এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

জয়িতা ভট্টাচার্য




মুক্তগদ‍্য




"বিকজ আই লাভ ইউ টু মাচ্"

চৈত্রের গন্গনে রোদে এখনো দাঁড়িয়ে আছে পলাশ গাছটা। রবীন্দ্রসদনের সামনে । ওর দিকে একান্তে চেয়ে থাকলে আজো কেমন গায়ে কাঁটা দেয়। শব্দহীন সংলাপময় দৃশ্য । ফুলে ফুলে রক্তাক্ত হয়ে আছে একা পলাশ । পলাশ গাছ কি নারী !
এই এখন যেমন সূর্য মাথার ওপর স্থির নিজের ছায়াও ক্ষুদ্র আকার , এখনো অঝোর বৃষ্টির কদম ফুলে ভরা গাছটা দেখলে নিরঙ্কুশ আত্মসমর্পণ কোনো নিরাকারের জন্য । বুক ধরফর , গলায় উদ্গত কান্না দলা পাকায় ।সেই সব দিনের মতো । যখন আধুনিক আর আধুনান্তিকের ঝগড়া ছিলোনা ।
যখন চারঘন্টার পরীক্ষা দিয়ে বাইরে এসে আকাশটাকে বলতাম "ওহে শোনো আজ থেকে পৃথিবীটা আমার"।
কলেজ লাইফ ।এক জীবনের 3D।
বি কম অনার্স পড়তে ভর্তি হয়েছিলাম সিটি কলেজ (দক্ষিণ ) প্রভাত বিভাগে ।
কমার্সের জন্য সে সময় সব চেয়ে ভালো কলেজ ছিলো শিবনাথ শাস্ত্রী ।
কলেজের পেছনেই অভিনেতা চিরঞ্জিতের বাড়ি ,মেয়েরা হামলে পরে দেখত তাঁর টুকরো জীবন । আমি একবার দাড়ি কামাতে দেখেছিলুম ।
কলেজ আলো করে সেকেণ্ড ইয়ার ইংলিশ অনার্স অভিনেত্রী ইন্দ্রানী মুখার্জ্জী আসত কখনো সখনো ।
লেসবিয়ান বান্ধবী ছিলো দুই জোড়া ।
ওখান থেকে আমার ছাল ছাড়ানোর শুরু ।
মোটামুটি পরিবারের যাবতীয় নীতিকথার আবরণগুলো ধীরে ধীরে খসে পড়ার শুরু ।
কলেজ গিয়ে শিখলাম বহূ বিন্যাসের যাপন চিত্র ।
আমাদের সময় প্রিন্সিপাল ছিলেন কৃষ্ণা বসু ( নেতাজী পরিবার) । শান্ত সৌম্য ছোটোখাটো মহিলা ।ধীর নিম্ন স্বরে আবশ্যিক ইংরেজি পড়াতেন ।
কমার্স ডিপার্টমেন্টের ডিন মনিলাল দাশ । কোম্পানি ল পড়াতেন সীতারাম বেহানি । এম এল ডি কলেজ গেটে ঢোকামাত্র করিডোর নিমেষে ফাঁকা হয়ে যেত । ছিপছিপে দোহারা মানুষটি ভাবলেশহীন হেঁটে যেতেন মাথা উঁচু করে । হাসতে দেখিনি তাঁকে কখনো । সকলেই যমের মতো ভয় করতাম । অথচ তাঁর জনপ্রিয়তা ছিলো সবচেয়ে বেশি । অন্য কলেজের মেয়েরাও পেছনে বসে ক্লাস করে যেত । এ্যাকাউনট্যান্সি তাঁর বই ই পড়েছি সেই একাদশ থেকে ।
অদ্ভুত দক্ষতায় ক্লাস নিতেন । মন্ত্রমুগ্ধের মত ছাত্রীরা নিশ্চুপ থাকত তাঁর ক্লাসে ।
অনেক বছর পর একবার এ্যাপোলো হাসপাতালে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। বুড়ো হয়েছেন ।নিতান্ত আপন এক অসহায় বৃদ্ধর মতো কী খুশী আমাকে দেখে ।
অনেকটা সময়ই মেয়েরা রাস্তা পেরিয়ে চলে যেত রবীন্দ্র সরোবরে প্রেম করতে । এত ভোরেও তাই তারা দারুণ সুন্দর সেজে আসত । মাড়োয়াড়ি মেয়েরা অতি সংক্ষিপ্ত পোষাকে ফর্সা ত্বক উন্মিলিত করে ঘুরে বেড়াতো ।
মনে হয় সে কারণেই ট্যাক্স পড়াতে এসে ডি কে এস স্যর লিপস্টিকের নানা ব্র্যাণ্ডের গল্প করতেন । তবু শেষ দিকের সারিগুলো খালিই থাকত ।
কলেজ জীবনে আমার ক্রাশ ছিলেন অর্থনীতির লেকচারার কমলেশ মুখার্জ্জী । উস্কো খুস্কো একমাথা নুন মরিচ চুল ,শ্যামবর্ণ চোখ । দেখে মনে হয় যেন এই জগতের বাসিন্দা নয় । তিনি সদ্য বিদেশী ইউনিভার্সিটির শিক্ষকতা ছেড়ে এসেছিলেন । আমাদের ক্লাস নিতে আসতেন মাঝে মধ্যে ।
কখনো পড়ার বাইরে কথা নেই কিন্তু এক অদ্ভুত চুম্বক ছিলো । ক্লাস পরিপূর্ণ হ়য়ে থাকত আমি একদম সামনে বসতাম ওনার ক্লাসে । মনে হয় তার পর থেকেই পরিণত পুরুষের প্রেমে পড়ার প্রবণতার শুরু !
কমলেশ স্যর বিদেশি ইউনিভার্সিটিতে চলে যান পরে ।
কলেজ জীবন টা আমার কাছে দুটো কারণে পানসে ।
প্রথমত সতেরো পার করেই আচমকা আমার বিয়ে হয়ে যায় প্রেম বিহীন , কোনোরূপ মানসিক সম্পর্কহীন এক পরিবারে । সেখানে ফেলে ছড়িয়ে বড়ো হয়ে ওঠা পরিবার থেকে গিয়ে পড়ি নিদারুণ দারিদ্র্যে ।
দ্বিতীয়ত শৈশব পুরোটাই কেটেছে ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে । মেয়েলি কথাবার্তা বেশি সাজ গোজ মা পছন্দ করতেন না ।বাড়িতে ছিলো রাজনৈতিক আবহাওয়া ।ফলে এত মেয়েদের সুবাসে হাঁসফাস করতুম । সে সময়টা রাজনীতি করেছি । আগেই স্মোক করতাম । বাবার পকেট থেকেও পরীক্ষার রাতে সিগারেট চুরি করে খেয়েছি । এখন বাড়ল । রেবাদি বলে একজন ছিলেন । ছা়ত্র পরিষদ করতেন । কলেজেই তাঁর কাজ । তাই তিনি পাশ যেন না করেন বলাই ছিলো । আমাদের কলেজে ঢোকা ও বেরোনোর সময়ও রেবাদি ছিলেন।
কলেজের কমার্স বিভাগে একমাত্র ব্যাচেলর মহসিন স্যর বহূবল্লব ছিলেন । মাস্টার্স করার সময় খবর পেলাম একটি ছাত্রীকে সত্যি সত্যি ভালোবেসে আত্মহত্যা করেছেন ।
বেশি ভালোবাসা ভালো নয় ।
কলেজের বাইরে বাকী সময়টা ভাগ করে নিয়েছিলাম রামকৃষ্ণ মিশন লাইব্রেরী ও আনন্দবাজার পত্রিকার ততকালীন সহকারী সম্পাদক নিরঞ্জন হালদারের কাছে লেখা পত্রে । তিনি এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভারতীয় শাখার সভাপতি ছিলেন ।
রামকৃষ্ণ মিশন লাইব্রেরী তে কত রকম বই পড়েছি ইয়ত্তা নেই । একেক সপ্তাহে একেক বিষয় । আর্কিটেক্চারের ইতিহাস থেকে মনোবিজ্ঞান , পাখি থেকে পুরান ।
ওপরের ধ্যানঘরেও যেতাম ।বিক্ষিপ্ত মনের উপকার হয়েছে । আত্মশক্তিও ফিরে পেয়েছি ওই একটিমাত্র লাল আলোর বিন্দু থেকে ।
দুএকটি ট্যুশন করতে হতো মায়া সেনের কাছে গান শেখার দক্ষিণা ও হাতখরচের জন্য ।
মায়াদির কাছে পল্লবদা(কীর্তনীয়া) শিখত যদিও বড়ো ছিলো আমাদের চেয়ে ও অন্য ব্যাচ ।পরে আবার যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ হয় বাড়ির কাছে চলে আসার পর থেকে ।
পাখি ডানা আবার মেললো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে ।
আমাদের এম কম ক্লাসে চারটি মেয়ে বাকী সব ছেলে ।দুটি মেয়ে তাই আসতনা । আশুতোষ বিল্ডিং এ তিনতলার বাঁদিকের ঘরে ক্লাস হতো ।
ক্লাসে কম বাইরে বেশি ।
রাজনীতি ও লেখালিখি , কফি হাউসে কেটেছে বেশি সময় বা কলেজস্কোয়ারে ।
প্রাথমিক যৌন তৃষ্ণা মিটে গিয়ে ব্যর্থ বিবাহের মানসিক বন্ধন মুক্ত হয়েছি ততদিনে । কলেজ ম্যাগাজিন ও পরবর্তী সব কলেজ ইউনিভার্সিটি পত্রিকায় লিখতাম । তখনও রাজনীতি প্রধান ছিলো । প্রেম জিনিষটা সচেতন ভাবে উপেক্ষা করে চলতাম ।
ইউনিভার্সিটির অলিন্দে অনেক অন্ধকার তখন ও ছিলো ।
মাস্টার্সের পরীক্ষায় দুজন ইনভিজিলেটর সংখ্যালঘুত্বের সংকোচে চলা ফেরা করতেন নিজের মনে প্রায় ধৃতরাষ্ট্র হয়ে।আমাদের একজন প্রফেসরের পুত্র আমাদের ব্যাচমেট ছিলো । প্রতিদিন পরীক্ষার সময বিভিন্ন শিক্ষক এসে তার সব অসুবিধে দূর করে দিয়ে যেতেন কোনো গোপনীয়তা ছিলোনা ।

নাটকের রিহার্শাল চলত। চলত এ্যাকাডেমির সামনের সিঁড়িতে আড্ডা।
একদিন কলেজ স্কোয়ারে বসে প্রেসিডেন্সির একটি ছেলে আমার সদ্য জ্বালানো সিগারেট টি ছুঁড়ে ফেলে বলল এসব ছোটোরা খায় এখন থেকে এটা । শুকনো পাতার এত সুন্দর এফেক্ট সেই প্রথম পেলাম ।
ছাত্র জীবনের মাধুর্য আলাদা । মুক্তির স্বাদ ।
এরপর আরো কিছু ডিগ্রী । সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়াকালীন গানের শো করেছি বেশ কিছু ।
গীটার ,গান , মাঠ আরও কিছু......। ফাদার ফেলিক্সের কথা মনে হলে আজ ও মাথা নত হয় ।
পার্ক স্ট্রীট দুবছরে সেই যে আপন হলো সেই নস্টালজিয়া আজও। কলেজের উল্টোদিকের সুপ্রাচীন বাড়িটার সিঁড়ির নীচে ঘুপচি চায়ের দোকানে কেটে যেত অনেক প্রহর ।
পরবর্তীতে নাটক বা কবি বন্ধুদের সঙ্গে পার্ক স্ট্রীটের অন্য অস্থানগুলোতে বসেছি । আমি সে সময় নানা রকম চাকরী করছি ।
বর্তমান সরকারি শিক্ষকের চাকরীটা পাওয়ার আগে বিচিত্র সব কাজ করতে হয়েছে সে প্রসঙ্গ পরে কখনো ।
         বন্ধুদের স্বমেহনের আলোচনা হত। কয়েকজন ছাত্রী হাত খরচের টাকা তুলত শুয়ে।
আমরা একবার ঠিক করেছিলাম ডি. কে.লোধের চেম্বার খুঁজে বার করতেই হবে । তাঁর ইন্টারভিউ নেওয়ার পরিকল্পনা ছিলো ।
সেই সময় বাংলা শব্দ ভাণ্ডার প্রবল সমৃদ্ধ হয় আমার !
মাঝে মাঝে কলেজ না গিয়ে হাওড়া বা শিয়ালদার ট্রেন ধরে অজানা স্টেশনে নেমে পরতাম রিপোর্টার সেজে । এভাবে অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে দূর গ্রামের আলপথে ......কখনো চাষা ভুষোর ঘরে ।
রঙিন ছিলো দিন । রাত কাটতো পড়াশুনোয় ।      
ছাত্র যারা ছিলো তারা ক,খ,গ,ঘ,......আজ স্ব স্ব ক্ষেত্রে নামী কেউ সতীর্থও এই বৃত্তে ।

রাজনীতির থেকে জেভিয়ার্সে পড়ার সময় থেকেই সরে আসি । পরে সরকারি শিক্ষক হবার পর অনেকদিন নাটক ও লেখালিখি চলতে থাকে ।
এরপর চলে যাই সেচ্ছা নির্বাসনে , দূর দ্বীপবাসিনী হয়ে সঙ্গী শুধু কালো অক্ষর গুলি ও ছাত্র জীবনের স্মৃতি ।

অনেক বছর পর এমনই এক কালবৈশাখির ঝড়ের মাঝে পার্কস্ট্রীটের পথে মুখোমুখি হয়ে যাই জীবনের । সেই জীবন .......আবেগ আর উত্তেজনার জীবন ,অনেক কিছু করে ফেলার অধৈর্য সেই জীবন । চারিদিকে বেজে উঠল গমগম করে (এলভিস প্রিসলে) "বিকজ আই লাভ ইউ টু মাচ্"...  জীবন.............
আবার ফিরলাম লেখাপড়ার জীবনে ।আবার শব্দ যাপনে । নতুন উদ্যমে।
এখন আবার যাই সেই নানা রঙের দিনগুলোতে যখন দ্বারভাঙা বিল্ডিং এ অনুষ্ঠান থাকে,
কলেজস্ট্রীট , কফি হাউস আবার ডেকে নেয় ।
এখন বেশ সাজ গোজ করি । কথা রচনা হয়..........
এখন প্রেমে পড়ি । কোনো পরিণতির পরিকল্পনা ছাড়াই । প্রেমে পড়তে ভালো লাগে ।
সেই সব প্রাচীনতার সুবাস নিয়ে যুবক থেকে বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া কফি হাউসের ওয়েটার , পার্ক স্ট্রীটে পেগে লাল জলে ভাসে ম্যাপ্ ল পাতা, একাডেমিতে পুরোনো অভ্যেসের ধোঁয়ায় চেনা মুখ হাতছানি দেয় । চকিত চুম্বনে জীবন আরক্ত হয় ।
জীবনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়ে লেখাকে মুখ্য করে ।
কলেজ স্ট্রীট গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দুমিনিট দাঁড়াই ।
লিখতে লিখতে আঙুল ব্যাথা............আধো অন্ধকার সিঁড়ি .....এ্যালেন্স পার্কের ঘাস.....গোলপার্ক .........পরীক্ষার নোট্সগুলো বিকেলের ঝড়ে উড়তে থাকে ।


জয়িতা ভট্টাচার্য
শূন্য দশকের শব্দ কর্মী

No comments:

Post a Comment