এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

পদ্মাবতী রায় চৌধুরী



মুক্তগদ‍্য




তুমি আমি মুখোমুখি নীরবতা পালনের গান...শুনে যাই...

পদ্মাবতী রায় চৌধুরী
মন, তুই চড়ুই পাখির বাসা বানানোটা দেখেছিস কখনও ? কোথা কোথা থেকে খুদকুঁড়ো জুটিয়ে আনে...বাঁশের কঞ্চি,ঝাঁটার কাঠি,শুকনো পাতা...আরও কত কি ! তারপর বাসা বাঁধে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে...চড়ুই ! ছেলেটার গলায় কালো দাগ,তাই চেনা যায় ৷ ওরা ভালোবাসে আদর করে...আমরা বুঝি ৷ কি ভাবিস...ওরা আমাদের বোঝে না ! খুব বোঝে ৷ পারিবারিক সব জটিল ব্যাপারে টিঁইইই টিঁইইই শব্দ তাকে করতেই হবে ৷ তারপর মেয়ে চড়ুইটার চলাফেরা একটু শ্লথ...আমরা বুঝি ওর ছানা হবে...সেসব হয় প্রকৃতির নিয়মে ৷ মেয়ে চড়ুইটা দিনের আলো ফুটতেই খাবার খুঁজতে যায় ৷ আর ছেলে চড়ুইটার তখন ডিউটি বাচ্চা সামলানো ৷ নদীমাতৃক সমাজ ওদের বুঝলি !
তা সে প্রথম দু এক ঘন্টা বড় চেষ্টা করে তীব্র বাবা হওয়ার ৷ তারপর বাকি পুরুষের মতই বিরক্ত হয়ে ঘুলঘুলি ছেড়ে টিউবলাইটের মাথায় বসে দম নেয়...আর মাঝেমাঝেই উড়ে গিয়ে বাইরে একছুটে দেখে আসে ...বৌ এলো কিনা ! ঠিক যেমনটি আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে মন থেকে একটা করে তারিখ মুছে ফেলি...আজও তুই এলি না...আর হয়ত দেখা হবে না ৷ তারপর মা আসে,ক্ষুধার্ত শিশুর আকুল লাল ঠোঁটে ঠোঁট রেখে খাবার পুরে দেয় ৷ নিজের ওম ছড়িয়ে দেয় বাচ্চাদের শরীরে ৷ ওরা ঝগড়া করে আমাদের মতই ৷ আবার মিলে গেলে ছেলে চড়ুই মেয়ে চড়ুই এর পিঠে চড়ে বসে ৷ ওটাই আদর ওদের ৷ আর গতদিনগুলিতে আমি যখন ফুরিয়ে যাচ্ছি একটু একটু করে...ওরা ওদের সব কাজ ফেলে ঘুরতে থাকে আমার মাথার উপরে ৷ কথা তো আর বলতে পারে না ৷ ওরা ভালোবাসে আমায়...ভালোবাসা দেখানো যায় না, বোঝা যায় ৷ কাল রাতে যখন মেয়ে চড়াইটা ফ্যানের ব্লেডে গলা কেটে ডানা ঝাপটিয়ে আমার পায়ের উপর এসে পড়লো...মাথার উপর তখন অজস্র সাদা ধূসর ডানাকাটা পালক...ওর গলা গলে রক্ত...চোখে জল...

মন,তুই কখনও ঘুমন্ত কোনও রেলশহরের খোলা ছাদের আবছা অন্ধকারে একলা,ভোর চারটের প্রথম রেলের টাউন কাঁপানো সাইরেন শুনেছিস ? অথবা তোর ভারতের নানা শহরে ঘুরে ঘুরে কাজের সময়...ধর, এমন কোন অনামী স্টেশনে সিগন্যাল না পেয়ে ট্রেন থেমেছিল,যেখানে তা থামার কথা নয় ৷ তুই হয়ত অফিসের ফরমান পেয়ে তড়িঘড়ি চলে এসেছিস...আর আমি অন্যান্য রাতে যে বিরক্তিকর তড়কা রুটি রোজ প্রায় দুবেলা খাস শুনে শুনে আস্তেআস্তে কখন যেন নিজেই কষ্টে ও খাবার খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি...সেদিন হয়ত তাড়াহুড়োয় তোর পেটে সেই সামান্য রুটির দানাটুকুও পড়েনি বুঝে দেড় হাজার কিলোমিটার দূরের কোন নির্ঘুম রাতে পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে একলা বিছানায় শুয়ে আছি ৷ তুই এখন সেই ঘুমঘোর স্টেশনের দিকে চেয়ে আছিস,জানলা গলিয়ে ধোঁয়ার কুয়াশা সরিয়ে মাটির ভাঁড়ে এগিয়ে আসছে ভোরের প্রথম চা...আমি বলছি, খালি পেটে শুধু চা খাস না...তুই হাসছিস আর বলছিস...
খাচ্ছি তো রে ! তুই ঘুমা এবার...রাত শেষ হয়ে গেল...এবার খেয়ে নে কিছু ...
হুঁমমম ! রাত নয় ভোর হয়ে এলো...আমরা দুজনেই যে কিছু খাইনি...দুজনেই জানি...অথচ কেউই কিছু বলিনি কাউকে ৷ কিছু কিছু কথা বুঝে নিতে হয় ৷ রাত কেটে যায় গল্প আর চিন্তায়...সাক্ষী শুধু আমরা দুজন আর দেড় হাজার কিলোমিটারের চাঁদধোয়া আঁকাবাঁকা রেললাইন...

তোর কাজ যেখানে মানুষ বৃষ্টির রাতে বিদ্যুৎগতিতে আকাশ চিরে বাজ পড়তে তো বহুবার দেখেছে, বিজলী বাতি দেখেনি...ভারতের গ্রামে গ্রামে এখনও কুপির আগুন জ্বলন্ত ক্ষুধার মত ক্ষুরধার ৷ মন তুই নাকি সেখানে আকাশছোঁয়া টাওয়ারে উঠে আলোর প্রথম রেখা জুড়তে জুড়তে এগিয়ে চলিস ! ওখানে আগামীতে শিল্প হবে...শিক্ষা হবে...ঝকঝকে বাড়িঘর কত ...কেউ সেই প্রথম বিজলী জ্বালানো মানুষটাকে জানবে না ৷ শুধু মৃত্যুমুখে শুয়ে প্রথম আলো দেখা অচেনা গ্রামের বৃদ্ধার চোখের জল...শিশুদের আলোছড়ানো কিলকারি দেখে তুই হাসিমুখে পাড়ি দিস নতুন কোন অন্ধকার গ্রামে আলোর আগুন জ্বালাতে ৷ তুই কি বুঝিস মন...আমরা একই সাথে শহর গ্রাম পার করে যাই মন থেকে ...দিনের আলোয় প্রচন্ড যান্ত্রিক লোকটাকে রাতের চাঁদের আলোয় আমি মানুষ হয়ে যেতে দেখি একটু একটু করে ৷ তখন সে একমনে কবিতাকে জন্ম দেয়...তার খিদে ঘুম নেই...আমাকে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে পরশু মাঝরাতে বলে গেছে ...আমি তোর মত ডাল ভাত খেয়ে ক্ষুধার্তের কান্না এত সহজে কাঁদতে পারবো না...একথা শুনে আমার চোখে জল আসছে...নীড় তার মনকে মন থেকে আদর করছে...শ্রদ্ধা করছে...

অথচ মন...তুমি তো জানলেই না...চোখে দেখা যায় শহর নগর পার করে তুমি এগিয়ে চলেছো...আসলে আমরা এগিয়ে চলেছি যুগান্তরের আঙ্গুল ধরে...মন, তোমার মনে হয় তুমি দেখ...অথচ আমি জানি আমিও বহুযুগ পার করি তোমার চোখের আলো ধরে ধরে...মন,তুমি ভাবো উদ্দেশ্যহীন তুমি ঘোরতর ঘুরছো একা, কবিতার কষ্টে...অথচ আমি জানি , পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথে একজন উন্মত্ত মানুষ বিস্কুট চুরি করেছিল বলে এক ট্রেন মারমুখী লোক ছুটে গেছিলো...আর আমি তাকে দুহাতে আড়াল করতে করতে অচেনা স্টেশনে নেমে পড়ে তার অস্হির মুঠোয় গুঁজে দিচ্ছিলাম...গরম চা,মুড়িভাজা...আর ওর চোখ দিয়ে মহাকালের উদ্দেশ্যে গড়িয়ে পড়ছিল হাসি...ওই অলীক হাসি দেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলছিলাম আমি...বুকের ভেতরে ঘাই মারছিল প্রথম দুধের মত তীব্র টনটনে ব্যথা...আমার আবার ভয় করছে মন...তোকে হারাবার ভয়...তুই চলে গেলে এই ভয়ই মাঝরাতে আমার শিয়রে বসে হাসবে...আমি আবার একলা হয়ে যাচ্ছি...তুই সরে যাচ্ছিস...আর আমি ঘুমের ওষুধের স্ট্রিপ গুনছি একটা দুটো...দুচোখ জুড়ে নেমে আসছে অসম্ভব ঘুম...নীল...চাপচাপ গাঢ়তর নীল...মাঝে মাঝে কালো বেদনা আর বিশ্বাসগুলো যেখানে কাঁচের গুঁড়োর মত ছড়িয়ে আছে ,ওখানে বিজলীর গোলাপী চলকে চলকে উঠছে...আমি তোকে অন্ধকারে পা বাড়াতে দেখে পিছন থেকে বলছি...সাবধানে এগো মন...বিশ্বাসের কাঁচগুলো বুকের কাঁচুলি থেকে ঝেড়ে ফেলা হয়নি এখনও ...বিশ্বাসের কাঁচে পা কাটিস না যেন ৷

তোমার প্রতিটা ব্যস্ততার অভুক্ত রাতে আমরা ভালোবাসার একঘটি জল ভাগ করে খেয়ে লিখতে শুরু করেছি...তুমি এখানে সেখানে,ট্রেনে,বাসায় অথবা পথে ৷ আমি শূণ্য বিছানায় বুকজলে বালিশটাকে আরও কাছে টেনে নিতে নিতে ...তোমার বুকের জঙ্গলের ওমটাই আমার কলমের কালি...আর আমার বুকের লাবডুবের উত্তাপ কখনই হয়ত তোমার কবিতার শীৎকার হতে পারেনি...জানা হবে না আর কখনও...আমার মুখের হাসির আড়ালে একটা আমি আছে ...তোমার মুখের হাসির আড়ালেও একটা অন্য তুমি আছো ৷ একথা শুধু আমরা জানি ৷ আমার আলোর দায় তো সবাই নিতে পারে ...যে আলোয় আমি কখনও ছিলাম না...ওটা আমার খোলসের কঙ্কাল ৷ ওর আড়ালে লুকিয়ে থাকে আমার আমি ৷ যে আমিকে অন্ধকারের চাঁদ চেনে একমাত্র ...আর চিনিস তুই ! নাহ্...তুই চিনিস না...চিনলেও তোর গভীরতর অস্বীকার বাতাসে ভাসে...আমি চড়ুইয়ের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া বিন্দু বিন্দু জল মুছি আর ওর হাঁ করা ঠোঁটে জল দিই...আমাদের মাঝে এতদিনে দুনিয়া ঢুকে পড়লো...আমি জানি মরা চড়ুইয়ের বর একটু পরেই হয়ত তাকে খুঁজবে,পাবে না...ওর গলা কাঁপছে শেষ নিঃশ্বাসে...আর আমি চড়ুইয়ের আর্ত চোখ থেকে ঝরে পড়া জলে ঈশ্বরের চোখের জল দেখছি ৷ তুই আর এঘরে ফিরবি না হয়ত নতুন বাসা ছেড়ে...এঘর মৃত...

মন ! আমার আলোর দায় তো সবাই নিতে পারে...আমার অন্ধকারের দায় কে নেবে ! মন ! তুই কখনও জানতেও পারলি না...তোর নীড় আড়ালে তোকে "মন" বলে ডাকে ৷ খুঁদকুঁড়ো জমানো বিগত রাতের বৃষ্টিপাতে ব্রেনোলিয়ারা চিরকাল মিথ্যা হয়েই থাকে...


পদ্মাবতী রায় চৌধুরী 

সম্পাদক "সময়...23:59"সাহিত্য পত্রিকা

দীর্ঘ দশবছর ধরে লেখালেখির নানা ফর্মের চাতালে চারাগাছ বোনা আমার নেশা,বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনই চারণক্ষেত্র ৷ ঝুলিতে দেড়খানা স্নাতকোত্তর ডিগ্রীও আছে যদিও ৷ আপনারা আমার লেখা পড়ে মন্তব্য জানালে ভালো লাগবে ৷



No comments:

Post a Comment