এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

রুমেলা দাস


বিভাগ : গল্প (ছোট গল্প)


"বাদামি বুনন"

সকালের কলকাতা আমার বরাবরের পছন্দের।ঝাঁট দেওয়া রাস্তার একধারে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কেটলি,কাগজ খোলা মেজাজি মুখ কিংবা যাপনের শুরুতেই মা-বাবার ব্যস্ততা এ সমস্তই আপন করে শহুরে ফ্রেমকে।বিবর্তনের কাঁটা ধরে অনেক কিছু পাল্টালেও,এমন অনেক কিছু আছে যা প্রবাসী পা-কেও স্বচ্ছন্দে টেনে আনতে পারে ট্রামলাইনের ধারে পুরোনো কলকাতায়।
লোকে বলে,এ শহর আজ নিজের পায়ে চাকা লাগিয়েছে।চাকরি,এগিয়ে যাওয়ার দৌড়,রেস এসবে হারিয়েছে নরম সোনালী সকাল। আদুরে ভালোবাসা।গোলা পায়রার দল নাকি আজকাল জোড়ে নয়,বিজোড়ে থাকতেই ভালোবাসে।স্পর্শ,চেতনা,অনুভূতিটুকু কেবল সিনেমা হলের আড়াই-তিন ঘন্টায় আটকে কিংবা কফিশপের আড্ডার ঘেরাটোপে।কি জানি,হয়তো তাই।
তবু একদিন একটা সকাল আমি দেখেছিলাম,যে সকালে লাইন জড়ানো ভালোবাসা পায়ে হেঁটে এসে পৌঁছতো ব্রেসব্রিজ স্টেশনের আটটা কুড়ির লোকাল ট্রেনে।আমি তাদের নাম জানতাম না।জানার বিশেষ কৌতূহলটুকুও বোধ করিনি তবে কলেজ যাওয়ার ভিড়-ভাট্টায় এটুকু মনে হতো ওদের জগৎটা যেন এক্কেবারে আলাদা।সবের মাঝে থেকেও ওরা যেন নিজেদেরই মধ্যে।খুব অবাক লাগতো আবার হাসিও পেতো মাঝে মাঝে।এমনও হয়!
গল্পের রূপ দিতে আমি তাই তাদের নাম দিয়েছি।মিস্টার এবং মিসেস চৌধুরী।ট্রেন আসার সাথে সাথে তড়িঘড়ি বাকিদের মতো একে অপরের হাত ধরে উঠে পড়তেন জেনেরাল কামরায়।কোনোদিন সীট পেতেন,কোনোদিন আবার পেতেন না।রোজকার অভ্যাসটা যেন রুটিনে দাঁড়িয়ে গেছিলো ওদের।একফালি জায়গাতেও মানিয়ে বসে পড়তেন দুজনে।চল্লিশোর্ধ মিস্টার চৌধুরী খবরের কাগজে মুখ গোঁজার সাথে সাথে,মিসেস চৌধুরীও তাঁর বুনন শুরু করে দিতেন।একটা বাদামি রঙা উল আর তার থেকে সমান কিছু অংশের অসমান আঁকাবাঁকা বুনন।মা-মাসীদের হাতে প্রায়শই এসব দেখেছি তবে ধারণা নিতান্ত কম থাকায় বুননটি কিসের বুঝে ওঠা দায়।শুধু দেখতাম বাদামি রঙা উল আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যাচ্ছে আর বুনন ক্রমশঃ বড় হয়ে যাচ্ছে।সাথে সাথে মিস্টার এবং মিসেস-এর যাপনচিত্র আরো গভীর থেকে গভীর হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ট্রেন-লাইনের গলিপথে।মিসেস চৌধুরীর হাসি,মাপ নেওয়ার যত্ন দেখে আশেপাশের লোক ব্যাঙ্গ করতো কখনো।কিন্তু নিয়মিত সাধারণ বুঝতোনা এটুকু অক্সিজেনই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে।নাহলে ধুলো,ধোঁয়ায় বিজ্ঞাপনেরও হাঁফ ধরে।দিন,সপ্তাহ,মাস কাটতে থাকে।মিসেসের বুনন ও প্রায় শেষের পথে.....
**************
(২ মাস পর)
এ দুমাসের একদিনও কলেজ যাওয়ার পথে চৌধুরী দম্পতিকে দেখতে পায়নি। পরীক্ষা আর যাবতীয় টেনশনে নিজেকে দেখার সময়টুকু পেতাম না।তবু অবান্তর,চোখা প্রশ্নগুলো নানান ভাবে,নানান ভাঁজে আমার আর আমার পড়ার টেবিলে ঘোরাফেরা করেছে।তবে কি মিস্টার চৌধুরী বদলি হয়েছেন? নাকি অন্য কোনো পথে যাতায়াত শুরু করেছেন তাঁরা।জানি প্রশ্নগুলো খুবই অমূলক।তবে মানুষ যতই প্রগতির দিকে এগোচ্ছে,অমূলক চিন্তা ভাবনা ততই তাকে ঘিরে ধরছে।এরপরই আসে সেই দিন,যা আমার জীবনে কেবল একটা দিন নয়,একটা অধ্যায় হয়ে রয়ে গেছে.....।
************
রোজের মতো আজও ছুটছে সবাই।আমিও এরই মাঝে রোজনামচায় এগিয়ে চলেছি আটটা-কুড়ির লোকালের দিকে।কিন্তু হটাৎ......হটাৎ স্টেশনের রতন কাকুর চায়ের দোকানে চোখ পরে আমার।মিস্টার চৌধুরী না?এতদিন পর!বুদ্বুদের মতো এক কৌতুহল আমাকে ধাওয়া করতে শুরু করে আর আমিও ছুটতে ছুটতে পা মেলাই ইঁদুর দৌড়ে।পাশ কাটিয়ে,হাত সরিয়ে জেনেরাল কামরার উঠে পড়ি সেই মানুষটির গা ঘেঁষে।কেমন যেন আনমনা।নিজেকে কিছুতে আর আটকে রাখতে পারিনি.....পাশে বসার অজুহাতে প্রশ্নটা করেই ফেললাম.....
"কেমন আছেন আপনি?অনেকদিন দেখিনি!আপনার স্ত্রী আসেননি? চিনতে পারছেন আমাকে?"- একনাগাড়ে কথাগুলো বলে দম নিলাম।না জানি কি ভুলচুখ করে ফেললাম।
"তুমি সেই ছেলেটা না!.....যে আমাদের বারবার দেখতে.....ও আমাকে বলেছিলো.... তুমি একদিন আমাকে এই প্রশ্নটাই করবে!"- উত্তরের সমস্তটা জুড়ে একরাশ সাদা।
অদ্ভুত একটা তিরতিরে ভয় শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যেতে লাগল।হাসির ভাঁজগুলো অমলিন হয়ে,মিস্টার চৌধুরীর মুখ জুড়ে এক বৃদ্ধের ছায়া ফেলেছে যেন।এ ক-মাসে চল্লিশোর্ধ একজনকে করেছে অশীতিপর।কিন্তু কি এমন ঘটেছে.....!
****************
ট্রেন চলতে শুরু করেছে।
তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে একের পর এক দোকান,ঘর-বাড়ি,রাস্তাঘাট,দোকানের ঝাঁপি আরো অনেক কিছু।পরবর্তী স্টেশনে নামার জন্য কিছু হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে গেল গেটের দিকে,কেউবা অপেক্ষায় থাকলেন তার গন্তব্যের।মিসেস চৌধুরীরও হয়তো এমনি তাড়া ছিল।তাই কাঁটা ধরে ঘন্টা,মিনিট,সেকেন্ড মুহূর্তের চুলচেরা যাপন করে গেছেন নিভে যাওয়ার মুহূর্ত পর্যন্ত।কোষে কোষে ক্যান্সারের বিষ শুষে নিলেও প্রাণের সঞ্জীবনী তাকে কখনো উদ্যম হারাতে দেননি।
দাবি শুধু এটুকুই ছিল,তার প্রাণপ্রিয় মানুষটির পাশে থাকা ক্ষণ যেন কোনোভাবেই হারিয়ে না যায় তার জীবন থেকে।আর তাইতো হাজার নিষেধ,হাজার বারণ সত্ত্বেও রোজ অফিস যাওয়ার সময়টুকু মিস্টার চৌধুরীর সাথে আসতেন,বসতেন,গল্প করতেন।আবার তিনি  নেমে যাওয়ার পর,পরবর্তী স্টেশনে নেমে ঘরে চলে যেতেন।
প্রতি মুহূর্তের এই ছোট্ট ছোট্ট বাঁচার মানে হয়তো আমি মিসেস চৌধুরীকে না দেখলে কখনো জানতে পারতাম না।ট্রাম,রাস্তা,ধুলো ধোঁয়া পথের মাঝে এমন এক গল্পকথা কেবল এ মহানগরীর বুকেই হতে পারে!
সমস্তটা শোনার সাহস আমার তখনও ছিলোনা।মুখ ঘুরিয়ে নিজের অনুভূতিটুকু লুকাতে গিয়ে সেই মানুষটার দিকে আরো একবার চোখ চলে গেছিলো,সেই চল্লিশোর্ধ মানুষ যার গলায় অর্ধ-বুননের বাদামি মাফলার জড়ানো,জড়ানো সেই পরম আদুরে আবদার।যা তাকে কোনোদিন ছেড়ে যায়নি,যাবেনা,যেতে চায়না।
লোকাল ট্রেনের ভিড় আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে।গন্তব্য এগিয়ে এলো আমারও........
(সমাপ্ত)
(একটি নিবেদন:
আমার এই গল্পটি 'বাদামি বুনন' হিন্দি ছোট গল্প 'মেহেরুনী' থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা।)


বিভাগ : চিত্র (অঙ্কন)






*******
রুমেলা দাস।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ব-বিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী।নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে জার্নালিজম এ ডিপ্লোমা স্নাতকোত্তর।বেসরকারি কিছু নিউজ চ্যানেলে সংবাদপাঠক হিসাবে কাজ।
বর্তমানে কলকাতার বাইরে।সাহিত্যের সাথে যুক্ত।
কলকাতা 24*7ওয়েব ম্যাগাজিন,বাঁকুড়া থেকে প্রকাশিত ওয়েব অন্তর্বর্তী শুন্যতা, ফেরারি ওয়েব,এখন তরঙ্গ,অর্বাচীন পত্রিকা সহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কবিতা,গল্প প্রকাশিত।প্রচ্ছদ অঙ্কন অর্বাচীন পত্রিকা ও বারণিক প্রকাশনার বিভিন্ন সংকলনে।
সদ্য আগত বর্ধমান লিটিল ম্যাগাজিনে প্রকাশিতব্য প্রেমের গল্প সংকলনে গল্পের স্থান।
আরো কিছু গল্প,কবিতা,প্রবন্ধ,প্রচ্ছদ প্রকাশের অপেক্ষায়।
অনুপ্রেরণা-একমাত্র কবিগুরু।





No comments:

Post a Comment