যে সকল গানের বাণী অংশ বাংলা ভাষায় রচিত, সেসকল গানের সাধারণ নাম 'বাংলা গান'। এই সংজ্ঞার সূত্রে বাংলা গান যেভাবে আদিকাল থেকে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ক্রমবিকাশের ধারায় বিকশিত হয়েছে। এমন কোনো নৃগোষ্ঠী নেই যাদের ভাষা এবং গান নেই। উভয়ই যোগাযোগের মাধ্যম। উভয়ই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির অংশ। সুরের ভাব প্রকাশের ক্ষমতা আছে, ভাষার তো আছেই। তবে মাধ্যম ভিন্ন, প্রকৃতিও ভিন্ন। ভাষার সাথে সঙ্গীতের (গীত-বাদ্য-নৃত্য) সম্পর্ক সহোদরার মতো। নিত্য দিনের বাস্তব জীবনের কাজকর্মের ভিতরে যে কথোপকথন বা বর্ণনা শুনতে পাই বা পাঠ করে অনুভব করি, তার ভিতরে রয়েছে মনোজগতের বাস্তব দশা। আর সেই বাস্তব দশাই যখন কল্পনার আশ্রয়ে সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা ইত্যাদিতে উপস্থাপন করা হয়, তখন তা হয়ে যায় মনোজগতের কল্প-বাস্তব নামক দ্বিতীয় স্তরের বিষয়। সুকুমার শিল্পকলায়, বাস্তব জীবনের বিভিন্ন বাস্তব দশাকে উপস্থাপন করা হয় নান্দনিক উপস্থাপনায়।
যদি বাংলা গানের ভাষার সন্ধান করতে যাই, তাহলে অবশ্যই ৩টি ভাষাকে জানতে বা উপলব্ধি করতে হবে। এই ভাষা তিনটি হলো বাণী, সুর ও ছন্দ। এ ক্ষেত্রে বাণীপ্রধান গানে, গানের অর্থ জানাটা আবশ্যক, কিন্তু না জানলেও গানের আনন্দ নষ্ট হয়ে যায় না। মূলত এক্ষেত্রে গানের আনন্দটা প্রবহমান ধারায় সঞ্চারিত হয় সুর ও ছন্দের যাদুতে। গানের সুর ও ছন্দের প্রকৃতি না বুঝেই অধিকাংশ মানুষ গান শোনে, এমন কি গেয়েও থাকে। তাতে গানের জাত যায় না। কিন্তু জাতেও উঠে না। জাত শিল্পী হতে গেলে, গানকে সকল অর্থে আত্মস্থ করতে হয়। জাত শ্রোতা হতে গেলেও তাই। তাই জাত শিল্পীর পরিবেশিত গান, জাত শ্রোতার মাধ্যমে জাতের গান হয়ে উঠে ।
সঙ্গীতের পরিচয়
সঙ্গীত যদি হয় গীত, বাদ্য, নৃত্য হয়। তাহলে অনুভবের মৌলিক ক্ষেত্রের বিচারে সঙ্গীত প্রথমেই দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এর একটি হলো শ্রবণের। এই ধারায় পড়ে গীত ও বাদ্য। দ্বিতীয় ধারাটি হলো দর্শনের। এই ধারায় পড়ে থাকে নৃত্য। নিশ্চয় এ কথা মানতেই হয় যে, সঙ্গীতের এই দুটি ধারায় যে নান্দনিক অনুভূতির জন্ম দেয়, তা দর্শন এবং শ্রবণের সমন্বয়ে পূর্ণতা লাভ করে। বেতারযন্ত্রে এবং রেকর্ডে গান শোনার আগে গীত ও বাদ্য শ্রবণ ও দর্শনের বিষয় ছিল। কিন্তু দর্শন না করেও গীত-বাদ্য শ্রবণ করা যায়। এই কারণে গীত-বাদ্যের মৌলিক মাধ্যম হলো শ্রবণ-যোগাযোগ। এই বিচারে গীতবাদ্যের প্রকৃতি বিশ্লেষণের মৌলিক ধাপগুলো হলো-
সঙ্গীত যদি হয় গীত, বাদ্য, নৃত্য হয়। তাহলে অনুভবের মৌলিক ক্ষেত্রের বিচারে সঙ্গীত প্রথমেই দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এর একটি হলো শ্রবণের। এই ধারায় পড়ে গীত ও বাদ্য। দ্বিতীয় ধারাটি হলো দর্শনের। এই ধারায় পড়ে থাকে নৃত্য। নিশ্চয় এ কথা মানতেই হয় যে, সঙ্গীতের এই দুটি ধারায় যে নান্দনিক অনুভূতির জন্ম দেয়, তা দর্শন এবং শ্রবণের সমন্বয়ে পূর্ণতা লাভ করে। বেতারযন্ত্রে এবং রেকর্ডে গান শোনার আগে গীত ও বাদ্য শ্রবণ ও দর্শনের বিষয় ছিল। কিন্তু দর্শন না করেও গীত-বাদ্য শ্রবণ করা যায়। এই কারণে গীত-বাদ্যের মৌলিক মাধ্যম হলো শ্রবণ-যোগাযোগ। এই বিচারে গীতবাদ্যের প্রকৃতি বিশ্লেষণের মৌলিক ধাপগুলো হলো-
- সত্তা (entity): মানুষ যত ধরনের বিষয়বস্তুকে পৃথকভাবে শনাক্ত করতে পারে, তা এক বা একাধিক শব্দ দ্বারা প্রকাশ করে। এই প্রকাশযোগ্য শব্দ বা শব্দসমূহের সাধারণ পরিচিতি 'নাম'। আবার 'নাম' রয়েছে যে কোন বিষয়বস্তুকে পদপ্রকরণের বিচারে 'বিশেষ্য' হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
- বিমূর্ত সত্তা (abstract entity): মানুষ এমন কিছু বিষয় অনুভব করে, যেগুলো কোনো বস্তু নয়। যে সত্তাগুলোর ওজন নেই, দেখা যায় না, স্পর্শ করা যায় না, বস্তু জগতে যাকে কোনো জায়গা ছেড়ে দিতে হয় না। এই জাতীয় বিষয়ের বস্তুগত আকার নেই বলেই এদেরকে বিমূর্ত বলা হয়েছে।
- যোগাযোগ (communication): যে কোনো প্রক্রিয়া বা মাধ্যমের দ্বারা পরস্পরে ভিতরে সংযোগ তৈরি করে।
- শ্রবণ যোগাযোগ (auditory communication): যে যোগাযোগ ঘটে ধ্বনি এবং শ্রবণেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ।
- বর্তমান আলোচনার প্রধান বিষয় হল সঙ্গীত বিমূর্ত বা Abstract music । সাধারণ সঙ্গীত বা Absolute music হল যে সঙ্গীত কেবলমাত্র শিল্পী তাঁর কণ্ঠে ভাষায় ফুটিয়ে তোলেন অর্থাৎ এই ধরনের সঙ্গীতের সাহায্য নিয়ে কোন নৃত্য বা আলেখ্য হয় না । শিল্পীর কণ্ঠস্বর এবং শ্রোতা সরাসরি যুক্ত থাকে । মূলত এই ধরণের বিমূর্ততা সম্পর্কে সম্যক ধারনার সৃষ্টি হয় আনুমানিক আঠেরো শতকে জার্মান রোমান্টিসিজম নিয়ে লেখা কাব্যগাথায় । যেমন – উইলিয়াম হেনরিচ , লুড উয়িকটিকের প্রমুখের লেখায় । তবে ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে রিচার্ড ওয়াগনার , বিথভেন প্রমুখ Absolute music শব্দটিকে আক্ষরিক অর্থে প্রয়োগ করেন । এখানে উল্লেখযোগ্য হল কোন কোন সমালচকগণ Absolute music বা সাধারণ সঙ্গীত এবং Abstract music বা বিমূর্ত সঙ্গীতকে অনেকাংশে এক দেখেছেন ।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে গীত আর সংগীত সমার্থক নয় । গীত যেন সংগীতের অধীন একটা বিষয়। কিন্তু একদিন তারা একার্থক ছিল। কালক্রমে গীত যেখানে ছিল সেখানেই থেকে গেছে। আর সঙ্গীত শব্দটির অর্থবিস্তৃতি ঘটেছে। এ রকম ঘটা অভূত পূর্ব, অসাধারণ বা অযৌক্তিক কিছু নয়। বরং এর প্রয়োজন আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে অর্থ-বিস্তৃতির মূলে কাজ করেছে দুটি বিষয়। সহজ ভাষায় দাঁড়ায় , গীত কেবলমাত্র শিল্পীর কণ্ঠস্বর থেকে নির্গত হয় এবং সঙ্গীত বাদ্যযন্ত্র সহযোগে পরিবেশিত হয়ে থাকে ।
No comments:
Post a Comment