এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

তুষ্টি ভট্টাচার্য


বিভাগ : ফিরে দেখা


‘এখন তরঙ্গ’ ষষ্ঠ সংখ‍্যা থেকে…..



ফেসবুক


  নিজের লেখালেখির শুরু মুক্তমঞ্চে। সেখান থেকে উৎখাত হয়ে এই ফেসবুকে। এখান থেকে কেউ তাড়াতে পারবে না আমায়, যতদিন না আমি চলে যাব। যার পছন্দ হবে না, সে আমাকে ছেঁটে ফেলতে পারে। সে যাই হোক, এখান থেকেই পত্রপত্রিকায় যোগাযোগ হতে থাকে। আর লেখার নেশায় মেতে যাই। ওয়ালে স্ট্যাটাস লেখাটা আরও নেশা। রোজ কিছু না কিছু লিখি। সেই স্ট্যাটাস জুড়ে জুড়ে একটা খন্ডচিত্র বানিয়ে ফেললাম এখানে।
   একটা শব্দের নেশায় মেতে থাকি। কালো কালো অক্ষরগুলো হাজার ওয়াটের আলো জ্বেলে দিয়ে যায়। অথচ ওদের কোন চাহিদা নেই। যেন বিলিয়ে দিতে পারলেই সুখ। এই এক তরফা প্রেম আমি দুহাত ভরে নিই স্বার্থপরের মত। শব্দগুলো লিখে ফেলি দ্রুত হাতে। কখনো হয়ত ওরা কৃপণ, কখনো তত উদার নয়, তবে সে সাময়িক। ওদের দেওয়া ফুরোয় না। আমি চির ঋণী থেকে যেতে চাই ওদের কাছে। দয়াময়, মায়াময়, ভালোবাসায় ভরা এই অক্ষরগুলো এক হয়ে শব্দ রূপে বেজে ওঠে আর আমি নুপূরের রিনিঝিনি শুনে ফেলি।
    আজকাল এফবিতে এলেই সবাইকেই ফেক মনে হয়। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করি না এই ভয়ে। নিজের ওয়ালে এলে নিজেকেও ফেক বলে মেনে নিই। সত্যিই তো, এই জগত আর কতটুকু জানে মানুষের ভেতরের কথা! এখানে সবাই প্রোফাইল মাত্র। যা লিখছি, ছবি দিচ্ছি সেটুকুই জানছি। বাকি কথা? পরে কেন, কোনদিনই কেউ জানবে না। আজকাল এই জন্য কিছু লিখতেও ইচ্ছে করে না এখানে। বেশিক্ষণ থাকতেও না।
     সুখে, দুঃখে পাশে থাকবে, ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দেবে বা নেবে, এমন বন্ধুকে মানুষ আর পাশে চায় না এখন। চায় স্তাবক পেতে আর হতে
     এক বিটকেল লোকের কাজই হচ্ছে গা জ্বলানো পোস্ট দেওয়া। অন্যরা যাতে রেগে গিয়ে আক্রমণ করে, আর সে সেই সুযোগে বিখ্যাত হয়ে যায়। সে তার উদ্দেশ্যে ভীষণভাবে সফল। বাকিরা বেকার রাগটাগ করে গাদাগুচ্ছের পোস্ট দিয়ে শক্তি নষ্ট করলেন। এই জন্যই বলি, সামলে রেখ জোছনাকে!
   ছোটবেলায় পয়লা বৈশাখ মানেই লুচি, পায়েস, পোলাও, মাংস। আর বিকেলের খেলা শেষ হওয়ার আগেই তুমুল কালবৈশাখী। দে ছুট, দে ছুট... বাড়ির দিকে। চোখে ধুলো ঢুকে দেখতে না পাওয়া সেই আমাকে কিছুতেই ঝড় বাড়ি যেতে দেবে না, এমনই প্রতিজ্ঞা ছিল যেন তার। একপাটি চটি কোথায় যেন ছিটকে চলে যেত.... আজ দেখলাম কালীবাড়িতে পুজো দিতে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে কয়েকটা মেয়ে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে সেলফি তুলছে। কয়েকটা খুদেও দেখলাম মোবাইলে খুটখুট করতে ব্যস্ত। আরও দেখলাম দুই বুড়িকে। কোন দূরের গ্রাম থেকে দুবার বাস বদলে ভোরে এসেছে। ফেরার সময়ে বিভিন্ন আড়ত ঘুরে ঘুরে দুই থলে ব্যাগ ভর্তি মিষ্টি আর বাংলা ক্যালেন্ডার নিয়ে দুপুর রোদে ভেজা গামছা মাথায় দিয়ে বাড়ি ফিরছে। গতকাল রাত সাড়ে দশটার সময় মল বন্ধ হওয়ার পরে জোড়ায় জোড়ায় বাইক সওয়ারীরা উড়ে যাচ্ছিল বাড়ির দিকে। হাইলাইটেড স্ট্রেট চুলের গোছা উড়ছিল আরো বেগে। আজকের উতসবে এই সব চুলে কোন ঝড়ের লক্ষণ দেখি নি। এখন আর কালবৈশাখী আসে না দিনক্ষণ মেনে। পরের প্রজন্ম তাদের পরের প্রজন্মকেও এমন কিছুই বলবে দশ বছর পরে। এভাবেই দিন কাটে আমাদের, এভাবেই। নিয়ম না মেনে।
     কোথা থেকে এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া এসে জানলাটা নাড়িয়ে দিল। আমার নাকে এসে পৌঁছল মেঘের কুলফি গন্ধ। এই মেঘটা আমার খুব চেনা। কুলফির মতই স্বাদ বলে ওর এই নাম। আরেকটু দূরে একটা তরমুজের শরবত নামের মেঘ দাঁড়িয়ে আছে। ওর গা থেকে টপটপ করে ঝরে পড়ছে হিমানী স্নো। আমি ফর্সা হয়ে যাচ্ছি মাগো! আরেকটা দুষ্টু মেঘ, যার নাম কাদম্বরী, নামের মত গম্ভীর সে নয় মোটেও, আমাকে মুখ ভ্যাঙাচ্ছে। একটুও মজা লাগছে না, রাগ হচ্ছে খুব। এসবের থেকে দূরে থাকব বলে বৃষ্টিকে চেঁচিয়ে ডাকলাম-- বিন্নিইইইইইইইই... কই গেলি? ডাক শুনেই হাঁফাতে হাঁফাতে, লাফাতে লাফাতে সে হাজির হল মুষলধারে। নাও, এবার সব্বাই ভিজতে থাক।
(গরমে মাথাখারাপ হলে এমন লেখা হয়)
     পাগলা হাওয়াকে ধরে বেঁধে কী আর সুস্থ করা যায়? তাই জানলা-দরজাকে আর আটকানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। পাগল যেমন পাগলামী না করলেই অস্বাভাবিক, তেমন সুস্থরা পাগলামী করলে অদ্ভুত লাগে। তবে সুস্থ আর পাগলের কোন সীমারেখা নেই, এই যা। কে পাগল আর কে নয় - জানে কি কেউ? পাগল দেখেছি আমি কত জানলায়... কত জানলায় ঝরে অকাল পাগল!
    গরম পড়তে না পড়তেই যা মশার উৎপাত শুরু হয়েছে, এবারে ডেংগিতে ফিনিশ হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না মনে হয়। কাল দেখলাম এক নাটকে মরা সৈনিকের পার্ট করা লোকটা তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল। ব্যাস, নাটকের দফারফা। হুগলী জেলার এই মশা বিবিদের কেউ পুরস্কার- টুরস্কার দেবার ব্যবস্থা করুন অবিলম্বে।
    চুপ! সাহিত্য উদ্ধারের কাজ চলছে। কাল যে পত্রিকার জন্ম হল, তার বিষয় ছিল – ‘একটি গাছ ও একটি বাঁদরউদ্বোধনী আসরে আমাকে গাইতেই হবে। গতকাল সেই পুরনো এক এবং একক গরিষ্ঠ সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকা হুকুম দিয়েছিল চাঁদে গেলে আমরা কেন এক পায়ে নাচতে পারি নাএই বিষয়ের ওপর লিখতে। আর সাতদিন আগে সেই দাদা মিষ্টি করে বলেছিলেন, ‘মিষ্টির ঠিকুজী কুষ্ঠিযেন দ্রুত বিচার করে দিই। সর্বদা অম্বল-গ্যাসে ভোগা সেই দিদি বলেছেন, ‘বিষাক্ত পোকামাকড় ও তাদের বঞ্চনার কাহিনীআমার চাই যত তাড়াতাড়ি হয়। ভাইটি অনুরোধ করেছে, ‘দেরিদার কেন দেরী হলএই নিয়ে কিছু অনুবাদ চাইই চাই। বোনটি বলছে আবদার করে, ‘রাতের বাগানে কে তুমি সূর্যের মত অন্ধকারনিয়ে লেখা কিন্তু আমাকে দিতেই হবে! আর বন্ধু সম্পাদক আর্জি জানিয়েছে, প্রবন্ধ এবার রাখতেই হবে। বিষয় যেমন বলব, তেমন লিখবেবিশ্বাস করুন, আমি নাকরতে পারি না বৃহত্তর বাংলা সাহিত্যের কথা ভেবে। তাই লিখে চলেছি...... বাচ্চারা কেউ ঝামেলা কর না, উল্টোপাল্টা প্রশ্ন কর না... চুপ! সাহিত্য চলছে।
    রোজ সকালে মেঘগুলো আসে। ছায়া দেয় কিছুক্ষণ। যেন এটুকু দেওয়াই ওদের লক্ষ্য। বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ার কোন ইচ্ছে নেই, তাড়া নেই। কেমন অলস হয়ে উড়ে বেড়ায় হাওয়ার হাত ধরে! একটু বাদে যখন রোদ ওঠে, ওরা কোথায় যায়, জানা হয় নি। সব কথা জানতে নেই, সব প্রশ্ন করতে নেই, তাই না?
   খুব বোরিং লাগছে। এককথায় অসহ্য! একবার মেঘ, তারপর গুমগুম, কালো করে আসা আকাশ...এই ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরল বলে! হাঁ করে চেয়ে থাকা আকাশের দিকে। কখন জিভের ডগায় এসে পড়ে এক ফোঁটা জল... আর তারপরেই হঠাৎ অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স! টক করে রোদ উঠে পড়ল, নাকের ডগায় ঘাম জমল, চামড়া শুকিয়ে ডুগডুগি বাজালো...... আর হয়ে গেল আজকের মত খেলা শেষ। এরপর আবার পরের দিন সকাল হতে না হতেই শুরু... এই মেঘ, এই এল, এই এল... তারপর আবার রোদ। আবহাওয়া দপ্তর থেকে রোজ জানানো হচ্ছে, কোথাও কোথাও বৃষ্টির সম্ভাবনা। সেই কোথাওর মধ্যে আমার বাস করা আর হয় না। সে না হোক, কিন্তু এই তানানানানানানানা নাটকটা......... জাস্ট আর নেওয়া যাচ্ছে না!
     জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার ব্রেক-এর সময়ে ছেলের খাবার নিয়ে দৃশ্যত ছুটতে থাকা এক বাবার স্বগতোক্তি - শালার ছেলে ছেলে করে যৌবন গেল, জীবন গেল, আর কী কী নিবি রে পাগলা?
    সাইটস্ক্রিন ছোট ছিল। যদিও এটা খুবই তুচ্ছ কারণ। এই তুচ্ছতা অজুহাত হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। প্রথম বলে আউট হওয়া খুব বেদনার, লজ্জারও। সামনে অনন্ত সুযোগ, অনেক খেলা পড়ে আছে। এগিয়ে যেতে হবে, ম্যাচ জিততে হবে। -- চোখেমুখে ফুটে ওঠা হতাশার সঙ্গে যখন এক দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় ফুটে ওঠে কারুর মুখ থেকে, তাকে আমার একটা আকাশের মত লাগে। এই আকাশেই খর রোদ, এই আকাশ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টি। ফিকে নীল, গাঢ় নীল, ধূসর, কালো, সাদা... আরও কত শেড। এই আকাশকেই আবার জীবনের মত লাগে। কী মুশকিল!
    আমাদের আধার আছে। গরুরও হবে। হয়েই গেছে ধরে নিলাম। তাহলে যুক্তি অনুসারে আমরা আর গরুরা সমান সমান। কিন্তু না মশাই না, সমান নই আমরা। এখানেও সেই ওরা আমরার বৈষম্য। আধার ওদের পাচার রুখবে। আমাদের রোখে নি। তাহলে কী দাঁড়ালো? এই বঞ্চনার জন্য আবার কেন্দ্রকে দায়ী করব? এদিকে আমাদের এপিসেন্টার জুড়ে পড়ে রয়েছে ক্ষোভের চিৎকার। তাহলে?
    রামকুমার গাইছেন - 
এত গয়না বেটি কোথায় পেলি
এত গয়না...
অবস্থা তোর আছে জানা
ভাতের ওপর নুন জোটে না
তবে কিসের এত নবাবী রে তোর
পরে আছিস রাঙা চেলি
এত গয়না বেটি কোথায় পেলি
এত গয়না....
আমার অভক্তিভরা মন বুঝল এই গানটা আমার মত ফেসবুক ফ্রেন্ড-ধন্যদের জন্য।

  কতজনের কত কত রোজকার অভিজ্ঞতা, সে ছবিই হোক বা লেখা, জুড়ে জুড়ে এত বৈচিত্রে ভরা এই ফেসবুক যে আমার নিজের এই সামান্য কোলাজ তার কাছে অত্যন্ত নগন্য। কত তর্ক, বিতর্ক, ঝগড়া, প্রেম... কত যুদ্ধ যে এখানে শেষ হল, কত যুদ্ধ যে এখানে শুরু হল, তার ইয়ত্ত্বা নেই। যদিও বেশিক্ষণ এখানে থাকলে খুব একঘেয়ে লাগে এই এফবিকে, যেমন লাগে নিজের রোজকার জীবনকে। এও এক জীবনের ছায়া, যেখানে মানুষগুলো রোজকার জীবনের মতই মুখোশ পরে, হাসে, কাঁদে, গান গায়। ভাল থাকো জীবন আর দিব্যি থাকো ফেসবুক।

তুষ্টি ভট্টাচার্য
লেখালেখি চার-পাঁচ বছর।
মূলত লিটল ম‍্যাগে  কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ লিখে থাকেন।
২০১৩ সালে পাঠক প্রকাশনী একটি কবিতার বই,
'ভিজে যাওয়া গাছ'





No comments:

Post a Comment