এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

মৃগাঙ্ক চক্রবর্তী



মুক্তগদ‍্য




সেদিনের কথা


স্কুল জীবনে শুধু অঙ্ক নিয়েই নাজেহাল হয়েছি এমনটা একেবারেই নয়। ক্লাস সেভেনে উঠতেই জানতে পারলাম আমাদের একটা নতুন সাবজেক্ট পড়তে হবে টানা দু'বছর- সংস্কৃত। লিখতে শিখতে হবে দেবনগরী ভাষা। প্রথম যেদিন হাতে সংস্কৃত বইটা পেলাম, বুঝে গেলাম এসব আত্মস্থ করা আমার সাধ্যি নয়। আমার পিসিকে আমি মনিমা বলে ডাকি। মনিমা সংস্কৃতে শুনেছিলাম ভীষণ ভালো। বইটা নিয়ে গেলাম মনিমার কাছে। দু'দিন আমাকে পড়িয়েই বুঝে গেছিলো মনিমা যে এই ছেলেকে বাগে আনা তাঁর কম্ম নয়। কারন যখনই পড়তে যেতাম, পড়া কম আর আমার দুষ্টুমি চলতো বেশী। একবার বই নিয়ে মনিমার ঘরে গিয়ে দেখি মনিমা ঘুমাচ্ছে। আমার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো। ভাবলাম এই ভরদুপুরে একটু ভূতের ভয় দেখালে কেমন হয়? যেমন ভাবা ওমনি কাজ। যে বিছানায় মনিমা শুয়ে ঘুমাচ্ছিল, তার ঠিক সামনে বিছানার ওপর একটা ফটোফ্রেম রেখে ঘরের এক কোণায় লুকিয়ে পড়লাম। পকেটে পিংপং বল ছিল একটা। জোরে শব্দ করে বলটা মাটিতে ছুড়ে দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে মজা দেখতে লাগলাম। বলের শব্দে মনিমার ঘুম ভেঙে গেলো। ফাঁকা ঘরে একটা বল ড্রপ খেয়ে খেয়ে একা একা চলছে আর বিছানায় ফটোফ্রেম দেখে ভয়ে মনিমা বাবাকে বলল নিশ্চয় ঘরে ভূতুড়ে কোনো ব্যাপার আছে। দিনকয়েক বাদে দেখলাম এক জাঁদরেল মতো একজন লোক এসে বাবাকে কীসব বোঝাচ্ছেন। পরে শুনলাম ওই লোকটা বাড়ি দেখে বাবাকে নাকি বলে গেছিলো বাড়িতে অশরীরী আছে এবং উনি সেটা নির্মূল করতে পারবেন।
অবশেষে বাবাকে বলে দিয়েছিলাম ওটা কোনো অশরীরী-র কুকাজ নয়, বরং সশরীরে আমারই মস্তিষ্ক প্রসূত দুষ্টুমি। বইয়ে পড়েছিলাম, নিউটন বলে গেছেন-"প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।" এতদিন শুধু বইতে পড়েছিলাম। সেদিন তার চাক্ষুষ প্রমাণ পেলাম। আমার ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া এটা হবে জানলে দুষ্টু বুদ্ধিটা বুকে পাথর দিয়ে হলেও চাপা দিয়ে রাখতাম।
সেদিনের পর আর মনিমার কাছে সংস্কৃত পড়া হয়নি।

আরেকটা সাবজেক্ট ছিল অঙ্ক। অঙ্কে আমার দুরবস্থার কথা আগেই বলেছি। বাবা একজন টিচারকে বাড়িতে রাখলেন আমাকে অঙ্ক  পড়ানোর জন্য। ভদ্রলোক প্রথম দিন এলেন আমার সঙ্গে পরিচয় করতে। বলির পাঁঠার মতো সামনে গিয়ে বসলাম। দু'পাশে বাবা মা- আমার যাবতীয় গুণগান (পড়ুন বদনাম) উগড়ে দিতে ব্যস্ত মাস্টারমশাই এর কাছে। উনি আমাকে বললেন-"বাবু, বলো- " বীজগণিতের কিছু ফর্মুলা।"
স্বাভাবিক মুখ করেই বললাম-"বলবো কীভাবে? আমার তো মুখস্থ নেই।"
-"আমার সঙ্গে সঙ্গে বল"- এই আদেশ দিয়ে উনি বলা শুরু করলেন- "এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার, ইজ ইকুয়াল টু- এ'স স্কোয়ার প্লাস টু-এ-বি প্লাস বি'স স্কোয়ার"।
মা পাশ থেকে খোঁচা দিয়ে বলল-"বল বল, ওনার সঙ্গে বল।"
আমিও চিৎকার দিয়ে বলা শুরু করলাম ওনার সঙ্গে সঙ্গে। উনি খুশী; আমার বাবা মা ডাবল খুশী-ভাবছে এতদিনে ছেলে বাগে এসেছে, আমি তার চারগুণ অখুশী।"
স্যার এককথায় ভীষণ ভালো মানুষ ছিলেন। সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ বা দ্বিমত নেই। একদিন উনি পড়াতে এসেছেন; কিছুক্ষণ বাদে মা চা দিতে এসে দেখে ওনার পকেট দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে। স্বাভাবিকভাবে মা ঘাবড়ে গিয়ে ওনাকে জিজ্ঞেস করেন-"স্যার আপনার কি শরীর খারাপ করছে বা কোথাও কেটে গেছে? রক্ত পড়ছে কেন পকেট দিয়ে?"
উনি স্বাভাবিক মুখভঙ্গিতে নিচু হয়ে পকেটের দিকে একবার দেখে নিয়ে বললেন-"ও হাহাহাহা! আসলে এখানে আসার আগে মাছ কিনেছিলাম। ভেবেছিলাম এখানে আসার আগে বাড়িতে মাছটা রেখে আসবো। সাইকেল নিয়ে আসতে আসতে মাথায় একদম ছিল না সেই কথা। কাঁটা মাছটা প্যাকেট করে মুড়ে ভুল করে পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে এসেছি। এটা সেই কাঁটা মাছেরই রক্ত। ঘাবড়াবেন না। ওসব কিছু নয়।"
মা ঘাবড়ায়নি। ঘাবড়েছিলাম আমি। কারন আমি নিশ্চিত ছিলাম স্যার যাওয়ার পর মা এই রাত্রিবেলায় আমাকে আপাদমস্তক ঠাণ্ডা জল গায়ে ঢেলে শুদ্ধ করবে।
এরপর ক্লাস এইটে একটা টিউশন ব্যাচে পড়তে গেছিলাম। স্যার যেমন রাগী, তেমনি ছিলেন ঘুমকাতুরে। "জোরে জোরে পড়বি, যেন আমার কানে আসে পড়া। না হলে কিন্তু......" এই বলে উনি আমাদের পড়তে দিয়ে বসে বসে ঝিমাতেন। আর আমরা ছিলাম বরাবরের (অ)শান্ত ছেলে। স্যার যেই ঘুমাতেন ওমনি আমরা ব্যাচ শুদ্ধ সবাই "সৃষ্টি সুখের উল্লাসে" চিৎকার শুরু করতাম। ধড়ফড় করে উঠে বসে স্যার বলতেন-"অ্যাই, কে রে? কে চিৎকার করলি? নাম বল! আজ তার একদিন কি আমার একদিন।"
আমরা নির্দিষ্ট একটা ছেলেকে টার্গেট করে তার নাম ঠিক করে রাখতাম। স্যার জিজ্ঞেস করলেই তার নাম স্যারকে বলতাম- "স্যার, অনির্বাণ, স্যার। ও চিৎকার করেছে।"
তারপর স্যারের হাতের কাঠের স্কেলের গুণমান পরীক্ষা তার হাত-পা আর পিঠের ওপর দিয়ে হতো। এরকমই একদিন আমরা ব্যাচে পড়ার নাম করে চিৎকার করছি, স্যার ঘুমোচ্ছেন নাক ডেকে। হঠাৎ ধড়ফড় করে উঠে বসে বললেন-" অ্যাই কে রে? কে চিৎকার করলি?"
আমরা স্বভাব বশত বলে বসলাম-"অনির্বাণ চিৎকার করেছে স্যার।"
স্যার দ্বিগুণ রেগে বললেন-" অসভ্য ছেলে, প্রতিদিন আমি পড়তে দিলে তুই চিৎকার করে সবাইকে ডিস্টার্ব করিস। এতো মারি, তাও শিক্ষা হয় না! আজ তোর পিঠে স্কেল ভাঙবো, তারপর তোর গার্ডিয়ান কল করবো। ওরাও জানুক তাঁদের ছেলে কি জিনিস। এদিকে আয় অনির্বাণ!"
কিন্তু কোথায় অনির্বাণ? ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম সেদিন সে টিউশন পড়তেই আসেনি। অতয়েব আমাদের চালাকি ধরতে স্যারের এক মুহূর্ত-ও সময় লাগলো না আর স্কেলের গুণমান পরীক্ষা কাদের ওপর দিয়ে হয়েছে নিশ্চয় বুঝতে পাড়ছো তোমরা।
টিউশন বলতে আরেকটা ঘটনা মনে পড়লো। তখন কলেজে পড়ি। সেমিস্টারের বন্ধে বাড়িতে এসেছি। পাড়ার এক আত্মীয় তার ছেলেকে নিয়ে এসে বললেন-"তোমার তো ছুটি এখন এক মাস মতো, এই কয়দিন আমার ছেলেটাকে একটু পড়িয়ে দাওনা বিজ্ঞান, ভূগোল আর অঙ্কটা।"
আমি রাজি হয়ে গেলাম। পরদিন থেকে ছেলেটা আসা শুরু করলো। নিউটনের গতিসুত্র বোঝাতে গিয়ে তাকে আমি উদাহরণ স্বরূপ বোঝালাম-" দেখো, আমি টেবিলটায় একটা ঘুসি মারলাম, এটা ক্রিয়া। এবার আমার হাতে ব্যাথা লাগলো; অতয়েব টেবিলটাও আমার হাতের বিপরীতে একটা সমান বল প্রয়গ করেছে, যে কারনে আমার ব্যাথা লাগলো; সেটাকে প্রতিক্রিয়া বলে। বুঝলে?"
বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে সে জানান দিলো যে সে সমস্তটা বুঝে গেছে। দু'দিন বাদে তাকে নিউটনের গতিসুত্র লিখতে দিলে দেখলাম সে লিখছে-"আমরা টেবিলে ঘুসি মারলে আমাদের হাতে ব্যাথা লাগে- এটাই নিউটনের তৃতীয় গতিসুত্র।"     
আরেকদিন ওকে স্থিতিজাড্য-গতিজাড্য বোঝাতে গিয়ে উদাহরণ স্বরূপ বলেছিলাম বাসের উদাহরণটা; মানে, যেকারনে চলন্ত বাস হঠাৎ থামলে আমরা সামনের দিকে ঝুকে পড়ি। আর স্থির বাস চলতে শুরু করলে পেছন দিকে হেলে যাই- সেই উদাহরণটা ওকে বুঝিয়েছিলাম। আবার কিছুদিন বাদে ওকে লিখতে দিলাম- জাড্যতা নিয়ে যা জানো লেখো।
ওর উত্তর দেখে আমার চক্ষুচড়কগাছ। সে লিখেছে দেখলাম-"বাস যখন চলে, তখন আমরা বাসের জানালা দিয়ে এদিক ওদিক, এঁকে ওকে তাকে দেখি; আর সেই জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি। তাই বাস হঠাৎ থামলে আমরা হুমড়ি খেয়ে সামনের দিকে মুখ থুবড়ে পড়ে যাই।" সাথে দেখলাম একটা লোকের মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার ছবি সে নিজে হাতে এঁকে দিয়েছে উত্তরের পাশে। (তার মা নাকি বলেছে বিজ্ঞানের প্রশ্নের উত্তর লেখার সময় যথাযথ ছবি এঁকে দিবি উত্তরের সঙ্গে। এতে নম্বর ভালো পাওয়া যায়।)
পরিষ্কার শুনতে পেলাম স্বর্গ থেকে সমস্ত দেব দেবী আমাকে বলছেন-"দেখ, কেমন লাগে? একেই কর্মফল বলে পাগলা।"
প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে- প্রমাণিত।


মৃগাঙ্ক চক্রবর্তী

No comments:

Post a Comment