এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

মধুমিতা সেনগুপ্ত



বিভাগ : গল্প (ছোট গল্প)



লড়াই
        
          স্নিগ্ধা মরিয়া হয়ে ছোটে ডাক্তার সোমের পিছনে ..
__ শুনুন না ডাক্তারবাবু আমার কথাটা ; একটু দয়া করুন  আমায়, আমি বাড়ি যাব ৷

    শান্ত দৃষ্টিতে ডাক্তারবাবু তাকিয়ে থাকেন বছর তিরিশের মেয়েটির দিকে ৷
সন্তান হওয়ার কিছুদিন পরে মানসিক ভারসাম্য হারানোয় ওর স্বামী এই পাগলা গারদে ওকে দিয়ে যায় ৷ দুবছরের চেষ্টায় মেয়েটি  প্রায় সুস্থ হয়েগেছে ৷

__আমার বাচ্ছাটা দুধ খায় ...কতদিন কোলে নিইনি ওকে ৷ আপনার পায়ে পড়ি বাড়িতে জানান আমি সুস্থ হয়েগেছি ৷ এই চিঠিটা পাঠিয়ে দিন ও ঠিক নিতে আসবে ....আমাকে বড্ড ভালবাসে ...৷

        চিঠিটার সাথে নিজে অফিশিয়াল প্যাডে চিঠি লিখে ডাক্তারবাবু পাঠিয়ে দেন ৷ এতবছরের আভিজ্ঞতায় কোনো আশা না রেখেই ৷ দীর্ঘশ্বাস চেপে ৷

       দিন দশেক বাদে উত্তর আসে ৷ সদ্য কাজে যোগ দেওয়া অনভিজ্ঞ এক ওয়ার্ডবয় স্নিগ্ধার হাতে চিঠিটি দেয় ৷ দুমিনিট বাদেই সে কান্নায়  ভেঙে  পরে .. কেউ সামলাতে পারেনা ৷
       ডাক্তারবাবু এসে ইঞ্জেকশন রেডি করতে বলে, চিঠিটি পড়েন .. "পাগল ,তুই মর ৷"
__হায় ভগবান ! কেন ওর হাতে চিঠিটা ধরালে ! কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই ! আমার দুবছরের সমস্ত  চিকিৎসা বৃথা হয়ে যেতে দেবনা কিছুতেই  ! "

  তাড়াতাড়ি কড়া ঘুমের ওষুধ ইনজেকশন দেন ডাক্তারবাবু ।


    ডিনার টেবিলে খাওয়ারের থালা সামনে নিয়ে ডাক্তার বাবু অন্যমনস্ক হয়ে যান । আবার নতুন করে চিকিৎসা শুরু করতে হবে কিনা সেটা এখুনি বোঝা যাচ্ছে না । মানসিক হাসপাতালের এক একটি রুগীকে সুস্থ করা  এক একটা দীর্ঘ  পরীক্ষা । প্রতিটি রুগীর ইতিহাস আলাদা । সামাজিক বা পারিবারিক অত্যাচারের গল্প আলাদা । কারো বংশগত অসুখ কারো আঘাত জনিত । কিন্তু একটি মানুষ যখন সুস্থ হয়ে ওঠে তাদের দেখে ডাক্তার হিসেবে ভীষণ আনন্দ হয় তাঁর । কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সমাজে তাদের ফেরার জায়গা থাকে না তখন পুরো সংগ্রামটাই অর্থহীন লাগে । এদের পূর্ব স্মৃতি ফিরে আসে কিন্তু পরিবার এদের মেনে নিতে চায় না । অথচ আগের অবস্থানে ফিরে গেলে এরা স্বাভাবিক জীবন কাটাতে পারে ।
―“ কি গো ! খাচ্ছ না কেন ! ” প্রশ্ন করেন তাঁর স্ত্রী শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ কস্তুরী সোম  ।

―“না তেমন কিছু না ।” খাওয়াতে মন দেন রাহুল ।


   পরের দিন স্নিগ্ধা গুটিগুটি পায়ে এসে দাঁড়ায় । ডাক্তার বাবু খুব শান্ত গলায় বলেন ―“ কতদূর পড়াশোনা করেছিলি ?  মনে আছে কিছু ? ”

―“ হায়ার সেকেন্ডারি তে সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছিলাম । সেসব কাগজপত্র মায়ের কাছে আছে ।” বলে স্নিগ্ধা ।

―“মায়ের কাছে ফিরে যাবি ? যোগাযোগ করবো ? ” জিজ্ঞাসা করেন রাহুল ।

―“আমায় একটা কাজ জোগাড় করে দেবেন ডাক্তারবাবু ?  আমি কারো বোঝা হতে চাইনা । বাবা নেই । দাদার রোজগার অল্প । ওই বাড়িতেও আমার জায়গা হবে না । আমি কি নিজের দুমুঠো ভাত জোটাতে পারবোনা ? ” চোখের অবাধ্য জল মোছে স্নিগ্ধা ।

―“আপাতত তুই এখানে রান্নাঘরে কাজ কর । একটু সময় লাগবে । ভাবতে হবে । ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলতে হবে । " বলেন ডাক্তার বাবু।


          হাসপাতাল ম্যানেজমেন্ট এর দায়িত্বে থাকা বিপ্লব বাবু এককথায় সব যুক্তি নাকচ করে দিলেন ।  সবার কাজ খুঁজে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে তাঁরা অপারগ । প্রতিবছর অনেক রুগী সুস্থ হয়ে উঠছেন । তাঁদের সবাইকে হাসপাতালে কাজ দেওয়া অসম্ভব ।

      
        রাতের বেলা মাঝে মাঝে দুটো কথা  বলার সুযোগ পান ব্যস্ত ডাক্তার দম্পতি । রাহুল স্ত্রী কে স্নিগ্ধার ঘটনা পুরোটা খুলে বলেন । কস্তুরী শুনে একটু ভেবে বলেন ―“ মেয়েটির তো দুই বছরের বাচ্ছা আছে বাড়িতে । ওকে তুমি আমার কাছে নিয়ে এসো । শিউলির বাড়িতে একটা বড় ক্রেশ খুলেছে ।  অনেক বাচ্ছা আসে । ছোট বাচ্ছাদের কাজ শিখিয়ে নেবে ওরা  । ওর টাকা রোজগার ও হবে আবার বাচ্ছাদের সঙ্গে থেকে মন ভালো হয়ে যাবে । ”

―“ শিউলি কে  বলোনা যেন যে ও আমাদের  এসাইলাম এ ছিলো । বেচারী চাকরীটা পাবে না । তাছাড়া বাচ্ছাদের অভিভাবক রা জানতে পারলে ওর ক্রেশ উঠে যাবে ।সব দিক ভেবে চিন্তে এগিয়ো । তোমার সাথে শিউলির সম্পর্ক টা যেন নষ্ট না হয়ে যায় । " বলেন রাহুল ।

―“ ও আবার অসুস্থ হয়ে যাবে না তো ? ” কস্তুরী জিজ্ঞাসা করেন ।

―“ না । আমার বিশ্বাস হবে না । কারণ ওকে আর বাড়িতে ফেরৎ নিয়ে যাবে না কেউ এই রূঢ় বাস্তবটা জানার পর যখন ও সামলে নিয়েছে তখন অল্প ঝড়ে বেসামাল আর হবে না ও । তবু কিছু মাস  অন্তর আমি ওকে দেখবো । বাচ্ছাদের কাজ করতে ওর ভালোই লাগবে আশাকরি । লড়াই টা একটু হলেও কম কষ্টকর হবে । " আশ্বাস দেন রাহুল ।


       মাতৃ ক্রোর ক্রেশের সামনে এসে গাড়ি পার্ক করেন কস্তুরী । স্নিগ্ধা নামে গাড়ি থেকে । শিউলির কাছে কোনো কথা লুকিয়ে রাখেননি কস্তুরী । শিউলি সামনে দেখতে চান স্নিগ্ধা কে ।

       কাঁচের দরজা খুলে অফিসে ঢোকে দুজনে । শিউলি মন দিয়ে স্নিগ্ধার কথা শোনে । সন্তানের সঙ্গ পেতে উন্মুখ এক মায়ের কান্না দেখে ।

    শিউলি ম্যাডামের পিছনে লম্বা করিডোর পেরিয়ে একটা দরজা খুলে বিশাল এক হল ঘরে ঢোকে স্নিগ্ধা । দেওয়ালে দেওয়ালে কার্টুনের ছবি আঁকা । মাটিতে পুরু কার্পেট পাতা তার উপরে নানা বয়সের শিশু । কেউ নিজে হাতে ধরে বোতলে দুধ খাচ্ছে । কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে । কেউ ছুটোছুটি করছে । কয়েকজন অল্প বয়সী মেয়ে তাদের খেয়াল রাখছে ।

    শিউলি একজনকে ডেকে বলেন ―“ রীতা আজ থেকে ও এই ঘরে ডিউটি করবে । ওকে কাজ বুঝিয়ে দিও । " বলে নিজের অফিসের দিকে ফিরে যান তিনি ।

    একটি বাচ্ছা মেয়েকে স্নিগ্ধার কোলে দিয়ে রীতা বলে ―“এর ন্যাপী পাল্টাতে হবে পারবে ? ”

      দু আড়াই বছরের ঘুমন্ত মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে বুক ভরে মিষ্টি গন্ধটা টেনে নেয় স্নিগ্ধা । তার চোখে জল আসে । কোলে শুইয়ে দেয় মেয়েটিকে । নিজেকে সামলে নিয়ে বলে ―“পারবো । নিজের বাচ্ছার মতো যত্ন করেই করবো । ”

   এত স্বর্গীয় কাজ জোগাড় করে দেওয়ার জন্য ডাক্তারবাবু আর ডাক্তার বৌদিকে মনে মনে প্রণাম জানায় স্নিগ্ধা ।
জীবনে বাঁচার লড়াই টা আর কঠিন থাকলো না তুলতুলে শিশুদের সান্নিধ্যে । ।


মধুমিতা সেনগুপ্ত 

গৃহবধূ । ছোট থেকে লেখালেখিতে আগ্রহী । 



No comments:

Post a Comment