এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

শ্যামশ্রী রায় কর্মকার



বড়ো গল্প




বেমানান

বেরিয়ে যাও বলছি! বেরিয়ে যাও! আর একমূহুর্ত এবাড়িতে থাকবে না।
প্রকাশের চিৎকারে কেঁপে ওঠে তানিয়া। কান গরম হয়ে ওঠে। সারাজীবনে কেউ তার সাথে এভাবে কথা বলেনি। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে ছেলের গা। তানিয়া ছেলেকে বুকে চেপে ধরে । তারপর আলনার হুকে টাঙানো শান্তিনিকেতনী ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে চৌকাঠের দিকে পা বাড়ায়। শাশুড়ি ছুটে আসেন-
কী করছ বউমা! জানই তো ওর চণ্ডালে রাগ। তুমি এঘরে এসে বসো দেখি!
চোয়াল শক্ত হয়ে যায় তানিয়ার। বুকের ভিতর জলের কল্লোল শুনতে পায় । আর একটু হলেই সেটা বুক ঠেলে চোখে উঠে আসবে। শাশুড়ি দুহাতে জড়িয়ে ধরেন তাকে ।শাশুড়ির ঘরের দিকে পা বাড়াতেই এক শতাব্দীর বৃষ্টি এসে ঝাপসা করে দেয় চারপাশ। তানিয়ার বুকের ভিতরকার কল্লোল প্রবল বেগে উপচে পড়ে দুচোখ বেয়ে।
শাশুড়ির ঘরে বসে বসে পুরনো কথা মনে হয় তানিয়ার। বিয়ের কথা। ইতিহাসে এম এ করার পর স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় বসেছিল তানিয়া। ভালই হয়েছিল পরীক্ষাটা। অবশ্য তানিয়ার পরীক্ষা কোনদিনই খারাপ হত না। স্কুলে প্রথম পাঁচজনের মধ্যেই র‍্যাঙ্ক ঘোরাফেরা করত। কলেজে বা ইউনিভার্সিটিতে গিয়েও খুব একটা অধঃপতন হয়নি। ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছা ছিল স্কুলে পড়াবার। তাই নেট না দিয়ে এস এস সি র কথাই ভেবেছিল। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল, মাঝখান থেকে বড়জেঠু এসে সব গোলমাল করে দিলেন।
দারুণ একটা সম্বন্ধ এনেছি রে মহেন! এক্কেবারে পাল্টিঘর। বনেদী জমিদার। বিরাট জমিজায়গা। রানী হয়ে থাকবে মেয়েটা।
বাড়িতে হইহই পড়ে গেল। প্রকাশের ফরসা সুন্দর চেহারা তার বিরাট প্লাস পয়েন্ট।তানিয়াকে কালো বলত না কেউ। দাদু বলতেন, ছায়াস্নিগ্ধ রূপ। চশমার আড়ালেও তার ছায়ানিবিড় চোখের মায়া ধরা পড়ত অনেকের চোখেই। তবু সবার মনে হল, অনেক ভাগ্য করে প্রকাশের মত জামাই পাওয়া গেছে।
তানিয়া জিজ্ঞেস করেছিল, উনি কতদূর পড়াশোনা করেছেন জেঠু?
অন্য কেউ হলে সুরেন মজুমদার একথার উত্তর দিতেন না। কিন্তু এই নদীর মত শান্ত মেয়েটিকে ভারী স্নেহ করতেন তিনি।
তোমার মত অতটা পাশ দেয়নি মা। তবে খুব করিৎকর্মা ছেলে। অল্প বয়েসেই বাবাকে হারিয়েছে ছেলেটা। কলেজে ঢুকেও তাই আর এগোতে পারেনি। বড়ভাই ব্যবসার কাজে বাইরে থাকত। তাই সব কিছু ওর ঘাড়ে গিয়েই পড়েছিল। খুব মান্য করে সবাই ওকে। বিচক্ষণ ছেলে।
এর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করা স্বভাবে ছিল না তানিয়ার। পাত্রের ভালত্ব মাপার মাপকাঠি সম্বন্ধে আপত্তি ছিল একটু। তবে ভরসা ছিল বাড়ির সবার উপর। শুধু মা বলেছিল, শহরে মানুষ হয়েছে মেয়েটা। গাঁ গঞ্জে গিয়ে মানিয়ে নিতে পারবে তো?
এত শান্ত মেয়ে তোমার বউমা! এত লক্ষ্মী। ও না পারলে আর কে পারবে বল দেখি!
একটু সময় পেলে ভাল হত দাদা। মেয়েটা তো মনের দিক থেকে তৈরী নয় এখনো! মা খুব সাহস করে বলেছিলেন কথাগুলো।
বিয়ে শাদির ব্যাপারে বাড়ির বড়রা যা ঠিক করে, তাই হয় বউমা! অত আধুনিক হওয়াও ভাল নয়।
অত আধুনিক হওয়া ভাল নয়। ঠিক এই কথাটাই তানিয়া শুনে আসছে বিয়ে হওয়া ইস্তক। যা কিছু তানিয়ার কাছে সহজ স্বাভাবিক, প্রকাশের চোখে সেটাই বাড়াবাড়ি রকমের আধুনিকতা। অথচ প্রথম দর্শনে শ্বশুরবাড়ির এই গ্রামটি ভারী মন টেনেছিল তানিয়ার।
তাজপুর গ্রামটি মায়াময় সৌন্দর্যে ঘেরা। চারদিকে নারকেল সুপারির পাতা ঝমঝম করছে। বাসরাস্তা থেকে বাঁ পাশের মেঠো রাস্তায় নেমে গেলেই দুপাশে বিরাট পুকুর। বর্ষাকালে এপুকুরের জল উপচে ও পুকুরে গিয়ে গড়ায়। পুকুর পেরিয়ে যতদূর চোখ যায়, ধানক্ষেত আর ধানক্ষেত। মাঝে আলগা ইঁটের রাস্তা। বর্ষায় সেই পথে চললে পোশাক আসাকে মাটিয়ালি আলপনা আঁকা হয়ে যায়। ক্ষেত ফুরালেই ইতস্তত কয়েক ঘর দরিদ্র মানুষের বসত। প্রকাশের বাড়ি গাঁয়ের ঠিক মাঝখানে। কয়েক বিঘা জুড়ে তাদের বিরাট বাগান। বাগানের মাঝখানে বিরাট দোতলা বাড়ি।তবে পুরনো আমলের। বোঝা যায়, একসময়ে অনেক লোকজনের আনাগোনা ছিল। এখন সলতে নিভে এসেছে। মূল বাড়ির পিছন দিকে রান্না আর খাওয়ার ঘর। সেও ছোটখাটো একটা একতলা বাড়িই বলা যায়। রান্নাঘরের পাশ দিয়ে আরও কিছুটা গেলে বাথরুম। বাড়ির আরেক পাশে সার দিয়ে বিভিন্ন রঙের গাঁদাফুলের গাছ, গোলাপের ঝাড়। তারপর একটা ছোট মত রোদসোহাগী পুঁইমাচা। মাচা পেরিয়ে বিরাট কালো পুকুর। পুকুরের চারপাশে বেড় দিয়ে তাল,সুপারী আর নারকেল। তানিয়া এখনও গোটা বাগান ঘুরে শেষ করতে পারেনি। বেশি দূর যাওয়া যায় না একা। গা ছমছম করে।
তানিয়ার বিয়ের সময় ঘোর গ্রীষ্ম। ফুলশয্যার আগের দিন সন্ধ্যায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিভোর হয়ে চাঁদ দেখেছিল তানিয়া। বকুল গাছের আড়াল থেকে চাঁদ একটু একটু করে প্রবেশ করেছিল তার বিবাহিত জীবনে। সেদিনের সেই চাঁদ আর বকুলগাছ না থাকলে দশ বছরের বড় গুরুগম্ভীর প্রকাশকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে তার অনেক সময় যেত। অদ্ভুত একটা ইচ্ছে তাকে পেয়ে বসেছিল সেই সন্ধ্যায়। খোলা চাঁদের নীচে বকুল বিছানো মাটিতে ফুলশয্যা পাতার ইচ্ছে হয়েছিল। যেন পৃথিবীতে তারা দুজন ছাড়া আর কারও অস্তিত্ব নেই। ঘরবাড়ি তখন আত্মীয় স্বজনে জমজম করছে। প্রকাশকে মুখফুটে বলা হয়নি এই আজগুবি ইচ্ছের কথা। এখন মনে হয়, না বলে ভালই করেছিল। প্রকাশ হয়তো বউয়ের এই বদখেয়াল সহ্য করতেই পারতো না।
বিয়ের কদিন পরেই তানিয়া টের পেল, এত বড় বাড়িতে কাজের লোক বলতে এক বনমালীদা ছাড়া আর কেউ নেই। বাগানের কাজ থেকে শুরু করে নানা ফাইফরমাশ খাটতে তার জুড়ি নেই। শুধু ভিতর বাড়ির দায়দায়িত্ব শাশুড়ি আর বউমার কাঁধে। কাঁসার বাসনে খাওয়ার চল এবাড়িতে। শাশুড়ি চান না, অন্য কারও হাতে পড়ে এসব নষ্ট হয়। প্রথম প্রথম বেশ অসুবিধা হত। শাশুড়ি হয়তো তাকে বললেন, পুকুরপাড়ে গিয়ে বাসন কটা মেজে নিয়ে এসো তো বউমা! ওই একতাড়া বাসন পুকুরপাড়ে নিয়ে যেতে সে হিমশিম খেয়ে যেত। এখন অবশ্য তেমন অসুবিধা হয় না। তার শাশুড়ি খুবই কর্মঠ। ভোর হতে না হতেই সব্জীপাতি কেটে কুটে রেডি করে ফেলেন। মাছ কাটা, মশলা করা... সবই করে ফেলেন দশভূজার মত। তানিয়ার কাজ উনুনে আগুন দেওয়া, রান্না করা। আজন্মকাল শহরে মানুষ হওয়া তানিয়া উনুন ধরাতে,কাঠের জ্বালে রান্না করতে নাজেহাল হয়ে যেত । চশমা পরে রান্না করে বলে আশেপাশের বাড়ি থেকে প্রতিবেশিনীরা উজিয়ে আসত নিন্দা করতে। উনুনের ধোঁওয়ায় চশমা ঝাপসা হয়ে যায়, বারবার মুছতে হয়... অতএব আধকানা বউ কী রাঁধতে কী রেঁধে বসবে, সেই আশঙ্কায় প্রতিবেশিনীরা শাশুড়ির কাছে নিয়ম করে দরবার করত। শাশুড়িও চিন্তায় পড়তেন। বুঝতেই পারত তানিয়া। তবে তাকে কোনদিন কিছু বলতেন না। তানিয়া প্রাণপণ নিখুঁত থাকার চেষ্টা করত, প্রতিবেশিনীদের দেখলে চশমা খুলে রাখবে কিনা ভাবত... কিন্তু সাহস পেত না। বিনা চশমায় ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ির ভেতরটা গরম কুয়াশার মত দেখায়।
প্রকাশ গাঁয়ের গণ্যমান্য ব্যাক্তি। তার কথায় আর পাঁচটা মানুষ ওঠে বসে। নির্বিরোধ আনুগত্য পাওয়াই তার অভ্যাস। নতুন বউও তার কথায় উঠবে বসবে, এমনটাই আশা করেছিল সে। কিন্তু এই অদ্ভুত মেয়েটিকে সে ঠিক কব্জা করে উঠতে পারছিল না। তানিয়া উচ্চশিক্ষিত। এটা তার ভাল লাগে। কিন্তু সব ব্যাপারে নিজের মতামত দেওয়ার বদভ্যাসটি মেনে নিতে পারে না। জমিদারবাড়ির বউ হয়ে আদাড়ে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানোও তার নাপসন্দ। হোক না নিজেদের বাগান, তবু ছেলে ছোকরারা তো ফল পাকুড় নিতে যখন তখন ঢুকে পড়তেই পারে। তানিয়াকে এইসব যুক্তি দেখিয়ে প্রকাশ অনেক বার বাগানে যেতে বারণ করেছে। এটুকু বোঝেনি, যে এবাড়িতে বাগানের ফুল পাতার গন্ধ, ভিজে মাটির হাতছানি, পুকুরের কালো জলে ভেসে যাওয়া কাগজ ফুলের সারিই কেবল তানিয়াকে বুকঝিম ভালবাসার আস্বাদ দেয়।  
প্রতিদিন প্রকাশ খেয়ে দেয়ে সকাল দশটার মধ্যে বার হয়ে যায়। তানিয়াকে সাতসকালে উঠে উনুন ধরিয়ে ডাল ভাত মাছের ঝোল রান্না করে ফেলতে হ্ত। মাছ তাদের পুকুরের।ভোর ভোর জাল ফেলে বনমালীদা মাছ ধরে দিত। এখনো দেয়। ওইটুকু রান্না করতেই তানিয়া হিমশিম খেয়ে যেত তখন। কাঠের উনুনের মতিগতি সে ঠিক বুঝে উঠতে পারত না। কখনো ভাতে পোড়া লাগে তো কখনো তরকারি আধসেদ্ধ থেকে যায়। প্রকাশ খেতে বসলেই তানিয়ার বুক দুরদুর করত।এই বুঝি থালা ঠেলে উঠে যায় প্রকাশ, এই বুঝি জল ঢেলে দেয় পাতে।   
অথচ বিয়ের আগে তানিয়ার রান্না নিয়ে কোন সমস্যা ছিল না। বড়জেঠু এসেই হাঁক পাড়তেন, তানি মা! কোথায় গেলি! এই দেখ ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছি। আজ তোর হাতে পাতুড়ি খাব।
বন্ধুদের ছোটখাটো পিকনিকেও তানিয়ার রান্নার কদর ছিল। পিকনিকের হিসাবপত্র দেখার ভারও তানিয়ার। বাবার ট্যাক্সের হিসেব তো তানিয়াই করে দিত।
বিয়ের পর তার সেইসব গুণগুলোই কেমন করে যেন দোষ হয়ে গেল। বিয়ের পর প্রথমবার যখন বড় ভাসুর এসেছিলেন, সাথে বড় জা আর তাদের পাঁচ বছরের বাচ্চাটা...  ওনারা আসতেই তানিয়া চা করে দিয়েছিল। সাথে গরম গরম পরোটা আর সাদা আলুর চচ্চড়ি। বড় ভাসুর বহুবছর বাইরে থাকেন। ব্যবসা করেন। এসেই ব্যবসাপাতি,জমিজিরেত নিয়ে জমিয়ে গল্প ফেঁদে বসলেন। শুনতে বেশ লাগছিল। এবাড়িতে তার সাথে বেশি কথা বলার লোক নেই। সবাই যেন পরচর্চা নিয়েই মেতে আছে। বড়ভাসুরের গল্পগুলো একটু অন্য স্বাদের।  অচেনা জায়গা, অচেনা মানুষজনের গল্প। তানিয়া বুভুক্ষুর মত সেইসব গল্প গিলছিল। হঠাৎ বড় জা বললেন, “কিরকম বেয়াক্কেলে মানুষ গো তুমি! ভাসুর কথা বলছেন, আর তুমি হাঁ করে তাই গিলছ! বলি লজ্জার মাতা খেয়েছ নাকি! কই, আমার সাথে তো এককানা কথাও বলতে শুনলাম না। কি ঢলানি মেয়েছেলে রে বাবা!”তানিয়া চমকে উঠেছিল। কী বিশ্রী ভাষা এদের মুখে! কী নীচ মনোভাব! প্রকাশ সামান্যতম প্রতিবাদও করেনি সেদিন। তানিয়ার আর কথা বলতে প্রবৃত্তি হয়নি ওই মহিলার সাথে। বড় ভাসুর বলেছিলেন, “শহরের মেয়েরা অমন ধারাই হয়। তুমি কি কিছুই শেখোনি বউমা! লোকের সাথে কি ব্যবহারটা কত্তে হয়, সেটুকুনও শেখায়নি তোমার বাপের ঘরে। আর বলি এটা কি পরোটা হয়েছে হ্যাঁ?ধোঁওয়ার গন্ধে মুখে দেওয়া যায়না!” বাঁ হাত দিয়ে প্লেটখানা ঠেলে দিয়েছিলেন বড় ভাসুর। ঠনঠন শব্দে গড়িয়ে গেছিল প্লেটটা। পরোটা ছিটকে পড়েছিল তানিয়ার পায়ের কাছে। বড় ভাসুরের বাচ্চা ছেলেটা ঘাবড়ে গিয়েছিল। সতর্ক গলায় ডেকে উঠেছিল, “বাবা!” প্রকাশ পরোটাটা তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল বাইরে। হিসহিস করে উঠেছিল, “কুকুরেও মুখ দেয় না এই সব রান্নায়”। তানিয়া চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। প্রকাশের উগ্র মূর্তির দিকে তাকাতে পারেনি।
বিয়ে হওয়া ইস্তক তানিয়া দেখে আসছে, সে আসলে কিছুই পারে না। না পারে রান্নবান্না, না পারে স্বামীর মন জুগিয়ে চলতে। আত্মীয় স্বজন থেকে পাড়া প্রতিবেশী, এতগুলো মানুষ যখন তার চরিত্রে এত এত ত্রুটি খুঁজে পাচ্ছে... সে নিশ্চয় একটা অপদার্থই হবে। স্কুল কলেজে দিদিমনিদের খুব প্রিয় ছিল তানিয়া। বন্ধুরাও কোন অভিযোগ করেনি কোনদিন। কেন করেনি, সেটা ভেবে আশ্চর্য লাগে তানিয়ার। রাগ হয় বাবা মায়ের ওপর। কেন কেউ কোনদিন তার ভুলগুলো ধরিয়ে দেয়নি?
এর মধ্যেই প্রকৃতির আশ্চর্য নিয়ম খেটে গেল তার ওপর। প্রকাশের ভালবাসাহীন আশ্লেষ আর তার সমর্পণ তার গর্ভের ভিতর তিলতিল করে স্পন্দিত হতে লাগল।প্রকাশও কি নরম হয়ে পড়ছিল একটু? আসন্ন পিতৃত্ব তার প্রবল কাঠিন্যে চিড় ধরাতে শুরু করেছিল। পৃথিবীটা অন্যরকম হয়ে উঠছিল তানিয়ার চোখে। প্রকৃতির নিস্তব্ধ সুরটুকুও ধরা দিচ্ছিল তার কানে।
মা খবর পেয়ে যখন তাজপুর এলেন, তানিয়া তখন পুকুর পাড়ে বাসন মাজছে। এক জোড়া নীলবর্ণ প্রজাপতি হলুদ ফুলের ঝোপের মাথায় ওড়াওড়ি করছিল। তানিয়া বাসন মাজা থামিয়ে প্রজাপতির নীল দেখছিল নিবিষ্ট দৃষ্টিতে। আরও এক নির্বাক দর্শকের আগমন হয়েছিল সেখানে। তানিয়ার ঠিক পিছনে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে একটি সাপিনী গর্ভিনী মানুষীর খেয়াল পর্যবেক্ষণ করছিল। মা পিছন থেকে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, “সাপ! সাপ!” তানিয়া মায়ের গলা পেয়ে সটান উঠে দাঁড়িয়েছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল সাপিনী ছোবল মেরেছিল সামনের দিকে। তানিয়ার পা এড়িয়ে সেই ছোবল গিয়ে পড়েছিল বাসন মাজার শানের উপর।  
আর একমূহুর্তও এখানে নয়। এখনি নিয়ে যাব তোকে।
তুমি তো জেনে বুঝেই বিয়ে দিয়েছিলে মা! গাঁ গঞ্জে সাপখোপ থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক!
স্বাভাবিক। তবে জমিদার বাড়ির বউকে পোয়াতি অবস্থায় পুকুর পাড়ে বাসন মাজতে হওয়াটা স্বাভাবিক নয় তানি। তর্ক করিস না মুখেমুখে। আমি তোকে নিয়ে যাবই।
তানিয়ার বুকটা কেমন করে ওঠে। ধরা ধরা গলায় বলে, “যাব না”।
গভীর একটা শ্বাস ফেলেন তানিয়ার মা। বলেন, “ বুঝতে পারিনি রে সোনা। তোর জেঠুর ওপর তো কথা বলিনি কোনদিন। ভরসা করেছিলাম। কপালে যা থাকে, তা কে খণ্ডাবে বল! এ আমাদের কপাল”।  
বাগবাজারে বাবা মার কাছে ফিরে গিয়ে তানিয়ার মনে হয়, সে যেন কেমন বেমানান হয়ে গেছে এবাড়িতে। ঘুমের মধ্যে প্রায়ই একটা নিষ্পত্র বটগাছ দেখতে পায় তানিয়া। বটের ডালপালাগুলো ক্রমশ এগিয়ে আসে তার দিকে , বেষ্টন করতে চায় তার অস্তিত্ব। দূরে নদীর বুকে মাঝিমাল্লাহীন একটা নৌকা ভাসতে দেখে প্রতিদিন। তানিয়ার মনে হয়, ওই নৌকা তার জন্যেই অপেক্ষা করে আছে। যত দিন যায়, নৌকাসমেত নদী আরও এগিয়ে আসে তার কাছে। সে একপাও নড়তে পারেনা। যতদিনে নদীর জল তার কণ্ঠ স্পর্শ করে, ততদিনে সে পূর্ণ গর্ভা। এর মধ্যে একদিনও প্রকাশ তাকে দেখতে আসেনি।
তখন সদ্য বিবানের জন্ম হয়েছে। হাসপাতাল থেকে বাড়ি এসেছে তানিয়া। বিভাবতী দেখলেন, ছেলেটা খিদেয় কাঁদছে।
তানি! ও তো কেঁদে সারা হল! ওকে খাওয়া!
ও কে মা? আমি তো চিনতে পারছি না!
কী বলছিস তানি! ও তোর ছেলে!
ও কেউ না আমার! কেউ না! নিয়ে যাও ওকে এখান থেকে! চিৎকার করে উঠেছিল তানিয়া।
বিভাবতী ভেবেছিলেন, সন্তান জন্মের পর অনেক মায়েরই এমন হয়। কদিন গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তা হল না। বিভাবতী লক্ষ্য করলেন, মেয়ে সারারাত জেগে থাকে। আতিপাতি করে সন্তানের মুখ দেখে।
কী দেখিস মা!
আমার সাথে কোন মিল নেই মা! দেখো! ওকে ভুল করে নিয়ে এসেছি। চল ফেরত দিয়ে আসি।
কী যা তা বলছিস! ধমকে ওঠেন বিভাবতী। ও তোর সন্তান! নিজের ছেলেকে চিনতে পারছিস না?
হা হা করে হেসে ওঠে তানিয়া। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে বিছানার ওপর। তুমি কিচ্ছু জান না মা। আমি তো কিছুই পারি না। সবাই বলে। আমি মা হব কেমন করে!
তারপর হঠাৎ বিছানা থেকে উঠে আসে মায়ের কাছে। এত ব্যাথা কেন মা! সোজা হতে পারি না।পেটে লাগে কেন এত? বুকে দানা দানা কী জমে আছে বল তো! ও মা! আমি কি মরে যাচ্ছি!
বিভাবতী জড়িয়ে ধরেন মেয়েকে। কী বলবেন তিনি! কীভাবে বোঝাবেন! নাতিকে কৌটোর দুধ গুলে খাওয়ান। সারা রাত হাত বুলিয়ে দেন মেয়ের মাথায়। তানিয়া ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়ে। মানুষ প্রবৃত্তির দাস। ঘুমের ঘোরেই ছেলের নড়াচড়া টের পেয়ে ছেলের মুখে মাতৃত্বের আশ্বাস গুঁজে দেয় তানিয়া। বেলার দিকে বিভাবতী এসে দেখেন বুকের কাছে শিশু সন্তানকে নিয়ে হাক্লান্ত মুখে ঘুমিয়ে আছে তাঁর মেয়ে।
বিভাবতী টের পান, তাঁর সন্তান নিজের সাথে লড়তে লড়তে ক্লান্ত। তাঁর বিছানার লেপকম্বলের মতই অসহায়।নাতির জন্মের পর মাত্র একবার দেখতে এসেছিল জামাই। রাতটুকুও কাটায়নি এখানে। দ্বিধা দ্বন্দ্বে আত্মবিশ্বাসের অভাবে তাঁর আদরের তানি এখন ক্ষতবিক্ষত। বিভাবতী সহজে হেরে যাবার মেয়ে নন। ভেঙে পড়েন না তিনি। নিজেই এপয়েন্টমেন্ট করে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যান মেয়েকে। টানা আটমাসের চিকিৎসায় অনেক সুস্থ হয়ে ওঠে তানিয়া। যদিও ওষুধ তাকে খেতেই হবে সারাজীবন।
এর মধ্যেই স্কুল সার্ভিস পরীক্ষার ফল বেরোয়। পাশ করেছে তানিয়া। একমাসের মাথায় ইন্টারভিউ,তারপর চাকরী। স্কুল বাছতে গিয়ে খানিকক্ষণ সময় নিয়েছিল তানিয়া। বেরিয়ে ফোন করে প্রকাশকে,
আমার চাকরী হয়েছে। আসিসট্যান্ট টিচার। সাতদিনের মধ্যে জয়েনিং।
প্রকাশ পরেরদিন নিতে আসে তানিয়াকে। চল তানিয়া। মা অপেক্ষা করে আছে তোমাদের জন্য।
আর তুমি?
আমি তো নিতে এসেছি। প্রকাশ অল্প হাসে।
হাসলে প্রকাশকে খুব মিষ্টি দেখায়। তানিয়া কয়েক মূহুর্ত তাকিয়ে থাকে সেদিকে।
তুমি কোনদিন প্রেমে পড়েছ ? এ আবার কি প্রশ্ন তানিয়া?
পড়েছ কি?
পড়েছিই তো। নাহলে এলাম কেন?
বিশ্বাস হয় না।
কেন?
এতদিন তো আসনি। খোঁজখবরও নাওনি।
তাতে কী? তুমি তো আমার বউই আছ, নাকি!
সেটা বড় কথা নয়।
উফফ! আবার সেই! কী চাইছ বল তো!
তুমি বোঝাতে পারনি আমাকে।
কী বোঝাতে পারিনি?
ভালবাসা।
ভালবাসা বাইরে থেকে বোঝানো যায় না তানিয়া। এটা তোমার নাটক নভেল নয়। এটা বাস্তব।
বেশ। তবে শোন। আমাকে ভালবাসা খুব কঠিন। আমার মধ্যে অনেক ডিফেক্ট। সেই ডিফেক্ট সারারও কোন সম্ভাবনা নেই। বোঝাতে পারলাম?
আরে! বিরাট বদলে গেছ তো!
বদলাইনি একটুও। তবে চেষ্টা করেছিলাম। তোমাদের বাড়িতে গিয়ে তোমাদের পছন্দমত হবার চেষ্টা করেছিলাম। পারলাম না।তুমি চাইলে একাই ফিরে যেতে পার।
তাতে যে একটা মস্ত অসুবিধা আছে!
কীসের অসুবিধা? তোমার মা?
না তানিয়া। সবচেয়ে বড় অসুবিধা হল, আমার তোমাকে ছাড়া চলবে না। বুঝলে কি!  
তানিয়া চুপ করে থাকে।
মানতে পারছ না , তাই না! বিশ্বাস করে দেখ একবার । ঠকবে না।প্রকাশ দুহাতে আকর্ষণ করে তানিয়াকে। তানিয়া কঠিন হয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর প্রকাশের আদরের কাছে মেলে দেয় নিজেকে।
তাজপুরে ফিরে আসার পর মাস খানেক খুব আনন্দে কেটে যায় তানিয়ার। পাড়াপড়শি ঝেঁটিয়ে আসে বিবানকে দেখতে। সবাই খুব খুশী। সেই খুশীতে তানিয়ার পুরনো খুঁতগুলোও বুঝি ঢাকা পড়ে গেছে। রান্নাবান্না শাশুড়িই করেন। তানিয়া স্কুল যাবার আগে হাতে হাতে সাহায্য করে। প্রকাশকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করে তানিয়া। অনেক প্রগলভ, খোলামেলা প্রকাশ। যে ছেলের দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে হঠাৎ হঠাৎ, গান গেয়ে ওঠে অকারণেই। শুধু তানিয়ার ওষুধ খাওয়াটা নিয়েই আপত্তি। ক্যালশিয়াম খাও, ভিটামিন খাও । ঠিক আছে। ওসব হাবিজাবি ওষুধ আবার কিসের! ও খেতে হবে না। অসুবিধা হলে ঝাড়ফুঁক করিয়ে নিয়ে আসব। প্রকাশ জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দেয় সাইকিয়াট্রিস্টের ওষুধগুলো। তানিয়া পরে আবার সব কুড়িয়ে নিয়ে আসে। এবার লুকিয়ে রাখে আলনার পেছনে পুরনো কাপড়ের বাক্সে।




এরমধ্যে একদিন ধুম জ্বর আসে বিবানের। তানিয়া ডাক দেয় ঘুমন্ত প্রকাশকে। ডাক্তার দেখাতে হবে ছেলেকে। একটা ভ্যানওয়ালাকে যদি বলে দেয় প্রকাশ। প্রকাশ বলে, “ওসব ডাক্তার ফাক্তার কিচ্ছু লাগবে না। স্নান করিওনা ছেলেকে। বনমালীর মা টোটকা জানে। ওকে ডাক দাও, সব ঠিক হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ, ভাত দিও না যেন। বার্লি দিও”। “অতটুকু ছেলে বার্লি খাবে?” তানিয়া ইতস্তত করে। “হ্যাঁ খাবে। তুমিও খেয়েছ ছোটবেলায়।মা খাইয়ে দেবে এখন । তুমি স্কুলে চলে যাও। ” তানিয়ার মন খচখচ করতে থাকে। টোটকা খাওয়াবে ছেলেকে! যদি কিছু হয়! চুপ করে নিয়ে যাবে ডাক্তারের কাছে! যদি রেগে যায় প্রকাশ! দিন দুই কেটে যায়। বনমালীর মায়ের টোটকায় কোন কাজ হয় না। ওদিকে জ্বরে ছেলেটা আরও নেতিয়ে পড়েছে। তানিয়া কি করবে বুঝতে না পেরে মাকে ফোন করে, “মা! ওরা বারণ করছে বিবুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। কী করব আমি?”
ফোনের ওপ্রান্তে বিভাবতী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। “ নিয়ে যা মা, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যা। নাহলে জ্বর কমবে না। তুই একাই নিয়ে চলে যা”। “আমি একাই নিয়ে যাব!”। “যাবি। ভাইকে একাই জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতিস, মনে নেই! বকেঝকে ওষুধ খাওয়াতিস। তোর জন্যেই তো সেরে উঠল ও। ঠিক পারবি। এখনই চলে যা। বেশি বেলা হয়নি”। তানিয়া জোর পায় একটু। শাশুড়িকে বলে, “আমি বিবুকে ডাক্তার দেখিয়ে আনি মা। আপনি চিন্তা করবেন না”। শাশুড়ি বাধা দেন না। বাগান পেরিয়ে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেন বউমাকে। ছেলে কোলে হাঁটতে হাঁটতে তানিয়ার মনে হয়, তার শাশুড়িমাই একমাত্র বাধা দেন না তাকে। এবাড়িতে এই একটা জায়গায়  একটু হলেও স্নেহের ছোঁয়া পায় তানিয়া।

ডাক্তার দেখিয়ে এসে ঘরে ঢুকতেই প্রকাশের ওই চিৎকার। অপমানে এখনও শরীর কাঁপছে তানিয়ার। বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশ অনেকটাই পরিষ্কার দেখাচ্ছে। তানিয়া উঠে পড়ে। ছেলে কোলে নিয়ে নীচু হয়ে প্রণাম করে শাশুড়িকে-
আসি মা।
কোথায় যাবে? প্রৌঢ়ার চোখে আশংকা ডানা মেলতে দেখে তানিয়া।
কলকাতা যাব মা। আধঘন্টা পরেই বাস আছে একটা। পেয়ে যাব।
কাল রবিবার আছে। কাল যেও বউমা। প্রকাশও সঙ্গে যাবে এখন।
না মা। আমি একাই যেতে পারব।
প্রকাশের ওপর রাগ কোরো না মা। ও একটু রগচটা। একটু পরেই রাগ পড়ে যাবে। তখন আকুলিবিকুলি হবে মনটা।
হ্যাঁ হ্যাঁ! যাক যাক!ওসব মেয়ের মুরোদ আমার জানা আছে। প্রকাশ কখন এসে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়েছিল, কেউ লক্ষ্য করেনি।
ওসব মেয়ে বলছ কেন তুমি? কী বলতে চাইছ?তানিয়ার চোয়াল শক্ত হয়ে যায়।
যা বলতে চাইছি, ঠিকই বুখতে পারছ। কার ভরসায় গটগট করে বেরিয়ে যাচ্ছে শুনি! দুদিনে ছিবড়ে করে ফেলে দিয়ে যাবে! তখন এই শর্মাই উদ্ধার করবে তোমাকে।
ছিঃ! এত নোংরা মন তোমার!
শাশুড়ি ছেলেকে থামাতে যান- চুপ কর! ওরে চুপ কর!
তুমি চুপ কর মা। বাড়ির বউকে কিভাবে সিধে করতে হয়, আমার জানা আছে। বনমালী! আমার চাবুকটা নিয়ে এস তো!
একটুও ভয় করে না তানিয়ার। প্রকাশকে একটা ফড়ফড় করতে থাকা আরশোলার মত লাগে। শাশুড়ির হাত ধরে বলে, আসি মা। ভাল থাকবেন।
উঠোনে বনমালীকে হতভম্ব হয়ে  দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তানিয়া। আসি বনমালী কাকা। শরীরের যত্ন নিও।
মাথা উঁচু করে হাঁটতে থাকে তানিয়া। কাঁধের উপর বিবানের শরীরে তখনও জ্বরের তাপ।পিছন থেকে প্রকাশের চিৎকারের শব্দ ক্রমশ মিলিয়ে আসতে থাকে। বিরাট গেটটা পার হতে হতে তানিয়া টের পায়, বুকের মধ্যেকার বিনি সুতোর মালাটা ছিঁড়ে পড়ছে একটু একটু করে।


শ‍্যামশ্রী রায় কর্মকার
পরিচিতি : লেখক, সম্পাদক, কবি ও শিক্ষিকা। প্রকাশিত বই 'বব ডিলান,অন্তহীন যাত্রা', 'বিটলস,বদলের তালে তালে'। বোধ পত্রিকার সাহিত্যপাতা সম্পাদনা করেন, ‘সাহিত্য এখন’ ব্লগজিনের সম্পাদক।

2 comments:

  1. apurba......mon vore galo.......bastab chitrayon.......a je jibo9ner galpo......jiboner jantrana........superb.....

    ReplyDelete
  2. আন্তরিক ধন্যবাদ আপনাকে।খুব ভালো থাকুন।

    ReplyDelete