এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

'এখন তরঙ্গ' অষ্টম সংখ‍্যা

প্রকাশকাল : ২১ নভেম্বর, ২০১৭


প্রধান সম্পাদক : জ‍্যোতির্ময় মুখার্জি
সহ-সম্পাদকগণ :
 ●বিজন পণ্ডিত
                              ●ঐন্দ্রিলা মোহান্তি
                              ●তুলি রায়

                              ●দিব‍্যায়ন সরকার



       সর্বসত্ব সংরক্ষিত
তরঙ্গ পরিবারের পক্ষ থেকে



শাল‍্যদানী
  (Chairman, Taranga House)




------------: সূচীপত্র :---------




কবিতা

সাধারণ বিভাগ :
                               তৈমুর খান, মুরারি সিংহ, মনোজ দে, ঐন্দ্রিলা মোহিন্তা, মহাদেবাশা, রশ্মি মজুমদার, বিশ্বরূপ বিশ্বাস, অরবিন্দ বর্মন, অরিন্দম ভাদুড়ী, দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, কুমারেশ তেওয়ারী, ফারজানা মণি, ব্রতশুদ্ধ, অনুপ বৈরাগী, পিয়ালী বসু, সুজিত মান্না, পার্বতী রায়, তুলি রায়, স্মৃতি রায়, অভিশ্রুতি রায়, মৃণালিনী, সোনালী মন্ডল আইচ, দেবব্রত মাইতি, মৌসুমী ভৌমিক, সুদীপ্তা পাল, মুনমুন ভৌমিক, পিয়ালী সাহা, পিয়ালী দাস, চন্দ্রাবলী ব‍্যানার্জী, নির্মলেন্দু কুন্ডু, বনলতা, ফিরোজ আখতার, প্রতিমা রায়, সুদর্শন প্রতিহার, সৌমেন ঘোষ, রাজেশ, জয়দীপ রায়, সুদীপ ব‍্যানার্জি, অর্ণব মন্ডল, বাসব মন্ডল, সবর্না চ‍্যাটার্জ্জী, তারক নাথ গাঙ্গুলী, মৌসুমী রায় ঘোষ, আবদুস সালাম, রাজ পাল, বর্ণনা রায়, বৈশাখী চ‍্যাটার্জী, মায়িশা তাসনিম ইসলাম, রনজিৎ কুমার মুখোপাধ্যায়, শঙ্কর লাল মন্ডল, গৌতম সমাজদার, সায়ন্তনী হোড়, তিতাস বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়, সুনন্দ মন্ডল, প্রবীর রায়(ছোট), প্রশান্ত রায়, বিজয়,

কবিতার ল‍্যাব :
                                 সব‍্যসাচী হাজরা, রাহুল গাঙ্গুলী, শুভঙ্কর পাল, জয়িতা ব‍্যানার্জি গোস্বামী, অলোক সরকার, জ‍্যোতির্ময় রায়, অনুরূপা পালচৌধুরী,


অনুবাদ কবিতা :  সৌম‍্যজিৎ আচার্য


গদ‍্য সাহিত্য

আত্মজীবনী : প্রভাত চৌধুরী (ধারাবাহিক)

প্রবন্ধ : 
               অনিন্দ্য রায়(ধারাবাহিক), পবিত্র চক্রবর্তী, আফজল আলি(ধারাবাহিক), শাল‍্যদানী(ধারাবাহিক)

গল্প (বড়ো/ছোট/অণু) :
                                            প্রবীর রায়, তাপসকিরণ রায়, ধীমান পাল, শুভঙ্কর পাল, মধুমিতা সেনগুপ্ত, শ‍্যামাপদ মালাকার, দীপক আঢ‍্য, গৌতম সমাজদার, কমলিকা রায়, মধুমিতা সেনগুপ্ত, রুমেলা দাস

পত্রিকা/সিনেমা আলোচনা :
                                        রাহুল গাঙ্গুলী, অনিন্দিতা ভট্টাচার্য

সাক্ষাৎকার :
                    কবি রুদ্র পতি’র কবিতা ভাবনা (সাক্ষাৎকার নিলেন রাহুল গাঙ্গুলী)

ফিরে দেখা : তুষ্টি ভট্টাচার্য্য


বাচিক শিল্প

কবিতা পাঠ : পৃথা ব‍্যানার্জি, মৌসুমী ভৌমিক,

চিত্রকলা

চিত্রাঙ্কন
               তমোহি ভট্টাচার্য্য, রুমেলা দাস, অভিশ্রুতি রায়, মৌনতা সাঁতরা,

ফটোগ্রাফি :  শিবম ঘোষ, অভিশ্রুতি রায়,




ধন‍্যবাদান্তে
সম্পাদক মন্ডলী, ‘এখন তরঙ্গ’
(সাহিত্য বিভাগ, তরঙ্গ হাউস)

সম্পাদকীয়

               
                 হঠাৎ করেই যখন সম্পাদকীয় ডেস্কে বসতে হলো কলম বাগিয়ে(আদপে কলম নয়, আঙুল বাগিয়ে), সত্যি বলছি, ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলাম। লিখতে হবে সম্পাদকীয়! এবং আমাকে‍? কী লিখবো? কীভাবে?
উত্তর খুঁজতে মাথার চুলগুলো ঠিক ছিঁড়ে না ফেললেও, কাছাকাছি কিছু একটা করেছিলাম নিশ্চিত। অতঃপর, মাথা চুলকে কীনা জানিনা, উত্তর একটা পেলাম, একটা সহজ পথ…….এই ‘আমি’ শব্দটিকে জাস্ট ভ‍্যানিশ করে দেওয়া।
কে আমি? সম্পাদক’তো কোনো ‘আমি’ নয়……
যদি লিখতেই হয় কিছু, যদি বলতেই হয় কিছু, তাহলে বলবে ‘এখন তরঙ্গ’ নিজেই, সম্পাদকীয় ডেস্ক থেকে শুধু সেটা পোঁছে যাবে আপনাদের কাছে।

তবু সমস্যা একটা থেকেই যায়, যেকোন পত্রিকায় সম্পাদকের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার ছবি ফুটে ওঠেই। পত্রিকায় সম্পাদকের মননের ছাপ স্পষ্টতই থাকে। সম্পাদকের পরীক্ষা এখানেই, কতখানি সে তার ব‍্যক্তি-আমি’কে অস্পষ্ট করে, পত্রিকার দাবীকে স্পষ্ট করে তুলতে পারে।

পত্রিকা কী ও কেন? এইকথাটা অনেক সময়েই ভুলে যায় আমরা, পত্রিকার নিজস্ব চরিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে প্রতি মূহুর্তে ছলনা করি পত্রিকার উদ্দেশ্যের সাথেই। আসলে পত্রিকার চরিত্র নির্মাণ নয়, আমরা অনেক সময় পত্রিকার মধ্যে নিজের নির্মাণের পরিকল্পনা করে ফেলি। ঠিক সেই মূহুর্ত্তেই ‘সম্পাদকের নিরপেক্ষতা’ শব্দবন্ধটির মৃত্যু ঘটে এবং নিজেকে, নিজের পত্রিকাকে সবার থেকে আলাদা কিছু করার দাবীতে প্রতি মূহুর্তে গুটিয়ে ফেলি নিজেকে ও নিজের পত্রিকাকে নিজেরই খোলসে, আদতে খোলস নয় কঙ্কালের।
এই ভুলটাই আমি প্রায় করেই ফেলেছিলাম আর একটু হলেই, পরিকল্পনা করেছিলাম কবিতার ছলে লিখবো সম্পাদকীয় বা বেশ জমাটি গদ‍্য, বাঁচিয়ে দিল শাল‍্যদানী। ঠিক আমাকে নয়, ‘এখন তরঙ্গ’-কে। ও বললো, তোমার পাঠক কিন্তু সবাই, যে কবিতা বোঝে বা না বোঝে, সাহিত্য জগতের কেউ বা সাহিত্যের বাইরে এবং শিশুরাও। ভেবে দেখলাম ঠিকই তো, আমি তো এখানে সাহিত্য ফলাতে লিখতে বসিনি, আমি সেটাই লিখবো যেটা এই পত্রিকাটি চায় বা ‘এখন তরঙ্গে’র বৈশিষ্ট্য, উদ্দেশ্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।

অতএব আর ভ‍্যানতাড়া না করে সরাসরি সহজ সরল পথে ঢুকে পড়ি সেখানেই।
কিন্তু প্রতিটি শুরুর পিছনে একটা শুরু থাকেই,
যে প্রদীপটা আজ জ্বলতে দেখছেন, তার সলতে পাকানোর কাজ শুরু হয়েছিল অলক্ষ্যে, অন্ধকারে…….

খুব বেশি পিছনে যাবোনা, আমি শুধু আমার সংযোগটুকুই বলবো। ‘এখন তরঙ্গে’র মধ্যে আমি প্রবেশ করি মূলত শাল‍্যদানীর উৎসাহে এবং একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে এবং একটা স্বপ্ন। স্বপ্নটা এখন স্বপ্নই থাক, সময় এলে জানতেই পারবেন, এবং আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া পূর্ণও হবেনা। এখন আমরা লক্ষ্যর দিকে নজর ঘোরাই, হ‍্যা আমাদের এই লক্ষ্যটাই ‘এখন তরঙ্গে’র ক‍্যারেকটার….. make an open platform, একটি পত্রিকা যেখানে সবাই স্বাগত। কলমকে ভাগ-বাটোয়ারায় বিশ্বাসী নই আমরা। আমরা শ্রুতি থেকে পুঁথির ইতিহাসকে সামনে রেখে এঁকে যাবো সময়কথা, চূড়ান্ত অশ্লীল হোক বা ‘ধোয়া তুলসী পাতা’, মেলানকোলি সুর হোক বা বিরক্তিকর খটাংখট, যৌনতা হোক বা দেবকথা, গে হোক বা লেসবি, ‘এখন তরঙ্গ’ নির্দ্ধিধায় তাকে বুকে টেনে নেবে।
সোজা কথায়, তোমার কলম বাঁশি হতে পারে বা অসি, ‘এখন তরঙ্গ’ দুটোরই কেরামতি দেখতে রাজি, যদি তুমি দেখাতে পারো। খুব স্পষ্টভাবে নিরপেক্ষ দূরত্বে সময়কথাকে আঁকবে । পাঠক কী খাবে…….এইকথা ভাবার অবকাশ বা ইচ্ছা কোনটাই নাই। পাঠকের মতামত অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তার জন্য কমেন্ট বক্সের দিকে তাকিয়ে থাকবো, কিন্তু তার দোহাই দিয়ে দূরে সরে যাবোনা পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য থেকেই।

‘এখন তরঙ্গ’, ‘তরঙ্গ হাউসে’র সাহিত্য বিভাগের (আরো চারটি বিভাগ হল, নৃত্য, সঙ্গীত, নাটক, বাচিক শিল্প) অন্তর্গত একটি সাহিত্য পত্রিকা, যা সাহিত্যের চারপাশে কোনো গন্ডী টানায় বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস করে না, নিজের চারপাশে গন্ডী টেনে, নিজেকে অত‍্যুৎকৃষ্ট প্রমাণ করার অজুহাতে, নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে। এবং পুরো ‘তরঙ্গ পরিবার’ একযোগে এই ধারনায় বিশ্বাসী, প্রতিটি বিভাগ আলাদা আলাদা ভাবে কাজ করলেও আমরা সামগ্রিক ভাবে একই পথের পথিক।
                       এই ছোট্ট ছোট্ট তরঙ্গরা
                                   যেদিন ঢেউ হবে
                         মিলবে ও মেলাবে

                        এই লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই কিছু    ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়েছি আমরা, বা বলা ভালো ‘এখন তরঙ্গ’ আমাদের কানে কানে বলে গেল সে কী চায়…..

◆ কবিতার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে।
এখানে অভিজ্ঞ কবিদের সাথেই, বেশি করে নতুনদের লেখা ছাপা হবে। ‘কবিতার ল‍্যাব’ থাকবে, কবিতাকে ‘কাটাছেঁড়া’ চলছে ও চলবে।

◆◆ ‘কবিতা পাঠ’কে সাহিত্য অনুশীলনের অংশ
হিসেবেই আমরা মনে করি এবং এই সত‍্যকে সামনে রেখেই, ‘কবিতা পাঠ’কে সরাসরি পত্রিকার মধ্যে ঢুকিয়ে নিতে আমরা দ্বিধা করিনি।

◆◆◆এছাড়া, আম‍রা চিত্রাঙ্কন, ফটোগ্রাফিকেও
গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেছি।
◆◆◆◆ অতঃপর, যেকোনো ইউনিক ‘কাজ’, পেনে হোক বা তুলিতে, ক‍্যামেরার লেন্সে হোক বা বকমবকম মুখে, যদি আমরা খুঁজে পাই নিজস্ব চিন্তা ভাবনার ফসল, তবে সেটা নির্দ্ধিধায় গ্রহণ করবো, (প্রয়োজনে আলাদা বিভাগ খুলেও)
★ ‘এখন তরঙ্গ’ খুব স্পষ্টভাবে, পরবর্তী সংখ‍্যা
থেকেই, শিশু ও কিশোর সাহিত্যকে গুরুত্ব দেবে। এবং অবশ্যই শিশু ও কিশোর/কিশোরীর কলম অগ্রাধিকার পাবে। ‘এখন তরঙ্গ’ চায়, তাদের সাহিত্য তারা নিজেরাই সৃষ্টি করুক। তাদের অপরিণত(?), এলোমেলো রেখাকেও ‘এখন তরঙ্গ’ নির্দ্ধিধায় গ্রহণ করবে।

★ ★ পরবর্তী সংখ‍্যা থেকে সমসাময়িক নবীন কবি, মূলত ২০১৫ পরবর্তী সময়ে লিখতে আসা বা তার একটু আগে, এমন একজন করে কবিকে নিয়ে একটা সামগ্রিক ‘পোর্টফোলিও’ করা হবে।
ভাবছেন তো, সেটা আবার কী ? খায় না মাথায় দেয় ? একটু অপেক্ষা করুন, পরবর্তী সংখ‍্যা পর্যন্ত, তারপর সেটা খেতেও পারেন বা মাখতে।

★★★ আচ্ছা কবি/সাহিত্যিক তো দুইপ্রকার তাইনা? পূরুষ ও মহিলা ‍! রাগ করবেন না, জানি আপনি চেঁচিয়ে বলবেন কলমের কোনো জেন্ডার হয় নাকি? তুলির’ও কোনো জেন্ডার নাই। শিল্প-সাহিত্য জেন্ডারহীন সার্বজনীন। ঠিক, একদম ঠিক, মেনে নিলাম আপনার কথা এবং আপনার কথা মেনেই ‘এখন তরঙ্গ’ কলমকে প্রশ্ন করবে না তোমার জেন্ডার কী? তুমি পুরুষ, নারী না তৃতীয় লিঙ্গ? তুমি মানুষ। তোমার কাজেই তোমার পরিচয়। তুমি হতে পারো পূরুষ, তুমি হতে পারো নারী, বা তুমি তৃতীয় লিঙ্গ, হাতে কলম তুলে নাও, বা তুলি, ‘এখন তরঙ্গে’ তোমায় স্বাগত।

★★ ★★ “কীসব ছাপা হচ্ছে আজকাল”, আগডুম বাগডুম…..পাঠকেরা এসব খাবে? চিরন্তন সাহিত্যের ইতিহাসে কী মূল্য আছে এর? ইত্যাদি ইত্যাদি…..এই ডায়ালগ চিরকালীন। তবু ভাগ‍্যিস সব যুগেই কেউ না কেউ সম‍য়কথাকে লিখে রেখেছিল, জনপ্রিয়তার দোহাই না দিয়ে, পাঠকের টেস্টকে পাত্তা না দিয়েই। তাইতো জানতে পারি কোলরিজ মোটেও ঠিক প্রেমের কবি নয়, তাঁর অঙ্ক-কবিতার কথা বেমালুম ভোলা যায়নি শুধু এই সময়কথার সৌজন্য, যা অনেকক্ষেত্রেই পাঠকবিমুখ। তবু পাঠকের গূরুত্ব থাকেই, তাইনা ? সর্বোপরি সবই তো পাঠকের জন‍্যই। হ‍্যা, আমরাও গুরুত্ব দিই ও দেবো পাঠককে ও পাঠকের মতামতকে। এই ব‍্যপারে প্রাথমিক পরিকল্পনা করেছিল রাহুলদা, (এই পত্রিকার প্রতিটি আনাচে কানাচে রাহুলদার চিন্তা ভাবনা জড়িয়ে আছে, হয়তো থাকবেও) প্রতিটি সংখ‍্যায় একজন পাঠকদের সাক্ষাৎকার রাখার, পূর্ববর্তী সংখ‍্যার উপর, কিন্তু তার ব‍্যবহারিক প্রয়োগে বেশ কিছ সমস্যা রয়েছে। আমরা পরিকল্পনা একটু বদলে নিলাম, পরবর্তী সংখ‍্যা থেকে পাঠক রিভিউ বা পাঠকের মূল‍্যায়ন ছাপা হবে, সেটা কোনো লেখা নিয়ে হতে পারে, বা সামগ্রিক ভাবে পত্রিকা নিয়ে, গঠনমূলক সমালোচনা হতে পারে বা বিরুদ্ধ সমালোচনা আমরা নির্দ্ধিধায় ছাপবো। ব্লগে, ফেসবুক পেজে, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যে মতামত পাবো আমরা, সেখান থেকেই বেছে অবিকৃত ভাবে তুলে দেবো পরবর্তী সংখ‍্যায়।

একটা প্রশ্ন প্রতিটি পত্রিকার সামনে থাকেই, তা হলো, সেই পত্রিকাটির টার্গেট পাঠক কারা? এই উত্তরের পথেই হেঁটে যায় পত্রিকা। প্রশ্নটা ছিল আমাদের সামনেও, এবং উত্তর ? জলবৎ তরলম্…….আমাদের কোনো টার্গেট পাঠক নেই, বরঞ্চ ঠিক উল্টোটা, সমস্ত পাঠকের টার্গেট পত্রিকা নাম হবে ‘এখন তরঙ্গ’

এরপরেও কিছু বলার ছিল, কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ছিল, কিছু অভিযোগের।
কিন্তু ভেবে দেখলাম, কেন? প্রয়োজন কী তাদের গুরুত্ব দেওয়ার? যদি কিছু বলতে হয়, আপনারই বলবেন, বা আরো ভালো করে বললে, ‘এখন তরঙ্গ’ নিজেই তার পাঠকদের দিয়ে, তার বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগের জবাব বলিয়ে নেবে।

শুধু সমালোচনা নয়, পাশে পেয়েছি অনেককেই এবং উৎসাহ ও সাহায্য। তাঁদেরকে ধন্যবাদ ও প্রণাম। তবে, শাল‍্যদানী, বিজন, ঐন্দ্রিলা, তুলি, দিব‍্যায়নকে ধন্যবাদ জানাবোনা। কেন জানাবো? আমরা তো পুরো কাজটা একসাথেই করেছি এবং করে যাবো আর নিজের লোককে কেউ ধন্যবাদ জানায় নাকি ?

ধন্যবাদান্তে
জ‍্যোতির্ময় মুখার্জি
Chief Editor at ‘এখন তরঙ্গ’

(সাহিত্য বিভাগ, তরঙ্গ হাউস’)

জ‍্যোতির্ময় মুখার্জি
মাহাতা-পূর্ব বর্ধমান


তরঙ্গ পরিবারের বার্তা

তরঙ্গ পরিবার
(শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র)

সূর্যের পর আবার সূর্য ওঠে আবার। তরঙ্গের পর তরঙ্গ। চেয়ারম্যান ডেস্ক থেকে প্রথম লিখতে বসলাম। শাল্যদানী ব্যস্ত তাই আমাকেই লিখতে হবে। কিন্তু কি লিখি? এতদিন যা কাজ করেছি হাউসে তা গোপনেই, সামনে প্রথমবার। ভালো আছে তরঙ্গ, খুব ভালো আছে। শাল্যদানী আর আমি মিলে আরো কয়েকজনের সাহায্যে যখন প্রথম তরঙ্গ বানালাম ঠিক সেইদিন থেকে চিন্তনের শুরু আর কাজ। আর কখনো ব্যর্থতা, কখনো সফলতা। প্রথম থেকেই পত্রিকা সফল, শুধু এগিয়ে চলছিলো। কিন্তু সেটা আপনাদের কাছে আসলে একটা অন্য গল্প আছে সেটা আজ বলি আপনাদের। আপনাদের চেয়ারম্যান সাহেব, মানে আমার চিরশত্রু শাল্যদানী পঞ্চম সংখ্যা প্রকাশ করে হঠাৎ লা পাতা। সেই সময়ে জ্যোতির্ময় তরঙ্গ জয়েন করেনি। তখন পত্রিকা সম্পাদক ছিলেন রাহুলবাবু। উনি আর আমরা কয়েকজন লেখা বাছতাম আর শাল্যদানী ডিসাইন করে পিডিএফ বানাতো। শাল্যদানীর ফোন অফ, খোঁজ নেই। আমাকে পর্যন্ত ফোন করছে না। দুমাস পর তাকে খুঁজে আনলাম। উনি ধর্ম করতে গিয়েছিলেন কাউকে কিছু না বলে। তুমুল ঝামেলা করে ফিরিয়ে আনলাম। প্রকাশ পেল পরের সংখ্যা। তারপর কত বাধা বিপত্তি পার করে আজ আমরা 'এখন তরঙ্গ'। আমরাই সেরা। জ্যোতির্ময় নতুন প্রধান সম্পাদক আমার হাউসের পত্রিকা বিভাগের। ওকে অভিনন্দন। যোগ্যতরকে তরঙ্গ বারাবরই গুরুত্ব দেয় এবং দেবে।

এবার আসি নাটকের বিভাগের কথা। ব্যর্থতা। প্রোডাকশন শুরু হল, বিভিন্ন অসুবিধা শেষ করতে দেয়নি আজো। নাট্যকার হিসাবে শাল্যদানী কি পথ দেখায় সে দিকে তরঙ্গ তাকিয়ে আছে।

তরঙ্গ বইমেলায় এবার থাকবে। একা নয়, বন্ধু পত্রিকাওয়ালাদের নিয়ে থাকবে। তরঙ্গ ছুতমার্গ বিশ্বাস করে না। তরঙ্গ গোষ্ঠী বিরোধিতা করে। তরঙ্গ নিজে প্রতিষ্ঠান রূপে প্রতিষ্ঠান বিরোধী।

সামনে তরঙ্গ সিনেমায় হাত দিতে চলেছে। শর্টফ্লিম দিয়ে কাজ শুরু করবে। তারপর দেখে যাক।

তরঙ্গ খোলা জানালা। তুমি দখিনা বাতাস হও...

ভালো থাকবেন। তরঙ্গায়িত হোন।

বিজন কুমার পণ্ডিত
ভাইস চেয়ারম্যান
তরঙ্গ পরিবার
বিজন পন্ডিত
ভাইস চেয়ারম্যান
তরঙ্গ পরিবার


রুদ্র পতি


বিষয় : সাক্ষাৎকার


কবি রুদ্র পতি’র কবিতা ভাবনা
(মুখোমুখি
রাহুল গাঙ্গুলী)





রাহুল : লেখার শুরুটা যদি বলেন একটু, আপনার জীবনে লেখা শুরু করার জন্য কী কোনো বিশেষ ক্ষেত্র বা উদ্দেশ্য ছিল ?

রুদ্র পতি : ভাবুন সেই সময়, যখন ইলেকট্রিসিটি ছিল না, ফোন ছিল না, প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলায় লন্ঠনের কাচ মুছতাম ন‍্যাকড়া দিয়ে আর মুখের বাষ্প দিয়ে, তারপর ফিতে’তে দেশলাই জ্বালাতাম, সময়টা ১৯৮৮, সেই সময় আমি 2nd year-এ পড়ছি, Chemistry-তে অনার্স, প্রথমে ভর্তি হয়েছিলাম বাঁকুড়া শহরের সম্মিলনী কলেজে, কিন্তু এক মাসের মধ্যে সরে আসি মফস্বলের বাঁকুড়া জেলার শালডিহা কলেজে। উদ্দেশ্য ওই, পর্যাপ্ত ফুটবল খেলার মাঠ। ভলিবল খেলা আমার ভীষন পছন্দের আর পুকুরে সাঁতার কেটে স্নান করার সুযোগ। এই সুবিধা নেওয়ার জন্য, শহর ছেড়ে গ্রামের কলেজে চলে আসি। অবশ্য, তখন গ্রামের এই কলেজটিতে Chemistry খুব Strong. বাঁকুড়া শহরের ছেলেরা এখানে প্রফেসর’দের কাছে tution পড়তে আসতো। আমি পড়াশোনাতে বরাবরই ভালো ছিলাম। ফলে স্বপ্ন বলতে এইটুকুই ছিল, কেমেস্ট্রির অধ্যাপক হবো। Simple living, high thinking-এ তখনও বিশ্বাসী ছিলাম। ভাববো, সমস্ত কিছুই খুঁজবো পরমাণু বা মৌলের ভিতর, যেমন মানুষের এই শরীর, প্রেমিকার শরীর, সেখানে কোষ-কলা এসবই কী কী দিয়ে তৈরি উত্তর খুঁজতাম। কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস ইত্যাদি ইত্যাদির ভিতর। এই শরীর নির্মাণে অপরিহার্য, এই বৃক্ষদের নির্মাণে অপরিহার্য কার্বন ও হাইড্রোজেন এই দুটো পরমাণু বা মৌল। জলকে ভাবতাম হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের
কম্বিনেশনে একটা অনুপাতে যারা জুড়ে আছে। অসম্পৃক্ত জৈব যৌগের ভিতর অ্যাসিটিলিনের গ্রামীণ আলোয় আমার গঞ্জের পথ উদ্ভাসিত হতো যেখানে রাতের মেলা বসতো, গাজনের ঝুমুর, ছৌ-নাচ হতো।

   তেমনই সমুদ্রের জল, তাকে আমি খুব সম্মান করতাম, এখনো করি, কারণ সেখানেই প্রথম প্রাণের উপযোগী অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরী হয়েছিল, যা থেকে এককোষী প্রাণীর জন্ম, তারপর তা থেকে বহুকোষী প্রাণীর সৃষ্টি, এই আমাদের জন্মের ঋণ সেখানে। ঈশ্বরের থেকে জন্মেছি আমরা, একথা কখনো ভাবিনি।
ওহ্, বলা হয়নি, আসলে আমি ১৯৮৭ সাল থেকে প্রথম যে দুটো লিটল ম্যাগাজিনের গ্রাহক ছিলাম, তার প্রথমটি হল ‘উৎস মানুষ’ পত্রিকা আর দ্বিতীয়টি ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান’ পত্রিকা। কিন্তু কী হলো? বাঁকুড়া শহরে সপ্তাহে দুদিন যেতাম কেমেস্ট্রির টিউশন পড়তে, তখন বাঁকুড়ার মাচানতলার ‘সুনীল বুক স্টলে' পত্রিকা কিনতাম। ‘দেশ’ পত্রিকার সঙ্গে তখনই পরিচয়। তখন সাপ্তাহিক বেরোত। ‘চন্ডীদাস’ সিনেমা হলে কোনো কোনো রবিবারে টিউশনির পর সিনেমা দেখেও ফিরেছি আমরা প্রায় চল্লিশ কিমি. দূরের গ্রামীণ কলেজ হস্টেলে, আমাদের মধ্যে তখন লেখাপড়ায় তেমন সিরিয়াসনেস্ ছিল না। কিন্তু প্রফেসররা আপ্রাণ চেষ্টা করতেন আমাদের জন্য।
তো ওই ‘দেশ’ পত্রিকায় আনন্দ বাগচী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দিবেন্দু পালিত প্রভৃতি কবিদের কবিতা পড়তাম। খুব টানতো আনন্দ বাগচী’র কবিতা। গল্প ও উপন্যাসের’ও পোকা ছিলাম আমি। HS পরীক্ষা দেওয়ার পর ১৯৮৬ তেই প্রায় আমাদের গ্রামীণ লাইব্রেরীর সমস্ত উপন্যাস পড়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমার প্রিয় ঔপন্যাসিক মাত্র দু-তিন জন এখনো, শুনলে বোকা বোকা লাগবে, তবুও বলছি, ১), ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, ২)  আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ৩)  নিমাই ভট্টাচার্য্য। অর্থাৎ, আমার নরম মনে এইসব ঔপন্যাসিকদের লেখা প্রবলভাবে নাড়া দিত। খুব কেঁদেছি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’ পড়ে এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’, ‘পোস্টমাস্টার’, অর্থাৎ গল্পগুচ্ছের গল্পগুলি পড়ে, তখন আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি। কিংবা

‘মধু মাঝির ওই যে নৌকাখানা
বাঁধা আছে রাজগঞ্জের ঘাটে,
কারো কোনো কাজে লাগছেনা তো,
বোঝাই করা আছে কেবল পাটে।
আমায় যদি দেয় তারা নৌকাটি
আমি তবে একশোটা দাঁড় আঁটি,
পাল তুলে দিই চারটে, পাঁচটা, ছ’টা’......

এই ‘নৌকাযাত্রা’ কবিতাটিও খুব নাড়িয়েছিল আমাকে। পরবর্তী সময়ে  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার ভেতর আমি ওই শিশু কাব‍্যগ্রন্থ ও শিশু ভোলানাথ, এই দুটি থেকেই আমি আমার কাব্য রসদ সংগ্রহ করতাম। মাধ্যমিকে পর্যাপ্ত নাম্বার নিয়ে পাশ করি, HS এও ভালো নাম্বার ছিল। কিন্তু গোলমাল হলো, ওই কেমেস্ট্রি অনার্সে পার্ট ওয়ান পরীক্ষার দুমাস আগে, সব উলোটপালট হয়ে গেল। ভেবে দেখলাম, একজন কেমিস্ট বা অধ‍্যাপকের চাইতে একজন কবির অনেক বেশি বলবার আছে, প্রকাশ করবার আছে, আছে নির্মাণ, পরিব‍্যপ্ত হওয়ার অসীম ক্ষমতা। ফলে কবিতা লিখবার জন্য ভিড়ে গেলাম, মন সায় দিল। আমি তখন আমার বন্ধুদের হস্টেলে, অনেকেই যখন কোনো চ‍্যাপ্টারে আটকে যেতো আমি সাহায্য করতাম; তারা অনেকেই প্রবল আপত্তি করেছিল আমার এই লেখালেখি নিয়ে, আবার অনেকেই সমর্থন’ও করেছিল। তখনই শুরু হলো দেওয়াল পত্রিকা প্রকাশ। প্রতি ১৫ দিন অন্তর সেকী পাগলামি! সেখান থেকেই প্রিন্টেড পত্রিকা, নাম ‘আঘ্রাণ, সম্পাদক আমি, সহযোগীর অভাব নেই, অনেকেই জুটে গেল। আমাদের কলেজে থার্ড ইয়ারে ইকনমিক্স অনার্সে পড়তো শেখ আপ্তার আলি, গ্রাম থেকে সে আসতো সাইকেলে, সে তখন কোলকাতা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন কাগজে লিখছে, যেমন ‘দেবযানী’, ‘যুবমানস’ ইত্যাদি। আমার এক বন্ধু আফতারকে আমার হস্টেলে নিয়ে এলো, তার সঙ্গে লেখালেখি, লিটল ম্যাগাজিন বিষয়ে আলোচনা হলো, আপ্তারদা আমাকে পত্রিকাও দিল, এইভাবেই কবিতা লেখাটা শুরু হয়ে গেল।


শুদ্বসত্ত্ব বসু সম্পাদিত ‘একক’ পত্রিকার গ্রাহক হলাম, বর্ধমান জেলার কালনা থেকে প্রকাশিত ‘হোত্রী’ ও ‘সীমায়ন’ পত্রিকায় দুহাত ভরে লিখলাম গদ‍্য এবং পদ‍্য। এই দুটি পত্রিকা আমায় লেখার জন্য পুরস্কৃত’ও করলো রৌপ্য পদকে। শুদ্বসত্ব বসু নিয়মিত আমার কবিতা ছাপলেন ‘একক’-এ, তারপর আমাদের ছাত্র সংগঠনের এক বিশাল সমাবেশে যোগ দিতে কলকাতায় গেলাম, কলেজ স্কোয়ারে অবস্থান। সেখানে কামরুজ্জামানের স্টল থেকে সেই প্রথম দু’শো টাকার লিটল ম্যাগাজিন কিনেছিলাম। প্রায় বাইশ খানা টাটকা লিটল ম্যাগাজিন।

সেসব থেকে ঠিকানা পেয়ে যোগাযোগ, লেখালেখি। আর জানিনা কী অমোঘ টানে একদিন সব ছেড়ে ছুড়ে  দিয়ে কবিতাকেই পাথেয় করলাম। কারণ তখন বুঝলাম, একাডেমিক লেখাপড়া করা বন্ধুদের চাইতে আমি এগিয়ে রইবো। ভেসে রইবো আলো অন্ধকারে। হস্টেল ছেড়ে পালিয়ে গেলাম কবি কুমুদরঞ্জনের গ্রামে, বর্ধমানের ‘কোগ্রাম’-এ, ।

    কাটোয়ার জুনিয়র বেসিক ট্রেনিং কলেজের চত্বরে তাঁর লাগানো কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে একবছরে লিখে ফেললাম ৪০০ টি কবিতা।

কৃষ্ণনগরের শতদল ঝর্ণার ধ্বনি অনুষ্ঠান অথবা বর্ধমানের বাকচর্চায় অনুষ্ঠান, কালনার সাহিত্য সম্মেলন গেলাম। নবদ্বীপে জলঙ্গী, কাটোয়ায় ভাগীরথী আর অজয়ের পাড়ে আমি কবিতা, গল্পের চিত্রকল্প, থিম ও আবেগ খুঁজে পেলাম। জেবিটি পড়েও পেলাম শ্রেষ্ঠ নাম্বার প্রাপকের সম্মান। সেখানেই নন্দন সিংহের কাছে আবৃত্তি শিখলাম। তাঁর কাছেই শামসুর রাহমান, অমিতাভ দাশগুপ্ত, শঙ্খ ঘোষের কবিতার আবৃত্তি শিখি। একদিন পুরনো বই বিক্রির ঠেলা(রিক্সা ভ‍্যান) থেকে ভবতোষ শতপথী এবং চারণকবি বৈদ‍্যনাথের বই পেয়েছিলাম খুব অল্প দামে, সেই আনন্দ কখনো ভুলবোনা। সেই সব কবিতা কাটোয়ার হস্টেলে আমরা বন্ধুরা আবৃত্তি করতাম মহানন্দে, প্রফেসররাও খুব উৎসাহ দিতেন। সময়টা হলো১৯৮৯ থেকে ১৯৯০।

ভোরে বৈষ্ণব ও বৈষ্ণবী এসে হস্টেলে আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে যেতো‌। আমরা ধুতি ও পাঞ্জাবি পরতাম। প্রার্থনা দিয়ে শুরু হতো সকাল।  তারপর ক্লাসরুমে মেঝের ওপর বসে চৌকিতে বই ও খাতা রেখে পাঠাভ্যাস। আগামীতে শিক্ষক হওয়ার প্রশিক্ষণ।



রাহুল : লেখা শুরুর উদ্দেশ্য বা কোনো বিশেষ ক্ষেত্র


রুদ্র পতি : হ‍্যা, লেখা শুরুর বিশেষ ক্ষেত্র অবশ্যই ছিল, মিথ্যা বলবোনা, কারণ অমরত্বের লোভ ছিল, আমার তখন মনে হয়েছিল একমাত্র কবিতা লিখেই তা সম্ভব। গল্প, উপন্যাস বা প্রবন্ধ লিখেও নয়। বিজ্ঞানীর চেয়েও কবি বড়ো তখন মনে হতো। আসলে মরণশীল এই নশ্বর জীবনে আজ আছি কাল নেই, কিছু কবিতা যদি মহাকালের কাছে রেখে যেতে পারি, তাহলে দাগ রেখে গেলাম, এই আর কী। আসলে আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা আমার গ্রামে। চোখের সামনে আমার জন্মান্ধ জ‍্যেঠা ও পিসিকে দেখেছি। সেখান থেকেই অন্ধজনে দেহ আলো, মৃতজনে দেহ প্রাণ, কবিতা যদি দিতে পারে, কোনো ডাক্তার তো পারলোনা। আধুনিক বিজ্ঞান’ও তো পারলোনা। ছোট থেকে খুব কাছ থেকে দারিদ্র্য দেখেছি, যে দারিদ্র্যের শেকল ছিঁড়তে পারতাম কেমেস্ট্রি পড়ে, কোথাও ভুল বোঝা বুঝিতে সেই শেকলেই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেলাম। বড়ো হওয়া কাকে বলে…..আমার সেই সব বন্ধুরা, কলেজের বন্ধুরা, কেউ ভারতের NIT তে অধ‍্যাপনা করে, কেউ বিদেশে। আমি তাদের চেয়ে এগিয়ে ছিলাম পড়াশোনায় তবুও কবিতায় শ্রেষ্ঠ সময়টুকু দিয়ে দিলাম, ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৬ দীর্ঘ নয় বছর। শুধুই কবিতার জন্য, মৃত্যুর পরেও নামের প্রত‍্যাশায় আর লিখে আনন্দ পাওয়া, সেটা তো বাড়তি পাওনা। কবিতার সংখ্যা এই পর্বে প্রায় তিন হাজার। প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা প্রায় দুহাজার, পৃথিবীর প্রায় সমস্ত বাংলা কাগজে ও পত্রিকায়। এইসময় কবিতা পাঠানোর মাধ্যম ছিল একমাত্র ভারতীয় ডাক বিভাগ। এই পর্যায়ের সমস্ত কবিতা লেখা হয়েছে, লন্ঠনের আলোয়, কেরোসিনের ব‍্যবহারে। তখন গ্রামীণ কলেজ হস্টেলেও ইলেকট্রিসিটি ছিল না।

দ্বিতীয় পর্যায়ে, অর্থাৎ ২০০০ সাল থেকে ২০০৮ সাল, দীর্ঘ নয় বছর, এই পর্যায়ে কবিতার সংখ‍্যাও প্রায় তিন হাজার, গল্পের সংখ‍্যা ১২ টি, প্রবন্ধ/নিবন্ধ পাঁচটি, সমস্তই প্রায় প্রকাশিত। কবিতাগুলো লেখা হয়েছে ইলেকট্রিকের আলোয়, এবং ফোন ব‍্যবহারের সুযোগ পেয়েছি ২০০৪ সাল থেকে। কুরিয়ারের সুযোগ পাইনি, সেই ভারতীয় ডাক বিভাগ, যারা আমার কিছু মূল্যবান লেখা ঠিক স্থানে পৌঁছেও দেয়নি, হারিয়ে ফেলেছে। মন খারাপ হয়ে গেছে, কপি না থাকা সেইসব লেখার জন্য অনুশোচনা হয় এখনো। 



রাহুল : কখনো কি মনে হয়নি, যা লিখছি কেন লিখছি?

একজন কবির কাছে এই প্রশ্নটি নিজেকে করা কতটা জরুরী?


রুদ্র পতি : প্রথম থেকেই এই ব‍্যপারে আমি সচেতন ছিলাম, সেই নয়ের দশকের শুরুতেই আমি প্রান্তীয় অঞ্চলের কবিতা লিখি এবং সেইসব কবিতার নির্মাণ, স্টাইল ছিল ছোট ছোট। ‘প্রান্তিক চাষা’ এবং ‘অসম্পৃক্ত হাইডোকার্বন’ গ্রন্থে তার নমুনা রয়েছে। দুটোরই প্রকাশকাল ১৯৯৩, রচনাকাল ১৯৯০-৯২ এবং এই দুটি কাব‍্যগ্রন্থই প্রকাশকরা প্রকাশ করেছিলেন নিজেদের খরচে, আমার কোনো টাকা-পয়সা লাগেনি। ওই পর্বে লেখা ‘এবছর শ্রাবণ ভালো’ এবং ‘বেকারের কবিতা’য় আমি যেমন লোকজ শব্দ ব‍্যবহার করেছি তেমনি লেদ, সিঙ্গেল-ফেজ মোটর, থ্রি-ফেজ মোটর, হ‍্যান্ড্রিল, প্রোটোপ্লাজম থেকে শুরু করে, e = mc2, ফিশান, ফিউশন ইত্যাদি ব‍্যবহার করেছি একদম নিজস্ব স্টাইলে।

আমার আগে বাংলা কবিতায় কেন সম্ভবত ইংরেজিতেও কেউ এভাবে e = mc2 সূত্র কবিতায় প্রয়োগ করেনি। আমিই প্রথম। যেমন আমার তৈরী ‘সালফার-বালিকা’ এর আগে কেউ এমন শব্দ লেখেননি। ভারী শিল্পে আর তেজস্ক্রিয় অস্থিরতায় আর মুখোমুখি বেশ‍্যালয় ও প্রসূতিসদনের মাঝে ওই  ‘সালফার-বালিকা’র কথা লিখেছিলাম সেই নয়ের দশকের গোড়ায়। বাংলা কবিতা আমি দুহাতে লিখেছি, বাঁহাতে গ্রামীণ লোকজ কৃষিভিত্তিক প্রান্তীয় মালভূমির কবিতা, দারিদ্রবিক্ষত, ঊষর, তাঁত ও কুটির শিল্প, বিশ্বাস, সরলতা, লম্ফের কাঁপা আলো, সাপে কাটা গ্রাম।
আর ডানহাতে মফস্বল, শহর, নগরকেন্দ্রীকতা, শিল্পাঞ্চল, ফার্নেস, ভারী শিল্প, অবিশ্বাস, প্রতারণা, ক্রুড়তা, তেজস্ক্রিয়তার কবিতা। সেখানেও তবু বাঁচবার দ‍্যোতনায় ল‍্যেলান্ড ইঞ্জিন ছুটে যায় কিংবা স্টিম ইঞ্জিনের পিস্টনের সরলরৈখিক গতি, কীভাবে চাকার বৃত্ত গতিতে কনভার্ট হয়, তা দেখিয়েছি। কিংবা সমস্ত তেজস্ক্রিয় মৌল, অস্থিরতায় রশ্মি বিকিরণ করে করে শেষে শান্ত ও সুস্থির হচ্ছে সীসায়।

আসলে সরকার প্রদত্ত দুবছরের আইটিআই ট্রেনিং আমার মেশিন-মানুষের পরিচয় নয়, আমি ছোট থেকেই উড়িষ্যার রাউড়কেল্লার সামনেই লাঠিকাটায় ‘ওড়িশা ইন্ড্রাস্টিজ লিমিটেডে’র কারখানার ধুলো ও ধোঁয়ার ভিতর, এখানে মারুতচুল্লী বানানোর ইঁট তৈরী হতো, সেইখানে মিনি ভারতবর্ষে খেলে বড়ো হয়েছি শৈশবে। গুজরাট, মহারাষ্ট্র, আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ সবজায়গার লোকেই এই কারখানায় কাজ করতো, আমি সকলের ভাষা কি বুঝতাম? তবু আমরা সমবয়সীরা কতো খেলা খেলতাম একসাথে, ভাষা ভিন্ন কিন্তু খেলাতে কোনো আনন্দের ঘাটতি হতোনা কোনো। তখন আমার বয়স আট বছর, পরেরবার আমার বয়স তেরো বছর, মাঝের সময়টুকু গ্রামে বসবাস। আমার বাবা ওই কারখানার সুপার ভাইজার, পরে ফোরম‍্যান হয়েছিলেন। সেইথেকেই আমাকে কেমিস্ট বানানোর স্বপ্ন। কারণ ওই কারখানায় কেমিস্টদের তখন দারুণ কদর ও মাইনে। আর আমার নরম মনে কবি হওয়ার স্বপ্ন ; ফলে সংঘাত ও বিপর্যয়। স্টিল প্লান্টের মারুতচুল্লি(ফার্নেস) কাছ থেকে পরে দেখেছি বার্ণপুরে লৌহ-ইস্পাত কারখানায় ১৯৯১ তে আইটিআই পড়ার সময়। সে এক বিস্ময় । লোহার গলনাঙ্ক প্রায় ১৫৩৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, সেটা সহ‍্য করার মতো, অর্থাৎ তার চেয়েও বেশি গলনাঙ্ক সম্পন্ন মাটি ও রাসায়নিক দিয়ে মেশিনের সাহায‍্যে তৈরী হতো এই ইঁট। সেখানেই প্রথম লেদ ছাড়াও নানান মেশিনের ব‍্যবহার দেখেছি শৈশবে, সবই বিদ্যুৎ চালিত। Lathe is the mother of all machines. এবং কী আশ্চর্য! লেদের লোহা অন্য লোহাকে কাটে, খায়, ফুটো করে, আকৃতি দেয়, ঘর্মাক্ত করে। আমার অগ্রজ কবি ও ঔপন্যাসিক বর্ধমানের চিত্তরঞ্জনের কবি মানব চক্রবর্তী ‘ফার্নেস’ নামে একটি দারুণ পত্রিকা করতেন। তিনি আবার লৌহ-ইস্পাত কারখানায় চাকরিও করতেন। আমার কবিতা খুব পছন্দ করতেন তিনি। নিয়মিত তাঁর ফার্নেস পত্রিকায় কবিতা ছাপতেন আর বলতেন তোমার কবিতা পড়ে আমি লেখার শক্তি পাই।
      অনেকে আনন্দে সমুদ্রের কবিতা লেখেন, ট্রেস কমানোর জন্য, তিনি আনন্দের জন্য, বিনোদনের জন্য লেখেন। আর হোলটাইমার কবিদের প্রচুর পড়াশোনা ও চিন্তা ভাবনার মাধ্যমে নতুন আঙ্গিক খুঁজে, শব্দ খুঁজে, নতুন ভাবনায় তাকে কবিতায় প্রতিস্থাপন করতে হয়। এটা হোলটাইমার কবির দায় ও দায়িত্ব। এই প্রতিস্থাপন যদি অনুকূল হয় তাহলেই কবিতায় তা বাজবে, কার্যকরী হবে, পরবর্তী প্রজন্ম গ্রহণ করবে। আমি ওই ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত প্রায় তিন হাজারের বেশি কবিতা লিখেছিলাম, সেই স্টাইল, ভাবনা, শব্দের ব‍্যবহার এবং ঢং দেখে, পাঠকেরা আমার নাম না থাকলেও বলতে পারতেন এটা রুদ্র পতি’র লেখা কবিতা। তারপর হঠাৎ কবিতা লেখা ছেড়ে দিলাম, অসুস্থ হয়ে পড়ার জন্য। হোলটাইমার কবিদের অসুবিধা এই, কবিরা দিন দিন শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে, কারণ মনের চাপ শরীরকে প্রভাবিত করে উপর্যুপরি, ফলে তাদের শরীরে ঔজ্জ্বল্য, বুদ্ধীদীপ্ত, চকচকে স্মার্টনেস খুঁজে পাওয়া যায় না এবং মনে রাখতে হবে, চোখের দেখায় অর্থাৎ অবয়বে, দেখতে আনইমপ্রেসিভ কবিরাই কালজয়ী হয়। উদাহরণ জীবনানন্দ দাশ, উদাহরণ বিনয় মজুমদার। অর্থাৎ কবিতার জন্য শহীদ হওয়া যাকে বলে। আর পিছনে ফিরে দেখলে দেখা যাবে, এই হোলটাইমার কবিদের লেখা যেহেতু একটু অন্যরকম হয় সেজন্য তাঁদের লেখা বানিজ্যিক কাগজ ছাপাতে চাননা তেমন। এ এক বিরাট আবহমানের সংকট।



রাহুল: কবিতার আর্কাইভ যদি করা হয় তা আমাদের সাহিত্যকে কতটা বিকশিত করতে পারে? এরকম কিছু চিন্তা-ভাবনা কি কখনও আপনার মনে হয়, যা সাহিত্যকে আরও এগোতে সহায়তা করবে?

রুদ্র পতি : কবিতার আর্কাইভ কবিতার পক্ষে এবং কবির পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কত কবির কত ভালো কবিতা যেগুলো প্রায় হারিয়ে গিয়েছে কারণ সেসব কাব্যগ্রন্থ এখন দুষ্প্রাপ্য , কবিতার আর্কাইভ হলে সেগুলো পড়ার, কপি করার সুযোগ মিলবে । 
   লিটল ম্যাগাজিনের কবি ও কবিতা কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যেটা জরুরী ছিল সে কথা আমি নয়ের দশকে বলেছিলাম তা আবার রিপিট করছি : স্নাতক স্তরে বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ছাত্রীদের সিলেবাসে লিটিল ম্যাগাজিন এবং সমকালীন কবিতা' শীর্ষক একটি chapter বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তরফ থেকে জুড়ে দেওয়া, এটা বাধ্যতামূলক অর্থাৎ তা থেকে প্রশ্ন আসবে উত্তর লিখে ছাত্রছাত্রীদের নম্বর পেতে হবে । তা হলে কি হবে? একাডেমিক পড়াশোনা করা অধ্যাপকেরাও লিটল ম্যাগাজিন এবং সমকালীন কবিতা সম্পর্কে আগে  জানবেন  তারপর ছাত্রছাত্রীরাও জানবে । এটা হলে কবিতা কেন্দ্রিক লিটিল ম্যাগাজিন গুলো এবং সমকালীন কবিদের প্রচার ও প্রসার যেমন হবে তেমনি পাঠকও বাড়বে । কবিতার প্রচার-প্রসারে টিভির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে ,কারণ এটি একটি দৃশ্য শ্রাব‍্য মাধ্যম। ইউটিউব এর ভূমিকাও রয়েছে । ওয়েবmagazine , facebook, whatsapp groupএর সাহায্যে কবিতার আদান-প্রদান , মত বিনিময় দারুণ কার্যকরী হচ্ছে । এবং নতুন লিখতে আসা অনেক কবি তার প্রথম লেখা কবিতাও অন্যের কাছে পৌঁছে দিতে পারছে আবার পরীক্ষামূলক লেখালেখি যেগুলো ছাপা কাগজে হয়ত আলোর মুখ দেখত না কোনদিন সেসব প্রকাশিত হচ্ছে অনলাইন পত্রিকার মাধ্যমে কারণ ছাপা ম্যাগাজিনের সম্পাদক এর অর্থনৈতিক চিন্তা তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা মূল লেখা ছাপাতে উৎসাহিত করে না।  অনলাইন পত্রিকায় সে খরচ নেই তাই স্বাধীনতাও প্রচুর।

(ক্রমশ)
রুদ্র পতি
জন্ম : ১৮ আগস্ট, ১৯৬৮
পিতামাতা : জগবন্ধু পতি ও যশোদাময়ী পতী
রসায়নে সাম্মানিক
আইটিআই সহ নানা বিষয়ে পড়াশোনা
নেশা : অ্যাক্রোস্পেস মহাকাশ, ইউক্লীডিয় জ‍্যামিতি চর্চা, রসায়ন চর্চা, সবজি চাষ ও গরু চরানো
তিনি লেখেন : স্বপ্ন ভেঙে যায়, ফের স্বপ্ন দেখি

প্রকাশিত কাব‍্যগ্রন্থ : প্রান্তিক চাষা (১৯৯৩)
লেদ অথবা অথবা অসম্পৃক্ত হাইডোকার্বন (২৯৯৩)
এ বছর শ্রাবণ ভালো (২০০৪)
বেকারের কবিতা (২০০৪)
গুচ্ছমূল (২০০৫)