এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

পবিত্র চক্রবর্তী


বিভাগ : প্রবন্ধ


বাংলা সাহিত্যের উৎস থেকে খেউর ও পাঠক মনন

প্রথমেই লিখি বিষয়টি লিখতে যাওয়ার পূর্বে বেশ কিছুদিন লাগলো নিজেকে পরিমার্জিত করতে । কারণ প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সাহিত্যে একবিংশ শতকের পাঠক মহল – এ এক দীর্ঘ পথ তথা আলোচনা । স্মার্ট ফোনের যুগে বিষয়টি মধ্য যুগীয় হলেও তাৎপর্য অনেকখানি । যাইহোক অত্যাধিক গৌড়চন্দ্রিকা করে প্রবন্ধটির অবয়ব তথা পাঠকবর্গের হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করার অভিপ্রায় আমার নেই । কতটা সারল্য ধরে রাখতে পেরেছ তা নির্ভর করবে একান্তই যারা একটু ধৈর্যশীল । তবে এটা সঠিক আপাত নীরসতার আড় ভাঙার কারনে আলোচ্য প্রবন্ধটিকে কিছু পর্বে ভাগ করলাম ।
মহাকাব্যিক যাত্রা

রামায়ণ রচনার সময়কাল নিয়ে যতই মতভেদ থাক, একটি যুক্তি সর্বজনগ্রাহ্য যে রামায়ণ এক যুগসন্ধিক্ষণের কাব্য ।  যে যুগসন্ধিতে বৈদিক আচার ও অনাচারের গভীর প্রভাব, আর্য অভ্যুত্থান ও ভারত-মননের উপলব্ধি । ভারতীয় আর্যরা যখন অনার্য আদিবাসীদের সঙ্গে লড়াইয়ে রাজ্যবিস্তারে ব্যস্ত, ভীতিশূন্য, দিগন্তবিচারী, বিজয়ী বীর জাতি । সেই জাতীয় চরিত্রের ফল রামায়ণ । কাব্য, নাটক, গদ্য, পদ্য ইত্যাদি কাব্যরচনার যে ক’টি ধারা প্রাচীন ভারতে প্রচলিত ছিল, তার প্রত্যেকটির মধ্যেই রামায়ণ নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েছে ।
তারপর ভারতবর্ষের অনার্য শত্রু ক্রমে বিজিত । ভারতবর্ষ আর্যদের আয়ত্ত, ভোগ্য এবং মহা সমৃদ্ধিশালী। তখন আর্য বাহ্য শত্রুর ভয় থেকে নিশ্চিন্ত  ।  আর্য্কুল আভ্যন্তরিক সমৃদ্ধি সম্পাদনে সচেষ্ট । দেশের ধনবৃদ্ধি শ্রীবৃদ্ধি ও সভ্যতাবৃদ্ধি । রোমক থেকে যবদ্বীপ ও চৈনিক পর্য্যন্ত ভারতবর্ষের বাণিজ্য বিস্তার লাভ করেছে । প্রতি নদীকূলে এক একটি অপরূপ মহানগরী । তখন আর্য পৌরুষ চরমে, অন্য শত্রুর অভাবে সেই পৌরুষ নতুন প্রশ্নের মুখে, হস্তগত ঐশ্বর্যশালী এই সুন্দর দেশটি কার ভোগ্য হয়ে থাকবে ? শুরু হল আভ্যন্তরিক বিবাদ । আর্য রাজাদের নিজেদের মধ্যে একের পর এক যুদ্ধ, রক্তক্ষয় । এই সময়ের সাহিত্য মহাভারত ।
অবশেষে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ধর্মের জয় । কুরুক্ষেত্র একটি রূপক । ধর্ম নামের এক শৃঙ্খল প্রযোজন হয়েছিল দুর্দম রক্তস্পৃহা থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করার জন্য । সুখ শান্তি এসেছিল বৈকি । এই সুখ ও তৃপ্তির ফসল ভক্তিশাস্ত্র ও দর্শনশাস্ত্র । যদিও কাব্য বা গীতিকাব্যে এই দুই শাস্ত্রের তেমন প্রকাশ হয় নি । কিন্তু ধর্মচেতনায় আচ্ছন্ন হতে বেশি সময় লাগে নি সমাজের। এমনকি মানুষের স্বাভাবিক বোধ ও বিচারশক্তি ধর্ম নামক মোহে লুপ্তপ্রায় । সাহিত্যও ধর্ম-রজ্জুতে বদ্ধ। ধর্মানুসারী সাহিত্য । এই প্রবল ধর্ম-স্রোতের ফল বিভিন্ন পুরাণ । 
আর একই সঙ্গে বিলাসিতা ও ভোগের যে বিপুল অসংযম, তার ফসল কাব্য, নাটক, নাটিকা ।
বৈষ্ণবীয় ভাবনার উদ্ভব 
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে , বাংলা সাহিত্যে রামায়ন-মহাভারতের পর বৈষ্ণবীয় চেতনা বিপুল ভাবে প্রভাব ফেলেছিল । কিন্তু তাঁর আগে “ বৈষ্ণব ” শব্দ তথা তার দর্শন আমাদের কিঞ্চিৎ জানা দরকার । সোজা কথায় বিষ্ণুর উপাসক হলেন বৈষ্ণব । বৈষ্ণব একটি ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে আবির্ভূত হয় একটি বিশেষ সামাজিক বাস্তবতায়, শাস্ত্রীয় ধর্মের সীমাবদ্ধতা ও ক্ষেত্রবিশেষে বাড়াবাড়ির প্রতিক্রিয়ায় । সংস্কারমুক্ত মানুষের এক হবার বাসনা থেকেই প্রতিবাদী ধর্ম-আন্দোলন হিসেবে বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তনা । পৌরাণিক বা শাস্ত্রীয় বৈষ্ণব-আন্দোলন থেকে ক্রমে চৈতন্য প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব এবং আরো পরে সহজিয়া বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের উদ্ভব । 
গবেষকদের মতে,বৈষ্ণব ধর্মমত আরো প্রাচীন । বৈদিক কর্মকাণ্ডের বিপরীতে যেসব অহিংস মত ছিল, বৈষ্ণবমত তাদের মধ্যে প্রধান । ‘History of Sanskrit literature’ বইয়ে Weber লিখছেন যে এই অহিংসমতের দলকে তখন ‘ভাগবতের দল’ বলা হত । চতুর্থ শতাব্দীর গুপ্তরাজারা বৈষ্ণব ছিলেন । শ্রীমদ্ভাগবত, হরিবংশ এমন অনেক কৃষ্ণ-বিষয়ক বই সংস্কৃত ভাষায় অনেক আগে থেকেই পাওয়া যায় । শ্রীমদ্ভাগবতে রাধা নেই, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে রাধা ‘হ্লাদিনী শক্তি’। 
বাংলায় রাধা-কৃষ্ণ প্রণয় বিষয়ে প্রথম লেখা জয়দেবের । এই জয়দেবই সংস্কৃত ভাষায় দশ অবতার স্তোত্র লেখেন । জয়দেবের কৃষ্ণ গুপ্তযুগের কৃষ্ণের চেয়ে আলাদা নন । তিনি কেশী মুর ইত্যাদি দৈত্য-নাশক, একজন যোদ্ধা। জয়দেবের কাব্যে নিবৃত্তির কথা নেই, ভোগই আসল। তাঁর কৃষ্ণ যোদ্ধা, ধনুর্ধর, এবং প্রেমিক  আর জয়দেবের রাধা শ্রীকৃষ্ণের প্রণয়িণী, তিনি সাধিকা সন্ন্যাসিনী নন ।
কেন আজও পদাবলী এত জীবন্ত ও সমকালীন ?
‘পদাবলী’ শব্দটি সংস্কৃত ‘পদাবরিক’ (অর্থাত্ পদাবরণ, পদাভরণ, নূপুর) শব্দের প্রাকৃত রূপান্তর ‘পআঅরিঅ’ শব্দের পরিবর্তিত রূপ । শব্দটির প্রথম প্রয়োগ হয় জয়দেবের গীতগোবিন্দে । 
‘পদাবলী’ বলতে যদিও সম্যক বৈষ্ণব-কবিতা বোঝায়, ‘পদ’ বলতে কিন্তু একটি বৈষ্ণব-কবিতাকেই বোঝায় না । সংস্কৃত সাহিত্যে ‘পদ’ শব্দের অর্থ পদ্যের ছত্র । সেসময় পদ্য ছিল দু’ছত্রের শ্লোক । ‘পদ’ শব্দের অন্য অর্থটি সবার জানা, দুই পা । সেই প্রেক্ষিতে সংস্কৃতে দুই ছত্রের শ্লোক বা পদ্যের নাম হয়েছিল ‘পদ’, গবেষকরা এমনটি মনে করেন । পুরোনো বৈষ্ণব-সাহিত্যেও তাই ‘পদ’ অর্থে দু’ছত্রের গান, কিংবা গানের দুটি ছত্র বোঝানো হয় ।
যে ভাষায় আমরা কথা বলি, যে ভাষার মাধ্যমে যোগাযোগ করি এবং তাতেই ভাষিক সম্ভাবনা সম্পূর্ণ বলে মান্য করি, আমরা প্রায়শ: অনুধাবনই করি না, ভাষার অন্তরালে হয়ত অনাবিস্কৃত পড়ে আছে আদি ভাষার অবয়ব । পদাবলী সম্পর্কে আলোচনা করতে বসে এই কথাটি বারবার মনে হয়েছে ।
বৈষ্ণব পদাবলী এই বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বের রসভাষ্য । ‘কৃষ্ণভজনে নাই জাতিকুলাদি বিচার’..  জাতিভেদে বিভক্ত মানুষকে মনুষ্যত্বের উদারলোকে আহ্বান করেছিল এই নতুন ধর্ম । মানবকেন্দ্রিকতা এই ধর্মের অনন্য গুণ । তাই পদাবলীতে বৈষ্ণবীয়তার আড়ালে মানুষ এবং মানুষের প্রতি মানুষের প্রেমের ছবি বারবার । মধ্যযুগের ধর্মসম্পৃক্ত মানস কাঠামোর মধ্যে এমন মানব-মাহাত্ম্যের প্রকাশ সত্যিই বিস্ময়কর ।
যদিও ধর্মীয় তত্ত্বকথা হিসেবে বৈষ্ণব পদাবলীর যত না আবেদন, মধুর এক সাহিত্যরস বহনকারী গীতিকবিতা হিসেবে পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি । গান হলেও সাধারণ গানের মতো আকারে ছোট ও নির্দিষ্ট বাঁধনে নয়, পদাবলীর গানগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ সুষম ছন্দের ভাবময় কবিতা। সংস্কৃত প্রকীর্ণ কবিতার সঙ্গে পদাবলীর বেশ মিল। পদের প্রথম ছত্রে অল্প কিছু অক্ষর, দ্বিতীয় পদ হল ধুয়া, এবং কবির স্বাক্ষর থাকবে শেষ পদে । নিজের নাম-স্বাক্ষর, যেমন ‘ভণই বিদ্যাপতি শুন বরনারী’। এমনটি না করে অনেকে গুরুর নামও স্বাক্ষর করতেন। যেমন রূপগোস্বামী তাঁর পদাবলীতে গুরু সনাতন গোস্বামীর নাম রাখতেন । স্বাক্ষরহীন বহু পদাবলীও আছে, যেগুলোকে ‘ধুয়া পদ’ বলা হয়ে থাকে ।
বাংলায় পদাবলীর জন্ম
বাংলায় বৈষ্ণব পদাবলীর জন্ম জয়দেবের গীতগোবিন্দ থেকে । এমনও বলা হয় যে, গীতগোবিন্দ লক্ষণসেনের রাজসভায় অভিনীত হয়েছিল । গীতগোবিন্দের অনুসরণে চোদ্দ-পনেরো শতকে মিথিলা ও বাংলায় যে পদাবলী রচনা হয়, তা রাজ-আনুকূল্যে । মিথিলায় উমাপতি ও বিদ্যাপতি রাজসভার কবি ছিলেন । গীতগোবিন্দের অনুসরণে চোদ্দ-পনেরো শতকে মিথিলা ও বাংলায় যে পদাবলী রচনা হয়, তা রাজ-আনুকূল্যে । মিথিলায় উমাপতি ও বিদ্যাপতি রাজসভার কবি ছিলেন । ত্রিপুরায় ‘রাজপণ্ডিত’ যশোরাজ খান, ‘বিদ্যাপতি’ কবিশেখর দুজনেই রাজসভার কবি । গীতগোবিন্দের গান শুধু মিথিলা বা বাংলায় নয়, আসাম, গুজরাট, পাঞ্জাব, রাজস্থানেও প্রচলিত হয়েছিল । রাজসভায় শ্রীকৃষ্ণের নামগান বহু পুরোনো রীতি ।
বৈষ্ণব পদাবলীর বিষয় তিনটি : কৃষ্ণলীলা, প্রার্থনা, চৈতন্যলীলা । চৈতন্যের আবির্ভাবের আগে পর্যন্ত কৃষ্ণ-উপাসনা ছিল প্রধানত বালগোপালের উপাসনা ।  শ্রীচৈতন্যের গুরু মাধবেন্দ্র-পুরী বালগোপালের উপাসক ছিলেন । মাধবেন্দ্র-পুরীর প্রধান শিষ্য ঈশ্বর-পুরী চৈতন্যদেবকে দশাক্ষর গোপাল-মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন । চৈতন্যের আধ্যাত্মিক জীবনের শুরু এখান থেকেই ।
বালগোপালের আরাধনা হলেও বৈষ্ণব-পদাবলীতে বাত্সল্য রস তেমন পাওয়া যায় নি তখন । ভক্তিরসই ছিল প্রধান । বাত্সল্য রস এল ষোড়শ’ শতকে, যখন চৈতন্যের সাধনসঙ্গীরা মহাপ্রভুর শিশুজীবনের ছবি বৈষ্ণব-পদাবলীতে নিয়ে এলেন ।
মহাপ্রভুর প্রভাব-বৈষ্ণব ধর্মের প্রসার
চৈতন্যযুগের সময় পর্যন্ত ঠিক কিভাবে বাংলাদেশে হিন্দুধর্ম বিবর্তিত, সে সম্পর্কে ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক তথ্য অনেক ক্ষেত্রেই পরস্পর বিরোধী । তুর্কি-মুসলমান আক্রমণের পর চতুর্দশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ’ শতাব্দী পর্যন্ত ধর্ম-আন্দোলন সারা ভারতেই । ‘শ্রী’ সম্প্রদায়ের রামানন্দ উত্তর-ভারতে নিয়ে এলেন । এই ধর্ম-আন্দোলন উত্তর-ভারতে‘সন্ত-আন্দোলন’ নামে খ্যাত । এই বিপুল ধর্ম-আন্দোলনের ফল হয়েছিল অভূতপূর্ব এক সমাজ-সংস্কার । বাংলায় চৈতন্যদেবের নব্য-আন্দোলন এই ভারতব্যাপী স্পন্দনের প্রকাশ । চৈতন্যদেব একজন যুগ-প্রবর্তক সমাজ-সংস্কারক ।
ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছেন,
“যে দেশে বৌদ্ধধর্মের এত নিবিড় প্রভাব ছিল, সে দেশ হইতে বৌদ্ধধর্ম লুপ্ত হইল কিভাবে ? মোটের ওপর বাংলার বিশাল হিন্দু ও মুসলমান মণ্ডলী এই বৌদ্ধগণকে গ্রাস করিয়া লইয়াছে । মুসলমানগণের মধ্যে যাহাদিগকে বেদাতী ফকির বা নেড়া ফকির বলা হয়, তাহাদের মধ্যে অনেকটা সহজসিদ্ধির ভাব দেখা যায় । আমার মনে হয়, সত্যপীর নিরঞ্জনের এবং মানিক পীর গোরক্ষনাথেরই প্রকারভেদ ।”
প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, নাথপন্থীরা উত্তরভারতে এইভাবেই মুসলমান সমাজে প্রবেশ করেছে । এরা নিজেদের ‘জুগী’ বা যোগী বলে পরিচয় দেয়, পেশা বস্ত্র-বয়ন । এরাই মুসলমান হয়ে “ জোলাহা” বা “জুগী-জোলা” । একইভাবে ‘কাণ-ফট্টা যোগী’ সমাজে শিশু জন্ম নিলে গোরক্ষপুরে গোরক্ষনাথের মন্দিরে নিয়ে মন্ত্র দেওয়া হয় । উত্তরভারতে হিন্দু রাজাদের রাজত্ব তখন শেষ, রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এই ধর্ম-বদলের কারণ । বাংলায় চৈতন্যদেবের সময় এইভাবেই বৌদ্ধধর্ম লুপ্ত । প্রাচীন নাথ-সম্প্রদায় এবং বর্তমান যোগী-সম্প্রদায় এখন গৌড়ীয় বৈষ্ণব । মুষ্টিমেয় কিছু শাক্ত হিন্দু , বাকিরা সবাই বৈষ্ণব । হিন্দু সমাজের ধর্মে এই বিশাল পরিবর্তন এইভাবেই অন্য ধর্মমত গুলোকে নির্জীব করেছে, বৈষ্ণব অন্য ধর্মকে গ্রাস করেছে যে কোনো  ধর্ম-আন্দোলনের মতই ।
চৈতন্যের জন্মসময়ের পারিপার্শ্বিক অবস্থা একটু আলোচনা করি । বাংলায় তখন মুসলমান শাসন । চৈতন্যের জন্মের আগেই রাজা গণেশ ও তারপর তাঁর পুত্র যদু গৌড়ের সিংহাসনে আসীন হয়েছেন । ঐতিহাসিকদের মতে, যদু মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার শুরু করেন । দলে দলে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা গৌড় ছেড়ে চলে যেতে থাকেন । 
“আচম্বিতে নবদ্বীপ হইল রাজভয়
ব্রাহ্মণ ধরিঞা রাজা জাতিপ্রাণ লয় ।” (চৈতন্যমঙ্গল : জয়ানন্দ)
অন্তত দু’টি বৈষ্ণবগ্রন্থে এই ঘটনার উল্লেখ আছে । সম্ভবত হোসেন শাহ-র আগে হাবশী বাদশাহদের সময়কার কথা ।
এই রাজনীতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে নবদ্বীপে বৈদিক-ব্রাহ্মণ বংশে চৈতন্যের জন্ম । তাঁর জন্মের ঠিক আগেই নবদ্বীপের হিন্দু মনীষীরা বাঙলাকে তুর্কি-মুসলমানের হাত থেকে পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনাও করেছিলেন । এইসময়ের একজন খ্যাতনামা মানুষ অদ্বৈতাচার্যের উল্লেখ ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’ ও ‘গৌড়ের ইতিহাস’ বইতে পাওয়া যায় ।
শ্রীচৈতন্যের জীবনীতে বেশ কিছু সমাজতাত্ত্বিক সংবাদ পাওয়া যায় । যেমন, অল্প বয়সেই চৈতন্য টোল খুলে অধ্যাপনা শুরু করেন । সেসময় টোলে কায়স্থ বা অন্যজাতির ছাত্র পড়ত না তবে বৈদ্য ছাত্র ছিল । ব্রাহ্মণ-শিশু জন্ম গ্রহণ করার এক মাস পর তার নিষ্ক্রমণ-সংস্কার পালন হত । শিশু বা বালকের অসুস্থতার সময় ‘ষষ্ঠীর খেলা’ বলে তাকে নিমগাছের ওপর রেখে দেওয়া হত । এইসব কুসংস্কার এখন আর নেই ।
দিগ্বিজয়ী কেশব কাশ্মীরীর নবদ্বীপে পরাজয় বা মাধবপুরীর শিষ্য শ্রীরঙ্গপুরীর নবদ্বীপে জগন্নাথ মিশরের বাড়িতে নিমন্ত্রণ ইত্যাদি থেকে বোঝা যায় ভারতে পণ্ডিতদের মধ্যে যোগাযোগ ও ভাব-বিনিময় ছিল । সেসময় ছেলেরাও মাথায় লম্বা চুল রাখত । চৈতন্যের সন্ন্যাস-গ্রহণের সময় কাটোয়ায় লম্বা চুল কাটা হয়েছিল । মেগাস্থিনিসের ভারত-ভ্রমণেও এ তথ্য পাওয়া যায়। এইসময় বাঙ্গালীদের ‘গৌড়ীয়া’ বলা হত । চৈতন্যদেবের শিষ্যদের মধ্যে মুসলমান শিষ্যও ছিল । বৈষ্ণব সাহিত্য থেকে মনে হয়, তখন ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সঙ্গে বৌদ্ধদের বার্তালাপ বা সম্পর্ক ছিল না ।  
  ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্ম থেকে যে এক পৃথক সম্প্রদায় গঠন করেছিলেন, তার প্রমাণ হল ‘হরিভক্তিবিলাস’ নামের একটি বিধি-পুস্তক । চৈতন্যের প্রধান দুই অনুচর গোপাল ভট্ট ও সনাতন গোস্বামী বৈষ্ণব-সমাজ পরিচালনের এই বই রচনা করেছিলেন ।
এমন বহু সমাজতাত্ত্বিক খবর বৈষ্ণব-সাহিত্যে । আমাদের আলোচনা যেহেতু পদাবলী-ভিত্তিক, তাই বিশদ বিবরণ থাক । পদাবলী নিয়েই আরো দু’চারটি কথা। সখ্য-রস, রাধা-কৃষ্ণের অনুরাগ, অভিসার, মিলন, বিরহ চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দীর অবহটঠ ভাষায় লেখা প্রাচীন পদাবলীর সময় থেকেই আছে। বাংলায় বৈষ্ণব-পদাবলীর দুই ভাষা । একটি বাংলা, অন্যটি ব্রজবুলি।একটি বাংলা, অন্যটি ব্রজবুলি । একটি মিশ্র ভাষা, মিথিলার প্রাচীন কবিদের ভাষা ।
চর্যাপদে পদাবলীর স্পর্শ
চর্যাপদের সময় থেকেই প্রাচীন বঙ্গভূমির যে সমাজচিত্র পাওয়া যায়, আদিবাসী ও বাঙালি সমাজের অসাধারণ সম্পর্ক, তাতেও এই বাংলা পদাবলীর ছন্দের চরিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। গবেষকদের মতে, বাংলা ছন্দের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছে সাঁওতাল মুণ্ডাদের syllabic metre বা দলবৃত্তরীতির উপর, যা হল কিনা বাংলার মাটির ছন্দ বা ছড়ার ছন্দ । এই ছড়ার ছন্দের অন্য নাম হল ‘ধামালী’। চণ্ডীদাসের পদাবলী এই ধামালী ছন্দে রচিত । বাংলা সাহিত্যের এক আদিকবি বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা-কৃষ্ণ আদিবাসী সমাজের চরিত্র থেকেই আঁকা। যদিও কৃষ্ণলীলার সুর চর্যাপদের পদাবলীতে পাওয়া যায় না ।
আশ্চর্য হবার কারণ এই যে, কৃষ্ণের কংস-বধ, বিষ্ণুর বীরলীলা, কৃষ্ণের গোবর্ধন পাহাড় উত্তোলন, পুতনা-বধ ইত্যাদি বিষ্ণুপুরাণ ও হরিবংশে আগে থেকেই ছিল । ঋগ্বেদে বিষ্ণুর রাখালগিরির উল্লেখ আছে । নারদের সহযোগিতায় মহাদেব রাধা-বিরহ গাইছেন, আর বিষ্ণু এবং সমস্ত দেবতাকুল তার শ্রোতা, পুরাণে এমন ইঙ্গিত আছে । কিন্তু রাধা-কৃষ্ণ প্রণয়ের স্বীকৃতি গুপ্তযুগের আগেকার সাহিত্যে পাওয়া যায় না । কালিদাসের রঘুবংশের ষষ্ঠ সর্গে বৃন্দাবন ও গোবর্ধনের যে উল্লেখ, তা থেকেই ব্রজধাম-লীলার লৌকিক ঐতিহ্য প্রমাণ হয় । কালিদাসের মেঘদূতেও কিশোর বিষ্ণুর নাম আছে । কিন্তু বৈষ্ণব-পদাবলীর প্রধান বিষয়, রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা, তার প্রকাশ ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দীতে ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অনেক গবেষকই মনে করেন, কৃত্তিবাস রচিত রামায়ণে দস্যু রত্নাকরের যে মানসজগতে বিপ্লব তার সঙ্গে চৈতন্যদেবের ভক্তি-আন্দোলনের যোগ রয়েছে । সে যা-ই হোক, রতিবিলাস থেকে উচ্চ একটি আধ্যাত্মিক স্তরে রাধা-কৃষ্ণ লীলার যে উত্তরণ প্রক্রিয়া, সেটি সম্পূর্ণ হয়েছিল চৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবের পরে । জয়দেব বিদ্যাপতি চণ্ডীদাসের পদাবলী-গান শুনতে ভালবাসতেন চৈতন্যদেব। তাঁর ঈশ্বর-প্রিয় মন স্বভাবতই বিরহ-ব্যাকুলতায় রাধা-বিরহকে নতুন প্রাণ দিয়েছিল । চৈতন্যের সহচর অনুচর অনেকেই নতুন করে পদাবলী রচনা শুরু করেছিলেন । এ পদাবলীর ভাষা আরো জীবন্ত, প্রাণের পরশে উষ্ণ, বিশ্বাসের অনুভূতিতে মরমীয়া ।
রূপগোস্বামী, প্রথম জীবনে সুলতান হোসেন শাহ’র দবীর-খাশ ছিলেন এবং চৈতন্যের নির্দেশে সংসার ত্যাগ করে ব্রজবাসী, সংস্কৃত সাহিত্যের কাব্যের আধারে পদাবলী রচনা করলেন, রাধাকৃষ্ণের লীলার তত্ত্ব সহযোগে । এই থেকেই ভারতে গৌড়ীয় ধর্মের এক সর্বজনগ্রাহ্য রূপ । এইসময় থেকে বৈষ্ণব কবিরা রূপগোস্বামীর মত করেই ভক্তিরস-আশ্রিত পদাবলী রচনা করতে শুরু করেন। এর ফল হল দু’রকম । 
এক) যাঁরা এই রীতি মেনে পদাবলী রচনা করতে চাইলেন না, তাঁদের রচনা তেমন প্রচার পেল না । ছোট ছোট গ্রামীণ গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেল ।
দুই) পদাবলীতে যে স্বাধীন স্বত:স্ফুর্ত একটি আনন্দের ভাব ছিল, সে অবকাশ রইল না ।
পদাবলী বা পালা কীর্তন
ষোড়শ’ শতাব্দীর শেষদিকে নরোত্তম দাসের হাত ধরে পদাবলী-কীর্তনের বৈঠকী রূপটি শুরু । কৃষ্ণলীলা-কাহিনীতে বালগোপাল-লীলা, গোচারন, অনুরাগ, অভিসার, জলকেলি, রাস, মিলন, বিরহ, মানভঞ্জন এমন নানা ঘটনার গীতবদ্ধ পালাগান রীতি শুরু হল । প্রতি পালার গান শুরুর আগে বিষয় অনুসারে চৈতন্য-বন্দনা আর নিত্যানন্দ-বন্দনা রীতিও এইসময় শুরু । এই আবাহন গানটির নামই গৌরচন্দ্রিকা; চৈতন্যের গার্হস্থ্য-নাম গৌর বা গৌরাঙ্গ থেকে এই নামকরণ । বাঙালির বৈষ্ণবভাব-আশ্রয় ছাড়াও কীর্তনগান তার নিজের রস-মাধুর্যেই একটা স্থায়ী জায়গা করে নিল । বৈষ্ণব ধর্মের উত্সবে ও শ্রাদ্ধ ইত্যাদি অনুষ্ঠানে পদাবলী কীর্তনের রীতি একটা সামাজিক ব্যবস্থা ।
পদাবলীতে সমাজ চিত্র
যে কোনো কবিতার একটা মূল ব্যাপার হল,  সমকালীন জীবনের, দেশ ও কালের, রাজনীতি ও সমাজের প্রতিধ্বনি । জয়দেব পরবর্তী সময়ের কথায় আসা যাক—চণ্ডীদাস । সম্ভবত চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকে জন্ম । এইসময় বাংলায় হিন্দুরা বিজিত জাতি, সামান্য প্রলোভনে স্বধর্ম ত্যাগ করে মুসলমানের ধর্ম গ্রহণ করছে । অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদ সমাজের মূল বিষয় । চণ্ডীদাস ও রজকিনী রামীর প্রেমকথা অমর হয়ে আছে এই কারণেই । চণ্ডীদাসের বিখ্যাত পদাবলী, ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল...’
কোনো কোনো গবেষক মনে করেন, এ যেমন একদিকে বিরহের গাথা তেমনই এক ভগ্নহৃদয় সামাজিক মানুষের আক্ষেপ । রাধাকে রাঙা-বসন যোগিনী সাজিয়েছেন চণ্ডীদাস । 
‘বিরতি আহারে, রাঙা বাস পরে
যেমন যোগিনী পারা..।’
‘দশাবতার’ কাব্যে চণ্ডীদাসের সুর জয়দেবের তুলনায় অনেক নরম । বিজিত বাঙালি যে শাসকের অধীনে, শাসকের মনোমত কাব্য রচনা করতেই হবে । চণ্ডীদাসের ‘কৃষ্ণকীর্তন’ কবিতা সুরুচির পরিচয়ও দেয় না । ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থে শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন বলছেন, “রাজসভায় যে ভাববিকার আরম্ভ হয়, সমাজের নিচের স্তরে তাহা যখন আসিয়া পৌঁছয়, তাহা অতি বিকট হয় ।‘এইসময়ের গীতিকাব্যগুলো তাহার প্রমাণ ।”
গৌড়ের বাদশাহের আদেশে হাতীর পিঠে বেঁধে জর্জর প্রহরে চণ্ডীদাসের মৃত্যু । বড় নিষ্ঠুর হত্যা । একজন কবির এই করুণ পরিণতি একটি সমাজ-ব্যবস্থাকেই প্রকট করে ।

এই সময়েরই মিথিলাবাসী কবি বিদ্যাপতি । বিদ্যাপতির কবিতায় কিন্তু হাহাকার বা কান্নার ভাব নেই ।
“হরি কি মথুরাপুর গেল... কৈন ধাবই মাথুর মুখে..
বিদ্যাপতি কহ নীত, অব রোদন নহে সমুচিত ।”
তাঁর রাধা বরং বেশ আগ্রাসী নায়িকা । বিদ্যাপতির রাধা
“গেলি কামিনী গজহুগামিনী বিহসি পালটি চায়..”
কিংবা রাধার রূপবর্ণনা প্রসঙ্গে
“তুহারী ভয়ে সব দূরে পলায়ল…।”
কিন্তু এই বিদ্যাপতিরই একটি পদ এইরকম –
“এখন তখন করি দিবস গোঞাইনু
দিবস দিবস করি মাসা..।”
একজন হতাশ প্রেমিকের মর্মবেদনা, নাকি পরাধীন মানসিকতার চাপ ? বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কমলকান্তের দপ্তর’ মনে করি, ‘দিন গুনিতে গুনিতে মাস.. কিন্তু আমার মা কই?’
এই পদাবলিতে যেমন হতাশ-প্রেমিকের আক্ষেপ পাওয়া যায়, তেমনি দেশপ্রেমিকেরও আক্ষেপ.. বিদ্যাপতি পঞ্চগৌড়াধিপ শিবসিংহ ভূপের পারিষদ ছিলেন এবং এই রাজাকে তিনি ‘দিগ্বিজয়ী মহারাজাধিরাজ’ বলে অভিহিত করেছেন । কিন্তু এই রাজা শেষে দিল্লির বাদশাহের নিকট পরাজিত হইয়া বন্দী অবস্থায় সেখানে নীত হন । এইসময় থেকে তাঁর গীত বন্ধ হয়েছিল । বিদ্যাপতি হয় সামন্ত অথবা এক অর্ধ-স্বাধীন রাজার পারিষদ ছিলেন এবং এই রাজার শোচনীয় পরিণাম দেখে অনুমান হয় যে, পরাধীনতার ছাপ থেকে তিনিও বিমুক্ত ছিলেন না ।
বাংলায় চণ্ডীদাসের পর বড় বৈষ্ণব কবি জ্ঞানদাসের একটি পদ এইরকম : 
“দিবস দিবস করি মাস বারিখ গেল
বরিখে বরিখে কত ভেল ।”
ষোড়শ’ শতাব্দীর শেষভাগের বাংলার এই কবি নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর দ্বিতীয় স্ত্রী জাহ্নবী দেবীর মন্ত্রশিষ্য ছিলেন । জ্ঞানদাস যখন পদাবলী লিখতে শুরু করেন, তখন বাংলায় নবীন বৈষ্ণব ধর্মের পূর্ণ জোয়ার। এই সময়ের পদাবলীর কৃষ্ণ দশ-অবতারের কৃষ্ণ নয় । এই কৃষ্ণ “কোটি ইন্দু যিনি বরন মনোহর.. অধরে মুরলী রসাল ।
চণ্ডীদাসের সময় থেকে প্রেম ও বিরহের এই স্রোত জ্ঞানদাসেও প্রবাহিত ।
এরপর এলেন গোবিন্দদাস । ইনি চৈতন্যের অনুচর ছিলেন। কৃষ্ণ-বন্দনা গাইছেন “ জয় শচীনন্দন ত্রিভুবন বন্দন ” এবং তাঁর কৃষ্ণ “ চিকনকালা গলায় মালা, বাজয় নূপুর পায়..।”
তাঁর পদাবলী মূলত গৌরলীলা বিষয়ক । চৈতন্য প্রতিষ্ঠিত এই নতুন ধর্মে তাঁর তিরোভাবের পরই শ্রীকৃষ্ণের জায়গায় তাঁকে বসানো হয় । শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলার অনুকরণেই তাঁর ‘গৌরাঙ্গ ভক্তি পদাবলী ।‘
আমরা জানি, বিপ্লব প্রথমে চিন্তাক্ষেত্রে হয়, তারপরে তার ব্যবহারিক প্রতিফলন । চৈতন্য-ধর্ম-আন্দোলনেও তাই । সনাতনবাদীদের গোঁড়ামি ভেঙে, আপামর বাঙালিকে নতুন মত ও পথে জড়িয়ে নিলেন যে মহাজীবন, পদাবলীতে তার অনেক নজির ।
“ চণ্ডালে ব্রাহ্মণে করে কোলাকুলি
কবে বা ছিল এ রঙ্গ..।”
কিংবা ,
“ আচণ্ডালে দিল প্রেম আলিঙ্গন
জাতিবিচার তার না ছিল কখন..”।
চৈতন্যদেবকে নিয়ে লিখিত কাব্য
মধ্য-মধ্যযুগ  এ সময়  চৈতন্যদেব বঙ্গদেশে এক নবভক্তি-ধারার প্রবর্তন করেন, যা ভাবচৈতন্যের ক্ষেত্রে রেনেসাঁর সূচনা করে । তাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের কারণে বাংলায় একটি শক্তিশালী সাহিত্যিকগোষ্ঠী এবং এক বিরাট সাহিত্যধারার সৃষ্টি হয় । এ যুগেই বাংলায় জীবনচরিত লেখার প্রচলন হয় এবং প্রধানত চৈতন্যদেবের জীবনকে কেন্দ্র করে জীবনীগ্রন্থগুলি রচিত হয় । এ ধরনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো: 
বৃন্দাবনদাসের চৈতন্যভাগবত (১৫৭৩),
 জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল (১৬শ শতকের শেষভাগ),
 লোচনদাসের (১৫২৩-১৫৮৯) 
চৈতন্যমঙ্গল 
এবং 
কৃষ্ণদাস কবিরাজের  চৈতন্যচরিতামৃত (১৬১৫)।
 এগুলি ছাড়া আরও কিছু উল্লেখ করার মতো চৈতন্য-সংশ্লিষ্ট জীবনীকাব্য হচ্ছে – 
নরহরি চক্রবর্তীর ভক্তিরত্নাকর (চৈতন্যদেবের পার্ষদ-ভক্তদের জীবনী), 
নিত্যানন্দ দাসের প্রেমবিলাস (শ্রীনিবাস, নরোত্তম ও শ্যামানন্দের জীবনী এবং তাঁদের ধর্মমত প্রচারের কথা) 
 ঈশান নাগরের অদ্বৈতপ্রকাশ (১৫৬৮-৬৯) । 
এগুলির মধ্যে চৈতন্যচরিতামৃতকে চৈতন্যদেবের সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনীগ্রন্থ মনে করা হয় । পান্ডিত্যপূর্ণ এ গ্রন্থে একাধারে জীবনচরিত, দার্শনিক তত্ত্ব ও ভক্তিতত্ত্ব চমৎকারভাবে বিবৃত হয়েছে । জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল বেশকিছু ঐতিহাসিক তথ্যসমৃদ্ধ ।
মঙ্গলকাব্যের অণু-কথা 
মধ্যযুগ আদি-মধ্যযুগ সাধারণভাবে খ্রিস্টীয় ১৩শ-১৪শ শতক পর্যন্ত কাল বাংলা সাহিত্যের আদি-মধ্যযুগ বা চৈতন্যপূর্ব যুগ বলে চিহ্নিত । এ সময়ের বাংলা সাহিত্য তিনটি প্রধান ধারায় বিকশিত হয়েছে -  বৈষ্ণব সাহিত্য, মঙ্গল সাহিত্য এবং অনুবাদ সাহিত্য ।  অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেম, "বাংলা দেশের নানা অঞ্চলে বহু মনসামঙ্গল কাব্য পাওয়া গিয়েছে, তন্মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের কাব্যগুলি ‘মনসামঙ্গল’ ও পূর্ববঙ্গে প্রায়শই ‘পদ্মাপুরাণ’ নামে পরিচিত।"
মালাধর বসু সংস্কৃত শ্রীমদ্ভাগবত অবলম্বনে পয়ার ছন্দে কৃষ্ণলীলা বিষয়ক উপাখ্যান  শ্রীকৃষ্ণবিজয় রচনা করেন ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দের দিকে । এই কাব্যের জন্য গৌড়েশ্বর তাঁকে ‘গুণরাজ খাঁ’ উপাধিতে ভূষিত করেন । এটি ‘মঙ্গল’ বা ‘বিজয়’ জাতীয়  পাঁচালি বা আখ্যানকাব্য হিসেবে পরিচিত; তাই এর অন্য নাম গোবিন্দমঙ্গল  বা গোবিন্দবিজয় । এই পাঁচালিকাব্য বাংলার অনুবাদ শাখারও একটি প্রাচীনতম নিদর্শন বলে অনেকে মনে করেন ।
মঙ্গলকাব্য বাংলার নিজস্ব উপাদানে রচিত লৌকিক দেবমাহাত্ম্যমূলক কাহিনীকাব্য । পাঁচালি কিংবা পালার আকারে চৈতন্যপূর্ব যুগেই এগুলি রচিত হয় । এগুলির নাম কেন  মঙ্গলকাব্য হয়েছে সে সম্পর্কে মতভেদ আছে । এর পালা এক মঙ্গলবারে শুরু হয়ে আরেক মঙ্গলবারে শেষ হতো বলে কেউ কেউ একে মঙ্গলকাব্য বলেছেন । নামকরণের ক্ষেত্রে এরূপ একটি কারণকে বিবেচনা করা হলেও মূলত কাব্যগাথার মাধ্যমে দেবদেবীর মাহাত্ম্য প্রচার এবং তা শ্রবণে ধর্মীয় বিনোদনের সঙ্গে মঙ্গল কামনাই বাঙালি হিন্দু কবিকে মঙ্গলকাব্য রচনায় উৎসাহিত করে । প্রাকৃতিক প্রতিকূলতায় পূর্ণ বঙ্গদেশে তাই অবশ্যম্ভাবিরূপে এসেছে পুরাণের দেবদেবীরা এবং ভক্তমনের কল্পনাপ্রবাহে অসংখ্য মানব ও অতিমানব; আর চরিত্রগুলিও হয়ে উঠেছে শাশ্বত বাংলার প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া সংগ্রামী মানুষের প্রতীক । 
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ নিম্নলিখিত ১৬ প্রকারের মঙ্গলকাব্য চিহ্নিত করেছেন । মনসা মঙ্গল, চণ্ডী মঙ্গল, ধর্ম মঙ্গল, কালিকা মঙ্গল, বাসুলী মঙ্গল, শীতলা মঙ্গল, ষষ্ঠী মঙ্গল, সারদা মঙ্গল, সূর্য মঙ্গল, রায় মঙ্গল, বরদা মঙ্গল, গোসানী মঙ্গল, লক্ষ্মী মঙ্গল, গঙ্গা মঙ্গল, কপিলা মঙ্গল ও পীর মঙ্গল । এসব মঙ্গলকাব্য প্রধানত ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী সময়কালে রচিত হয় । তবে পঞ্চদশ শতকের শেষদিকে ও ষোড়শ শতকে বেশি মঙ্গলকাব্য রচিত হয় । এই কাব্যগুলি থেকে বাংলাদেশের তৎকালীন ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজ, কৃষি, বাণিজ্য, অর্থনীতি প্রভৃতি সম্বন্ধে অনেক তথ্য জানা যায় ।
মনসামঙ্গল
মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন  মনসামঙ্গল, তন্মধ্যে বিজয়গুপ্তের পদ্মাপুরাণ (১৪৯৪) সর্বাধিক জনপ্রিয় । মনসামঙ্গল এক সময় পূর্ববঙ্গের জাতীয় কাব্যের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল। মঙ্গলকাব্যের ইতিহাসে চন্ডীমঙ্গল কাব্যধারা উৎকর্ষের জন্য বিখ্যাত । 
চন্ডীমঙ্গল
 মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (১৬শ শতক) রচিত চন্ডীমঙ্গল সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত; এর জন্য রাজা রঘুনাথ রায় তাঁকে ‘কবিকঙ্কণ’ উপাধিতে ভূষিত করেন । 
ধর্মমঙ্গল, শিবমঙ্গল
অন্যান্য মঙ্গলকাব্য হচ্ছে ধর্মমঙ্গল, শিবমঙ্গল ইত্যাদি এবং এগুলির প্রধান রচয়িতারা ছিলেন ১৮শ শতকের । ধর্মমঙ্গলের আদি কবি ময়ূরভট্ট; তাঁর পরবর্তী প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন খেলারাম চক্রবর্তী, যাঁর কাব্যের নাম গৌড়কাব্য; কিন্তু এঁদের কাব্যের  পুথি পাওয়া যায়নি; একমাত্র রূপরাম চক্রবর্তীর কাব্যই পাওয়া গেছে, যার রচনাকাল ১৬৪৯-৫৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বলে ধরা হয় । রূপরাম বাস্তব দৃষ্টিতে মানব-জীবন বর্ণনা করেছেন ।
                 কৃষিভিত্তিক সমাজজীবনে বৈদিক দেবতা রুদ্র শিবের রূপ ধারণ করে; শিব বাঙালি হিন্দুর জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাই বাঙালির সুখ-দুঃখ ভরা সংসারের কথা স্থান পেয়েছে শিবমঙ্গলে। এ ধারার প্রথম কাব্য দ্বিজ রতিদেবের মৃগলুব্ধ (১৬৭৪) পাওয়া গেছে চট্টগ্রামের পটিয়ায় । শিবায়নের শ্রেষ্ঠ কাহিনীর রচয়িতা রামেশ্বর চক্রবর্তী (১৭১০-১১) । 
শীতলামঙ্গল ও ষষ্ঠীমঙ্গল
এগুলি ছাড়া শীতলামঙ্গল (কৃষ্ণরাম দাস) ও ষষ্ঠীমঙ্গল নামে দুটি মঙ্গলকাব্যের কথাও জানা যায় । ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণরায়ের কথা নিয়ে রচিত শেষোক্ত কাব্যটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । এ কাব্যে সমাজধর্মের সমন্বয় প্রয়াসে নিম্নশ্রেণীর হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সহাবস্থানের কথা আছে । ফলে দক্ষিণরায়ের সঙ্গে মুসলমান পীর বড় খাঁ গাজীর পূজাও এতে স্থান পেয়েছে ।
শাক্তপদাবলীর বিকাশ
খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে শ্যামাসঙ্গীতের ধারাটি বিকাশলাভ করে খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে । এই সময় বঙ্গদেশে বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে এক রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটকালে বৈষ্ণব ধর্মানুশীলনের পরিবর্তে শাক্তদর্শন ও শক্তিপূজা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। তার কারণ দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়ার সতীরুপের শক্তিপীঠগুলির অনেকগুলিই বঙ্গদেশে । সেই শক্তিপীঠগুলিকে কেন্দ্র করে প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে এসেছে শক্তিসাধনা । তারই ফলস্রুতিতে উদ্ভূত হয় শাক্তসাহিত্য । শ্যামাসঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ কবি রামপ্রসাদ সেন এবং শাক্তপদাবলির জগতে তাঁর পরেই স্থান কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের । এই দুই দিকপাল শ্যামাসংগীতকার ছাড়াও অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট পদকর্তা এই ধারায় সংগীতরচনা করে শাক্তসাহিত্য ও সর্বোপরি শাক্তসাধনাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য – কৃষ্ণচন্দ্র রায়, শম্ভুচন্দ্র রায়, নরচন্দ্র রায়, হরুঠাকুর অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, রামনিধি গুপ্ত (নিধুবাবু), কালী মির্জা, দাশরথি রায় (দাশুরায়) প্রমুখ । অনেক মুসলমান কবিও শ্যামাসঙ্গীতের ধারায় নিজ নিজ কৃতিত্ব স্থাপন করে গেছেন । বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ শ্যামাসংগীতকার হলেন কাজী নজরুল ইসলাম । অন্যদিকে এই শতাব্দীর জনপ্রিয় শ্যামাসঙ্গীত গায়কদের অন্যতম হলেন পান্নালাল ভট্টাচার্য, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, রামকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।কোন দেব-দেবীর নাম, গুণাবলী বা কীর্তিকাহিনী সম্বন্ধিত গান । প্রখ্যাত সংস্কৃত পন্ডিত জয়দেব রচিত গীতগবিন্দম, কীর্তেন গানের প্রকৃত উৎস । এছাড়াও বাড়ু চন্ডিদাস, শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, বিদ্যাপতি প্রভৃতি কবিগন প্রচুর কীর্তন গান রচনা করেন । ১৫০০ শতকে শ্রীচৈতন্য ভক্তি সংগিতের এই ধারার প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। তার গান নারী, পুরুষ, শিক্ষিত, অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকলের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে । তিনি বিশ্বাস করতেন ভগবানের উপসনার জন্য গান ধর্মগ্রন্থ পাঠের চেয়ে সহজতর মাধ্যম ।
নানা ভাষা থেকে অনুদিত কাব্য
এ যুগেই রামায়ণ,  মহাভারত, ভাগবত প্রভৃতি অনুবাদকাব্যের রচনা শুরু হয়। এ ব্যাপারে মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । এ সময় বাংলা সাহিত্যের বিকাশে সুলতান আলাউদ্দীন হুসেন শাহ, তাঁর পুত্র নসরৎ শাহ (১৫১৯-৩২) এবং সেনাপতি পরাগল খাঁর উৎসাহ ও অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয় ।  ব্রজবুলি ভাষায় বাঙালিদের পদ-রচনার শুরুও এ সময়েই। এ সময়  কবি কঙ্ক সত্যপীরের মহিমা প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলায় সর্বপ্রথম  বিদ্যাসুন্দর কাহিনী রচনা করেন (আনু. ১৫০২) । চৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩) আবির্ভাবও এ সময় । তিনি স্বপ্রতিষ্ঠিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবমত বাংলা ভাষায় প্রচার করলে বাংলা সাহিত্যের নতুন দিক উন্মোচিত হয় এবং বৈষ্ণব সাহিত্যেরও ভিত্তি স্থাপিত হয় ।
অনুবাদ সাহিত্য এ ক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য  রামায়ণ রচয়িতা  কৃত্তিবাস ওঝা । বড়ু চন্ডীদাসের পরে তিনিই বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবি। তাঁর রচিত রামায়ণ বাংলা ভাষায় প্রথম ও সর্বাধিক জনপ্রিয়  কাব্য । বর্ণনার হূদয়গ্রাহিতা এবং ভাষার প্রাঞ্জলতাই এর জনপ্রিয়তার কারণ । কৃত্তিবাস ১৫শ শতকের গোড়ার দিকে জীবিত ছিলেন। তাঁর কাব্যে মধ্যযুগের বাঙালি-জীবন প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে । ১৮০২-৩ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটি  শ্রীরামপুর মিশন থেকে মুদ্রিত হয় । মুদ্রণের সঙ্গে সঙ্গে তা সমগ্র বঙ্গদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে । কৃত্তিবাসের পরে আরও অনেকে রামায়ণ রচনা করেছেন । সতেরো শতকে ময়মনসিংহের মনসামঙ্গলের  কবি দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা চন্দ্রাবতীর রামায়ণগাথা সে অঞ্চলে প্রচলিত ছিল । উত্তরবঙ্গের অদ্ভুত আচার্য রামায়ণ  গায়ক হিসেবে খ্যাত ছিলেন । নোয়াখালীর দ্বিজ ভবানী দাসের শ্রীরামপাঁচালি কাব্য অধ্যাত্ম্যরামায়ণ  অবলম্বনে রচিত ।

মহাভারতের প্রথম বাংলা অনুবাদ হচ্ছে কবীন্দ্র মহাভারত । ১৫১৫-১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে  কবীন্দ্র পরমেশ্বর এটি রচনা করেন । লস্কর পরাগল খাঁর নির্দেশে রচিত বলে এটি পরাগলী মহাভারত নামেও পরিচিত । কবীন্দ্র মহাভারতে  অশ্বমেধপর্ব সংক্ষিপ্ত ছিল বলে ছুটি খাঁর নির্দেশে শ্রীকর নন্দী জৈমিনিসংহিতার অশ্বমেধপর্ব অবলম্বনে বিস্তৃত আকারে সেটি রচনা করেন, যাকে পৃথক গ্রন্থ না বলে বরং কবীন্দ্র মহাভারতের পরিশিষ্ট বলা চলে। বাংলা মহাভারতের প্রধান কবি  কাশীরাম দাস আনুমানিক ১৬০২-১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তাঁর কাব্য রচনা করেন । শ্রীরামপুর প্রেস থেকে ১৮০১-৩ খ্রিস্টাব্দে কাব্যটি মুদ্রিত হয়। সকল বাংলা মহাভারতের  মধ্যে এটি সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে ।


বাইবেল-কুরআনের ইউসুফ নবীর সংক্ষিপ্ত কাহিনী যা ফেরদৌস ও জামীর ইউসুফ-জুলেখায় পল্লবিত, তিনি তা বাংলায় যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তাতে তা একটি মৌলিক কাব্যের মর্যাদা পেয়েছে। জৈনুদ্দীন একটিমাত্র কাব্য  রসুলবিজয় রচনা করে খ্যাতি লাভ করেন । তিনি গৌড় সুলতান ইউসুফ শাহের (১৪৭৪-৮১) সভাকবি ছিলেন । এর গল্পাংশ  ফারসি থেকে নেওয়া । ‘বিজয়’ জাতীয় যে কাব্যধারা মধ্যযুগে প্রাধান্য লাভ করে তদনুসারেই এর নামের সঙ্গে ‘বিজয়’ শব্দটি যুক্ত হয়। কাহিনীতে কিছু ঐতিহাসিক নামের উল্লেখ থাকলেও ঘটনা ঐতিহাসিক নয় । মুজাম্মিল ১৫শ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে বর্তমান ছিলেন । তিনি প্রধানত তিনটি কাব্যের জন্য খ্যাতি অর্জন করেন: নীতিশাস্ত্রবার্তা, সায়াৎনামা ও খঞ্জনচরিত । আরবির অনুবাদ সায়াৎনামায় সুফিবাদ স্থান পেয়েছে এবং অনুবাদে স্বাচ্ছন্দ্যের কারণে কাব্যটি আকর্ষণীয় হয়েছে । তাঁর নীতিশাস্ত্রবার্তায় বহু বিষয় লিপিবদ্ধ হয়েছে। চাঁদ কাজী ছিলেন গৌড় সুলতান হুসেন শাহের (১৪৯৩-১৫১৯) নবদ্বীপের কাজী । তিনি এ পদে থাকাকালেই নবদ্বীপে গৌড়ীয় বৈষ্ণবমতের প্রচার ও প্রসার ঘটে এবং তিনি নানা কারণে বৈষ্ণব-ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি কোনো কাব্য রচনা করেননি, তবে বৈষ্ণব পদ রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন । শেখ কবীরও ছিলেন একজন খ্যাতিমান পদকর্তা । তিনি সুলতান নাসিরুদ্দীন নসরৎ শাহের সময়ে আবির্ভূত হন এবং সম্ভবত তাঁর রাজকর্মচারী ছিলেন । আফজাল আলী এযুগের কবিদের অন্যতম । নসিহৎনামা  নামে একটি কাব্য এবং বৈষ্ণবীয় ঢঙে রচিত তাঁর কয়েকটি পদ পাওয়া গেছে (সম্ভবত ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দের দিকে রচিত) । এ গ্রন্থে কবিত্ব তেমন নেই, তবে সরল ভাষায় ধর্মোপদেশ আছে । সাবিরিদ খান বেশ কয়েকটি গ্রন্থের রচয়িতা বলে মনে করা হলেও কোনোটিরই সম্পূর্ণ অংশ পাওয়া যায়নি । বিদ্যাসুন্দর, রসুলবিজয় এবং হানিফা ও কয়রাপরী নামে তাঁর তিনটি কাব্যের খন্ডিত পুথি পাওয়া গেছে । দোনাগাজীর বিখ্যাত কাব্য সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল।  তিনি সম্ভবত ১৬শ শতকের মধ্যভাগে আবির্ভূত হন । তাঁর ভাষা সাধারণ এবং প্রাকৃত-প্রভাব ও সারল্যের মিশ্রণে প্রাচীনত্বের দ্যোতক ।
অন্ত্য-মধ্যযুগ  এ সময়টা নানা দিক থেকে বাংলার অবক্ষয় যুগ এবং রাজনৈতিক দিক থেকে নবাবি আমল হিসেবে চিহ্নিত । এ সময় মুগল সাম্রাজ্যের অবক্ষয়, বাংলার নবাবদের উত্থান-পতন, ইউরোপীয় বেনিয়া শক্তির আগ্রাসন এবং কোম্পানি আমলের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে সাহিত্য সৃষ্টির স্বাভাবিক ধারা ব্যাহত হয় । ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশী যুদ্ধের পর থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সাহিত্য ক্ষেত্রে নবাবি আমলেরই জের চলতে থাকে। এ যুগেও তাই হিন্দু পৌরাণিক ও ইসলামি ভাবসমৃদ্ধ পদাবলি, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ ইত্যাদি সাহিত্যের ধারা অব্যাহত থাকে ।
পাঁচালি কাব্য
পাঁচালি কাব্য  বিদ্যাসুন্দরের পাঁচালি বিদ্যাসুন্দর কাব্য অনেকটা রূপক বা আধ্যাত্মিক ভাবধারায় রচিত । বিদ্যাসুন্দর কাহিনীর উৎস কাশ্মীরী পন্ডিত বিহ্লনের (১২শ শতক) চৌরপঞ্চাশৎ বলে অনুমান করা হয় । এতে দেহ ভোগের প্রাবাল্য দেখা যায় । বাংলায় ষোলো শতকে দ্বিজ শ্রীধর ও কবি কঙ্ক এবং সতেরো শতকে গোবিন্দদাস, কৃষ্ণরাম দাস, প্রাণরাম চক্রবর্তী ও সাবিরিদ খান এ কাহিনী রচনা করেন । কাহিনীটি পরে ‘পালা’ হিসেবে কালিকামঙ্গলে যুক্ত হয় ।
লোকগাথা
লোকগাথা আঠারো শতকের অন্যতম সাহিত্যধারা । এর প্রধান বিষয় প্রণয় কাহিনী । অধিকাংশ লোকগাথাই ছিল অলিখিত, লোকমুখে প্রচলিত; ফলে সেগুলির ভাব, ভাষা ও উপমায় প্রক্ষেপণ ঘটেছে উনিশ শতক পর্যন্ত গাথাগুলির প্রায় সবটিতেই নারীর ভূমিকা প্রধান । এ ধারার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো  মৈমনসিংহ-গীতিকা ও  পূর্ববঙ্গ-গীতিকা । গীতিকাগুলির কালনির্ণয় দুরূহ । প্রথমটি দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯) ও দ্বিতীয়টি চন্দ্রকুমার দে ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করে প্রকাশ করেন । এগুলিতে পল্লীর লোকজীবন চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে ।
পাঁচালি, যাত্রা,  তরজা, কবিগান এবং খেউর ও ইত্যাদি...
অবক্ষয়িত সমাজ-মানসের বিস্রস্ত রুচির প্রকাশ ঘটে পাঁচালি, যাত্রা,  তরজা, কবিগান ইত্যাদিতে । বাংলায় পাঁচালি গানের প্রচলন ছিল বহু আগে থেকেই । যাত্রার উদ্ভব হয় দেবদেবীদের বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে এবং কৃষ্ণলীলা ছিল এর মূল বিষয়; পরে অবশ্য বিদ্যাসুন্দর কাহিনীও এর সঙ্গে যুক্ত হয় । তরজার প্রচলন হয় চৈতন্যদেবের সময় থেকে এবং অবক্ষয়কালে তা হয়ে যায় উত্তর-প্রত্যুত্তর ঢঙের ছড়াগান। এ থেকে আবার আসে  কবিগান, যা দুটি পক্ষের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়। এরই চরম রূপ হচ্ছে খেড় বা খেউড় ।
                    যুগ-পরবির্তন সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গে  জারি গান, সারি গান ইত্যাদি লোকগীতির ধারা সচল থাকে; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে নাগরিক সংস্কৃতির প্রভাবে পাঁচালি-কীর্তন ঢঙ বদলে  আখড়াই ও পরে হাফ-আখড়াইতে পরিণত হয় । এই বিস্রস্ত ধারার মধ্য দিয়েই চলে আসে যুগান্তর ।
কীর্তন সংগীত ও এর ধারা
চৈতন্যের মৃত্যুর পর লীলা কীর্তনের  পাঁচটি ধারার সৃষ্টির হয় । এই ধরার গুলোর নাম করন করা হয় তাদের উৎপত্তি স্থান অথবা কবিদের নাম অনুসারে । 
১) গাদানহাটি (১৬০০ শতকে নরোত্তম দাস গাদানহাটি ধারাটির সূচনা করেন। তিনি ছিলেন রাজশাহী জেলার গাদানহাটি পরগনার বাসিন্দা ।)
২) মনোহর্ষী (বীরভুম জেলার জানানদাস মনোহর মনোহর্ষী ধারাটির প্রবোক্তা ।)
৩ ) রেনেটি (বর্ধমানের বিপ্রদাস ঘোষ সূচনা করেন রেনেটি ধারার ।)
৪) মান্দারনি (মান্দারান সরকার প্রচলন করেন মান্দারনি কীর্তনের ।)
 এবং
৫) ঝাড়খান্ডি (ঝাড়খন্ডি কীর্তনের উদ্ভব হয় ঝাড়খন্ড জেলায় ।)
কোলকাতা শহরের পত্তনের আগে, কীর্তন ছিল সম্পূর্ণ রূপে গ্রামীন সংস্কৃতির অংশ । ১৮০০ শতকের গোড়ার দিকে কোলকাতার পত্তনের পর পাঁচালী ও কীর্তন শহুরে সংস্কৃতির অংশ হয়ে পরে । ১৯৪৭ সালের পূর্বে হিন্দু মুসলিম উভয়েই কীর্তন সংগিত শুনত । কাজী নজরুল ইসলাম বেশ কিছু কীর্তন সংগীত রচনা করেছেন ।
শেষের পথে আলোচনা
আলোচনার শেষ পর্যায়ে শেষ কিছু আলোচনা করে ইতি টানবো । উনিশ শতক হচ্ছে বাঙালির নবজাগরণের যুগ । এ সময় বাঙালি-প্রতিভার সর্বতোমুখী বিকাশ ঘটে এবং জাতি হিসেবে বাঙালির অভ্যুদয়ের সর্ববিধ প্রচেষ্টারও সূত্রপাত ঘটে । এ যুগেই একটি শক্তিশালী সাহিত্যেরও সৃষ্টি হয়। এ সময়ের বাংলা সাহিত্যের প্রধান কয়েকটি বিশেষত্ব হচ্ছে: -
ক. শক্তিশালী গদ্য-সাহিত্যের সৃষ্টি ও তার অসাধারণ বিকাশ; 
খ. উনিশ শতকের প্রথম পঞ্চাশ বছরের গদ্য-সাহিত্যে সংস্কৃত পন্ডিতদের প্রভাব;
 গ. বিশ্বসাহিত্য ও বিশ্বের আধুনিক চিন্তাধারার সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের নিবিড় সংযোগ; 
ঘ. জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক সাহিত্য সৃষ্টি; 
ঙ. সাময়িক সাহিত্য সৃষ্টি; 
চ. মান-বাংলা হিসেবে চলিত ভাষার সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ ও পরবর্তী ধারায় এর ক্রমবর্ধিষ্ণু প্রভাব; 
ছ. কাব্য-সাহিত্যের অসামান্য উন্নতি;
 জ. সর্বদেশীয়, সর্বকালীয় ও সর্বজাতীয় সার্বভৌম সাহিত্য সৃষ্টির আদর্শ 
এবং
 ঝ. জাতীয় জীবনে সাহিত্যের প্রভাব সর্বাধিক অনুভূত হওয়া এবং সাহিত্যই যে জাতীয় চরিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানদন্ড এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া।
পাঠক ও সাহিত্যিক-কবি রবীন্দ্রনাথের রচনায় বৈষ্ণব ভাব
“ হইয়াও হইল না শেষ ” , শেষের পথে লেখার আঁচড় কাটতে গিয়েও কাঁটা হল না ইতির আঁচড় । কেননা , রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়েী ধরণের রচনা কী সত্যি অন্তিম লগ্নে উপনিত হতে পারে ? উপরের যে সকল বিসয় নিয়ে , আন্দোলন নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল তার বর্তমানে যুগে কতটাই স্থায়িত্য আছে ? এটা স্বীকার্য যে সাহিত্য-বিপ্লব জাই কিছু হোক না কেন সবই সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল । আজও রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যের মধ্যে জীবিত আছেন কিন্তু এটা কী বলা যেতে পারে তাঁর সৃষ্টি সদাই অবিনশ্বর থাকবে ? জগত-সন্সারটাই তো আপেক্ষিকতায় নির্ভরশীল ।
যাইহোক , 
“সই কেবা শুনাইল শ্যাম-নাম ।
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ ।”
রবীন্দ্র-সাহিত্য সৃষ্টির অন্দরমহলে বিভিন্নভাবে ভিন্ন-ভিন্ন প্রসঙ্গে বৈষ্ণব কাব্যকবিতা, গান ও কীর্তনের আনাগোনা দেখা গেছে। রবীন্দ্র কাব্য, কবিতা, গান, গল্প, নাটক, উপন্যাস ও প্রবন্ধে ঘুরে ফিরে আসতে দেখি বৈষ্ণব প্রসঙ্গ। তাই তো তাঁর সম্পরকে যথার্থই বালা হয় –
Abstract Vaisnab literature alludes in the innermost part of Rabindranath’s literary creation in various ways in various occasions. The relation between Rabindra darshan and vaisnab padabali is always ever green. This very thought and impression that is inherent in his poems and verses is to highlight my subject matter.
বৈষ্ণব পদাবলীর ভাব ও ভাবনা, ভাষা তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথেরও বিশেষ প্রিয় ছিল । রবীন্দ্রনাথের কাব্যকবিতা গল্প নাটক উপন্যাস ও প্রবন্ধের মধ্যে তার যথেষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বৈষ্ণব পদাবলী অনুকরণে তিনি রচনা করেন ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী (১২৯১)। এ সম্পর্কে সমালোচক অজয় কুমার চক্রবর্তী মন্তব্য করেন—“বৈষ্ণব কবিতার ভাষা-মাধুর্য, ছন্দ-লালিত্য, তাহার লোকোত্তর মহিমা তরুণ কবির হৃদয় মথিত করিয়াছিল । তাহারই ফলে ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ রচিত হইয়াছিল। ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী রচিত হয় বৈষ্ণব পদাবলীর অনুসরণে এবং ঐ পুস্তকের নামকরণে কবি বিদ্যাপতি ঠাকুরের উপর শ্রদ্ধা ও প্রীতির নিদর্শন বিদ্যমান ।” ‘ব্রজবুলি’ ভাষার অনুকরণ দেখা গেল রবীন্দ্রনাথের ‘ভানু সিংহ ঠাকুরের পদাবলী’র প্রথম কবিতার মধ্যেই—“গহণ কুসুম কুঞ্জ মাঝেমৃদুল মধুর বংশি বাজে,বিসরি ত্রাস লোক লাজেসজনি, আও আও লো।অঙ্গে চারু নীল বাস,হৃদয় প্রণয় কুসুম রাশ,হরিণ-নেত্রে বিমল হাস,কুঞ্জ বনমে আও লো।”এই পদের সঙ্গে গোবিন্দ দাস কবিরাজের ‘শারদচন্দ পবন মন্দ’ পদের সুন্দর সাদৃশ্য আছে ।“শারদ চন্দ পবণ মন্দবিপিনে ভরল কুসুম গন্ধফুল্ল মল্লিকা মালতি যূথি মত্ত-মধুকর ভোরণি ।” বৈষ্ণব পদাবলীর ধারক ও বাহক জয়দেব গোস্বামীর ‘গীতগোবিন্দ’ সব থেকে বেশী করে পাঠ করতেন এবং বালক কালের ভালোলাগার বিষয় ছিল রবীন্দ্রনাথের । জয়দেবের ভাব-ভাষা ও ছন্দ যে শুধু কিশোর কবি রবীন্দ্রনাথকেই মুগ্ধ করেছিল তা নয়, পরিণত রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করেছিল। তাই দেখা যায় জয়দেবের— “রতি সুখ সারে গতমভিসারেমদন মনোহর-বেশম।নকুরু নিতম্বিণি গমন বিলম্বনমনুসর তং হৃদয়েশম্‌ ।।” এই পদের প্রতিধ্বনি রবীন্দ্রনাথের ভানুসিংহে প্রতিফলতি হয় এইভাবে— “সতিমির রজনী সচকিত সজনীশূন্য নিকঞ্জ অরণ্য।কলয়তি মলয়ে, সুবিজন নিলয়েবালা বিরহ বিষন্ন ।।”
রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ প্রশান্ত কুমার পাল তাঁর ‘রবিজীবনী’ গ্রন্থের পাদটীকাতে চন্দ্রনাথ বসুর একটি সুন্দর মন্তব্য তুলে ধরেন—“The sentiment of love is expressed in these sonnets in forms which are at once so deep, delicate, tine, fervid and in verses so full of the luxuriance of Music and Melody that it is difficult to decide who the better sonneteer the imitator Bhanusinha Thakur is, or his Model the great Baisnaba poet.”
একবিংশ শতকের পাঠক ও তাদের মনোভাব
বাংলার ছাত্র ও লেখালেখির দরুন হয়ত কিছুটা জানার প্রচেস্টা করি বাংলার নানা সাহিত্য । তবে , একথার অর্থ এই নয় যে অন্য বিষয়ের ছাত্র-ছাত্রী বানলাকে জানার চেষ্টা করেন না । কিন্তু এটিও পক্ষান্তরে স্বীকার্য যে , কয়জন মানুষ বর্তমানে রয়েছেন যারা বাংলা সাহিত্য নিয়ে নাড়াচাড়া করেন । বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস থেকে আধুনিক যুগের লেখক-কবিকুলের সৃষ্টি বাড়ীর দেরাজ থেকে শুরু করে কাঁচের আলমারিতে ডানা ঝাপটায় ।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এ এক আশ্চর্য মধুর সাধনা । সাধারণ বাঙালি পাঠকের কাছে বৈষ্ণব পদাবলীর আবেদন যত না তত্ত্বকথা, রসময় গীতিকবিতা হিসেবে অনেক বেশি । যদিও বৈষ্ণব পদাবলীর পাঠক যাঁরা, তার সিংহভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার্থী । পাঠ্যসূচির প্রশ্রয় না থাকলে মাইকেলই বা কতখানি পড়া হত ?  গান বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথই বা কতটা ?  পরীক্ষার খাতায় উত্তর লেখার দায় একটা বড় দায়, তাতে মুখস্থ আছে, শেখার পাখী পাখা মেলে দেয় ।
অবশ্য সমকালের পরে পাঠক তো ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়েই যায় – এমনকি যাদের ক্লাসিক বলি, তাদের ক্ষেত্রেও তা সত্যি । একদল সংখ্যালঘু শিল্পী , প্রকাশক , লেখক-কবি তথা পাঠক রয়েছেন যারা এই প্রাচীন ঐতিহ্যকে নিয়ে চিন্তা করেন ।
যাঁরা বৈষ্ণব-ভক্ত কিংবা কীর্তন-গানের ভক্ত , তাঁরা সাহিত্য হিসেবে পদাবলী পড়েন না, সমগ্র পদাবলীর পাঠও তাঁদের ইচ্ছে নয়, নিজ নিজ গুরুর শিক্ষায় ও বহুল-প্রচারিত পদগুলোর কীর্তনগান হিসেবে পড়েন ।
আর নিতান্ত হাতেগোনা গুটিকযেক পাঠক আছেন, যাঁরা বৈষ্ণব-সাহিত্য পড়ার জন্যেই পদাবলী পড়েন । আর মজার কথা হল, এই গুটিকযেক পাঠকের তাগিদেই আজও বৈষ্ণব-সাহিত্য সম্পর্কিত বেশ কিছু বই হচ্ছে । শুধু ভক্তিরস নয়, তত্ত্বকথা নয়, শুধুই একটি দর্শন নয়, এতগুলো শতাব্দী পেরিযেও বৈষ্ণব পদাবলীর যে আগ্রহ পাঠকের কাছে, তার মূল সুরটি মধুর । অক্ষুণ্ণ একটি সাহিত্যরস। কোনো একটি পদ বা গীতি-কবিতার খুচরো বিচারে নয়,  সামগ্রিকতাতেই জুটে যায় পদাবলীর স্থায়ী অনুপ্রাণিত পাঠক । মঙ্গলকাব্য-রূপকথা-লোককথার অনুষঙ্গে স্বদেশি কবিতার একটি মধুর আবেশ, যা চিরকালের বাংলাকে স্পর্শ করে আছে।
একথা শুধুমাত্র বৈষ্ণব পদাবলীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয় , একথা শাক্ত পদাবলী , লৌকিক কাব্য ও সে থেকে উদ্ভুত লোকসঙ্গীত সবক্ষেত্রেই লক্ষ্যনীয় ।
গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর ভাবতরঙ্গ বলি কিংবা চৈতন্যদেবের ভক্তি-আন্দোলন, অথবা রামপ্রসাদ ,নরহরির সৃষ্টি আজকের পাঠক সেসব ঘটনা থেকে দূরবর্তী । তাঁদের কাছে সেসব কানে শোনা বা বইয়ে পড়া । তাঁদের কাছেও কি সে-সময়ের ঘটনার প্রত্যক্ষ চাপে বা প্রেরণায় লেখা কবিতা বা পদগুলি সমান সাড়া জাগাবে আজও ?  তা ছাড়া ওইসব ঘটনা বা আন্দোলনের ব্যাপারে যে ব্যাপক সম্মতি ছিল,  আজ অনেকক্ষেত্রেই তো তা আর নেই । মূল্যায়ন বদলেছে । যে-মতবাদের প্রেরণায় সমকালীন কবিরা দেখছেন,  তার অর্থান্তর ঘটেছে । যে ঘটনা বা মতবাদের বাতাবরণে পদাবলী লেখা হয়েছে,  সেই কবিতাগুলো আজ নতুন পরিস্থিতিতে আজকের পাঠককে কীভাবে নাড়া দেবে ? এভাবেই যে-কোনো একটি উপলক্ষ্য, কোনো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, সামাজিক-রাজনৈতিক বিক্ষোভের এক-একটি অধ্যায় বাস্তবের বা খণ্ডিত সময়ের সীমাকে ছাপিয়ে যায়,  কবিতার সেই রহস্যকেই খুঁজে পাই বৈষ্ণব পদাবলীর মধ্যে , সন্ধান পাই প্রাচীন কাব্য-পদ-গাঁথায় ।


তথ্যঋণ: 
বৈষ্ণব পদাবলী – সাহিত্য আকাদেমি 
বিদ্যাপতি পদাবলী – বসুমতী সংস্করণ 
বৈষ্ণব সাহিত্যে সমাজতত্ত্ব – ড: ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত 
রামায়ণ : প্রকৃতি পর্যাবরণ ও সমাজ – ধূর্জটিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় 
বঙ্গভাষা ও সাহিত্য – দীনেশচন্দ্র সেন 
প্রশান্ত কুমার পাল, ‘রবিজীবনী ২য় খন্ড বিশ্বভারতী, পৃঃ ২৭৬১১ । দাসগুপ্ত শশিভূষণ,  রবীন্দ্ররচনাবলী, ‘গীতাঞ্জলি’, পৃঃ ৭৮১৩ । ‘সোনার তরী’, ‘বৈষ্ণব’ কবিতা, পৃঃ ৩৬৭১৪ ।

পবিত্র চক্রবর্তী
প্রাবন্ধিক, শিশু সাহিত্যিক,
উপাধি : কাব‍্য প্রভাকর, কাব্য ভারতী







No comments:

Post a Comment