বিভাগ : গল্প (ছোট গল্প)
চির বসন্ত উপাখ্যান -
কলেজের প্রথম দিন থেকেই একটা উন্নাসিক ভাব পৌষালির। শহরের উপকণ্ঠে আমাদের কলেজটি হলেও মূলত মফঃস্বলের ছেলে মেয়েরাই এখানে এসে যোগ দিয়েছে। দক্ষিণ কোলকাতার অভিজাত পাড়ায় বেড়ে ওঠা পৌষালি, শহর ও সংস্কারে বেড়ে ওঠা পৌষালি, একটু বেশী রকমেরই সচেতন তার চার পাশের লোক’জনের থেকে। তাই কলেজের প্রথম দিন থেকেই সে একটা স্বতন্ত্র ঘেরাটোপের মধ্যে দিয়েই হাঁটছিল। আসলে মফঃস্বলে বেড়ে ওঠা ছেলে মেয়েদের মধ্যে একটা সহজ সরল ভাব থাকে, যা পৌষালির মতে অনেকটা গায়ে পড়া। প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসায়ী পরিবারের মেয়ে, আর দীর্ঘ দিন ধরে বয়ে আনা একটা সাবেকিয়ানার সাথে বেড়ে উঠেছে বলেই হয়তো সে সহজে সরল হতে পারতো না। কলেজে সবার থেকেই একটু আলাদা হয়ে থাকার চেষ্টা, কিংবা বলা যেতে পারে ‘আমি না ঠিক তোদের মত নই’ এই ধরনের একটা ভাব। কলেজ সোশ্যালের আগে যখন সবাই এক সাথে মেতে উঠেছিলাম আমরা আসন্ন প্রোগ্রাম নিয়ে, তখন এক মাত্র পৌষালিই সবার থেকে আলাদা হয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে বাড়ি চলে আসতো, পাছে মফঃস্বলীয় গন্ধটা যেন তার গায়ে না লেগে থাকে। যোধপুর পার্কের অভিজাত পাড়ায়, অভিজাত পরিবারের এক মাত্র কন্যা সন্তানের এই স্বতন্ত্র উন্নাসিক মানসিকতার জন্য কলেজে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সে পরিচিত হয়ে উঠে বাকি সকলের মুখে ব্যাঙ্গক্তিতে ‘মহারানী ভিক্টোরিয়া’। কলেজের মস্ত করিডোর দিয়ে যখন পৌষালি হেঁটে আসে, আথবা মেইন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে তার ব্যাক্তিগত ব্যাবহারের দামী গাড়ি ও ড্রাইভারের জন্য, তখন হামেশাই দূর থেকে ভেসে আসা গানের মতন শোনা যায় কোনো না কোনো পুরুষ কণ্ঠের কর্কশ অথবা মৃদু মন্দ আওয়াজ – ‘মহারানী ভিক্টোরিয়া, এ ভাজা খায় রোজ কিনিয়া’। অত্যন্ত বেশী রকমের উত্যক্তি করলেও এটা বলা অবশ্যাম্ভাবী যে, এই ধরনের সুমধুর সঙ্গীত চর্চায় আমার গল্পের নায়িকার একটি বিশেষ রকমের মানসিক চির্ চিরা্নির উন্মেষ ঘটত। সুতরাং মহারানী পৌষালি আরও বেশী রকমের উন্নাসিক হয়ে ওঠতেন। যাই হোক, নারী চরিত্রের বিশ্লেষণে আর না গিয়ে মোদ্দা কথায় আসা যাক।
মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ। কলেজে আসন্ন বসন্ত উৎসবের তোর জোর চলছে। আমাদের রানী’মা যথারীতি সব ডাক ছাড়িয়ে, সব কিছু এড়িয়ে নিজের গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধা। আমরা যারা মফঃস্বলের গন্ধ মাখা মানুষ তারা অতি অল্পেই সন্তুষ্ট। বড়লোকি সীমানার বাইরে দাঁড়িয়ে ঢাক ঢোল পিটিয়ে শুরু করছিলাম কলেজের সংস্কৃতির পরিকাঠামোকে রঙিন করে তোলাবার এক অদ্ভুত মাদকীয় উল্লাসে। বসন্ত উৎসব মানেই তো রবিবাবুর বাপত্তর সম্পত্তি। সুতরাং নৃত্য, নাট্য, আর চিরন্তন রবীন্দ্র সঙ্গীতের উপঢৌকন যেমন ছিল, তেমনি আমাদের মতন কিছু উড়নচণ্ডী বাউন্ডুলেদের স্বপ্ন ও হতাশা মিশ্রিত নতুন ধারার বাংলা গানের ব্যান্ড নামক উৎপাতটিও ছিল এই উৎসবের এক মুখ্য আকর্ষণ। আমাদের নতুন বছরের ছাত্র দল দুটি, রাজনৈতিক মতাদর্শে যতই আলাদা থাকুক না কেন, এই উৎসবকে কেন্দ্র করে সবাই মেতে উঠেছিলাম আলেকজান্ডারের রাজ্য অভিযানে। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত চলত কর্মসূচির পরিবর্তন ও সমবণ্টন। মেয়ে মহলেও লেগেছিল সমান পরিমানে উল্লাসে ঢেউ। যেমন করেই হোক উৎসবের আলো যেন মাঠে মারা না যায়, সেই দিকেই ছিল আমাদের সবার দৃষ্টি।
আমি যেহেতু বরাবরেরই একটু আঁতেল টাইপের, তাই আমার উপরেই পড়েছিল উৎসবের মূল পরিকাঠামোটি সাজানোর দায়িত্ব। ছোটো বেলা থেকেই ছবি আঁকা ও লেখা লেখির একটা বদভ্যাস আমার আছেই, আর এই বদ গুণের জন্যই বোধ হয় লোকের চোখেও পড়তাম বেশী। সঙ্গী যেমন জুটে যেত অহরহ, সঙ্গিনীর সংখ্যাও নেহাত নিন্দনীয় কম কিছু ছিল না। কলেজে আসার পর মাস তিনেকের মধ্যেই আমার নিজস্ব পার্শ্বচরের দলটি একটি ঔপনিবেশিক মানসিকতার সাথে বেড়েই চলেছিল উত্তরোত্তর। আমি নিজেই একটি স্বতন্ত্র কলেজ রাজনৈতিক নেতার মতন চেয়ার দখল করে বসে ছিলাম, যদিও তৎকালীন ডান কিংবা বাম কোন রাজনৈতিক দলের প্রতিই আমার বিন্দু মাত্র আকর্ষণ ছিল না। ব্যস্ত থাকতাম নিজের নামের সাথে ইন্টেলেকচুয়াল শব্দটিকে নিয়নের আলোতে সর্বদা উজ্জ্বল রাখবার চেষ্টায়। সুতরাং সখা ও সখি মহলে যে আমার অবস্থান অনেকটা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল সেই কথা আর বড়াই করে না বলাই ভালো, হিতে বিপরীত হতে পারে। যাই হোক আমাকে ঘিরে আমার ও আমার বন্ধুদের এই পরিক্রমণ বেশ বাড়াবাড়ি রকমের অসহ্য হয়ে উঠেছিল পৌষালির কাছে। মূলত সে কখনোই আমার কোনরকম চটকদার কাজের তারিফ করেনি, তা সে আমার অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টই হোক, কিংবা আমার লেখা কবিতা। আমিও নানারকম অদ্ভুত ও অক্ষুণ্ণ চেষ্টা চালাতাম মহারানীর দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্য। যতই তাকে আমার দলে টানবার চেষ্টা করি, ততই সে উন্নাসিক হয়ে উঠতে থাকে। এমনকি একদিন আমার এক সহপাঠিনী কে বলেই বসে – ‘কি পাস তোরা বলত, ঐ মর্কটটার সাথে মিশে ! ছবি আঁকে না ব্যাঙ – যত সব সস্তা, বস্তা পচা কনসেপ্ট দিয়ে লোকের হাততালি পাবার চেষ্টা। গাড়ল একটা’।
কথাটা তৎক্ষণাৎ দূত মারফত আমার কানে এল। কানের ভীতর দিয়ে মরমে পশিল কি না জানি না, তাবে মর্কট কিংবা গাড়ল শব্দটা মেনে নিলেও, আমার কনসেপ্ট তুলে কথা বলাটা ঠিক হজম করে নিতে পারলাম না। আমি হলাম গিয়ে মুকুট হীন সম্রাট, আরা মহারানী কিনা আমারই আকবরনামার উপর কলমের খোঁচা দিচ্ছে! মাথার মধ্যে একটা প্রতিশোধের কালনাগিনী লকলকে জিহ্বা লেলন করতে থাকল অহরহ। আসলে পুরুষের আত্মশ্লঘায় সুড়সুড়ি দিলে যে কোন পুরুষই তা সহ্য করতে পারে না। তারপর যদি আবার সে আমার মতন ইন - টে - ল্যাক - চুয়াল হয়, তবে তো আর কথাই নেই। ছোবল মারবার সুযোগের অপেক্ষায় বসে রইলাম, এমনকি মনে মনে (তা সে যতই নাস্তিক হই না কেন) মহারানীর দর্প চূর্ণের দাবীতে মা মনসার কাছে মানতও করেছিলাম বোধহয়।
৫ ই মার্চ, বুধবার। বসন্ত উৎসবের আর মাত্র দিন দুই বাকি। আমাদের কলেজের ইকনমিক্স বিভাগের অধ্যাপক মাননীয় দয়াকান্ত মুখার্জি (কলেজিও প্রথায় ডি কে এম) মানে আমরা যারা অতি বজ্জাতের দল, তারা তাঁকে ডাকতাম ‘ডাকুম’ বলে। তা সেই ডাকুমের সাথে একটি মিটিং ছিল উৎসবের গোলযোগ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে। ঘণ্টা দুয়েক ডাকুমের হালুম হুলুম জ্ঞান আর বিধিসম্মত সতর্কীকরণ শোনার পর, মাথা ঝিম্ঝিম্ অবস্থা নিয়ে অডিটোরিয়ামের করিডোরের সামনে এসে সবে একটি মূল্যবান হাতে বানানো সিগারেট (তখন আমার আঁতলামোর আর একটি বলিষ্ঠ কেতা ছিল প্রিন্স হেনরি মহাশয়ার নামাঙ্কিত পাউচ প্যাক) ধরিয়েছি, এমন সময় হন্ত’দন্ত হয়ে (যেন সাধের গরুটি হারাইয়া গিয়াছে) মালিনী এসে অত্যন্ত ন্যাকাপনার সাথে খানিকটা আদরের উষ্ণ রসায়ন মিশিয়ে বলল – ‘জানিস আমন ; পৌষালি মেয়েদের কমন রুমে সবার সামনে তোর নামে যাচ্ছেতাই বলেছে’।
নিভন্ত সিগারেটে আর এক বার দেশলাই অপচয় করে, চশমার নিচের অংশটি দিয়ে মালিনীর মালা বিহীন বুক, থুড়ি মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম – ‘মানে ! কি বলেছে বল দেখি, শুনি একটু’।
‘বলে কিনা - আমন না বামন। একটা আস্ত ঢ্যাঁড়স, সে কিনা আবার করবে বসন্ত উৎসব। ঐ তো শিক্ষার বহর, রবীন্দ্রনাথের দু’কলমও পড়ে দেখেনি কোনদিন। কালচার বলতে তো কিছুই নেই, বসন্ত উৎসবের নামে মেয়েদের সাথে ন্যাকামো করার তাল খুঁজছে। থাকে তো ব্যারাকপুরে কলনীতে, সে কিনা আবার কালচার ফোটাচ্ছে’ –
এক নিঃশ্বাসে মালিনী কথাগুলো বলে একটু থামল। আমি তো হতবাক্। কানের পাশগুলো কেমন জানি গরম হয়ে উঠেছে। প্রথমত, আমার প্রতি পৌষালির আক্রোশের কারণটা ঠিক অনুধাবন করতে পারলাম না। দ্বিতীয়ত, রবি বাবু ব্যারাকপুরের কলোনির কোনো ঘরে আসবেন না বা কলনীতে থাকা কেউ রবি বাবুকে জানবে না এমন কথা তো স্বয়ং তিনিও কোথাও লিখে জাননি। তৃতীয়ত, আমার কালচার আছে কি নেই, সেটার সাথে বসন্ত উৎসবের অমিলটা কোথায় বুঝে উঠতে পারলাম না। চতুর্থত, আমি যে একটি ঢ্যাঁড়স সেটা কিন্তু সঠিক ভাবে প্রমাণিত নয়, এমনকি বাজার দরটাও ঢ্যাঁড়সের থেকে আমার কিঞ্চিৎ বেশী বলেই আমি জানি। তবে মেয়েদের সাথে ন্যাকামোর কথাটা একেবারে উড়িয়ে দিতে পারলাম না, তা সে আমি যতই খোঁচে যাই না কেন। মালিনী নিজের মনে আরও অনেক কিছু বলে যাচ্ছিল, আমার কানে আর কিছুই ঢোকেনি সেদিন। মাথাটা আচমকা কেমন জানি গরম হয়ে গেল। বুকের ভীতর কালনাগিনীর ফোঁস ফোঁস যেন আরও বেড়ে গেল হঠাৎ করে। আমি অডিটোরিয়াম ছেড়ে এগিয়ে চললাম ক্যান্টিনের দিকে ।
কিছু একটা করতেই হবে! কিছু একটা তো করতে হবেই! নাহঃ আজ একটা গোটা ভুঞ্জা (গাঁজা) দরকার। রাখুর (আমাদের ক্যান্টিন ম্যানেজার) কাছে স্টক থাকে সব সময়। কথাগুলো হজম করতে পারছিলাম না কিছুতেই।
৬ ই মার্চ, বৃহস্পতিবার। বসন্ত উৎসবের সমস্ত প্রস্তুতি শেষ। কালকে সকাল থেকেই শুরু হবে সারাদিন ব্যাপি উৎসব। অডিটোরিয়ামের মধ্যে আমরা জনা চারেক মূর্তিমান প্রস্তুতি পর্বের শেষ তুলির টানে ব্যাস্ত। স্টেজের আদ্যপ্রান্ত ডিজাইন আমার হাতে করা, এমনকি আজ সারাদিন ধরে হলঘর জুড়ে একটি রঙের বাহারে আলপনা দিয়েছি, নিজের দক্ষতার সর্ব শেষ রস টুকুকে উজাড় করে। স্তরে স্তরে প্রশংসার মাল্যদান করে গেছে আমার সখা ও সখি বৃন্দ। এমনকি অধ্যাপকদেরও কেউ কেউ এসে মুগ্ধ দৃষ্টিতে আলোকপাত করে গেছেন আমার নিপুণ হাতের গড়া ইন্দ্রপ্রস্থের কারুকার্যের উপর। সাফল্যের ব্যাপ্তিতে আমার সর্ব শরীর ঝক্ ঝক্ করছে তখন। করিডোরের সামনে বেড়িয়ে এসে সিগারেট ধরালাম একটি। বেলা তিনটের কাছা কাছি সময় হবে, কলেজের ছেলে মেয়েরা শুরু করে দিয়েছে আবিরের উৎসব। নানা রঙের আবিরে মাখা চেনা মুখগুলো ভীষণ রকমের অচেনা হয়ে উঠছে নিমেষের মধ্যে। আবির হল সখ্যতার প্রিতীকি, সম্প্রিতির প্রতীকি। সবাই সবাইকে আবির মাখানোয় ব্যস্ত। হঠাৎ নজরে এল, ক্যান্টিনের গেটের দিকে লাল কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে পৌষালি একা। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের মাঠের দিকে, যেখানে আবির খেলছে কলেজের সবাই। মুখে কেমন জানি একটা তাছিল্যের ভাব। ভারি অদ্ভুত লাগলো পৌষালির এই ব্যবহার, যেন সবাই কোন এক নিষিদ্ধ অপরাধ করছে একসাথে। নিজেকে সামলাতে পারলাম না। নেমে এলাম মাঠে। আমাকে দেখে ঘিরে ধরেছে সবাই। আবিরে আবিরে আমার মুখ রঙিন হয়ে গেল নিমেশে। সবাইকে ছাড়িয়ে আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে, দুই হাতের মুঠোয় লাল আর গোলাপি আবির। সামনের মাঠের দিকে চেয়ে আছে পৌষালি। দেখতে পায়নি আমায়। নিশ্চুপে এসে দাঁড়ালাম তার পিছনে। মৃদু গলায় ডাকলাম – পৌষ!
মুখ ফিরিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই, দুই হাত উজাড় করে ঢেলে দিলাম আবির, পৌষালির সমস্ত মুখে, সাদা ক্যানভাসে প্রথম রঙের দাগ। ভীষণ রকমের আবেগ মাখিয়ে বললাম, - ‘শুভ বসন্ত উৎসব, পৌষ’
মাথার ভীতরে একটা কিছু ভড় করেছিল যেন। নিমেশে বুঝতে পারলাম, আমার অপরাধের মারাত্মক ফল কি হতে পারে। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম পৌষালির সামনে। পৌষালিও যেন সম্বিৎ ফিরে পেল হঠাৎ। এত সচেতন ভাবে আর আচমকা আমি ঘটনাটা ঘটিয়ে ফেলেছিলাম, যে বাধা দেবার সুযোগও পায়নি সে। ভারি সুন্দর লাগছিল তার মুখ, বিকেলের ম্লান আলোতে মাখা পৌষের রঙিন মুখ, আমার বুকের ভীতরের ইমারতগুলো ভেঙে পড়ছিল ক্রমশ। চোখ ফেরাতে পারছিলাম না পৌষের মুখের থেকে। কয়েক মিনিটের স্তব্ধতা। তারপর, হঠাৎ পৌষালি ছুটতে লাগলো কলেজের মেইন বিল্ডিঙের দিকে। আমি নির্বাক স্তব্ধ এক মূর্তি। দুই হাত আবিরের রঙে রাঙানো, নিস্পলক চোখে দেখছিলা, পৌষ ছুটে চলেছে নীল উড়নি উড়িয়ে।
মাঠের দিক থেকে অনেকেই লক্ষ্য করেছিল আমাকে। উল্লাসের আনন্দে মাতোয়ারা ছিল সবাই, তাই বুঝে উঠতে পারেনি অনেকেই ছায়াছবির মূল দৃশ্যটি। যখন বুঝতে পারল, সবাই ঘিরে ধরল আমায়। ততক্ষণে সারা কলেজে রটে গেছে আমার চরম অপরাধের কথা। ডাক পড়েছে প্রিন্সিপালের ঘর থেকে। বিচারাধীন আসামী আমি, ফাস্ট ইয়ারের এক ছাত্রীকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আবির মাখানোর অপরাধে দণ্ডিত, যাবজ্জীবন অরণ্য বাস।
৭ ই মার্চ, শুক্রবার। কলেজের উৎসবের বাঁশি বেজে চলেছে অবিরাম। অপরাধ যতই গুরুতর হোক না কেন, শাস্তি হিসেবে একটু বেশী মাত্রাই লঘু দণ্ড দেওয়া হয়েছিল আমাকে। টানা ঘণ্টা দেড়েক প্রিন্সিপাল রুমে নানা রকম বাক্ বিতণ্ডার মধ্যে দিয়ে ধার্য হল, স্ব-বিস্তারে ক্ষমা চাইতে হবে আমায়, পৌষালির কাছে। নিম রাজি আমি, সহপাঠীদের কথায় রাজি হলাম শেষ পর্যন্ত। প্রয়োজনে নাক খত কিংবা ঐ জাতীয় গুরুতর ব্যাবস্থাও গ্রহণ করতে রাজি। কিন্তু গতকালের ঐ তাণ্ডবের পর পৌষালিকে আর খুঁজে পায়নি কেউ, সে বাড়ি পালিয়েছিল।
সকাল থেকেই কলেজের আবহাওয়া পরিবর্তন হয়েছে। কালকে বিকেলের ঝড়ের বিন্দু মাত্র চিহ্ন নেই কোথাও। সবাই মেতে উঠেছে রঙের উৎসবে রঙের সাজে। শুধু আমিই যেন তালটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না ঠিক করে। মনের ভীতর একটা অদৃশ্য হাওয়ায় সুরটা কেটে যাচ্ছিল বারে বারে। এক জোড়া চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছিল আর এক জোড়া চোখকে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চলল। পৌষালি আসেনি আজ কলেজে। অডিটোরিয়ামের সামনে
তিল ধারণের জায়গা নেই। সবাই নানা ভাবে আমাকে প্রশংসা পত্র দিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। কিন্তু নিজের ভীতরে একটা দামামা শুধু বেজেই চলেছ দুম্ দুম্ - দুম্ দুম্ - অদ্ভুত ছন্দে। আনমনে একটা সিগারেট ধরিয়ে আমি এগিয়ে চলেছি কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে। ক্ষমা চাইবার মতন ক্ষমা টুকুও করেনি পৌষালি আমাকে ।
গাছের নিচে বসে আছে একা পৌষালি। পরনে সাদা খোলের লাল পাড়ে জামদানী। বসে আছে একা, এক ভাষাহীন দৃষ্টির সাথে, সামনে মাঠের দিকে তাকিয়ে।
সে লক্ষ্য করেছে আমার আনমনে হেঁটে আসা। শুধু আমিই প্রথমে দেখতে পাইনি তাকে। কাছে এসে দাঁড়ালাম অপরাধীর মুখে, ক্ষমা যে আমাকে চাইতেই হবে। বললাম – ‘আমায় ক্ষমা করো পৌষালি। আমি বুঝতে পারিনি যে তুমি আবির ভালোবাস না। আর কোনদিনও এরকম করবনা আমি’।
চুপ করে বসেছিল পৌষ। ভীষণ মায়াময় একটা মুখ, বুকের ভীতর ইমারতগুলো আবার ভাঙতে শুরু করেছে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, পৌষালির দু চোখ বেয়ে নেমে আসছে জল। বললাম – ‘আমি সত্যি বুঝতে পারিনি পৌষ, বিশ্বাস করো। আমি কোনদিনও আর রঙ মাখাবো না তোমায়’।
উঠে দাঁড়ালো পৌষালি, বলল -
‘আমি যে এই রঙে রাঙাতে চাইনি আমন। তোমার এই রঙ যে শুধু আমার জন্য নয়। এই রঙ যে তুমি বিলিয়ে দাও সবার সাথে। আমি উন্নাসিক, ভাগ করে নিতে শিখিনি কোনদিন। তোমার রঙের ধারায় ভেসে যায় সবাই। তোমার ছবির সাথে, তোমার লেখার সাথে সবাই আছে। সেখানে তো শুধু আলাদা করে আমি কোথাও নেই আমন! কেমন করে মেনে নেব এই রঙ, কেমন করে মেনে নেব তা! কেন আমাকে অপমান করলে তুমি! কেন!!
অঝস্র কান্নায় ভেসে যাচ্ছে পৌষের মুখ। একই সঙ্গে অজস্র রঙের মাঝে শুধু একটাই রঙ আমার বুকের সমস্ত ক্যানভাস জুড়ে।
কান্নাও যে এত রঙিন, এত সুন্দর হতে পারে, ভাবিনি কোনদিন।
কলেজের প্রথম দিন থেকেই একটা উন্নাসিক ভাব পৌষালির। শহরের উপকণ্ঠে আমাদের কলেজটি হলেও মূলত মফঃস্বলের ছেলে মেয়েরাই এখানে এসে যোগ দিয়েছে। দক্ষিণ কোলকাতার অভিজাত পাড়ায় বেড়ে ওঠা পৌষালি, শহর ও সংস্কারে বেড়ে ওঠা পৌষালি, একটু বেশী রকমেরই সচেতন তার চার পাশের লোক’জনের থেকে। তাই কলেজের প্রথম দিন থেকেই সে একটা স্বতন্ত্র ঘেরাটোপের মধ্যে দিয়েই হাঁটছিল। আসলে মফঃস্বলে বেড়ে ওঠা ছেলে মেয়েদের মধ্যে একটা সহজ সরল ভাব থাকে, যা পৌষালির মতে অনেকটা গায়ে পড়া। প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসায়ী পরিবারের মেয়ে, আর দীর্ঘ দিন ধরে বয়ে আনা একটা সাবেকিয়ানার সাথে বেড়ে উঠেছে বলেই হয়তো সে সহজে সরল হতে পারতো না। কলেজে সবার থেকেই একটু আলাদা হয়ে থাকার চেষ্টা, কিংবা বলা যেতে পারে ‘আমি না ঠিক তোদের মত নই’ এই ধরনের একটা ভাব। কলেজ সোশ্যালের আগে যখন সবাই এক সাথে মেতে উঠেছিলাম আমরা আসন্ন প্রোগ্রাম নিয়ে, তখন এক মাত্র পৌষালিই সবার থেকে আলাদা হয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে বাড়ি চলে আসতো, পাছে মফঃস্বলীয় গন্ধটা যেন তার গায়ে না লেগে থাকে। যোধপুর পার্কের অভিজাত পাড়ায়, অভিজাত পরিবারের এক মাত্র কন্যা সন্তানের এই স্বতন্ত্র উন্নাসিক মানসিকতার জন্য কলেজে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সে পরিচিত হয়ে উঠে বাকি সকলের মুখে ব্যাঙ্গক্তিতে ‘মহারানী ভিক্টোরিয়া’। কলেজের মস্ত করিডোর দিয়ে যখন পৌষালি হেঁটে আসে, আথবা মেইন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে তার ব্যাক্তিগত ব্যাবহারের দামী গাড়ি ও ড্রাইভারের জন্য, তখন হামেশাই দূর থেকে ভেসে আসা গানের মতন শোনা যায় কোনো না কোনো পুরুষ কণ্ঠের কর্কশ অথবা মৃদু মন্দ আওয়াজ – ‘মহারানী ভিক্টোরিয়া, এ ভাজা খায় রোজ কিনিয়া’। অত্যন্ত বেশী রকমের উত্যক্তি করলেও এটা বলা অবশ্যাম্ভাবী যে, এই ধরনের সুমধুর সঙ্গীত চর্চায় আমার গল্পের নায়িকার একটি বিশেষ রকমের মানসিক চির্ চিরা্নির উন্মেষ ঘটত। সুতরাং মহারানী পৌষালি আরও বেশী রকমের উন্নাসিক হয়ে ওঠতেন। যাই হোক, নারী চরিত্রের বিশ্লেষণে আর না গিয়ে মোদ্দা কথায় আসা যাক।
মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ। কলেজে আসন্ন বসন্ত উৎসবের তোর জোর চলছে। আমাদের রানী’মা যথারীতি সব ডাক ছাড়িয়ে, সব কিছু এড়িয়ে নিজের গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধা। আমরা যারা মফঃস্বলের গন্ধ মাখা মানুষ তারা অতি অল্পেই সন্তুষ্ট। বড়লোকি সীমানার বাইরে দাঁড়িয়ে ঢাক ঢোল পিটিয়ে শুরু করছিলাম কলেজের সংস্কৃতির পরিকাঠামোকে রঙিন করে তোলাবার এক অদ্ভুত মাদকীয় উল্লাসে। বসন্ত উৎসব মানেই তো রবিবাবুর বাপত্তর সম্পত্তি। সুতরাং নৃত্য, নাট্য, আর চিরন্তন রবীন্দ্র সঙ্গীতের উপঢৌকন যেমন ছিল, তেমনি আমাদের মতন কিছু উড়নচণ্ডী বাউন্ডুলেদের স্বপ্ন ও হতাশা মিশ্রিত নতুন ধারার বাংলা গানের ব্যান্ড নামক উৎপাতটিও ছিল এই উৎসবের এক মুখ্য আকর্ষণ। আমাদের নতুন বছরের ছাত্র দল দুটি, রাজনৈতিক মতাদর্শে যতই আলাদা থাকুক না কেন, এই উৎসবকে কেন্দ্র করে সবাই মেতে উঠেছিলাম আলেকজান্ডারের রাজ্য অভিযানে। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত চলত কর্মসূচির পরিবর্তন ও সমবণ্টন। মেয়ে মহলেও লেগেছিল সমান পরিমানে উল্লাসে ঢেউ। যেমন করেই হোক উৎসবের আলো যেন মাঠে মারা না যায়, সেই দিকেই ছিল আমাদের সবার দৃষ্টি।
আমি যেহেতু বরাবরেরই একটু আঁতেল টাইপের, তাই আমার উপরেই পড়েছিল উৎসবের মূল পরিকাঠামোটি সাজানোর দায়িত্ব। ছোটো বেলা থেকেই ছবি আঁকা ও লেখা লেখির একটা বদভ্যাস আমার আছেই, আর এই বদ গুণের জন্যই বোধ হয় লোকের চোখেও পড়তাম বেশী। সঙ্গী যেমন জুটে যেত অহরহ, সঙ্গিনীর সংখ্যাও নেহাত নিন্দনীয় কম কিছু ছিল না। কলেজে আসার পর মাস তিনেকের মধ্যেই আমার নিজস্ব পার্শ্বচরের দলটি একটি ঔপনিবেশিক মানসিকতার সাথে বেড়েই চলেছিল উত্তরোত্তর। আমি নিজেই একটি স্বতন্ত্র কলেজ রাজনৈতিক নেতার মতন চেয়ার দখল করে বসে ছিলাম, যদিও তৎকালীন ডান কিংবা বাম কোন রাজনৈতিক দলের প্রতিই আমার বিন্দু মাত্র আকর্ষণ ছিল না। ব্যস্ত থাকতাম নিজের নামের সাথে ইন্টেলেকচুয়াল শব্দটিকে নিয়নের আলোতে সর্বদা উজ্জ্বল রাখবার চেষ্টায়। সুতরাং সখা ও সখি মহলে যে আমার অবস্থান অনেকটা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল সেই কথা আর বড়াই করে না বলাই ভালো, হিতে বিপরীত হতে পারে। যাই হোক আমাকে ঘিরে আমার ও আমার বন্ধুদের এই পরিক্রমণ বেশ বাড়াবাড়ি রকমের অসহ্য হয়ে উঠেছিল পৌষালির কাছে। মূলত সে কখনোই আমার কোনরকম চটকদার কাজের তারিফ করেনি, তা সে আমার অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টই হোক, কিংবা আমার লেখা কবিতা। আমিও নানারকম অদ্ভুত ও অক্ষুণ্ণ চেষ্টা চালাতাম মহারানীর দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্য। যতই তাকে আমার দলে টানবার চেষ্টা করি, ততই সে উন্নাসিক হয়ে উঠতে থাকে। এমনকি একদিন আমার এক সহপাঠিনী কে বলেই বসে – ‘কি পাস তোরা বলত, ঐ মর্কটটার সাথে মিশে ! ছবি আঁকে না ব্যাঙ – যত সব সস্তা, বস্তা পচা কনসেপ্ট দিয়ে লোকের হাততালি পাবার চেষ্টা। গাড়ল একটা’।
কথাটা তৎক্ষণাৎ দূত মারফত আমার কানে এল। কানের ভীতর দিয়ে মরমে পশিল কি না জানি না, তাবে মর্কট কিংবা গাড়ল শব্দটা মেনে নিলেও, আমার কনসেপ্ট তুলে কথা বলাটা ঠিক হজম করে নিতে পারলাম না। আমি হলাম গিয়ে মুকুট হীন সম্রাট, আরা মহারানী কিনা আমারই আকবরনামার উপর কলমের খোঁচা দিচ্ছে! মাথার মধ্যে একটা প্রতিশোধের কালনাগিনী লকলকে জিহ্বা লেলন করতে থাকল অহরহ। আসলে পুরুষের আত্মশ্লঘায় সুড়সুড়ি দিলে যে কোন পুরুষই তা সহ্য করতে পারে না। তারপর যদি আবার সে আমার মতন ইন - টে - ল্যাক - চুয়াল হয়, তবে তো আর কথাই নেই। ছোবল মারবার সুযোগের অপেক্ষায় বসে রইলাম, এমনকি মনে মনে (তা সে যতই নাস্তিক হই না কেন) মহারানীর দর্প চূর্ণের দাবীতে মা মনসার কাছে মানতও করেছিলাম বোধহয়।
৫ ই মার্চ, বুধবার। বসন্ত উৎসবের আর মাত্র দিন দুই বাকি। আমাদের কলেজের ইকনমিক্স বিভাগের অধ্যাপক মাননীয় দয়াকান্ত মুখার্জি (কলেজিও প্রথায় ডি কে এম) মানে আমরা যারা অতি বজ্জাতের দল, তারা তাঁকে ডাকতাম ‘ডাকুম’ বলে। তা সেই ডাকুমের সাথে একটি মিটিং ছিল উৎসবের গোলযোগ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে। ঘণ্টা দুয়েক ডাকুমের হালুম হুলুম জ্ঞান আর বিধিসম্মত সতর্কীকরণ শোনার পর, মাথা ঝিম্ঝিম্ অবস্থা নিয়ে অডিটোরিয়ামের করিডোরের সামনে এসে সবে একটি মূল্যবান হাতে বানানো সিগারেট (তখন আমার আঁতলামোর আর একটি বলিষ্ঠ কেতা ছিল প্রিন্স হেনরি মহাশয়ার নামাঙ্কিত পাউচ প্যাক) ধরিয়েছি, এমন সময় হন্ত’দন্ত হয়ে (যেন সাধের গরুটি হারাইয়া গিয়াছে) মালিনী এসে অত্যন্ত ন্যাকাপনার সাথে খানিকটা আদরের উষ্ণ রসায়ন মিশিয়ে বলল – ‘জানিস আমন ; পৌষালি মেয়েদের কমন রুমে সবার সামনে তোর নামে যাচ্ছেতাই বলেছে’।
নিভন্ত সিগারেটে আর এক বার দেশলাই অপচয় করে, চশমার নিচের অংশটি দিয়ে মালিনীর মালা বিহীন বুক, থুড়ি মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম – ‘মানে ! কি বলেছে বল দেখি, শুনি একটু’।
‘বলে কিনা - আমন না বামন। একটা আস্ত ঢ্যাঁড়স, সে কিনা আবার করবে বসন্ত উৎসব। ঐ তো শিক্ষার বহর, রবীন্দ্রনাথের দু’কলমও পড়ে দেখেনি কোনদিন। কালচার বলতে তো কিছুই নেই, বসন্ত উৎসবের নামে মেয়েদের সাথে ন্যাকামো করার তাল খুঁজছে। থাকে তো ব্যারাকপুরে কলনীতে, সে কিনা আবার কালচার ফোটাচ্ছে’ –
এক নিঃশ্বাসে মালিনী কথাগুলো বলে একটু থামল। আমি তো হতবাক্। কানের পাশগুলো কেমন জানি গরম হয়ে উঠেছে। প্রথমত, আমার প্রতি পৌষালির আক্রোশের কারণটা ঠিক অনুধাবন করতে পারলাম না। দ্বিতীয়ত, রবি বাবু ব্যারাকপুরের কলোনির কোনো ঘরে আসবেন না বা কলনীতে থাকা কেউ রবি বাবুকে জানবে না এমন কথা তো স্বয়ং তিনিও কোথাও লিখে জাননি। তৃতীয়ত, আমার কালচার আছে কি নেই, সেটার সাথে বসন্ত উৎসবের অমিলটা কোথায় বুঝে উঠতে পারলাম না। চতুর্থত, আমি যে একটি ঢ্যাঁড়স সেটা কিন্তু সঠিক ভাবে প্রমাণিত নয়, এমনকি বাজার দরটাও ঢ্যাঁড়সের থেকে আমার কিঞ্চিৎ বেশী বলেই আমি জানি। তবে মেয়েদের সাথে ন্যাকামোর কথাটা একেবারে উড়িয়ে দিতে পারলাম না, তা সে আমি যতই খোঁচে যাই না কেন। মালিনী নিজের মনে আরও অনেক কিছু বলে যাচ্ছিল, আমার কানে আর কিছুই ঢোকেনি সেদিন। মাথাটা আচমকা কেমন জানি গরম হয়ে গেল। বুকের ভীতর কালনাগিনীর ফোঁস ফোঁস যেন আরও বেড়ে গেল হঠাৎ করে। আমি অডিটোরিয়াম ছেড়ে এগিয়ে চললাম ক্যান্টিনের দিকে ।
কিছু একটা করতেই হবে! কিছু একটা তো করতে হবেই! নাহঃ আজ একটা গোটা ভুঞ্জা (গাঁজা) দরকার। রাখুর (আমাদের ক্যান্টিন ম্যানেজার) কাছে স্টক থাকে সব সময়। কথাগুলো হজম করতে পারছিলাম না কিছুতেই।
৬ ই মার্চ, বৃহস্পতিবার। বসন্ত উৎসবের সমস্ত প্রস্তুতি শেষ। কালকে সকাল থেকেই শুরু হবে সারাদিন ব্যাপি উৎসব। অডিটোরিয়ামের মধ্যে আমরা জনা চারেক মূর্তিমান প্রস্তুতি পর্বের শেষ তুলির টানে ব্যাস্ত। স্টেজের আদ্যপ্রান্ত ডিজাইন আমার হাতে করা, এমনকি আজ সারাদিন ধরে হলঘর জুড়ে একটি রঙের বাহারে আলপনা দিয়েছি, নিজের দক্ষতার সর্ব শেষ রস টুকুকে উজাড় করে। স্তরে স্তরে প্রশংসার মাল্যদান করে গেছে আমার সখা ও সখি বৃন্দ। এমনকি অধ্যাপকদেরও কেউ কেউ এসে মুগ্ধ দৃষ্টিতে আলোকপাত করে গেছেন আমার নিপুণ হাতের গড়া ইন্দ্রপ্রস্থের কারুকার্যের উপর। সাফল্যের ব্যাপ্তিতে আমার সর্ব শরীর ঝক্ ঝক্ করছে তখন। করিডোরের সামনে বেড়িয়ে এসে সিগারেট ধরালাম একটি। বেলা তিনটের কাছা কাছি সময় হবে, কলেজের ছেলে মেয়েরা শুরু করে দিয়েছে আবিরের উৎসব। নানা রঙের আবিরে মাখা চেনা মুখগুলো ভীষণ রকমের অচেনা হয়ে উঠছে নিমেষের মধ্যে। আবির হল সখ্যতার প্রিতীকি, সম্প্রিতির প্রতীকি। সবাই সবাইকে আবির মাখানোয় ব্যস্ত। হঠাৎ নজরে এল, ক্যান্টিনের গেটের দিকে লাল কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে পৌষালি একা। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের মাঠের দিকে, যেখানে আবির খেলছে কলেজের সবাই। মুখে কেমন জানি একটা তাছিল্যের ভাব। ভারি অদ্ভুত লাগলো পৌষালির এই ব্যবহার, যেন সবাই কোন এক নিষিদ্ধ অপরাধ করছে একসাথে। নিজেকে সামলাতে পারলাম না। নেমে এলাম মাঠে। আমাকে দেখে ঘিরে ধরেছে সবাই। আবিরে আবিরে আমার মুখ রঙিন হয়ে গেল নিমেশে। সবাইকে ছাড়িয়ে আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে, দুই হাতের মুঠোয় লাল আর গোলাপি আবির। সামনের মাঠের দিকে চেয়ে আছে পৌষালি। দেখতে পায়নি আমায়। নিশ্চুপে এসে দাঁড়ালাম তার পিছনে। মৃদু গলায় ডাকলাম – পৌষ!
মুখ ফিরিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই, দুই হাত উজাড় করে ঢেলে দিলাম আবির, পৌষালির সমস্ত মুখে, সাদা ক্যানভাসে প্রথম রঙের দাগ। ভীষণ রকমের আবেগ মাখিয়ে বললাম, - ‘শুভ বসন্ত উৎসব, পৌষ’
মাথার ভীতরে একটা কিছু ভড় করেছিল যেন। নিমেশে বুঝতে পারলাম, আমার অপরাধের মারাত্মক ফল কি হতে পারে। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম পৌষালির সামনে। পৌষালিও যেন সম্বিৎ ফিরে পেল হঠাৎ। এত সচেতন ভাবে আর আচমকা আমি ঘটনাটা ঘটিয়ে ফেলেছিলাম, যে বাধা দেবার সুযোগও পায়নি সে। ভারি সুন্দর লাগছিল তার মুখ, বিকেলের ম্লান আলোতে মাখা পৌষের রঙিন মুখ, আমার বুকের ভীতরের ইমারতগুলো ভেঙে পড়ছিল ক্রমশ। চোখ ফেরাতে পারছিলাম না পৌষের মুখের থেকে। কয়েক মিনিটের স্তব্ধতা। তারপর, হঠাৎ পৌষালি ছুটতে লাগলো কলেজের মেইন বিল্ডিঙের দিকে। আমি নির্বাক স্তব্ধ এক মূর্তি। দুই হাত আবিরের রঙে রাঙানো, নিস্পলক চোখে দেখছিলা, পৌষ ছুটে চলেছে নীল উড়নি উড়িয়ে।
মাঠের দিক থেকে অনেকেই লক্ষ্য করেছিল আমাকে। উল্লাসের আনন্দে মাতোয়ারা ছিল সবাই, তাই বুঝে উঠতে পারেনি অনেকেই ছায়াছবির মূল দৃশ্যটি। যখন বুঝতে পারল, সবাই ঘিরে ধরল আমায়। ততক্ষণে সারা কলেজে রটে গেছে আমার চরম অপরাধের কথা। ডাক পড়েছে প্রিন্সিপালের ঘর থেকে। বিচারাধীন আসামী আমি, ফাস্ট ইয়ারের এক ছাত্রীকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আবির মাখানোর অপরাধে দণ্ডিত, যাবজ্জীবন অরণ্য বাস।
৭ ই মার্চ, শুক্রবার। কলেজের উৎসবের বাঁশি বেজে চলেছে অবিরাম। অপরাধ যতই গুরুতর হোক না কেন, শাস্তি হিসেবে একটু বেশী মাত্রাই লঘু দণ্ড দেওয়া হয়েছিল আমাকে। টানা ঘণ্টা দেড়েক প্রিন্সিপাল রুমে নানা রকম বাক্ বিতণ্ডার মধ্যে দিয়ে ধার্য হল, স্ব-বিস্তারে ক্ষমা চাইতে হবে আমায়, পৌষালির কাছে। নিম রাজি আমি, সহপাঠীদের কথায় রাজি হলাম শেষ পর্যন্ত। প্রয়োজনে নাক খত কিংবা ঐ জাতীয় গুরুতর ব্যাবস্থাও গ্রহণ করতে রাজি। কিন্তু গতকালের ঐ তাণ্ডবের পর পৌষালিকে আর খুঁজে পায়নি কেউ, সে বাড়ি পালিয়েছিল।
সকাল থেকেই কলেজের আবহাওয়া পরিবর্তন হয়েছে। কালকে বিকেলের ঝড়ের বিন্দু মাত্র চিহ্ন নেই কোথাও। সবাই মেতে উঠেছে রঙের উৎসবে রঙের সাজে। শুধু আমিই যেন তালটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না ঠিক করে। মনের ভীতর একটা অদৃশ্য হাওয়ায় সুরটা কেটে যাচ্ছিল বারে বারে। এক জোড়া চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছিল আর এক জোড়া চোখকে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চলল। পৌষালি আসেনি আজ কলেজে। অডিটোরিয়ামের সামনে
তিল ধারণের জায়গা নেই। সবাই নানা ভাবে আমাকে প্রশংসা পত্র দিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। কিন্তু নিজের ভীতরে একটা দামামা শুধু বেজেই চলেছ দুম্ দুম্ - দুম্ দুম্ - অদ্ভুত ছন্দে। আনমনে একটা সিগারেট ধরিয়ে আমি এগিয়ে চলেছি কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে। ক্ষমা চাইবার মতন ক্ষমা টুকুও করেনি পৌষালি আমাকে ।
গাছের নিচে বসে আছে একা পৌষালি। পরনে সাদা খোলের লাল পাড়ে জামদানী। বসে আছে একা, এক ভাষাহীন দৃষ্টির সাথে, সামনে মাঠের দিকে তাকিয়ে।
সে লক্ষ্য করেছে আমার আনমনে হেঁটে আসা। শুধু আমিই প্রথমে দেখতে পাইনি তাকে। কাছে এসে দাঁড়ালাম অপরাধীর মুখে, ক্ষমা যে আমাকে চাইতেই হবে। বললাম – ‘আমায় ক্ষমা করো পৌষালি। আমি বুঝতে পারিনি যে তুমি আবির ভালোবাস না। আর কোনদিনও এরকম করবনা আমি’।
চুপ করে বসেছিল পৌষ। ভীষণ মায়াময় একটা মুখ, বুকের ভীতর ইমারতগুলো আবার ভাঙতে শুরু করেছে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, পৌষালির দু চোখ বেয়ে নেমে আসছে জল। বললাম – ‘আমি সত্যি বুঝতে পারিনি পৌষ, বিশ্বাস করো। আমি কোনদিনও আর রঙ মাখাবো না তোমায়’।
উঠে দাঁড়ালো পৌষালি, বলল -
‘আমি যে এই রঙে রাঙাতে চাইনি আমন। তোমার এই রঙ যে শুধু আমার জন্য নয়। এই রঙ যে তুমি বিলিয়ে দাও সবার সাথে। আমি উন্নাসিক, ভাগ করে নিতে শিখিনি কোনদিন। তোমার রঙের ধারায় ভেসে যায় সবাই। তোমার ছবির সাথে, তোমার লেখার সাথে সবাই আছে। সেখানে তো শুধু আলাদা করে আমি কোথাও নেই আমন! কেমন করে মেনে নেব এই রঙ, কেমন করে মেনে নেব তা! কেন আমাকে অপমান করলে তুমি! কেন!!
অঝস্র কান্নায় ভেসে যাচ্ছে পৌষের মুখ। একই সঙ্গে অজস্র রঙের মাঝে শুধু একটাই রঙ আমার বুকের সমস্ত ক্যানভাস জুড়ে।
কান্নাও যে এত রঙিন, এত সুন্দর হতে পারে, ভাবিনি কোনদিন।
No comments:
Post a Comment