এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

মানসী মন্ডল



মুক্ত গদ্য




অনাহূত

ক'দিন ধরেই মানীর শরীরটা খুব একটা ভাল যাচ্ছে না। খুব দুর্বল লাগছে। হাঁটাচলা করতে গেলে মাঝে মাঝে মাথাটাও ঘুরে যাচ্ছে।ফাগুনের দুপুর গুলো বড় উদাসী। একা একা শুয়ে থাকতে থাকতে তার মনটা কেমন খারাপ করে ওঠে। কী কারণে কার জন্য বিষন্নতা আসে সে বুঝে উঠতে পারে না। দুপুরে ঘুম তার সবদিন আসে না,তাই এলো মেলো চিন্তা মাথার ভিতর ঘুর পাক খায়। সেল ফোনটা হাতে নিয়ে একবার সময়টা দেখে নেয়। না ওর এখনও ডিউটি আওয়ার খতম হয়নি। ফোন রেখে আবার নানা ভাবনায় ডুবে যায়। " ওয়াক... ওয়াক!" ছুট্টে যায় বাথরুমের দিকে। না বমি হল না। কিছুটা টকজল উঠে আসে শুধু। কয়েকদিন ধরেই যখন তখন এরকম হচ্ছে। কিন্তু সে বুঝতে পারছে না কেন এমন হচ্ছে। স্বামী কাছে না থাকায় কাউকে কিছু বলেও উঠতে পারছে না। চোখে মুখে ঠান্ডা জলের ছিটে দিয়ে সে আবার বিছানায় আসে। দুপুরটা বড্ড বেরসিক। কিছুতেই কাটতে চায় না। টিভিটা চালিয়ে সে ফোনটা হাতের কাছেই রাখল।
    
       আচমকা ফোনের আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল। ফোনটা হাতে নিয়ে জড়ানো গলায় বলল " বলো, এতক্ষণে সময় হল? "
সনু : "আরে আজ কাছের খুব চাপ ছিল। স্নান করে খেয়ে উঠতে দেরী হয়ে গেল। তুমি কী করছ বল?"

মানী: "আমার না কিছু ভাল লাগছে না। শরীরটাও কেমন যেন লাগছে। বমি বমি পাচ্ছে।"
এবার ধমকের সুরে সনু বলল " দেখ মানী তুমি একদম নিজের শরীরের যত্ন নিচ্ছ না। সময় মতো খাওয়া দাওয়া কর। আর মন খারাপ করো না আমি দু একদিনের মধ্যে বাড়ী যাব।"
ঘুম ছেড়ে গেল। অগত্যা উঠে এসে বাইরে পুকুর ঘাটে বাঁধানো সিঁড়িতে পা ঝুলিয়ে বসল। মানীর যখনই মন খারাপ করে তখনই এই জায়গাটাতে বসে। শ্বশুড় বাড়ী এসে থেকে এই জায়গাটা সব থেকে তার প্রিয়। জলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছোট বেলার কত কথা, মায়ের কথা, বোনদের কথা সব সিনেমার মতো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আচমকা পুকুরে একটা প্যঙাস মাছ লাফ দিয়ে মানীর ভাবনায় ছেদ ফেলল।। সে সেখান থেকে উঠে বাড়ীর ভিতর চলে যায়।

    বিকাল গড়িয়ে আসে। মানী রান্না ঘরে যায়।
" বাবা এখন চা খাবে? মা কোথায়? "
মানীর শ্বশুড় সুগারের রুগী, বহু নিয়ম করে চলতে হয়।  "তোর মা মনে হয় ঘুম থেকে উঠে রাস্তায় গেছে। যা গরম পড়েছে।"
মানী নিজের গায়ে একবার হাত দিয়ে দেখে গা টা কেমন গরম গরম লাগছে। গরম পড়লেও তার কেমন শীত শীত করছে। চায়ের জলটা ফুটলে তাতে নুন দিয়ে লিকার চা করে শ্বশুড়কে দেয়। শাশুড়ীকে ডাকতে পাঠিয়ে দুধ চা বসায়।
" রাতে কী রান্না করব বাবা? তুমি রুটি খাবে তো? " মানীর শ্বশুড় বেশ ভাল মানুষ। বলল যা করবি কর আমার কিছু একটা হলেই হবে।

     ভাতের জল বসিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভেবে নেয় মানী। আজকাল বড্ড ভাবুক হয়ে গেছে।  সে বড্ড বাচাল, কথা বলতে খুব ভালবাসে। কিন্তু এখানে কথা বলার মতো সেরকম কেউ নেই। যে একটু আধটু শোনে, যাকে নিয়ে মানীর সবটুকু সে তো চাকরী সূত্রে বাইরে। একদিনের জন্য বাড়ী এলে তার মনে খুশির হাট বসে। কী করে স্বামীকে আদরে ভালবাসায় ভরিয়ে দেবে খুঁজে পায় না। ভাত ফুটে এলে সে সবজির ঝুড়ি নিয়ে বসে। কিন্তু কী রাঁধবে! এই একটা বিষয়ে মানীর খুব বিরক্ত লাগে ; মেনু। কী মেনু হবে এটা ভাবতেই আধঘন্টা। ভাবা হয়ে গেলেই রান্না সে খুব ঝটপট সেরে নেয়। পড়ার ঘরে গিয়ে বইগুলো একটু ঝাড়াঝাড়ি করে। অনেকদিন কোচিং এ যাওয়া হয়না। সাজেশন গুলো যদিও শ্বশুড়মশাই স্যারের কাছ থেকে জেরক্স করে এনে দিয়েছেন। কিন্তু পড়ায় সে ভাবে মন লাগাতে পারছে না।

     রাত্রে খাবার সময় শ্বশুড় শাশুড়ী দুজনেই খুব জোর করে খাওয়ানো চেষ্ট করল। মানী কিছুতেই বিছানা ছাড়তে চাইল না। কাঁথাটা ভাল করে গায়ে চাপা দিয়ে শুয়ে পড়ল।  দেখেশুনে শাশুড়ী বলল" এমন করলে চলবে? খেতে হবে তো। যা পার দুটো মুখে দাও। " উঠে গিয়ে জোর করে দুটো মুখে দিতেই মানী ছুটে বেসিনের কাছে গেল। বিকালের চা বিস্কুটটাও বমি হয়ে উঠে গেল। ভাব গতিক দেখে শ্বশুড় হাউসফিজিশিয়ানকে ফোন করে সকালে আসতে বলল।

  এত ঘুমায় তবুও মানীর ঘুমের ভোগ হয় না। সকালে উঠে মুখ ধুয়ে সে রাতের বাসন গুলো নিয়ে বাঁধানো ঘাটে গিয়ে বসে।বাসনের ভিতর বাসী খাবারের গন্ধে তার পেটের ভিতরটা কেমন দলা পাকিয়ে গলা অবদি উঠে এল। তিনটে মানুষের সংসার। ঝামেলা বলতে সেরকম কিছুই নেই। তবুও মানী কেমন মনমরা হয়ে থাকে কথা বলতে ভুলে যায়। টাইম কলে শাশুড়ীর সাথে জল আনতে গিয়ে মাথাটা ঘুরে গেল। শাশুড়ী তাকে বাড়ী পাঠিয়ে দিলে সে কাঁথা গায়ে আবার শুয়ে পড়ে। চোখ লেগে যায় কখন বুঝতে পারে না।

      "ওঠো ডাক্তার এসেছে".....একটা ঠ্যালাদিয়ে শাশুড়ী তাকে জাগিয়ে দেয়। শ্বশুড়কে বাইরে যেতে বলে সে ডাক্তারকে কিছু কথা বলে। ডাক্তার শাশুড়ীকে ডেকে কয়েকদিন পর একটা প্রেগন্যান্সি টেস্ট করিয়ে নিতে বলে। "মা".... মানী মা হতে চলেছে! প্রথমে তার মাথাটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেল। ভাল মন্দ আনন্দ কোন ফিলিংসই তার হল না। কেমন একটা ঘোর। ঘোরটা কাটলে সে খুব ভয় পেল। একবার পেটে হাত দিয়ে আগতকে অনুভব করার চেষ্টা করল। " মা! আমি মা হয়েছি! " মানীর চোখে জল চলে এল। সে যে নিজেই এখন ছেলেমানুষী থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। তার আবার বাচ্ছা হবে! কী ভাবে মানুষ করবে তাকে! আরও একটা দুশ্চিতা তাকে চেপে ধরল, স্বামীর যথেষ্ঠ রোজগার নেই তাছড়া তার পরীক্ষাও আছে সামনে। কিছুই পড়া হয়নি।সব যেন কেমন গুলিয়ে গেল।

        সর্বোপরি প্রমাণ হল মানী মা হতে চলেছে। ডক্টর চেকাপ করে কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলার ফিরিস্তি দিলেন। জীবনে প্রথম রক্ত পরীক্ষা করতে এসে সূচ দেখে আগেই খানিকটা হাউমাউ করে কেঁদে নিল। শ্বশুড়ের বুকে মুখ গুঁজে কোন রকমে রক্তে দিয়ে সেখান থেকে মারল দৌড়। এতকিছুর পরেও মানী কিন্তু খুব খুশি। কারণ হবু শিশুর বাপ যে বেজায় খুশি। ফোন করে করে সবাই কে বীরদর্পে তার বাবা হওয়ার খবরটা ফলিয়ে বেড়াচ্ছে। এদিকে মানীর উপরও কড়া শাসন। ঘুম খাওয়া ওঠা বসা চলাফেরা সব যেন মানীর হাত থেকে ওরা ছিনিয়ে নিয়েছে। ওরা যেমনটি চায় তেমনটি করতে হয়। একটা ব্যাপারে সে খুব কষ্ট পায়। শুধু বমি! কারণে অকারণে বমি। কিচ্ছু খেতে পারে না। রান্নার গন্ধ নাকে গেলেও সে বমি করে। তাই বলে কোন টক খাবার খাবে আর পাঁচটা গর্ভবতী মায়ের মতো তাও সে খায় না। দিন দিন তার চোখ মুখ ফুলে ওঠে শরীর টান টান হয়। শরীরে রক্ত খুব কম তাই ডাক্তার বেশী করে আয়রণ জাতীয় খাবার খেতে বলেছে।

      গোটা পড়াটা দোল উৎসবে মেতে উঠেছে। মানীর মনটাও কেমন রঙিয়ে গেছে না দেখা কারোর অপেক্ষায়। "হোলি হ্যায়".... একমুঠো আবীর ছড়িয়ে দেয় মানীর মাথায়। কাল বিকালে সনু বাড়ী এসেছে।বিছানায় নিয়ে গিয়ে সারা পেটে চুমুতে ভরিয়ে দেয় সনু।
" মানী আমার কিন্তু মেয়েই চায়। তোমার মত দুষ্টু মিষ্টি ছোট্ট এক মানী চায়।"
স্বামীর বুকে মাথা রেখে সেই অলীক সুখ মানী অনুভব করতে থাকে।
" এ কী হাতে গড়ার জিনিষ গো!  যে যা চাইব তাই হবে! তুমি বরং ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা কর যে আসবে সে যেন সুস্থ সবল হয়, সে ছেলে বা মেয়ে যাই হোক।"
সনু তবুও জোর করতে থাকে না তার পুতুল পুতুল মেয়েই চায়। এই কথায় মানী কেমন যেন ভয় পেয়ে যায়।

      খুব বেশী বমি হতে থাকায় মানী দিন দিন খুব দুর্বল হয়ে পড়ে। চারমাস চলছে এখন। ছোটবোন এসেছে নিতে, কটা দিন বাপের বাড়ীতে কাটিয়ে আসবে। জায়গা বদলে যদি একটু বমিটা কমে এইভেবে।শাশুড়ীর যদিও ইচ্ছে ছিল না পোয়াতি বউ চৈত্রমাসের শেষে বাপের বাড়ী যাক।
কিছুটা বিরক্তির সুরেই বলে " চৈত্রমাসে বাড়ী থেকে কুকুর ছাগলও তাড়ায় না। বউ বাড়ীর লক্ষী সে বছরের শেষে যাবে বাপের বাড়ী!" যদিও ছেলের ভয়ে মুখের সামনে কিছু বলতে পারে না।মানীরও আর এখানে ভাল লাগছিল না। তারও মায়ের জন্য,  ছোট বেলার চেনা পরিবেশটার জন্য বড্ড মন কেমন করছিল। তাই সমস্ত বাধা বিপত্তিকে পাশ কাটিয়ে চৈত্র সংক্রান্তি দিনে চার'শ কিমি জার্নি করে বাপের বাড়ী চলে গেল। গেল ঠিকই কিন্তু মনটা কেমন খুঁত খুঁত করতে লাগল।

      বাবার বাড়ীর পরিবেশে এসে মানী অনেকটা প্রাণ ফিরে পেল। মা যত্ন করে খাওয়ায়। এখানে এসে বমিটাও তার কমে গেছে।সনু মানীকে বাবার বাড়ী ছেড়ে পরের দিন কাজে যোগ দিয়েছে। দিনে পাঁচবার ফোন করে মানীর খোঁজ নেয়। মায়ের সঙ্গে ডাক্তার দেখিয়ে আসে। ছোট বোনের সাথে গল্প্ করে বেড়িয়ে দিন গুলো বেশ কাটতে থাকে। ওদিকে শাশুড়ীও নিশ্চিন্ত হয় বমিটা কম হয়েছে শুনে। গতে যেন জীবনটা বাঁধা পড়ে যায়! ছোট্ট শরীরকে শরীরের ভিতর কল্পনা করে তার কেমন পুলক লাগে। তার ভাল মন্দ চিন্তা করেই মানীর দিন কেটে যায়।এখন অনেক ভাল ভাল বই পড়ে সে। তার ভালবাসার ফসলকে খুব যত্নে রাখে। সনু আর ওর লাভ ম্যারেজ।অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে সে জীবনে সনুকে পেয়েছে।তাই এই দুজনকে সে আঁকড়ে ধরতে চায়।একাকী জীবনে সময় কাটানো সঙ্গী ভাবী সন্তান।
       
          মা সকালে খেতে ডাকে।মানী কেমন যেন একটা ভিজে ভাব অনুভব করল। মাকে আসছি বলে সে সোজা টয়লেটে গেল। ঠিক যা ভেবেছে তাই! তার পা কাঁপতে থাকে। সারা শরীর ঘেমে যায়। হে ভগবান কী করলে তুমি! মানীর ভিতরটা ঢুকরে ওঠে। কাউকে কিছু না বলে সে সোজা রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। সনুকে ফোন করবে কিনা ভাবে। কাঁদতে কাঁদতে কখন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যায়।
" মানী! মানী!".....  দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে মা।
" কি রে না খেয়ে চলে এলি আবার দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছিস কেন? "
এই প্রথম বুক ফেটে মানীর কান্না বেরিয়ে এলো।
" মা আমার ব্লিডিং হচ্ছে মা" কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। প্রথমটা মাও থতমত খেয়ে গেল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে মানীকে বলল............
"দেখ ব্লিডিং হলেই যে নষ্ট হয়ে গেছে তা নয়। অনেক সময় প্রতিমাসে ব্লিডিং হয়েও সুস্থ বাচ্চার জন্ম হয়। তুই খাবি আয়। ভয়ের কিছু নেই। কাল আমরা ডাক্তারের কাছে যাব।"
মায়ের কথায় মানী খানিক আশ্বস্ত হল।খেয়ে এসে সে সনুকে আর শাশুড়ীকে ফোন করল।ওরা নিয়ম করিনি বলে দুকথা শুনিয়ে দিল। কিন্তু নিরাশ করল না।তবুও মানীর মনে কু যায় না।রাতে একটুও ঘুমাতে পারল না। যত বাজে স্বপ্ন গুলো ভির করে আসে।

      চেম্বারে ঢুকতেই ডাক্তার প্রশ্ন করল " কী ব্যাপার তোমার তো এখন আসার কথা না!" সব শুনে ডাক্তার ইউ এস জি করাতে বলল। মানী মন থেকে তখনও শক্ত।সে তার বাচ্চাকে অনুভব করার জন্য বার বার পেটে হাত দিয়ে দেখে। সে নিশ্চিত তার বাচ্চা ভাল আছে। তবুও ডাক্তারের চিন্তিত মুখটা দেখে সে দমে গেল। " আচ্ছা ডাক্তারবাবু ও ভাল আছে তো!" অভয় দিয়ে ডাক্তার তাড়াতারি রিপোর্টটা করাতে বলল।

সোনোগ্রাফি করার সময় মানী বার বার ঘাড় ঘুরিয়ে স্কিনে চোখ রাখার চেষ্টা করে।যদিও এসব মাথামুন্ড সে কিছুই বোঝে না।
" তুমি কী কিছু অনিয়ম করেছিলে?"
বড় বড় চোখ করে মানী জানতে চায় " কেন কী হয়েছে? ও কী আর নেই?"
সোনোগ্রাফিস্ট বলে " না না সে রকম কিছু না।"
মানী অপক্ষায় আছে।মা গেছে রিপোর্ট দেখাতে। সে  এখনও অপেক্ষায় আছে,তার কিচ্চু হয়নি।মনটা বড় দোটানায় ভুগছে।তবুও রিপোর্ট না দেখে সে কিছুতেই হার মানবে না।মা এলে অধীর হয়ে সে জানতে চায় "ডাক্তার কী বলল মা?"
" তুমি যা মনে ভাবছ তাই।"
"আমি যা ভাবচি! " হঠাৎ করে মানীর  ভাবনা গুলো সব এলোমেলো হয়ে যায়।
" ডাক্তার কী বলল বল না মা!" কাঁপা গলায় মানী জানতে চায়।
"নেই। মিসক্যারেজ।"
মানীর কানটা গরম হয়ে ভোঁ ধরে গেল। সে দেখল তার পেট ফাঁকা। সেখানে কিছুই নেই। কুন্ডলীর মতো কিছু একটা তার শরীর থেকে বের হয়ে দূরে বহু দূরে ধোঁয়া ধুলোর সাথে ঊর্দ্ধাকাশে উড়ে চলেছে। চারিদিকটা কেমন অন্ধকার কিচ্ছু দেখা যাচ্চে না। ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল সে।সনু! সনু কোথায়!  তাকে এখন খুব দরকার। প্রচন্ড হাহাকার চিৎকারে বুকে চিড়ে কান্না বেরিয়ে এল। এ যেন বাঁধ ভাঙা বেদনা। কিছুতেই রোখা যায়না। আকাশ বাতাস সব ধূসর হয়ে দৃষ্টি থেকে হারিয়ে গেল। গোটা পৃথিবীটা ঝাপসা হয়ে গেল নিমেষে।
" ফোনটা ধর কথা বল" ধরা গলায় ফোনটা মা এগিয়ে দিল।
" মানী!  তুমি কেঁদো না। তুমি মনকে শান্ত করে শক্ত হও। তুমি ঠিক থাকলে আবার সে ফিরে আসবে। "
মানী একটি কথাও বলল না। সে শুনতে পেল কিনা তাও বোঝা গেল না।
সনুর ভারী গলা ফোনের ওপার থেকে শোনা গেল.....
" মানী তুমি কথা বলচ না কেন? তুমি চুপ থেকো না প্লীজ! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। দেখ যে গেছে তাকে কখনও চোখে দেখিনি তোমাকে তো দেখেছি।তুমি ঠিক থাকলে আমি ভাল থাকব। জানি তুমি তাকে শরীরে অনুভব করেছ তোমার কষ্ট বেশী। তবুও......হ্যালো. ... হ্যালো।!"
মন্ত্র মুগ্ধের মতো মানী সেই চেয়ারে দেওয়ালে মাথাটা হেলান দিয়ে বসে থাকল।ডাক্তার খানার বহু রুগী এসে সান্ত্বনা দিতে লাগল।মানীর কানে কিছুই ঢুকল না একটা মিহি হট্টগোল ছাড়া। সে তার ঝাপসা দৃষ্টিতে কেবলই দেখতে পেল একটা মাংসপিন্ড ঝড়ের গতিতে কুন্ডলী পাকিয়ে আকাশে উড়ে যাচ্ছে।আর চারিদিক অন্ধকার।










রহস্যময় রাত

ক্লাস নাইনের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ।।কিছুদিন এবার বিশ্রামের পালা। তারপর আবার নতুন বই, নতুন ক্লাস----- মজা করা শেষ, গতে বাঁধা জীবন।পরীক্ষার নাম শুনলে কেন জানি না মুনিয়ার খুব ঘুম পায়। পরীক্ষার সাথে তার ঘুমের যেন নিবিড় সম্পর্ক। কিন্তু অবাক ব্যাপার পরীক্ষা যেই শেষ হয়ে যায় অমনি ঘুমও কোথায় উদাও হয়ে যায়।এত একঘেঁয়ে লাগে সারাদিন কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। এতবড় গ্রীষ্মের দুপুর কিছুতেই যেন কাটতে চায় না। লাইব্রেরী থেকে বই এনে পড়ে তাও আবার রাতারাতি শেষ হয়ে যায়। কোথাও কোন আত্মীয় বাড়ী বেড়াতে যাবে তাও তার ভাল লাগে না। এ আচ্ছাই জ্বালা। অচেনা পরিবেশ তার শরীর মনে অস্বস্তির সৃষ্টি করে।কোথাও গেলে দু' একটা দিন ভাল লাগে,তারপরই কেমন কান্না পায়। বাড়ীর জন্য, সঙ্গী সাথীর জন্য মন কেমন করে। তখনকার দিনে টিভি ফোনের এত চল ছিল না।সকাল বিকাল এরওর বাড়ী,মাঠ- ঘাট, আমতলা জামতলা করে কাটত। বাকী সময় কাটানোর জন্য সন্ধ্যাবেলা একটু টিভি আর রাতে শোবার সময় রেডিও মীরচি।
" হ্যাঁ রে পরীক্ষা হয়ে গেছে দু'দিন মামার বাড়ী ঘুরে আয় না!" মুনিয়ার মা তাকে সাধে।
" না না মা তুমি তো জানো সেখানে আমার মন টেকে না। তাছাড়া বড়মামা বড্ড কড়া, সবসময় শাসন আর ভয় দেখানো কাজ। আমার ভাল লাগে না।"
মুনিয়ার মা গজগজ করে বলে---" সারাদিন শুধু টো টো করে রোদে ঘুরে বেড়ানো,কাজকর্ম নেই। আমাকে তো একটু সাহায্য করতে পারিস!"
মুনিয়াও একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে---"ধূর তোমার কাজ তুমি কর আমাকে বলবে না। আমি পারব না। ঘরের কাজ করতে আমার ভাল্লাগে না। আমার পরীক্ষার পড়া কী তুমি করে দাও তাই তোমার কাজ করব?"
মুনিয়ার কথায় মা হাসবে না রাগ করবে খুঁজে পায় না।
" কাল রাতে তোর বাবা বকাবকি করছিল। তুই নাকি পুকুরে স্নানে গিয়ে তিন চার ঘন্টা সাঁতার দিস! পাড়ার লোককে ঠিক করে স্নান করতে দিস না, জল ঘোলা করিস! "
এই একটা বিষয়ে মুনিয়ার খুব আগ্রহ-- জলে সাঁতার দেওয়া। সারাদিন পুকুরে ডুবে থাকলেও ওর আশ মেটে না। বেলা দশটা থেকে দুপুর দুটো পেরিয়ে গেলেও তাকে কেউ জল থেকে তুলতে পারে না। জলে বেশীক্ষণ থাকার লক্ষণ হাত পায়ে দেখা দিলে তা লুকানোর নানা পদ্ধতি অবলম্বন করে,তবুও বাবার  মার থেকে রেহাই পায় না। পায়ে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে,মাথা নীচে করে বেধড়ক মার। তবুও তার ভয় লজ্জা কিছুই নেই। জলে সে যাবেই। পরীক্ষা শেষ মানেই সারাদিন গাছের মগডালে চড়া আর মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়ানো। দুপুরে ঘুমের ভয়ে সে বাড়ী থেকে পালিয়ে বেড়ায়। বাবা খুঁজে এনে জোর করে ঘুম পাড়ায়। যত দুষ্টুমিই করুক আর যত ঘুরে বেড়াক ক্লাসে ফার্স্ট কিন্তু মুনিয়াই হত।

        তখনকার দিনে কেবল বা ডিশ টিভির চল ছিল না। বিশেষ করে গ্রামে দিকে তো নয়ই। মুনিয়াদের বাড়ীতে একটা সাদাকালো টিভি ছিল। সেখানে ডিডি-১ চ্যানেলে শনিবার রাতে হিন্দি আর রবিবার বিকালে বাংলা সিনেমা হত। মুনিয়া শনিবারের অপেক্ষায় থাকত। পরীক্ষা হয়ে গেলে প্রত্যেক শনিবার সে নিয়ম করে সিনেমা দেখত। বাকী সময় কিন্তু সিনেমা দেখার সুযোগ ছিল না। বাবা খুব বকাবকি করত। আর বাবাকে মুনিয়া যমের মতো ভয় পেত। এমনই এক শনিবারে সে ঠিক করল রাতে সিনেমা দেখবে। বাড়ীর সবাই ঘুমিয়ে গেছে এমনকি গোটা পাড়াটা নিস্তব্ধ শুনশান। সব ঘুমিয়ে পড়েছে। অমাবশ্যার রাত, চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। শোবার ঘর থেকে টিভি ঘরের দুরত্ব অনেকখানি। মুনিয়া রাতে বোনের সাথে শোয়।
বোনকে ঠ্যালা দিয়ে বলল--" এই যাবি না সিনেমা দেখতে? "
ঘুমের ঘোরে বোন বলল " তুই যা দিদি। আমি যাব না। তুই দেখে আমাকে বলিস"
"ধুসস" মুনিয়া অসন্তুষ্ট হয়।
অগত্যা কী আর করা যাবে। কিছুটা বিরক্তি আর ভয় নিয়ে একা দেখারই সিদ্ধান্ত নিল। শোবার ঘর থেকে টিভি ঘরে যেতে গেলে অনেকটা বড় উঠোন পেরিয়ে যেতে হয়। টিভির ঘরটা রাস্তা লাগোয়া। অন্ধকার ঘুটঘুটে কিচ্ছু দেখা যায় না। উঠানের একধারে পোষা কুকুরটা শুয়ে ছিল। পায়ের আওয়াজে জেগে গিয়ে মুনিয়াকে একবার শুঁকে নিল। এত অন্ধকার থমথমে পরিবেশে একা মুনিয়ার গা- টা কেমন ছমছম করে উঠল।যদিও সে খুব সাহসী, ভয় ডর তার একটু কমই। তবুও এরকম পরিবেশে এত রাতে তার একটু ভয় ভয়ই লাগছিল। একবার ভাবল থাক, সিনেমা দেখে আর কাজ নেই ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ি। তবুও নেশা! কিছুতেই ছাড়তে পারল না। চোখ বন্ধ করে এক ছুট্টে উঠোন পেরিয়ে টিভির ঘরে গেল।

     সিনেমা চলছে কিন্তু তার মনটা নানা রকম শব্দে উত্তেজিত হয়ে উঠল। মনে হল কে যেন ঘরের বাইরে চলা ফেরা করছে।দু' একবার দরজায় টোকা মারার আওয়াজও কানে এলো। মনের ভুল ভেবে এসব কিছুকে এড়িয়ে গিয়ে সিনেমা দেখতে লাগল। রাত্রি একটা নাগাদ সিনেমা শেষ হল। টিভি বন্ধ করে সে টয়লেটে গেল। টয়লেট থেকে বেরিয়ে যেই না উঠোন পেরোতে যাবে অমনি ভয়ে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল।সারা শরীর ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। মা' কে যে ডাকবে তাও মুখের  রা বন্ধ হয়ে গেল। শুধু চোখ বিস্ফারিত করে দেখতে থাকল উঠোনের মাঝে নানা রঙের আলোর খেলা। আলো এত তীব্র যে মুনিয়ার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর সম্বিত ফিরে এলে সে একবার আকাশ পানে চেয়ে দেখল। না আকাশে কোন বিমান তো উড়ে যাচ্ছে না!! চারপাশটাও চেয়ে দেখল আলোর উৎস কোথায়। না কোথাও কিচ্ছু নেই। হঠাৎ বার দরজায় কে ধাক্কা মারল।
" কে? "
ভয়ার্ত ক্ষীণ স্বরে মুনিয়া জানতে চাইল।কিন্তু কোন উত্তর সে পেল না। বাড়ীর পাশেই রেল লাইন। ছোট থেকে অনেক মানুষকে টেনে কেটে মরতে দেখেছে। মুনিয়ার তখন সেই কাটা মুখ গুলো মনে পড়তে লাগল।ভয়ে তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল।শরীর টলমল করছে, মাথা ঘুরছে, মনে হল এবার মাটিতে পড়েই যাবে। সে সেখানেই স্থির হয়ে মৃতপ্রায় কাঠের মতো দাঁড়িয়ে থাকল কতক্ষন কে জানে! হঠাৎ দেখল উঠানের মাঝে সেই তীব্র আলো নিভে গেছে। চারপাশ চেয়ে দেখল কোথাও কিছু নেই। বাইরে তেঁতুল গাছে বকগুলো " জলহোক,জলহোক" করে ডাকছে। বাঁশতলায় ভ্যামটাও " বাপ, বাপ" করে ডেকে উঠল।মুনিয়া কোনদিকে না তাকিয়ে একদৌড়ে উঠোন পেরিয়ে রুমে ঢুকে সজোরে দরজা বন্ধ করে দিল।আতঙ্কে শোয়ার পর বোনকে চেপে জড়িয়ে ধরল।একবার ভাবল জানালাটা খুলে দেখবে নাকি উঠোনে কী কান্ডটা চলছে! কিন্তু সাহসে কুলালো না। ক'দিন আগে সে স্প্রিং ভূতের কথা শুনেছিল। এই ভূত নাকি শুধু মেয়েদেরই ঘাড় মটকায়। মুনিয়া জোর করে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ঘুম তার এলো না। সকালে মা' কে সব বলতেই মা খুব বকাবকি করল। মুনিয়াও নাক কান মুলে প্রতিজ্ঞা করল সে আর কখনও রাতে টিভি দেখবে না আর এবার থেকে মা যা বলবে সে সব শুনবে।



মানসী মন্ডল

No comments:

Post a Comment