এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

সমীপেষু দাসের একটি বিশেষ প্রতিবেদন



লোকসংস্কৃতি



বর্তমানে বাংলায় যে বর্ষপঞ্জী প্রচলিত রয়েছে, সেখানে বছরের শেষ মাস হল চৈত্র। জ্যোতিঃশাস্ত্রের মতানুযায়ী এই মাসে চিত্রা নক্ষত্রে পূর্ণিমা হয় বলে এই মাসের এই রুপ নামকরণ।বাংলায় একটি বহুশ্রুত প্রবাদ হল ‘যার শেষ ভালো, তার সব ভালো’।চৈত্র মাসের শেষের দিকে অর্থাৎ সূর্যের মেষ রাশিতে সংক্রান্তির (গমন)।

সময় বাংলার লোকসমাজে, এক উৎসব পালিত হয়, যাকে আমরা বলি ‘চড়ক’ বা ‘গাজন’ উৎসব।পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে মালদহ, বর্ধমান, বাঁকুড়া,দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলায় এই লোক উৎসবের প্রাবল্য ও জনপ্রিয়তা অধিক। তবে এখনও বাংলাদেশের রাজশাহী, ধামরাই, রংপুর অঞ্চলেও এই উৎসব প্রচলিত আছে।একসময় পুরোনো কলিকাতাতেও বিশেষতঃ কালীঘাট এলাকার বাবা নকুলেশ্বরের মন্দির ঘিরে ধুমধামের সঙ্গেই ‘গাজন’ উৎসব পালিত হত।

এই চড়কপুজোর আরাধ্যা দেবতা নিয়ে ঐতিহাসিকদের গবেষণাকক্ষে বহু সুক্ষ্ম চিন্তা বুদ্ধির জারণ – বিজারণের মত অনবরত বিক্রিয়া চলছে। মোটের ওপর ভিত্তি করে আমরা এই উৎসবকে ‘শিবের গাজন’ বলতে পারি, কারণ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে রাঢ়বঙ্গে ‘ধর্মের গাজন’ বা ‘ধর্মপুজা’ বা কথ্য ভাষাতে ‘ধরম পুজো’ ঘটতে দেখা যায়।চৈত্র  সংক্রান্তির ঠিক আগের দিনেই গৃহস্থী রমণীরা ‘নীলষষ্ঠী’ র ব্রতপালন করে সন্ধ্যাবেলায় কোনও শিবমন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়ে আসে। এই ব্রতকথার গল্পেও বারাণসী তীর্থের প্রসঙ্গ রয়েছে।

বৈদিক সাহিত্য থেকে পৌরাণিক যুগ পেরিয়ে বিভিন্ন লোককথা – উপকথাকে আশ্রয় করে ভগবান শিব বিভিন্ন রূপে আমাদের কাছে ধরা দিয়েছে। কখনও তিনি যোগমুদ্রায় তপস্যারত, কখনও তিনি ‘ব্যাধ’, কখনও তিনি অরণ্যশ্বাপ।

রক্ষাকর্তা হয়ে ‘পশুপতি’, কখনও নরকপালধারী শ্মশানচারী, কখনও নর্তকরুপে ‘নটরাজ’, আবার কখনও বা  জগতের সংহারকর্তা। অনার্য সংস্কৃতি থেকে আগত এই শিবের মধ্যে যেমন মঙ্গল মূর্তি রুপও রয়েছে, তেমনই প্রলয়ঙ্করস্বরূপও পূর্ণযাত্রায় বিদ্যমান। তিনি যেমন আদর্শ প্রেমী , তেমনই নৃত্যকুশলী নটনাথ ।

শিবের  নৃত্যকলার মধ্যে ‘তাণ্ডব’ ও ‘নাদন্ত’- এই দুটিকেই লক্ষ্য  করি আধুনিক কালে ‘তাণ্ডব’ নৃত্য বলতে পুরুষদের উদ্ধতনৃত্যকে বুঝলেও একসময়ে তা ছিল অত্যন্ত সুকুমার কলা। ভরতমুনির ‘নাট্যশাস্ত্র’ গ্রন্থের বিধানানুসারে তন্ডুমুণি কর্তৃক উদ্ভাবিত নৃত্য হল ‘তান্ডব’ (৪/২৭২-৭৩)।মধ্যযুগে ষোড়শশতকে শ্রীচৈতন্যের সময় পর্যন্তও এটি দেব পুজা বা বন্দনা –উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হত। ‘শ্রী ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে মহাপ্রভুর ভাবনৃত্যকে ‘তান্ডব’ –ই বলেছেন কৃষ্ণদাস কবিরাজ মহাশয়-

   এইমত তাণ্ডবনৃত্য কথোক্ষণ।(২/১৩/১৬৭) তবে সর্ব ক্ষেত্রেই এই মতটিকে যে স্বীকার হত এমনটা কিন্তু ন্য।এর কারণ খৃস্টীয় দশম শতাব্দীতে ধনঞ্জয়ের ‘দশরুপ’ গ্রন্থেই ‘তান্ডব’ –কে ঔদ্ধত্যের পর্যায়ে রাখা হয়েছে(১/১০)।

‘গাজন’ –ও বাংলার গ্রামীণ মানুষের নৃত্যগীতে আনন্দমুখর এক উৎসব। সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত মানুষদের অন্তরে রয়েছে যেমন শিবঠাকুরের প্রতি অবিচল নিখাদ ভক্তি, তেমনই তারা পুজার উপাচারের মধ্যে নৃত্যকলাকেও রেখে দেয়।কিন্তু সচরাচর নৃত্যপরিবেশন বলতে আমরা যে ছবি মনে মনে কল্পনা করে রেখেছি, এখানে তার ব্যাতিক্রম ঘটে। এই নৃত্যগীত কোনও পূর্বপরিকল্পিত সুষ্ঠু সুবিন্যস্ত উপস্থাপনা নয়, বরং এখানে রয়েছে ভয়ানকতা ও বীভৎসতা।শব,নরকঙ্কাল,করোটি-এগুলি উপকরণরুপে ব্যবহার করে শ্মশান সন্ন্যাসীরা উদ্দাম নৃত্য করে থাকে। আবার ‘মশাননাচা’, ‘কালীনাচ’- এগুলিও দেখতে পাই।

এই নৃত্যে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা কোনও প্রসিদ্ধ শিল্পী নন ।এরা চড়কের সংকল্পধারী ভক্তা।সারা চৈত্রমাস জুড়ে সাত্ত্বিক আচার আচরণ পালন করে। তবেই এই উৎসবে যোগদান করে। তাৎক্ষণিকভাবে স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিমায় এই তান্ডবনৃত্য ছলে।হরিদাস পালিত মহদয়ের ‘আদ্যের গম্ভীরা’ গ্রন্থে বরেন্দ্রভূমি অঞ্চলের নিম্নবর্গের মানুষদের চড়কপুজায় অংশগ্রহণের একটি চিত্র পাই-“প্রত্যেক নৃত্যবাদ্য শ্রবণে আপন আপন নৃত্য আরম্ভ করে। সেই নৃত্য তান্ডব –নৃত্য, উহা বিকট চিৎকার সহকারে সম্পাদিত হয়।“

এইসব নৃত্যে পোষাক –পরিচ্ছদ, রূপসজ্জা, কেশমার্জনায় পরিমিতিবোধের যথেষ্ট অভাবের চিহ্ন ফুটে ওঠে । এর পিছনে যেমন আর্থিক দৈণ্যতা একটা হেতু, তেমনই ঔচিত্যজ্ঞানের হীনতা ও একটি সরল কারণ।শিব,কালি,হনুমান,নরসিংহ প্রভৃতির পোষাক হয় কোনও না কোনও যাত্রাদলের উচ্ছিষ্ট ও পরিত্যক্ত বস্তু।অঙ্গরচনার ব্যাপারেও দেহে চুনের ফোঁটা,ভুসো কালি,আলতা,পাউডারের ব্যবহার করা হ্য।কোনও মহিলাশিল্পী ‘কালীনাচ’-এ অংশ নেয় না;পুরুষরাই সবধরনের স্ত্রীচরিত্রে রূপদান করে।পূর্ব বর্ধমান জেলার কুড়মুন গ্রামে চড়ক উৎসবের এই দৃশ্য খুবই সুলভ।

চড়ক-উৎসবের মূলদিনে যেমন কিছু রক্তক্ষয়ী কৃছসাধনের দৃষ্টান্ত পাই, যেমন-বাণফোঁড়া, আগুনে,কাঁটায় ঝাঁপ দেওয়া প্রভৃতি;তেমনই একদা মালদহের চড়ক পুজার চতুর্থদিনে সূর্যোদয়ের পূর্বে ‘মাশাননাচা’(বা ‘মশাননাচ’)সাধারণ শহরবাসী মানুষের মনে ভীতির  সঞ্চার করত।দীর্ঘ আলুলায়িত কেশ,কপালে সিঁদুর মাখা,হাতে শাঁখা-পলা এমন এক ভুমিকা ‘মশান’।

অনেকটা শ্মশানকালীর সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যেতে পারে। ধুনুচিতে জ্বলন্ত ধুনোর সামনে অঙ্গাবিক্ষেপ করে এই নাচ চলতে থাকত, সঙ্গতে রয়ে যেত ঢাকবাদ্য।

কবি রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের প্রথম অংশে দেবী কালিকার যে স্বরূপকে লেখনীবদ্ধ করেছেন, তার সঙ্গে মশানের একাত্মতার ইঙ্গিত পাই-
গলিতরুধির ধারা মুণ্ডমালা গলে।
গলিতরুধির মুন্ড বামকরতলে।।
প্রতি বছর দীপান্বিতা অমাবস্যায় বা বছরের অন্যান্য পুজা পার্বণে বা মধ্যবিত্তের ঠাকুরঘরেও দেবী কালিকা ভক্তদের থেকে নিত্যসেবা পান। কালীরুপের উদ্ভব ও বিকাশ নিয়ে একাধিক দার্শনিক, তাত্ত্বিকযুক্তি এবং কিংবদন্তী থাকলেও দেবীর বীভৎসরুপেও আমরা সদা প্রনত হয়ে থাকি ।এটি যদি ভক্তিধর্মের পরাকাষ্ঠা হ্য়,তবে ‘কালীনাচ’ বা ‘মশাননাচা’-ও অবশ্যই লোকজীবনের ও লোকবিশ্বাসেরই প্রতিরুপ।

যথার্থ শাস্ত্রসম্মত ‘নৃত্যকলা’-র মানে উন্নীত হতে না পারলেও লোকনৃত্য হিসেবে এটি উপভোগ্য।

তেমনই দুর্গন্ধযুক্ত শবদেহ বা নরকঙ্কাল হাতে নিয়ে ঢাক,কাঁসি,বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে নৃত্যাত্মক শোভাযাত্রার-ও একটি গুরুত্ব আছে ও তার রসযুক্ত।

স্থূলবুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে গেলে বিভিন্ন সংস্কৃত মহাপুরাণ,উপপুরাণ বা বাংলার মঙ্গলকাব্যের বিবৃতির নিরিখে বলতে হবে যে যেহেতু শিব শ্মশানচারী,তার অনুচরেরা ভূত-প্রেত, তিনি নেশাগ্রস্ত এবং বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে তান্ডবনৃত্য করেন, তাই শিবভক্তরাও শবনৃত্য করবে-এতে বিরোধ বা অন্যায়ের কোনও সংস্পর্শ নেই।
কিন্তু এটি কোনও সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া নয়।মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যে যে শিবের আখ্যান পাওয়া যায়, সেখানে ভক্তিরসের চেয়েও সমকালীন সমাজজীবনের প্রতিলিপির সন্ধানই যুক্তিসঙ্গত। সেকালের বৃহত্তর নবদ্বীপের মানচিত্রে শক্তিপুজকদের অবহেলা সহ্য করতে হত,এর প্রমান আমরা ‘শ্রীচৈতন্যভাগবত’ গ্রন্থে পেয়েছি।তাই শিবচরিত্রের  উৎশৃঙ্ক্ষলা ঝরে পড়েছে তথাকথিত নিম্নসম্প্রদায়ের প্রতি নিন্দা-

অমঙ্গল চিতাভস্ম লেপে সর্বগায়।
গলেতে হাড়ের মালা,সাপিনী ফোঁপায়।।
ত্রিনয়নে অগ্নিজ্বলে,শিরে শোভে গাঙ্গ।
উলঙ্গ উন্মত্ত বেশ,খায় ধুতুরা ভাঙ্গ ।।
(শ্রী রামপাঁচালী,৭/৫/৪৯-৫০)

আমরা প্রথমদিকে নীলপুজার কথা উল্লেখ করেছিলাম।শিবের অপর নাম নীল। অমৃতমন্থনের সময়ে যে কালকূট বিষ উত্থিত হয়েছিল, তা শিব পান করার ফলে তাঁর কণ্ঠদেশ ‘নীলবর্ণ’ ধারণ করে,সেই থেকে তিনি নীলকণ্ঠ নামে পরিচিত হন।

কিন্তু সাহিত্য সমীক্ষায় তথা সমগ্র শিল্পতত্ত্বের ভিত্তিতে বীভৎস রসের বর্ণ হল নীল এবং সেই রসের আদি দেবতা হলেন মহাকাল মহাকবি কালিদাসের (‘মেঘদূত’)খণ্ডকাব্যে উজ্জিয়নীর মহাকাল মন্দিরের কথা পাই এবং ভারতবর্ষের দ্বাদশ জ্যোতিলিঙ্গের মধ্যে এই শৈবপীঠের স্থান রয়েছে।তাহলে এই মহা বিশ্বে ভগবান শিব-ই যদি মহাকাল হয়ে থাকেন,তাহলে সেই মহাকালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনও উৎসব বা নৃত্যগীতে বীভৎসতার গ্রহণযোগ্যতা সংশয়হীন।
রস মাত্রেই তা আনন্দ স্বরূপ । রবীন্দ্রনাথঠাকুর ‘সাহিত্যের পথে’ প্রবন্ধে মনোরম ভাষায় এটিকে ব্যক্ত করেছেন-‘অমৃতের দুটি অর্থ-একটি যার মৃত্যু নেই, এবং যা পরম রস।আনন্দ যে রুপ ধরেছে এই তো হল রস’। নবরসের সারনীতে ‘ বীভৎস’ রসরুপেই গণ্য।তাই জনসাধারণকে আনন্দিত করার ক্ষমতা এই রসের মধ্যেও নিহিত।এর চেয়েও বড় সত্য হল স্থান, কাল, পাত্র- এই তিনের অবিরোধে কোনও অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা।দারিদ্রে ভরা পল্লীজীবনের সঙ্গে মানানসই এই ধরনের লোক – উৎসব ও লোকনৃত্য কিছুঅংশে বেঁচে আছে বলেই ‘ধ্রুপদী’ এবং ‘লোক’ এই দুটি শিল্পের ভেদ সহজেই নির্ণিত।



তথ্যসুত্রঃ

১। ভরত নাট্যশাস্ত্র (১)- সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক সম্পাদিত।
২। দশরূপক- সীতানাথ আচার্য ও দেবকুমার দাস কর্তৃক সম্পাদিত।
৩। শ্রীরাম পাঁচালী- বেণীমাধব শীল কর্তৃক সম্পাদিত।
৪। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত-গীতা প্রেস থেকে প্রকাশিত।
৫। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল-বজেন্দ্রচন্দ্র ভট্টাচার্য কর্তৃক সম্পাদিত।
৬। সাহিত্যের পথে-‘বিশ্বভারতী’ থেকে প্রকাশিত।
৭। আদ্যের গম্ভীরা-হরিদাস পালিত।
৮। বাংলার লোক উৎসব ও লোক শিল্প- হীরেন্দ্রনাথ মিত্র।
৯। বাংলার লোকন্রিত্য-দ্বিতীয় খণ্ড- আশুতোষ ভট্টাচার্য।

সমীপেষু দাস