বিষয় : প্রবন্ধ
অঙ্ক √কবিতা
____________________________
“Pure mathematics is, in its way, the poetry of logical ideas.”
-Albert Einstein
লিখতে বসে দেখি, কীবোর্ডে কয়েকটা অক্ষর, কয়েকটা চিহ্ন আর কয়েকটা সংখ্যা। আর কয়েকটা ফাংশন কী। তো, কিছু লিখতে আমরা ব্যবহার করি এইসব, অক্ষর, চিহ্ন আর সংখ্যা। আমাদের ভাষায় যতটা গুরুত্বপূর্ণ বর্ণমালা, ততটাই সংখ্যা, যতিচিহ্ন যতটা ততটাই গাণিতিক চিহ্নগুলি। হ্যাঁ, আমাদের প্রকাশভঙ্গীতে lexical উপাদানের সাথেই অঙ্কের উপাদানও একইভাবে ক্রিয়াশীল।
সংখ্যা , মান আর ক্ষেত্র ( number, quantity and space) এই তিন নিয়ে অঙ্কের পৃথিবী, যোগবিয়োগ-গুণভাগ-বর্গ-ঘন-সমীকরণ,পাটiগণিত-বীজগণিত-জ্যামিতি-ক্যালকুলাস, এসব দিয়ে বানানো এক দুনিয়া, যা বিমূর্ত, যা মেটাফরনির্ভর, যা কল্পনায় রচিত হয়, অথচ যুক্তিপূর্ণ, এবং বাস্তবোচিত, যা তো আসলে কবিতাই, the poetry of logical ideas, এবং একটি ভাবপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে অঙ্ক যতটা বিজ্ঞানের, ততটাই কবিতার। কীবোর্ডে লিখতে গিয়ে যেভাবে আঙুল ঠেকাই ক-খ-গ-ঘ-ঙ-এ, সাথেসাথেই ১ ২ ৩ ৪ ৫-এ, কবিতা আর অঙ্ক, সাহিত্য আর বিজ্ঞান আমাদের জীবনযাপনে মিশে যায়। আলাদা করা যায় না, অনুভূতিতে একই রকম প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। অঙ্ক আর কবিতার মিশ্রণ নয়, অঙ্কই কবিতা হয়ে ওঠে।
অঙ্ককবিতা বলব কাকে?
Bob Grumman, যিনি সারাবিশ্বের সামনে এটিকে কবিতার একটি ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাত্ত্বিক ভিত্তি দিয়েছেন, বিষয়টিকে সংজ্ঞায়িত করেন এইভাবে " A mathematical poetry is a poem some or all of whose verbal elements undergo a mathematical operation certainly important to the poem that is simultaneously both significantly mathematical and significantly verbal -in the opinion of those capable of appreciating the poem” ।
অঙ্ককবিতায় যুগপৎ গাণিতিক ও কথ্য উপাদানের সমান গুরুত্বের কথা বলেন তিনি, যা কবিতাটির উপলব্ধিতে সমানভাবে কার্যকরী।
Connecticut বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কের পড়ান Sarah Glaz , অঙ্ক ও শিল্পের মেলবন্ধনে বিশেষভাবে উৎসাহী তিনি, সংক্ষেপে বলেন," Mathematical poetry is an umbrella term for poetry with a strong link tp mathematics in either imagery, content, and structure. "। এখানে অঙ্ককবিতার ক্ষেত্র আরও বাড়িয়ে তোলা হয়, কবিতায় চিত্রকল্প বা কল্পচিত্র, বিষয়বস্তু, আঙ্গিকে জোরালো অঙ্কের সাথে যোগসূত্র থাকলেই তাকে অঙ্ককবিতার আওতায় নিয়ে আসার কথা বলেন তিনি।
Mathematical Poetry ব্লগটি চালান Kazmier Maslanka , তাঁর “Polyaesthetics and Mathematical Poetry.” নিবন্ধে তিনি বলেন, “Mathematical poetry’ is that it is an artistic expression arising from performing mathematical operations on words or images as if they were numbers.” শব্দ বা ছবির ওপর গাণিতিক ক্রিয়াকলাপ এই কবিতা ধারার অন্যতম শর্ত হিসেবে তুলে ধরেন তিনি। কোনো কেবলমাত্র শব্দে রচিত কবিতায় বিষয় বা রূপক হিসেবে অঙ্কের উপাদান ব্যবহারের থেকে কবিতার মধ্যে mathematical operations-কেই এর মূল বৈশিষ্ট হিসেবে চিহ্নিত করেন । Sarah Glaz-এর imagery যে Kazmier-এর image থেকে ভিন্ন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
Karl Kempton, এই নামটি এখন আমাদের অনেকের কাছেই পরিচিত। পৃথিবীর অঙ্ককবিতার মানচিত্রে উজ্জ্বল কার্ল ,” A mathematical poem is a lexical or visual poem that contains mathematical properties generally central to its expression. Such properties include, though not exclusively, a spectrum that may range from purely mathematical operation(s), as Bob Grumman suggested in his definition and central to the definitions of Kaz Maslanka, to a use of verbal and non verbal symbols to nuanced conceptual mathematical ideas or gestures.” এইভাবে দৃশ্যকবিতার ভূমিকা, কথ্য ও কথ্য-নয়-এমন (মূলত গাণিতিক) চিহ্নের ব্যবহারের বিশিষ্টতা দিয়ে সব সংজ্ঞাগুলির সাযুজ্য স্থাপন করেন।
এই চারজনের বক্তব্য থেকে আমরা পাই অঙ্ককবিতার পরম্পরা, যা
verbal elements undergo a mathematical operation (Bob Grumman )
↓
mathematics in either imagery, content, and structure (Sarah Glaz )
mathematics in either imagery, content, and structure (Sarah Glaz )
↓
mathematical operations on words or images (Kazmier Maslanka )
↓
lexical or visual poem that contains mathematical properties (karl kempton )
এইভাবে ভাবনার পরিবর্তনকে চিহ্নিত করে।
verbal element, word, lexical element - এই তিনটি হচ্ছে একই ব্যাপার, যা শব্দ দিয়ে রচিত হয়। আমরা একে ধরতে পারি a
আর যদি images বা visual element, যা চিত্ররূপ, তাকে ধরি b এবং mathematical operation-কে ধরি m
আমরা যে সমীকরণটি পাই,
Mathematical poetry ∝ m( a+b)
Mathematical poetry = X.m( a+b)
এখানে X হল একটি ধ্রুবক, যাকে আমরা বলতে পারি কাব্যগুণ, যা কোনো বাক্যকে, বাক্যাংশকে, সমীকরণকে, কোনো রচনাকে কবিতা করে তোলে। যা Kazmier কথিত artistic expression এবং এই x ফ্যাক্টারটি না থাকলে কোনো অঙ্কই কবিতা হয়ে উঠবে না; একটি mathematical statement, একটি গাণিতিক বিবরণমাত্র রয়ে যাবে।
কবিতায়, আমরা জানি, গণিত কাজ করে । ছন্দে, মাত্রা গণনায়, লাইন বিন্যাসে অঙ্ক থাকে, যা হল কবিতার অঙ্ক, the mathematics of the poetry, অঙ্ককবিতা এর থেকে আলাদা, যা the poetry
of the mathematics, গণিত যেখানে কবিতা হয়ে ওঠে।
বাংলাভাষায় অঙ্ককবিতার ঐতিহ্য যথেষ্টই সমৃদ্ধ। বিনয় মজুমদার, ভট্টাচার্য চন্দন, প্রভাত চৌধুরী,বারীন ঘোষাল, রতন দাস, নিখিল কুমার সরকার, পিনাকীরঞ্জন সামন্ত, প্রদীপ সিংহ,বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়,আফজল আলি প্রমুখের কবিতায় গাণিতিক চিন্তাভাবনার ছাপ আমরা দেখতে পাই। যদিও তাঁদের সমস্ত রচনাই যে গণিতকেন্দ্রিক এমন নয়। এবং বাংলাকবিতায় অঙ্কের চিহ্ন-সমীকরণ অথবা ইমেজে রব্যবহার নিতান্তই সামান্য । গণিতের ভাবনাকে কবিতায় অথবা কবিতায় গাণিতিক যুক্তি-সংগঠন-অভিব্যক্তিকে নিয়ে আসা, এই আমরা দেখতে পেয়েছি বাংলা কবিতায়। সাম্প্রতিক তরুণদের লেখালেখিতে কবিতার ভাবনায়, বিষয়ে, অঙ্গিকে, উপস্থাপনায় অঙ্ক আরও বিস্তৃতভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইন্দ্রনীল ঘোষ, নীলাব্জ চক্রবর্তী, সব্যসাচী হাজরা, সৈকত ঘোষ,রাহুল গাঙ্গুলী, পিনাকী হালদারের কিছু কিছু কবিতা উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলা কবিতায়
Mathematical poetry ∝ m( a+b)
এই সুত্রটিতে b প্রায় ০-ই ধরা যায় , এটি
Mathematical poetry ∝ m.a
অর্থাৎ Mathematical poetry = X.m.a এমনও ব্ললা যেতে পারে।
অঙ্ককবিতা, আমাদের কাছে এখনও, কবিতায় বিষয় হিসেবে, রূপক হিসেবে গণিতের ব্যাবহার। তবু আমরা আশা রাখি অঙ্কের ক্ষেত্রটি বাংলা কবিতায় বিস্তৃত হবে।
কোনো কবিতায় বিষয়ে, অঙ্গিকে, উপস্থাপনায় অঙ্কের ভাবনা ও অভিব্যক্তি ব্যবহৃত হয়ে কবিতাটির প্রকাশে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করলে তাকেই আমরা বলব অঙ্ককবিতা। অঙ্কের উপাদানটি বাদ দিলে কবিতাটি আর সম্ভবই হবে না। যদি এরকম না হয়, তা অঙ্ককবিতা হয়ে উঠবে না, কবিতায় অঙ্কের নিছক ব্যবহার হিসেবে বিবেচিত হবে।
কিন্তু কবিতা অনির্দেশের যাত্রা আর গণিত নির্দিষ্টকে সূচিত করে। শব্দের যে বহুমাত্রিকতা সংখ্যা দিয়ে তা কি তৈরি করা যায়? ‘বটগাছ’ এই শব্দটি বিভিন্ন শ্রোতার/পাঠকের মনে বিভিন্ন অভিঘাত নিয়ে আসে, কিন্তু ৩ সংখ্যাটি, অনেকের মতে, কেবলই ৩ এবং এই ৩-এর সঙ্গে ৫ যোগ করলে আমরা পাব ৮, সবক্ষেত্রেই ৮, যা অনিশ্চয়তাকে নষ্ট করে, বোধকে সীমাবদ্ধ করে।বারীন ঘোষাল তাঁর “ছাব্বিশ দফা প্রতারণা’ নিবন্ধে ১৫ নম্বর ফ্যালাসি হিসেবে চিহ্নিত করেন সংখ্যার ফ্যালাসিকে। লেখেন, “ কবিরা কবিতায় সংখ্যা হাজির করে কোনো অলীক প্রভাবের জন্য, অথবা কোনো ঘটনা বা বিশ্বাসকে স্বীকৃতি দেবার জন্য, অথবা খুঁটিনাটি বিশেষত্বের আপাত প্রতিষ্ঠার জন্য, অথবা আঙ্কিক নিয়মকে আক্রমণ করার জন্য। .... এই ফ্যালাসিটি আজকের কবিরা ব্যবহার করে না , এটাই সুখের।”
‘আজকের কবি’ না হয়ে প্রচলিত পথের বাইরে যাঁরা হাঁটতে চান, তাঁদের কেউ কেউ সংখ্যা ও অঙ্ককেই সঙ্গে নেন, গাণিতিক প্রকাশভঙ্গীর সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে যান।
শব্দে যেভাবে লেগে থাকে অর্থের মিথ, কমিউনিকেশনে যেভাবে পরম্পরাগত অর্থ কাজে লাগে, সংখ্যাতেও তাই। আর গণিতের মধ্যে যে বিমূর্ততা, কল্পনার যে চূড়ান্ত প্রকাশ তা তো কবিতাতেও একইভাবে ক্রিয়াশীল। এবং কাব্যগুণ, ওই x ফ্যাক্টার একটি সমীকরণকে, একটি গাণিতিক অভিব্যক্তিকে কবিতা করে তোলে।
আর কবিতা যদি হয় কবির উপলব্ধির প্রকাশ, যদি একান্তই কোনো দার্শনিকতার দায় থাকে তার, যদি কোনো সত্যের মুখোমুখি হতে হয় তাকে, তো, H. D. Thoreau-র কথাগুলি মনে রাখতে হয় আমাদের, “We have heard much about the poetry of mathematics, but very little of it has as yet been sung. The ancients had a juster notion of their poetic value than we. The most distinct and beautiful statements of any truth must take at last the mathematical form. We might so simplify the rules of moral philosophy as well as of arithmetic, that one formula would express them both”।
ক্রমশ
( প্রথম প্রকাশঃ মধ্যবর্তী )
অনিন্দ্য রায়
জন্ম: ২৮শে জানুয়ারি ১৯৭১, বাঁকুড়া
লেখালেখি শুরু : নব্বইয়ের দশক
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : তিরিশে ফেব্রুয়ারি
স্পার্ক অ্যাভেনিউ
কাগজের হারপুন
এক পঙ্ক্তির অনিন্দ্য রায়
সম্পাদনা : কবিতাডিহি
|
No comments:
Post a Comment