এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

পায়েল খাঁড়া




বড় গল্প




তুমি আসবে বলেই

[১]

প্রায় খান পঁচিশেক সিঁড়ি।আয়ু নয় নয় করেও কয়েক দশক তো হবেই।জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা খসে এক একটা ক্ষতচিহ্নের মত চেয়ে আছে।ভরা জোয়ারের নদী—প্রতিটা ঢেউয়ের ফনায় যেন শত সহস্র নালিশের ফর্দ নিয়ে আছড়ে পড়ছে এই সিঁড়িগুলোরই বুকে___হয়ত এরা সবাই কিছু বলতে চাইছে,কিন্তু কেই বা বুঝবে? ...আজকাল মানুষ বড়ই কম বোঝে_বা হয়ত বুঝতেই চায় না!

               পশ্চিমের আকাশটা কালো করে এসেছে।আজ ঝড় উঠবেই.........তবু উসাদীন মুখেই বসে রইল ঐশি।আসলে ওর জীবনে তো সবটাই এলোমেলো__অবিন্যস্ত;তাই দমকা ঝাপটার ভয় আর ওর লাগে না।দুরে কোথাও থেকে হালকা অথচ মিঠেল একটা গানের সুর ভেসে আসছে।ঐশি চেনে সুরটা!খেয়া-নৌকার মাঝি মাল্লাদের সুর।ঐশি ভাঁজ করা হাটুর উপর মাথাটা কাত করে রাখে... চুপচাপ বসে শোনে গানটা।কথা না বুঝলেও___সুরটা বেশ লাগে তার।এই ছন্নছাড়া বাউন্ডুলে ভাবটার সাথে নিজের জীবনের কেমন যেন একটা মিল খুঁজে পায় সে।আস্তে আস্তে সুরটা মিলিয়ে যায় সন্ধ্যের ঝাপসা অন্ধকারে।বৈকালিক বিরতি কাটিয়ে শহরটা আবার সরগরম হয়ে উঠেছে।ঐশি পিছন ফিরে দেখল......গঙ্গাতীরের নিরিবিলিটার পাশ ঘেঁষে ছুটে চলেছে শহুরে ব্যস্ততার ভিড়। বড় আজব এই বড় শহরের ভিড়__হাজার হাজার মানুষ একসাথে,তবু সবাই একা... সবাই অচেনা!এই ভিড়ের আবর্তে সবাই হারিয়ে যায়—একান্ত প্রিয় মানুষটাও।

   ঐশি উঠে দাঁড়াল...পিছন ফিরে এক পা এগিয়েই থমকে গেল সে।সন্ধ্যে হয়ে এসেছিল।তবু কিছুটা আলো তখনও বাকি ছিল আকাশের গায়।খুঁচরো খোলাম-কুচির মত ছড়িয়ে ছিল এদিক ওদিক;আর সেই আধো আলো আবছায়ার মাঝে__সে আবার দেখল তাকে।

ঐশির হৃদপিন্ডটা যেন এক মুহুর্তের জন্য থেমে গিয়ে আবার দ্বিগুন গতিতে ছুটতে শুরু করল! ছায়ামুর্তিটা এক পা করে এগিয়ে এল ঐশির দিকে।তার চোখেও অপ্রতিম বিষ্ময়!অত বছর আগে তার জীবনে হারিয়ে যাওয়া গল্পটার মোড় যে আজ এখানে এমন হটাৎ করে আবার খুঁজে পাবে ......তা আশা করেনি।

   “ঋজু”......অজান্তেই নামটা এসে গেল ঐশির ঠোঁটে। কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই অতীতটা রিলের ছবির মত ভেসে গেল তার চোখের সামনে দিয়ে।


                          [২]

শিলিগুড়ির মেয়ে ঐশি। সেবছর কলকাতায় জয়তির বাড়ি এসেছিল পুজোর ছুটি কাটাতে।জয়তি ঐশির কলেজের বান্ধবী......বিয়ের পর কলকাতায় এসেছে, বাগবাজারের একটা ফ্ল্যাটে থাকে ওরা। দিনটা বিজয়া__জয়তির একটা জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায় সে বেরোতে পারল না।তবে ঐশি এতদিনে কলকাতার রাস্তাঘাট বেশ ভালোই চিনেছে।__ঠিক করল আজ আর মন্ডপে নয়, ট্রেন ধরে সোজা চলে এল বালিতে।তারপর হাঁটতে হাঁটতে এল এই গঙ্গার তীরে।

কলকাতা শহরটা এমনিতেই ঘেঁষাঘেঁষি...তারপর পুজার ভিড়ে আরও কনজেস্টেড হয়ে পড়েছে।

এই বদ্ধ ভিড়ে কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল ঐশির।আজ গঙ্গার খোলা হাওয়ায় সে প্রান  ভরে শ্বাস নিল।

কখন যে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে বুঝতেই পারল না।হাত ঘড়িটায় চোখ পড়তেই খেয়াল হল__ ঘরে ফিরতে হবে!তাড়াতাড়ি করে উঠতে গিয়ে আর একটু হলেই পা পিছলে পড়ছিল সে, হটাৎ কোত্থেকে একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরল ঐশির হাতটা।প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিয়েই সে তাকিয়ে দেখল—একটা বছর পঁচিশের ছেলে শক্ত মুঠোয় ধরে আছে তার হাতটা...আর যেন আজীবন ছাড়বে না বলেই হাত ধরেছে সে। সেই প্রথম ঋজুকে দেখল ঐশি।একটা অজানা অনুভুতিতে কাঁটা দিয়ে উঠল তার সারা শরীরে।‘লাভ এট ফার্স্ট সাইট’__কথাটা এতদিন গল্পের বইতেই পড়েছিল ওরা... এবার সেটাই বাস্তব হয়ে এল ওদের জীবনে। প্রথম দেখার সেই খুচরো অনুভুতি...সময়ের অবকাশে ভালোবাসার গাঢ় রঙে রেঙে গেল।আর এই ভালোবাসার বিশ্বাসেই একদিন ঘর ছাড়ল ঐশি।ওদের পরিবার এই সম্পর্কটা মেনে নেয়নি।অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল ঋজুকে।নিজের বাড়ির এই অমানবিক ব্যবহার ঐশি সহ্য করতে পারেনি, তাদের অমতেই চলে এল কলকাতায়। ঠিক করল ওরা বিয়ে করবে।আর সেই কথামত সেদিন এই গঙ্গাতীরেই অপেক্ষা করছিল ঐশি।সারাটা দিন কেটে গেল......কিন্তু ঋজু এল না!  


                               [৩]

   দূরে ব্রিজের উপর দিয়ে একটা ট্রেন চলে গেল।হুইশেলের আওয়াজটা তীক্ষ্ণ চিৎকারের মত আছড়ে পড়ল তাদের স্মৃতির আয়নাটায়...ভেঙে টুকরো করে দিল।অতীতের কল্পনা থেকে তারা ফিরে এল বাস্তবের মাটিতে।ঐশির দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল।সেদিন ঘড়ির কাঁটায় দিনটা ফুরিয়ে গেছিল কিন্তু ফুরায়নি ঐশির অপেক্ষা।এই দীর্ঘ সাতটা বছর ধরে একটা কাঁটার মত সেটা বিঁধেছিল বুকের পাঁজরে__আজ সহসা একমুঠো কান্না হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে চোখের চৌকাঠে।

‘কেমন আছো___ঐশি!’ ঋজুর প্রশ্নটা খান খান করে দিল সান্ধ্য নিরবতা।

ঐশির চোখে জমা অভিমানের আগুনটা দপ্‌ করে জ্বলেই আবার নিভে গেল। বলল,

‘মন্দ নয়.........তুমি?’

প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে ঋজু বলল, ‘জানতে চাইবে না__সেদিন কথা দিয়েও আমি কেন এলাম না?’

ঋজুর মুখের উপর একটা কঠিন দৃষ্টি ফেলে ঐশি বলল,

‘না___চাই না জানতে!

সাত-সাতটা বছর পেরিয়ে গেছে ঋজু।জীবনের সাতটা বছরের কাছে আমি ঋনী হয়ে আছি__ শুধু মাত্র একটা প্রশ্নের দায়।প্রতিটা মুহুর্তে তারা আমার কাছে জবাবদিহি করেছে, কিন্তু আজ__আজ আর সেই সওয়াল-জবাবের হিসেব নিকেশ করতে মন চাইছে না।তাছাড়া এতদিন পর কোন অধিকারে সে জবাবদিহি করব__আর করেই বা কি লাভ?’

‘কিন্তু আমাকে যে বলতেই হবে!’ব্যস্তভাবে বলে উঠল ঋজু।

‘হ্যাঁ ঐশি,যে প্রশ্নটা এতবছর ধরে তোমায় ঋনী করে রেখেছে__তার না দিতে পারা উত্তরটা যে আমাকেও একমুহুর্তের জন্য রেয়াত দেয়নি।এই সাতটা বছর_একটা নির্বাক বোঝার মত সেটা বয়ে বেড়িয়েছি__একদন্ডও শান্তি পাইনি। আমি তোমার অপরাধী ঐশি...তার যে শাস্তি তুমি দেবে আমি মাথা পেতে নেব,কিন্তু এটাও সত্যি যে আমি চিরদিন শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছি।সে ভালোবাসায় কোনদিনও এতটুকু মিথ্যে এতটুকু ফাঁকি ছিল না।  

   সেদিন সকালে বাবার সাথে একটা বিশাল কথা কাটাকাটি হয়...আর তার পরেই তিনি হটাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন।ডাক্তার বললেন_মেজর হার্ট অ্যাটাক।ওনার অবস্থা ভালো নয়।উনি যেন কোনভাবেই মানসিক আঘাত না পান।যেকোন রকম উত্তেজনা এখন ওনার পক্ষে মারাত্মক।বাবার আগেই আরও দুটো অ্যাটাক এসেছিল।তাই ডাক্তারের কথা এড়িয়ে যাবার সাহস আমি করতে পারিনি।

তোমায় হয়ত বলে বোঝাতে পারব না ঐশি__সেদিন কতখানি অসহায় হয়ে পড়েছিলাম আমি। একদিকে আমার ভালোবাসা আর অন্যদিকে বাবার জীবন......এই চরম দোটানার মাঝে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিলাম প্রতিটা মুহুর্তে।আমি তোমায় হারাতে চাইনি ঐশি......কিন্তু মায়ের চোখের জল আর বাবার প্রান বাঁচানোর তাগিদের সামনে বাধ্য হয়ে পড়েছিলাম।সেদিন_একটা সন্তানের দায়িত্বের কাছে হেরে গেল আমার ভালোবাসা!’

এটুকু বলে থামল ঋজু।টানা একটা ঝড়ের পর যেন ক্ষনিক বিরতি।ঐশি তাকিয়ে দেখল ঋজুর ক্লান্ত মুখের দিকে।তার দৃষ্টিতে এখন আর সে কঠোরতা নেই...সমবেদনার আতপে স্তিমিত হয়ে এসেছে।হয়ত সে একটু বেশিই ভুল বুঝে ফেলেছিল ঋজুকে।ভালোবাসা আর পরিবারের মধ্যে ঋজু পরিবারকে বেছেছিল ঠিকই__কিন্তু ওই পরিস্থিতে যদি সে নিজে পড়ত;তবে সেও কি এমনটাই করত না?এতখানি অবিশ্বাস করা হয়ত তার সাজেনি।অভিমানের ধুলো জমে ঐশির মনের কাঁচটা যতই ঝাপসা হয়ে থাক্‌ না কেন...একদিন তো সে ঋজুকে নিজের প্রানের চেয়েও বেশি ভালোবাসত__আর আজও সে প্রেম অক্ষুন্ন রয়েছে তার মনের অতলে।ঐশির চোখ অনুশোচনায় ভিজে এল।

কিন্তু গল্পটা যদি এখানেই শেষ হত তাহলেও হয়ত নিজেকে দেবার মত একটা অজুহাত থাকত ঋজুর,......কিন্তু ভাগ্য যে তাকে সেই পরিসরটুকুও দেয়নি।তার নিষ্ঠুর উপসংহারটা তখনও বাকি। বাবার ইচ্ছেমত পরের দিনই সিঙ্গাপুরে রওনা দেয় ঋজু।কিন্তু তখনও সে জানত না যে কি ভীষন ভাবে ঠকেছে সে তার নিজেরই আপনজনদের কাছে।তখনও তার বাবার আসল রূপটা তার সামনে আসেনি।দু-মাস পর হটাৎ একদিন ঋজু জানতে পারল __এসবই তার বাবার প্ল্যানিং ছিল। তাঁর হটাৎ অসুস্থ হয়ে পড়া_ডাক্তারের সতর্কবানী,এই সবই আসলে একটা সাজানো মিথ্যে ছিল,তাকে আর ঐশিকে আলাদা করার জন্য। সেদিন সে প্রথম বুঝল যে নিজের দম্ভ আর জেদটাকে জেতানোর জন্য তার বাবা সব করতে পারেন,__নিজের ছেলের জীবনটাকে তছনছ অবধি করে দিতে তিনি পিছ-পা হননি।  

সত্যিটা জানার পর রাগে দুঃখে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল ঋজু। ছুটে এসেছিল কলকাতায় ......ঐশির কাছে,কিন্তু খুঁজে পায়নি তাকে।জয়তির কাছে জানতে পারে যে সেদিন অনেক রাত অবধি অপেক্ষা করার পরও যখন ঋজু এলনা তখন ঐশি ফোন করেছিল তাকে,কিন্তু ফোনটা রিসিভ করেন তার বাবা।তিনি ঐশিকে বলেন যে ঋজু নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে...আর তাই বিকেলের ফ্লাইটে সে সিঙ্গাপুর চলে গেছে।ঐশি যেন আর কোনদিনও কোনভাবে তাকে ডিস্টার্ব করার চেষ্টা না করে।পরের দিন জয়তির হাসব্যান্ড খবর আনে__যে ঋজুর বাবা ভুল বলেননি,ঋজু সত্যিই কলকাতায় নেই।সিঙ্গাপুর চলে গেছে।কথাটা শুনে ভীষন ভেঙে পড়েছিল ঐশি।তারপর হটাৎ একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে সেখান থেকে চলে যায় সে।

এরপর শহর জুড়ে__শহরের বাইরে তাকে পাগলের মত খুঁজেছিল ঋজু।কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে......এই শহরের ভীড়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেল ঐশি। একটা মিথ্যে জেদ অর্ধসত্যের বর্ম পরে খড়কুটোর মত তছনছ করে দিল দু-দুটো সবুজ জীবন!


                    [৪]

“সন্ধ্যের অন্ধকারটা গাঢ় হয়ে এসেছে......তবু সে যেন আজ গায়ে লাগছে না।চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে নদীটা।চারপাশটা যেন ভিজে গেছে রূপোলী জোৎস্নায়।

ঐশির নরম হাতদুটো নিজের বুকের উপর চেপে ধরল ঋজু।তার প্রতিটা স্পন্দনে মেখে নিতে চাইল সেই হাতের উষ্ণতা!

‘তোমায় ফিরে পাবার আশাটা কেমন যেন ফিকে হয়ে এসেছিল সময়ের সাথে।মাঝে মাঝে মনে হত হয়ত আমার এই আশা করাটাও অন্যয্য___জানি না সে অধিকার আর আমার আছে কি না? তাই ঠিক করেছিলাম...যে শহর তোমায় আমার থেকে কেড়ে নিয়েছে__সেখান থেকে অনেক অনেক দুরে চলে যাব।তবু জানিনা কেন__কিছুতেই মন চাইছিল না।বারে বারে শুধু মনে হচ্ছিল... যাবার আগে অন্তত একবার এখানে আসি,’__বলতে বলতে গলাটা কেঁপে উঠল ঋজুর!

   ঐশির চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।তবে তাতে আজ ব্যাথার লেশটুকু নেই, আছে শুধু ফিরে পাওয়ার আনন্দ।ঐশি চোখ বুজল__ঋজুর বুকে মাথা রেখে বলল,

‘আমিও তো প্রতিবার ভেবেছি...আর না! আর আসব না এখানে।তবু কিসের যেন একটা টানে রোজ ছুটে এসেছি.........হয়ত আজ বুঝেছি কেন! হয়ত কোন একদিন এভাবেই তোমার সাথে আবার দেখা হবার ছিল বলেই___হয়ত ,তুমি আসবে বলেই’।।


*****



1 comment: