এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

প্রভাত চৌধুরী


বিষয় : গদ‍্য (আত্মজীবনী)



সুন্দরের দিকে

(১)

            কীভাবে শুরু করবো কিছুই ঠিক করা নেই । তবু শুরু করতে হবে। একবার শুরু হলে গেলে তর্জনী নিয়ে যাবে একটা সুন্দরের দিকে। একটা সন্ধানের দিকে।
ঠিক কবে থেকে শুরু মনে নেই । তবে বাবার বই পড়ার অভ্যাস ছিল । আর আমাদের পারপিচ্যুয়াল ক্লাব নন্দ মেমোরিয়াল লাইব্রেরি না থাকলে লেখার কথা স্বপ্নেও  আসতো না । তার ওপর ছিল  88A কালীঘাট রোডের বাড়িটি। দীপংকর সরকার এবং ওর মামা পরিমল দত্তের সান্নিধ্য । দীপংকর আমার ফার্স্ট ফ্রেন্ড । আর পরিমল দত্ত শিক্ষক ।পরিমল দত্ত ছিলেন দীপংকরের মামা আর আমাদের বাড়িওয়ালা ।  পুজোর আগে উনি বই উপহার দিতেন দীপংকরকে ।আমার মনে করতাম আমাদের সকলের । ছোটো ছিলাম ।এত ভেদাভেদ বুঝতাম না। সিলেবাসের বাইরেও যে পড়ার বই আছে স্যারই তার সন্ধান দিয়েছিলেন । সুকান্ত র ছাড়পত্র পড়ার পর জানতে পেরেছিলাম মানুষের হাতে লেখা  হয় কবিতা ।
আমাদের দেশের বাড়িতে একটা বড়ো কাঠের সিন্দুক ছিল । ওর ভেতর থেকে আবিষ্কার করেছিলাম  তুলোট কাগজে ছাপা  মহুয়া । তাতে রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষর ছিল । আমার ঠাকুরদা  অন্য প্রজাতির মানুষ ছিলেন । হয়তো কোনো কুটুমবাড়ি যাবার পথে পেয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। শান্তিনিকেতনে। সুরুলের সরকার বাড়ি আমাদের কুটুমবাড়ি ।ঠাকুরদা ওখানে যেতেন।ওখানেই আমার প্রাণের ঠাকুরকে পেয়েছিলাম ।
আমি কোনো ভবিতব্যে বিশ্বাস করি না । তবুও মনে করি  পারিবারিক সূত্রে  আমি যুক্ত  আছি তাঁর সঙ্গে । এটা অলীক কল্পনা হতে পারে  তবু আমি এই অলীক নিয়েই বেঁচে  থাকতে চাই ।


(২)

গতকাল যেখানে শেষ করেছিলাম আজ সেখান থেকেই শুরু করতে হবে এমনটা  আমার ভাবনায় নেই ।আমি লিখি আনন্দে ।আমি লিখি নিজেকে প্রকাশ করতে ।নিজেকে ভাসিয়ে দিতে ।
একটা লেখার কতটুকু ক্ষমতা তা আমার জানা নেই ।শুধু জানি কোনো কোনো শব্দ কাছে এসে গেলেই এসে উপস্থিত হয়ে যায় গোটা  একটা পঙক্তি । এই যেমন শ্রাবণ শব্দটির উচ্চারণ ভেসে এলেই শুনতে পাই  এই শ্রাবণের বুকের ভিতর আগুন আছে।কিংবা প্রাঙ্গণ কথাটি  এসে গেলেই  একটি  শিরীষশাখা  ফাগুন মাসের জন্য  অপেক্ষা করে না । কেন এমনটা হয়।জানি না।
জানি প্রতি বছর পরীক্ষার পর যেতে হত দেশের বাড়ি । রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিতে হত আগেভাগে । একটা বেবি ট্যাক্সি, তখন ট্যাক্সিকে বেবি ট্যাক্সিই বলা হত। হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে যেতাম ঘণ্টাখানেক  আগেই ।ট্রেনে তখন স্লিপার ক্লাস ছিল না । ট্রেনে উঠেই মেজভাই আর আমার শোবার ব্যবস্থা হবে যেত। তারপর   ঘুম আর জাগরণের মধ্যে একটা খেলা চলত । জাগরণে রূপনারায়ণ পার হয়ে যেতাম । তারপর ঘুম অধিকার করত ট্রেনযাত্রা। 
বাঁকুড়া এসে গেলেই ঘুমচোখে নেমে যেতাম । কিছুটা হেঁটে বি ডি আর ।ছোটো ট্রেন ।সাঁওতাল কুলিকামিনদের সঙ্গে  একই বগিতে। ওরা তখনও সিটে বসার অধিকার অর্জন করেনি। বি ডি আর চলত যে গতিতে তার থেকে অনেক বেশি শব্দ হত ধোঁয়া হত। এক সময়ে সূর্যকে উঠতেই হত।কারণ সূর্যের  ওঠাটা বাধ্যতামূলক । অবশেষে বেলিয়াতোড়। কালোমাজি গাড়ি নিয়ে হাজির থাকত ।গোরুর গাড়ি । একটা  হেলে লাল অন্যটা সাদা। তখন ছাঁদারে স্টেশন হয়নি। বেলেতোড় থেকেই যেতে হত কাদাকুলি। 
আর কাদাকুলি পৌঁছে গেলেই আমি মুক্ত তথা মুগ্ধ । খেজুররসের গন্ধ  । বড়ো পিসিমার কোমল শাসন ।কত্তামা অর্থাৎ কাকার মায়ের সঙ্গে গোরুপাল।কাচফল তুলে রাখা। এসব  না থাকলে পক্ষীজাতক লিখতাম  কীভাবে । সাক্ষাৎকার  আসতো কীভাবে । আমি আকন্দ লেখার জন্য  আকন্দর সান্নিধ্য পেয়েছি । এজন্যই  আমার আকন্দ থেকে  মাটির  ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সপুষ্পক  আকন্দগাছ দেখা যায়।
ধান কাটার  পর জমিতে যে ভুঁইখাল থাকে সেখানে কোন প্রক্রিয়ায় জ্যোৎস্নার শরীর ঢুকে যায় তা না জেনে লেখা  যায় না । 
একজন কবি  অবশ্যই নাগরিক হবেন। উচ্চ প্রযুক্তির সমর্থক হবেন ।এতে কোনো সন্দেহ নেই ।কিন্তু  হরীতকী গাছ না দেখে  হরীতকী লেখা সংযত হবে না । এমনটাই  আমি মনে করি । 
এখন স্নান করার জন্য  রানিসায়রে যেতে হবে। কেন নিয়ে যাবে  আমাকে  । আট বছরের প্রভাত চৌধুরীকে ।


(৩)

স্নানে যাবার কথা রানিসায়রে । একটা পুকুর।ঠিক পুকুর নয়। একেই তো পুষ্করিণী নামে ডাকা হয়।পুকুর ভর্তি লালপদ্ম।কোকনদ। একটাও  সাদা নেই ।পাশাপাশি দুটি পুষ্করিণী দুরকম । একটাতে লাল।রানিসায়রে ।পাশেরটি  ইন্দভাঙায় সাদা । ইন্দভাঙা নাকি  ইন্দ্রভঙ্গের অপভ্রংশ ।পুকুরপাড়ে একটা প্রাচীন  অশথগাছ।কয়েকটি পুরোনো তেঁতুল আর বাঁশঝাড়।
রানিসায়রের জলে চাঁদ ডুবে গেলে ছান্দারের নিরন্নের রানি জেগে ওঠে ।শরৎকালীন নৈশরূপকথা র প্রথম লাইনটি এরকমই ছিল ।আর শেষকথাটি ছিল  হে চক্ষুদান,  আপনার চোখের ব্যবহার ফিরিয়ে  আনুন।বোল্ড হরফে ছিল ।এক গর্ভবতী  মহিলার আত্মহত্যার কাহিনি ।কল্পনাবিলাস। এখন স্নান স্নানকাজ ।
পুকুর  এবং অবগাহন পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত ।যেমন রানিসায়রের সঙ্গে যুক্ত আদিবাসীদের শিকারপরব।পাঁচই বৈশাখ ।দিনমানে বনের ভেতর শিকারের সন্ধান ।সূর্যের বিদায়ের আগে রানিসায়রের পাড়। নাচগান খানাপিনা ।সে এক উৎসবের  আদিরূপ।কুপির আলোয় মায়াময় হয়ে  উঠতো চারপাশ ।মাদল বাজতো।বাঁশিও। পোড়ামাংসের গন্ধ । পাখিদের পালক পুড়তো।প্রাণীদের লোম।মারাং বুরু দিগুদের ক্ষমা কর।
দূর থেকে যতটা দেখা যেত আলোখেলায় দেখতাম ।সেই  দেখার সাক্ষী আছে চাঁদ ।সাক্ষী  আছে পদ্মের পাতাগুলো । এখনো পাতার ওপর টলটল করছে স্মৃতির  অক্ষরমালা ।
স্নান করে বাড়ি  ফেরা ।ফিরতে ফিরতে শুকিয়ে যেত মাথার চুল।শীতের রোদ কৃপণ ছিল না । 
আমাদের বাড়িটা ছিল  অদ্ভুত । দোতলা  অথচ খড়ের চাল। সরু ঘোরালো সিঁড়ি ।দোতলায় যাবার ।প্রতি তলায় একটা করে ঘর আর একটা করে বারান্দা ।তখন বেশ  বড়ো মনে হত। কাঠের  অসাধারণ কিছু কারুকাজ  ছিল ।শিল্পকর্ম লেখা  যেতে  পারে ।
আমার শোবার ব্যবস্থা বড়োপিসিমার সঙ্গে । এক তলার ঘরে । ওই ঘরে ঢুকলেই পুজো পুজো গন্ধ  পাওয়া যেত।ঠাকুরঘরের গন্ধ । ঠাকুরের  গন্ধ ।বড়ো পিসিমার গায়েও ঠাকুরের  গন্ধ ।
আমার নাক সেই গন্ধ  এখনো ভুলে যায়নি।
স্নান করে


(৪)

সুন্দরের দিকে যেতে চাইছি ।তাও আবার ফেসবুকে ।নাসের তো নাম মুক্ত । আমাকে তো একাএকাই সুন্দরের দিকে যেতে হবে।একাএকা কেন? তোমরা সকলেই আছো।
রানিসায়র কাদাকুলি জঙ্গল পরিক্রমা, সেসব আবার ফিরে আসবে ।চল বাসুদেবপুরে যাওয়া যাক ।তার জন্য তো পুজো আসতে হবে ।
বাজিয়ে দিলাম ঢাক।এসে গেল পুজো।একটা ট্রেনের বগি।সেই বগিতে শুধুই আমরা । অর্থাৎ ন দাদু ন দিদিমা,  আমার দাদুদিদিমা, ফুলদাদু ফুলদিদিমা ডাক্তার মামা খুকুমাসি আর আমি ।বাবামাকে ওই বগিতে দেখতে পাচ্ছি না ।
সকালের ট্রেন । পানাগড়ে পৌঁছে গেল।স্টেশনমাস্টার এবং আরো কয়েকজন রেলকর্মীর বদান্যতায় মালপত্র নামানো হল।লাইন পেরিয়েই গোরুর গাড়ি ।চারপাঁচটি। ওইসব গাড়ির গাড়োয়ানরা ধরাধরি করে মালপত্র তুলে নিল সব। একটাতে দুই দাদু আর একটায় দুই দিদিমা ।তিন নম্বরে ডাক্তার মামা মাসি আর আমি ।
গাড়ি চলতে শুরু করলো ।দুপা গিয়েই ময়রার দোকান থেকে উঠলো মিষ্টির হাঁড়ি।তখনো বেশ গরম ।হাত জানিয়ে দিল।
আমার  উৎকণ্ঠা শুরু হল। এখনো কেন দামোদর ধেয়ে আসছে না ।ছিলামপুরের ঘাট। ওই ছিলামপুরে বাবার মামাবাড়ি।সিংহপরিবারে।
এসে গেল ছিলামপুরের ঘাট এবং দামোদর । গাড়ি তরতর করে নেমে গেল নদীতে । তবে জলে নয়। বালিতে । পা বাড়ালেই জল। দুটি জলযান  আমাদের  অপেক্ষায় তামাক খাচ্ছিল। গাড়োয়ান আর মাঝিরা যৌথভাবে তুলে নিল জলযানে।
নিজের হাতে জলকে স্পর্শ করলাম । এই জল যেন আমাদের পারিবারিক জল।ব্যক্তিগত জল। কলকাতার বন্ধুদের কোনো  অধিকার নেই  এই জলে ।সিনিয়র মাঝির কত প্রশ্ন ।দাদুরা  আজ প্রাণখোলা ।কেউ স্যার স্যার করছে না । এখন ন দা ফুল দা।পানাগড়েই পরে আছে স্যার ।
বলা হয়নি পানাগড়ে যে গাড়িগুলি গিয়েছিল সেগুলো ওদিকের চাষিদের ।
জলে বেশ স্রোত ।দাঁড়ের শব্দ । ওই স্রোত  এবং শব্দ কালীঘাটকে মুছে দিলাম নিমেষে ।
রাঙামাটি ঘাটে বাসুদেবপুরের গাড়ি।এখানে গাড়ির সংখ্যা বেশি ।লোকজনের সংখ্যাও।
দূর থেকে ঢাকের শব্দ কানে আসতেই লাফ। একদমে দুর্গামণ্ডপ।মিশে গেলাম পুজোয়।


(৫)

দুর্গামণ্ডপে ঢোকার আগে রায়বাড়ির কথা বলে নিই।এই রায়বাড়ি তারাশংকরের রায়বাড়ি কিংবা সত্যজিতের জলসাঘর নয়।এই রায়বাড়ি বাসুদেবপুরের রায়বাড়ি ।যাঁরা বাসুদেবপুর চেনেন না, তাঁদের জানিয়ে রাখি এখন আর দামোদর এ নৌকাবিহার না করেই বাসুদেবপুরে যাওয়া যায়। ট্রেনে দুর্গাপুর ।দুর্গাপুর থেকে বাসে ।ভায়া সোনামুখী, বিষ্ণুপুরগামী বাস।বড়জোড়া পেরিয়ে  আশুরিয়া মোড় থেকে বাঁদিকের রাস্তা ধরে পখন্না পলাশডাঙা মদনপুর  আলমপুরের পর বাসুদেবপুর ।পিচরাস্তা থেকে কদম ঢুকে গেলেই ধাক্কা খাবেন দুর্গামণ্ডপে ।
আমার দাদুরা রায়বাড়ির দৌহিত্র ।ঘোষবাড়ি।আমরা  আবার ঘোষেদের দৌহিত্র । অর্থাৎ দৌহিত্রর দৌহিত্র । তাতে কিছুই  এসে যায় না ।পাশেই যে বকুলগাছটি দাঁড়িয়ে আছে একশো বছর ধরে তার ফুলের গন্ধ  একটুও কমে যায়নি ।কমে যায় না ।এই যেমন আমি 60-65 বছর  আগের বাসুদেবপুরের কথা বলছি, এই বলা থেকে ঢাকের বাদ্যি কিংবা ধূপধুনো স্পর্শগুলি মুছে যায়নি ।
রায়বাড়ি চার তরফের। প্রথম রায় কানাইদাদু।দ্বিতীয় রায় গোমস্তাজেঠা চণ্ডীকাকা।তৃতীয় রায় ভোঁতাদাদু ভূতোদাদু।আর ছোটো রায়বাড়ি ঘোষেদের ।কানাইদাদু আমার কাকার মামা।সেই সূত্রে কানাইদাদু ।গোমস্তাজেঠা চণ্ডীকাকা  আমার বাবার পিসিমার ছেলে ।সেকারণে জেঠা কাকা।আমাদের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়িটার নাম ছিল ব্রজনাথ ধাম। এই ব্রজনাথ দাদাদের বাবা।দাদুরা ছয় ভাই একটা বোন।
বড়দাদু রেলে কাজ করতেন ।চাকরি ছেড়ে দেন ভাইদের  মানুষ করার জন্য তৎসহ সম্পত্তি রক্ষার কারণে ।মেজদাদুর কন্ট্রোলের দোকান ছিল ।এখন যাকে রেশনদোকান বলে।ন দাদু এবং আমার দাদু কলকাতার । ন দাদু এ জি বেঙ্গলের প্রায় বড়োসাহেব ।আমার দাদু সার্ভে বিল্ডিংসের মেজসাহেব। সেজদাদু স্যানিটারি কর্তা ।ছোটো দাদু  এল এম এফ ডাক্তার ।হাটকেষ্টনগরে থাকতেন ।পুজো কদিন বাড়িঘর গমগম করতো।দাদুদের  আলাদা  আলাদা এনক্লোজার। খাওয়া হত মাটিতে আসন পেতে ।বেশ বড়ো খাবার ঘর। একসঙ্গে পনেরো কুড়ি জন্য বসে খেতাম।
আমার খাওয়া শোওয়া হাঁটাচলা সবকিছুই ছিল দেবীর সঙ্গে ।দেবী সেজদাদুর ছেলে ।সেই অর্থে দেবীমামা।আমার থেকে একটু বছরের ছোটো বলেই দেবীমামা আমার কাছে মামা  হতে পারেনি , শুধু দেবী হয়ে থেকে  গেছে।ওরা এখন জিব্রাল্টারের আশেপাশে ।আর আমি পটলভাঙায় বসে বাসুদেবপুর লিখছি ।
সকালের জলখাবার গরম গরম ফুলকো লুচি ।গন্ধ পাচ্ছি ।বিশুদ্ধ গব্যঘৃতের।খেতে তো হবে ।দেবীর পাশে আমি। আমার পাশে দেবী।


(৬)

প্রথমে ভেবেছিলাম কবিতা লেখালেখির কথাবার্তা বলবো  এই লেখায়।কিন্তু এখনো পর্যন্ত সেই কবিতাকে স্পর্শ করতেই পারলাম না ।
একটা কথা খুব স্পষ্ট করে বলছি, তাহল আমি শৈশবে কবিতার কথা ভাবিনি । আমাকে যে কবিতা লিখতে হবে  এমন কোনো সংকল্প ছিল না । এমনকি স্কুল ম্যাগাজিনে ও কবিতা লিখিনি ছাত্রাবস্থায়।লিখেছিলাম অনেক পরে ।কিন্তু আমার জীবনযাপন সংযুক্ত ছিল কবিতাতেই । এখন মনে হয়।
রাঙামাটি খেয়াঘাটে বাড়ে জল , আমার শৈশব
ভেসে আসে দামোদরে দক্ষিণারঞ্জনে -- দিদিমার ঘুমগানে, 
খুবই কাঁচা লেখা ।এপ্রিল 1979  এ প্রকাশিত  প্রভাত চৌধুরী কাব্যগ্রন্থের কবিতা । তারও আগে লিখেছিলাম  ---কলকাতা তোমাকে আমার কেন প্রবাস মনে হয় / বড়ো বেশি অনাত্মীয় ট্রাফিক সিগন্যাল /  টানা ট্রামলাইন ধরে হেঁটে গেলে / কোনো প্রিয়মুখ চোখেও পড়ে না ----এভাবে শুরু করে শেষ করেছিলাম ----কলকাতা তোমার গভীরে কবে ক্ষত সেরে গেলে/ প্রবাস হারিয়ে আমি মুগ্ধ হব।
এসব বানানো লেখা ছিল না ।কোনো কল্পনাবিলাসও নয়।আমি প্রকৃতই কলকাতাতে  আমার প্রবাসজীবন কাটাতাম ।আমার মূল বা শিকড় ছিল কাদাকুলি কাদাকুলিতে বাসুদেবপুরে 
দুর্গাপ্রতিমার শেষ মুহূর্তের কাজ চলছে ।গর্জন তেলের গন্ধ পাচ্ছি । একেই কি বার্নিশ বলা হয়। একচালা প্রতিমা ।ডাকের সাজ ।এই আয়োজন কলকাতাতে কখনো দেখিনি ।কলকাতার পুজো বহিরঙ্গ পুজো।পুজোর অন্তরে প্রবেশের কোনো সদিচ্ছাই চোখে পড়ে না ।
কাল নবপত্রিকা  আসবে ।মাঝে মাঝে চাবিফটকার শব্দ ।তখন বাজি বলতে চাবিফটকাই ছিল । আটচালায় রায়বাড়ির কর্তাব্যক্তিরা ।আমরা  এদিক ওদিক । আমাদের নির্দিষ্ট কোনো দিক ছিল না ।তখন সমবয়সী বলতে দেবী ছাড়াও মনে পড়ছে নানুর কথা ।ভোঁতাদাদুর ছোটো ছেলে।বর্ধমানের টাউন হল পাতার বাসিন্দা । আর ভূতোদাদুর ছেলে সোনা । ওরা বাসুদেবপুরের । দেবীর বোনের নাম বকুল। আমরা ওকে  কেন যে পাঁচি নামে ডাকতাম জানি না।
আমাদের ঘোষবাড়ির সঙ্গে মিশে ছিল বাগালে বাগদি।আমরা বাগালে মামা বলতাম। বাগালেমামাই আমাদের দেখভালের দায়িত্বে ছিল ।
রায়বাড়ির পুজো হলেও এই পুজোর সর্বময় কর্তা ছিলেন ঘোষালদাদু। পুজোর মূল পুরোহিত । কখন স্নান করতে হবে, তা রাত তিনটেও হতে পারে, তা নির্ধারণ করতেন ঘোষালদাদু। বাড়ি পখন্নায়। পুজোর কদিন  আমাদের বৈঠকখানা ঘরেই অস্থায়ী  আস্তানা করে নিতেন এমন কৌশলে  , মনে হত ওটাই তাঁর স্থায়ী ঠিকানা । 
তখন দুর্গামণ্ডপ ছিল মাটির কিন্তু রহস্যময়।


(৭)

লেখার ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়ে শুরু করলাম  আজকের লেখা ।
তখনও কাঁসরঘণ্টা বাজাবার সুযোগ পাইনি । তখন ছিল  ধুনুচিতে ধুলো দেবার কাজ। এই কাজে আমার দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত । মাটির মণ্ডপ । দরোজা এবং জানলা  অপেক্ষাকৃত ছোটো । ধুনোর ধোঁয়াতে ঘর অন্ধকার হয়ে গেলেও কোনো প্রতিবাদ  আসেনি । এটা যে  আমাদের  একটা খেলা,  এটা রায়বাড়ির কর্তাব্যক্তিরা মেনে নিয়েছিল। আমরাও বেশ মজা পেতাম । এখন বললে বলতে হবে ব্যাপারটা  উপভোগ করতাম।
এখন যারা দশ তারা এই মজা পেতে শেখেনি। আমরা তাদের শেখাতে পারিনি । আমরা ষষ্ঠীর দিন থেকেই তাদের হাতে তুলে দিয়েছি ফুলঝুরি রংমশাল চরকি সহ আরো নানাবিধ বাজি। আমাদের খাজনা থেকে বাজনা বেশি হয়ে গেছে ।
বাজনার কথা  এসে যাওয়ার পর এসে গেল বাজনদারদের কথা । এরা সপরিবারে  আসতো ।ঢাক বাজাতো । সঙ্গে সঙ্গতে থাকতো সানাই এবং ঘণ্টা । একটা ছোটোখাটো ব্যান্ড । 
ঢাকিরা যে কেবল খালেবিলে ঢাক বাজায় এটা সর্বসম্মত  একটি মিথ্যা বচন।ঢাকিদের বাজনা ছিল বহুমুখী ।আরতির সময়  একরকম। পুজোর ফাঁকে ফাঁকে আর এক রকম । আর বলির বাজনা  একেবারেই ভিন্ন  এক উল্লাসের শব্দরূপ। বিসর্জনের বাজনা এখনই বাজিয়ে দেবো না ।
ঢাকিরা ছিল ডোম সম্প্রদায়ের। ওরা পুজোর প্রথম দিন থেকে তৈরি শুরু করতো একটা মোড়া বানানোর কাজ । দশমীর দিন  একটা নতুন মোড়া পেতাম আমরা ।কোনো দরদাম নয় একটা ভালো বকশিশ পেতো ঢাকিরা। এটা নিয়ে  কোনো রকম কথা হত না । 
মনে রাখতে হবে তখনো মধ্যস্বত্বভোগী ছিলাম আমরা । অথচ কখনোই সামন্ততান্ত্রিক প্রভু সুলভ মনোভাব দাদুদের মধ্যে দেখিনি । আমার আচরণে ফিউডাল ব্যাপারসাপার হয়ত থাকতে পারে ।কিন্তু কীভাবে সেটা এসেছে জানি না ।
শুনেছি মহাপ্রভু শ্রী শ্রী চৈতন্যদেব যে পথে নীলাচলে গিয়েছিলেন সেই পুরো যাত্রাপথই পশুবলি নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল । আমরাও সেই গোত্রের 
বলি হত চালকুমড়ো  এবং আখ। আর সেই বলিকে কেন্দ্র করে সেকী চিৎকার ।মা কে ডাকা।
আমরা  এক টুকরো আখেই সন্তুষ্ট হতাম। আমাদের চাহিদা তখন অনেক কম ছিল । 
আর একটা কথা বলে রাখি  এই পর্বে ।তা হল পুকুর  এবং মাছধরা ।তবে হাতে ছিপ আসতে  অনেক দেরি । মাছ ধরা হত  জালে।টানা জাল।ঘাটের কাছাকাছি  এসে গেলেই খই ফোটার মতো মাছ ফুটতো।এত বেশি মাছ ছিল সেনপুকুরে।কেন সেনপুকুর নাম ছিল জানি না। জানতে পারলে জানিয়ে দেবো।
পুজোতে নিরামিষ ।মাছ নিষিদ্ধ ।তবে কুটুমজনেরা ভাতের পাতে মাছ পেত। আর পেতাম  আমরা  অর্থাৎ ছোটোরা।কাজেই  আমরা পুজোতে ছিলাম , পেটপুজোতেও।
আমি কি খুব পেটুক ছিলাম এটা কে বলে দেবে ? যদি কেউ বলতে না পারে তাহলে চিন্তার কী আছে ।
কানে কানে বলে রাখি সে সময়ে  আমাদের কালীঘাটের বাড়িতে দু তিন রকম মাছ রান্না হত। আমি  যে সেগুলি দেখতাম  এমনটা বললে ঘোড়াও হাসবে।
সাপের হাঁচি ব্যাঙও চেনে , এইবলে  এই পর্ব শেষ করছি।


(৮)

এই যে বাসুদেবপুরের পুজো , এই পুজোর যাবতীয়কে আমি আমার মতো করে সঞ্চয় করে রেখে দিয়েছি  একটা ফোল্ডারে । মাউসে স্পর্শ করলেই পৌঁছে যাই বাসুদেবপুরে । 
এখন নবপত্রিকা আসবে । চল যাওয়া যাক চাপড়া নামক পুকুরটির পাড়ে। কলাগাছ  একটা লালপাড়ের কোড়া শাড়ি পরেছে । নতুনের একটা গন্ধ আছে, নতুন কোনো গল্পও আছে হয়তবা। এত দূর থেকে সবটা দ্যাখা যাচ্ছে না । ছোটোখাটো একটা জমায়েত দেখতে পাচ্ছি ।  এই জমায়েতের মধ্যে নিজেকে দ্যাখার চেষ্টা করে লাভ হবে না ।খুঁজেও পাওয়া যাবে না ।
কার হাতে একটা চাবিফটকা ছিল, প্রায় কেড়ে নিয়ে ঠুকে দিলাম  একটা পাথরের  ওপর । শব্দ হল।কার কাছ থেকে নিয়েছিলাম তার হাতটিকে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু মুখ দ্যাখা যাচ্ছে না ।তাহলে আইডিন্টিফাই করবো কীভাবে । সব স্মৃতি চেনা যায় না ।যেমন রাতে  অনেক স্বপ্ন সকালের রোদের আলোয় হারিয়ে যায়। এটাই বাস্তবতা । এই বাস্তব থেকে যতটুকু পাই ততটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার ব্যবস্থা করি ।এতে চাহিদার কোনো আসন থাকে না বলে সে স্থায়ী ভাবে বসার সুযোগ পায় না।অল্পতেই খুশি থাকি ।
তখন প্রতিদিনই ভোজ হত । যাদের যেদিন পালা বা পালি থাকত সেদিন তাদের বাড়িতেই দল বেঁধে খেতে যেতাম । 
সপ্তমীর দিন কানাইদাদুর বাড়ি।অষ্টমীর দিন গোমস্তাজেঠা, নবমীর দিন ভোঁতাদাদুর বাড়ি।আর দশমীর দিন  আমাদের পালি।
ভোঁতাদাদুর বাড়ির হাঁকডাক বেশি ছিল, মাত্র এটুকুই উদ্ধার করতে পারলাম ।গোমস্তাজেঠা ছিল নরম মনের মানুষ । আমাদের হইচইকে কিছুটা সমর্থন করতো।দেখতে পাচ্ছি ।
এই ফাঁকে একটা কথা বলে রাখি ।যতদিন ছোটো ছিলাম ততদিন পুজোতে  আমি ঘোষবাড়ির ছিলাম। আর একটু বড়ো হবার পর  আমার ঘরবদল হয়েছিল । ঘোষবাড়ি থেকে রায়বাড়ি ।মেজরায় অর্থাৎ গোমস্তাজেঠার বাড়ি।চণ্ডীকাকা তখন গৃহকর্তা ছিল না ।বড়োদাদার আজ্ঞাবহ ছিল । দাদার প্রতি সম্মান করার দৃষ্টান্ত  ছিল  চণ্ডীকাকা । এখনো আমি চণ্ডীকাকার ভাগেই আছি ।গাজু লালু ভুলো এবংআরি অর্থাৎ আরতি,  আমার এই ভাই বোনেদের ভরসাতেই এখন  অবধি বাসুদেবপুরে যাই।
চণ্ডীকাকার সঙ্গে  আমার খুব মিল আছে ।খেতে এবং খাওয়াতে ভালোবাসার সূত্রে ।
গোমস্তাজেঠার বড়ো ছেলে হারা ব্য়সে বেশ কিছুটা ছোটো ছিল।কিন্তু বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে তা বাধা হয়নি।  হারার দুই ভাই  ভোমা এবং বোদে অনেকটাই ছোটো । 
মেজমামা  অর্থাৎ বড়োদাদুর ছেলে নবীনমামাকে মেজমামাই বলতাম ।কলকাতাতেই একটা মেসে থাকতো আমাদের পাড়াতেই।
মেজমামার বড়ো ছেলে দিলু  আলিপুর আদালতের আইনজীবী । ওর ছোটো  বোনের নামকরণ করেছিলাম কবিতা । তখন তো ছোটো বড়ো পত্রিকায় কবিতা  প্রকাশিত হতে শুরু হয়েছে ।


(৯)

গতকাল কবিতার নামকরণের মধ্য দিয়ে  অজ্ঞাতসারে ঢুকে পড়েছি কবিতায়।এখন  এখান থেকে বাইরে যাব কেন । বরং কবিতার কথায় ঘোরাঘুরি করি।
কবিতার কথার প্রথম কথাটি হল পিকলুর কথা । কথা শব্দটি বারবার প্রয়োগে যাঁরা বিব্রত বোধ করবেন আমি তাঁদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী । আমি তো কথার ব্যাপারি, কথা ছেড়ে দিলে দোকানের শাটার বন্ধ করে দিতে হবে । পিকলুর কাগজনাম শৈবাল চট্টোপাধ্যায ।আমার থেকে দু - ক্লাস নীচে পড়তো।সাউথ সাবার্বানে।তা সত্ত্বেও পিকলু আমাকে তুই সম্বোধন করতো।আমি তুমি বলতাম। এটাই গৃহীত সিদ্ধান্ত ছিল । কখনো  অন্যথা হয়নি। আর এই সম্বোধন কখনোই কোনো সমস্যার কারণ হয়নি।পরবর্তীতে চণ্ডী মণ্ডলের ক্ষেত্রেও এমনটাই ছিল ।
যখন শুরু করছি তখন আমাকে কবিতার বই সংগ্রহ করতে হয়নি । শৈবাল ছিল বাংলা কবিতার আর্কাইভ ।যখন যাঁর কবিতা শুনতে  ইচ্ছে হত শৈবালের কাছে আর্জি পেশ করলেই পেয়ে যেতাম তাঁর কবিতা । একটি দুটি নয়।যতগুলো শুনতে ধৈর্য থাকত ততগুলি শুনতে পেতাম । এর ফলে কবিতা পড়া ব্যাপারটাই মুছে গেল আমার শিক্ষণপর্বে।
খুবই ভালো লাগতো সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে।পাঁচের দশকের কবিদের কবিতাও মনে দিয়ে শুনেছি । বলা হয়নি পিকলু ছিল তুষার চট্টোপাধ্যায়ের ভাইপো। তুষারদা ছিলেন কবিপত্র পত্রিকাটির  অন্যতম সম্পাদক।যদিও আমরা পরবর্তীতে বুঝেছিলাম কবিপত্র  মানেই পবিত্র মুখোপাধ্যায়। এমনকি  আমি যখন কবিপত্রর সম্পাদনা করি পবিত্রদার সঙ্গে তখনও সকলেই বলত পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের কবিপত্র ।
এই শৈবাল বা পিকলুর সঙ্গে  একদিন গিয়েছিলাম সদানন্দ রোডে।পবিত্রদার বাড়ি বা কবিপত্র দপ্তরে । সেদিন ভেতরে ঢোকার ছাড়পত্র পাইনি । এত ভিড় ছিল ভেতরে । শৈবালের সৌজন্যে পবিত্রদা বাইরে এসে বলেছিলেন  সনেট লিখে নিয়ে এসো । তো সনেট লেখা হয়নি বলেই  আর পবিত্রদার সদানন্দ রোডের বাড়িতে যাওয়া হয়নি। 
পরে যখন গেলাম তখন ঠিকানা বদলে গেছে । সদানন্দ  রোড থেকে ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটের বাড়িতে । একটা কথা  এই প্রসঙ্গে না বললে খুবই অন্যায় হবে তা হল পবিত্রদার  বাসস্থান ছিল  একজন প্রকৃত কবির বাসভূমি। খুবই পরিপাটি করে ঘর সাজাতেন পবিত্রদা । এটা শেখার বিষয় ছিল ।আমার  এখন মনে হয় এই  ঘরসাজানো প্রক্রিয়াটি মান্যবর বিষ্ণু দে - র নৈকট্য থেকে পেয়েছি লেন। পবিত্রদাই আমাকে হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন বিষ্ণু র বাড়ি ।প্রিন্স গোলাম রোডের বাড়িতে ।কবরখানার লাগয়া বাড়ি। শুধু বিষ্ণু দে র বাড়িতেই নয় বিভিন্ন অগ্রজ কবিদের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম পবিত্রদার সৌজন্যে ।
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের বাড়িতেও নিয়ে গিয়েছিলেন পবিত্রদা । অলোকরঞ্জনের বাড়িতে প্রথম ক্রিম  দেওয়া চা পান করেছিলাম । সেই এক কাপ চায়ের স্বাদ  এখনো  মুছে যায়নি । 
তা কত বছর হল।2017 থেকে1967  র  বিয়োগফল যা ঠিক তত বছর। আমি বিয়োগ করতে ভুলে গেছি। আমার পুরোটাই যোগফল ।


(১০)

গতকাল শৈবালের হাত ধরে পবিত্রদা, সেখান থেকে বিষ্ণু দে এবং অলোকরঞ্জন এসে গিয়েছিলেন। পবিত্রদা অবধি ঠিক ছিল । তারপর যাবার কথা প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের 42/B বাড়িটিতে।ওটাই ছিল সাম্প্রতিক  এর আঁতুড়ঘর। আমার  অবশ্য সাম্প্রতিক  এর আগে ছিল জোয়ার।তারও আগে মরাল। ওইসব ক্ষণজীবী ছোটো পত্রিকার নাম  উল্লেখ্য না করলে সত্য বিকৃত হত।
সাম্প্রতিক ছিল সাউথ সাবার্বান স্কুলের প্রাক্তনীদের সাহিত্য প্রয়াস।কাননকুমার ভৌমিক চঞ্চল ভট্টাচার্য  এবং আমাকে প্রধান  উদ্যোক্তা বলে ধরে নেওয়া যায় তাহলে এদের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে  আরো কিছু নাম ।সেসব নাম কাননকে জিগ্যেস না করে লিখবো না।তথ্যে ভুল হয়ে যেতে পারে । 
প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাড়িটি ছিল চঞ্চলদের। আর প্রধান  চরিত্রটির নাম আড্ডা মা ।এই আড্ডা মা কেবলমাত্র চঞ্চলেরই মা ছিলেন এমনটা  আমরা মনে করতাম না।আমরা সকলেই  আড্ডা মা নামেই ডাকতাম ।কেন আড্ডা মা তার কোনো প্রশ্ন তখন মনে  আসেনি । একারণে জানাতে পারলাম কেন আড্ডা মা। তবে  এটুকু  তো বলতেই পারি আড্ডা মা ছিলেন  আমাদের সকলের  নেত্রী । সাম্প্রতিক  এর প্রথম পর্বের নেত্রী ।
আর ছিলেন শচীন ভট্টাচার্য, চঞ্চলের বড়দা।তখনকার নামী নাট্যকার ।খুবই নামডাক ছিল । তবুও  আমাদের মতো বালখিল্যদের অবহেলা করতেন না।পরোক্ষভাবে সমর্থন করতেন ।তখন যেকোনো অফিস ক্লাব বা পাড়ার ক্লাবে শচীনদার নাটকের প্রচুর চাহিদা ছিল । সেকারণে ওনার নাটক প্রকাশকরা ছাপতে না এবং তা বিক্রিও হত প্রচুর ।
এহেন পরিবেশে শুরু হয়েছিল আমাদের কবিতাচর্চা । আড্ডা মার কথা বললাম  আর বেড়ালদের কথা বললাম না তা আবার হয় নাকি । একপাল বেহাল ছিল আড্ডা মা র। তারাও আমাদের সাম্প্রতিক  এর সৎসঙ্গী ছিল ।বেড়ালরা এবং আমরা  একসঙ্গে  আড্ডা মা র স্নেহের আশ্রয়ে ছিলাম ।একে ভুল করে আশ্রমও লেখা যেতে পারে ।
এই আশ্রম থেকেই একবার পৌঁছে গিয়েছিলাম শান্তিনিকেতন আশ্রমে । শৈবালের প্রথম গৃহত্যাগের পর। ওকে ফিরিয়ে আনতে । শ্রীনিকেতনের হোস্টেলে অংশুমানের খপ্পর থেকে ওকে পাকড়াও করে ফিরিয়ে  এনেছিলাম কলকাতায়। অংশুমান ছিল শৈবালের দাদা। সেবার  একটা ঘটনার সাক্ষী ছিলাম কাকতলীয়ভাবে।দেখলাম  একজন অন্ধ মানুষ রঙিন স্লেট জুড়ে জুড়ে ছবি করছেন । এবিষয়ে  আমি যথার্থ  অজ্ঞ ছিলাম। শৈবাল পরে জানিয়েছিল উনি ছিলেন শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। আর উনি যা করছিলেন  তার নাম  ম্যুরাল ।
এখন মনে হয় আমার মতো মানুষের কবিতার জন্য সময় ব্যয় না করে চাষাবাদ করা উচিত ছিল । সেটা করলে অনেকানেক সমস্যা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারতাম ।


(১১)

প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের কাছাকাছি সময়ে গোপালনগরের চা-   দোকানটির কথা না বললে ঘোরতর অন্যায় হবে । প্রতি রবিবার নটার পরে কালীঘাট ব্রিজ হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যেতাম গোপালনগর । মালিক পাঞ্জাবি, তাতে  আমাদের জমায়েতের কোনো অসুবিধা হত না । এই নিরামিষ  আড্ডার প্রধান ছিল শান্তনু দাশ।চা আর চায়ের সঙ্গে টা।শান্তনুর পত্রিকা গঙ্গোত্রী । তখনকার সব থেকে ঝকঝকে পত্রিকা ছিল গঙ্গোত্রী । ভালো ছাপা, ভালো কাগজ , উৎকৃষ্ট প্রচ্ছদ । বেশ লোভনীয় পত্রিকা ছিল । আমার সৌভাগ্য কেবলমাত্র বন্ধুত্বের সৌজন্যে শান্তনু আমার দুর্বল কবিতাও গঙ্গোত্রীতে স্থান দিত।  
এবার  ওই রবিবারের আড্ডাধারীদের কথা লেখার চেষ্টা করি। সব নাম মনে থাকার কথা নয়,মনেও নেই ।যতটুকু  উদ্ধার করতে পারি , ততটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে পাঠকদের ।যে কেউ সংযোজনের জন্য তথ্য দিলে তা সাদরে গৃহীত হবে, কথা দিলাম ।
শান্তনুর সবথেকে কাছের সঙ্গী ছিল গৌতম গুহ। আর ছিল সুশীতকান্তি রায়।খিদিরপুরের দিকে বাড়ি ছিল ।হরিজীবন বন্দ্যোপাধ্যায় কি আমার মতোই ছিল । তবে কাকদ্বীপ থেকে নিয়মিত হাজির হতেন সামসুল হক। আর যাদের কথা মনে পড়ছে তারা হল  সুনীথ মজুমদার  রথীন্দ্র মজুমদার আরো কেউ কেউ ।
নামটা বড়ো কথা নয় শান্তনুর পরিকল্পনা ছিল বিরাট ।পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়  অনেক কেন্দ্র ছিল শান্তনু র। পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যা সেখানে পৌঁছে যেত । আবার ছোটো বড়ো বেশ কিছু পত্রিকার কবিতা বিভাগের দায়িত্ব পালন করতো শান্তনু । এর মধ্যে শ্রীমতী নামের একটা হাফ বাণিজ্যিক পত্রিকার শারদীয় সংখ্যাতে আমার কবিতাও গুঁজে দিত শান্তনু ।হরিজীবনের একটা পত্রিকা ছিল, Kavita বুদ্ধদেব বসুর কবিতা কে নকল করে নামটা দিয়েছিল । শুনেছিলাম বুদ্ধদেব বসু খুবই  অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন । হবারই কথা ।একটু সময় হরিজীবনের সঙ্গে  আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছিল।পার্থ রাহা সম্ভবত গোপালনগরের যাত্রী ছিল ।ওই সময়ে  শান্তনু আমার ঘাড়ে বন্দুক রেখে  একটা কাজ করেছিল। তাহলে ছয়ের দশকের কবিদের কবিতা  সংকলন আজকের কবিতা র সম্পাদক রূপে পরিচিত করে দিয়েছিল ।ওটিই ছিল ষাটের কবিদের প্রথম কবিতা সংকলন ।
পবিত্রদা তখন বেহালায়।সম্ভবত কোনো এক মামার বাড়িতে। মনে পড়ছে বইটির  প্রচ্ছদ করেছিলেন শিল্পী শ্যামল দত্তরায়। সেটা সম্ভব হয়েছিল পার্থ রাহা র তৎপরতায়।পার্থ ক্রমাগত লেগে থেকে প্রচ্ছদটি করিয়ে নিয়েছিল ।
এর ফলে সংকলনটি প্রকাশের পর  আমি রাতারাতি হনু বনে গিয়েছিলাম ।সম্পাদক হিসেবে  আমার নাম ফেলেছিল বেশ ভালো রকম । আবার রাতারাতি কয়েকজনের কাছে  অপ্রিয় হয়ে গিয়েছিলাম । তবে  এটাও স্বীকার করতে  আমার দ্বিধা নেই যে এই প্রকল্প টি ছিল শান্তনু দাশের।
আর একটা কথা তো জানানোই হয়নি তা হল শান্তনু ছিল কবি দিনেশ দাশের ছেলে । হ্যাঁ কাস্তেকবি দিনেশ দাশের ছেলে ।


(১২)

গতকাল গোপালনগরের চা দোকানেরর কথা লিখেছিলাম ।আজ লিখবো কবিতা গ্রন্থাগারের কথা।লেক স্টেডিয়ামের একটা ঘর ব্যবস্থা করেছিলেন স্বদেশদা  এবং শান্তিদা। অর্থাৎ স্বদেশরঞ্জন দত্ত  এবং শান্তি লাহিড়ী । আর আমরা ছিলাম ক্যাডার বা কর্মী । একটা বড়ো টেবিল আর বেশ কয়েকটি চেয়ার। অবশ্যই  চার পাঁচটি আলমারি ।
স্বদেশদা ছিলেন প্রচার বিমুখ কবি ।তদুপরি বন্ধু বৎসল।শান্তিদা ঠিক বিপরীত । অথচ দুজন ছিলেন  অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু । একে অপরের পরিপূরক । অগ্রজ কবিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ব্যাগভর্তি বই সংগ্রহ করে লাইব্রেরিটি গড়ে তুলেছিলেন । মূলত এই দুজনের  উদ্যোগ না থাকলে কবিতার গ্রন্থাগার তৈরি হত না ।একবার যখন প্রায় তৈরি হয়ে যাচ্ছে তখন যোগ দিলাম আমরা কজন কবিযশঃপ্রার্থী যুবক। শান্তিদা তার  আগেই পঞ্চাশের কবিদের কবিতা সংকলন বাংলা কবিতা সম্পাদনা করে ফেলেছেন। আর বাংলা কবিতা নামে একটি অনিয়মিত একটি পত্রিকাও বের করতেন। স্বদেশদা শান্তিদার মতোই অ্যাকটিভ ছিলেন পল্লবদা। পল্লব সেনগুপ্ত । নিয়মিত আসতেন । 
তখন  আমরা এই বহুবচনটির সঙ্গে যুক্ত ছিল পার্থ রাহা  সুনীথ মজুমদার কালীকৃষ্ণ গুহ হরিজীবন বন্দ্যোপাধ্যায় সহ আরো বেশ কয়েকজন । দ্রোণাচার্য ঘোষ সুদর্শন রায়চৌধুরী প্রমুখ মাঝে মাঝে  আসতো। রত্নেশ্বর হাজরা মৃণাল বসুচৌধুরীর গ্রন্থাগারে যাতায়াত ছিল বলেই মনে হচ্ছে  । আর দেবারতি মিত্রকেও আসতে দেখিছি।
আর একটা বলার কথা মনে পড়ে গেল, শান্তিদা আসতেন সাইকেলে মেয়েকে নিয়ে ।মেয়ের বয়স তখন বড়োজোর ছ সাত , কমও হতে পারে ।
পল্লবদার বান্ধবী, পরবর্তীতে স্ত্রী,  আসতেন ।নামটা মনে নাই রাখাটা  অমার্জনীয়  অপরাধ । উনি  একদিন  অনেকগুলি রবীন্দ্রগান শুনিয়েছিলেন।তা এখনো ভুলে যাইনি ।
তখন  আমাদের  অনেকেরই নিজনিজ পত্রিকা ছিল ।আমাদের ছিল সাম্প্রতিক ।কালীকৃষ্ণ আর অশোক দত্ত চৌধুরী বের করতো ক্রান্তদর্শী।সুনীথের ছিল প্রতিবিম্ব ।প্রতিবিম্ব র প্রকাশক ছিল রাণা চট্টোপাধ্যায়। 
সেই সময় সুনীথ আর আমার মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। সুনীথ যাদবপুরে প্রিন্টং টেকনোলজি পড়ত।থাকতো  প্রতাপাদিত্য রোডে।আমার সঙ্গে দৈনন্দিন যোগাযোগ ছিল।বড়ো ভালো কবিতা লিখত। আলোকদা বা আলোক সরকারের পছন্দের কবি ছিল সুনীথ। আলোকদা কালীকৃষ্ণ র কবিতাও খুব পছন্দ করতেন ।
আগামীকাল দুটো চা দোকানের কথা বলব।


(১৩)

দুটি চা দোকান।দক্ষিণের।তখন রেস্তরা বলা হত। আমরা যারা দক্ষিণের তারা দক্ষিণেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করতাম ।উত্তর তখন দূরবর্তী কোনো দেশ।
দুটিই রাসবিহারী মোড়ের কাছাকাছি । অমৃতায়ন ছিল একদম রাসবিহারী মোড়ে।এর পাশেই ইলেকট্রিক বিল জমা দেবার  অফিস ছিল ।এখন ওই চা দোকানের কোনো অস্তিত্ব নেই । উবে গেছে । ওটা ছিল  আমাদের সন্ধের আস্তানা ।প্রায় প্রতিদিনই  আমরা  ওখানে মিলিত হতাম।পরে আসছি সেসব কথায়।
আগে আসি সুতৃপ্তিতে।দেশপ্রিয় পার্কের ঠিক  উল্টোদিকে সুতৃপ্তিতে প্রতি রবিবার সকালে চাঁদের হাট বসতো। প্রথমেই প্রণবদার নাম দিয়ে শুরু করি।প্রণবরঞ্জন রায়ের সামনে কী বিশেষণ বসাতে হবে বুঝতে পারছি না ।প্রণবদাকে  আমি শেষকথা বলার অধিকারী মনে করতাম ।প্রণবদা ছিলেন নীহাররঞ্জন রায়ের সুযোগ্য পুত্র । এত বড়ো মাপের মানুষ, আচরণে কখনোই তা ধরা যেতে না ।আমার মতো গণ্ডমূর্খের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতেন। আর ছিলেন প্রসিদ্ধ শিল্পী শ্যামল দত্তরায়।শিল্পীদের মধ্যে  অনেকেই আসতেন ।গণেশ হালুই এর নামটা মনে  আসছে ।
কবিদের মধ্যে শংকর চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সবথেকে বাঙময়। এখানে হসন্ত দিতে পারলাম না ।তাতে যে শংকরদার গলার আওয়াজ কমে যাবে তা ভাববেন না। মনে  পড়ছে শংকরদা জোর করে আমাকে  আলু খাওয়াতেন । আমি তখন  ঊনচল্লিশ কেজি।শংকরদা চাইতেন আমার ওজন বৃদ্ধি । জানি না শংকরদা আমার  ওজন বাড়াতে পেরেছিলেন কিনা। তবে তখন থেকেই কিছুটা নাম ফেটেছিল  আমার। তা আজকের কবিতা সম্পাদনা করার সূত্রে কিনা বলতে পারবো না।
শংকরদা ছিলেন দক্ষিণের শতভিষা এবং উত্তরের কৃত্তিবাস  এর যোগসূত্র ।আলোক সরকারের যেমন ঘনিষ্ঠ ছিলেন, আবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়েরও নিকটজন ছিলেন । 
প্রণবেন্দুদা মাঝে মাঝেই চলে  আসতেন । বেশি সময় দিতেন শিল্পীদের। আমরা সকলেই যেতাম ।পবিত্রদা রত্নেশ্বর হাজরা কালীকৃষ্ণ অশোক দত্ত চৌধুরী সুনীথ  পার্থ রাহা সহ সকলেই হাজির হত। বলা হয়নি পুষ্কর দাশগুপ্তের কথা।
পুষ্কর পরেশ মণ্ডল সজল বন্দ্যোপাধ্যায় মৃণাল বসুচৌধুরী  রা বের করতেন শ্রুতি। এদের  মধ্যে মৃণাল ছিল আমার কাছের জন।মৃণালের সঙ্গে  অনেক সুখদুঃখের কথা চালাচালি হত ।
সুতৃপ্তিতে সকলের একসাথে বসার সুযোগ হত না । একদল চেয়ারের দখল নিয়ে বসে থাকলে  অন্যরা বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে  চালিয়ে যেত কথাবার্তা । কেউ যদি প্রশ্ন করে জানতে চান কী কথা হত? আমার স্বীকারোক্তি হল তার একবর্ণও মনে নেই ।কিন্তু  মনে না  থাকলেও পরের রবিবারের জন্য  অপেক্ষা করতাম বাকি ছ দিন ।এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবো জানি না ।যেমন জানি না এত জায়গা থাকতে কেন যে সুতৃপ্তিতে  মছে ছিলাম। এর একটা সহজ উত্তর হল লোকেশন।সিনেমায় যেমন দৃশ্য গ্রহণে লোকেশনকে গুরুত্ব দেওয়া  হয় ঠিক  অনুরূপভাবেই সুতৃপ্তিকে নির্বাচন করা হয়েছিল ।যেহেতু  আমি ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচকমণ্ডলীতে ছিলাম না সেহেতু এই প্রশ্নের উত্তর  দেবার দায়িত্বও  আমার নয়। 
আমাদের কবিপত্রর প্রায় সকলেই চলে আসতো সুতৃপ্তিতে ।আমরা দলে ভারী ছিলাম ।দলপতি ছিলেন পবিত্রদা।দ্বিতীয় কোনো দলপতির চিন্তা কখনোই আমাদের মনে  আসেনি ।মৃণাল দত্ত অনন্ত দাশ তো ছিলেন ই।পরবর্তীতে  এসেছিল তুষার চৌধুরী তুষার রায়চৌধুরী সমীর চট্টোপাধ্যায পিনাকী ঘোষ সুকোমল  রায়চৌধুরী মনোজ নন্দী  সহ আরো অনেকেই ।যারা  কবিপত্রর নতুন প্রজন্ম ।
আর একজনের কথা বলতেই হয় নারানখুড়োর কথা ।নারায়ণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন ফরাসি ভাষার শিক্ষক ।আমাদের মতো বাংলাভাষার কবিতালেখকদের তিনি  অবহেলা করতেন না ।তুষার  এবং আমার সঙ্গে  কার্যকারণ অনুযায়ী গভীর বন্ধুত্ব গড়ে  উঠেছিল । সেসব জলযাত্রার অভিযানকথা পরবর্তীতে  আসতে বাধ্য । এখন ছোটোদের ছোটোবেলার ছোটোকথা।
আবছা মনে পড়ছে নবারুণ ভট্টাচার্যকেও সুতৃপ্তিতে আসতে দেখেছি ।বাইরেই থাকত।তবে হাতে  একটা  ইংরেজি পেপার ব্যাক বই থাকতো।কথা হত।ঘনিষ্ঠতা  হয়নি কখনোই । 
আরো কিছু মুখ দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু নাম মনে করতে পারছি না।
শ্যামলদার  উপস্থিতি মনে পড়ছে কিন্তু  তখন সম্পর্ক  গড়ে ওঠেনি । সম্পর্ক গড়ার জন্য সময় দিতে হবে। শ্যামলদা এসে গেলে সবটাই শস্যশ্যামল হয়ে  উঠবে।অন্যকোনো রং  চোখে পড়বে না ।
অপেক্ষা করুন।ব্যস্ত হবার কোনো কারণ নেই ।
নাইট ইজ স্টিল ইয়াঙ্ক।বা
Night is still  young.


(১৪)

গতকাল  অজয় সেনের নামটা লেখা হয়নি সুতৃপ্তি পর্বে।এহেন ভুল অন্য কেউ করলে তাকে লেখা থেকে বাদ থেকে বাদ দিয়ে দিতাম ।কিন্তু নিজেকে কীভাবে বাদ দিতে সেটা জানা নাই থাকায় লেখাটা চালিয়ে যেতে হয়।পিনাকীর মনে পড়া  আর আমার মনে পড়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে বলে আমি মনে করি না ।
তো  অজয়কে নিয়েই আজকের লেখা শুরু করছি । আমাদের দুজন  অজয় ছিল । একজন নাগ  অন্যজন সেন। অজয় নাগ বেশি পরিচিত ছিল ।তার তিনটি বেড়ালের জন্য ।বই এর নাম ধরেই পরিচিতি ।আর সেন অজয় থাকতো  আমাদের এখানকার বাসস্থান পটলভাঙার খুব কাছাকাছি ।মির্জাপুরের একটা মেসবাড়িতে।আমি বয়সে কিছুটা বড়ো হলেও আমাদের বন্ধুত্বে কোনো সমস্যা হয়নি।অজয়কে কখনোই নিজের কবিতা নিয়ে ছোটাছুটি করতে দেখিনি । সুতৃপ্তি থেকে বেরিয়ে পাশের পানদোকানেও গেছি  একত্রে ।
আর শিল্পী  অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা ধরিয়ে দিয়েছে অতনু ।অতনুকে ধন্যবাদ । আমি তো বলেছি রেখেছিলাম সুতৃপ্তি ছিল শিল্পীদের দ্যাখা সাক্ষাতের জায়গা ।
গতকাল  অমৃতায়ন দিয়ে শুরু করলেও কিছু বলা হয়নি । সন্ধেবেলা চলে আসতাম অমৃতায়নে।পবিত্রদা কাননকুমার ভৌমিক অনন্ত দাশ সহ আরো অনেকেই।ওখানে সুনীথও আসতো।চণ্ডী মণ্ডলও হাজিরা দিত ।অমৃতায়ন ছিল  আমাদের কবিপত্রর নিজস্ব চা দোকান । অমৃতায়নে  একাধিক দিন ছাতা ফেলে রেখে বাড়ি চলে গেছি।পরদিন সকালে নিয়ে এসেছি ।ঘনিষ্ঠতা বোঝাতে ছাতাকে টেনে বের করলাম ।ঝুলি থেকে কোনো বেড়াল কিন্তু  এই মুহূর্তে বের করতে চাইছি না ।বেড়াল ঝোলাতেই থাকুক এখন বরং লেখকদের রাইটার্স এ যাওয়া যাক। আমি 1966 ব্যাচের কেরানি । আমার  অনেক আগেই রাইটার্সে  ছিলেন তারাপদ রায় হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় সমীরকান্তি বিশ্বাস দেবপ্রসাদ মৈত্র কালীকৃষ্ণ গুহ মুকুল রায় প্রমুখ কবিলেখকরা।প্রণব মুখোপাধ্যায় নামে একজন ছিলেন জানতাম  ।তবে  আমার সঙ্গে খুব একটা দ্যাখা দ্যাখাসাক্ষাৎ হয়নি কখনোই ।
আমাদের আড্ডা হত  তারাপদদাকে কেন্দ্র করে ।তারাপদদার সঙ্গে  অনেকেই দ্যাখা করতে আসতেন । হিমানিশ গোস্বামী তুষার রায় তো আসতেনই আরো অনেকেই আসতেন ।
তারাপদদা তারাপদ তখন  একটা নতুন পত্রিকা বের করেছিলেন ।কয়েকজন।তারাপদদা বলতেন হাউজজার্নাল। ওই পত্রিকার প্রায় প্রতিটি সংখ্যাতেই আমার কবিতাও স্থান পেত ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে।
পরে এই আড্ডা চলে গেল হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের কব্জায়। অফিস এক ।কিন্তু টেবিল  আলাদা।হৃষিকেশ  আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু ছিল সেসময়।হৃষিকেশের  একটা পত্রিকা ছিল  অধুনা, পরে সেটাই অধুনা সাহিত্য । সম্পাদক হিসেবে নাম ছাপা হত সুধাঙ্কুর মুখোপাধ্যায়ের ।কিন্তু  আমরা সকলেই জানতাম  অধুনা সাহিত্যের মূল কর্মকর্তা ছিল হৃষিকেশ । অধুনা সাহিত্য আমার গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা প্রকাশ করে আমাকে  উৎসাহিত করেছে।
আমার কর্মস্থল ছিল রাইটার্সের পাঁচ নম্বর ব্লকের তিন তলায়। আর তারাপদদা হৃষিকেশরা দোতলায়। ওই পাঁচ  নম্বর ব্লকেই ।
হৃষিকেশের  আকর্ষণে এসে উপস্থিত হতেন রবীন সূর  অমল চন্দ প্রমুখ আরো কেউ কেউ ।
কিছু দিনের মধ্যেই জানতে পারলাম কালীকৃষ্ণ গুহও রাইটার্সে ।PWD Roads  এ।আর অবস্থানগত ভাবে জি ব্লকের চারতলায়।কাছের লোকের উপস্থিতি হল কাজের জায়গায়। এর থেকে আর কী ভালো হতে পারে একজনের কর্মস্থল ।
আমার মনে হয় আমার থেকে ভাগ্য নিয়ে  আর কেউই চাকরি করতে আসেনি ।
আমাকে ঈর্ষা না করার কোনো কারণ খুঁজে পাই না  আমি ।
আরো অনেক অলৌকিক ঘটনা এবং ব্যক্তিত্ব  আগামীদিনে সুন্দরের দিকে নিয়ে যাবে  আমাকে ।তার অংশীদার হবেন আপনারা।Good Night. .

(১৫)

নৈহাটি হালিসহর পরে আসবে।আগে একটু আগের কথা বলে রাখি ।
সাম্প্রতিক প্রথম সংখ্যা বেরিয়েছিল কোনো এক পুজোর ছুটির ঠিক  আগে।বাসুদেবপুর যাবার আগে সব করেছিলাম তাড়াহুড়ো করে ।প্রকাশক ছিল দীপক চৌধুরী, মেজভাই ।ঠিকানা 36D, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের । অর্থাৎ  আমাদের বাড়ির । পরের সংখ্যা থেকেই সাম্প্রতিক  পর্ব ধরা হয়।কিন্ত শুরুর আগের কথা লিখলাম । আমার প্রথম বন্ধু দীপংকর সরকারও সাম্প্রতিক এর প্রস্তুতিপর্বে যুক্ত ছিল ।এই দীপংকর পরবর্তীতে দীপংকর স্যার, পাঠভবনের  অঙ্কের শিক্ষক । আর ছিল  অনিল কাজল শৈবাল সহ আরো অনেকেই ।জয়ন্ত দত্ত প্রথম জীবনে সাম্প্রতিক এ ছিল।পরে খেলাধুলোর বেশ কিছু বই লিখে রীতিমত নামী লেখক হয়ে যায়। প্রকাশকরা তাগাদা দিয়ে জয়ন্তকে দিয়ে বই লেখাতো।
এবার কবিপত্র বা পবিত্রদার সঙ্গে যুক্ত হবার দিনটিকে দ্যাখার  এবং দ্যাখানোর চেষ্টা করি।
পবিত্রদা তখন বেহালার নিরাপদ জীবনকে তোয়াক্কা না করে কেবলমাত্র লেখালেখির স্বার্থে চলে এসেছেন ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটের বাড়িতে।রাসবিহারী মোড়ে দ্যাখা। টানতে টানতে নিয়ে গেলেন নতুন আস্তানায়। সেদিন থেকেই নিজেকে কবিপত্রর  একজন হিসেবে দেগে দিলাম । কবিপত্রর নতুন সংখ্যার প্রস্তুতি চলছিল তখন । সেদিন কাননকুমার ভৌমিকও সঙ্গে ছিল বা কাননের সঙ্গী ছিলাম  আমি।
তার আগেই সাম্প্রতিক প্রকাশিত হয়ে চলেছে।তাছাড়া আজকের কবিতা সংকলনটিও বাজারে চালু আছে।বাজার শুনে কেউ বিগবাজার ভেবে বসবেন না।দু চারটে বইদোকান কিংবা পত্রিকার স্টলেই সীমাবদ্ধ ছিল সেই বাজার ।তাতেই বা কী।আমাদের দম্ভ কিন্তু  এক ছটাকও কম ছিল না,  আজ কফিহাউসে তো কাল বারদুয়ারিতে কাক মারছি বক মারছি  । নিজেকে কবিতার দূত ভাবতে শুরু করে দিয়েছি । 
পবিত্রদা সেসময় প্রায়  একা হয়ে গিয়েছিলেন।যোগাযোগহীন হয়ে পেরেছিলেন ।ঠিক একা নয় পবিত্রদার সঙ্গে তখন ছিল  অতীন রায়চৌধুরী ।গদ্য লেখার কলম ছিল । কবিপত্রর নতুন সংখ্যা তে একটা কবিতা বিষয়ক গদ্য ছিল অতীনের।সেই গদ্যে রত্নেশ্বর হাজরা  এবং কালীকৃষ্ণ গুহকে কদর্য ভাষায় আক্রমণ করা হয়েছিল।বলতে দ্বিধা নেই  সেই আক্রমণকে মেনে নিয়েছিলাম চোখ বন্ধ করে ।
এই প্রসঙ্গে  আমার একটা উপলব্ধির কথা অকপটে জানিয়ে রাখি । পাঁচের দশকের কবিরা সবসময়ই সংঘবদ্ধ থেকেছিলেন।শেষ দিন পর্যন্ত  একত্রে ছিলেন। একবার ভেবে দেখুন কৃত্তিবাস  এর প্রথম সংখ্যাতেই প্রকাশিত হয়েছিল শঙ্খ ঘোষের দিনগুলি রাতগুলি।কবিতা কবিতাভাবনা এবং জীবনযাপন কোনো কিছুর সঙ্গে কৃত্তিবাস  এর  সঙ্গে শঙ্খ ঘোষের একবিন্দুও মিল ছিল না ।তবু বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে বাইরের পরিবেশগত কোনো প্রভাব কারো মনকে প্রভাবিত করতে পারেনি।এর জন্য সব কৃতিত্বটাই  একক ভাবে দাবি করতে পারতেন সুনীলদা অর্থাৎ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।কিন্তু কোনোদিনই তিনি তা দাবি করেননি।এখানেই সুনীলদার মহত্ব।
সুনীলদা তাঁর বন্ধুদের জন্য যা করেছেন তা খোলাখুলি লিখলে এখন দাঙ্গা লেগে যাবে। আর তাছাড়া সুনীলদা কখনোই তাঁর মহত্ত্বগুলিকে প্রকাশ্যে আনতে চাননি আমি কোন অধিকারে সুনীলদার এই না চাওয়াকে অমান্য করবো।
আমাদের দশকের ক্ষেত্রে ঠিক  এর উল্টো ছবি । একজন অন্যজনের বিরুদ্ধে হাতে খাঁড়া তুলে নিতেন। এর জন্য কে কতটা দায়ী তা এই মুহূর্তে  তুলে ধরার সাহস আমার নেই ।
এর ফলে আমার সঙ্গে সুব্রত চক্রবর্তী বা ভাস্কর চক্রবর্তী র কখনোই ঘনিষ্ঠতা হয়নি।সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি শামসের কিংবা  মানিকের সঙ্গে । আমাদের মধ্যে  একমাত্র কালীকৃষ্ণ র সঙ্গে  ওদের সুসম্পর্ক ছিল ।
আসলে আমরা যে যার তৈরি কুয়োর মধ্যে থাকতে চেয়েছিলাম, এতে আমাদের বাইরের দিকে শ্যাওলা পড়লেও ভেতরটা কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল তার বিচার করবে মহাকাল নামক এক দৈত্য ।
তবে আমি নিশ্চিত আমাদের দশকে  একজন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থাকলে এমনটা কিছুতেই হত না ।হতে দিতেন না সুনীলদা ।

(১৬)

আজ তরুণদা চলে গেলেন ।তরুণ সান্যালকে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে পেয়েছিলাম ।সেটা আমার সৌভাগ্য বলতে দ্বিধা নেই । তবে সেটা পরিচয়-পর্ব। এখনো দেরি আছে পরিচয় এ পৌঁছতে 
এখন কবিপত্র - কাল।পবিত্রদা  এখন  ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটের সাজানো বাড়িতে ।পবিত্রদা তখন চেতলা স্কুলের বাংলাশিক্ষক।বাড়িতে টোল। একদল টগবগে ছাত্র । তবুও কবিপত্রর কাজকে প্রাধান্য দিতেন। কাননকুমার ভৌমিক চণ্ডী মণ্ডল এবং আমি পৌঁছে গেলেই ছাত্ররা বুঝে যেত এখন শুরু হবে কবিতা । কেউ কেউ আমাদের  আলোচনায় মনোনিবেশ করত। সম্ভবত সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ও সেই ছাত্রদলের একজন ছিল ।এই সঞ্জয়  এখন স্বনামধন্য ফিল্ম বিশেষজ্ঞ । স্কুলের পর সঞ্জয়  ইন্জিনিয়ারিং ভর্তি হয় এবং পাশটাশও করে।পরে কিছুদিন চাকরিও করে।সম্ভবত ত্রিপুরাতেও কাজ করে এসেছিল ।
কিছুদিন পর পবিত্রদা বাড়ি বদলালেন।চলে এলেন 22 B প্রতাপাদিত্য রোডের তিনতলায়। এই বাড়িই ছিল  আমাদের স্বর্গ মর্ত্য পাতাল।যত রকম  অত্যাচার করা সম্ভব তার থেকে অনেক বেশি অত্যাচার করেছি।অথচ পবিত্রদার স্ত্রী মিনুদি হাসিমুখে সব সহ্য করেছেন ।মিনুদি র সমর্থন  এবং সহযোগিতার কোনো তুলনা আমার কাছে নেই ।এখন অনেকেই যূথিকার কথা বলে।কিন্ত মিনুদি মিনুদিই।
তখন  ওখানে এসেছেন প্রায় সকলেই । কবি  এবং গল্পকার প্রায় সমান সমান ।কবিদের মধ্যে মৃণাল দত্ত  অনন্ত দাশ শিবেন চট্টোপাধ্যায় কাননকুমার  তুষার চৌধুরী বাপ্পা বা অনন্য রায় দীপেন রায় শিশির সামন্ত  অঞ্জন কর সুকোমল রায়চৌধুরী মনোজ নন্দী সহ আরো অনেকেই নিত্যযাত্রী ছিল  এই তীর্থের ।
এবার গল্পকারদের কথা বলা যাক ।আমাদের চণ্ডী মণ্ডল সুবিমল মিশ্র  অমিয় সিংহ তো ছিলই ।আর পবিত্রদার ঘনিষ্ঠ  আশিস ঘোষ রমানাথ রায় সুব্রত সেনগুপ্ত  রা প্রায়ই আসতেন ।নতুন ভাবে যুক্ত হয়েছিল অমর মিত্র শচীন দাশ  অসীম চক্রবর্তী দীপংকর দাশ প্রমুখ আরো অনেকেই ।ডায়মন্ডহারবার থেকে মাঝেমধ্যে হাজির হত ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায় ।আর একসময় সন্দীপ সরকার যুক্ত হলেন আমাদের সঙ্গে ।সন্দীপ একসময়  Frontier নামক বিশিষ্ট ইংরেজি পত্রিকার কলাসমালোচক ছিলেন।পরে দেশ আনন্দবাজার ।
এই সময়ে  আমরা দুটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ।
প্রথমটি হল কবিপত্রর বিশেষ গল্প সংখ্যার প্রকাশ ।দ্বিতীয়টি কবিপত্র শিল্পসংখ্যা।
এই দুটি সংখ্যার সার্থক প্রকাশ কবিপত্র কে  একলাফে লিটল ম্যাগাজিনের শীর্ষে স্থাপন করলো। পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র  আমরা অভিনন্দিত হলাম । 
দু একটা অত্যাচারের কথা না বললে পাপ হবে।তুষার চৌধুরী এবং আমার প্রাত্যহিকতায় তখন বারদুয়ারি জায়গা করে নিয়েছে ।অফিস ছুটির সমিতির তুষার চলে আসত আমার  অফিসে ।তারপর দুজনে হাঁটাপথে বারদুয়ারিতে ।যতটুকু সময় দেওয়া আবশ্যক, ঠিক ততটুকুই সময় দিতাম । তারপর বাইশের বি,অর্থাৎ পবিত্রদার বাড়ি বা কবিপত্র দপ্তর। আমার তখন একটা  অভ্যেস ছিল  জন্মদিনের পোশাকের প্রতি প্রগাঢ়  আকর্ষণ ।ঘরে ঢুকেই প্রথম কাজ ছিল জন্মদিনের পোশাকটা পরে নেওয়া ।মনে  আছে পবিত্রদা ঘরের পবিত্রতা রক্ষার জন্য একটা চৌকো বালিশ ছুঁড়ে দিতেন আমার দিকে ।তবে এই প্রসঙ্গে  একটা কথা জানিয়ে রাখি আমি কিন্তু তালে ঠিক থাকতাম।বুঝে যেতাম এখন মিনুদি বাড়িতে নেই ।
পবিত্রদা বিষয়টিতে মজা পেতেন এমনটাই  আমি মনে করতাম ।
সেই দিনগুলি আর ফিরে আসবে না ।
আজ যখন এই লেখাটা লিখছি তখন চণ্ডী নেই, তুষার নেই , বাপ্পা নেই, শচীন নেই  ।এই না থাকাগুলিকে ঠিক কী ভাষায় কী পদ্ধতিতে  অনুবাদ করতে হবে তা  আমার জানা নেই । এরকম ঘটনার কথা যেন আর কাউকে লিখতে না হয়।
(১৭)

যারা নেই তাদের  অনেক কথা থেকে গেছে।লেখা থেকে গেছে ।কথাগুলো আমরা শুনব।লেখাগুলো পড়ব। আমি  চেষ্টা করব কিছু লেখার ।তবে মনে রাখতে হবে  আমার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কথা। আমি নেহাতই একজন ক্ষুদ্র কবিতালেখক। প্রয়োজনে টুকটাক গদ্যও লিখেছেন থাকি। তবে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যে গদ্য গুলি লিখি বা লিখতে বাধ্য হই সেগুলি এই গোত্রের নয়। সেগুলি একদিকে  আত্মরক্ষার গদ্যও।তার সঙ্গে  এই স্মৃতিচারণকে  এক গোত্রে ফেলা ঠিক হবে না ।
যারা চলে গেছে তাদের মধ্যে চণ্ডী মণ্ডল সব থেকে পুরোনো বন্ধু । চণ্ডী দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার  এক গ্রাম থেকে  আসা ছাত্র ।পড়তো চারুচন্দ্র কলেজে।থাকতো লেক গ্যারেজ লাগোয়া এক মেসবাড়িতে ।
চণ্ডী কলকাতা  আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে তাকে লেখক হতে হবে ।গল্প লিখতে হবে।উপন্যাস লিখতে হবে । পরীক্ষা দিতে হবে, পাশ করতে হবে  এসব তুচ্ছ বিষয়ে  কখনোই  ওকে চিন্তা করতে দেখিনি ।দেখা হলেই গল্পের কথা ।গল্পের পরিকল্পনার কথা । গল্প ছাড়া  আর কোনো কিছুই জানত না চণ্ডী ।
চণ্ডীর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় সাম্প্রতিক এ। আমরা যে কবিতা নিয়ে  উদয়াস্ত পরিশ্রম করে চলেছি সেটা ও কোনোদিনই  পাত্তা দেয়নি ।অথচ আমরা ওর নিয়ে গলা ফাটিয়েছি সর্বত্র ।
চণ্ডীর গল্পের মধ্যে  আমরা  আবিষ্কার করতাম গ্রামবাংলার  এক নতুন রূপ ।যা তারাশঙ্কর কিংবা বিভূতিভূষণের মতো নয়। আবার গ্রাম্য গল্পও নয়।চণ্ডী গ্রামের ছেলে হলেও ওর মধ্যে বিন্দুমাত্র গ্রাম্যতা ছিল না । একশো পার্সেন্ট নাগরিক ছিল ।বলতে দ্বিধা নেই আমার মধ্যে যে গ্রাম্যতা ছিল এবং এখনো বর্তমান তা চণ্ডীর মধ্যে ছিটেফোঁটা ছিল না । কারণটা  এখন বুঝতে পারি, চণ্ডী জানতো লেখার মধ্যে গ্রাম্যতা প্রকাশের কোনো স্থান নেই ।
শুনলে অবাক হয়ে যাবেন চণ্ডী  একটা গল্প ছাপতে দেবার আগে কমপক্ষে দশ থেকে পনেরো বার লিখত বা লেখার পরিশ্রম করতো। এতো আর দশ লাইন বারো লাইন নয় যে কপি করে দিলাম দশ মিনিটের মধ্যে ।দশ পনেরো পাতা । এবং দশ পনেরো বার। আমি যেসব মহান কথাকারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলাম তাঁরা কোনো লেখাই একবারের বেশি দুবার লেখেননি। আমি নিজে কী কবিতা কী গদ্য, কোনো লেখাই দুবার লিখি না।তাহলে চণ্ডীর এই বারবার লেখার উল্লেখ করছি কেন? এ ব্যাপারে চণ্ডীর গুণগান করছি কেন ।আসলে চণ্ডী তার নিজের লেখা গল্পতে সন্তুষ্ট হতে পারতো না । এই অতৃপ্তি থেকেই ও নিজের গল্পের ঘষামাজা করতো।একবার চণ্ডী  একটা  উপন্যাস লিখে ফেলল। হাত নেই ।যা বাংলা সাহিত্যের সম্পদ।ছাপা হল কবিপত্র এ।পবিত্রদা সহ আমরা সকলে মেতে রইলাম হাত নেই নিয়ে ।জানি না  এই লেভেলের উপন্যাস সমগ্র বাংলাসাহিত্যে কটি আছে।
এবার কিছু ব্যক্তিগত কথা বলে রাখি । এক সময় মেসবাড়ির টাকা সময় মতো দিতে পারলো না ।মেস ছেড়ে দিতে হবে ।চিন্তার ব্যাপার ।সকলের ।অবশ্য চণ্ডীর মধ্যে কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না ।পবিত্রদা কাননকুমার আমি সকলেই ভাবছি কী করা যায়।দিদিমা কে জানালাম পুরো বিষয়টি ।দিদিমা এক মুহূর্ত চিন্তা না করেই বিধান দিল চণ্ডী  আমাদের বাড়িতেই থাকবে ।আমরাও চিন্তা মুক্ত হলাম ।চণ্ডীকে দেখে মনে হল ও যেন আগে থেকেই জানতো ও আমাদের বাড়িতেই থাকবে।মেস থেকে বইখাতা সব নিয়ে চলে এল।
চণ্ডী তখন দু চারটে টিউশনি করতো।মাসের প্রথম দিকে সেইসব টিউশনির মাইনে পেত। আমরা  আশা করতাম আমাদের ধারবাকির কিছুটা ফেরত পাবো। কিন্তু  আমাদের সকলকে  অবাক করে চণ্ডী  এককৌটো গোল্ডফ্লেক অর্থাৎ একটিন গোল্ডফ্লেক নিয়ে হাজির হত।যার একটি দুটি আমরাও পেতাম । আসলে চণ্ডী সবসময়ই নিজেকে সম্পন্ন মনে করতো। নিজেকে অভিজাত ভাবতো।
দৈন্য  বা দীনতা থেকে নিজেকে দূরে রাখা একটা  বৈশিষ্ট্য যা চণ্ডীর মধ্যে যতটা দেখেছি আর কারো মধ্যেই  তা প্রত্যক্ষ করিনি ।
চণ্ডীর সঙ্গে স্বস্তির সম্পর্ক  এবং পরিণতিতে পরিণয় সেসব কথা সময় মতো আসবে।অনেক  পরের একটা ঘটনার কথা বলে রাখি চণ্ডীর চরিত্র সম্পর্কে । আমার বিয়ের পর সস্ত্রীক নিমন্ত্রণ চণ্ডী  স্বস্তির বাড়িতে ।ওরা তখন বাগবাজারের বাড়িতে ।ওই বাড়িতেই থাকতেন বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব গঙ্গাপদ বসুর পরিবার।
চণ্ডীরা সেদিন যে সাইজের পাবদামাছ প্লেটে দিয়েছিল তার মাথাএবংলেজা প্লেট থেকে বেরিয়ে ছিল তিন চার আঙুল করে।পাবদা ছাড়াও আমার অতিপ্রিয় খাসির মাংস ছিল একবাটি।
বেশি লিখলে নিন্দুকেরা বলে বেরাবে আমি পেটুক।
ভেবেছিলাম  আজই তুষার চৌধুরী পর্বে চলে  আসতে পারবো।হল না । তা না হোক , কাল তো হবে।
(১৮)

গতকাল লিখেছিলাম আজ তুষার চৌধুরীর কথা লিখবো।কিন্তু কতটা এবং কীভাবে লিখবো তা নির্ণয় করা ততটা সহজ নয়। সবটা খোলাখুলি লেখার হিম্মত  আমার নেই ।প্রথমেই এই স্বীকারোক্তি করে রাখতে বাধ্য হলাম । এমন  অনেক কথা  আছে যা বলার ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা নেই কিন্তু লিখতে গেলেই নানা পিছুটান টেনে ধরে রাখে। 
আমি চেষ্টা করব যাতে ভারসাম্য বজায় থাকে । কথা দিলাম তুষার কিংবা আমাকে পাঠক যেন ভুল না বোঝেন।
তুষার তার প্রথম লেখা কবিতাটি পাঠিয়েছিল ডাকযোগে।সাম্প্রতিক এর জন্য ।তখন ধ্বংসকালীন কবিতা আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে ।প্ররকের নাম
তুষারকান্তি চৌধুরী ।সেই নামেই ছাপা হয়েছিল কবিতাটি। কাননকুমার ভৌমিক  এর পূর্ণ সমর্থন ছিল তুষারের প্রতি । আর আমি তো আত্মহারা ।আর এক পিস চৌধুরী পাওয়া গেছে ।
এই তুষার কিছু দিনের মধ্যেই আমার একান্ত আপনজন হয়ে উঠলো ।বা তুষারের আত্মজন হয়ে উঠলাম আমি ।তা যায় হোক না কেন আমরা  অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধনে যুক্ত হয়ে গেলাম।সেই 1969-70 এর বাঁধন কবিতা পাক্ষিক এর প্রথম পর্ব পর্যন্ত  অটুট ছিল ।
তুষার কবিতা লেখার জন্যই  এই পৃথিবীতে এসেছিল। কবিতাযাপন এই শব্দবন্ধটি যেন তুষারের জন্যই সৃষ্টি হয়েছিল । তখন বাইশের বি ছাড়াও আরও একটা ঠিকানা পেয়ে গেছি আমরা ।তা হল 36D, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট ।অর্থাৎ আমার বাড়ি।
তবে এই প্রসঙ্গে আরো একটা কথা জানিয়ে রাখি , তাহল তুষারের সঙ্গে দ্যাখা হবার আগে দ্যাখা হয়েছিল বাপ্পা বা অনন্য র সঙ্গে ।পবিত্রদা হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন কবি মণীন্দ্র রায়  এর বাড়ি।বাপ্পা মণিদার ছেলে।তখন স্কুল ছাত্র ।সম্ভবত সাউথ পয়েন্ট স্কুল।ক্লাস সেভেন এইট হবে বড়জোর ।তখন থেকেই কবিতায়।এরকম বাল্যপ্রতিভা দেখা যাবে প্রচুর ।কিন্তু ধরে রাখতে পারে না কেউই।ব্যতিক্রম  অনন্য রায়।
হচ্ছিল তুষারের কথা, এসে পড়ল বাপ্পা । এমনটাই হবার কথা ।তুষার এবং বাপ্পা আমার কাছে  অভিন্ন।
তখন আমার বারদুয়ারি পর্ব শুরু হয়ে গেছে ।শুরুর কথাটা না লিখলে মজাটাই মরে যাবে ।
হাংরি আন্দোলনের সুভাষ ঘোষ একদিন বললেন শণিবারে খালাশিটোলায় চলে  আসুন ।আমি তখন খালাশিটোলা চিনি না,  একথা বলব কোন মুখে ।কবিতা লিখি আর খালাশিটোলা চিনি না তা আবার বলা যায় নাকি ।বললাম ঠিক আছে ।সুভাষ জেনে গেলেন আমি যাচ্ছি খালাশিটোলায় ।
দেখতে দেখতে শনিবার এসে গেল।শনিবারের না  আসার কোনো সুযোগ নেই, তাকে আসতেই হবে।বিকেল এল।কিছুটা জানতাম যে খালাশিটোলা ওয়েলিংটনের কাছাকাছি ।ওয়েলিংটন চেনা শব্দ ।সেই শব্দটির কাছে পৌঁছে গেলাম, এবার পথ দ্যাখাবে কে।ট্রাফিক পুলিশ ছিল, কিন্তু লাল পাগড়ি না থাকায় পুলিশকে অ্যাভয়েড করলাম ।জানা ছিল মদ্যপ এবং রিক্সার একটা ঘনিষ্ঠ এবং গোপন যোগসূত্র আছে ।রিক্সাওয়ালাকে বললাম ইঁয়া দারু কা দুকান কীধার? রিক্সা  অলা হাতেরইশারায় দেখিয়ে দিল সেই পথ। আমি ওই রিক্সা অলাকে চিনি না ।কিন্তু সে আমার যে উপকার করছে তার কোনো তুলনা নেই ।
আমি রিক্সা অলা নির্দেশিত পথে এগিয়ে গেলাম । কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার নাক আমাকে জানিয়ে দিল আমি সঠিক পথেই যাচ্ছি ।শেষে গন্ধ  শুঁকে ঢুকে পড়লাম।দেখেই মনে হল এটা খালাশিটোলা নয়।বারদুয়ারি ।
ওপরে  উঠে গেলাম । একটা ছোটোখাটো ঘর।শ্বেতপাথরের টেবিল ।মাথার মধ্যে উদিত হলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ। কনফার্ম হলাম পৌঁছে গেছি বারদুয়ারিতে ।এখন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কে ছেড়ে  অন্যত্র যাবো কীভাবে, তা না জানার কারণে  আশ্রয় নিলাম বারদুয়ারিতে

(১৯)

এখন জলযানে আছি ।জলযাত্রায় আছি ।জলযান থেকে কিছুক্ষণের জন্য নামতে না পারলে অনেকগুলি জরুরি কথা হারিয়ে যাবে।এখন সেইসব কথাগুলি বলার চেষ্টা করি ।
প্রথমেই জানিয়ে রাখি রাসবিহারী মোড়ের লাগোয়া একটা বাড়িতে থাকতেন কবি আলোক সরকার । চাকরি করতেন বর্ধমানের শ্যামসুন্দর কলেজে ।রবিবার সকালে আমরা দল বেঁধে পৌঁছে যেতাম আলোকদার বাড়ি।একটাই ঘর।তাতে আমরা মানিয়ে নিতাম।কখনোই মনে হয়নি ঘরটা আর একটু বড়ো হলে বেশ হত। আলোকদার স্ত্রীর নামও মিনু।আমরা মিনুদি বলতাম। বরাদ্দ ছিল চা বিস্কুট।কবিতা নিয়ে কথাবার্তা হত।কালীকৃষ্ণ সুনীথ অশোক দত্ত চৌধুরী নরেশ কাননকুমার আর আমি যেতাম ।রাণা চট্টোপাধ্যায়ের যাওয়ার সম্ভাবনা হয়ত ছিল ।
তখন শতভিষা চলছে । দীপংকর দাশগুপ্ত তরুণ মিত্র এই দুজন ছিলেন শতভিষার কোর কমিটির । আমার কিন্তু মনে হত শতভিষার সর্বাধিনায়ক আলোকদা ।কেন মনে হত বলতে পারবো না । শংকরদাও এই আড্ডায় মাঝে মাঝে আসতেন। 
আরো একটা কথা খুবই সঙ্কোচের সঙ্গে বলছি আলোকদা কালীকৃষ্ণ সুনীথ দের বেশি পছন্দ করতেন ।আমরা মনে মনে হিংসা করতাম কালীকৃষ্ণদের।সেই হিংসা নেহাতই অমূলক ছিল হয়তবা। 
একটা সময় আমরা বলা শুরু করেছিলেন গাছফুলপাতা সর্বস্ব কবিতা আমরা পছন্দ করি না ।রক্ত মাংস হীন কবিতার বিরুদ্ধে আমরা ।এই আমরার মধ্যে পবিত্রদাও ছিলেন । 
এসব তখন যেমন ছিল এখনো আছে ।এসব কথা না বললে সত্যের অপলাপ হত।
আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছি , এখন শুনলে মনে হবে বানিয়ে বলছি ।কথাটি হল সেই সময়ে আমরা সকলেই ধরে নিয়েছিলাম আলোক-অলোক জুটিই বাংলাকবিতার প্রধান দুই কবি।অর্থাৎ আলোক সরকার এবং অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ।
এই প্রসঙ্গে শেষ কথাটি হল ওই বাড়িতেই থাকতেন কবি অরুণকুমার সরকার ।আলোকদার দাদা।অরুণদা এক সময় বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকার অন্যতম পরিচালক ছিলেন ।অরুণদা আমাদের লক্ষ করতেন  ওঠানামার সময় কিংবা আলোকদার ঘরে ঢোকার এক চিলতে ভেতরের বারান্দায়।বাইরের বারান্দা দিয়ে রাসবিহারীর ট্রামরাস্তা দ্যাখা যেত।
অরুণদা আমাদের আসাযাওয়া দেখলেও কখনোই গুরুত্ব দেননি ।এটা এখনো মনে আছে ।

রাইটার্সে কর্মরত কবিজনদের কথা আগে বলেছি 
তখন বলা হয়নি রত্নেশ্বর হাজরার কথা ।রত্নেশ্বরদা বসতেন প্রক্টেটেট জোনে।সব সময় যাতায়াত সম্ভব ছিল না । লেখা নিতে যেতেই হত।মৃদুভাষী রত্নেশ্বর কখনোই আত্মপ্রচারে মন দিতেন না ।নিজের মনে নিজের লেখা লিখে যেতেন।
আর অনেক পরে পার্থদা অর্থাৎ পার্থসারথি চৌধুরী এলেন রাইটার্সে ।ওনার ঘরে আমার প্রবেশ ছিল অবারিত ।পার্থদাকে নিয়ে আরো অনেক কথা চলে আসবে পরের ঘটনাক্রমে । 
নাসের, দুই দেবাশিস চাকী এবং চট্টোপাধ্যায় অরূপ দের কথা আসতে এখনো অনেক দেরি ।
একতলার বি টি অফিসে একজন ছিলেন, নামটা মনে আসছে না, তারা একটি পত্রিকা করত।নাম শস্য ।পরে জেনেছিলাম শস্য র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন উৎপল চক্রবর্তী ।যিনি পরে ছান্দারের  অভিব্যক্তির প্রাণপুরুষ রূপে চিহ্নিত হন।এই উৎপল চক্রবর্তী যাঁকে আমি ছোটদা বলে ডেকে এসেছি এই সেদিন পর্যন্ত ।আজ ছোটদা থাকলে এই লেখা পড়ে খুবই খুশি হতেন ।
দু এক দিন নরেশ গুহর বাড়িতেও গেছি ।নরেশ গুহ ছিলেন বুদ্ধদেব বসুর দক্ষিণ হস্ত ।বা ডানহাত।কবিতা পত্রিকার অন্যতম কর্ণধার ।খুবই মিতভাষী ছিলেন ।তখনও ওনার দুরন্ত দুপুর মধ্য গগনে ।ওনার সঙ্গে ব্যাক্যালাপে খুবই সঙ্কোচ বোধ করতাম ।তবুও কী একটা  আকর্ষণ ছিল ।চলে যেতাম ।এখন মনে হয় প্রত্যেক কবিরই এইরকম আভিজাত্য থাকা উচিত ।আমার মতো সব তরুণকে কোলে তুলে নেওয়াটা ঠিক নয়।কিন্তু যারা যা স্বভাব তা কি পাল্টানো সম্ভব। সম্ভব নয় বলেই পদেপদে এত অপবাদ এত  লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়।
এতে যে কিছুই যায় আসে না, সেটুকু বুঝি।আর বুঝি বলেই আমার হাত থেকে কেউ চলমান কেটে নিতে পারেনি ।যা লেখার কথা তা লিখে চলেছি ।লিখে যাবো।অবিরাম সেই বা এই লেখার পাঠকরা বুঝে যাবেন ঠিক কী লিখতে চাই ।

(২০)

মৃণাল চক্রবর্তীর মতামতের সূত্র ধরে যাওয়া যাক কাদাকুলি, আর কাদাকুলির পাশেই ছাঁদার।ছাঁদার আমার মানচিত্রে  উৎপল চক্রবর্তীময়।
শেষবার আমার যাবার সঙ্গে মিলে গিয়েছিল মৃণাল অমল বসু দের যাওয়া ।গত দশই মার্চ । অভিব্যক্তি র জন্মদিনের  অনুষ্ঠানে ।সেই তখনই ছোটদার সঙ্গে শেষ দ্যাখা ।বালুরঘাট থেকে ওরা এসেছিল ।আর বাঁকুড়া থেকে এসেছিল ভজন দত্ত পার্বতী রায় ।শ্রীমহাদেব শ্রীমহাদেবকে বাঁকুড়ার বলতে পারছি কই ।মহাদেব তো অভিব্যক্তির অংশ। আর আমি কি নই। জানি না ।পরের বছর দ্যাখা হবে না অনুমান মাত্র ছিল।সিদ্ধান্ত ছিল না ।সেই অনুমানই মিলে গেল ।
এখন ফিরে যাই  অতীতকথায়।যা লেখার কথা সেই উপবনে।
সনতারিখ মনে নেই ।তুষার চৌধুরী অনন্য রায় বা বাপ্পা  আর আমি তিনজন পৌঁছে গেলাম বেলেতোড় হয়ে কাদাকুলিতে । তখন সবে অভিব্যক্তি গড়ে  উঠছে ।
সেবার কি আমরা বোলপুর শান্তিনিকেতন থেকে গিয়েছিলাম? ঠিক মনে নেই ।শান্তিনিকেতনের কথা পরে বলা যাবে । এখন  অভিব্যক্তি  এবং উৎপল চক্রবর্তী ।
সেবার যতক্ষণ কাদাকুলিতে ছিলাম বেশির ভাগ সময়ই ছিলাম অভিব্যক্তিতে। ছোটদা তখন গানে ডুবে আছেন। একটা শস্তা হারমোনিয়াম  এবং চা  অনুসারী পান। এই পান স্থলপথের পান।জলপথের নয়।
তখনকার  একটা গান  এখনো আমাকে তাড়িত করে।
এ জীবন সকলই সুন্দর  গো 
এই গানটির উৎস ছিল একটি সাঁওতালি গান ।যার বাংলা রূপান্তর 
ছাতু তোলা সে বড়ো লজর গো ।
গানটি  এতবার ছোটদা গেয়েছিলেন, শেষের দিকে আমরাও গলা মিলিয়ে ছিলাম, যে ওই গানটি  আমরা রপ্ত করে ফেলেছিলাম ।আর ওই গানটিকে বহন করে নিয়ে এসেছিলাম কলকাতায়।বারদুয়ারিতে ওই গানটি নিয়মিত গাইতাম । ওই গান তখন  আমরা কি আমাদের ব্যক্তিগত জাতীয় সংগীত করতে চেয়েছিলাম ।জানি না ।তবে গানটিতে মজে ছিলাম। অনুরূপ অভিজ্ঞতা হয়েছিল সুমনের প্রথম ক্যাসেটের গুটিকয়েক গান। এটা গান বিষয়ক স্মৃতিকথা নয়।ফিরে যাই কবিতায়।

বাঁকুড়ায় কবিতার সঙ্গে বসবাস শুরু হয়েছিল  আরও কিছুটা আগে। সেটা 1968-69 ।তখন  আমার কাকার বড়ো ছেলে বুড়ো বা সমীর বেলেতোড় স্কুলের শেষদিকে র ছাত্র ।বুড়োর সহপাঠী ছিল রাজকল্যাণ চেল, বেলবনীতে বাড়ি।রাজকল্যাণ তখন থেকেই কবিতা নিয়ে মাতামাতি শুরু করবো করবো করছে ।হাতের কাছে পেয়ে গেল আমাকে ।শুরু হয়ে গেল ছন্দ শিক্ষার পাঠ।রাজের সঙ্গে  আসতো প্রণব চট্টোপাধ্যায় স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্গা শর্মা বিজয় দাস। আমাদের দোতলার  বারান্দায় বসতো সেই আসর।মূলত অক্ষরবৃত্ত নিয়েই কথা হত।
বাঁকুড়ার রাজকল্যাণ  এবং তার দুই ভাই সত্যসাধন আর সুব্রত  আমার জন্য যা করেছে তার কোনো প্রতিদানই আমি দিতে পারিনি। তার প্রধান কারণ  আমার হাতে কোনোদিনই প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ক্ষমতা ছিল না । আমি  আমার ক্ষুদ্র পরিসরে  এদের মনে রাখার চেষ্টা করেছি ।
সেই অর্থে শহর বাঁকুড়ার কবিদের কাছ থেকে বিন্দুমাত্র সমর্থন পাইনি সেসময়। এখন ভজন দত্তের প্রায় একক প্রচেষ্টায়  পা রাখার একটা জায়গা পেয়েছি।
কবিতা পাক্ষিক পর্বে পেয়েছিলাম গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে। গুরুদাসের দৌলতে শুশুনিয়া উৎসবে  একটা মঞ্চ  উদ্বোধনের ডাক পেয়েছিলাম ।আর সত্যসাধন  আমাকে সংবর্ধনা দেবার ব্যবস্থা করেছিল । দৈনিক বাংলা সংবাদপত্রের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল সেই সংবর্ধনা । বাঁকুড়ার কজন কবি উপস্থিত ছিলেন  আমার জানা নেই ।
গুরুদাসের ব্যবস্থাপনায় কবিতাপাক্ষিকের অনুষ্ঠান হয়েছে।সেসব অনেক পরে । আর জন্মদিন পালন তো এই সেদিন ।
উৎপল চক্রবর্তী  আজ নেই, অথচ তাঁর উপস্থিতি  আমার সুন্দরের দিকে যুক্ত হয়ে থাকলো এই বাস্তবতাকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে ।পরে আবার দ্যাখা হবে পথের সঙ্গী হিসেবে ।
একটা  অনুরোধ রাখছি কারো স্মৃতিতে যদি সেই সময়ের কোনো কথা মনে থাকে জানালে উপকৃত হব, লেখাটাও সমৃদ্ধ হবে।

(২১)

গত সন্ধের সঙ্গে  আজকের সন্ধের অনেকগুলি মিল যেমন  আছে তেমনি অনেকগুলো অমিলও আছে ।মিলের কথা নিয়ে মেতে থাকলে অমিলগুলিকে অবহেলা করা হবে ।
যেমন তখন আমি শার্ট প্যান্টে যাতায়াত করতাম ।আর এখন শার্ট প্যান্ট পরাই হয়ে  ওঠে না ।তাহলে কি  আমি মানুষটা বদলে গেছি? 
বদলেছি অনেক পরে।পরের কথা পরে বলবো।এখন যাত্রা করলাম শঙ্খ ঘোষের বাড়ির দিকে ।তখনও পবিত্রদাই হাত ধরে নিয়ে যেতেন । তার অর্থ হল তখনো আমি স্বাবলম্বী হইনি। ধরে  আছি পবিত্রদার হাত । মান্যবর শঙ্খ ঘোষ তখন শ্যামবাজার চারমাথার খুব কাছে। CESC অফিসের পেছনের দিকে । পেছন না পাশে , দিক দিকভুল হতে পারে ।হলে শঙ্খদা শ্যামবাজার থেকে শ্যামনগর চলে যাবেন না । অর্থাৎ এতটা ভুল করে ফেলবো না ।
সম্ভবত লিফট ছিল । শঙ্খদা এখনকার মতোই অবারিত  ছিলেন। কবিপত্রর জন্য কবিতা নিতে গিয়েছিলাম । আগের সংখ্যা নিয়ে গিয়েছিলাম।দিলাম আর উনি  আগ্রহের সঙ্গে তা দেখেছিলেন ।এটুকুই মনে করতে পারছি ।
তখন 2B বাস দোতলা ছিল ।যাবার সময় বাসের একতলায় বসে গিয়েছিলাম ।ফেরার সময়ে দোতলায়। এটা স্মৃতি নির্ভর নয় তর্জনী নির্ভর তথ্য । লেখার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ।
আসল কথাটি হল ফিরেছিলাম পূর্ণ হয়ে। এখানে কোনো চাতুর্য নেই ।এরকম শান্ত এবং সৌম্য মানুষ আমি  আগে দেখিনি ।যে কটা কথা চালাচালি হয়েছিল তার মধ্যে কোনো ছলনা ছিল না, সবটাই  আন্তরিক । এখনকার মতো তখনও মৃদুভাষী ছিলেন। শঙ্খদা তখন যেমন ছিলেন এখনও ঠিক তেমনটাই আছেন ।এই এত বছর ধরে নিজেকে একই রকম রেখা বেশ দুরূহ ব্যাপার । আর কেউ পেরেছেন তা আমার জানা নেই । 
শঙ্খদাকে শান্ত সৌম্য এসব বিশেষণে ভূষিত করার অর্থ  এই নয় যে তিনি প্রতিবাদী ছিলেন না।যখনই প্রয়োজন পড়েছে শঙ্খদা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন ।
যখন দীপেনদা অর্থাৎ দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যাডার ছিলাম তখন তাঁর প্রতিবাদী বৈশিষ্ট্য দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি।
পরে সময় আসলে শঙ্খদার সম্পর্কে বহু কথা বলা যাবে । এখন উত্তর থেকে ফিরে আসি দক্ষিণে।
কুঁদঘাটে থাকতেন কবি দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। এখনো  একই বাড়িতেই থাকেন।দেবীদা আমাদের পাড়ার জামাই।দেবীদার স্ত্রীর নামও দেবী ।আমার বান্ধবী মিতা র দিদি।সেই সূত্রে দেবীপ্রসাদ সাম্প্রতিক তে কবিতা লিখেছেন ।অর্থাৎ আমাদের তিনি কবিতা লিখেছিলেন ।শুরুতে দেবীপ্রসাদ কীভাবে যে দেবপ্রসাদ হয়ে গেল জানি না ।এই লেখায় কীভাবে প্রুফ সংশোধন করতে হবে তা জানা নেই ।
দেবীদা ছিলেন আপাদমস্তক ভদ্রলোক । এবং নিজের তৈরি একটি  খোলসের মধ্যে বসবাস করতে পছন্দ করেন ।নিজের খেয়ালে নিজের কাজ করে যান। বাইরের তাপ উত্তাপ খুব  একটা স্পর্শ করে না দেবীদাকে।প্রকৃত কবির মতোই তাঁর যাপনচিত্র। আমার প্রতি তাঁর  আচরণে প্রশ্রয়চিহ্ন আমার না দ্যাখা নয়।কিন্তু সত্য কথাটা হল আমি সেভাবে দেবীদাকে তাঁর প্রাপ্য সন্মান দিতে পারিনি ।হয়ত ঘরের মানুষ ভাবার ফলেই এমনটা হয়ে থাকতে পারে ।অথচ যখনই কবিতা নিতে গেছি উনি  আমাকে নিরাশ করেননি ।
আর বিনয় মজুমদারের সঙ্গে যাবতীয় যোগাযোগ তখন ছিল কফিহাউসের দৌলতে।তখন ঠাকুরনগর যাওয়া হয়ে ওঠেনি ।কফিহাউসে বিনয়দার নির্দিষ্ট একটা টেবিল  ছিল ।অনেক আগে আসতেন এবং অনেক পরে যেতেন।তখন আমি কফিহাউসের গেট খুললেই ঢুকে পড়তাম। আর বের হতাম গেট বন্ধ হবার সময়। দুপুরের দিকে অনেকটা সময় বিনয়দার সঙ্গে কাটাতাম ।তার অর্থ এই নয় যে বিনয়দার সঙ্গে গল্পগুজব করতাম ।বিনয়দা নিজের মধ্যে থাকতেন ।পাশে কে বসে আছে তা দেখার প্রয়োজন বোধ করতেন না ।এটা যে কেবলমাত্র  আমার ক্ষেত্রে নয় সকলের প্রতি একই আচরণ ছিল বিনয়দার।তবে কবিতা দেবার কথা থাকলে তা কখনোই ভুলে যেতেন না।এসেই দিয়ে দিতেন।
তবে একটা কথা বলে রাখি, পরের কথা ।কবিতা পাক্ষিক পর্বে যখনই কবিতা চেয়েছি পোস্টকার্ড ।উনি খামে ভরে পাঠিয়ে দিয়েছেন ।ঠিকানা ভুল হয়নি। আমার মনে হয়েছে বিনয়দা কবিতা লেখার জন্যই এই ভূখণ্ডে এসেছিলেন ।আদ্যোপান্ত কবি বলতে যা বোঝায় বিনয় মজুমদার ঠিক তাই ছিলেন ।
আমি যখনকার কথা বলছি তখন বিনয়দাই পঞ্চাশের জনপ্রিয়তম কবি । আলোক - অলোকরঞ্জনের গ্রাফ তখন নিম্নমুখী।সুনীলদা  আর শক্তিদার জুড়ি তখনও দানা বাঁধেনি।
বিশ্বাস না হলে অমরেন্দ্র চক্রবর্তী র স্মরণাপন্ন হতে হবে । আমার বিশ্বাস  আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ সম্পাদক হলেন অমরেন্দ্র চক্রবর্তী ।কবিতা পরিচয় নামে একটি পত্রিকা করতেন ।এরকম সুসম্পাদিত পত্রিকা  আর একটিও ছিল না,  এখনও নেই ।
একটি করে কবিতা  আর তার আলোচনা ।কে না অংশগ্রহণ করেছেন। এক টন দেড় টন ওজনের লেখকরা বিখতেন।বিতর্কে যুক্ত হতেন। সেই কবিতা পরিচয় পত্রিকায় বিনয় মজুমদারের কবিতা  আলোচিত হয়েছিল অনেকের আগে।
তাছাড়া বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় বিনয়দার উপস্থিতি লক্ষণীয় ছিল । 
কফিহাউসে  আসতেন আর এক কবি শান্তিকুমার বসু।পঞ্চাশের এই কবি খুবই সিরিয়াস ছিলেন। একটা দূরত্ব  বজায় রেখে মিশতেন ।আমাকে কিছুটা ভয়ও করতেন। এমনটাই  আমার মনে হত। শক্তি দা দের সাপ্তাহিক কবিতার  একটা পাতা ফাঁকা আছে ।আমার বন্ধু মিহির রায়চৌধুরী জানালো একজনের কবিতা দিতে হবে।চলে এলাম কফিহাউসে । শান্তিদাকে পেয়ে গেলাম ।একটা খাতা আর কলম ধরিয়ে দিয়ে বললাম একটা কবিতা লিখে দিতে হবে , এখুনি ।প্রথমে থতোমতো খেলেও শেষমেশ কবিতা লিখে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন ।

(২২)

গতকাল শেষ করেছিলাম কবিতার  ইতিহাস দিয়ে ।আমার এই সামান্য লেখাটি ইতিহাস নয়।সে দাবিও আমি সজ্ঞানে করবো না ।সেই চেষ্টা করেছিলেন সত্য গুহ।কৃষ্ণগোপাল মল্লিক সম্পাদিত গল্পকবিতা নামক পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল একালের গদ্য পদ্য  আন্দোলনের দলিল ।বহুদিন ধরে চলেছিল ।আমরা  অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম ।পরে পুস্তকাকারে লেখাটি প্রকাশিত হয়।প্রকাশক অধুনা র পক্ষে কৃষ্ণগোপাল মল্লিক ।
ওই বইটিতে যে তথ্য সম্ভার আছে তা দিয়ে বহু গবেষক করে খেয়েছেন ।আপাতত এই ভূমিকাটুকু করে রাখলাম, না হলে ধ্বংসকালীন কবিতা  আন্দোলনের কথা লেখা হবে না ।আজ প্রতিজ্ঞা করেছি ধ্বংসকালীন লিখবোই। না হলে দেরি হয়ে যাচ্ছে ।
হাংরি শ্রুতি ধ্বংসকালীন এই তিন কবিতা আন্দোলন ছয়ের দশককে শতাব্দীর সবথেকে প্রাজ্ঞ দশক বলে চিহ্নিত করেছে । এটা আমার কথা নয় এটা সত্তরের বিশিষ্ট কবি কমল চক্রবর্তীর।কমলের পত্রিকা কৌরব এর ষাটের কবিদের কবিতা সংকলনের সম্পাদকীয়তে ঠিক  এমনটাই লিখেছিল কমল।কমলকে ধন্যবাদ,  ওর আগে  আর কেউই একথা বলেনি।সেসব এখন তোলা থাক ।পরে বলার সময় পাওয়া যাবে ।
আমরা কবিতা পাক্ষিক থেকে অক্টোবর 1994 এ প্রকাশ করেছিলাম ধ্বংসকালীন কবিতা আন্দোলনের দলিল নামে একটি পুস্তক ।সম্পাদনা করেছিল শান্তিময় মুখোপাধ্যায়।বইটির দ্বিতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল  অগাস্ট 2011 , এই দলিলটি  এখনো পাওয়া যায়।
আগ্রহী পাঠক সংগ্রহ করতে পারেন । এই আন্দোলন নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা আছে।সেই ধোঁয়া সরাবার চেষ্টা থেকে বিরত থাকছি। 
1st Part. বাকিটা রাতের মেলে।
(ক্রমশ)

প্রভাত চৌধুরী

কবিতা পাক্ষিক


No comments:

Post a Comment