এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

জুই দাশগুপ্ত



ছোট গল্প



শেষ রাত্রি

নিউ টাউনের কাছে দু কামরার এই ফ্ল্যাটে আজই প্রথম দিন কৃতিকার। অফিসের কাছাকাছি বাড়িটা হওয়ায় সাত পাঁচ কিছু না ভেবেই বাড়িটি ভাড়া নিতে রাজি হয়ে যায় সে। আজ সারাটা দিন বাড়ি গোছাতে লেগে যাবে বলে অফিস থেকে একদিনের ছুটি চেয়ে নিয়েছে সে। গৃহপ্রবেশের জন্যে একটা ছোট্ট পুজোর আয়োজন । পুজো ছোট হলে কি হবে আয়োজন সারতে সারতে অনেক বেলা হয়ে গেল, এতক্ষণ সে খেয়ালই করেনি যে  ঠাকুরমশাই, যাকে কাল সে বলে এসেছিল পুজোর কথা তিনি এখনো এসে পৌঁছাননি। এদিকে অতিথিরা একে-একে আসতে শুরু করেছেন, আর অপেক্ষা করা উচিত হবেনা ভেবে নিজেই পুরোহিতের গৃহের উদ্দেশ্যে রওনা হয় কৃতিকা, পুরোহিতের বাড়ি পৌঁছে জানতে পারে তিনি গত রাত থেকেই আশ্চর্যজনক ভাবে নিখোঁজ। তার বাড়ির লোকজন এমনকি প্রতিবেশীরাও কোনো খোঁজ দিতে পারলেন না। হতাশ হয়ে সেখানের থেকে ফিরে আসতে হয় কৃতিকাকে, অদ্ভুত ভাবে আর কোনো পুরোহিতই তার বাড়ি যেতে সম্মত হচ্ছিলেন না।অবশেষে একজনকে কে বেশি দক্ষিণার লোভ দিয়ে রাজি করিয়ে তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে কৃতিকা, পূজো শুরু হয়, দরজার কাছে মঙ্গল ঘট রেখে আসে কৃতিকা, এরপর পূজো শেষ হলে একে একে সকলে বাড়ি চলে যেতে থাকে। পুরোহিত মহাশয় ও নিজের প্রাপ্য বুঝে নিয়ে প্রস্থান করলেন।শুধু কৃতিকার এক বান্ধবী নীরা থেকে যায় কৃতিকার সাথে, দুজনে মিলে খাওয়া দাওয়া সারতে সারতে বেশ রাত হয়ে গেল। এত রাতে নীরার একা বাড়ি ফেরা নিরাপদ হবেনা বলে কৃতিকাই তাকে নিজের গাড়িতে বাড়ি ছেড়ে আসার প্রস্তাব দেয়। নীরা তাতে রাজি হয়ে দরজার কাছে গিয়ে, হঠাত্ই তার চোখে পড়ে বাড়ির বাইরে নেইম প্লেট এ লেখা নামটায় ,সে কৃতিকাকে ডেকে নামটা দেখায়, কৃতিকাও বেশ অবাক হল এই ঘটনায়, কারন তার স্পষ্ট মনে আছে আজ সকালেই এখানে নিজের নামের নেইম প্লেট লাগিয়ে ছিল সে। নীরা বললো "সারা দিনের ব্যস্ততার কারনে হয়তো নেইম প্লেট পাল্টাতে ভুলে গিয়েছো"। কথাটা মন থেকে কিছুতেই মানতে পারলো না কৃতিকা। তার খুব ভালো করেই মনে আছে সবকিছু, কিন্তু সেই মুহূর্তে কথা বাড়ানো টা ঠিক হবে না তাই, 'হয়ত'  বলে পা বাড়ালো গাড়ির দিকে, নীরা অনুসরণ করলো তাকে। নীরাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে একাই বাড়ি ফিরছিল কৃতিকা, ফাঁকা রাস্তা পেয়ে গাড়ির গতি বেশ দ্রুতই রেখেছিল সে, আচমকা বৃষ্টি শুরু হল, ধীরে ধীরে গতি বাড়তে থাকল, সাথেই আরম্ভ হল ঝড়, সম্ভবত কালবৈশাখী। গাড়ির সামনের কাচ বেশ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল, কিছুই দেখা যাচ্ছিল না, গাড়ির গতি কমানোর চেষ্টা করেও কোনো লাভ হলো না, সামনে কোনো এক বস্তুকে সজোরে ধাক্কা মেরে গাড়িটা, থেমে গেল কৃতিকা দ্রুত গাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলো, কিন্তু সামনে কিছুই দেখতে পেল না। তবে কিসের সাথে ধাক্কা লাগলো গাড়ির? রাস্তায় মানুষ জন তো দূরের কথা একটা গাছ অবধি নেই ,শুধুই লম্বা ফাঁকা রাস্তা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ  তখন হঠাত্ই থেমে গেল, গাড়িতে ফিরে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল, কিছুতেই আর স্টার্ট হলো না গাড়ি। নেমে গেল যদি কোনো সাহায্য পাওয়া যায়। কিন্তু সেখানে জনবসতি আছে বলে তো মনে হলো না, আর কে আসবে তাহলে এখানে এত রাতে? এতসব চিন্তা করছিল তখনই বাইক নিয়ে এক যুবক কে তার দিকে আসতে দেখে কৃতিকা হাত দেখাল, বাইকটা তার কাছে এসে থেমে গেল  কৃতিকা এগিয়ে গিয়ে সাহায্য চাইলো, সেই যুবক ও সম্মত হলো তাকে বাড়ি পৌছে দিতে, নাম জানতে চাওয়াতে যুবকটি তার পরিচয় দিয়ে বললো তার নাম শুভায়ু। পরিচয় পর্ব সমাপ্তির পর তারা যাত্রা শুরু করলো। এতক্ষণে কৃতিকা লক্ষ্য করলো এই কিছুক্ষণ আগের বৃষ্টিতে সে নিজে পুরো ভিজে গিয়েছে অথচ যুবকটির পোশাকে সেই চিহ্ন সামান্যতম ও নেই। এও কি সম্ভব? কৃতিকার বাড়ির সামনে বাইক থামতেই শুভায়ু চলে গেল, ধন্যবাদ টুকু বলার সময় অবধি দিল না। কৃতিকার অবাক হওয়ার পালা তো সবে শুরু হয়েছিল, কারন তখনই ওর খেয়াল হলো নিজের বাড়ির ঠিকানা সে বলেইনি ওই অচেনা যুবককে, বাড়ির গেটের বাইরে সেই নেম প্লেট টা চোখে পড়লো, খুলে নিয়ে নামটা পড়ার চেষ্টা করলো, সম্ভবত খুব পুরোনো হওয়ার কারনে নামটি একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কিছুই পড়তে পারলো না। দরজা খুলতে গিয়ে মাটিতে পায়ের কাছে একটা কিছু অনুভব করতে পারলো। তুলে নিয়ে দেখলো তার নেম প্লেট টা, কিন্তু একি! এতো রক্ত লেগে, তাজা রক্ত তখনো জমাট বাধেনি। দুটো নেম প্লেট ই একসাথে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল সে। সকালের সেই মঙ্গলঘট তখন দরজার কাছে উল্টে পড়ে রয়েছে। কৃতিকা ঘরে যেতেই দরজা টা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেল। ঘরে ঢুকতেই সে টের পেল এক মিষ্টি সুগন্ধে ভরে রয়েছে ঘরটা, খানিকটা আতরের মত গন্ধ, কিছুক্ষণ আগের সেই যুবক, তার কাছেও এরকম সুগন্ধি অনুভব করেছিল, মনে পড়ে কৃতিকার। হঠাত্ই অজানা কোনো আশঙ্কা চেপে ধরে তাঁকে। অন্ধকার ঘরে  দেওয়াল হাতড়ে খুঁজতে থাকল সুইচবোর্ড । সুইচবোর্ড খুঁজে পেতেই লাইট জ্বালানোর চেষ্টা করতেই সুইচবোর্ডের উপর অন্য একটি হাতের ঠান্ডা স্পর্শ অনুভব করল সে।ভয়ে হাত পা অবশ হয়ে আসছিল তার, কোনো মতে নিজেকে সামলে নিয়ে দরজার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলো সে, কিন্তু কই দরজা? এখানেই তো থাকার কথা। দেওয়াল হাতড়ে দরজা খুঁজে যেতে থাকলো সে, কিন্তু পেল না, চারিদিকে যেন শুধুই ইটের দেওয়াল।মরিয়া হয়ে ছুটে পালাতে চাইলো সে, কিন্তু কিসে যেন ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল , ঘুটঘুটে অন্ধকার চারিদিকে, কিছুই চোখে পড়ে না। এদিক ওদিক হাতড়ে বোঝার চেষ্টা করছিল, তখনই একটা ঠান্ডা হাত তার হাত টাকে শক্ত করে ধরে ফেললো। প্রাণপণে চেষ্টা করছিল কৃতিকা নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার, কিন্তু কোন লাভ হল না ।

অদৃশ্য সেই হাতে অসম্ভব জোর তার

হাত ক্রমশ অবশ হয়ে আসছিল, তারপর চেতনা হারালো সে।ক্রমাগত কাঁচে ঠক ঠক করার মতো শব্দে চোখ মেলে তাকায় কৃতিকা, আশ্চর্য হয়ে দেখলো নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে সে, কিভাবে এখানে এলো ভাবতে ভাবতে চোখ গেল ঘরের জানালার দিকে, সব কটি জানালাই কাঠের, তবে সেই শব্দ কিসের ছিল? আবার সেই কাঁচে ঠক ঠক করার শব্দ পেল সে, শব্দটা অনুসরণ করতেই তাঁর সমস্ত শরীর হিম হয়ে এলো,  শব্দটা আসছিল ঘরের আয়না থেকে। আয়নার দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সে, আয়নার কাছে পৌঁছাতেই সেখানে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল , শব্দটা তখন ধীরে ধীরে কমছে। ফিরে আসছিল তখনই একটা শব্দে আবার থমকে দাঁড়ালো কৃতিকা, কেউ যেন ডাকছে। কাছে গিয়ে দেখলো ওর নিজের প্রতিবিম্বই ওকে ডাকছে, কিছু বলতে চাইছে। এগিয়ে গিয়ে আয়নায় হাত রাখতেই প্রচন্ড শব্দে তা ভেঙে গিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো কাঁচের টুকরো। ভয়ে আর্তচিৎকার করে উঠলো সে। কৃতিকা নিজের খুব কাছে সেই সুগন্ধির উপস্থিতি টের পাচ্ছিল। গন্ধটা যেন ক্রমে আরও কাছে আসছিল তার, এরপর একটা ঠান্ডা নিশ্বাস অনুভব করলো নিজের কাঁধের উপর।..পরদিন সকালে নীরা আসে কৃতিকার বাড়ি, একসাথে অফিস যাবে বলে, অনেক ডাকাডাকির পরও কোনো সাড়া না পাওয়ায় লোক জড়ো করে নীরা, দরজা ভাঙ্গা হয়, বাড়ির ভিতর বিছানার উপর পড়েছিল কৃতিকার নিথর দেহটি।দরজার বাইরে নেম প্লেটে তখন উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে একটা নাম "শুভায়ু ব্যানার্জি"।

(শেষ)

জুঁই দাশগুপ্ত

No comments:

Post a Comment