এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

সম্পাদকীয়





মনোরম আবহাওয়া দেখে কবর থেকে উঠে এসেছিল যে মামদো ভুত, ভেবেছিলাম সে ফিরে যাবে আবার কবরে, দিগন্ত থেকে উড়ে আসবে জালছেঁড়া প্রজাপতির দল। মণিন্দ্র গুপ্তে’র ভবিষ্যতবাণী’কে সত্যি করেও, অকালবৈশাখীতে ভিজে যাবে গনগনির মাঠ।

না, হয়নি, হয়নি কোনটাই। মামদো ভুতেরা আজ’ও আমাদের চারদিকে ঘুরঘুরে পোকার মতো ঘোরে। আমাদের অস্তিত্বের সবটুকু ঝাঁকিয়ে দিয়ে কেউ বলে ওঠে, ‘তুমিও তো আদতে পুংলিঙ্গই’.......অতঃপর, এক জমাট অন্ধকার….চোখের সামনে……..লজ্জায়, ঘৃণায়, ভয়ে…...চোখ বুজে আসে…..আমারও যে একটা ‘আসিফা’ আছে…….

তবু বাঁচতে হয়, তবু হাসতে হয়, খেতে হয়, শুতে হয় এবং সেক্স……..ভুলে যাই সবকিছুই বা ভুলে যেতে হয় বলে…….ঠিক এরকম সময়েই কেউ প্রেমের গান বন্ধ রেখে হাতে তুলে নেয় কাস্তে, কেউবা পূর্ণিমার চাঁদের মুখে লজ্জা ছুড়ে দিয়ে বলে ওঠে, তুমি কিন্তু মোটেই সুন্দর নও, তুমি তো আদতে ঝলসানো রুটি, আবার কেউবা মুক্তি খোঁজে আলোয় আলোয়, ঘাসে ঘাসে…….ঠিক তেমনই এক অন্ধকারে আমাকে আলো দেখিয়েছিল, আমার চোখে চোখ রেখেছিল, আমাকে দু’দন্ড শান্তি দিয়েছিল ‘নাটোরের বনলতা সেন’।

হয়তো ভাবছেন, এটা কী হলো? দারুচিনি দ্বীপের খোঁজ আমি পেলাম কীভাবে? কীভাবেই বা পেলাম, বনলতা সেনের চোখে চোখ রাখার অধিকার?

স্বীকার করছি, পাইনি। ওটা ডাঁহা ঝুট…..সব ঝুট হ‍্যায়….সব ঝুট হ‍্যায়….তফাৎ যাও….এই সূত্র ধরেই নিশ্চিত ভাবে পেয়ে গেলাম বনলতা সেনের ঠিকানা। শুধু আমি নয়, আপনিও পেতে পারেন তাঁর ঠিকানা, চোখে চোখ রাখার অধিকার, শুধু জানতে হবে, বনলতা সেন আদতে কে? এবং কী?

বনলতা সেনকে নিয়ে লেখা অনেক হয়েছে, হবে আর’ও। হোক, ক্ষতি নেই। তাঁদের সব ধারণাকে অস্বীকার না করেও নাস‍্যাৎ করে বলছি, আমি যা বলব, সেটাই সঠিক।

একটা মানুষ এবং পুরুষ, দেখতে ভালো নয়। অথচ, মারাত্মক রোমান্টিক। সে কবিতা লেখে, সে গান শোনে, সে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে দেখে স্রোত ভাঙার নিশিডাক, সে প্রকৃতির চোখে চোখ রেখে অনায়াসে পড়ে নিতে পারে সবটুকু ভ্রুকুঞ্চন। অথচ, কী আশ্চর্য, কোনও নারীর চোখে চোখ রাখার সাহসটুকু নেই, কলেজে পড়াতে গিয়েও কলেজ ঢোকে পিছনের দরজা দিয়ে, মুখ নিচু করে। লাজুক কি? না, লাজুক নয়। মুখের সামনে আয়না ভেসে ওঠে…...যদি কেউ তার অসুন্দর চেহারা দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়? যদি কারো মুখ বেঁকে যায় ঘৃণায়? তাহলে? এবং তাহলে? এই উপেক্ষা, এই ঘৃণাকে সে বয়ে বেড়াবে কীভাবে? তাইতো সে ‘মশারি’ ছিঁড়ে বেরিয়ে যায় মৌসুমী সমুদ্রের দিকে প্রতি রাতে, প্রতি রাতে সে ‘ঘাস’ খেতে যায় জ‍্যোৎস্না মেখে মহীনের ঘোড়া হয়ে। সে জানে, তার জন্য অপেক্ষা করে নেই কেউ, এমনকি তাঁর স্ত্রী’ও। সে জানে, এর থেকে মুক্তি নেই এই জীবনে, সে জানে স্ত্রী নয়, শিশু নয়, মাথার ভেতর ঘুরঘুরে পোকার মতো কেউ ঘোরে বা জলের মতো, তাইতো সে চিত হয়ে শুয়ে থাকে টেবিলের উপর।

আদতে এক বোধ কাজ করে মাথার ভিতর, তাকে এড়ানোর উপায় তার জানা ছিলনা, প্রয়োজন’ও তো ছিল না। অন্তত, কেউ তো তার সাথে কথা বলে, কেউতো হাত রাখে হাতে, কেউ তো সাগ্রহে জিগ্যেস করে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’

‘বনলতা সেন’ আদতে আর কিছুই নয়, বোধ। কবির অন্তরের সেই কবিটি, যার খোঁজ পেলে, যার মুখোমুখি বসলে ফুরিয়ে যায় জীবনের সব লেনদেন, সব চাওয়া-পাওয়া, সবটুকু অভাব-অভিমান-অভিযোগ…...অতঃপর এক নিশ্চিত সমর্পণ। আপনি অনায়াসে একে মনের মানুষ বলতেই পারেন বা সেই যে ব্রহ্মজ্ঞান।

একটু কঠিন হয়ে গেল ব‍্যাপারটা? আসুন একটু সহজ করেই আলোচনা করা যাক। আমরা আমাদের আলোচনাকে এই মুহূর্তে কবি ও কবিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখি, তাহলে আরও সহজ হবে বুঝতে।

আমি যখন লেখালেখির জগতে এলাম, এই মে-জুন মাসে, তখন তিনজনের কবিতা আমি খুব পড়তাম (এখনও পড়ি).......মহাদেবাশা, ফারজানা মণি এবং ঐন্দ্রিলা মোহিন্তা। কিছুদিন পরেই এর সাথে আর একটি নাম যোগ হল, মনোজ দে। এদের লেখা পড়ে চমকে যেতাম এবং শিখতাম (এখনও)। তা, হয়েছে কী….কয়েক মাস আগে, মহাদেবাশা হঠাৎ লেখা প্রায় ছেড়ে দিল। একদিন ফোন করলাম ওকে, জিগ্যেস করলাম, হঠাৎ লেখা ছেড়ে দিলে কেন? ও বলল, ‘দাদা, লিখে কী হবে? আমি তো কবিতায় আছি। এই যে আমার সামনে যা কিছু হচ্ছে, এই যে হর্নের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছো, এর মধ্যেও আমি কবিতা খুঁজে পাই, ফালতু লিখে কী হবে?’

চমকে গেলাম, তবে ভাবলাম, ধূর, ফালতু কথা। বিরক্তিকর হর্নের আওয়াজেও কি কবিতা খুঁজে পাওয়া যায় নাকি? হয়তো কোনও অভিমান, হয়তো কোনও হতাশা থেকে সাময়িক বিরতি। এরকম ফেজ্ অনেকের জীবনেই আসে। ঠিক ফিরে আসবে একদিন, ওকে শুধু বলেছিলাম, ফিরে এসো। না, ফিরে সে এখনও আসেনি, তবে ঐন্দ্রিলার জন্য কাল জানতে পারলাম, সে কবিতায় আছে। কবিতা লেখেও, তবে বিশেষ কারণে। পত্রিকায় ছাপার জন্য নয়।

মহাদেবাশার ব‍্যাপারটা আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, খুঁজতে লাগলাম আবার নতুন উদ‍্যোমে, কবিতা আদতে ঠিক কী বস্তু? খায় না মাথায় দেয়?

ঠিক এরকমই সময়ে হাতে এলো, অমিতাভ প্রহরাজদার একটা লেখা, যেখানে তিনি কবিতার জিনটাকে স্পষ্ট করে ধরেছেন। তিনি সূত্র দিয়েছেন, কীভাবে একটা লেখা পড়ে বুঝে নেওয়া যায়, এটা গদ‍্য না কবিতা বা একই লেখার মধ্যে কোন কোন অংশ কবিতা আর কোন কোন অংশ গদ‍্য। সম্পাদনার ক্ষেত্রে এই সূত্রটা আমার খুব উপকার করেছে এবং অবশ্যই ব‍্যক্তিগত ভাবে লেখা ও পড়ার ক্ষেত্রেও। সূত্রটা হলো, কোনও লেখা পড়ে তোমার মনে কী হ‍্যাঁ বা না আসছে? তর্ক করতে ইচ্ছে করছে? নিশ্চিত সমর্পনের বিপরীতে হাজির হচ্ছে সত্য বা মিথ্যার দ্বন্দ্ব? তাহলে, নিশ্চিত সেটা কবিতা নয়, গদ‍্য। কারণ, কবিতা আদতে হ‍্যাঁ বা না, সত‍্য বা মিথ্যার মধ‍্যবর্তী এমন এক অঞ্চল যেখানে শুধু নিশ্চিত সমর্পণ থাকে। আঙুল তোলা যায় না, শুধু চোখে চোখ রাখা যায় বা হাতে হাত।

অনেকে বলেন বা মনে করেন, কবিতার শুধু দুটো দিক থাকে, ভালো লাগা বা খারাপ লাগা। আমি কিন্তু মোটেই এটা মনে করিনা, আমি মনে করি, কবিতার শুধু একটিই দিক থাকে, এবং সেটা শুধুই ভালোলাগা, নিশ্চিত সমর্পণ। (প্রভাত চৌধুরীও এটা বলেন। পরবর্তী অংশে, আমি প্রভাত চৌধুরীকে ‘ভুল’ প্রমাণ করব, প্রভাত চৌধুরী’ই অস্ত্রে।)

আবার গুলিয়ে গেল ব‍্যাপারটা? ভাবছেন, এতো যে কবিতা লেখা হচ্ছে, সবই কি ভালো লাগে নাকি?
না, একদম না, ভালো লাগে না, কারণ সেগুলো কবিতাই নয়। আরে মশাই, কবিতা যে লেখাই যায় না, কবিতা যে আদতে একটা বোধ, একটা উপলব্ধি, একটা অনুভব। তাকে পুরোপুরি ধরা যায় না, লেখা তো যায়ই না, একটা আলো-আঁধারি খেলা। আলো, যখন জ্ঞান এসে হাজির হয়, যখন বাস্তবের চাওয়া পাওয়াগুলো সুরুৎ করে ঢুকে পড়ে আমাদের মাথার ভিতর। অন্ধকার, যখন জ্ঞানের বাইরে দাঁড়িয়ে, চাওয়া পাওয়াহীন মৌনতা, যখন কোনও প্রশ্ন নেই, কোনও উত্তর নেই, যখন একান্তে আপন কথা আপন জনারে। জ্ঞানের অহং-আলো ফুরিয়ে যখন সন্ধ্যা আসে, যখন অহং ভেদ করে, জ্ঞান ত‍্যাগ করে, ‘জানা’ ত‍্যাগ করে ‘চেনা’ এসে সামনে দাঁড়ায় তখনই তো ‘আমি’ প্রস্তুত হয় ‘আমি’র মুখোমুখি হওয়ার। এই অন্ধকার জ্ঞানহীনতার নয়, জ্ঞানের অহং ত‍্যাগ করে প্রশ্নহীন ও দ্বীধাহীন আত্মসমর্পণের।

(জানা ও চেনার মধ্যে পার্থক্যটা ঠিক কতটা, একটা ঘটনার উল্লেখ করলে বুঝতে পারবেন।
কিছুদিন আগে একটা বিষয়ে আলোচনা করতে করতে প্রভাতজ‍্যেঠু হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের একটা বিশেষ দিক নিয়ে লিখতে বললেন আমাকে।
আমি বললাম, জ‍্যেঠু আমি পারব না।
উনি বললেন, কেন?
উত্তর দিলাম, আমি তো রবীন্দ্রনাথকে চিনিই না। জানি হয়তো, কিন্তু চিনি না।
তখন উনি বললেন, অহ্, তাহলে তুমি পারবে না।

জানা ও চেনার পার্থক্য ঠিক এতটাই। মধ‍্যবর্তী অঞ্চলে দু-চারটে আলোবর্ষ অনায়াসে নাক ডাকিয়ে ভাতঘুম দিতে পারে।)

একটু স্পষ্ট করেই বলা যাক ব‍্যাপারটা, কয়েক মাস আগে আই-সোসাইটি নিয়ে একটা গদ‍্যে আমি লিখেছিলাম, কবিতা আদতে তিনটি,
প্রথম কবিতা : যা আমাদের চিন্তনে সৃষ্টি হয়।
দ্বিতীয় কবিতা : প্রথম কবিতার লিখিত রূপ।
তৃতীয় কবিতা : দ্বিতীয় কবিতা পড়ে পাঠকের মধ্যে যে অভিঘাত বা পাঠকের মধ্যে সৃষ্ট যে কবিতা।

অদ্ভুত সুন্দর ঘটনা হলো, এই তিনটি কবিতা মোটেই এক নয়, বা এক হতেও পারে না। গুটিপোকা থেকে প্রজাপতি হওয়ার মতো ক্রমাগত পাল্টে ফেলে তার রূপ। তাইতো সে এতো সুন্দর। (এই ধারণার জন‍্য আমি অনিন্দ্যদার (রায়) কাছে বিশেষ ভাবে ঋণী।)

প্রথম কবিতা বা আদতে যেটি সৎ কবিতা, তা প্রশ্নহীন। এটা সৃষ্টি হয় আমাদের মধ্যে প্রতি মুহুর্তেই, শুধু কবি বা সৃষ্টিশীল মানুষের মধ্যে নয়, সমস্ত মানুষের মধ্যেই। কিন্তু সবাই ধরতে পারে না বা বুঝতে পারে না কারণ রিসিভারটা যে তাদের কাছে নেই, রিসিভারটা জন্মদত্ত। একমাত্র সৃষ্টিশীল মানুষের মধ্যেই থাকে এই রিসিভার, সে অনুভব করতে পারে ভিতরের সৃষ্টিশীলতার জন্মটাকে, তারপর সে সেটাকে ধরার চেষ্টা করে তার সৃজনশীল কাজের মধ্যে দিয়ে। কবির ক্ষেত্রে কবিতায়। প্রশ্নটা কিন্তু অনুভবের নয়, প্রশ্নটা যাপনের। আরও ভালো করে বললে, ভিতরের সৃষ্টিশীল ‘আমি’র সাথে একাত্ম হওয়ার। এখানেই একটা শব্দ এসে উপস্থিত হয়, সাধনা। একটা দীর্ঘপথ, যার শেষে কবি মুখোমুখি হয় অন্তরের কবিটির, আমি মুখোমুখি হয় অন্তরের ‘আমি’র, জীবনানন্দ মুখোমুখি বসবার অবকাশ পায় নাটোরের বনলতা সেনের। অর্থাৎ, স্পষ্ট ভাবেই বলছি, বনলতা সেন জীবনানন্দের প্রেমিকা নয়, বাস্তব অস্তিত্ব থাকতে পারে বা নাই থাকতে পারে, তাতে কিছু এসে যায় না, বাস্তবজীবনে প্রেমহীন, নারীহীন, সাংসারিক অশান্তি, চরমতম আত্মবিশ্বাসহীন অবস্থা থেকে মুক্তি খুঁজে পান যখন মুখোমুখি হন তাঁর ভেতরের কবিটির সাথে, সবাই যখন মুখ ফিরিয়ে নেয় তখন সে কীভাবে অনবরত ঘুরে ঘুরে কথা বলে তার সাথে, কীভাবে ভিড়ের মাঝেও সে একান্তে পেতে চায় কবিকে, কীভাবে তার মুখোমুখি বসলে জৈবিক চাহিদাগুলো জাস্ট ভ‍্যানিস হয়ে যায়, একটা অদ্ভুত সুন্দর শান্তি হেঁটে যায় অস্তিত্বের সবটুকু পথ ধরে। (যারা, লেখালেখি করেন তারা জানেন, কীভাবে আমরা হঠাৎ হঠাৎ অন‍্যমনস্ক হয়ে যাই, কোথায় যেন হারিয়ে যাই আমরা, কেউ যেন কানে কানে বলে যায় কিছু লাইন, কেউ যেন কথা বলে আমাদের সাথে। হয়তো খেতে বসে খেতে ভুলে যাই বা প্রেমিকার ঠোঁটে রাখতে ঠোঁট হঠাৎ। এরজন্য কম গঞ্জনা শুনতে হয় না আমাদের, বৌ বলে, একটু সংসারী হও, শালী বলে মৌন জামাই, আর বন্ধুরা বলে…..থাক, ওটা এখানে না বলাই ভালো)। বনলতা সেন আদতে কবির প্রেমিকা। হ‍্যাঁ, ব‍্যক্তি জীবনানন্দের নয়, কবি জীবনানন্দের প্রেমিকা। কবির ভালোবাসা অন্তরের কবির প্রতি। পুরুষ কবি স্বাভাবিক ভাবেই ভিতরের ‘আমি’কে কল্পনা করেছেন নারীরুপে, নাহলে মিলন হবে কেমনে? আর, বনলতা সেন’ অবশ্যই একটি মাত্র কবিতার নাম’ও নয়, আমাদের প্রত‍্যেকের ভিতরে সৃষ্টি হওয়া প্রথম কবিতাকে অনায়াসে ডাকতে পারি, হ‍্যালো মিস্ বনলতা সেন, হাও আর ইউ ডার্লিং? (মিস্, মিসেস নয় কিন্তু। মিসেস হলেই জাগতিক চাওয়া পাওয়ার মোচার ঘন্ট।)

সমস্যা কিন্তু প্রথম কবিতাকে নিয়ে নয়, সমস্যা শুরু হচ্ছে দ্বিতীয় কবিতা থেকেই, কারণ এখান থেকেই শুরু হচ্ছে, কলমের কেরামতি এবং কবিদের কাঁকড়ামি। দ্বিতীয় কবিতার সাথেই জড়িয়ে পড়ছে ‘কবি’ নামক ভয়ঙ্কর সুন্দর জীবটি। যে আঁচড়াতে জানে, খামচাতে জানে, বুকে মেডেল ঝুলিয়ে সেল্ফি তুলতেও জানে এমনকি তার পাঠকের মনে ছিটিয়ে দিতে পারে শান্তিজল।

দ্বিতীয় কবিতায়, কবি প্রথম কবিতাকে কপি করার চেষ্টা করে, চেষ্টা করে তাঁর ভেতরের কবিতাকে শব্দে বাঁধতে। কিন্তু, পুরোপুরি কখনোই সম্ভব হয় না। এই পুরোটা ধরতে না পাড়ার তাড়নাটাই কবিকে বাধ্য করে বারবার ‘কবিতা’ লিখতে। হেঁটে যেতে সবটুকু কবিতার ভিতর। কয়েকদিন আগে, সুদীপ (ব‍্যানার্জি) আমাকে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা আমার লেখা কি হচ্ছে না? কনফিউজড।’ আমার কিছু বলার ছিল না, তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো জ্ঞান’ও আমার নেই, শুধু বললাম, ‘একটা কথা বলতে পারি, নিজের লেখা নিয়ে নিজের মনে প্রশ্ন আসা মানে তুমি সঠিক পথে আছো।’

হ‍্যাঁ, এটাই কোনও কবির (যেকোনও সৃষ্টিশীল মানুষের) চালিকাশক্তি। এটা হতেই পারে পাঁচন বা অঙ্কুশ, কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই জানি, এটাই প্রভাত চৌধুরীর ‘আপডেটেড ভাবনা’, যার ফলাফল ‘আপডেটেড কবিতা’।

কিছুদিন আগে একজন বলল, ‘আমি কবিতা পাক্ষিকে কবিতা পাঠাতে চাই’। আমি বললাম, খুব ভালো, পাঠাও। তখন সে বলল, ‘কিন্তু আমার কবিতাগুলো কি আপডেটেড? তুমি একটু চেক করে দাও’। আমি তখন জিগ্যেস করলাম, আপডেটেড কবিতা বলতে তুমি কী বোঝো? সে বলল, ‘ওই যে একটু ইংরেজি শব্দ থাকবে, একটু খটখটে, রসহীন কবিতা’। বুঝলাম, যে ভুলটা আমি করেছিলাম একদিন, সেই ভুলটা রয়ে গেছে এখনও।

পরিস্কারভাবে বলছি, এটা মোটেই আপডেটেড কবিতা নয় বা এটা মোটেই আপডেটেড কবিতার বৈশিষ্ট্য নয়। আরও স্পষ্ট করে বললে, আপডেটেড কবিতার কোনও নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য হয় না, হয় না বলেই প্রভাত চৌধুরী বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করেননি। আপডেটেড কবিতা আদতে একটা জার্নি…...জার্নি টু কবিতা। একটা খোঁজ, খোঁজ আরও নতুন কিছুর। লেখার মধ্যে নতুন নতুন অঞ্চল সৃষ্টি। ধরা যাক, তুমি চাঁদকে নিয়ে কিছু লিখছো, চাঁদকে নিয়ে তো প্রচুর লেখা হয়েছে, তুমি নতুন কী দিতে পারছো? যা আগে কেউ দেয়নি, চাঁদকে নিয়ে এমন কী ভাবতে পারছো? যা আগে কেউ ভাবেনি? একটা উদাহরণ দিলেই ব‍্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যাবে, “আকাশে ক্ষমার মতো চাঁদ ওঠে” (কবির নাম মনে নেই)। এটাই আপডেটেড ভাবনা, এটাই আপডেটেড কবিতার প্রতি যাত্রা। প্রতি মুহূর্তে ভাবনাকে আরও বিস্তৃত করা, আরও ছড়িয়ে দাও, আরও বহুমাত্রিক হয়ে ওঠা, নতুনের সন্ধানে ক্রমাগত হেঁটে যাওয়াই আদতে আপডেটেড থাকা। থেমে থাকা মানে তো পিছিয়ে যাওয়া, তাই, আপডেটেড ভাবনায় থামার কোনও সুযোগ নেই, সুযোগ নেই নিজের লেখার প্রতি প্রশ্নহীন থাকা, এটা একটা নেভার এন্ডিং প্রসেস্। এই প্রসেসের ফলস্বরূপ যে ‘আপডেটেড কবিতা’, তা থেকে যাবে চিরদিনই অধরা, ততদিন পর্যন্ত কোনও লেখা ‘কবিতা’ হয়ে উঠবে না, কবিতা হয়ে ওঠার চেষ্টা করে যাবে মাত্র। এটা অনেকটা একটা একটা করে পেঁয়াজের খোসা ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো। খোসা ছাড়ালে ঝাঁঝ উঠবেই, এই ঝাঁঝটাই বলে দেবে তুমি আপডেটেড আছো কিনা, পেঁয়াজটা হাতে ধরে বসে থাকলে তো আর ঝাঁঝ উঠবে না। প্রভাত চৌধুরী কবিতার মধ‍্যে শুধু দেখে নেন এই ঝাঁঝটা আছে কিনা, কারণ তিনিও জানেন আপডেটেড কবিতা কোনদিনই লেখা সম্ভব নয়। কারণ আজ যা নতুন, কাল তা পুরাতন। চরম এবং পরম বলে কিছু হয়না পৃথিবীতে, সবকিছুই আপেক্ষিক। এই ঝাঁঝালো গন্ধটা আমি অনেকের কবিতা থেকেই পাই, এমনকি তাঁদের থেকেও যাঁরা আপডেটেড কবিতাকে গালি দেন বা মনে করেন না তাঁদের কবিতা আপডেটেড পথে যাত্রা করেছে। আর এই জন্যই আমি প্রভাত চৌধুরীর কথার বিরোধিতা করে বলছি, কবিতা শুধু মাত্র ভালো লাগার জন্ম দিতে পারে, খারাপ লাগা নয়, কারণ কবিতা চিরদিনই অধরা থেকে যাবে, আমরা যা লিখি তা তো কবিতাকে ধরার চেষ্টা মাত্র। এই চেষ্টাটুকু অবশ্যই ভালো লাগতে পারে বা খারাপ।

অতঃপর তৃতীয় কবিতা, এটাই সবচেয়ে বেশি গোলমেলে এবং এটাই সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে কবিকে। এই তৃতীয় কবিতার জন‍্যেই কবি অসৎ হতে বাধ‍্য হয়। পাঠকের মন বুঝে লেখে, আই মিন্ কবিতা তৈরি করে। হ‍্যাঁ, কবিতা তৈরি করা যায়। চুরি করে, শব্দ সাজিয়ে এবং তা কবিতা বলে চালানো যায় এবং চলেও যায়। এই তৃতীয় কবিতার বাধ‍্যবাধকতাতেই কবি নিরালা পথ ছেড়ে উঠে আসে খোলা বাজারে। মুখ দেখানোর প্রবণতা আদতে কবিতা বিক্রির বিজ্ঞাপন। (স্বাভাবিক ভাবেই তৃতীয় কবিতা পাঠক ভেদে আলাদা।)

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই আমিও এর শিকার। এই হট্টগোলের রাজনীতিতে গুলিয়ে গেছে আমার কবিতার সহজ সমীকরণ। সত্যি আমি ক্লান্ত, আমি বিরক্ত। আর ভালো লাগছে না, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, আমি সত্যিই পাখি হতে চাই। তাই, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আপততত এটাই আমার শেষ সম্পাদনা। আমি এবার নিজের মতো করে লিখতে চাই, সবচেয়ে বেশি করে পড়তে চাই। লেখালেখির মানুষের একটা প্রস্তুতি পর্ব থাকা বাধ্যতামূলক। ফেসবুকে ভর করে আমি সেটা ডিঙিয়েই চলে এসেছি লেখালেখির জগতে। প্রস্তুতিহীনতার অভাবটা টের পাচ্ছি এখন, প্রশ্ন উঠছে নিজের মনেই। তাই, আমি সম্পাদনা ছাড়ছি। সময়টা দিতে চাই পড়াশোনায়। তাছাড়া, আমার সন্তানের শৈশবকে তো অস্বীকার করতে পারিনা, ওটাও যে আমার কবিতা, আমার ‘বনলতা সেন’।

সিদ্ধান্তের প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়েছে জানুয়ারি মাস থেকেই। কৈশোরের প্রেমিক-প্রেমিকার মতো ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে, লভ্ মি….লভ্ মি নট্ করতে করতে অবশেষে স্থির সিদ্ধান্তে এসেছি, আমি সম্পাদনা ছাড়ছি এবং তরঙ্গ’ও।

এই সংখ‍্যার শুরুতেই আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম আমি সম্পাদনা ছাড়ব, তাই লেখার আহ্বানের সুরটাও ছিল একটু অন্য রকম। ঠিক এই কারণেই, ভোটের অজুহাত দিয়ে পত্রিকা প্রকাশের দিনটাকে এগিয়ে নিয়ে আসা, যাতে পরবর্তী সম্পাদক বা সম্পাদক মন্ডলী প্রস্তুতির সময়টুকু পায়। আর এই কারণেই সম্পাদক মন্ডলী ভেঙে দেওয়া, তারজন্য একটু নাটক করার বা শাল‍্যদানীকে দিয়ে নাটক করানোর প্রয়োজন ছিল। (ও বেচারি জানেও না, ওকে দিয়ে আমি এই নাটকটুকু করিয়েছি, ও সেটাই করে যেটা আমি বলে দিই, এমনকি সমস্ত ঘোষণার লেখাটুকুও এডিট করিয়ে নেয়, হ‍্যাঁ এতটাই বিশ্বাস ও নির্ভর করে ও। তাই এই নাটকটা করতে খারাপ লেগেছে আমার, কিন্তু আমি নিরুপায়, সত্যিটা বলে এটা করানো যেত না হয়তো। যাইহোক, তারজন্য দুঃখিত) সম্পাদকীয়তে আমি যা লিখলাম, তা সম্পাদক মন্ডলীর প্রতিনিধিত্ব করে লেখা ঠিক হবে না মনে করেছি বলেই সম্পাদক মন্ডলী ভেঙে দিয়েছি। যদিও, আমি কোনদিন সম্পাদক মন্ডলী কনসেপ্টে বিশ্বাস রাখিনি। এই ব‍্যাপারে আমি চরমভাবে একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমি সেটাই করেছি, যেটা আমার মনে হয়েছে। সম্পাদক মন্ডলীকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে কাজ করে গেছি, তারপরও ওরা কেউ সামান্যতম অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করেনি, তারজন্য আমি ওদের কাছে কৃতজ্ঞ এবং ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ এই জন‍্যেও যে, যখনই যায় কাছে কোনও সাহায্য চেয়েছি, তারা নির্দ্বিধায় করেছে।

যাইহোক, যাবার আগে কিছু কথা বলা যাওয়া উচিত বলে মনে হচ্ছে, যাতে পরবর্তী সম্পাদক মন্ডলী একটা স্পষ্ট রোডম্যাপ থাকে।

১। ‘এখন তরঙ্গ’কে বাংলা সাহিত্যের Open platform করতে চেয়েছিলাম এবং করেছি। চেয়েছিলাম সাহিত্যের প্রতিটি ধারা একই পত্রিকার মধ্যে ধরতে, এবং সেটা সফলতার সাথেই করেছি। অনুপম মুখোপাধ্যায়, ব‍্যঙ্গ করে বলেছিল, ‘তুমি কি বাংলা সাহিত্যের জুকারবার্গ হতে চাও নাকি? সব ধারাকে একসাথে ধরা?! পত্রিকা না লঙ্গরখানা? প্রতিটি পত্রিকার একটা নির্দিষ্ট চরিত্র থাকে, কিন্তু তোমার পত্রিকার কোনও চরিত্রই নেই, বেশ‍্যাদের মতো, প্রতি রাতে খদ্দের পালটায়’। ঠিক, একদম ঠিক, এটাই বলেছিলাম ওনাকে, আরও বলেছিলাম, ‘চরিত্রহীনতা’ই হবে আমার পত্রিকার চরিত্র। দেখা যাক, ‘জুকারবার্গ’ হতে পারি কিনা। হ‍্যাঁ, পেরেছি। কারণ বিশ্বাস ছিল নিজের উপর আর ভরসা ছিল আমার জন্মগত জেদের উপর। পরবর্তী সম্পাদক মন্ডলী এই বিশ্বাস ও জেদটা বজায় রেখ।


২। প্রতি সংখ‍্যায় কমপক্ষে ৫ টি করে জায়গা রাখতাম একদম নতুন কলমের জন্য। এমন কলম, যারা আগে কখনও কোথাও লেখেনি। পত্রিকার ছাপানোর যোগ্য কিনা ভাবিনি, শুধু একটা সুযোগ সামনে রেখেছি তাদের। কারণ, আমি বিশ্বাস করেছি, একটা সুযোগ এনে দিতে পারে প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস। আমি ভুল করিনি, তার কারণ তাদের মধ্যে সাতজন এখন নিয়মিত লিখছে বিভিন্ন পত্রিকায়। পরবর্তীর কাছে অনুরোধ, নতুনদের সুযোগ দিও, নিঃস্বার্থভাবে।

৩। স্কুল পড়ুয়াদের লেখা সেভাবে আমি যোগাড় করতে পারিনি, এই ব‍্যাপারে আমি ব‍্যর্থ। পরবর্তীতে তোমারা এটাকে এগিয়ে নিয়ে যেও সফলভাবে।

৪। ‘আঞ্চলিক উপভাষা’ এই ট‍্যাগ লাইনটা এই সংখ‍্যা থেকেই তুলে দিয়েছি। আঞ্চলিক ভাষায় লেখা কবিতা রেখেছি ‘কবিতা’ বিভাগেই। ব‍্যাপারটা মাথায় রেখ।

৫। সূচীপত্রে নামের তালিকায় আমি ‘ছোট’ কবি/লেখক, ‘বড়ো’ কবি/লেখক ধারণাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছি। এটা বজায় রাখার অনুরোধ রইল।

৬। সম্পাদক হিসেবে আমি অন্য কোনও পত্রিকার সাথে শত্রুতা বা অসহযোগিতায় বিশ্বাস রাখিনি। তাই, নির্দ্বিধায় অন্য পত্রিকার লিঙ্ক, লেখা আহ্বান শেয়ার করেছি। ভিতর থেকেও সাহায্য করি এবং করেছি অনেক পত্রিকাকেই। এই স্পিরিট’টা বজায় রেখ।

৭। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, লেখা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমি অন্য কোনও সমীকরণ মাথায় রাখিনি। এমনকি আমার ব‍্যক্তিগত বিরুদ্ধাচারণ করা কলমের’ও লেখা ছেপেছি। কারণ আমি প্রত‍্যেককে কলম হিসাবেই দেখেছি, ব‍্যক্তি হিসাবে নয়। মনে রেখ, কলমের সাথে শত্রুতা করা যায় না।



অতঃপর, কিছু কথা স্পষ্ট করে বলে নেওয়াই ভালো, নাহলে, অনেকে যে ভেবে বসে আছেন, আমি আদতে একটি গভর্মেন্ট রেজিস্টার্ড ব‍্যক্তিগত সম্পত্তির বিনা পয়সার পোষা ভৃত্য, তরঙ্গ ছাড়া আমার গতি নেই, তরঙ্গ ছাড়া আমি চলতেই পারব না, তাদের ভুলটা থেকেই যাবে। যাবার আগে, ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে যাওয়াই ভালো লক্ষণ।

তরঙ্গ মোটেই গভর্মেন্ট রেজিস্টার্ড নয়, নয় কোনও হাউস। (থাকলে আমি অন্তত জানতে পারতাম, বা তরঙ্গের ব্লগে রেজিস্টার নাম্বারের উল্লেখ থাকতো।)
১০ই নভেম্বর ২০১৬ সালে কয়েকজন কয়েকজন বন্ধুর Whatsapp group আড্ডার মাঝে হঠাৎ সৃষ্ট, সৃজনশীল কাজের একটা প্লার্টফর্ম খোঁজার শুরু। (তরঙ্গের ব্লগে About তরঙ্গে ইতিহাসটা কিছুটা পাবেন)। যাইহোক, লীনাদির পরমর্শে এবং সক্রিয় সহযোগিতায় সাহিত্য পত্রিকা ‘এখন তরঙ্গ’ শুরু। Pdf আকারে। নীরবতা, বিজন পন্ডিত, ব্রতশুদ্ধ, ফারজানা মণি, রাহুল গাঙ্গুলীর হাত ধরে তরঙ্গ এগিয়ে চলে। ওদের পরিশ্রমে বেশ কিছু ভালো মানের পত্রিকা সৃষ্টি হয়। (ব্লগে পুরনো পত্রিকার লিঙ্ক পাবেন) যদিও মাঝে মধ্যে অনিয়মিত হয়ে পড়ে তবু পত্রিকা বেঁচে ছিল। রাহুলদা তখন প্রধান সম্পাদক, পত্রিকা ফিরে আসে আবার। সেইসময়, শাল‍্যদানীকে পরামর্শ দিই pdf নয়, ব্লগে আসতে। যেচে উপকারের ফর্মুলা মেনে বাঁশটি এসে ঢোকে……...যাইহোক, তরঙ্গে আমার অন্তর্ভুক্তি প্রথমে ব্লগের কাজ করার জন্য, শর্ত রেখেছিলাম একটাই, কোথাও আমার নাম থাকবে না। সপ্তম সংখ্যা সেইভাবেই চলেছিল। কিন্তু, বিধি বাম হলে যা হয় আর কী, অষ্টম সংখ‍্যা প্রকাশের ঠিক আগে রাহুলদা সরে যাওয়াতে শাল‍্যদানীর অনুরোধে আসতেই হলো সামনে। হ‍্যাঁ, অনুরোধে, কারণ আমাকে নিয়োগ করা যায় না, তাই আমাকে সরিয়েও দেওয়া যায় না, যেমন যায় না, আমাকে কিছু দায়িত্ব দেওয়া বা আদেশ করা, শুধু যেটা যায় সেটা হলো অনুরোধ, বন্ধুর প্রতি বন্ধুর অনুরোধ।
সম্পাদনার অনুরোধ করাতে, শাল‍্যদানীর কাছে শর্ত রেখেছিলাম একটাই, আমি পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাস রাখি, কোনওদিন আমার কাজে কোনও হস্তক্ষেপ করা যাবে না, যেদিন হস্তক্ষেপ করা হবে, সেটাই হবে তরঙ্গে আমার শেষ দিন। আমি স্বীকার করছি, শাল‍্যদানী শর্তটা এই মুহুর্ত পর্যন্ত লঙ্ঘন করেনি, আমি তার জন্য ওর কাছে কৃতজ্ঞ। ও কথা রেখেছে, কিন্তু আমি রাখতে পারলাম না, ওর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আসলে আমি নিরুপায়, প্রয়োজনটা যে সম্পূর্ণ আমার ব‍্যক্তিগত এবং পারিবারিক।

অতঃপর, নভেম্বর থেকে (অষ্টম সংখ্যা) থেকে শুরু হলো সম্পাদক হিসেবে আমার পথ চলা, লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছিলাম আমি প্রথমেই, এমন একটা পত্রিকা, যেখানে বাংলা সাহিত্যের সব ধারা থাকবে। কারণ তখনও পর্যন্ত দেখিনি এমন কোনও পত্রিকার অস্তিত্ব। ছড়া-ছড়াক্কার পাশে কবিতার ল‍্যাব ! এ তো ছিল আকাশ কুসুম কল্পনা। আর, ভিতরে ভিতরে ঠিক করেছিলাম, অনুপম মুখোপাধ্যায়ের বাকের দম্ভ আমি ভাঙবোই এবং আফজল আলির জিবাকের। ব‍্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন আমাকে এরকম লক্ষ্য স্থির করতে বাধ‍্য করেছিল, যদিও ব‍্যক্তিগত ভাবে ওনাদের দুজনকেই আমি শ্রদ্ধা করি, বিশেষ করে ওনাদের লেখার ভক্ত আমি। তাছাড়া, আমি এটা মনে করি, যে ‘শত্রু’র প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, তার শত্রুতার অধিকারই নেই।

অনলাইন ম‍্যাগাজিন হিসাবে আমি তরঙ্গকে ঠিক কোন জায়গায় নিয়ে এসেছি তার মূল‍্যায়ণ হোক আপনাদের কাছে, তবে এইটুকু নিশ্চিত জানি, তরঙ্গকে সেই জায়গায় নিয়ে আসতে পেরেছি, যেখান থেকে খুলে যায় একটা বিরাট সম্ভাবনা। ঠিকঠাক পরিচর্যা করলে তরঙ্গ অনেক দূর যাবে। আর, পত্রিকার/লেখালেখির মূল লক্ষ্যই হওয়া উচিত লং টার্ম জার্নি। সিঁড়িভাঙা অঙ্ক কষে শর্টকাট প্রসেসে আস্থা রাখলে পতন অনিবার্য।

সবশেষে বলব, তরঙ্গের প্রত‍্যেকের কাছে, পত্রিকার কবি/লেখকদের কাছে এবং সাহিত্য জগতের অনেকের কাছেই আমি যে সাহায্য, সম্মান ও ভালোবাসা পেয়েছি, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। প্রত‍্যেককে আমার ধন‍্যবাদ জানিয়ে…….বিদায়…..


জ‍্যোতির্ময় মুখার্জি
সম্পাদক : 'এখন তরঙ্গ'

4 comments:

  1. ।।চমকে যাচ্ছি বারবার লেখাটা প'ড়ে।।

    ReplyDelete
  2. এ কথা জ্যোতির নয় , আমাদের সকলের ।। হাটস অফ বন্ধু ।।

    ReplyDelete
  3. শ্রদ্ধা হল জ্যোতির্ময়। আর হ্যাঁ,চমকে দিল তোমার কলম।

    ReplyDelete
  4. যে টুকু লিখেছি লেখার মতো আমার সংজ্ঞায়, সেটা তোর প্রশয় এ। তোকে যত দেখেছি,পড়েছি অবাক হয়েছি কলমের এমন বলিষ্ঠ পদচারণা কে, এই সব কিছু কে ভেঙে ফেলার স্টাইল টা র ফ্যান হয়ে গেছি বন্ধু। তরঙ্গ কে তোর আরও অনেক দেবার ছিল। বন্ধু হিসেবে কথাও হয়েছে অনেক বার। বার বার তোর লেখায় সময় দেবার পক্ষে সওয়াল করেছি। তরঙ্গ এগিয়ে চলুক তরঙ্গের মতো করে । যেকারণে ছাড়ছিস ,সে ব্যাপারে কিছু বলার নেই। লেখাই থাক, ভালো থাক।

    ReplyDelete