এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

কমলিকা রায়


বিভাগ : গল্প (ছোট গল্প)


ফাদার্স ডে


দমদম ষ্টেশনের ৪নং প্ল্যাটফর্মে বসে থাকা বুড়ো মানুষ টা কে এক ঝলক দেখে মণীষার খুব চেনা লাগলো। কিন্তু এই অফিস যাওয়ার প্রবল ব্যস্ত সময়ে চেনা চেনা লোক টা কে এটা ভাবতে যাওয়া একটা বিলাসীতা। মণীষার অফিসের গাড়িটা আজ ব্রেক ডাউন করেছে। নিজের গাড়ী নিয়ে যাবে ভেবেও সিদ্ধান্ত নেয় ট্রেনে যাওয়ার। অফিস টাইমে ডাউন মাঝের হাট লোকাল ধরা আর বর্ডার এলাকায় যুদ্ধ করা একই রকম মনে হয় মণীষার। তারপর ফেয়ার লি তে নামা আর এক প্রস্থ!! অফিসের বায়োমেট্রিক অ্যাটেন্ডেন্সে আঙুল ছুঁইয়ে তবে শান্তি। 
কিন্তু আজ মণীষা কিছুতেই কাজে মন লাগাতে পারছে না। একটা চেনা চেহারা যেন অচেনা অবয়বে ঢাকা পড়ে আছে। এক বিবর্ণ, ধূসর, চোখমুখ ভেঙে যাওয়া বৃদ্ধের মুখ। কিন্তু আবছা ধূসর চোখ টাতে যেন এক অদ্ভূত চেনা চেনা ছোঁওয়া। এক অদ্ভূত অস্বস্তি সারা দিন মণীষা কে ঘিরে থাকলো। 
কাল ১৯শে জুন- ফাদার্স ডে!! সারাদিন ফেসবুক, রেডিও সবেতেই শুধু চলবে বাবা কে কত ভালবাসি সেটা প্রমাণ করার আপ্রাণ চেষ্টা!! এই গুলো খুব হাসির উদ্রেক করে মণীষার মনে। শুধু এই সব বিশেষ দিন গুলো তেই মনে পড়ে বাবা অথবা মার কথা!! 
ফেরার সময় টাতেও গাড়ি টা নিলোনা, আজ যেন ট্রেন অদম্য ভাবে টানছে! প্ল্যাটফর্মে নেমেই এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখতে পেল তাকে। আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। মণীষার মনে পড়েছে বৃদ্ধ কে। আস্তে করে ঘাড়ে হাত দিয়ে বললো, আমায় চিনতে পারছেন? চলুন আমার সাথে। সেই ধূসর চোখের অবুঝ চাউনি নিয়ে বৃদ্ধ তাকালো মণীষার দিকে। তারপর মুখ টা নামিয়ে নিলেন। বোঝাই গেলো উনি মণীষা কে চেনেন না বা চিনতে পারেননি। মণীষা হাত টা ধরলো। - উঠে আসুন। 
মণীষা একটা multinational কম্পানি তে বেশ বড় পদেই চাকরী করে। এখন বোর্ড অফ ডাইরেক্টরের সদস্য। একজন সাধারন manager হিসেবে কাজ শুরু করে। নিজের কর্মদক্ষতা যোগ্যতা দিয়ে আজ এই জায়গায় পৌঁছেচে। চাকরী শুরু করার মাস ছয়েকের মাথায় নির্মাল্যর সাথে বিয়ে হলো। নির্মাল্য ডাক্তার হলেও সেই ভাবে পসার জমাতে পারেনি। বাবার ওপর অনেকাংশেই ভরসা করতে হয়। বাবা অর্থাৎ মণীষার শ্বশুর ছিলেন একজন অবসর প্রাপ্ত সরকারী আধিকারিক। অসম্ভব দোর্দন্ডপ্রতাপ এবং আদ্যান্ত সৎ income tax officer ছিলেন মনিময় মজুমদার। কারো কাছে কখনও মাথা নীচু করেননি সততার জন্য। তাঁর সময়ে দপ্তরের প্রতিটা কর্মী বা বড় বড় tax payer রা সবাই বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেতো। মনিময় বাবু ছেলে কে একাই মানুষ করেছেন কারন স্ত্রী খুব কম বয়সেই মারা যান। মনিময় বাবু কোনো দিনই পুত্রবধূর চাকরী করা টা মেনে নিতে পারেন নি। তাতে নাকি ওনার সম্মানহানি হয়। নির্মাল্য এমন ধরনের মানুষ যার মেরূদণ্ড নেই। বাবার আপত্তির কথা ক্ষীণ স্বরে মণীষা কে বলেছে কিন্তু মণীষার প্রবল আপত্তির কথাটা বাবা কে বলতে পারেনি। মণীষা বহুবার চেয়েছে শ্বশুরের সাথে কথা বলতে কিন্তু নির্মাল্য বলতে দেয়নি। একটা ঠান্ডা লড়াই বাড়ি তে চলেই যাচ্ছিল কারন মনিময় বাবু মানতেই পারছিলেন না যে ওনার কথা কেউ অমান্য করছে। মার্চ মাসের দিন গুলোতে ফিরতে দেরীই হচ্ছিলো। এই রকমই একদিন রাতে মনিময় বাবু সরাসরি বলেই দিলেন হয় চাকরী ছাড়তে হবে না হয় এই বাড়ি। সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্ত দ্বিধা করেনি কারণ মেরূদণ্ডহীন একটা পুরুষের সাথে ঘর করার চেয়ে নিজের বাবা মায়ের কাছে ফিরে যাওয়া টা অনেক সম্মানের মনে করেছিল মণীষা। আর নির্মাল্য খুব বিশেষ বাধা দেওয়ারও চেষ্টা করেনি। সাত মাসের সংসারের পরবর্তী দশ বছরে তড়তড় করে মণীষা সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেছে আর সাত মাস টাকে দুঃস্বপ্নের মত একটু একটু করে ভুলেছে। 
মণীষা কিছুতেই একটা জিনিস মেলাতে পারছিলো না সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ মনিময় বাবু এই অবস্থায় পৌঁছলেন কি ভাবে! কি এমন চমৎকার ঘটলো যাতে মানুষ আজ রাস্তায়? মণীষা যখন মনিময় বাবু কে নিয়ে বাড়ি পৌঁছালো মা বাবা দুজনেই যারপরনাই চমকে গেলেন। মণীষা অনেক কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু একটা কথাও বলাতে পারেনি। বাড়ি তে ঢুকেই আগে ওনা কে একটু পরিষ্কার করিয়ে জামা কাপড় বদলে দেওয়া হলো। চা খাবেন কিনা জানতে চাইলে এই প্রথম মুখে বললেন, খাবো। 
চা খাওয়ার পর যেন একটু স্বাভাবিক লাগছিলো ওনাকে। বললেন, কিছু খাবার আছে? মনে হয় কদিন কিছু খাইনি। মণীষা স্তম্ভিত হচ্ছিল এই বৃদ্ধ কদিন না খেয়ে আছে? কিন্তু সেটা কতদিন?
পরের দিন অফিস গেলো না বা যাওয়ার ইচ্ছে টা জাগলো না। তেমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ তেমন ছিলোনা। অফিসে জানিয়ে দিলো যে আজ যাবেনা। একটু বেলায় বেরিয়ে পড়লো নিজের গাড়ি টা নিয়ে। হিন্দুস্থান পার্কের সেই পাড়া টা প্রায় একই রকভ আছে। গত দশ বছরে খুব বিশেষ পরিবর্তন হয়নি শুধু সম্পর্ক গুলো বদলে গেছে! তো বাড়ির উল্টোদিকের চাএর দোকান টা আছে তবে একটু ঝাঁ চকচকে হয়েছে। মালিকানাও বাবা থেকে ছেলে তে বর্তেছে।ভালোই হলো কেউ চিনবে নামনে মনে ভাবলো মণীষা। গাড়ি টা একটু দুরে রেখে চাএর দোকান টায় গেলো। মনিময় বাবুর এক্স বৌমা পাড়ার চাএর দোকানে চা খাচ্ছে!! ঘটনা ভেবেই কেমন হাসি পেলো। যাইহোক দোকান টার বয়স্ক কর্মচারী নিজেই এগিয়ে এলো। মণীষা জিজ্ঞাসা করলো, “আচ্ছা মনিময় মজুমদারের বাড়ি টা কোন দিকে?” মণীষা জানে খবর যোগার করতে গেলে একটু অজ্ঞতার অভিনয় করতেই হবে। দোকানের লোকটি বললো বাড়ি কোনের টা কিন্তু বড় বাবু তো নেই। আপনার কি ওনার সাথেই দরকার? মণীষা বললো দরকার টা তো ওনার সাথেই ছিলো কিন্তু বাড়ির অন্য কেউ কথা বললেও হবে। কিন্তু উনি এখন এখানে থাকেন না?কোথায় থাকেন? সেখানে গিয়েই না হয় দেখা করবো। 
লোকটার মুখে চোখে একটা দুঃখের ছাপ হলো। কোথায় পাবেন তারে দিদিমণি? তাকে তো ছেলে বউ তাড়িয়ে দেছে। নতুন বৌ টা এমন পাজি শ্বশুর কে একটুও দেখতো না। বাপের বাড়ি যে খুব পয়সাওলা। ছোটবাবু বাপ কে ভুললো শ্বশুরের পয়সা দেখে। বুড়ো বাপ কে বৌ টা তাড়িয়ে দিল আর ছোটবাবুও দাঁড়িয়ে দেখলো!- বলতে বলতে লোকটার দুচোখে জল ভরে এলো। আবার বলতে শুরু করলো, “কি বলবো মা জননী বুড়ো মানুষ টা কে খেতে অবদি দিতোনা। মাঝে মাঝে আমাদের কাছে এসে খেতে চাইতো। ইদানিং কাউকে তেমন চিনতেও পারতেন না। কিন্তু আশ্চর্য বাড়ি টা পারতো। এবার হয়তো পথ ভুলে কোথাও হারিয়ে গেছে! তবে মা জননী যদি কোথাও হারিয়ে যান উনি বাঁচবেন। এই শয়তান দের হাত থেকে। তা আপনে কি যাবেন উনার বাড়ি?”
চমক ভাঙলো মণীষার, বললো, নাহ! যে লোক নিজের বাবা কে সম্মান করে না সেই রকম পশুর সাথে আর কি দেখা করবো! চলি কাকা আবার হয়তো পরে দেখা হবে। 
নিজের গাড়ির দিকে হাঁটতে হাটতে মণীষা ভাবলো, আজএই নাকি ফাদার্স ডে!!



No comments:

Post a Comment