে ছিল বাইরে, সে নিরুপায়। কাস্টমার বেড়িয়ে গেলে সে ঘরে ছুটে যায়। নগ্ন বাচ্চা মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে।
"আমার খুব লাগছিল দিদি! কাঁদতে থাকে স্নেহা।
নিজের উপর খুব রাগ হয় রেশমির।
"আজকে রাতে এখান থেকে বের করে দেব তোকে। পালিয়ে যাবি যত দূর পারিস!"
বাইরে থেকে আওয়াজ আসে।
"রেশমি তোর কাস্টমার.।"
রেশমি চলে যায়। রাত ঘনিয়ে আসে।
"এই ওঠ স্নেহা। চল চটপট!"
স্নেহা তৈরী হয়ে নেয়।
একের পর এক ঘর পার হচ্ছে রেশমি স্নেহাকে কোলে নিয়ে। সামনেই দরজা। আর কয়েক পা বাড়ালেই মুক্তি।
কোল থেকে নামাতে যাবে রেশমি স্নেহাকে, সেই সময়,
"খুব কষ্ট হচ্ছে না রেশমি!"
সপাটে চড় মারে বয়স্ক মহিলাটি।
"সুমন ওকে নিয়ে যা রেশমিকে। বড্ড বার বেড়েছে!"
টানতে টানতে নিয়ে চলে যায় রেশমিকে সুমন। ভাড়াটে গুন্ডা তো।
"এই শোন ছোকরি। অনেক টাকায় তোকে কিনেছি। পালাতে আর পারবি না!"
অন্ধকার গ্রাস করেছে। যে আলোকে মনে হল এই ছুঁয়ে ফেলছি, সেটা যেন উধাও হয়ে যায়। ওকে টানতে টানতে নিয়ে ঘরে বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর কোনো দিন রেশমিদিকে দেখতে পারে নি স্নেহা। প্রথম প্রথম খুব কস্ট হত। দিনের পর দিন চলে গেছে, বছরের বছর নেমে এসেছে। কিছুই পালটায়নি। ছোটোবেলার স্মৃতিগুলো এখন আবছা। আজ যে সে সমাজের অপরাধী, দাগী বেশ্যা! অপরাধ কি করেছিল? স্বপ্ন দেখেছিল? বাবা কে বাঁচাতে চেয়েছিল?পড়াশোনা করতে চেয়েছিল? না দোষ ওর নয় আমাদের সমাজের! আমরাই আসল অপরাধী। বার বার ভুলে যাই এরাও মানুষ, এদের ও জীবন আছে। না হয় আজ নিজেই বদলাই, কাল অন্যদের বলবো!
(সমাপ্ত)