এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

সম্পাদকীয়

               
                 হঠাৎ করেই যখন সম্পাদকীয় ডেস্কে বসতে হলো কলম বাগিয়ে(আদপে কলম নয়, আঙুল বাগিয়ে), সত্যি বলছি, ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলাম। লিখতে হবে সম্পাদকীয়! এবং আমাকে‍? কী লিখবো? কীভাবে?
উত্তর খুঁজতে মাথার চুলগুলো ঠিক ছিঁড়ে না ফেললেও, কাছাকাছি কিছু একটা করেছিলাম নিশ্চিত। অতঃপর, মাথা চুলকে কীনা জানিনা, উত্তর একটা পেলাম, একটা সহজ পথ…….এই ‘আমি’ শব্দটিকে জাস্ট ভ‍্যানিশ করে দেওয়া।
কে আমি? সম্পাদক’তো কোনো ‘আমি’ নয়……
যদি লিখতেই হয় কিছু, যদি বলতেই হয় কিছু, তাহলে বলবে ‘এখন তরঙ্গ’ নিজেই, সম্পাদকীয় ডেস্ক থেকে শুধু সেটা পোঁছে যাবে আপনাদের কাছে।

তবু সমস্যা একটা থেকেই যায়, যেকোন পত্রিকায় সম্পাদকের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার ছবি ফুটে ওঠেই। পত্রিকায় সম্পাদকের মননের ছাপ স্পষ্টতই থাকে। সম্পাদকের পরীক্ষা এখানেই, কতখানি সে তার ব‍্যক্তি-আমি’কে অস্পষ্ট করে, পত্রিকার দাবীকে স্পষ্ট করে তুলতে পারে।

পত্রিকা কী ও কেন? এইকথাটা অনেক সময়েই ভুলে যায় আমরা, পত্রিকার নিজস্ব চরিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে প্রতি মূহুর্তে ছলনা করি পত্রিকার উদ্দেশ্যের সাথেই। আসলে পত্রিকার চরিত্র নির্মাণ নয়, আমরা অনেক সময় পত্রিকার মধ্যে নিজের নির্মাণের পরিকল্পনা করে ফেলি। ঠিক সেই মূহুর্ত্তেই ‘সম্পাদকের নিরপেক্ষতা’ শব্দবন্ধটির মৃত্যু ঘটে এবং নিজেকে, নিজের পত্রিকাকে সবার থেকে আলাদা কিছু করার দাবীতে প্রতি মূহুর্তে গুটিয়ে ফেলি নিজেকে ও নিজের পত্রিকাকে নিজেরই খোলসে, আদতে খোলস নয় কঙ্কালের।
এই ভুলটাই আমি প্রায় করেই ফেলেছিলাম আর একটু হলেই, পরিকল্পনা করেছিলাম কবিতার ছলে লিখবো সম্পাদকীয় বা বেশ জমাটি গদ‍্য, বাঁচিয়ে দিল শাল‍্যদানী। ঠিক আমাকে নয়, ‘এখন তরঙ্গ’-কে। ও বললো, তোমার পাঠক কিন্তু সবাই, যে কবিতা বোঝে বা না বোঝে, সাহিত্য জগতের কেউ বা সাহিত্যের বাইরে এবং শিশুরাও। ভেবে দেখলাম ঠিকই তো, আমি তো এখানে সাহিত্য ফলাতে লিখতে বসিনি, আমি সেটাই লিখবো যেটা এই পত্রিকাটি চায় বা ‘এখন তরঙ্গে’র বৈশিষ্ট্য, উদ্দেশ্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।

অতএব আর ভ‍্যানতাড়া না করে সরাসরি সহজ সরল পথে ঢুকে পড়ি সেখানেই।
কিন্তু প্রতিটি শুরুর পিছনে একটা শুরু থাকেই,
যে প্রদীপটা আজ জ্বলতে দেখছেন, তার সলতে পাকানোর কাজ শুরু হয়েছিল অলক্ষ্যে, অন্ধকারে…….

খুব বেশি পিছনে যাবোনা, আমি শুধু আমার সংযোগটুকুই বলবো। ‘এখন তরঙ্গে’র মধ্যে আমি প্রবেশ করি মূলত শাল‍্যদানীর উৎসাহে এবং একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে এবং একটা স্বপ্ন। স্বপ্নটা এখন স্বপ্নই থাক, সময় এলে জানতেই পারবেন, এবং আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া পূর্ণও হবেনা। এখন আমরা লক্ষ্যর দিকে নজর ঘোরাই, হ‍্যা আমাদের এই লক্ষ্যটাই ‘এখন তরঙ্গে’র ক‍্যারেকটার….. make an open platform, একটি পত্রিকা যেখানে সবাই স্বাগত। কলমকে ভাগ-বাটোয়ারায় বিশ্বাসী নই আমরা। আমরা শ্রুতি থেকে পুঁথির ইতিহাসকে সামনে রেখে এঁকে যাবো সময়কথা, চূড়ান্ত অশ্লীল হোক বা ‘ধোয়া তুলসী পাতা’, মেলানকোলি সুর হোক বা বিরক্তিকর খটাংখট, যৌনতা হোক বা দেবকথা, গে হোক বা লেসবি, ‘এখন তরঙ্গ’ নির্দ্ধিধায় তাকে বুকে টেনে নেবে।
সোজা কথায়, তোমার কলম বাঁশি হতে পারে বা অসি, ‘এখন তরঙ্গ’ দুটোরই কেরামতি দেখতে রাজি, যদি তুমি দেখাতে পারো। খুব স্পষ্টভাবে নিরপেক্ষ দূরত্বে সময়কথাকে আঁকবে । পাঠক কী খাবে…….এইকথা ভাবার অবকাশ বা ইচ্ছা কোনটাই নাই। পাঠকের মতামত অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তার জন্য কমেন্ট বক্সের দিকে তাকিয়ে থাকবো, কিন্তু তার দোহাই দিয়ে দূরে সরে যাবোনা পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য থেকেই।

‘এখন তরঙ্গ’, ‘তরঙ্গ হাউসে’র সাহিত্য বিভাগের (আরো চারটি বিভাগ হল, নৃত্য, সঙ্গীত, নাটক, বাচিক শিল্প) অন্তর্গত একটি সাহিত্য পত্রিকা, যা সাহিত্যের চারপাশে কোনো গন্ডী টানায় বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস করে না, নিজের চারপাশে গন্ডী টেনে, নিজেকে অত‍্যুৎকৃষ্ট প্রমাণ করার অজুহাতে, নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে। এবং পুরো ‘তরঙ্গ পরিবার’ একযোগে এই ধারনায় বিশ্বাসী, প্রতিটি বিভাগ আলাদা আলাদা ভাবে কাজ করলেও আমরা সামগ্রিক ভাবে একই পথের পথিক।
                       এই ছোট্ট ছোট্ট তরঙ্গরা
                                   যেদিন ঢেউ হবে
                         মিলবে ও মেলাবে

                        এই লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই কিছু    ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়েছি আমরা, বা বলা ভালো ‘এখন তরঙ্গ’ আমাদের কানে কানে বলে গেল সে কী চায়…..

◆ কবিতার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে।
এখানে অভিজ্ঞ কবিদের সাথেই, বেশি করে নতুনদের লেখা ছাপা হবে। ‘কবিতার ল‍্যাব’ থাকবে, কবিতাকে ‘কাটাছেঁড়া’ চলছে ও চলবে।

◆◆ ‘কবিতা পাঠ’কে সাহিত্য অনুশীলনের অংশ
হিসেবেই আমরা মনে করি এবং এই সত‍্যকে সামনে রেখেই, ‘কবিতা পাঠ’কে সরাসরি পত্রিকার মধ্যে ঢুকিয়ে নিতে আমরা দ্বিধা করিনি।

◆◆◆এছাড়া, আম‍রা চিত্রাঙ্কন, ফটোগ্রাফিকেও
গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেছি।
◆◆◆◆ অতঃপর, যেকোনো ইউনিক ‘কাজ’, পেনে হোক বা তুলিতে, ক‍্যামেরার লেন্সে হোক বা বকমবকম মুখে, যদি আমরা খুঁজে পাই নিজস্ব চিন্তা ভাবনার ফসল, তবে সেটা নির্দ্ধিধায় গ্রহণ করবো, (প্রয়োজনে আলাদা বিভাগ খুলেও)
★ ‘এখন তরঙ্গ’ খুব স্পষ্টভাবে, পরবর্তী সংখ‍্যা
থেকেই, শিশু ও কিশোর সাহিত্যকে গুরুত্ব দেবে। এবং অবশ্যই শিশু ও কিশোর/কিশোরীর কলম অগ্রাধিকার পাবে। ‘এখন তরঙ্গ’ চায়, তাদের সাহিত্য তারা নিজেরাই সৃষ্টি করুক। তাদের অপরিণত(?), এলোমেলো রেখাকেও ‘এখন তরঙ্গ’ নির্দ্ধিধায় গ্রহণ করবে।

★ ★ পরবর্তী সংখ‍্যা থেকে সমসাময়িক নবীন কবি, মূলত ২০১৫ পরবর্তী সময়ে লিখতে আসা বা তার একটু আগে, এমন একজন করে কবিকে নিয়ে একটা সামগ্রিক ‘পোর্টফোলিও’ করা হবে।
ভাবছেন তো, সেটা আবার কী ? খায় না মাথায় দেয় ? একটু অপেক্ষা করুন, পরবর্তী সংখ‍্যা পর্যন্ত, তারপর সেটা খেতেও পারেন বা মাখতে।

★★★ আচ্ছা কবি/সাহিত্যিক তো দুইপ্রকার তাইনা? পূরুষ ও মহিলা ‍! রাগ করবেন না, জানি আপনি চেঁচিয়ে বলবেন কলমের কোনো জেন্ডার হয় নাকি? তুলির’ও কোনো জেন্ডার নাই। শিল্প-সাহিত্য জেন্ডারহীন সার্বজনীন। ঠিক, একদম ঠিক, মেনে নিলাম আপনার কথা এবং আপনার কথা মেনেই ‘এখন তরঙ্গ’ কলমকে প্রশ্ন করবে না তোমার জেন্ডার কী? তুমি পুরুষ, নারী না তৃতীয় লিঙ্গ? তুমি মানুষ। তোমার কাজেই তোমার পরিচয়। তুমি হতে পারো পূরুষ, তুমি হতে পারো নারী, বা তুমি তৃতীয় লিঙ্গ, হাতে কলম তুলে নাও, বা তুলি, ‘এখন তরঙ্গে’ তোমায় স্বাগত।

★★ ★★ “কীসব ছাপা হচ্ছে আজকাল”, আগডুম বাগডুম…..পাঠকেরা এসব খাবে? চিরন্তন সাহিত্যের ইতিহাসে কী মূল্য আছে এর? ইত্যাদি ইত্যাদি…..এই ডায়ালগ চিরকালীন। তবু ভাগ‍্যিস সব যুগেই কেউ না কেউ সম‍য়কথাকে লিখে রেখেছিল, জনপ্রিয়তার দোহাই না দিয়ে, পাঠকের টেস্টকে পাত্তা না দিয়েই। তাইতো জানতে পারি কোলরিজ মোটেও ঠিক প্রেমের কবি নয়, তাঁর অঙ্ক-কবিতার কথা বেমালুম ভোলা যায়নি শুধু এই সময়কথার সৌজন্য, যা অনেকক্ষেত্রেই পাঠকবিমুখ। তবু পাঠকের গূরুত্ব থাকেই, তাইনা ? সর্বোপরি সবই তো পাঠকের জন‍্যই। হ‍্যা, আমরাও গুরুত্ব দিই ও দেবো পাঠককে ও পাঠকের মতামতকে। এই ব‍্যপারে প্রাথমিক পরিকল্পনা করেছিল রাহুলদা, (এই পত্রিকার প্রতিটি আনাচে কানাচে রাহুলদার চিন্তা ভাবনা জড়িয়ে আছে, হয়তো থাকবেও) প্রতিটি সংখ‍্যায় একজন পাঠকদের সাক্ষাৎকার রাখার, পূর্ববর্তী সংখ‍্যার উপর, কিন্তু তার ব‍্যবহারিক প্রয়োগে বেশ কিছ সমস্যা রয়েছে। আমরা পরিকল্পনা একটু বদলে নিলাম, পরবর্তী সংখ‍্যা থেকে পাঠক রিভিউ বা পাঠকের মূল‍্যায়ন ছাপা হবে, সেটা কোনো লেখা নিয়ে হতে পারে, বা সামগ্রিক ভাবে পত্রিকা নিয়ে, গঠনমূলক সমালোচনা হতে পারে বা বিরুদ্ধ সমালোচনা আমরা নির্দ্ধিধায় ছাপবো। ব্লগে, ফেসবুক পেজে, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যে মতামত পাবো আমরা, সেখান থেকেই বেছে অবিকৃত ভাবে তুলে দেবো পরবর্তী সংখ‍্যায়।

একটা প্রশ্ন প্রতিটি পত্রিকার সামনে থাকেই, তা হলো, সেই পত্রিকাটির টার্গেট পাঠক কারা? এই উত্তরের পথেই হেঁটে যায় পত্রিকা। প্রশ্নটা ছিল আমাদের সামনেও, এবং উত্তর ? জলবৎ তরলম্…….আমাদের কোনো টার্গেট পাঠক নেই, বরঞ্চ ঠিক উল্টোটা, সমস্ত পাঠকের টার্গেট পত্রিকা নাম হবে ‘এখন তরঙ্গ’

এরপরেও কিছু বলার ছিল, কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ছিল, কিছু অভিযোগের।
কিন্তু ভেবে দেখলাম, কেন? প্রয়োজন কী তাদের গুরুত্ব দেওয়ার? যদি কিছু বলতে হয়, আপনারই বলবেন, বা আরো ভালো করে বললে, ‘এখন তরঙ্গ’ নিজেই তার পাঠকদের দিয়ে, তার বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগের জবাব বলিয়ে নেবে।

শুধু সমালোচনা নয়, পাশে পেয়েছি অনেককেই এবং উৎসাহ ও সাহায্য। তাঁদেরকে ধন্যবাদ ও প্রণাম। তবে, শাল‍্যদানী, বিজন, ঐন্দ্রিলা, তুলি, দিব‍্যায়নকে ধন্যবাদ জানাবোনা। কেন জানাবো? আমরা তো পুরো কাজটা একসাথেই করেছি এবং করে যাবো আর নিজের লোককে কেউ ধন্যবাদ জানায় নাকি ?

ধন্যবাদান্তে
জ‍্যোতির্ময় মুখার্জি
Chief Editor at ‘এখন তরঙ্গ’

(সাহিত্য বিভাগ, তরঙ্গ হাউস’)

জ‍্যোতির্ময় মুখার্জি
মাহাতা-পূর্ব বর্ধমান


No comments:

Post a Comment