কবিতা
ডাকবাক্স
আজকাল ‘ডাকবাক্স’ শব্দটির কান হাতির মতো বড়ো হয়ে উঠছে, আর
তুমি এইসব নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারপরও ভুল হয়ে যাওয়া গুপ্তরোগ এই সুড়ঙ্গপথে
খালি পায়ে হেঁটে আসে পৃথিবীর আয়ুর দিকে। আমি জানি ‘ফুল’ শব্দটির আয়ু
লুপ্ত হলে পৃথিবী থেকে তুমি কাঁদতে বেরুবে। কিন্তু আমরা যারা পাখিদের
রাজনীতির অন্তঃসার শূন্যতা নিয়ে তর্ক করি। ভাবি খরগোস খুব হিংস্রপ্রাণী।
তাদেরকে শোনাই অল্পবিস্তর ঋতু বিপর্যয়ের গল্প। আজকাল ডাকবাক্স শব্দটির অর্থ
আগের মতো নেই। এখন ডাকবাক্স মানে বজ্রাহত বাক্যালাপ। প্রতিদিন আমরা
এইসব নিরুত্তাপ বিষয় নিয়ে তর্ক করি আর বাকা জগতের ভাঙা পা নিয়ে
খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটতে থাকি বিকেলের দিকে।
মেঘের ডালপালা
তুমি আজ লিখে পাঠিয়েছো মেঘের ডালপালা আর হারিকিরি শব্দের গল্পস্তূপ।
বড়জোর, অভাগাদের যেমন ঘোড়ারোগ হয়, তোমার চিঠি পড়ে আমারও
তাই হল। আমি স্বেচ্ছাপ্রহরী সেজে তোমার চিঠির রাশিফল অনুবাদ করি।
তুমি লিখেছো বিষণ্নতার ব্যাসার্ধ আর ব্যাখ্যার দার্শনিকতা নিয়ে। অথচ
ভুলে গেছো তোমার পরিত্যক্ত খোঁপার পেছনে আমার ফিসফাস, গোপন আয়নার
কথা। তোমার এ চিঠিতে পরিচয় পর্ব বলে কিছু নেই- আছে খোরগোশ মাংস নিয়ে
পৃথিবী ও ছুরির হিংসা কাহিনী। তারপরও আমাদের এই রক্তাক্ত ইতিহাসের সঙ্গে
তোমার কি কথা হল- সে কথা বলতে গিয়ে তুমি বারবার ভুলে লিখেছো,
মনের ছাতার আড়ালে যেখানে আমি থাকি- সেই ইউক্লিডের উপপাদ্য বিষয়ে?
বোকাদের জন্য ইতিহাস
বিষাদ ও চাঞ্চল্যকর প্রবেশ পথে থাকেন তিনি, আমার ভাষা তৈরির
কুহকীভার জানে- তার মনে ধূপগন্ধ আর বক্ষে বুনোহাঁস শিকারের ছবি।
তিনি আমাকে উচ্চারণ শেখান ‘টিছার’ নয় ‘টিচার’ আর ‘কপি’
নয় ‘কফি’। আর বলেন পাবলো, তুমি কিছু মনে করোনা- ‘বোকাদের জন্য
ইতিহাস’ আর তোমার জন্য ‘গণিত ও সংখ্যা’। তা না হলে তোমার সঙ্গে
তাম্বুল চিবাতে চিবাতে ঘর করবো কিভাবে? আমি জানি তার শুদ্ধ বাকচিন্তা
ও মতিভ্রমের পূর্বাবস্থা। আমি কিছু বলিনা, শুধু বেলপাতা দেখলে ভয় পাই।
তারপর প্রেমের পুষ্পনিঃশ্বাস ছেড়ে একদিন বলি, ম্যাডাম- উর্ধ্বকমা যে ভাষায়
থাকে সেই ফুল শুকিয়ে যাওয়া পাপড়ির ইস্কুলে তুমি আমায় ভর্তি করে দাও।
উহ্যত, এভাবে আমি তার রাত্রিসাধ পরীক্ষায় ‘শূন্য’ পেতে থাকি। ফলে,
চাঁদ থেকে চন্দ্রবিন্দু নিয়ে আমি ফলাফল ‘শূন্যের’ আগে ‘এক’ সংখ্যাটি
বসিয়ে দি। তিনি বুঝতে পারেন আমার এই অযথা চেষ্টা, তারপরও বলেন-
বড় হলে আমি ঠিকই ‘রামায়ণ’ লিখবো। আর সেদিনই আকাশে নবমীর
চাঁদ ওঠে , আমি তাকে বলি ‘টাইটোনিকের গল্প। তিনি জ্যাক-জ্যাক বলে
তার রক্তজবা বক্ষ নিয়ে হাসফাস করতে থাকেন। তারপর দুজনায় পাথর মূর্তি।
আমি মাথা ঝাকালে- তিনি বিরক্ত হয়ে প্রকাণ্ড এক মমবাতি জ্বালেন। তারপর
চাঁদের সাকো পার হয়ে আমরা আতাভর্তি গাছ দেখতে বেরোই। আমি অনর্থক মাথা
নাড়ি আর ভাবি- আমার স্ত্রী একটা ‘আয়না’। আমাদের জীবনটা ‘সাপলুডু’
আর আমার স্ত্রীর বক্ষ এক ‘মায়াবীইস্কুল’ -যেখানে রচিত হয়েছে এক পাগল
নামধারী কবি অথবা আয়না ব্যাখ্যাকারি এক দুঃখীরাজপুত্রের সমাধি।
পুরুষ
আমাদের উপর থেকে একমুখী অপচ্ছায়া মুছে যাবে একদিন, এই কথা
বলে গেল ০২রা শ্রাবণ। তারপর শালজঙ্গলে যে সব স্মৃতি ও বিস্মৃতি
এতদিন ঘুমিয়েছিল, তাদের সঙ্গে নিয়ে এক জ্ঞানী-ব্যক্তির মতো জিজ্ঞাসার
সামনে দাঁড়িয়ে থাকলো সারাদিন। আমি বল্লাম তুমি মানে ‘০২রা শ্রাবণ’
মানে এক বালির উপর দাগ। সে বলল, ‘আমি’ মানে ‘০২রা ভাদ্র’
অর্থাৎ বই, চশমা আর ব্রিফকেস। আসলে তার ভিতর ঘর পরাপৃথিবী ‘পুরুষ’
এই শব্দ নিয়ে আমি ডিঙাতে পারিনা। বরং সে যখন বিস্ময়ের নিস্তব্ধ আগ্নেয়গিরি,
আমি তার রাজপথে হাঁটি- গোপনে ভাবি সে নিশ্চয় গভীর এক কুয়ো অথবা
শালবনে দাড়ানো বিস্ময়ের কাটা হাত।
তুমি
দিকভ্রান্তির পাঁচ আঙুল থেকে ‘তুমি’ এই শব্দচিহ্নটির জন্ম। এইকথা
ভেবে আমরা আর একবার সূর্যমুখি ফুলের কাছে রোদের ফাঁকা রঙের মধ্যে
এসে পড়ি। তুমি বলেছো পৃথিবীর আদি ফুল প্রেমিকার চুলের খোঁপা, আমরা
তা খুজঁতে গিয়ে দেখি তা ঘাড় বেকিয়ে পড়ে আছে সাকার্সের তাবুর মধ্যে।
কী আমরা পারবো না কবিতার সঙ্গে শব্দহীন, ঘুমের মাছি হয়ে থাকতে।
কেননা, তুমি তো আজও মন্দিরের ঘন্টার মতো দীর্ঘ ঝুলে থাকো বুকে।
যারা জগতের উপর হিংসার থুতু ছিটিয়ে দেয়, তারা তো জানেনা এই ভ্রাদ্র
মাসে মানুষের মনের কষ্টে কোন ক্ষতি হয় না? শুধু ‘আমাদের’ কি হয়
তা বুঝতে না পেরে, শুধু বাঘছাল ছাড়িয়ে অলীক আগুনে পুড়ে যেতে থাকি।
একদিন কবিতারা হয়তো শোক লিপি হয়ে যাবে কিংবা বিশ্বাসের ডালপালা
হাতে-মাখিয়ে শীতের রাতের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে সারিবদ্ধ বর্ণমালা। তুমি প্রশ্ন
করবে- শরীর কি আশ্চর্য গহ্বর? আমি বুকের বোতাম খুলে দেখবো-শব্দের গহীন
অরণ্যে হারানো টাকা খুঁজে পাবার মতো তোমার বেগুনি হাত, পা- কবিতার
শোক স্ত্রোস্তপাঠ হয়ে উঠেছে।
ডাকটিকিটের চিহ্ন
বৃষ্টিকে বুকে পাবার জন্য আমি তার হাত ধরি, জগতের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়
যাকে বলে কাঙালের প্রার্থনা। অথচ মানুষতো সন্ধান দিতে পারে চাঁদের,
মানুষতো তিন তাসের খেলা। যদি ডাকটিকিটের চিহ্ন মুছে ফেলো মহাকাল
থেকে, তখন দেখবে নারী খুলে দিয়েছে জানালা, যৌনচুলা। তারপরও রাজহাঁসের
বন্ধুত্ব ও জ্ঞান মন্দিরের বিমর্ষতা নিয়ে থলের ভেতরে রাখি। আমাদের বক্ষথলিতে
এভাবে জন্মে পৃথিবীর বিরোধ। জানি, ইতিহাস লেখার আগে তুমি অন্তরে খুঁজেছিলে
মনস্তাপ আর ঘাসে যে স্মৃতির দীর্ঘশ্বাস পড়ে থাকে তার জন্য রচনা করেছিলে
মহাপৃথিবীর বাড়ি। তারপরও আমি যতচিঠি দিয়েছিলাম ডাকটিকিটহীন
তাদেরকে তুমি কড়াইয়ের জ্বলে ফোটাও, শব্দের বাষ্প বানাও, দেখবে- হাত,
পা, মুখ আর শিশ্ন কেমন সিদ্ধ হচ্ছে ভালোবাসার জলে।
ঘড়ি
আজ কাচের বোতলে রাত ভরে নিয়ে আমি তোমার জন্য জেগেছিলাম,
আর তুমি সেই তোমার পুরোনো প্রেমিক ভেবে আমাকে নুন-বাতাসে
একা রেখে ঘুমিয়ে গেলে। আমি সারারাত রাত্রির হৈ-হুল্লোড় দেখি,
ঘড়ির কাটার মতো হাসফাস করি; বুক কাঁপে, নিঃশ্বাস ফেলি অদ্ভূত ব্যাঙের
মতো। তুমি যেন অর্ধেক ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকো বারান্দায়; ভাবি, তোমার
বক্ষ, হাত, পা-খুলে রাখা জুতোগুলো- বাথটবে ঝুলানো ব্রেসিয়ার কতদিন থেকে
বিরহ কাতর হয়ে আছে। একমাস, দুইমাস করে কতবা তাদের বয়স হল? তবু,
রাত্রির বেলা- আমি অনার্থক দেখে ফেলি তোমার আশ্চর্য চপ্পল, যে হাঁটু মুড়ে বসে
থাকে আমার ঘরের সিঁড়িতে। কত রাত ঘরে ফিরিনি আমি, তবু আজ ঘরে ফিরি-
কোলবালিশ, নির্জন বাথরুম আর নিঃসঙ্গ তিনতাসের এক তাসে তোমায় দেখবো বলে...
নৌকাডুবি
তুমি আজ ‘নৌকাডুবি’ দেখে অবিকল আমার কবিতা হয়ে ডুবে থাকো টেবিলে
সাজানো ফলের ঝুড়িতে। কবিতার নামে আমার এই ভিখারীপনা, এই অনার্থক
নিরালা ঘরের কোণে বসে থাকা, টবের মাটিতে হাত পা পুঁতে দাঁড়ানো অথবা
নাপিতের ক্ষুরে হাতের আঙুল কেটে কেটে রক্তে লেখা অনুবাদগুলি, পিঠে বেঁধা
তীরসহ ছেড়ে দেই রাতের বাগানে। ভালোবাসার নামে যে সবুজ ঘাসের স্তন
কেটে বাদ দিয়েছি আমি, তার নাম-ই তো কবিতা- এই কথা ভেবে আমি পুনর্বার
তোমার ক্ষতেরগাছে স্মৃতিরবাদুর হয়ে ঝুলে থাকি। আর ভাবি পাপ কী মৃত্যুর দিকে
যাওয়া? যা তোমার সঙ্গে এতোকাল করেছে কবিতা। আজ না হয় আরো কিছু ফড়িংয়ের
অপরাধ বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলি; বলি, জয় হোক তীরবিদ্ধ গোলাপের। এতো কিছু,
তারপরও আমি তো কবিতা লিখিনি কোনদিন, শুধু কিভাবে ফুল পায় আয়ু সেই কথা
বুঝতে গিয়ে তোমার বুকের দিকে ঝুঁকে কাটিয়েছি কাল...
বুকপকেট
এই অসুখী পৃথিবী আর ‘তুমি’ আছো যার, তার আর ক্রশবিদ্ধ জীবন লাগেনা।
সে নিজেই খালি পায়ে ভেজা-ছাতিম গাছের মতো একা একা- অপরাধের পরিনাম
গুনতে জানে। অজ্ঞাত দেশে ছোট এক ঘরে শুয়ে ভাবি, আমিও একদিন তোমার
ঝুড়ির-ফলের মতো বিছানা ও চৌকাটের কাছে ছিলাম। তারপরও যারা প্রেমিক
থাকে, তারা পাঁচটি বৃক্ষের মতো শিকড়ের গোপন অসুখ থেকে নোটবুকে লেখে কবিতা।
আমিও তাই সামান্য জীবন নিয়ে আমারি কবিতা হয়ে উঠি। একথা তোমার কি মনে
পড়ে- যখন প্রেমিক ছিলাম, যখন দিন রাত্রি ছিলাম; আজ ছোট ঘরে শুয়ে দু’তিনটি
কবিতা লিখে- তোমার কাছে নিজেকে জাহির করি। আমি তো নুলোভিখারী ভালোবাসার
কাছে ঊনত্রিশ বছর হাঁটু মুড়ে বসে থাকতে ভালো লাগেনা আর। এখন অলৌকিক দুঃখ চাই,
বুকপকেটে লুকাতে চাই অশ্বক্ষুর। তুমিও সঙ্গে নাও তোমার মাথায় যত আছে অনর্থক কথার
পোকা আর পাগলী সাজার দরপত্র ও কাগজের চাঁদ। কতকাল আর কতকাল থাকবে আমাদের
মৃত্যুগামী জীবন, তার থেকে চলো রাস্তায় নামি- তুমি যদি রাজি থাকো- হাত, পা, চুল, কঙ্কাল
সমেত- নামবো এই ভয়ংকর খেলায়?
একটুকরো নীল রঙের গান
তুমি একদিন বলেছিলে, মানুষতো একটুকরো নীল রঙের গান। মনের উপর
দিয়ে উড়ে যাওয়া সাপমাসী। জগতের বেদনাগুলো গুনে গুনে যার নিজেরি আজ
পা ফুলে ঢোল। আসলে জগতের সত্যিকার অর্থ কী মাথা ব্যথা, অসহায়ত্ব আর
এক টুকরো অধ্যয়ন? অথবা প্রশ্ন চিহ্ন আঁকা প্রাগৈতিহাসিক যুগের দু’একটা শব্দ।
আমি ভাবি এসব কথাতো আগুনেরি কথা। তারপর একদিন ‘নীল রঙের গান’
ও ‘আগুন’ এই শব্দ দুটি নিয়ে তোমার ফুসফুসির সামনে দাঁড়িয়ে বাকহীন হয়ে
পড়ি। তুমি নিঃশ্বাস নিলে আমি দিব্য অভিমানীর আত্মার ধুপ গন্ধ পাই। তুমি খোলা
শরীরে দাঁড়ালে আমি আগুনকে আগুন হিশাবে চিনতে পারি। আসলে ‘তুমি’ আর ‘আমি’
এই শব্দ দুটির মধ্যে লুকিয়ে আছে আদি অপরাধের ঘুঘু। কেননা, ‘তুমি’ কখনো ‘চাঁদ’
ছিলেনা, ছিলে এক টুকরো ‘বজ্রমেঘ’। ‘আমি’ কখনো ‘বাঁলিহাঁস’ ছিলাম না,
ছিলাম প্রেম প্রার্থি এক ‘বনমরগের আর্তি’।
জগতের ট্রেন
তোমার বিকেল মানে মুদ্রা ঘোরানো হাত, যে হাতে থাকে তিন তাসের সাহেব,
বিবি, গোলাম। জগতের ট্রেন ধরতে তুমি হাঁটো পেরেকবিদ্ধ রাস্তায়- প্রার্থনা করো,
কবে হবে আমাদের ক্রশবিদ্ধ জীবন। এখন ফাঁকা জুতো জোড়ার পৃথিবী। যে মিথ্যা
আগুন কথা দিয়েছিল পোড়াবে আমাদের তার নাম প্রেম, হয়তো বা শুয়ে বসে থাকা আয়ু।
আজ ত্রিশ বছর ধরে খোলা আছে এই অন্ধকার? জীবনের চারদিক আজ নখে বিধা
আলপিনের মতো। একটা বৃক্ষপৃথিবীতে কতটুকু আছে ক্ষতের কুয়োতলা, মানুষের মন
পোড়াতে তার কতটুকু কেরোসিন লাগে? এই গল্প অবিশ্বাস্য হলেও গাছেদের হাড়ের মমি, আর
বজ্রহত বক্ষের ভেতর লুকানো দেখা যায় অধিদেবতার ঘর। আজকাল গাছও প্রেমিক সেজে
দুঃখ কেনে, দুঃখবাদীদের রতিউল্কা থেকে তার জন্য পাঠাও ঘুঘুডিঙার খাম। আর লাল
পিঁপড়াদের বিরহে তেঁতুল বাগানে চলো আজ, গাছেদের মতো আমরাও
অবিশ্বাস্য জীবন কাটাই।
বেগুনের কাঁটা
আজ ক’দিন মনে হচ্ছে কেমন অভিশাপগ্রস্ত হয়ে কবিতা লিখে চলেছি একটানা।
তোমার ঘুমও আমার কবিতা, আমার জাগরণও আমার কবিতা। আমি ঘুম
হারিয়ে ফেলি সারারাত ধরে, আমার জন্মের আগেকার তমসার মধ্যে। আর দেখি
মাথার পোকগুলির বেড়েছে জ্বালা, তারা জেগে থাকে পথ হারা পথিকের প্রাণে।
তারপর ঘুমের একগলি থেকে অন্য গলিতে অবিশ্বাসে ঢুকে পড়েছে চাঁদ। আমি হাত
বাড়িয়ে তাকে ধরতে গিয়ে দেখি সে দুপুর, ভুল গল্প নিয়ে চুপচাপ তার পিছে দাঁড়িয়ে বোবা
সপ্তাহ। তারপরও আমার চুলে দেশলাই জ্বালিয়ে দেখি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে মনের আগুন।
আমিতো কবিতার জন্য বাজি ধরেছি এই জীবন। মহাকালের ডাকঘরে যে সর্বনাশ দিয়েছে
ডাক- তার কাছে ছুটে যাই, বলি বুকের ভেতরে কেন ভিখারীর ঘন্টাধ্বনি; ভস্মের বোতামে
কেন গড়াগড়ি খায় ঋষি বেগুনের কাঁটা। এ সব আর ভালো লাগেনা। তার থেকে ভালো চলো
মহাকালকে বলি পাগলের সঙ্গে কথা বলতে, কেননা আমার বউ বলে তুমি একটা আস্ত পাগল,
সারাজীবন ধরে লিখে চলেছো উল্টো পৃষ্ঠার গল্প।
চিঠি
বালকবেলায় আমি তোমার প্রেমে পড়েছিলাম, বলতে পারিনি তাই ত্রিশ বছর আগে
নিয়তির পেরেকে আমার মাথা ফাটানো হয়েছিল। সেই থেকে আমার জীবনটা খোঁড়া
মাথার গল্প হয়ে আছে। তোমাকে ভালোবাসার আফসোস এখনও মনের মধ্যে তাসকাটা
ঘরের খেলা। আর সেই বিচ্ছেদকাল থেকে আমার মাথা মাটিতে বাঁকা করে পোঁতা।
জগতের যত ধারালো পেরেক আছে- তারা প্রতিদিন সে মাথা খুঁড়ে চলেছে। পৃথিবীর
এই বাঁকা নিয়ম নিয়ে নোতুন বন্ধুকে চিঠি লিখি। তুমি ছাড়া আমার দু’জন নোতুন বন্ধু।
একজন নিঃসঙ্গতা, যে ট্রাফিক আইল্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে ধু ধু রাস্তা পার হওয়া দেখে আর দ্বিতীয় জন
দুই পাগল প্রেমিকের মৃত দুটি শব’- যারা এফিটাপে ফোটা ফুল তুলতে গিয়ে আর
কখনো ফিরে আসেনি...
আমাদের বাড়ি
আমার পুরনো হাত-পাগুলিকে বইয়ের মতো বুক সেলফে সাজিয়ে রাখি; বন্ধু-বান্ধব,
আত্মীয়-স্বজন যাতে দেখতে পায়। আর বিদ্যাভিমানী আত্মা, তুমিময় হারানো নোটবুক ও
মনপক্ষিদের ঘুম আমি লুকিয়ে রাখি আমার বাকরুদ্ধ গল্পের মধ্যে। তারপরও দাঁতের ডাক্তার
দেখলে ভয়লাগে; যদি সে হা-করে আমড়া খেতে আসে। আমাদের বাড়ির দরোজায় এক কাঠের
পা-ওয়ালা ফাটা ডালিমের উপর চোখ রেখে ভাগ্য গণনা করে। ঘোড়া জানে পায়ের গতি পেয়ে
গেলে সকল সত্য জানা যায়। তুমি হয়তো ভাবো- এই সেকেলে হাত-পা নিয়ে আমি কী করে
রজনীগন্ধাপ্রিয় উন্মাদদের পাঠদান করি; কী করে প্রেমের মাছি হয়ে লীলাচূর্ণির নাকের ডগায়
ইয়ার্কি করি কিংবা আমার কুমড়োর ফালির মতো হাতের কব্জিগুলো, কেন মানুষেরা বাজারের
থলিতে ভরে বাড়িয়ে নিয়ে যায়। মানুষের মতো গোছানো ঘর আমার নেই। শুধু ঘুমাতে
যাবার আগে মোজার ভেতর লাল পিঁপড়ের সঙ্গে কাটাই সারাদুপুর।
কেরোসিনের বোতল
জগতের শুরুর গল্পটা জানি আমি, শেষের গল্পটাও। একদিন কেরোসিনের বোতল হাতে
বুকে আগুন ধরাবো বলে- শুয়েছিলাম জগতভুলের বিশাল ছাতার নিচে। তুমি বললে এই
ভুল গল্পটা অদ্ভুত গাছের শেকড়ে লুকিয়ে থাকে। কিন্তু আমি যে নিজেই একটা ভুল যাকে
নিয়ে জীবনবীমা, যাকে নিয়ে ঘোড়দৌঁড় খেলা কিংবা দেশলাই কাঠি বানিয়ে খেলতে চায়না
কেউ। তারপরও অসময়ের ভুল ঘন্টা আমি ঝুলিয়ে দিয়ে ছিলাম জগতের ভুল বাগানে।
জগৎ মানে তো অসুখকে জিব দিয়ে চেখে দেখা। যারা আমার জন্য পাঠিয়েছে সবুজ টিকটিকি
আর শীতের হাতপাখা- তাদের জন্য বুক কেটে জমা রাখি বাঘিনীর দুধ। আর এসব কথার
অর্থ বুঝে আমি বিকেলকে চুপ থাকতে বলি। কিন্তু শাল পাতার রোদ্দুর আমার কথার মানে
বোঝেনা- সে বলে এই জগতে আগুন নিজেই এক হতভাগ্য ভুলের নাম।
পাবলো শাহি |
No comments:
Post a Comment