উপন্যাস
(ধারাবাহিক)
(ধারাবাহিক)
চাটনি
পর্ব ৩
সোমের ঠোট শুঁকিয়ে আসে তেষ্টায় । চোখের সামনে ঢাকা দেওয়া এক গ্লাস জল, কিন্তু গ্লাসটা দেখলে শরীর গুলিয়ে উঠছে । সোম চেয়ার থেকে উঠে পাশের ছোট্ট চেম্বারে ঢুকল । অন্ধকার ঠাণ্ডা এই ঘরটায় মাঝে মাঝে এসে দাড়াতে খুব ভালো লাগে । ফ্রিজ থেকে একটা ঠাণ্ডা বোতল বারকরে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসল সে । হাতে ঠাণ্ডা বোতলের শীতলতা সে অনুভব করল কিছুক্ষণ । তারপর গলায় জল ঢেলে আবার চোখ বন্ধ করল । সোম অনুভব করছে তার গলা বেয়ে ঠাণ্ডা জল ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে । শরীরের তেষ্টা মিটলে আবার মনে পড়ে মেয়েটির মুখ ।এরকম কত মুখ এই কয়েক বছর ধরে সে দেখে চলেছে, এক সময় সব মুখ গুলো যেন কেমন একরকম হয়ে যায় । আজকাল সব মেয়ের মুখ তার কাছে এক রকম মনে হয়, আলাদা ভাবে কারুকে আলাদা সে করতে পারে না । আজকের মেয়েটার মুখটা প্রথম দেখে একটু ঘাবড়ে গেছিল সে, মনে হচ্ছিল অবিকল নকশীর মুখ । নকশীর পচাগলা নগ্ন শরীরের দুর্গন্ধে প্রথম কয়েক পা পিছু হটেছিল সে । তারপর ওসি সাহেব যখন বললেন, স্যার , শরীর খারাপ লাগছে নাকি ? তখন নিজেকে একটু সামলে নিয়েছিল সে ।
শোফার পাশে এসির সুইচটা অন করতেই একটা সুন্দর গন্ধে ভরে গেলো ঘরটা । সোমের এই গন্ধটা খুব ভালো লাগে, একটা ঠাণ্ডা গন্ধ সারা শরীরের ক্লান্তিকে নিমিষে মুছে দিতে পারে । এই ঘরে বসে নানা রকম কথা ভাবতে ভালো লাগে । আজ নকশীর কথা ভাবতে ইচ্ছে করছে । আজকাল নকশীকেও কেমন যেন অদ্ভুত লাগে সোমের । মাঝে মধ্যে মনে হয় নকশী মানসিক রুগী হয়ে গেছে । কথা বলার সময় কিংবা কোন কাজ করার সময় নিজের হাতের গন্ধ শোকা কিংবা মাঝ রাতে ঘুম ভাঙ্গলে সোম অনেক সময় নকশীকে বাগানের দিকের জানালায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে । প্রথম প্রথম কোন কিছু অস্বাভাবিক মনে না হলেও পড়ে মনে হয়েছে সে যেন কারুর সাথে এক মনে কথা বলে চলেছে । কি কথা যে বলে কিছু বোঝা যায় না, তবে বিড়বিড় করে এক মনে বলে চলে । নিজের কাজের চাপ এত বেশি যে ঘরের ভেতরের সমস্যা গুলো চোখে পড়লেও অদেখা করা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না । তাই সকালবেলা নকশীর চোখের তলার গভীর কালী সোমকে কোন দিন উদ্বিগ্ন করে না । অবশ্য এর আগেও কোন দিন করে নি । কারণ , সেদিন নকশীর মেলটা ভুল করে সোমের কাছে চলে না এলে তার থেকে অনেক ভালো মেয়ের সাথে হয় তো সোমের বিয়ে হত । যে কারণে তার বাবা, মা, দিদিরা কোন দিন নকশীকে মেনে নিতে পারে নি । দিদিদের আশা ছিল, দেখে শুনে ভায়ের জন্য সুন্দরী মেয়ে নিয়ে আসবে । বড় জামাই বাবু বিয়ে ঠিক হবার পড় তো বলে ছিলেন , বাড়ি গাড়িওয়ালা লোকের মেয়ের সাথে বিয়ে হতে পারত । কি বিয়ে হচ্ছে ! এখন সত্যি খুব আপসোস হয়, সেদিন বিয়ে না করলে আজ হয়তো আই এ এস টাও পেয়ে যেত সে । একবার ঝগড়ার সময় সে তার মাকে বলেছিল, আর এক বছর সম্পর্ক থাকলে আমি একে বিয়ে করতাম না । সোমের মায়েরও ইচ্ছে ছিল, লাখ পাঁচেক টাকা পণ নিয়ে ছেলের বিয়ে দেবে, কিন্তু ছেলের নির্বুদ্ধিতার জন্য তা হয়ে ওঠে নি ।
একটা মেয়ের জন্য সে নিজেকে আর ২৬ বছরের সম্পর্ক গুলোকে এই ভাবে ঠকিয়েছে । সোমের শরীরটা খারাপ লাগছিল । সে চোখ খুলে সোজা হয়ে বসল । আজ এই জেলার জেলা শাসক হলে সে নিজের ইচ্ছে মতন কত কাজ করতে পারত , তা না এই ভাবে একজন অযোগ্য জেলা শাসকের অধীন কাজ করতে প্রতি পদক্ষেপে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে হচ্ছে তাকে । সোম, দুটো হাত এত শক্ত করে বসে ছিল, এক সময় মনে হল হাতে রক্ত জমে গেছে । বাইরের চেম্বারে অফিসের বড়বাবুর গলার আওয়াজ পেয়ে নিজেকে কোনক্রমে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল সে ।
বাইরের বারান্দায় ঘুঘু পাখি ডাকছে । ঘুঘু পাখীর ডাক শুনলে মনটা খুব শান্ত লাগে । শান্তিপুরের অলকা পিসির বাড়িতে দুপুর বেলা এরকম ঘুঘুর ডাক সে শুনেছে । অলকা পিসির বাড়ি অনেক বছর যাওয়া হয় নি নকশীকাঁথার , কিন্তু পিসীর জন্য খুব মন কেমন করে । দুপুরে ঘুঘুর ডাক শুনে মনে পড়ে গেলো অলকা পিসির হাতে মাখা মুড়ি আর মিষ্টি কাঁঠালের স্বাদের কথা । কত বছর হয়ে গেছে কাঁঠাল খাওয়া হয় নি । সোমের কাঁঠালের গন্ধ পছন্দ না, তাই বিয়ের পড় থেকে কাঁঠাল খাওয়া হয়ে ওঠে নি তার । নকশীর মনে হয় বিয়ের জীবন আর তার আগের জীবনের মাঝে এক বিশাল দ্রাঘিমা রেখা । তার ভালো লাগা গুলো সব যেন রয়ে গেছে ওপাড়ে । খাবার ঘরের যে জানালাটা বারান্দার সাথে , সেই জানালার পর্দা ফাঁক করে সে দেখছিল ঘুঘুদের । দুটি ঘুঘু পাখী এসেছে । তারা প্রতিদিন আসে বলে নকশী কিছু শস্য ছড়িয়ে রেখে দেয় বারান্দায় আর এক পাশে একটা বাটিতে রেখে দেয় কিছুটা জল ।পশু পাখীদের জল খাওয়াতে ওর খুব ভালো লাগে । একটা বিষয় ওকে খুব অবাক করে, রোজ দুটো পাখী আসে, কিন্তু ওদের একজন শস্য দানা খায় আর একজন পাহারা দেয় । অন্য কোন পাখী এলে সে তাদের তাড়িয়ে দেয় । যে পাখীটা খায়, তার খাওয়া শেষ হলে দুজনে এক সাথে পাত্রে রাখা জল খেয়ে উড়ে যায় । নকশীর মনে হয় যে পাখীটা পাহারা দেয় সে ছেলে পাখী । কিন্তু ও কেন খায় না এ ব্যাপারটা নকশীকে সত্যি খুব ভাবায় । পক্ষী সমাজ সত্যি কত বিচিত্র । কিন্তু ওদের মধ্যে কত ভালোবাসা, একে অপরের প্রতি নির্ভরশীলতা যা মনুষ্য সমাজে পাওয়া যায় না । পাখী গুলো চলে গেলে নকশী ফিরে আসে শোবার ঘরে । ফোনটা পড়ে আছে খাটের ওপর । বিছানার হলুদ চাদরের ওপর নীল রঙের ফোনটা দেখতে চমৎকার লাগছে । হলুদের সাথে নীল রঙ সত্যি খুব সুন্দর মানায় । তার প্রিয় ফুল হলুদে গোলাপ আর সোমের নীল পদ্ম । একবার উত্তরাখণ্ডে ট্রেক করতে গিয়ে সোম নীল পদ্মের ছবি তুলে এনেছিল । স্বর্গে ফোটে এই পদ্ম । কিন্তু নীল তো বিষের রঙ । বিষাক্ত জিনিসও কত সুন্দর হয় আবার তা দুর্গার পূজাতেও লাগে । কিন্তু হলুদ গোলাপ কত সুন্দর, মিষ্টি , অথচ সেই অর্থে বেকার । নকশীর মনে হল নীলের পাশে আছে বলেই হলুদকে আজ এত সুন্দর দেখাচ্ছে । নীল রঙের প্রতি আজকাল তার আসক্তি খুব বেশি । বিষাক্ত নীল রঙে সারা দিন মেতে থাকতে ইচ্ছে করে । যেমন এই মুহূর্তে ফোনটার প্রতি খুব আকর্ষণ অনুভব করছে । বিছানায় শুয়ে ফোনটা তুলে নিলো সে । তারপর আবার সেই ছবিটা খুলে দেখল । লোকটা একটা চারচৌকো কার্ডের ওপর কিছু লিখছে । ছবিটা দেখে সত্যি মনে হচ্ছে কেউ তুলে দিয়েছে । না হলে এত সুন্দর ফ্রেমে আসে না । লোকটা হোটেলের ঘরে একা, কিন্তু, কেউ তুলে দিচ্ছে কিভাবে ? অস্বাভাবিকও কিছু না , কারণ এরকম বহু রাতে নকশী লোকটাকে ফোন করে শুনেছে অন্য নারীর কণ্ঠ । আবার পরের দিন সকালে সব স্বাভাবিক, যেন কেউ আসে নি । লোকটা যে বহু-গামী তাতে কোন সন্দেহ নেই । একটা বহু-গামী লোকের প্রতি এত আকর্ষণের কারণ কি ? লোকটা ভালো না, তা জেনেও কেন নকশীর মনে হচ্ছে এই লোকটার সাথে আরেকটু ঘনিষ্ঠতার প্রয়োজন আছে । বকুলের মতন মেয়েরা যারা হারিয়ে গেছে, এদের সন্ধান তো মরীচের মতন লোকেদের কাছেই থাকে । দীর্ঘ রোমাঞ্চ হীন জীবনে যেন কোন জিয়ন কাঠির সন্ধান সে পেয়ে গেছে ।
ফোনটা হাতে নিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই একটা নীল আলো জ্বলে উঠল । মাঝে মাঝে নীলকণ্ঠ বলে নিজেকে ডাকতে ইচ্ছে করে । সারা জীবন শুধু বিষ ধারণ করে গেছে সে , বিষ ধারণের ক্ষমতা তো সবার থাকে না । কিছু মানুষ তা পারে । তাই তো পৃথিবীর অন্য মানুষরা ভালো থাকে । নাম্বারটা কি যেন ছিল, এখনো মুখস্থ হয় নি । প্রথম দুটো সংখ্যা নয় ছিল এটুকুই মনে আছে । মিসকলে গিয়ে প্রথমেই নাম্বারটা পেয়ে গেলো নকশী । আধ ঘণ্টা আগে এই নাম্বার থেকে একটা ফোন এসেছিল , ফোনটা সাইলেন্ট মোডে থাকায় সে শুনতে পায় নি ।
নাম্বারটা ব্যস্ত আছে দেখে নকশী ফোনটা কেটে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল । এই মুহূর্তটা বড় বেশি নিঃসঙ্গ লাগে । মনে হয় যদি টাইম মেশিন থাকত তাহলে টাইম ট্রাভেল করে ছোটবেলার দিন গুলোতে ফিরে যাওয়া যেত । ছোট বেলার দিনের কথা মনে পড়তেই নকশীর মনে হল , সত্যি যদি তা করা যেত, জীবনটা বদলে ফেলা যেত । টাইম মেশিন থাকলে সত্যি যদি সব বদলে দেওয়া যায়, তাহলে ভবিষ্যতে গিয়ে আমরা সব কিছু দেখে এসে, সেই মত কাজ তো করতেই পারি । কিন্তু এই মুহূর্তে তার অলকা পিসির বাড়ি যেতে ইচ্ছা করছে । মন বলল তিন বাড় তুড়ি দিয়ে চোখ বন্ধ কর । ও মনের কথা মতন তাই করল । সে তিন বাড় তুড়ি দিয়ে চোখ বন্ধ করতেই ঘুঘুর ডাক শুনতে পেলো । নকশীর খুব গরম লাগলো । এই ভাবে বেশিক্ষণ চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব না । নকশী চোখ খুলে দেখল সে একটা গ্রামের বাড়ির বারান্দায় শীতল পাটির ওপর শুয়ে আছে । আর বারান্দাটার চারপাশে ঘুঘু চড়ছে । উঠে বসতেই দেখল অলকা পিসি একটা বাটিতে কি যেন নিয়ে আসছে । অলকা পিসির গাল ভরা হাসি । এই ভদ্রমহিলার মতন এত মাতৃত্ব সত্যি এর আগে কারুর কাছ থেকে সে পায় নি । নিজেকে বছর দেশের একটি মেয়ে মনে হচ্ছে যে একটা হলুদ রঙের জামা পড়ে বসে আছে । অলকা পিসীর হাতে শাখা,পলার ঘর্ষণে আওয়াজ হচ্ছে। পিসি বাটিতে কাঁঠাল আর মুড়ি মাখছে । মুড়ির মধ্যে কাঁঠালের রস ঢুকে বুদবুদি উঠছে । কাঁঠালের গন্ধ খুব প্রিয় তার , সে মুখ বাড়িয়ে দিতেই পিসি মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে । মাথায় ঘোমটা দিয়ে পিসিকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে । নকশী উঠানের দিকে তাকিয়ে দেখল , একটা জামরুল গাছের নিচে কয়েকটা ছাগল বাধা আছে । ছাগল গুলো দিবা নিদ্রা দিচ্ছে । জামরুল গাছের পাশের দেওয়ালে অনেক গুলো ঘুটে দেওয়া । ওটা গোয়াল । নকশীর মনে আছে ভোর বেলা পিশেমসাইয়ের সাথে গরুর দুধ দোয়ানো দেখতে গেছিল সে । এ বাড়িতে কাজলী নামে একটা কালো গরু আছে । গরুটার দুধ খুব মিষ্টি । নকশী পিসীকে বলল, পিসী কাজলী কেমন আছে ?
পিসী এক গাল হেসে বলল, কাজলীকে তুমি দেখবে ?
নকশী বলল, হুম ।
পিসী বলল, বেশ কাল ভোরে পিসেমশায়ের সাথে দুধ দোয়ানো দেখতে যেয়ো ।
খাওয়া শেষ হলে পিসি কুয়ো পাড়ে যায় বাটি ধুতে , সেও যায় সাথে । কুয়োর পাশে একটা ছোট্ট কুকুর ছানা বসে হাফাচ্ছে । নকশী হাত ধুয়ে কিছুটা জল একটা ভাঁড়ে করে এনে দেয় ওকে । কুকুর ছানা লেজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে জল খেতে থাকে । জল খাওয়া শেষ হলে, নকশীর দিকে তাকিয়ে দ্যাখে । নকশী বলে, তুই আজ রাতে গাড়ি চাপা পড়বি । আমি জানি , তাই খুব সাবধানে থাকিস । অলকা পিসি ডাক দেয়, নকশী কুয়োর ধার থেকে চলে এসো । সে পিসিকে বলে, পিসি কুয়োতে কি আছে ।
পিসি বলে , কুয়োর ভেতর হামাগুড়ি দেওয়া ভূত আছে , যে বাচ্চাদের একলা পেলে কুয়োর ভেতর নিয়ে চলে যায় ।
সে পিসির পেছন পেছন রান্নাঘরে এসে বলে, পিসি , আমাকে হামাগুড়ি ভূতের গল্প বলো ।
পিসি বিকেলের জন্য জলখাবার তৈরি করছিল । সামনে মাটির উনুনে কড়ায়, তেল গরম হচ্ছে, পিসি তাতে পাঁচ ফোঁড়ন আর শুঁকনো লঙ্কা দিতেই ঝাঁঝে নকশীর নাক মুখ বন্ধ হয়ে গেলো । নকশীকে কাশতে দেখে পিসি বলল, তুমি বারান্দায় গিয়ে শুয়ে থাকো । আমি কাজ শেরে এসে তোমাকে হামাগুড়ি ভূতের গল্প বলবো ।
নকশী বাধ্য মেয়ের মতন বারান্দায় এসে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ে । কিছুক্ষণ পড় ওর মনে হয় বুকের ভেতরটা কেমন যেন কাঁপছে । নকশী বুকের ওপর হাত দিয়ে দ্যাখে মোবাইলটা কাঁপছে । চোখ খুলে দ্যাখে সে নিজের বেডরুমে শুয়ে আছে । ফোন নাম্বারটা দেখে সে বুঝতে পারে মরীচ ফোন করেছে । ফোনটা ধরতেই মরীচ বলল, ফোন করেছিলে ?
নকশী বলল, এতক্ষণ ফোনে কার সাথে কথা বলছিলে ?
মরীচ বলল সামনের শুক্রবার শিলিগুড়ি যাচ্ছি , ইউনিভার্সিটিতে মিটিং আছে । তাই ফোন এসেছিল ।
নকশী কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবল । মনে মনে খুব খুশি হয়ে বলে , তাহলে শনিবার চলে এসো, দুদিন কাটিয়ে যেয়ো ।
মরীচ বলল, তোমার স্বামী থাকলে আমি যাবো কি করে ?
নকশী এখন কোন কিছু ভেবে আর বলছে না । সব কিছু যেন সে আগে থেকেই জানে । সে বলল, আমার স্বামী থাকবে না । ও দিল্লি যাবে প্রাইজ আনতে ।
মরীচ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, কিসের প্রাইজ পাচ্ছে তোমার স্বামী ?
নকশী বিছানা থেকে উঠে বসে বলল, ব্লকের উন্নয়নের জন্য সরকার ওকে পুরস্কৃত করছে ।
মরীচ বলল, নকশী তুমি জানো না, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি ।
নকশী বলল, আমি জানি , তাই তো আসতে বলছি ।
মরীচ বলল, এখন রাখি, আমার ক্লাস আছে । শুক্রবার ফোনে কথা বলে নেবো ।
মরীচ ফোন রাখার আগে নকশী বলল, এই তোমার দিল্লি যাবার ফ্লাইট তো বুধবার বিকেল পাঁচটায় তাই না ?
কথাটা শুনে মরীচের মাথায় যেন কারেন্ট লাগে । অবাক হয়ে একবার ভাবে, গত কয়েকদিন ধরেই সন্দেহ হচ্ছিল, তার মেল আইডি মনে হয় হ্যাক হয়েছে । এবার ব্যাপারটা আর সন্দেহের জায়গায় থাকল না । এখুনি পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করতে হবে । সে নিজের সব সন্দেহ কোন ক্রমে চাপা দিয়ে নকশীকে বলল, আমার ক্লাসের সময় হয়ে গেছে পড়ে কথা বলছি ।
এই বলেই সে ফোনটা কেটে দেয় ।
ফোনটা রাখার পড় নকশীর মনে হল বাগানে একটা কুকুর ডাকছে । সে ভালো করে শোনার চেষ্টা করল, কোন দিক থেকে আওয়াজটা আসছে । নকশী শুনতে পেলো মশলা বাগানের থেকে কুকুরটা ডাকছে । দুপুর বেলা মনে হয় শ্যামাচরন বাগানের গেট বন্ধ করতে ভুলে গেছে । সে আর দেড়ি না করে ছুটে যায় বাগানে । গিয়ে যা দ্যাখে, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না । অলকা পিসির বাড়ির কুকুর ছানাটা তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে । তাহলে কি কুকুরটা ওর সাথে টাইম ট্রাভেল করে এসেছে । সত্যি মানুষের জীবনে কত ঘটনা ঘটে যা স্বাভাবিক বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করা যায় না । কুকুরটা নকশীকে দেখে ছুটে আসে । নকশী ওকে কোলে তুলে নিলে, সে ওর গাল চেটে নিজের ভালোবাসার প্রকাশ করতে থাকে । নকশী নিজের মধ্যে এক গভীর মাতৃত্ব অনুভব করে । সে বাচ্চাটার মাথায় চুমু খেয়ে বলে, তোকে বলেছিলাম না আজ রাতে তুই গাড়ি চাপা খেয়ে মাড়া যাবি, তুই আমার কথা শুনলি না কিন্তু । এখন আমার সাথে আমার ঘরে চল । আজ রাতে তোর বিপদ আছে । তবে আমার সাথে থাকলে তোর কোন বিপদ হবে না । খাবার ঘরে ঢুকে সে কাঁঠালের গন্ধ পেলো । কুকুরটা এত বড় বাড়ি দেখে নকশীর কোল থেকে নেমে ছুট দিলো ঘরের ভেতরে । নকশী ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে ডাইনিং টেবিলের দিকে । সে দেখতে পেলো অলকা পিসির মুড়ি আর কাঁঠাল মাখা বাটি রাখা আছে টেবিলের ওপর । শরীরটা হঠাত করে খুব খারাপ লাগলো । ও শোবার ঘরে এসে মশলার বাগানের দিকের জানালাটায় দাঁড়াল । নকশীর ডান হাতটা চটচট করতে লাগল । সে হাতটা নাকে ছোঁয়াতেই আমতেলের গন্ধ পেলো ।
বাগানের চন্দন গাছটার নীচে বসে শ্যামাচরন কিছু একটা করছিল, ম্যাডামকে জানালায় দেখে সে এগিয়ে আসে জানালার সামনে । তার মনে হয় বকুলকে নিয়ে কিছু বলবেন বলে ম্যাডাম তার দিকে চেয়ে আছেন । নকশী হাতের গন্ধ শুকতে শুকতে বলে, শ্যামা তুমি আচারের ফ্যাক্টরিতে গেছিলে ?
শ্যামা চরণ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে আজ সারা দিন সময় পাই নি, আমি ভেবেছি আপনি হয় তো গেছেন ।
নকশী কি একটা ভাবছে, কিছুক্ষণ ভেবে সে বলল, ভুল করে আজ অন্য এক জায়গায় চলে গেছিলাম, কাল একবার আচারের ফ্যাক্টরিতে যাবো ।
শ্যামাচরন বলল, কোন দরকারি কাজে গেছিলেন ম্যাম ?
নকশী বলল, একটা কুকুরকে বাচাতে গেছিলাম ।
শ্যামার চোখ পড়ল মশলা বাগানের দিকে । একটা কুকুর দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে । এই কুকুরটাকে আগে সে কোন দিন দ্যাখে নি ।
নকশী বলল, ও খুব দুষ্টু, এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতে পারে না ।
শ্যামাচরনকে দেখে কুকুরটা লেজ নাড়তে নাড়তে এগিয়ে এলো । কুকুর খুব একটা পছন্দ না তার, তাছাড়া কুকুর বাগানে থাকলে বাগান নোংরা করবে । আর সে সব নোংরা তাকেই পরিষ্কার করতে হবে ।
নকশী বলল, ও অন্ধকারকে ভয় পায়, তাই রাতে আজ বাগানে আলো জ্বালিয়ো না , তাহলে ও বাইরে যাবে না ।
শ্যামাচরন কুকুরটাকে কোলে তুলে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিলো । তারপর মাথা চুলকাতে থাকল ।
শ্যামাচরন যখন মাথা চুলকায় তখন নকশীর খুব ভালো লাগে । ওর মনে হয় কর্মঠ মানুষরা মাথা চুলকায় বেশি । কারণ তারা আরো অনেক বেশি কাজ করতে চায় ।
নকশী বলল, শ্যামাচরন, রাত হলে আমি নানা রকম শব্দ শুনতে পাই । মনে হয় বাড়ির ছাদ থেকে বুট জুতো পড়ে কেউ নেমে আসছে । আমার আজকাল খুব ভয় করে ।
শ্যামা মাথা থেকে হাত নামিয়ে গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে থাকে তার দিকে ।
নকশী আঙ্গুল তুলে বলে, ঐ যে মশলার বাগানের পেছনে উঁচু মাটির ঢিবি, আমার মনে হয়, রাত হলে ওখানে কেউ বসে থাকে , লোকটা বিড়ি খেতে খেতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে ।
শ্যামাচরন বলল, ম্যাডাম আপনাকে গল্প বলতে ভালো লাগে । কারণ আমার গল্পের মধ্যে যে কোন গুঁজব নেই তা আপনি ছাড়া আর কেউ কোন দিন বোঝে নি । এত দিন মেটেলি এবং তার আশেপাশের জায়গায় ঘটে যাওয়া সব রকমের অলৌকিক ঘটনার কথা বলেছি । কারণ এ এক অদ্ভুত রাজ্য, এখানে থাকতে হলে এর নাড়ি নক্ষত্রের সব কিছুর সাথে আপনাকে পরিচিত হতে হবে । তবে ভেবেছিলাম এই ঘটনাটা আপনাকে বলবো না কারণ দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ , কিন্তু এখন আর না বলে কোন উপায় নেই ।
নকশী বিব্রত হয়ে বলল, তুমি যখন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, এসব কথা বাগানে দাঁড়িয়ে বলতে হবে না । কারণ কেউ শুনে ফেললে বিপদ হবে । আমি দরজা খুলে দিচ্ছি, তুমি ভেতরে এসো ।
শ্যামাচরন খাবার ঘরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে ছাদের দিকে তাকিয়ে গল্প শুরু করল । নকশী বসে আছে চেয়ারে । সে একবার ছাদের দিকে তাকিয়ে আবার শ্যামার মুখের দিকে তাকালো ।
আজ থেকে তিরিশ বছর আগে বিডিও অফিসে একজন নেপালি দারোয়ান কাজ করতেন । মশলার বাগানটা যেখানে এখন দেখছেন, সেখানে ওর ঘর ছিল । কারুর সাথে খুব বেশি কথা সে বলত না , সব সময় চুপচাপ থাকত । সবাই বলত দারোয়ানকে ভূতে পেয়েছে , রাতের বেলা শিমূল গাছ থেকে কে যেন নেমে আসে ওর ঘরে , তারপর দারোয়ান জী দরজা বন্ধ করে তার সাথে কথা বলে । তখন এখানে বিডিও সাহেব ছিলেন ইজাজ আহমেদ । ওনার স্ত্রী ওনার সাথে এখানেই থাকতেন , আপনি যেমন থাকেন । ভাবীও নিঃসন্তান ছিলেন, ঠিক আপনার মতনই । আপনার সাথে যেমন আমি এসে গল্প করি, ভাবীকেও নানা রকম গল্প শোনাতাম । দেখছেন কিভাবে মিলে যাচ্ছে ।
নকশী কি বলবে বুঝতে পারছে না, একটা ঘোরের মধ্যে যেন যে ডুবে যাচ্ছে । শ্যামাচরন লক্ষ্য করল নকশী খুব জোড়ে জোড়ে পা নাড়াচ্ছে । তার কামিজের ঠাণ্ডা হাওয়া এসে লাগছে শ্যামার গায়ে ।
সে আরো উত্তেজিত হয়ে একটু সোজা হয়ে বসে বলল, ভাবীও আপনার মতন অনেক কিছু দেখত । সে কথায় পরে আসছি । সে একটা বাচ্চার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল । আমি ভাবীর দুঃখ চোখে দেখতে পারতাম না । একদিন আমি শীতলা তলা থেকে জলপরা নিয়ে এসে বাইরের জানালার সামনে এসে দেখি সে এক মনে তাকিয়ে আছে চন্দন গাছটার দিকে । আমি অনেক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে তাকে ডাক দিই , ভাবী কি দেখছেন ঐ দিকে ?
ভাবী বলে, শ্যামা , কাল গভীর রাতে একবার বার্থরুমে গিয়ে মনে হল বাগান থেকে কিছু একটা আওয়াজ আসছে । আমি জানালার সামনে এসে দেখি চন্দন গাছ থেকে একটা উলঙ্গ মানুষ নেমে আসছে । ঘরের আলো বন্ধ থাকলেও বাগানের আলো এসে পড়ে ভেতরে, তাই পর্দার আড়াল থেকে দেখলাম, লোকটা গাছ থেকে নেমে হামাগুড়ি দিয়ে বাহাদুরের ঘরে ধুকে গেলো ।
আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না , আগে ভাবতাম অফিসের লোকজন বাহাদুরকে পছন্দ করে না বলে এসব রটাচ্ছে । কিন্তু ভাবী যখন বলছেন তখন তা মিথ্যা কখনই হতে পারে না । এই ভাবেই চলতে থাকে । আমি রোজ আসতাম আর ভাবী এক কথা বলতেন । দিন দিন তিনি কেমন যেন শুঁকিয়ে যেতে থাকেন , আপনি যে জানালায় দাঁড়িয়ে আমার সাথে কথা বলেন, ঠিক ওখানে দাঁড়িয়ে ভাবী রোজ বাগানের দিকে চেয়ে থাকত । বহু ডাক্তার আসে , কিন্তু কেউ কোন রোগ ধরতে পারে না । আমি রোজ জলপড়া এনে একটু একটু করে দিয়ে যেতাম ।
একদিন শুনলাম দারোয়ানের কোন খোজ পাওয়া যাচ্ছে না, দু দিন নাকি সে নিজের ঘর থেকে বেড় হয় নি । তখন সাহেব আমাকে বললেন দারোয়ানের ঘরে গিয়ে তার খবর নিয়ে আসতে , আমি ওর ঘরে গিয়ে দরজা ধাক্কালাম । কিন্তু ও দরজা খুলল না । তখন বাধ্য হয়ে বাগান থেকে শাবল এনে দরজা ভেঙ্গে দেখি লোকটা কোথাও নেই অথচ ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ । এই ঘটনার এক সপ্তাহ পর ভাবী মাড়া যান । যেদিন মাড়া গেলেন তার আগের দিন দুপুর বেলা আমি দেখি সে বিছানায় শুয়ে জানালার দিকে চেয়ে কি দেখছে । আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি ভাবী, কি দেখছেন ?
তিনি ধরা ধরা গলায় আমাকে বলেন, শ্যামা সেদিন রাতে বাহাদুর সেই লোকটার সাথে গাছে উঠে চলে গেছে, এবার আমার যাবার পালা ।
আমি বলি , রোজ জলপড়া নিয়মিত খান, আপনার কিছু হবে না । কিন্তু ভাবীকে বাঁচান যায় নি । তার মৃত্যুর পর বাহাদুরের ঘরটাও ভেঙ্গে দেওয়া হল । আমি অনেকটা ফাকা জায়গা দেখে সেখানে একটা মশলার বাগান করে ফেললাম ।
নকশী খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল, লোকটা বিড়ি খেতো ?
শ্যামাচরন বলল, মিথ্যে কথা কেন বলবো ম্যাডাম বিড়ি কেন ? তার কোন নেশাই ছিল না ।
কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা হয়ে রাত হয়ে গেছে । আজ ঘরের আলো জ্বালাতে ভুলে গেছে নকশী বাগান থেকে একটা আলো এসে খাবার ঘরে ধুকতেই একটা কুকুরের ডাক কানে এলো । তারপর সব চুপচাপ । নকশী তাকিয়ে দ্যাখে বারান্দার দরজা সে বন্ধ করতে ভুলে গেছিল । কুকুরটা সুযোগ বুঝে কখন বাগানে চলে গেছে । সব কিছু যেন কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে, তাহলে কুকুরটা অন্ধকারকে ভয় পায় না । দরজার সামনে সে একটা মানুষের অবয়ব দেখতে পেলো ।
পর্ব ৪
পাশ ফিরে দ্যাখে নকশী ঘুমচ্ছে । অন্যদিন জানালার ধারে দাড়িয়ে থাকলেও আজ সে নিশ্চিন্তে ঘুমচ্ছে । সোম ঝুঁকে তাকালো তার মুখের ওপর । কোন দিন এই ভাবে সে তার স্ত্রীকে দ্যাখে নি । আজ তার মনে হল নকশী এত সুন্দর তা কোন দিন মনে হয় নি তার । এ যেন স্বর্গের কোন কিন্নরী নেমে এসেছে তার কাছে । সোমের আজ তার স্ত্রীকে খুব আদর করতে ইচ্ছে করল । কাজের চাপে শরীরর থেকে ভালোবাসার অনুভূতি গুলো কেমন যেন হারিয়ে গেছিল, কিন্তু আজ ঘুমন্তু নকশীকে দেখে তা যেন আবার ফিরে আসছে । সোম একটু ঝুকে নকশীর কপালে চুমু খেতে যাবে এমন সময় তার মনে হল লাল বাতিটা এখন নিভিয়ে দেওয়া দরকার । সে মুখ তুলতে যাচ্ছে এমন সময় নকশীর দুটো চোখ খুলে গেলো । কি ভয়ঙ্কর সে দৃষ্টি, তাকানো যায় না এ মুখের দিকে এত ভয়ঙ্কর সে মুখ । নকশী কথা বলল ।
তুমি এখন কুকুরের রক্তের কথা ভাবছ ।
সোম সামনের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, তাই এইসব অদ্ভূত সব কথা তুমি বলো । তুমি শ্যামা চরনকে বাগানের আলো নিভিয়ে রাখতে বলেছিলে কেন ?
নকশী উঠে বসল না , সে একটু আলস্য ভেঙ্গে বলল, আগে বলো তুমি কুকুরের রক্তের কথাই তো ভাবছিলে আর তাই ভেবে লাল আলো নিভিয়ে নীল জ্বালাতে জ্বালাচ্ছিলে । কি ঠিক বলছি তো ?
সোমের মনে হল সে নকশীর চিন্তার দ্বারা কোন রকম ভাবে প্রভাবিত হচ্ছে । নকশীর মতন দূর্বল মনের মেয়ে তাকে কিভাবে চালনা করতে পারে ? সে এখন গিয়ে আলো বন্ধ করে দিতে পারে, কিন্তু দিতে পারছে না । কেন পারছে না সে ? অনেক দিন পর নকশী শান্তিতে ঘুমোতে পারবে তাই হয় তো । এক একটা রঙ আছে যা মানুষের মনে খুব প্রভাব ফ্যালে । নকশী হয় তো লাল রঙে শান্ত পায় । সোমের গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না, সে ধীরে ধীরে বলল,
তুমি কি করে বুঝলে ?
নকশী বলল, আমি মানুষের মনের কথা বুঝতে পারি । তা ছাড়াও অনেক কিছু বুঝতে পারি । যেমন তুমি কাল দিল্লি যাচ্ছ পুরস্কার নিতে । আসবে পরের বৃহস্পতি বার । আজ অফিস থেকে এসেই বলবে ভেবেছিলে, কিন্তু কুকুরের মৃত্যু তোমার ব্রেনের ডানদিকের সেল গুলোকে অবশ করে দিয়েছে, তাই বলার ইচ্ছেটা তোমার নেই ।
সোম কোন কথা না বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল । সমস্ত চিন্তা শক্তি তার যেন কেউ চালনা করছে, কেউ যেন তাকে বলছে, ঘুমিয়ে পর, এত রাত পর্যন্ত জাগতে নেই । সোমের মনে হল লাল রঙে খুব শান্তি । সে চোখের পাতা বুজে ঘুমিয়ে পড়ল ।
পরের দিন সকাল ন’টা নাগাদ সোম চলেগেলো এয়ারপোর্টে । গাড়িটা বাগান থেকে বেড়িয়ে গেলে নকশী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মশলার বাগানের দিকে চলল । শ্যামাচরন নকশীকে দেখে হাসিমুখে মাথা চুলকাতে থাকল । শ্যামাচরনের হাসিটা অনেকটা লাল বাতির মতন মাঝে মাঝে তা দেখা যায় । নকশী চন্দন গাছের পেছনের ঝোপ থেকে একটা ঝুড়ি নিয়ে শ্যামার হাতে দিয়ে বলল,
শ্যামা চরন, মশলা গুলো তুলে ভালো করে রোদে শুকিয়ে নাও, তিন দিন পর চাটনি বানাবো । শ্যামার মুখ থেকে জিভটা বেড়িয়ে এলো, আর তা থেকে দু ফোটা লালা মাটিতে এসে পড়ল ।
নকশী যেন আজ দশ বছরের এক শিশু, সে শ্যামা চরনের লালা ঝড়তে দেখে ঢোক গিলে হাসি হাসি মুখে বলল, যে লঙ্কা গুলো শুকোতে দিয়েছিলাম, সব নিয়ে আসবে । আর শোন , জিনিসটা কোথায় ?
শ্যামা আঙ্গুল দিয়ে আম্রপালী গাছটা দ্যাখালো ।
নকশী দেখল আম্রপালী গাছের নীচে একটা টব উপুড় করা আছে । সে কোন কিছুর গন্ধ নেবার চেষ্টা করল । নকশী আচারের গন্ধ পাচ্ছে । এত সুস্বাদু আচারের গন্ধ সে আগে কখনো পায় নি । চোখ বন্ধ করে সেই গন্ধ কিছুক্ষন নিয়ে সে চলল, আম গাছের দিকে । টবটা তুলে সে মড়া কুকুর বাচ্চাটাকে লেজ ধরে তুলে চলল ।
নকশী চলে যাচ্ছে, শ্যামা চরন তাকে প্রশ্ন করল , ম্যাডাম কতটা হবে তাও ?
মানুষ টক খেলে জিভে একরকম আওয়াজ করে, নকশী ঠিক সেরকম আওয়াজ করে বলল , এক ট্যাঙ্ক ।
শ্যামাচরনের কালো মুখটা আনন্দে লাল হয়ে গেলো । সে বলল, ভাগ পাবো তো ?
নকশী পেছন ফিরে চেয়ে বলল, তুমি ছাড়া আর কে পাবে শ্যামা ?
শ্যামা চরন মনের সুখে মশলা বাগানের মাটি কোপাতে লাগল ।
সোম গাড়িতে যেতে যেতে অনেক কিছু ভাবছে, তার সব চিন্তা আজ তার স্ত্রীকে নিয়ে । দিল্লিতে জাতীয় পুরস্কার নিতে যাচ্ছে সে, কিন্তু মনে তার কোন শান্তি নেই । সে লক্ষ্য করেছে, তার গাড়ি যখন বাগান থেকে বেড়িয়ে আসছে নকশীর মুখে এমন একটা ভাব ছিল, যে যেন কতক্ষনে যাবে, সে গেলে নকশী খুব শান্তিমতন থাকতে পাবে । কিন্তু এ তো তার চরিত্র না । সোম যখনই অফিস ট্যুরে কোথাও গেছে সে নকশী তার সাথে যাবে বলে কান্না কাটি করেছে । অনেক সময় বাধ্য হয়েই নকশীকে নিয়ে যেতে হয়েছে । কিন্তু এবার তার মধ্যে যাবার কোন ইচ্ছেই ছিল না । স্বামী জাতীয় পুরস্কার পাচ্ছে, এই ট্যুরে তো যাবার জন্য তার জেদ করার কথা । আরেকটা জিনিশ মনে খুব খটকা লাগছে, সোমের পুরস্কার পাবার খবর তার স্ত্রী জানল কি করে ? তাহলে কি অফিসের কেউ বলে দিয়েছে ? শ্যামা চরন ছাড়া আর কারুর সাথে নকশীর কোন যোগাযোগ নেই । তবে কি শ্যামা খবরটা দিয়েছে । সোমের মনে হল একটা সন্তান এই মুহূর্তে খুব প্রয়োজন তাদের । সন্তানের অভাব দীর্ঘদিন ধরে একজন মানুষকে অনেক সময় বিকার গ্রস্থ করে তোলে । তার স্ত্রীর মন থেকে মায়া, মমতার অনুভূতি গুলো যেন আর সে অনুভব করতে পারে না । একটা কুকুর বাচ্চা বাগানে চাপা পড়ে মাড়া গেলো, সেই দৃশ্য কোন প্রভাব পড়ল না নকশীর ওপর । আর গত রাতে নকশী বহু দিন পর শান্তিতে ঘুমিয়েছে । পুরো ব্যাপারটা স্বাভাবিক না । আজ অনেক দিন পর মনে হচ্ছে অফিস সামলাতে গিয়ে নিজের ঘরটা বহুদিন গোছানো হয়ে ওঠে নি । অফিসের বড় বাবু সব ডাক্তারদের খোঁজ খবর রাখেন । কোন রোগের জন্য কোন ডাক্তার ভালো, তার থেকে এত ভালো আর কেউ জানে না । অফিসে কারুর কিছু হলে বড় বাবু সবাইকে গাইড করেন । সোম বড় বাবুকে ফোন করে একজন ভালো সাইকোলজিস্টের খোঁজ করল ।
সাইকোলজিস্টের কথা শুনেই বড় বাবু বললেন , স্যার যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলি , সমস্যাটা কি ম্যাডামকে নিয়ে ?
সোম বলল, হুম ।
স্যার, আমি এই অফিসে তিরিশ বছ কাজ করছি, আমার এই তিরিশ বছরের কর্ম জীবনে আমি এক ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখে চুপ ছিলাম এই ভেবে আমার চোখের ভুল হতে পারে । কিন্তু আপনি যখন বলছেন, তখন আমার ধারনাটা পরিস্কার হয়ে গেলো ।
সোমের মনে হল গাড়ির ভেতরে ভূমিকম্প হচ্ছে । সে বড় বাবুকে বলল, বড় বাবু, আমার কাছে কোন কথা লুকোবেন না । আপনি যা জানেন আমাকে বলুন ।
বড় বাবু বললেন, স্যার আজ থেকে তিরিশ বছর আগে এই অফিসে এক নেপালি দাড়োয়ান কাজ করত । একদিন দাড়োয়ান উধাও হয়ে যায়, তখন এই অফিসে ইজাজ আহমেদ নামে একজন বিডিও সাহেব ছিলেন । ইজাজ স্যারের স্ত্রী তার সাথে এখানেই থাকতেন । ম্যাডাম কারুর সাথে কোন কথা বলতেন না । মুসলিম ঘরের মেয়ে বৌরা একটু লাজুক প্রকৃতির হয় । আমি আজ থেকে তিনিশ বছর আগের কথা বলছি । বুঝতেই পারছেন । তখনকার মেয়েরা আরো লাজুক ছিলেন । স্যার , আপনি শুনতে পাচ্ছেন ?
সোম বলল, হ্যা, আমি আছি । আপনি বলুন ।
সেই সময় শ্যামাচরন এই অফিসে মালির কাজে যোগ দেয় । শ্যামাচরন লোকটা খুব রহস্যজনক । সে কোথা থেকে এসেছে, তা কেউ জানে না । মেটিলি গ্রামের এক আদিবাসী মেয়েকে বিয়ে করে এ গ্রামের জামাই হয়ে যায় । শ্যামার শ্বশুড় পার্টির মাধ্যমে জামাইকে এই অফিসের মালির কাজে লাগিয়ে দেয় । শ্যামাও চুপচাপ , ম্যাডামও চুপচাপ চরিত্রের মানুষ । কিন্তু বাগানে কাজকরতে গিয়ে শ্যামার সাথে ম্যাডামের কথার আদানপ্রদান শুরু হয় । ইজাজ সাহেবের মুখে শুনেছিলাম, শ্যামা শীতলা তলা থেকে ম্যাডামকে জলপড়া এনে দিতো । ম্যাডাম নিয়ম করে সেই জলপড়া খেতে খেতে কেমন যেন বিকার গ্রস্থ হয়ে যান । সারা রাত বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকতেন, আর হাত থেকে গন্ধ শুকতেন । ইজাজ স্যার প্রশ্ন করলে বলতেন চন্দন গাছ থেকে একটা মানুষ নেমে আসে । তাই সে রাত জেগে পাহাড়া দেয় । যদি মানুষটা ঘরে এসে ঢোকে ।
সোমের হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, মাথার কোষ গুলো আর কাজ করছে না । সে বলল, বড় বাবু, ইজাজ আহমেদের স্ত্রীও রাত জেগে জানালায় দাড়িয়ে থাকতেন ?
বড় বাবু বললেন হুম ।
সোম বলল, হাত থেকে গন্ধ শুকতেন ?
বড় বাবু বললেন, হুম ।
সোম বলল, আপনি বলতে থাকুন, আমি শুনছি ।
তারপর একদিন বাগানের মাটি কুপিয়ে দাড়োয়ানের লাশ উদ্ধার হল । এই নিয়ে যখন সারা মেটিলি উত্তাল, ঠিক সেই সময় ইজাজ স্যারের স্ত্রী মাড়া গেলেন ।
স্যার সবাই বলে এই দুই মৃত্যুর পেছনে শ্যামার হাত আছে । প্রমানের অভাবে শ্যামাকে ধরা যায় নি ।
স্যার আপনি অন্য কোথাও পোস্টিং এর চেষ্টা করুন না হলে হয় তো ।
সোম কোন উত্তর দিতে পারছে না, কিন্তু সে যে জোড়ে জোড়ে শ্বাস ছাড়ছে তা বড় বাবু অনুভব করছে ।
স্যার, আমি বুঝতে পারছি আপনার মনের অবস্থা, তাই বেশি কিছু বলব না, তবে একটা কথা না বললেই না, বাহাদুরের দেহ যেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল । ইজাজ স্যারের স্ত্রীর মৃত্যুর পর শ্যামা সেখানে মশলা বাগান করেছিল ।
ফোনটা কেটে গেলো ।
বিডিও সাহেবের বাংলোর ছাদে দুটো ট্যাঙ্ক । একটা ট্যাঙ্ক গত তিরিশ বছর ধরে কেউ ব্যাবহার করে না । আরেকটা ট্যাঙ্ক নতুন । এই ট্যাঙ্কের জল ব্যাবহার করা হয় । নকশী কুকুরের বাচ্চাটার লেজ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে পুরান ট্যাঙ্কটার দিকে । কিছুটা গিয়ে একবার দাড়িয়ে কিছু গন্ধ নেবার চেষতা করল । মনে হল যেন ঠিকঠাক গন্ধটা পেলো না, এবার সে বাচ্চার দেহটা নাকের কাছে এনে ভালো করে গন্ধ নিলো । নকশীর চোখ বন্ধ, সে চোখ বন্ধ করে এগিয়ে যাচ্ছে ট্যাঙ্কের দিকে । এবার ট্যাঙ্কের ঢাকনাটা খুলে তার মধ্যে সে মাথা ঢুকিয়ে কিছু একটা গন্ধ নিলো । মনের মধ্যে যেন একটা খটকা লাগলো , সে ভুড়ু কুচকে কিছু একটা সন্দেহ করল । তারপর হাত ঢুকিয়ে অনেকক্ষন কিছু একটা খুজল, তারপর আবার তার মুখে হাসি ফিরে এলো । সে একটা কাটা হাত বার করে এনে বাগানের দিকে ঝুকে ডাকল,
শ্যামা চরন ।
শামা এগিয়ে এলো , সে তাকিয়ে আছে কাটা হাতের দিকে, তার কপালে টপটপ করে সর্ষের তেল পড়ছে । শ্যামা কাটা হাতটা ধরবে বলে তার দু হাত তুলে ধরল । নকশী বলল, এরকম ভুল আর করো না যেন । সব কিছুর পরিমান, ঠিকঠাক থাকতে হবে, একটু বেশিও না, আবার একটু কমও না । বুঝেছ ?
শ্যামাচরন , হাসতে হাসতে বলল, আর ভুল হবে না , দেখবেন ।
নকশী বলল, এবার ঠিক জায়গায় পুতে ফেলো ।
নকশী হাতটা ফেলে দিয়ে আবার ট্যাঙ্কের কাছে এসে মুখ ঢুকিয়ে গন্ধ নিলো । এবার গন্ধটা ঠিকঠাক লাগছে । সে মাথা তুলে কুকুরের বাচ্চাটার মৃত দেহ ঢুকিয়ে দিয়ে ট্যাঙ্কের মুখ বন্ধ করে দিলো ।
মাঝে দু দিন কেটে গেছে গত রাতে মরীচ ফোন করেছিল । সে আজ রাতে আসছে । সকাল থেকে রান্না আর ঘর গোছানয় ব্যাস্থ নকশী । রান্নার ফাকে সে কয়েকবার এসে জানালায় দাড়িয়েছে । শ্যামাচরন সেই কোন সকাল থেকে বাগানে মাটি খুড়ে চলেছে । মাটি খোড়া শেষ হলে নকশী ছাদে গিয়ে দাড়িয়ে বিবেচনা করে বলবে ঠিকঠাক কাজ হয়েছে কি হয় নি ।
কাজ করছে ঠিকই, কিন্তু কোন কাজে যেন ঠিক উৎসাহ সে পাচ্ছে না । এরকম হলে জলপড়াটা ম্যাজিকের মতন কাজ করে । নকশীর মনে পড়ল শ্যামা কোন সকালে জানালার সামনে জলপড়া রেখে গেছে , কিন্তু কাজের চাপে আজ তার খাওয়া হয়ে ওঠে নি । সে জানালার সামনে রাখা শিশির জল খেয়ে বিছানার ওপর বসে পড়ল । কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভাবল । তারপর মোবাইল ফোন থেকে ছবিটা আবার দেখলো । লোকটা বসে একটা ছোট্ট কার্ডে কিছু লিখছে । ছবিটা সে নিজে তোলে নি , সেই ঘরে কেউ ছিল , সে তুলে দিয়েছে ।
মরীচের আসতে রাত এগারোটা বেজে গেলো । বাগানে পাহাড়া দেবে বলে শ্যামাচরন সে রাতে বাইরের গেটের চাবি নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল । বাহাদুর খুন হবার পর থেকে এই অফিসের কোন দাড়োয়ান নেই । বাইরের গেটের চাবি সোমের আসার পর থেকে শ্যামার কাছে থাকে । এ নিয়ে অফিসে অনেক কথা হলেও সোম কোন কথায় কান দেয় নি । কারন প্রথম থেকেই তার এই লোকটিকে বিশ্বস্ত মনে হয়েছিল ।
সেদিন মরীচ আসলে শ্যামা গেট খুলে দিয়েছিল ।
খেতে বসে মরীচ দ্যাখে কম করে হলেও দশ রকমের পদ দেওয়া হয়েছে তাকে খেতে । এত পদ একসাথে সে কোন দিন খায় নি, তাই খাবার কোন ইচ্ছে তার নেই । মরীচ বলল, এত গুলো খাবার তো আমি খেতে পারবো না । তুমি একটু খাও ।
নকশী বলল, এত রাতে খাবার খাওয়ার অভ্যেস তার নেই । তাই সে খেয়ে নিয়েছে ।
মরীচও তাকে খাইয়ে ছাড়বে ।
নকশী বলল, আমি যখন বলেছি আমি খাবো না । একটুও খাবো না । বরং আমি তোমাকে সব কিছুর থেকে একটু একটু করে খাইয়ে দিচ্ছি , এসো ।
মরীচ নকশীর ঠোটের দিকে তাকিয়ে আছে ।
নকশী বলল, কি দেখছ ?
তোমার ঠোট দুটো খুব উত্তেজিত করছে আমাকে । তাই তাকিয়ে আছি ।
নকশী বলল, আগে খেয়ে নাও , তারপর অন্য সব কথা হবে ।
খাবার গুলো খাওয়ার সময় মরীচের মনে হল প্রত্যেকটা রান্না কোন আচারের তেল দিয়ে রান্না করা হয়েছে , তাই স্বাদ গুলো সব কটার এক রকম । কিন্তু খেতে খুব সুস্বাদু ।
মরীচ নকশীর হাত ধরে বলে, তোমার হাতে জাদু আছে । আমি টক খাবার খেতে ভালোবাসি না । কিন্তু এত সুস্বাদু খাবার না খেয়ে থাকতে পারলাম না ।
মরীচ খাবে না বলেও সব রকম পদ দিয়ে খাওয়া শেষ করে রাত একটা নাগাদ শুতে যায় । আজ নকশী লাল আলো জ্বালিয়েছে । বাগানের দিকের জানালার সামনে কিছুক্ষন দাড়িয়ে তারপর সে এসে বসল মরীচের পাশে । লাল আলোতে মরীচকে আরো বৃদ্ধ দেখাচ্ছে । মরীচ নকশীর ডান হাতের তালুতে চুমু খেয়ে বলল, নকশী তোমাকে ছবিতে যেমন দেখেছি, তুমি তার থেকেও অনেক বেশি সুন্দর । তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে স্বর্গের কোন দেবী নেমে এসেছে আমার কাছে ।
কথা গুলো শেষ করে সে নকশীকে আলিঙ্গন করে বলল, আমার শরীর অবশ হয়ে আসছে । বুঝতে পারছি, সব তোমার জাদু । সে কথা গুলো বলতে বলতে নকশীর কানে চুমু খেলো ।
নকশী যেন কোন কিছু অনুভব করতে পারছে না । সব অনুভূতি তার শরীর থেকে চলে গেছে । কিছুক্ষন এই ভাবে থাকার পর সে বলল, সেদিন ঐ ছবিটা কে তুলেছিল ?
মরীচের খুব ঘুম পাচ্ছে, সে জড়ানো গলায় বলল, কোন ছবিটা ?
নকশী বলল, যে ছবিটায় আপনি লিখেছিলেন, “ IN A DEEP MOOD” ।
মানুষের যখন খুব ঘুম পায়, তার কথা বলতে খুব অসুবিধা হয় । কিন্তু এরকম সমময় মানুষ সাধারনত সত্যি কথা বলে । মরীচও তাই বলল । সে বলল,
আমার সাথে প্রিয়াঙ্কা ছিল ।
প্রিয়াঙ্কা কে ?
আমার ছাত্রী । আমরা তিন দিন এক সাথে ছিলাম ।
নকশী বলল, যেমন ভাবে আজ আমার সাথে আছেন ?
মরীচ নকশীর কাধে চুমু খেয়ে বলল , হুম ।
নকশী মরীচকে ধরে বিছানায় শুয়ে দিয়ে তার মুখের ওপর ঝুকে বলল, আপনি জানেন কেন আমি আপনাকে আজ ডেকেছি ?
মরীচের মনে হল সে নকশী না অন্য কোন মেয়ের সাথে কথা বলছে, দৃষ্টি আবঝা হয়ে যাওয়ার জন্য মুখটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না , কিন্তু মনে হচ্ছে যেন বছর আট কি নয়ের একটি বাচ্চা মেয়ের সাথে কথা বলছে । নকশী বলল,
আমাকে তুমি সেক্স করতে ডেকেছো ।
এবার নকশী হাসলো,তারপর বলল, আপনাকে তাহলে বলি সেও এরকম ভাবেই বলেছিল ।
মরীচ বলল, কে এই ভাবে তোমাকে বলেছিল বেবি ?
নকশী মুখটা আরো ঝুকিয়ে বলল, আমার পিসেমশাই । যাকে ঠিক তোমার মতন দেখতে । সেও তোমার মতন সেক্স করতে চায় । কথাটা বলে নকশী হাসতে শুরু করল । ওর হাসিটা ঘরের চার দেওয়ালে প্রতিফলিত হতে থাকল । সে হাসি থামিয়ে মরীচের পায়ের নখ থেকে শোকা শুরু করলো । নকশী শুকতে শুকতে ওপরের দিকে উঠছে আর বলছে ,
সে তোমার মতন নিজের থেকে বয়সে অনেক অনেক ছোট মেয়েদের সাথে সেক্স করতে ভালোবাসত ।
নকশীর গলার আওয়াজ যেন এক শিশুর আর্তোনাদ । সে শুকতে শুকতে মরীচের মুখের সামনে এসে কেঁদে ফেলল । নকশী বাচ্চা মেয়ের মতন কাঁদছে । সে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
আমার মতন ছোট্ট শিশুকেও সে ছেড়ে দেয় নি ।
মরীচের এবার একটু সন্দেহ হচ্ছে , সে উঠে বসার চেষ্টা করছে, কিন্তু ঊঠতে পারছে না ।
নকশী বলল, তুমি আর উঠতে পারবে না । কেন উঠতে পারবে না, সে কথা সব কথার শেষে বলবো । আগে আমার কথা শোন । তোমাকে এখন আমি তুমি তুমি করে কথা বলবো, কারন মৃত্যুর আগে একজন মানুষকে মাফ করে আপন করে নিতে হয়, তাহলে আর কোন শ্ত্রুতা থাকে না । বুঝেছ ?
এবার মন দিয়ে শোন ।
আমি তখন খুব ছোট, আমার পরীক্ষার পর আমি গেছিলাম অলোকা পিসির বাড়ি । একা গেছিলাম । বাবা, মা কেউ যায় নি । ওরা তো বুঝতেই পারে নি এরকম কিছু হতে পারে । কি হ্যেছিল এবার তা বলি শোন । মন দিয়ে শোন । কারন এই গল্পটাই তোমার শোনা শেষ গল্পো ।
মরীচের চোখ গুলো ভয়ে লাল হয়ে গেছে, সে বুঝতে পারছে যে ভয়ঙ্কর কোন চক্রান্তের শিকার হয়েছে, কিন্তু সে অনেক চেষ্টা করেও উঠে বসতে পারছে না ।
নকশী বলল, আমাকে একদিন ভোরবেলা পিসেমশাই গোয়ালে নিয়ে গেলো । গরুর দুধ দোয়ানো দেখতে নিয়ে গেছিল । গোয়ালের ভেতরটা খুব অন্ধকার ছিল । আমাকে পিসেমশাই বলল একটা কবিতা শোনাতে । আমি বাংলা মিডিয়ামে পড়তাম , ক্লাস ফাইভে উঠে প্রথম ইংরেজীতে একটা কবিতা শিখেছি, টুয়েংকল, টুইংকেল লিটিল স্টার । সেই কবিতাটা পিসেমশাইকে শোনাতে শুরু করলাম । পিসিমশাই আমাকে বিচুলির ওপর শুইয়ে আমার ওপর উঠে পড়লেন । আমার খুব যন্ত্রনা করছিল । কিন্তু আমি চিৎকার করতে পারি নি । কারন সে বলেছিল , আমি কারুকে কিছু বললে সে আমার পিসিকে মেরে ফেলবে । এভাবে রোজ চলতে থাকে । একদিন আমি গোয়াল ঘরে বিড়ির গন্ধ পেলাম । অন্যদিন গোবরের গন্ধ পেতাম, সেদিনের গন্ধটা একদম অন্যরকম ছিল, তাই আমার খুব ভালো লাগল । পিসেমশাই আমাকে বিচুলির ওপর শুইয়ে দিয়ে আবার আমার ওপর উঠল । আমার মনে হচ্ছিল বিড়ির গন্ধটা খুব তীব্র ভাবে পাচ্ছিলাম । আমার মন বলল ভালো কিছু হতে চলেছে, খুব ভালো কিছু , যা এই মুহূর্তে হওয়া খুব প্রয়োজন । পিসেমশাই চিৎকার করে উঠল । সে ছটপট করতে করতে অন্যদিকে সরে যেতেই আমি উঠে পালিয়ে গেলাম । বেলার দিকে পুলিশ কাকুরা এসে পিসেমশাইয়ের মৃতদেহ কোথাও নিয়ে গেলো । পরে শুনেছিলাম কেউ আমার পিসেমশাইয়ের পিঠে ছুঁড়ি মেরে থাকে হত্যা করেছে ।
আমার বিশ্বাস ছিল পিসেমশাইয়ের মতন লোকেদের মৃত্যু এত সহজে হয় না । আমি সারা জীবন তাকে খুঁজতে খুঁজতে একদিন ফেসবুকে পেয়ে গেলাম । তাই তো আপনাকে ডেকে এনেছি ।
মরীচের মুখ বেকে গেছে, সে বোঝাতে চাইছে যে সে নকশীর পিসেমশাই না । কিন্তু নকশী তার কথা বুঝতে পারছে না ।
নকশী সোজা হয়ে বসে বলল, ব্যাস আর কিছুক্ষন, এখন ঘড়িতে তিনতে বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি । তিনটের মধ্যে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়বে । সারা জীবনের মতন । বুঝেছ ? নকশী আরো জোড়ে জোড়ে হাসছে । সে বিকটভাবে কিছুক্ষন হেসে আবার হাসি থামিয়ে বলল, তুমি কি খেয়েছ শুনলে খুব খুশি হবে । আমি বকুলকে নিজে হাতে খুন করে ওর শরীর দিয়ে আচার বানিয়ে সেই আচারের তেল দিয়ে রান্না করে তোমাকে খাইয়েছি । নারী শরীরের তেল ।
টক খেলে মানুষ মুখে যেমন আওয়াজ করে নকশীও করল, তারপর বলল, নিজের গোপন কথা কারুকে বলতে নেই , এটা বকুল জানত না । ও আমাকে বলেছিল ও যে আচারের ফ্যাক্টরিতে কাজ করে, সেখানে পশুর চরবি আর মৃত দেহ, নানা রকম জিনিশের সাথে তেলে ডুবিয়ে সুস্বাদু আচার বানানো হয় । ওর কাছ থেকে জেনেছিলাম, এই জন্য ওদের ফ্যাক্টরির আচারের স্বাদ এত ভালো । বকুল একদিন আমাকে বলল দশ লিটার সর্ষের তেল কিনে রাখতে । আমি কিনে রাখলাম । তারপর সেই তেল ঢালা হল ছাদের ওপরের পুরোন ট্যাঙ্কে । তারপর বকুল দুধের লোভ দেখিয়ে একটা হুলো বেড়ালকে নিয়ে আসে আমাদের বাড়িরে ভেতরে । তাকে দুধের মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে দেওয়া হয় । তারপর সেই ঘুমন্ত হুলোকে আশবটিতে কেটে তেলের মধ্যে ডুবিয়ে দেওয়া হয় । আমাদের দুজনকে যেন নতুন এক নেশা পেয়ে বসে । আমরা রোজ কিছু না কিছু প্রানীকে হত্যা করে ট্যাংকের তেলে ফেলে দিতে থাকি । খবরের কাগজ রোল করে টপাটপ দেওয়ালের টিকটিকি গুলো মেড়ে সব আচারের কাজে ব্যাবহার করি । এই ভাবে এক মাস রাখার পর সব মৃত দেহ গুলো আমরা তুলে ফেলে দিতাম মশলার বাগানে । সেগুলো শ্যামাচরন পুতে দিতো আর তার ওপর নতন মশলা গাছের বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হত । এর পর সেই তেলে শ্যামাচরনের বাগানের মশলা বেটে মিশিয়ে দিয়ে আরো একমাশ মজানো হত । দুমাস পর একদিন বকুল এক বাটি তেল ছাদ থেকে এনে আমাকে বলে ম্যাডাম, দেখুন একেই বলে আসল আচার । আমি গন্ধ নিতেই আমার শরীর অবশ হয়ে গেলো । আমি এক বাটি আচারের তেল চুমুক দিয়ে খেয়ে বললাম, এটা পাঁচ মিশেলি চাটনি । এত ভালো চাটনি আমি এর আগে কোন দিন খাইনি । এই চাটনির স্বাদ একটু মিষ্টি হয়েছিল । বকুল বলেছিল প্রানীর দেহের একটা মিষ্টতা আছে, তাই একটু মিষ্টি স্বাদ হয়েছে ।
এই ভাবে ভালোই কাটছিল । একদিন ভাবলাম অনেক তো পশুর শরীর নিয়ে চাটনি বানিয়ে খেলাম । এই একই পদ্ধতিতে মানুষের শরীর নিয়ে বানালে কেমন হয় । ভাবনাটা মাথায় আসার পর আমি সেই মতন সন্ধান শুরু করলাম । একদিন সকাল বেলা সোম অফিসে গেলে শ্যামা চরন এলো জলপড়া দিতে । শ্যামাচরনের জলপড়া না খেলে আমার মাথা ঠিকঠাক কাজ করে না । ওর সাথে আমার একটা টেলিপ্যাথিক সম্পর্ক আছে । আমি যদি রাত জেগে কোন সিদ্ধান্তে ঠিকঠাক পৌছতে না পারি , ও সোম অফিসে চলে গেলেই জলপড়া নিয়ে চলে আসে । আমি সে জলপড়া খেয়ে চিন্তা করতে বসি ।
কথা গুলো বলতে বলতে নকশীর মনে হল মরীচের চোখ দুটো স্থির হয়ে গেছে । সে দু হাত দিয়ে মরীচের চোখ দুটো বন্ধ করে বলল, এখন তুমি মৃত । আমার আর তোমার আর কোন শ্ত্রুতা নেই । তুমি এখন অশরীরি , তাই কারুর কোন ক্ষতি তুমি করতে পারবে না । নকশী বিছানা থেকে নেমে জানালার সামনে দাড়ালো । বাগানে মাটি কাটার আওয়াজ হচ্ছে । সে বলল, ওই দ্যাখো , তোমার জন্য কবর খোড়া হচ্ছে । তিন দিন তোমার শরীর তেলে ডুবিয়ে রাখা হবে, তারপর তা কবর দেওয়া হবে । চারদিনের মধ্যে সব কাজ করে নিতে হবে । কারন অপমৃত্যুর সব কাজ চারদিনের মধ্যেই করতে হয় ।
আমি যেন কি বলছিলাম, হ্যা, মনে পড়েছে । আমি বলছিলাম শ্যামা চরনের কথা । শ্যামা চরনকে আমার খুব ভালো লাগে , ওর সাথে সব কথা আলোচনা করতে আমার ভালো লাগে । কারন ওর গা দিয়ে বিড়ির গন্ধ বেড় হয় । আমার মনে হয় সেদিন যে লোকটা পিসেমশাইকে খুন করেছিল সে শ্যামাচরন । অনেক মানুষ তো টাইম ট্রাভেল করতে পারে , আমার মনে হয় শ্যামা তা পারে । তাই সে আমাকে বাচিয়ে ছিল । আমি শ্যামাকে বলি, আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে এবার আমি মানুষের শরীর দিয়ে চাটনি বানাবো ।
সব কথা শুনে শ্যামা বলেছিল , সেও নাকি ভাবছিল আমাকে বলবে মানুষের শরীর দিয়ে আচার বানাতে , কারন মানুষের শরীর নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা নিরিক্ষা করতে তারও খুব ভালো লাগে ।
আমি বললাম সমস্যা হচ্ছে, দেহ কোথায় পাবো ?
শ্যামা বলেছিল ঐ যে আপনার পেছনে দাড়িয়ে আছে ।
আমি তাকিয়ে দেখি বকুলের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে । সে শুধু বলেছিল, ম্যাডাম আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে । আগে জানলে আপনাকে কোন দিন এসব শেখাতাম না ।
আমি বলেছিলাম কোন দিন নিজের গোপন বিদ্যা কারুকে শেখাতে নেই বকুল , তা হলে বিপদে পড়তে হয় ।
বাইরের দরজাটা খোলা ছিল, শ্যামা এসে পেছন থেকে বকুলের মাথায় বাড়ি মারতেই ও ঘুমিয়ে পড়ল । তারপর আমি আর শ্যামা মিলে ওকে ডুবিয়ে দিলাম ট্যাঙ্কের মধ্যে । তিন দিন পর ওর পচাগলা দেহ কবর দেওয়া হল মশলার বাগানে ।
কেউ টেরও পেলো না, কারন এই দিকে কেউ ভুলেও আসে না । হা হা হা ।
নকশী টুইঙ্কেল টুইঙ্কেল লিটিল স্টার কবিতা বলতে বলতে বাইরের দরজাটা খুলে দিলো । শ্যামাচরন ঘরের ভেতর এসে ঢুকল ।
নকশী খুব অসুস্থ, সে আর বিছানা থেকে উঠতে পারে না । রাত হলে সে দ্যাখে মশলার বাগানে দুজন উলঙ্গ পুরুষ আর মহিলা বসে বসে চেয়ে থাকে তার দিকে । নকশীর ধুম জ্বর । সে জ্বরের মধ্যে ভুল বকে চলে । সোম দিল্লি থেকে ফেরার পর থেকেই এই অবস্থায় দেখছে তাকে । এই ভাবে এক সপ্তাহ কেটে গিয়ে অষ্টম দিনের দিন নকশীকাথার মৃত্যু হয় । ডাক্তার পরীক্ষা করে মৃত্যুর কোন কারন খুজে পায় নি । তাই ডেড সার্টিফিকেটে লেখা হয় অজানা জ্বরে মৃত্য হয়েছে । নকশীর মৃত্যুর পরের দিন সোমের ট্রান্সপার লেটার আসে । সোম পরবর্তী বিডিও আবু তায়েবকে ব্লকের দায়িত্ব দিয়ে কলকাতার পথে রঊনা হন । তায়েব মেটিলিতে আসার একমাস পর তার নতুন বিবাহিতা স্ত্রী হাসিনাকে নিজের বাংলোয় নিয়ে আসেন ।
সমাপ্ত
দেবশ্রী চক্রবর্তী |
প্রকাশিত গ্রন্থ: শ্রীর খোলা জানালা, উমার আত্মকথা, মনবনির কাব্যকথা, খোজ, লাল চিনার পাতা, ধর্ষনের সেকাল ও একাল, সত্যই সরাই (বাংলাদেশ এর অমর একুশে বইমেলা থেকে প্রকাশিত)।কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে আধুনিক ইতিহাসে স্নাতকোত্তর। লেখিকা সমাজের বাস্তব সমস্যা এবং মানুষের মনস্তত্ত্বের অন্ধকার দিক নিয়ে লিখতে ভালোবাসে। দুই বাংলার পত্রিকা সহ গুয়াহাটি,দিল্লি এবং ত্রিপুরার বেশ কিছু পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন।
No comments:
Post a Comment