প্রবন্ধ
জুনিয়রদের জন্য একটি বিপজ্জনক খোলা লেখা- (কার্টসি সরিৎবাবু)
১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭
এই লেখাটি আমার নিজের কাছে নিঃসন্দেহে ২০১৭ তে আমার সেরা সিংগুলার লেখা। আর এর পূর্ণ ক্রেডিট সরিৎবাবু (@sarit chatterjee)। একটা নেগেটিভ বিষয় নিয়ে লিখতে বাধ্য হয়েচজিলাম, লিখছিলাম তাই। যেকোনো চরম নেগেটিভ জায়গা থেকে একটা ক্রিয়েটিভ পজিটিভ জায়গা তৈরী করা হলো একজন লেখার লোকের কাছে সেরা চ্যালেঞ্জ। গতকাল থেকে জীবনানন্দ ইত্যাদি নিয়ে অনুপমের বিকট লেখাটি এবং তস্য বিকট নানারকম ব্যক্তিগত আক্রমণ তার পেশা, তার স্বভাব ইত্যাদি নিয়ে আমাকে বেজায় ডিসটার্ব করেছিলো। অনুপম হোক আর যেইই হোক, বাংলা লেখার জগতে এত নিম্নমানের পাঁকঘাঁটা আমাকে প্রচণ্ড কষ্ট দেয়। অনুপমকে বলার কিছু নেই, ও এক আশ্চর্য বস্তু, তুলনারহিত। কিন্তু জুনিয়রদের যে আক্রমণের মান লক্ষ্য করছি তা মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়। লেখা ছাড়াও একজন মানুষের যে মানুষ পরিচয়, সে কারোর বাবা, কারোর শিক্ষক, সেটাকে অসম্মান করার কোনো রাইট নেই কারো।
ক্ষোভটা জেনুইন। আর সেই ক্ষোভের অপরিণত প্রকাশ থেকেই এমন মন্তব্য এসেছে, সেটা বুঝতে পারি। যারা করেছে তারা জেনুইন লেখার আবেগ থেকে করেছে। কিন্তু জিনিসটা ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক। এবং এটা এমন প্রফেট তুল্য ভঙ্গিতে জ্ঞান দিয়ে গেলে কোনো দাম নেই। আমি বলছি ধ্বংসাত্মক যখন, তখন আমাকে হাতেকলমে দেখাতে হবে যে এমন নেগেটিভ জায়গা থেকে আশ্চর্য পজিটিভ ক্রিয়েটিভিটি সম্ভব। সেই চ্যালেঞ্জের লেখাটিই লিখছিলাম, যখন সরিৎবাবুর করা প্রশ্নটি ডাক দেয়। আর আমি সবাইকে বুক ঠুকে দেখাতে পারি যে, ওই বিকট অপরহেয়কারী মানসিকতা ও কাউন্টার মানসিকতা থেকেও চাইলে বছরের সেরা লেখাটি লেখা যায়। রাজেন্দ্রবাবু (@rajendra bhattacharya) আপনার রাগ আমি ফিল করতে পারি, কিন্তু রাগ থেকে সৃষ্টি হোক না, কাদা কেন? জ্যোতির্ময় মুখোপাধ্যায়ের সমালোচনাটি বরং তুলনায় অনেক স্পষ্ট এবং উন্নতবোধ হয়েছে। যাক সে কথা। আসছি সরিৎবাবুর কথায়।
কাল, সরি আজ জীবনানন্দ নিয়ে একটি পুরোনো পোস্টের নীচে এই নক্ষত্রদোয়াত হতে তুলে আনা প্রশ্নটি করেছিলেন সরিৎবাবু যার থেকে আমার সম্পূর্ণ লেখাটির অভিমুখ বদলে যায়। এই প্রশ্নের আমি কতোবছর অপেক্ষা করেছি বলে বোঝাতে পারবো না। পুরো লেখাটি বড়ো, এবং এটি প্রথম পর্ব। দ্বিতীয় পর্ব ঘুম থেকে উঠে লিখবো, এমন একটি লেখার পর বড়ো সূর্যোদয় বোধ হয় মনে। আমি প্রশ্ন আর প্রশ্নোত্তর লেখাটি (শুধু উত্তর নয়) এখানে তুলে দিলাম।
পুরো লেখাটা লিংকে আছে। পড়তে বোধহয় বেশী বোরিং লাগবে না। আর আমার প্রিয় বাচ্চাগুলোকেতো আমি অর্ডার দিতে পারি। অতিঅবশ্যই পড়বি। হিহি
ক্ষোভটা জেনুইন। আর সেই ক্ষোভের অপরিণত প্রকাশ থেকেই এমন মন্তব্য এসেছে, সেটা বুঝতে পারি। যারা করেছে তারা জেনুইন লেখার আবেগ থেকে করেছে। কিন্তু জিনিসটা ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক। এবং এটা এমন প্রফেট তুল্য ভঙ্গিতে জ্ঞান দিয়ে গেলে কোনো দাম নেই। আমি বলছি ধ্বংসাত্মক যখন, তখন আমাকে হাতেকলমে দেখাতে হবে যে এমন নেগেটিভ জায়গা থেকে আশ্চর্য পজিটিভ ক্রিয়েটিভিটি সম্ভব। সেই চ্যালেঞ্জের লেখাটিই লিখছিলাম, যখন সরিৎবাবুর করা প্রশ্নটি ডাক দেয়। আর আমি সবাইকে বুক ঠুকে দেখাতে পারি যে, ওই বিকট অপরহেয়কারী মানসিকতা ও কাউন্টার মানসিকতা থেকেও চাইলে বছরের সেরা লেখাটি লেখা যায়। রাজেন্দ্রবাবু (@rajendra bhattacharya) আপনার রাগ আমি ফিল করতে পারি, কিন্তু রাগ থেকে সৃষ্টি হোক না, কাদা কেন? জ্যোতির্ময় মুখোপাধ্যায়ের সমালোচনাটি বরং তুলনায় অনেক স্পষ্ট এবং উন্নতবোধ হয়েছে। যাক সে কথা। আসছি সরিৎবাবুর কথায়।
কাল, সরি আজ জীবনানন্দ নিয়ে একটি পুরোনো পোস্টের নীচে এই নক্ষত্রদোয়াত হতে তুলে আনা প্রশ্নটি করেছিলেন সরিৎবাবু যার থেকে আমার সম্পূর্ণ লেখাটির অভিমুখ বদলে যায়। এই প্রশ্নের আমি কতোবছর অপেক্ষা করেছি বলে বোঝাতে পারবো না। পুরো লেখাটি বড়ো, এবং এটি প্রথম পর্ব। দ্বিতীয় পর্ব ঘুম থেকে উঠে লিখবো, এমন একটি লেখার পর বড়ো সূর্যোদয় বোধ হয় মনে। আমি প্রশ্ন আর প্রশ্নোত্তর লেখাটি (শুধু উত্তর নয়) এখানে তুলে দিলাম।
পুরো লেখাটা লিংকে আছে। পড়তে বোধহয় বেশী বোরিং লাগবে না। আর আমার প্রিয় বাচ্চাগুলোকেতো আমি অর্ডার দিতে পারি। অতিঅবশ্যই পড়বি। হিহি
[ সম্পাদকের সংযোজন : পাঠকের সুবিধার্থে উল্লিখিত লেখাটি এবং লিঙ্ক এখানে তুলে দেওয়া হল।
অল্প কদিন জীবনানন্দ বিষয়ক এক লেখা-
বিশ্বরূপদার এই স্ট্যাটাসটি নিয়ে আমি সেদিনই লিখতাম, নানা ঝামেলায় হয়ে ওঠেনি। জীবনানন্দকে নিয়ে আমি কোনোদিন কোনো লেখাই লিখিনি, যেমন রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও। এর কারন জিজ্ঞেস করবেন না, কারন তা আমার অত্যন্ত ব্যক্তিগত। এরা আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের দুজন। বন্ধুদের নিয়ে লিখতে গেলে হয়তো বায়াসনেস এসে যাবে। যাকগে মোদ্দা কথা এটা বোধহয় জীবনানন্দকে নিয়ে আমার প্রথম লেখা। কারন এই খারাপ কবিতা নিয়ে ওখানে বিশ্বরূপদাকে নানাবিধ আক্রমনগুলির অসারতা দেখে মনে হলো কোথাও একটা অশুভপন্থা কাজ করছে। যেকোনো আন্দোলন, স্থবিরকে ধরে ঝাঁকুনি র মূল উদ্দেশ্য থাকে নিজের গতিপথটাকে চেনা, স্পষ্ট করা। খারাপ কবিতার কথা বলারও উদ্দেশ্য তাই, যেই বলুক। কিন্তু এখানে দেখছি একদল স্পষ্টর বদলে ঘোলা করে দিতে চাইছে জলটিকে। যা সহজে বলা যায় বোঝানো যায়, তাকে নানান তত্ত্ব উদ্ধৃতির কাঁটায় বিঁধে চরম ঝাপসা গোলমেলে বিষয় করে তুলছে। কারন খুব পরিষ্কার, ঘোলা জলে মাছ ধরা খুব সহজ ব্যাপার। এদের কাছে "খারাপ কবিতা" বিষয়টা ততোটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যতোটা গুরুত্ত্বপূর্ণ "আমি বলছি খারাপ কবিতা র কথা"। অর্থাৎ "খারাপ কবিতা" একটা প্রোডাক্ট বা পন্য ছাড়া কিছু নয় এদের কাছে যার ওপর নিজের মালিকানা কায়েম করাটাই মূল উদ্দেশ্য। তাই আপাত সহজ ও সৎ একটি উচ্চারণ জীবনানন্দ নিয়ে এমন বিতর্কিত করে তোলা হয়। যেন আমার পন্য নিয়ে তুমি কে বলার। এতে সবচেয়ে গণ্ডগলে পড়ছে নতুন কবিটি। সে বুঝে উঠতে পারছে না, কি বলা হচ্ছে। কি খারাপ কবিতা। ঘেঁটে ঘ হয়ে যাচ্ছে তার একটি সহজ সরল কথা। এ কারনেই প্রথমবার জীবনানন্দকে নিয়ে কিছু লিখতে উদ্যত হলাম আমি, এই জিনিসগুলো আমার কাউকে জানানোর প্রয়োজন মনে হয়নি কোনোদিন কারন এগুলো আলোর মতো স্পষ্ট আমি ভাবতাম। হঠাৎ এখানে দেখি একি এ নিয়েও এত ঝাপসা, এত জটিলতা?? তো আর্জ হ্যায়-
"জীবনানন্দই বাংলা ভাষায় প্রথম খারাপ কবিতা লিখেছিলেন। তার আগে খারাপ কবিতা লেখা হয়নি" - বিশ্বরূপ দে সরকার
দু ধরনের খারাপ হয়...... একটা খারাপ ভালোর স্কেলে মাপা হয়, চিরাচরিত ভালো স্কেলে, যেমন সৎ একটি চিরাচরিত ভালো, তাই অসৎ একটি খারাপ...... আরেকটা খারাপ হচ্ছে প্রচল যে ভালো তার বিপরীত...... প্রচলের বিপরীতে অন্য...... এখানে খারাপ ভালোর অবস্থানের বাইরে একটা অবস্থান হয়ে থাকে, সেটা সেই সময়ে প্রচলিত ধারনা অনুযায়ী ভালোর মধ্যে পড়ে না বলে তাকে খারাপ বলা হয়, আর সেই খারাপ পরে কোনো এক সময়ে যখন তৎকালীন সময়মুক্ত চোখে দেখা হয় তখন বোঝা যায় সেটা ছিলো এক অন্য ভালো, যা সেই সময়, সেই সময়ের ভাবনা তাকে চিনতে পারেনি......... আমি বুঝতে পারছি না, বিশ্বরূপদার এই কথাটায় এত অদ্ভুত গাঁট মার্কা প্রত্যুত্তরগুলো কোথথেকে আসছে...... কেউ কি খেয়াল করছেন না যে বিশ্বরূপদা একবারো জীবনানন্দকে খারাপ কবি বলেছেন?? জীবনানন্দ প্রথম খারাপ কবিতা লিখেছেন আক্ষরিক সত্য, খারাপ কবিতা মানে প্রচল এর এক্কেবারে বিপরীতে......... আমরা বলি না যে ছেলে রা ভয়ানক দুষ্টু ডানপিটে ব্যাড বয় হয়ে থাকে তাদেরকে পরে এক অন্য চেহারায় দেখা যায়...... এই দুষ্টু বা ব্যাড বয় মানে কি সে অত্যন্ত বাজে একটি বস্তু? তা তো নয়, সে সেই রেয়ার এক ক্যাটেগরির অংশ যার ধ্বক আছে বা সাহস আছে শৃঙ্খলা, নিয়ম, অনুশাসন ইত্যাদি ভেঙে ফেলার...... এবং সেটি এক অনুসন্ধিৎসা ও কৌতূহল থেকে...... জীবনানন্দ চূড়ান্ত কৌতূহলী, তাঁর কৌতূহল তাঁকে কোনো রকম শাসনে ফেলতে পারেনি......... কৌতূহলী বিষ্ণু দে, বুব, সুধীন দত্ত রাও, কিন্তু তাঁরা সেখান থেকেও কিছু না কিছু অনুশাসন নিজেদের জন্য তৈরী করে নিয়েছিলেন, ছন্দ পার্ফেকশান তার মধ্যে একটা...... জীবনানন্দ অনায়াসে মাত্রার গণ্ডগোল করেছেন ১৮ মাত্রার মহাপয়ার, একটায় আঠারো, একটায় ষোলো, এমন কি কানে লাগছে শুনতে এমনতরো ছন্দের ভুলও করেছেন… কল্লোলের কবিরা রবীন্দ্রনাথের ছায়ার বাইরে যেতে চেয়েছেন, কিন্তু সে শুধুমাত্র ভাষাগত, প্রকরণগত, বহিঃরূপ গতভাবে। ভেতরে তাঁদের বিশ্বাস ও ভাবনার আনুগত্য অটল অনড় থেকেছে। ভাবনা বা চেতনার দিক দিয়ে রবীন্দ্রনাথের এতটা বিপরীতে কেউ জাননি যতোটা জীবনানন্দ একা যাওয়ার সাহস করেছিলেন। এবং এই সাহস তাঁর আপাদমস্তক এবং আজীবন আকন্ঠভাবে ছিলো। কি রকম বিপরীত? রবীন্দ্রনাথ যখন জীবন, জীবনদেবতা, আলোর কথা বলে যাচ্ছেন, সেই সময় জীবনানন্দ মৃত্যুকে এক্সপ্লোর করছেন এক অন্য দিক থেকে। আলোর অস্তিত্ব আছে বলেই অন্ধকারে আমরা বুঝতে পারি এটা অন্ধকার। এই বৈজ্ঞানিক সারসত্যটা জীবনানন্দ বারবার নিয়ে এসেছেন, অদ্ভূত আঁধার বলে। বাইরে থেকে আবরণ থেকেছে লেখাদের নীরাশা, হতাশ, পরাজিত। কিন্তু কেউ লক্ষ্য করেনি যে সেই পরাজিত মানুষটি কিন্তু পরাজিত হয়েও কবিতা ছাড়ছেন না, আর সে কি কনফিডেন্সে ম ম করছে। যে পরাজিতবোধ থেকেও কাব্য বোধ করে তার চেয়ে জয়ী কে আছে।
একবার ভাবুন, কতোটা ব্যাড বয় হয়েছিলেন জীবনানন্দ সে সময়। আর কি পরিমান কনফিডেন্স থাকলে তা হতে পারে। অভিযোগের তালিকা দেখুন সাধারণ পাঠকের কাছ থেকে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ, বামপন্থীদের কাছ থেকে বুর্জোয়া পন্থার অভিযোগ, ছান্দসিকের কাছ থেকে ভুল ছন্দে কবিতা লেখার অভিযোগ, নীতিবাগীশের কাছ থেকে অশ্লীলতার অভিযোগ। কিন্তু জীবনানন্দ কখনো নিজের পথ পরিবর্তনের কথা ভাবেন নি। নিজের ডিকশন বদলান নি। এই হচ্ছে প্রকৃত খারাপ কবিতা লেখার সাহস। ওনার নেই বুব, বিষ্ণু দে, সুধীন দত্ত, অমিয় চক্কোত্তি, সমর সেন দের মতো দুরন্ত পেডিগ্রী। নেই একটি ফিটফাট সুরম্য জীবন। তাও কি সেই অমোঘ টান তাঁকে সব্বার বিপরীতে নিয়ে গিয়েছিলো? “কারুবাসনা আমাকে নষ্ট করে দিয়েছে চিরদিনের মতো” (প্রসঙ্গতঃ আজও বাঙালী জীবনানন্দ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দেশ বিদেশ উদ্ধৃতি-সারমেয় দের চেন ধরে এনে ছেড়ে দেয় কেন বুঝি না। আজও সাহস করে না বোধহয় এই প্রবল দুঃসাহসী কবিকে নিয়ে নিজের মনের কথা বলতে। আমি জীবনানন্দ নিয়ে লিখলে তাঁর লেখাই যথেষ্ট মনে হয়, আর কারোর মুখের ঝাল আমি কেন খেতে যাবো)। জীবনানন্দ কেন বাংলাভাষায় প্রথম খারাপ কবিতা লিখেছেন? কারন তার আগে আর কেউ এরকম বিপরীতে যাওয়ার, স্রোতের উলটোদিকে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস দেখাননি। রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে নিজের অপার জগৎ তৈরী করেছেন। ধীরে ধীরে ডিকশান বদলেছেন। বাংলা কবিতার প্রচল থেকে ভয়ংকর অন্য হয়ে শুরু করছেন তিনি, এ দেখতে পাই না। হয়তো ভাবনা আলাদা, ভাষা সামান্য অলৌকিক, কিন্তু তাও সেটা সে সময়ের প্রচল থেকে প্রচণ্ড ভিন্ন কিছু নয়। বিহারীলালের সার্টিফিকেট ওনার কাছে ম্যাটার করে, সেটা যেদিক দিয়ে হোক। এবং সবচেয়ে বড়ো কথা প্রচলের প্রতি আনুগত্যবোধ কিছুটা থাকার ফলেই ওনার কাছে মাইকেল গ্রহণীয় হয় নি বহুদিন। যাক রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দের তুলনা শুধু মূর্খেই করে, সেটা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার বলার উদ্দেশ্য জীবনানন্দে এসেই আমরা প্রথম দেখতে পেলাম কবিতার ব্যাড বয় হয়ে ওঠার প্রবণতা। যা পরে একের পর এক দশককে প্রথা ভাঙতে ট্রিগার করেছে। ৫০,৬০ সব। এমন কি কল্লোল, কালি কলম (যদিও সুধীন দত্ত ওনার কবিতা পরিচয় এর জন্য বাতিল করেছিলেন। বুব যথেষ্টই সমাদর করতেন কবিকে) সেখানেও ঝাঁকের একজন হতে দেখি না জীবনানন্দকে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তিনি দ্বার্থহীন ভাষায় বলছেন
“‘অর্থহীন অসন্তোষে বা দুর্বল বিদ্রোহের অভিমানে আমি আমার পূর্ববর্তী বড় কবিকে ডিঙ্গিয়ে গেলাম অকাব্যের জঞ্জালের ভিতর – সাহিত্যের ইতিহাসে এ রকম আন্দোলনের কোন স্থান নেই।’
(রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা কবিতা, কবিতার কথা)”
খারাপ কবিতা হয়তো সবাই কোনো না কোন সময়, কোন না কোন বয়সে, ঘরের কোনায় লুকিয়ে হোক কি নিজের মনে মনে সবাই লিখেছে। যে কবি শক্তির উপদেশ মেনে প্রথমে একশোটা সনেট লিখতে বসেছে সেও মাঝপথে “দূর নিকুচি করেছে আব্বা সিডিসিডিসিডিসিডি, আমি আলবালছাল লিখবো” ভেবে ফেলেছে কখনো জনান্তিকে। কিন্তু সেই রাজা, বা সেই আশ্চর্য সাহসে ধ্বকধ্বক করে ওঠে যে আজীবন একা বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে কোনো সংঘ ছাড়া, কোনো সুপারিশ ছাড়া, কোনো হাততালি ছাড়া। আজকের তালিবাজ লেখক কবিরাই একধরণের তালিবানি সন্ত্রাস তৈরী করেছেন কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ এই নির্দেশ করে দিয়ে। কাউকে বলে দিয়ে “তোমার দ্বারা এটা হবে না, স্কিল নেই”, কাউকে সটান “এসব কিস্যু হয়নি” বলে। এই ভালো খারাপ, হওয়া না হওয়ার অমোঘ উচ্চারণের সাথে যুক্ত হয়েছে এক জঘন্য দুর্বিনয় ও নিজেকে ত্রুটিহীন চিরন্তন ভাবার ভ্রম। এই চক্করে সদ্য লিখতে আসা কবিটির মনে জেগে উঠছে প্রশ্ন যে “আমি কি পারবো?”। এ যে কি ভয়ানক সংশয় বলে বোঝানো যাবে না। এই সময় দাঁড়িয়ে জীবনানন্দকে এইভাবে দেখাটা সত্যিই প্রয়োজন। দেখা প্রয়োজন, সমস্ত ধাক্কা সত্ত্বেও কখনো এই প্রশ্নটা তাঁর মনে জাগে নি “আমি কি পারবো, বা আমি কি পারি?” প্রত্যয় যে এক ঈশ্বরপ্রতিম শক্তি এটা বুঝতে পারলে কবির আর কোনো ভয় থাকে না। সে খারাপ কবিতা লেখে কেন? না সে কবিতা লিখতে পারে। সে খারাপ লিখতে পারে সেটাকে অকবিতায় বা অসৎ কবিতায় পরিণত না করে। জর্জ ম্যালোরি জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো যখন, আপনি বারবার হেরে গিয়েও আবার এভারেস্ট জয় করতে যেতে চাইছেন কেন? তখন ওনার সেই অনবদ্য উত্তর “বিকজ ইট ইজ দেয়ার”। খারাও কবিতা লিখি কেন? না আমি কবিতা লিখতে পারি। সিম্পল। আমি লিখবো আমার প্রাণ যে ভাষায় বার্তালাপ করছে আমার মনের সাথে, তুমি কে হে হরিদাস পাল বলে দেওয়ার কোনটা লেখা উচিৎ, কোনটা লেখা উচিৎ নয়? কোনটা সক্ষম কোনটা অক্ষম? জীবনানন্দ এই ঔদ্ধত্যই আজীবন না বলা কথায় আর লেখায় দেখিয়ে এসেন। জীবনানন্দ শুরুতেও খারাপ কবিতা লিখেছেন সেই সময়ের নিরিখে, শেষাবধিও খারাপ কবিতা লিখেছেন। গ্রাহ্য করেননি ব্যঙ্গ, রঙ্গ, রসিকতা কোনোকিছু। তাই জীবনানন্দই বাংলার প্রথম খারাপ কবিতা লিখেছেন এবং আমাদের শিখিয়ে গেছেন খারাপ কবিতা লেখার মূলকথা সাহস, আত্মপ্রত্যয় আর সততা। বাংলা সোজা কথায়, সপাটে লিখেছেন
“‘মহাবিশ্বলোকের ইশারার থেকে উৎসারিত সময় চেতনা আমার কাব্যে একটি সঙ্গতিসাধক অপরিহার্য সত্যের মতো ; কবিতা লেখবার পথে কিছুদূর গিয়েই আমি বুঝেছি , গ্রহণ করেছি। এর থেকে বিচ্যুতির কোনো মানে নেই আমার কাছে।’ (কবিতার কথা )”]
সরিত চ্যাটার্জী-
পড়লাম। কমেন্ট করার মতো বিদ্যে নেই আমার, কিন্তু ভালো লাগল সেটা জানালাম।একটা প্রশ্ন ছিল, কিছুটা অপাংক্তেও। প্রচলিত ছন্দ না থাকলে সেটা যে কবিতা, গদ্য নয়, সেটা কী করে চেনা যায়? মজার কথা হলো যে আমি চিনতে পারি। কিন্তু কী করে পারি সেটা জানি না। একটু স্পেসিফিক উত্তর খুঁজছি।
প্রশ্নোত্তর পর্ব-
যাক সরিৎবাবু, এতটা ধৈর্য্যের জন্য ধন্যবাদ। এবার আপনার প্রশ্নের স্পেসিফিক উত্তরে আসি। কবিতা ও গদ্যের তফাৎ আমরা কি করে সেন্স করি? এর উত্তর এই দুই জন্মরহস্যে রয়েছে। গদ্য জন্মেছে ঘটনা ধারণ করার জন্য, বর্ণনার জন্য। এর ডিএনএ র মধ্যে একটা এলিমেন্ট অফ ট্রুথ বা এলিমেন্ট অফ ইভেন্ট লুকিয়ে থাকে। আর কবিতা শ্লোকের জন্ম হয়েছে কল্পনাকে ধারণ করে সেটাকে সত্যের সাথে মেশানোর জন্য। বা মিথ্যা বা অনৃতভাষণ থেকে কল্পনাকে আলাদা করার জন্য। আর তাকে সেই কাঠামো দেওয়ার জন্য। তাই এর ডি এন এ র মধ্যে একটা এলিমেন্ট অফ ননট্রুথ বা এলিমেন্ট অফ ইমাজিনেশান থাকে। আদি ওই জন্মকালে না হয় এত কঠোর ভাগাভাগি ছিলো সংজ্ঞাবদ্ধ। সময়ের সাথে সাথে একে অপরের সাথে মিশে গেছে। কিন্তু ডি এন এ টা বদলায়নি। আর ওটাই আমাদের ভেতরে সেই মজার উপায়ে চিনিয়ে থাকে।
এবার আরো মজার ব্যাপারটা দেখুন। যেখানে এলিমেন্ট অফ ট্রুথ আছে, সেখানে আনট্রুথ বা লাই বা মিথ্যেও রয়েছে। সত্যির হাত ধরে এসে পড়ে। ফলে এলিমেন্ট অফ লাই বা ফিকশান এটাও গদ্যের ডি এন এ তে থাকে। আর কবিতায় যেহেতু এলিমেন্ট অফ ননট্রুথ বা ইম্যাজিনেশান এর ডি এন এ তাই এখানে মিথ্যে চাইলেও ঢুকতে পারে না। ঢুকলে সে কল্পনার খাদ্য হয়ে যাবে। তাই কবিতা পড়ার সময় সত্য মিথ্যে দ্বন্দ্ব আমাদের জন্মায় না অজান্তেই। এটা একটা বিরাট জায়গা তফাৎ করার। গদ্যে অজান্তেই জন্মে যায় পক্ষ, বিপক্ষ। মানা, না মানা। জিত, হার। সত্যি, মিথ্যে। বিশ্বাস্য, অবিশ্বাস্য। অজান্তে সাবকনশাসে ঢুকে যায়।
তাই কবিতা আর গদ্য আসল রহস্য লুকিয়ে থাকে ছন্দ, মাত্রা, শব্দ এসবে নয়। ওই আশ্চর্য বাক্যগঠনের ডি এন এ তে। এ এক অলৌকিক। আপাত ভাবে দেখে দুটিকেই বাক্য লাগবে। কিন্তু কোনটি কবিতার আর কোনটি গদ্যের আপনি সেন্স করতে পারেন। তার কারন ওই জন্মরহস্য। আর এই তফাৎটি এত সরল, এত আদিম, আর এত গভীরে থাকে যে ভুল হয়ই না। হতেই পারে না। কোন বাক্যটির অঙ্গে অলিখিত সত্যি-মিথ্যে লেগে আছে। আর কার অঙ্গে লেগে আছে কল্পনা বা সত্যি-মিথ্যের অভাব। এটা ধরা আমাদের আদিম ইন্সটিঙ্কট।
স্রষ্টারা দূরদর্শী ছিলেন। দেখতে পেয়েছিলেন কবিতার এই সত্য মিথ্যার ভুবন পেরিয়ে অপার ভুবনে বসে থাকার অলৌকিক ক্ষমতা। তাই প্রবলভাবে চেষ্টা করে গেছেন মাঝে পাঁচিল তোলার। ছন্দবদ্ধ করার, পদবদ্ধ করার, চরণবদ্ধ করার নানান স্ট্রিক্ট নিয়মাবলীর জন্ম এক মজবুত পাঁচিলের জন্য। ভাবুন দেখি মহাভারতে কতো কান্ড করেই না যুধিষ্ঠির একটি অর্ধসত্য বলেছেন। যদি ওনার জানা থাকতো পানিং, এ্যালিটারেশান, ডাবল মিনিং, ছন্দঘোর, তবে কতো কতোই না মিথ্যে কথার স্রোতে উপচে পড়তো মহাভারত। তো তাই এই পাঁচিল তোলা।
কিন্তু মানুষ এক আশ্চর্য প্রাণ। সে পাঁচিল দেখলেই ভাবে এ এক দরজাসম্ভব, জানালাসম্ভব জিনিস। বাধা পেলে ভাবে এ এক টপকানোসম্ভব গন্তব্য। আশা বা হোপ আমাদের সৃষ্টির আদি থেকে রয়েছে। আদিতে রয়েছে ধ্বনি, যার থেকে ধ্বনাত্মক বা পজিটিভিটি। তাই পাঁচিল বার বার ভেঙে গেছে। মিশে গেছে। কিছু জিনে জিনে মেশেনা, ডি এন এ, ডি এন এ তে মেশেনা। তাই স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতেই আমরা তফাৎ করতে পারি কোনটা কবিতা আর কোনটা গদ্য। তার জন্য কন্ঠস্বরে ব্রেণডোবানো অতি ক্রিয়েটিভ চিল্লানোসোরাসের প্রয়োজন হয় না। আরে আমার ভাষা তৈরী করবো কি আমি? আমি তো নিজে ভাষার থেকে তৈরী হয়েছে। অগাধগাণ্ডু না হলে কেউ বলে যে আমি আমারকবিতার ভাষা সৃষ্টি করেছি। তুমি কে হে দাড়িওয়ালা ব্রহ্মা? ভাষা সৃষ্টি করবে। তুমি খুঁজতে পারো। খুঁজবে তোমার ভাষা। সেতোমাকে সৃষ্টি করেছে, আছে পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও। ও তোমার বাপের সম্পত্তিও নয়। তোমাকে এক্সপেক্টেশানরহিত হয়ে খুঁজে যেতে হবে। আর তোমার সেই সন্ধান যদি সৎ ও সৃষ্টিশীল ও স্বতন্ত্র হয়, তবে ভাষা তোমাকে নিজে খুঁজে নেবে। তুমি এমন কোনো লায়েক নও যে নিজের কবিতার ভাষা চেরাপুঞ্জীর জঙ্গলে পেলে আর পাকড়াও করে পোষ মানালে। ভাষা যদি তোমার কাছে না এসে টোকা না দেয় তোমার দরজায়, তুমি জানতেই পারবে না, কোথায় তোমার দরজা, আর কোথায় তোমার জানলা। বনলতা সেন খুঁজতে যাবে বটানির ক্রীপার ক্লাইম্বার চ্যাপ্টারে। বন বাদাড়ে বেচারা পাখিদের বাসা ভেঙে ঘরে এনে খুব লক্ষ্য করবে। আর তারপর জীবনানন্দের ছবি দেখে, গায়ের রঙ দেখে, যখন মাথার মধ্যে ভ্যাবলাচাক ভোম্বল হবে। কিছুতেই খুঁজে পাবে না কুরূপ কবির অরূপ কলম কোথায়, আর ভুল বকবে হাজিবাজি।
সরি সরিৎবাবু, সরে গেছিলাম, আরেক লেখাটির জায়গায়। তবে খুব একটা সরিনি। আপনি বলেছেন না আপনার বিদ্যা কম। আপনি সৌভাগ্যবান। এবং তাই আপনি এমন এক উজ্জ্বল প্রশ্ন করতে পেরেছেন। যা আমাকে এমন এক লেখা লিখিয়ে নিলো। আমি বিদ্যাশূন্য। পড়াশোনায় বিশ্বাস করিনা, লেখাশেখায় বিশ্বাস করি। লেখাশেখা হলো পড়াশোনার মতোই এক যৌথ কাজ। বিদ্যা হলো ইঁট। আমরা মাথায় ইঁট ভরি। কিন্তু ওই ইঁট যে ভিত তৈরীর জন্য সেটি ভুলে যাই। বিদ্যা মাথায় ঢোকে, এবং ধাক্কা মেরে বের করেও দিতে হয় মাথা থেকে। আনলার্ন। বিদ্যা বেরিয়ে গেলে মাথায় তার যে পায়ের ছাপ পড়ে থাকে সেটিই হলো জ্ঞান। বিশুদ্ধ জ্ঞান। আর তার যে প্রভাবে আপনি দারুণ মজার ব্যাপার দেখেন, কবিতা ও গদ্য আলাদা করতে পারেন, কনফিডেন্টলি। ওটিই হলো বাক্যের ডিএনএ তে থাকা এক বোধ। ওই কুরূপ কবিও দেড়েল বুড়োর চেয়ে কম যায় না বিজ্ঞানমনস্কতায়। বহু আগে বলে গেছে, গভীরে এক বোধ খেলা করে।
ক্লিন্টন বি সিলি নামক গবেষক আছেন জীবনানন্দের, যাকে একবার সামনে পেলে ক্লিন্টন-কি-সিলি বলে চেঁচিয়ে ওঠার ইচ্ছে আছে। ওনার একটি গবেষণা হলো আদর্শ এ ধরণের পাঁঠামোর উদাহরণ। গদ্য আর কবিতার বেসিক জিনের জায়গাটা না ধরতে পারলে যা হয়। দশ বছর ধরে ভদ্রলোক জীবনানন্দের "মালয় সাগর তীরে" এটি কোথথেকে এসেছে তা নিয়ে বেজায় ভেবেছেন। বালী গেছেন। মালয়েশিয়া গেছেন। এবং লাস্টে বিশাখাপত্তনমের বীচে সার বেঁধে আলো জ্বলছে দেখে ভয়ানক আলোকপ্রাপ্ত হয়েছেন। আরে জীবনবাবু তো মালয় আলোর কথাও বলেছেন, আসলে ওটা হচ্ছে মালয়ালম ভাষার দেশ। বুঝুন কান্ড। আপনি এই জীবনানন্দ নিয়ে লেখাটি পড়ে এই অপূর্ব্ব প্রশ্ন করলেন, যার থেকে এই লেখা হলো। আপনাকে কেউ বিশেষজ্ঞ বলে পাত্তাই দেবে না। আর ক্লিন্টন বি সিলি বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উড়ে আসবেন আপনাকে শেখাতে এই অপূর্ব্ব পাঁঠামো জানাতে আর তারপর উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে লাখ টাকা নিয়ে যাবেন। যাক উনি তো তাও কিছু নিয়ে যান। বেচারা জীবনানন্দের রূপবিশেষজ্ঞ, বনলতার ফেমিনিজম খোঁজা অকাট্য গণ্ডারগুলি রাগে গরগর ছাড়া আর কি করবে? তারা বেসিক জায়গাটা কখনো দেখবে না যে জীবনানন্দদের মাল্যবান বা সুতীর্থ এর ভাষা বনলতা সেনের এর চেয়ে কোথায় আলাদা। যে প্রশ্নটি আপনি করলেন। "অভিজ্ঞ কবি" এক্সপ্রেশানটা শুনলেই আমার মনে হয় পুশ আপ ব্রা পরা বিধবা রাঙাপিসীমা।
রাগ ছাড়ূন। সরিৎবাবু, আপনাকে আরেকটি অলৌকিক বলি এই তফাৎ বোঝার আরো স্পেসিফিক। সবার জীবনে রয়েছে। কখনো দেখেছেন একটা বাচ্চা কি করে ভাষা শেখে? দেখবেন সে নকল করে। প্রথমে দোলে। ঠাকুমা বলছে "আয় আয় চাঁদমামা কপালে টি দিয়ে যা"। আর তিনি ভারি নকল করতে গিয়ে ক পিস গাপ করে দিয়েছেন, দিয়ে বলছেন "আয়ায়া চাম্মামা টিদিযা, আয়ায়া চাম্মামা টিদিযা"। এই হচ্ছে শ্রুতি। খেয়াল করুন যে ইতিহাস বলেছি। মন্ত্রের রিদম। ধ্বনি। সে প্রথমে অর্থ, শব্দ, এইসবের বাইরে গিয়ে শেখে একটা বাক্যের বাক্যাংশ। শব্দ অর্থ বহু পরে। আর তফাৎ, খেয়াল করবেন। একটা বাচ্চাকে ঠাকুমা ভাত খাওয়াচ্ছে "আয় আয় চাঁদমামা, টি দিয়ে যা/ আয় আয় সোনাপাখি হলুদপাখি আয় দেখি/দেখি দেখি দেখি এটা এক গালে কে খাবে? কে খাবে? কে খাবে?" বাচ্চাটা জানে পুরোটার কোন অংশ ছড়া, আর কোনটা তাকে একটা ঘটনা ঘটানোর নির্দেশ। কতো আগে সে তফাৎ ধরে গদ্য আর কবিতার। ও তার জিনে আছে। বাংলাভাষার জিনে রয়েছে এই অপূর্ব্ব ক্ষমতা। আর আমাদের পাঁঠা পণ্ডিতগুলো গাবদা প্রবন্ধ লিখে আপনাকে বোঝাবে গদ্য আর কবিতার তফাৎ। করবে এক্সপেরিমেন্ট। খুঁজবে ইজম। একটা বাচ্চা ভাষা উচ্চারণের আগেই বুঝে যায় কোনটা কান্না ভোলানোর ছড়া, আর কোনটা দুষ্টুমির বকুনি। মজার না??
বিশ্বরূপদার এই স্ট্যাটাসটি নিয়ে আমি সেদিনই লিখতাম, নানা ঝামেলায় হয়ে ওঠেনি। জীবনানন্দকে নিয়ে আমি কোনোদিন কোনো লেখাই লিখিনি, যেমন রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও। এর কারন জিজ্ঞেস করবেন না, কারন তা আমার অত্যন্ত ব্যক্তিগত। এরা আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের দুজন। বন্ধুদের নিয়ে লিখতে গেলে হয়তো বায়াসনেস এসে যাবে। যাকগে মোদ্দা কথা এটা বোধহয় জীবনানন্দকে নিয়ে আমার প্রথম লেখা। কারন এই খারাপ কবিতা নিয়ে ওখানে বিশ্বরূপদাকে নানাবিধ আক্রমনগুলির অসারতা দেখে মনে হলো কোথাও একটা অশুভপন্থা কাজ করছে। যেকোনো আন্দোলন, স্থবিরকে ধরে ঝাঁকুনি র মূল উদ্দেশ্য থাকে নিজের গতিপথটাকে চেনা, স্পষ্ট করা। খারাপ কবিতার কথা বলারও উদ্দেশ্য তাই, যেই বলুক। কিন্তু এখানে দেখছি একদল স্পষ্টর বদলে ঘোলা করে দিতে চাইছে জলটিকে। যা সহজে বলা যায় বোঝানো যায়, তাকে নানান তত্ত্ব উদ্ধৃতির কাঁটায় বিঁধে চরম ঝাপসা গোলমেলে বিষয় করে তুলছে। কারন খুব পরিষ্কার, ঘোলা জলে মাছ ধরা খুব সহজ ব্যাপার। এদের কাছে "খারাপ কবিতা" বিষয়টা ততোটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যতোটা গুরুত্ত্বপূর্ণ "আমি বলছি খারাপ কবিতা র কথা"। অর্থাৎ "খারাপ কবিতা" একটা প্রোডাক্ট বা পন্য ছাড়া কিছু নয় এদের কাছে যার ওপর নিজের মালিকানা কায়েম করাটাই মূল উদ্দেশ্য। তাই আপাত সহজ ও সৎ একটি উচ্চারণ জীবনানন্দ নিয়ে এমন বিতর্কিত করে তোলা হয়। যেন আমার পন্য নিয়ে তুমি কে বলার। এতে সবচেয়ে গণ্ডগলে পড়ছে নতুন কবিটি। সে বুঝে উঠতে পারছে না, কি বলা হচ্ছে। কি খারাপ কবিতা। ঘেঁটে ঘ হয়ে যাচ্ছে তার একটি সহজ সরল কথা। এ কারনেই প্রথমবার জীবনানন্দকে নিয়ে কিছু লিখতে উদ্যত হলাম আমি, এই জিনিসগুলো আমার কাউকে জানানোর প্রয়োজন মনে হয়নি কোনোদিন কারন এগুলো আলোর মতো স্পষ্ট আমি ভাবতাম। হঠাৎ এখানে দেখি একি এ নিয়েও এত ঝাপসা, এত জটিলতা?? তো আর্জ হ্যায়-
"জীবনানন্দই বাংলা ভাষায় প্রথম খারাপ কবিতা লিখেছিলেন। তার আগে খারাপ কবিতা লেখা হয়নি" - বিশ্বরূপ দে সরকার
দু ধরনের খারাপ হয়...... একটা খারাপ ভালোর স্কেলে মাপা হয়, চিরাচরিত ভালো স্কেলে, যেমন সৎ একটি চিরাচরিত ভালো, তাই অসৎ একটি খারাপ...... আরেকটা খারাপ হচ্ছে প্রচল যে ভালো তার বিপরীত...... প্রচলের বিপরীতে অন্য...... এখানে খারাপ ভালোর অবস্থানের বাইরে একটা অবস্থান হয়ে থাকে, সেটা সেই সময়ে প্রচলিত ধারনা অনুযায়ী ভালোর মধ্যে পড়ে না বলে তাকে খারাপ বলা হয়, আর সেই খারাপ পরে কোনো এক সময়ে যখন তৎকালীন সময়মুক্ত চোখে দেখা হয় তখন বোঝা যায় সেটা ছিলো এক অন্য ভালো, যা সেই সময়, সেই সময়ের ভাবনা তাকে চিনতে পারেনি......... আমি বুঝতে পারছি না, বিশ্বরূপদার এই কথাটায় এত অদ্ভুত গাঁট মার্কা প্রত্যুত্তরগুলো কোথথেকে আসছে...... কেউ কি খেয়াল করছেন না যে বিশ্বরূপদা একবারো জীবনানন্দকে খারাপ কবি বলেছেন?? জীবনানন্দ প্রথম খারাপ কবিতা লিখেছেন আক্ষরিক সত্য, খারাপ কবিতা মানে প্রচল এর এক্কেবারে বিপরীতে......... আমরা বলি না যে ছেলে রা ভয়ানক দুষ্টু ডানপিটে ব্যাড বয় হয়ে থাকে তাদেরকে পরে এক অন্য চেহারায় দেখা যায়...... এই দুষ্টু বা ব্যাড বয় মানে কি সে অত্যন্ত বাজে একটি বস্তু? তা তো নয়, সে সেই রেয়ার এক ক্যাটেগরির অংশ যার ধ্বক আছে বা সাহস আছে শৃঙ্খলা, নিয়ম, অনুশাসন ইত্যাদি ভেঙে ফেলার...... এবং সেটি এক অনুসন্ধিৎসা ও কৌতূহল থেকে...... জীবনানন্দ চূড়ান্ত কৌতূহলী, তাঁর কৌতূহল তাঁকে কোনো রকম শাসনে ফেলতে পারেনি......... কৌতূহলী বিষ্ণু দে, বুব, সুধীন দত্ত রাও, কিন্তু তাঁরা সেখান থেকেও কিছু না কিছু অনুশাসন নিজেদের জন্য তৈরী করে নিয়েছিলেন, ছন্দ পার্ফেকশান তার মধ্যে একটা...... জীবনানন্দ অনায়াসে মাত্রার গণ্ডগোল করেছেন ১৮ মাত্রার মহাপয়ার, একটায় আঠারো, একটায় ষোলো, এমন কি কানে লাগছে শুনতে এমনতরো ছন্দের ভুলও করেছেন… কল্লোলের কবিরা রবীন্দ্রনাথের ছায়ার বাইরে যেতে চেয়েছেন, কিন্তু সে শুধুমাত্র ভাষাগত, প্রকরণগত, বহিঃরূপ গতভাবে। ভেতরে তাঁদের বিশ্বাস ও ভাবনার আনুগত্য অটল অনড় থেকেছে। ভাবনা বা চেতনার দিক দিয়ে রবীন্দ্রনাথের এতটা বিপরীতে কেউ জাননি যতোটা জীবনানন্দ একা যাওয়ার সাহস করেছিলেন। এবং এই সাহস তাঁর আপাদমস্তক এবং আজীবন আকন্ঠভাবে ছিলো। কি রকম বিপরীত? রবীন্দ্রনাথ যখন জীবন, জীবনদেবতা, আলোর কথা বলে যাচ্ছেন, সেই সময় জীবনানন্দ মৃত্যুকে এক্সপ্লোর করছেন এক অন্য দিক থেকে। আলোর অস্তিত্ব আছে বলেই অন্ধকারে আমরা বুঝতে পারি এটা অন্ধকার। এই বৈজ্ঞানিক সারসত্যটা জীবনানন্দ বারবার নিয়ে এসেছেন, অদ্ভূত আঁধার বলে। বাইরে থেকে আবরণ থেকেছে লেখাদের নীরাশা, হতাশ, পরাজিত। কিন্তু কেউ লক্ষ্য করেনি যে সেই পরাজিত মানুষটি কিন্তু পরাজিত হয়েও কবিতা ছাড়ছেন না, আর সে কি কনফিডেন্সে ম ম করছে। যে পরাজিতবোধ থেকেও কাব্য বোধ করে তার চেয়ে জয়ী কে আছে।
একবার ভাবুন, কতোটা ব্যাড বয় হয়েছিলেন জীবনানন্দ সে সময়। আর কি পরিমান কনফিডেন্স থাকলে তা হতে পারে। অভিযোগের তালিকা দেখুন সাধারণ পাঠকের কাছ থেকে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ, বামপন্থীদের কাছ থেকে বুর্জোয়া পন্থার অভিযোগ, ছান্দসিকের কাছ থেকে ভুল ছন্দে কবিতা লেখার অভিযোগ, নীতিবাগীশের কাছ থেকে অশ্লীলতার অভিযোগ। কিন্তু জীবনানন্দ কখনো নিজের পথ পরিবর্তনের কথা ভাবেন নি। নিজের ডিকশন বদলান নি। এই হচ্ছে প্রকৃত খারাপ কবিতা লেখার সাহস। ওনার নেই বুব, বিষ্ণু দে, সুধীন দত্ত, অমিয় চক্কোত্তি, সমর সেন দের মতো দুরন্ত পেডিগ্রী। নেই একটি ফিটফাট সুরম্য জীবন। তাও কি সেই অমোঘ টান তাঁকে সব্বার বিপরীতে নিয়ে গিয়েছিলো? “কারুবাসনা আমাকে নষ্ট করে দিয়েছে চিরদিনের মতো” (প্রসঙ্গতঃ আজও বাঙালী জীবনানন্দ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দেশ বিদেশ উদ্ধৃতি-সারমেয় দের চেন ধরে এনে ছেড়ে দেয় কেন বুঝি না। আজও সাহস করে না বোধহয় এই প্রবল দুঃসাহসী কবিকে নিয়ে নিজের মনের কথা বলতে। আমি জীবনানন্দ নিয়ে লিখলে তাঁর লেখাই যথেষ্ট মনে হয়, আর কারোর মুখের ঝাল আমি কেন খেতে যাবো)। জীবনানন্দ কেন বাংলাভাষায় প্রথম খারাপ কবিতা লিখেছেন? কারন তার আগে আর কেউ এরকম বিপরীতে যাওয়ার, স্রোতের উলটোদিকে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস দেখাননি। রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে নিজের অপার জগৎ তৈরী করেছেন। ধীরে ধীরে ডিকশান বদলেছেন। বাংলা কবিতার প্রচল থেকে ভয়ংকর অন্য হয়ে শুরু করছেন তিনি, এ দেখতে পাই না। হয়তো ভাবনা আলাদা, ভাষা সামান্য অলৌকিক, কিন্তু তাও সেটা সে সময়ের প্রচল থেকে প্রচণ্ড ভিন্ন কিছু নয়। বিহারীলালের সার্টিফিকেট ওনার কাছে ম্যাটার করে, সেটা যেদিক দিয়ে হোক। এবং সবচেয়ে বড়ো কথা প্রচলের প্রতি আনুগত্যবোধ কিছুটা থাকার ফলেই ওনার কাছে মাইকেল গ্রহণীয় হয় নি বহুদিন। যাক রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দের তুলনা শুধু মূর্খেই করে, সেটা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার বলার উদ্দেশ্য জীবনানন্দে এসেই আমরা প্রথম দেখতে পেলাম কবিতার ব্যাড বয় হয়ে ওঠার প্রবণতা। যা পরে একের পর এক দশককে প্রথা ভাঙতে ট্রিগার করেছে। ৫০,৬০ সব। এমন কি কল্লোল, কালি কলম (যদিও সুধীন দত্ত ওনার কবিতা পরিচয় এর জন্য বাতিল করেছিলেন। বুব যথেষ্টই সমাদর করতেন কবিকে) সেখানেও ঝাঁকের একজন হতে দেখি না জীবনানন্দকে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তিনি দ্বার্থহীন ভাষায় বলছেন
“‘অর্থহীন অসন্তোষে বা দুর্বল বিদ্রোহের অভিমানে আমি আমার পূর্ববর্তী বড় কবিকে ডিঙ্গিয়ে গেলাম অকাব্যের জঞ্জালের ভিতর – সাহিত্যের ইতিহাসে এ রকম আন্দোলনের কোন স্থান নেই।’
(রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা কবিতা, কবিতার কথা)”
খারাপ কবিতা হয়তো সবাই কোনো না কোন সময়, কোন না কোন বয়সে, ঘরের কোনায় লুকিয়ে হোক কি নিজের মনে মনে সবাই লিখেছে। যে কবি শক্তির উপদেশ মেনে প্রথমে একশোটা সনেট লিখতে বসেছে সেও মাঝপথে “দূর নিকুচি করেছে আব্বা সিডিসিডিসিডিসিডি, আমি আলবালছাল লিখবো” ভেবে ফেলেছে কখনো জনান্তিকে। কিন্তু সেই রাজা, বা সেই আশ্চর্য সাহসে ধ্বকধ্বক করে ওঠে যে আজীবন একা বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে কোনো সংঘ ছাড়া, কোনো সুপারিশ ছাড়া, কোনো হাততালি ছাড়া। আজকের তালিবাজ লেখক কবিরাই একধরণের তালিবানি সন্ত্রাস তৈরী করেছেন কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ এই নির্দেশ করে দিয়ে। কাউকে বলে দিয়ে “তোমার দ্বারা এটা হবে না, স্কিল নেই”, কাউকে সটান “এসব কিস্যু হয়নি” বলে। এই ভালো খারাপ, হওয়া না হওয়ার অমোঘ উচ্চারণের সাথে যুক্ত হয়েছে এক জঘন্য দুর্বিনয় ও নিজেকে ত্রুটিহীন চিরন্তন ভাবার ভ্রম। এই চক্করে সদ্য লিখতে আসা কবিটির মনে জেগে উঠছে প্রশ্ন যে “আমি কি পারবো?”। এ যে কি ভয়ানক সংশয় বলে বোঝানো যাবে না। এই সময় দাঁড়িয়ে জীবনানন্দকে এইভাবে দেখাটা সত্যিই প্রয়োজন। দেখা প্রয়োজন, সমস্ত ধাক্কা সত্ত্বেও কখনো এই প্রশ্নটা তাঁর মনে জাগে নি “আমি কি পারবো, বা আমি কি পারি?” প্রত্যয় যে এক ঈশ্বরপ্রতিম শক্তি এটা বুঝতে পারলে কবির আর কোনো ভয় থাকে না। সে খারাপ কবিতা লেখে কেন? না সে কবিতা লিখতে পারে। সে খারাপ লিখতে পারে সেটাকে অকবিতায় বা অসৎ কবিতায় পরিণত না করে। জর্জ ম্যালোরি জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো যখন, আপনি বারবার হেরে গিয়েও আবার এভারেস্ট জয় করতে যেতে চাইছেন কেন? তখন ওনার সেই অনবদ্য উত্তর “বিকজ ইট ইজ দেয়ার”। খারাও কবিতা লিখি কেন? না আমি কবিতা লিখতে পারি। সিম্পল। আমি লিখবো আমার প্রাণ যে ভাষায় বার্তালাপ করছে আমার মনের সাথে, তুমি কে হে হরিদাস পাল বলে দেওয়ার কোনটা লেখা উচিৎ, কোনটা লেখা উচিৎ নয়? কোনটা সক্ষম কোনটা অক্ষম? জীবনানন্দ এই ঔদ্ধত্যই আজীবন না বলা কথায় আর লেখায় দেখিয়ে এসেন। জীবনানন্দ শুরুতেও খারাপ কবিতা লিখেছেন সেই সময়ের নিরিখে, শেষাবধিও খারাপ কবিতা লিখেছেন। গ্রাহ্য করেননি ব্যঙ্গ, রঙ্গ, রসিকতা কোনোকিছু। তাই জীবনানন্দই বাংলার প্রথম খারাপ কবিতা লিখেছেন এবং আমাদের শিখিয়ে গেছেন খারাপ কবিতা লেখার মূলকথা সাহস, আত্মপ্রত্যয় আর সততা। বাংলা সোজা কথায়, সপাটে লিখেছেন
“‘মহাবিশ্বলোকের ইশারার থেকে উৎসারিত সময় চেতনা আমার কাব্যে একটি সঙ্গতিসাধক অপরিহার্য সত্যের মতো ; কবিতা লেখবার পথে কিছুদূর গিয়েই আমি বুঝেছি , গ্রহণ করেছি। এর থেকে বিচ্যুতির কোনো মানে নেই আমার কাছে।’ (কবিতার কথা )”]
সরিত চ্যাটার্জী-
পড়লাম। কমেন্ট করার মতো বিদ্যে নেই আমার, কিন্তু ভালো লাগল সেটা জানালাম।একটা প্রশ্ন ছিল, কিছুটা অপাংক্তেও। প্রচলিত ছন্দ না থাকলে সেটা যে কবিতা, গদ্য নয়, সেটা কী করে চেনা যায়? মজার কথা হলো যে আমি চিনতে পারি। কিন্তু কী করে পারি সেটা জানি না। একটু স্পেসিফিক উত্তর খুঁজছি।
প্রশ্নোত্তর পর্ব-
যাক সরিৎবাবু, এতটা ধৈর্য্যের জন্য ধন্যবাদ। এবার আপনার প্রশ্নের স্পেসিফিক উত্তরে আসি। কবিতা ও গদ্যের তফাৎ আমরা কি করে সেন্স করি? এর উত্তর এই দুই জন্মরহস্যে রয়েছে। গদ্য জন্মেছে ঘটনা ধারণ করার জন্য, বর্ণনার জন্য। এর ডিএনএ র মধ্যে একটা এলিমেন্ট অফ ট্রুথ বা এলিমেন্ট অফ ইভেন্ট লুকিয়ে থাকে। আর কবিতা শ্লোকের জন্ম হয়েছে কল্পনাকে ধারণ করে সেটাকে সত্যের সাথে মেশানোর জন্য। বা মিথ্যা বা অনৃতভাষণ থেকে কল্পনাকে আলাদা করার জন্য। আর তাকে সেই কাঠামো দেওয়ার জন্য। তাই এর ডি এন এ র মধ্যে একটা এলিমেন্ট অফ ননট্রুথ বা এলিমেন্ট অফ ইমাজিনেশান থাকে। আদি ওই জন্মকালে না হয় এত কঠোর ভাগাভাগি ছিলো সংজ্ঞাবদ্ধ। সময়ের সাথে সাথে একে অপরের সাথে মিশে গেছে। কিন্তু ডি এন এ টা বদলায়নি। আর ওটাই আমাদের ভেতরে সেই মজার উপায়ে চিনিয়ে থাকে।
এবার আরো মজার ব্যাপারটা দেখুন। যেখানে এলিমেন্ট অফ ট্রুথ আছে, সেখানে আনট্রুথ বা লাই বা মিথ্যেও রয়েছে। সত্যির হাত ধরে এসে পড়ে। ফলে এলিমেন্ট অফ লাই বা ফিকশান এটাও গদ্যের ডি এন এ তে থাকে। আর কবিতায় যেহেতু এলিমেন্ট অফ ননট্রুথ বা ইম্যাজিনেশান এর ডি এন এ তাই এখানে মিথ্যে চাইলেও ঢুকতে পারে না। ঢুকলে সে কল্পনার খাদ্য হয়ে যাবে। তাই কবিতা পড়ার সময় সত্য মিথ্যে দ্বন্দ্ব আমাদের জন্মায় না অজান্তেই। এটা একটা বিরাট জায়গা তফাৎ করার। গদ্যে অজান্তেই জন্মে যায় পক্ষ, বিপক্ষ। মানা, না মানা। জিত, হার। সত্যি, মিথ্যে। বিশ্বাস্য, অবিশ্বাস্য। অজান্তে সাবকনশাসে ঢুকে যায়।
তাই কবিতা আর গদ্য আসল রহস্য লুকিয়ে থাকে ছন্দ, মাত্রা, শব্দ এসবে নয়। ওই আশ্চর্য বাক্যগঠনের ডি এন এ তে। এ এক অলৌকিক। আপাত ভাবে দেখে দুটিকেই বাক্য লাগবে। কিন্তু কোনটি কবিতার আর কোনটি গদ্যের আপনি সেন্স করতে পারেন। তার কারন ওই জন্মরহস্য। আর এই তফাৎটি এত সরল, এত আদিম, আর এত গভীরে থাকে যে ভুল হয়ই না। হতেই পারে না। কোন বাক্যটির অঙ্গে অলিখিত সত্যি-মিথ্যে লেগে আছে। আর কার অঙ্গে লেগে আছে কল্পনা বা সত্যি-মিথ্যের অভাব। এটা ধরা আমাদের আদিম ইন্সটিঙ্কট।
স্রষ্টারা দূরদর্শী ছিলেন। দেখতে পেয়েছিলেন কবিতার এই সত্য মিথ্যার ভুবন পেরিয়ে অপার ভুবনে বসে থাকার অলৌকিক ক্ষমতা। তাই প্রবলভাবে চেষ্টা করে গেছেন মাঝে পাঁচিল তোলার। ছন্দবদ্ধ করার, পদবদ্ধ করার, চরণবদ্ধ করার নানান স্ট্রিক্ট নিয়মাবলীর জন্ম এক মজবুত পাঁচিলের জন্য। ভাবুন দেখি মহাভারতে কতো কান্ড করেই না যুধিষ্ঠির একটি অর্ধসত্য বলেছেন। যদি ওনার জানা থাকতো পানিং, এ্যালিটারেশান, ডাবল মিনিং, ছন্দঘোর, তবে কতো কতোই না মিথ্যে কথার স্রোতে উপচে পড়তো মহাভারত। তো তাই এই পাঁচিল তোলা।
কিন্তু মানুষ এক আশ্চর্য প্রাণ। সে পাঁচিল দেখলেই ভাবে এ এক দরজাসম্ভব, জানালাসম্ভব জিনিস। বাধা পেলে ভাবে এ এক টপকানোসম্ভব গন্তব্য। আশা বা হোপ আমাদের সৃষ্টির আদি থেকে রয়েছে। আদিতে রয়েছে ধ্বনি, যার থেকে ধ্বনাত্মক বা পজিটিভিটি। তাই পাঁচিল বার বার ভেঙে গেছে। মিশে গেছে। কিছু জিনে জিনে মেশেনা, ডি এন এ, ডি এন এ তে মেশেনা। তাই স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতেই আমরা তফাৎ করতে পারি কোনটা কবিতা আর কোনটা গদ্য। তার জন্য কন্ঠস্বরে ব্রেণডোবানো অতি ক্রিয়েটিভ চিল্লানোসোরাসের প্রয়োজন হয় না। আরে আমার ভাষা তৈরী করবো কি আমি? আমি তো নিজে ভাষার থেকে তৈরী হয়েছে। অগাধগাণ্ডু না হলে কেউ বলে যে আমি আমারকবিতার ভাষা সৃষ্টি করেছি। তুমি কে হে দাড়িওয়ালা ব্রহ্মা? ভাষা সৃষ্টি করবে। তুমি খুঁজতে পারো। খুঁজবে তোমার ভাষা। সেতোমাকে সৃষ্টি করেছে, আছে পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও। ও তোমার বাপের সম্পত্তিও নয়। তোমাকে এক্সপেক্টেশানরহিত হয়ে খুঁজে যেতে হবে। আর তোমার সেই সন্ধান যদি সৎ ও সৃষ্টিশীল ও স্বতন্ত্র হয়, তবে ভাষা তোমাকে নিজে খুঁজে নেবে। তুমি এমন কোনো লায়েক নও যে নিজের কবিতার ভাষা চেরাপুঞ্জীর জঙ্গলে পেলে আর পাকড়াও করে পোষ মানালে। ভাষা যদি তোমার কাছে না এসে টোকা না দেয় তোমার দরজায়, তুমি জানতেই পারবে না, কোথায় তোমার দরজা, আর কোথায় তোমার জানলা। বনলতা সেন খুঁজতে যাবে বটানির ক্রীপার ক্লাইম্বার চ্যাপ্টারে। বন বাদাড়ে বেচারা পাখিদের বাসা ভেঙে ঘরে এনে খুব লক্ষ্য করবে। আর তারপর জীবনানন্দের ছবি দেখে, গায়ের রঙ দেখে, যখন মাথার মধ্যে ভ্যাবলাচাক ভোম্বল হবে। কিছুতেই খুঁজে পাবে না কুরূপ কবির অরূপ কলম কোথায়, আর ভুল বকবে হাজিবাজি।
সরি সরিৎবাবু, সরে গেছিলাম, আরেক লেখাটির জায়গায়। তবে খুব একটা সরিনি। আপনি বলেছেন না আপনার বিদ্যা কম। আপনি সৌভাগ্যবান। এবং তাই আপনি এমন এক উজ্জ্বল প্রশ্ন করতে পেরেছেন। যা আমাকে এমন এক লেখা লিখিয়ে নিলো। আমি বিদ্যাশূন্য। পড়াশোনায় বিশ্বাস করিনা, লেখাশেখায় বিশ্বাস করি। লেখাশেখা হলো পড়াশোনার মতোই এক যৌথ কাজ। বিদ্যা হলো ইঁট। আমরা মাথায় ইঁট ভরি। কিন্তু ওই ইঁট যে ভিত তৈরীর জন্য সেটি ভুলে যাই। বিদ্যা মাথায় ঢোকে, এবং ধাক্কা মেরে বের করেও দিতে হয় মাথা থেকে। আনলার্ন। বিদ্যা বেরিয়ে গেলে মাথায় তার যে পায়ের ছাপ পড়ে থাকে সেটিই হলো জ্ঞান। বিশুদ্ধ জ্ঞান। আর তার যে প্রভাবে আপনি দারুণ মজার ব্যাপার দেখেন, কবিতা ও গদ্য আলাদা করতে পারেন, কনফিডেন্টলি। ওটিই হলো বাক্যের ডিএনএ তে থাকা এক বোধ। ওই কুরূপ কবিও দেড়েল বুড়োর চেয়ে কম যায় না বিজ্ঞানমনস্কতায়। বহু আগে বলে গেছে, গভীরে এক বোধ খেলা করে।
ক্লিন্টন বি সিলি নামক গবেষক আছেন জীবনানন্দের, যাকে একবার সামনে পেলে ক্লিন্টন-কি-সিলি বলে চেঁচিয়ে ওঠার ইচ্ছে আছে। ওনার একটি গবেষণা হলো আদর্শ এ ধরণের পাঁঠামোর উদাহরণ। গদ্য আর কবিতার বেসিক জিনের জায়গাটা না ধরতে পারলে যা হয়। দশ বছর ধরে ভদ্রলোক জীবনানন্দের "মালয় সাগর তীরে" এটি কোথথেকে এসেছে তা নিয়ে বেজায় ভেবেছেন। বালী গেছেন। মালয়েশিয়া গেছেন। এবং লাস্টে বিশাখাপত্তনমের বীচে সার বেঁধে আলো জ্বলছে দেখে ভয়ানক আলোকপ্রাপ্ত হয়েছেন। আরে জীবনবাবু তো মালয় আলোর কথাও বলেছেন, আসলে ওটা হচ্ছে মালয়ালম ভাষার দেশ। বুঝুন কান্ড। আপনি এই জীবনানন্দ নিয়ে লেখাটি পড়ে এই অপূর্ব্ব প্রশ্ন করলেন, যার থেকে এই লেখা হলো। আপনাকে কেউ বিশেষজ্ঞ বলে পাত্তাই দেবে না। আর ক্লিন্টন বি সিলি বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উড়ে আসবেন আপনাকে শেখাতে এই অপূর্ব্ব পাঁঠামো জানাতে আর তারপর উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে লাখ টাকা নিয়ে যাবেন। যাক উনি তো তাও কিছু নিয়ে যান। বেচারা জীবনানন্দের রূপবিশেষজ্ঞ, বনলতার ফেমিনিজম খোঁজা অকাট্য গণ্ডারগুলি রাগে গরগর ছাড়া আর কি করবে? তারা বেসিক জায়গাটা কখনো দেখবে না যে জীবনানন্দদের মাল্যবান বা সুতীর্থ এর ভাষা বনলতা সেনের এর চেয়ে কোথায় আলাদা। যে প্রশ্নটি আপনি করলেন। "অভিজ্ঞ কবি" এক্সপ্রেশানটা শুনলেই আমার মনে হয় পুশ আপ ব্রা পরা বিধবা রাঙাপিসীমা।
রাগ ছাড়ূন। সরিৎবাবু, আপনাকে আরেকটি অলৌকিক বলি এই তফাৎ বোঝার আরো স্পেসিফিক। সবার জীবনে রয়েছে। কখনো দেখেছেন একটা বাচ্চা কি করে ভাষা শেখে? দেখবেন সে নকল করে। প্রথমে দোলে। ঠাকুমা বলছে "আয় আয় চাঁদমামা কপালে টি দিয়ে যা"। আর তিনি ভারি নকল করতে গিয়ে ক পিস গাপ করে দিয়েছেন, দিয়ে বলছেন "আয়ায়া চাম্মামা টিদিযা, আয়ায়া চাম্মামা টিদিযা"। এই হচ্ছে শ্রুতি। খেয়াল করুন যে ইতিহাস বলেছি। মন্ত্রের রিদম। ধ্বনি। সে প্রথমে অর্থ, শব্দ, এইসবের বাইরে গিয়ে শেখে একটা বাক্যের বাক্যাংশ। শব্দ অর্থ বহু পরে। আর তফাৎ, খেয়াল করবেন। একটা বাচ্চাকে ঠাকুমা ভাত খাওয়াচ্ছে "আয় আয় চাঁদমামা, টি দিয়ে যা/ আয় আয় সোনাপাখি হলুদপাখি আয় দেখি/দেখি দেখি দেখি এটা এক গালে কে খাবে? কে খাবে? কে খাবে?" বাচ্চাটা জানে পুরোটার কোন অংশ ছড়া, আর কোনটা তাকে একটা ঘটনা ঘটানোর নির্দেশ। কতো আগে সে তফাৎ ধরে গদ্য আর কবিতার। ও তার জিনে আছে। বাংলাভাষার জিনে রয়েছে এই অপূর্ব্ব ক্ষমতা। আর আমাদের পাঁঠা পণ্ডিতগুলো গাবদা প্রবন্ধ লিখে আপনাকে বোঝাবে গদ্য আর কবিতার তফাৎ। করবে এক্সপেরিমেন্ট। খুঁজবে ইজম। একটা বাচ্চা ভাষা উচ্চারণের আগেই বুঝে যায় কোনটা কান্না ভোলানোর ছড়া, আর কোনটা দুষ্টুমির বকুনি। মজার না??
কবিতা গদ্য তফাৎমজার গল্প-
সরি সামান্য ডিস্ট্র্যাক্ট হতে হলো এই প্রশ্নটার জন্য। এটা এক অসাম প্রশ্ন। এতদিন কেউ জিজ্ঞেস করেনি বলে অবাক হতাম। থ্যাংক্স সরিতবাবু (Sarit Chatterjee)। এমন প্রশ্নের জন্য জান নিছাওর করে দেওয়া যায়। ভারি ভালো লাগছে প্রশ্নের ভঙ্গিটি। কোনো আবছা, অস্বচ্ছ নেই। সটান সপাট। বহুদিন অপেক্ষা করেছি এই লেখাটি লেখার জন্য। সেই প্রশ্ন পেলাম গতকাল। বহু বহু বছর অপেক্ষা করেছি এই লেখাটি লেখার জন্য, সেই প্রশ্নটি গতকালের আগে পাইনি। সরিৎবাবুকে উৎসর্গ এই লেখা।
সরিত চ্যাটার্জী-
পড়লাম। কমেন্ট করার মতো বিদ্যে নেই আমার, কিন্তু ভালো লাগল সেটা জানালাম।একটা প্রশ্ন ছিল, কিছুটা অপাংক্তেও। প্রচলিত ছন্দ না থাকলে সেটা যে কবিতা, গদ্য নয়, সেটা কী করে চেনা যায়? মজার কথা হলো যে আমি চিনতে পারি। কিন্তু কী করে পারি সেটা জানি না। একটু স্পেসিফিক উত্তর খুঁজছি।
প্রশ্নস্পার্ক পর্ব-
- সরিৎবাবু একটু শুরু থেকে মানে শিবের গীত থেকে বলবো, কারন তাহলে লেখাটা কমপ্লিটনেস পাবে, আর এটি লেখার জন্য আমি বহু বহুদিন অপেক্ষা করেছি । এই দৈর্ঘ্যবৃদ্ধিটি মার্জনা করবেন। আপনার উত্তর অংশটি আলাদা করে হাইলাইট করা আছে, চাইলে সোজাসুজি ওখানে চলে যেতে পারেন, কোনো অসুবিধে নেই।
জন্মপর্ব-
একদম শুরুতে চলে যাই। কবিতা ও গদ্য তো আলাদা ছিলো না যখন লেখার ভাষা জন্মায়নি। ছিলো শ্রুতি। শ্লোক ছিলো না বাল্মীকীর আগে, বেদে উপনিষদে মন্ত্র। সেগুলি গদ্য নয়, কবিতাও নয়, অথচ রিদম ভিত্তিক। অসতো মা সদগময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ, মৃত্যুর্মাঅমৃতমগময়ঃ। এই লাস্টে গময়ঃ গময়ঃ কিন্তু ছন্দ বা অন্তমিল নয়। মনে রাখার সুবিধার্থে রিপিটেশান। তাই একই বর্ণ শব্দ রিপিট হয়েছে। ঘটনাকাল হিসেবে মহাভারত রামায়ণের পরে হলেও, রচনাকাল ভাষাবৈশিষ্ট্য ইত্যাদি থেকে প্রমাণিত যে মহাভারত রামায়ণের প্রায় হাজার দুই বছর আগে লেখা। মহাভারতে তাই শ্লোক পাইনা। পরপর ঘটনাচক্র, বর্ণনা, চরিত্রদের কার্যকলাপের বর্ণনা। যুদ্ধের চলমান বর্ণনা, লাইভ আর কি। এগুলিতে ছন্দ টন্দ থাকার স্কোপ নেই, তাই নেইও। তবে বেদ উপনিষদ থেকে ভাষাটি আলাদা হয়ে গেল। কারন বেদ উপনিষদে যা ছিলো কনসেপচুয়াল, একটি দুটি ঘটনা থাকলেও, সেই একটি দুটি বেস করে নানা দিকের দরজা জানালা খোলা। নচিকেতাকে তার বাপ বললো তুই যমের বাড়ি যা, সে যমের বাড়ি গেল। এই এক সরল ঘটনা থেকে আস্ত কঠোপনিষদ। ফলে সেখানে কথোপকথন সংলাপজাতীয় হলেও মন্ত্রধর্মী। মনে রাখতে হবে তো। নচিকেতার তো নোট নেওয়ার খাতা নেই।
মহাভারতে এসে লেখার ভাষা জন্মে গেছে তা দেখতে পাই, কিন্তু যেহেতু অতি প্রাচীন তাই সবাই লিখতে শেখেনি। শিখলেও ভাবতে ভাবতে লেখা কাজটি করার দক্ষতা কারোর জন্মায়নি (রামায়নের আগে তা কারোর জন্মাবেও না)। ফলে লিপিকার গণেশের প্রয়োজন। এবার আপনি নিজেকে টেলিপোর্ট করে ওই সময়ে নিয়ে যান, লেখার ভাষা শব্দ জন্মেছে, তাতে কি আছে লক্ষ লক্ষ কিলবিল করা শব্দ, বাক্য, বাক্যাংশ। কানে শুনলে যেটা জাস্ট একটাই মন্ত্র, বিড়বিড় করে মনে রাখা যায়, লিখলে তার জন্য হাজার অক্ষর শব্দ বিভক্তি ইত্যাদি টুকরো টুকরো ভাগে মনে রাখতে হয়। ভাবুন দেখি কি আপদ!! অবিকল এ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন প্রথম দিকের মতো। আরে বাপ, ফোন ধরবো, ফোন করবো, ফোন কাটবো, তার মাঝে এত হাজার লক্ষ কাজ, এ্যাপ, উস্তুম ঝুস্তুম ঢুকে গেলে কেমন আকূল দশা হয়। ঠিক সেই অবস্থাই হলো মহাভারতে। এবং এই দশা থেকে নিজেকে মোটামুটি গুছিয়ে চলন্ত করার জায়গা হলো গদ্য। লেখা তো থাকছে, তাই আর মন্ত্রের মতো মনের রাখার কিউ দরকার নেই। তার চেয়ে এত সব জিনিসপত্র গুছিয়ে টুছিয়ে লোকের সামনে আনি। সর্টিং এ্যান্ড অর্গানাইজিং অফ ল্যাংগুয়েজ। বিউটিফিকেশান তখনো বহু দূর। উইন্ডোজ নাইন্টি এইট। ভিস্টা এক্সপি হয়ে সেভেন টেভেন স্বপ্ন। তো এই ভাষার যে অপারেটিং সিস্টেম তৈরী হলো সেটি হলো গদ্য বা গদ্যাকৃতি। অপারেটিং সিস্টেম শব্দটি কি অপূর্ব ফিট করেছে দেখুন মিনিং এর দিক থেকেও। তো আমরা গদ্য পেলাম। জানলাম গদ্যের কি ক্ষমতা? না ঘটনা ঘটার সময় বর্ণনা করা যায় হুবহু। আগে স্মৃতিতে রেখে তার থেকে শাস্ত্রে ঢুকিয়ে রাখতে হতো ঘটনাকে। এখন ঘটনা ঘটাটাকেই বর্ণনা করা যাচ্ছে। সঞ্জয়বাবু আস্ত একপিস চৌদ্দদিনের যুদ্ধের কমেন্ট্রি দিয়ে গেলেন!! এই জন্মজায়গাগুলো মাথায় রাখবেন পরে আসবো ফিরে।
তার বহু বছর পর এলো রত্নাকর ডাকাত। পড়লো পাপের ফাঁদে। নারদ তাকে বললো রামের আরাধনা করতে এবং উইঢিপি। পৃথিবীর প্রাচীনতম পোকাটি এখনো বাল্মীকি নামের মধ্যে বেঁচে আছে। রত্নাকর মহর্ষি বাল্মীকি হলেন। তাঁর চেলা হলেন ভরদ্বাজ। ভরদ্বাজকে নিয়ে বাল্মীকি ঘুরে বেড়াচ্ছেন তীর্থে। ইতিমধ্যে নারদ এসে রামের জীবনকথা শুনিয়ে গেছেন। তখনো কিন্তু জীবনকথা। নারদ বীনা বাজান, বীনা থামিয়ে জীবনকথা শোনান। শুনিয়ে আবার থেমে খানিকক্ষণ বীনা বাজান। বাল্মীকি রামজ্বর হলো (এই জ্বর মানে আক্রান্তের এক তীব্রতম দশা, জ্বরাসুর নামক এক রাক্ষসের থেকে উৎপত্তি)। ভরদ্বাজকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, রামের কথা ভাবেন সারাক্ষণ। জাহ্নবীর কাছেই তমসা নদীর ধারে ভরদ্বাজকে নিয়ে গেছেন। সেই স্বচ্ছ জল দেখে বাল্মীকি মুগ্ধ বললেন "অকর্দমমিদং তীর্থং ভরদ্বাজ নিশাময়..." - ভরদ্বাজ এই নদীতীর্থে দেখো কী চমৎকার জল। ঠিক যেন চরিত্রবান মানুষের মতোই স্বচ্ছ। বৎস তুমি কলসিটা রেখে আমায় বল্কলটা দাও তো, আমি চান করবো।
এটা কিন্তু পূর্ণ ছন্দে লেখা, তবুও এটি শ্লোকের মর্যাদা পাইনি। তখনো শ্লোক আবিষ্কার হয়নি।আপনাকে এই ধান ভানতে শিবের গীত শুরু করেছি। এর মধ্যেই সেই অপার রহস্য আছে লুকিয়ে। শ্লোকের সংজ্ঞা বাল্মীকি অল্প পরে দেবেন আর তার সাথে জন্ম হবে পৃথিবীর এক অপূর্বতম জিনিসের।
সেই বল্কল হাতে নিয়ে জলে নামলেন না বাল্মীকি, ইতঃস্ততঃ চারপাশের বনে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। পাখি ডাকছে, নদী বইছে কুলকুল। রামের কথাগুলি মাথায় ঢেউ তুলছে তাঁর। কিন্তু কি একটা যেন নেই। কি একটা যেন নেই। কি পাচ্ছেন না তিনি? কোথায় অসম্পূর্ণ। ভাবতে ভাবতে দেখলেন এক্টি গাছের ডালে এক কোঁচ-বক কোঁচ-বকীর সাথে মিথুন খেলায় মত্ত। কলকন্ঠ ক্রৌঞ্চ, বলেছেন বাল্মীকি। কলকন্ঠ শব্দটি বাল্মীকির সৃষ্টি। অপূর্ব এক শব্দ। যেখানে একটা পাখির গলা থেকে অনেক পাখির সুরেলা কলকাকলি অব্যক্ত হয়ে বেরোয়, তাই কলকন্ঠ। কোঁচ-বক সাঁত্রাগাছিতে গেলেই দেখতে পাবেন। সাদা, গলায় কালো স্ট্রাইপ থাকে, মাথায় তামাটে ঝুঁটি। ডাকটা শুনে দেখবেন, কেন আদিকবি বলা হয় বাল্মীকিকে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকবে না।
আর ঠিক সেই সময়ে একটা ব্যাধ, তার যা কাজ তাই করেছে, অর্থাৎ তির ছুঁড়েছে। তিরের ফলায় বিদ্ধ ক্রৌঞ্চ অর্থাৎ পুরুষ বকটি মাটিতে পড়ে ছটফট করছে রক্তাক্ত অবস্থায়। আর তার ভার্যা ক্রৌঞ্চী নীচে না নেমেই তার সহচর ওই তাম্রঝুঁটি ক্রৌঞ্চের জন্য ওই কলকন্ঠে আকূল কান্না কাঁদতে লাগলো। একটু আগেই তারা দু ডানা মেলে কি অপূর্ব মিলনের খেলা খেলছিলো।
বাল্মীকি এটা দেখতে দেখতে যা বললেন তাও কিন্তু ছন্দে। অথচ সেটা হচ্ছে ওই মহাভারতের মতো ঘটনার বর্ণনা।
তং শোণিতপরীতাঙ্গং চেষ্টামানং মহীতলে।
ভার্যা তু নিহতং দৃষ্ট্বা রুরাব করুণাং গিরম
বিযুক্তা পতিনা তেন দ্বিজেন সহচারিণা।
তাম্রশীর্ষেণ মত্তেন পত্রিণা সহিতেন।
- মানেটা আগেই লিখেছি, খেয়াল করে দেখবেন এখনো অবধি কিন্তু লেখা হচ্ছে একটা বাক্যের পর পূর্ণচ্ছেদ। তার পরের বাক্যে পূর্ণচ্ছেদ নেই। আবার তার পরের বাক্যে আছে। তখনো অবধি যা কিছু লেখা তাতে পূর্ণচ্ছেদের চেহারা একটাই। দাঁড়ি। এবং সেটি কোনোকিছু অন্তিম বা শেষ বোঝায়। আর কিছু না এক্সট্রা।
আর তার পর সেই অমোঘ উচ্চারণ। যা ঘটনা ফুরিয়ে গেছে, তার অনুভূতি পড়ে আছে, সেখান থেকে জন্ম নিলো আশ্চর্য এক্সপ্রেশান।
মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগম শাশ্বতী সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম।।
মানে বলা নিষ্প্রয়োজন। ওরে নিষাদ তুই চিরকাল প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারবি না (অভিশাপেও কি শব্দের চয়েস দেখুন বাল্মীকির, প্রতিষ্ঠা, অকল্পনীয়!!) কারন তুই কামমোহিত থাকা অবস্থায় ক্রৌঞ্চমিথুনের একটিকে বধ করেছিস।
এবং এই হলো কবিতার জন্ম। এরকম পদ আগেও লিখেছেন বাল্মীকি কিন্তু এটা স্পেশাল কোথায়? নিজেই বলছেন ভরদ্বাজকে যে,শোকে অভিভূত হয়ে ভরদ্বাজ, এই যে আমি চরণ-বাঁধা (পঙক্তি বা লাইন) সমান অক্ষরে তৈরী নারদের বীণা না থামিয়ে গাওয়ার উপযোগী বাক্য নির্মাণ করলাম এটি শোকাবেগ থেকে নিঃসৃত বলে "শ্লোক" নামে খ্যাত হবে।
তারপর হু হু করে কিছু আশ্চর্য ঘটনা, সেগুলি বলেই আমি আপনার প্রশ্নের উত্তরে ফিরে যাবো। ব্রহ্মা এলেন বাল্মীকির কাছে। বাল্মীকি তখনো সেই নিজ রচনায় ডুবে আছেন। ব্রহ্মা বললেন "দাঁড়িয়ে কেন? বোসো", বাল্মীকি আবার উচ্চারণ করলেন "মা নিষাদ..."। কি সুক্ষ্ম এই খেলা, ব্রহ্মাকে অসম্মান করলেন না, অন্যমনস্কও থাকলেন, অথচ সত্য উত্তরই দিলেন। ব্রহ্মা বললেন তুমি রামের জীবনকথা রচনা করো। তুমি এখন তার যোগ্য। এরপরেই আরেকটি অসাধারণ পর্ব যা কেউ খেয়াল করেননি রবীন্দ্রনাথ ছাড়া। রবীন্দ্রনাথের পরেও কাউকে দেখিনি স্পট করতে।
বাল্মীকি বললেন, রামের জীবন আমি তো নারদের মুখ থেকে ছেঁড়া ছেঁড়া শুনেছি। আমি তো সব জানিনা। টুকরো টুকরো ঘটনা ইত্যাদি, রাক্ষস, সীতা, রাবণ এইসব জানি। আমি তো পূর্ণাঙ্গ ঘটনা জানিনা। (মহাভারতে ঘটনার সময় লেখা হচ্ছে তাই এই সমস্যা নেই। কিন্তু রামায়ণে এখান থেকেই স্পষ্ট যে প্রকৃত ঘটনাবলীর বহু পরে বাল্মীকির আগমণ।)
ব্রহ্মা এর উত্তরে বাল্মীকিকে দিলেন সেই এক অমর আশীর্ব্বাদ যা আজো প্রতিটি লেখার মানুষ, কবিতার মানুষ বহন করে। বললেন, বাল্মীকি, আমার প্রসাদে তোমার অজানা কিছু থাকবে না। সবই তোমার জানা হবে। আর এই শ্লোকবদ্ধ মহাকাব্যের একটা বাক্যও মিথ্যে হবে না। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন এই মহাকাব্য থাকবে।
আপাতভাবে মনে হয় এটা বোধহয় বর। আসলে এটা এক ভয়ংকর দায়িত্বের বাঁশ দিয়ে গেছিলেন বাল্মীকিকে প্রজাপতি। অজানা জিনিস লিখবেন, অথচ তা মিথ্যে বা অনৃতভাষণ হবে না, এটা কি করে লেখা যায়?!!!! বাল্মীকি ধ্যানে বসলেন এবং দ্বিতীয় আবিষ্কার করলেন। গোটা রামায়ণ করতলে রাখা আমলকীর মতো দেখতে পেলেন। কি অপূর্ব উপমা। হাতের তালুতে আমলকীর মতো একটা মহাকাব্য দেখতে পাচ্ছেন। এটা কি জানেন? এটা হচ্ছে "কল্পনা" র জন্ম। যা মিথ্যা বা অনৃতভাষণ নয়। যা বর্ণনার গৌরব বৃদ্ধি করে অথচ মানুষের অজানা, তাই হলো কল্পনা। এবং এই কল্পনার জোরেই বাল্মীকি নিজেকে ঢুকিয়ে দিলেন রামায়ণে চরিত্র হিসেবে। ছয় কান্ড, ২৪,০০০ শ্লোক, ৫০০ সর্গে লেখা রামায়ণ।
রবীন্দ্রনাথ এই অনবদ্য অংশটির আসল রহস্য স্পট করেছিলেন। "ভাষা ও ছন্দে" রয়েছে
"জানি আমি, জানি তাঁরে, শুনেছি তাঁহার কীর্তিকথা
কহিলা বাল্মিকি, তবু নাহি জানি সমগ্র বারতা
সকল ঘটনা তাঁর - ইতিবৃত্ত রচিব কেমনে!
পাছে সত্যভ্রষ্ট হই, সেই ভয় জাগে মোর মনে।
নারদ কহিলা হাসি "সেই সত্য, যা রচিবে তুমি,
ঘটে যা, তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি,
রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়েও সত্য জেনো"
রবীন্দ্রনাথ এখানে ব্রহ্মাকে নারদ করে দিয়েছেন। কারন উনি আরো কঠোর ভাষায় বলে দিচ্ছেন যে কল্পনা একরকমের অসত্য, কিন্তু তার প্রয়োজন কোথায়। আহা, সাধে এই দেড়েল বুড়োর দিকে চোখ তুলে তাকানো যায়না?
(আমি নিজে একবার লিখছিলাম "উই আর দ্য ট্রুথমেকার্স। আমরা যা সত্যি তাই লিখছি এমন কিন্তু নয়। আমরা যা লিখছি তাই সত্যি। এটা বিরাট দায়িত্ব। দক্ষিণারঞ্জন যদি না লিখতেন কুলোর মতো কান, তার ভাঁটার মতো চোখ। আমরা কি জানতাম যে সত্যি সত্যি এমন হয়না?" ভেবেছিলাম দুরন্ত উপলব্ধি এক। পরে দেখি সেই একশো বছর আগে বুড়োটা এটা জলবৎ আল্পনার মতো লিখে গেছেন। হ্যাটস অফ। দাড়ি টেনে ছিঁড়ে দিতে ইচ্ছে করে শালার। হিহিহি)
সরি সামান্য ডিস্ট্র্যাক্ট হতে হলো এই প্রশ্নটার জন্য। এটা এক অসাম প্রশ্ন। এতদিন কেউ জিজ্ঞেস করেনি বলে অবাক হতাম। থ্যাংক্স সরিতবাবু (Sarit Chatterjee)। এমন প্রশ্নের জন্য জান নিছাওর করে দেওয়া যায়। ভারি ভালো লাগছে প্রশ্নের ভঙ্গিটি। কোনো আবছা, অস্বচ্ছ নেই। সটান সপাট। বহুদিন অপেক্ষা করেছি এই লেখাটি লেখার জন্য। সেই প্রশ্ন পেলাম গতকাল। বহু বহু বছর অপেক্ষা করেছি এই লেখাটি লেখার জন্য, সেই প্রশ্নটি গতকালের আগে পাইনি। সরিৎবাবুকে উৎসর্গ এই লেখা।
সরিত চ্যাটার্জী-
পড়লাম। কমেন্ট করার মতো বিদ্যে নেই আমার, কিন্তু ভালো লাগল সেটা জানালাম।একটা প্রশ্ন ছিল, কিছুটা অপাংক্তেও। প্রচলিত ছন্দ না থাকলে সেটা যে কবিতা, গদ্য নয়, সেটা কী করে চেনা যায়? মজার কথা হলো যে আমি চিনতে পারি। কিন্তু কী করে পারি সেটা জানি না। একটু স্পেসিফিক উত্তর খুঁজছি।
প্রশ্নস্পার্ক পর্ব-
- সরিৎবাবু একটু শুরু থেকে মানে শিবের গীত থেকে বলবো, কারন তাহলে লেখাটা কমপ্লিটনেস পাবে, আর এটি লেখার জন্য আমি বহু বহুদিন অপেক্ষা করেছি । এই দৈর্ঘ্যবৃদ্ধিটি মার্জনা করবেন। আপনার উত্তর অংশটি আলাদা করে হাইলাইট করা আছে, চাইলে সোজাসুজি ওখানে চলে যেতে পারেন, কোনো অসুবিধে নেই।
জন্মপর্ব-
একদম শুরুতে চলে যাই। কবিতা ও গদ্য তো আলাদা ছিলো না যখন লেখার ভাষা জন্মায়নি। ছিলো শ্রুতি। শ্লোক ছিলো না বাল্মীকীর আগে, বেদে উপনিষদে মন্ত্র। সেগুলি গদ্য নয়, কবিতাও নয়, অথচ রিদম ভিত্তিক। অসতো মা সদগময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ, মৃত্যুর্মাঅমৃতমগময়ঃ। এই লাস্টে গময়ঃ গময়ঃ কিন্তু ছন্দ বা অন্তমিল নয়। মনে রাখার সুবিধার্থে রিপিটেশান। তাই একই বর্ণ শব্দ রিপিট হয়েছে। ঘটনাকাল হিসেবে মহাভারত রামায়ণের পরে হলেও, রচনাকাল ভাষাবৈশিষ্ট্য ইত্যাদি থেকে প্রমাণিত যে মহাভারত রামায়ণের প্রায় হাজার দুই বছর আগে লেখা। মহাভারতে তাই শ্লোক পাইনা। পরপর ঘটনাচক্র, বর্ণনা, চরিত্রদের কার্যকলাপের বর্ণনা। যুদ্ধের চলমান বর্ণনা, লাইভ আর কি। এগুলিতে ছন্দ টন্দ থাকার স্কোপ নেই, তাই নেইও। তবে বেদ উপনিষদ থেকে ভাষাটি আলাদা হয়ে গেল। কারন বেদ উপনিষদে যা ছিলো কনসেপচুয়াল, একটি দুটি ঘটনা থাকলেও, সেই একটি দুটি বেস করে নানা দিকের দরজা জানালা খোলা। নচিকেতাকে তার বাপ বললো তুই যমের বাড়ি যা, সে যমের বাড়ি গেল। এই এক সরল ঘটনা থেকে আস্ত কঠোপনিষদ। ফলে সেখানে কথোপকথন সংলাপজাতীয় হলেও মন্ত্রধর্মী। মনে রাখতে হবে তো। নচিকেতার তো নোট নেওয়ার খাতা নেই।
মহাভারতে এসে লেখার ভাষা জন্মে গেছে তা দেখতে পাই, কিন্তু যেহেতু অতি প্রাচীন তাই সবাই লিখতে শেখেনি। শিখলেও ভাবতে ভাবতে লেখা কাজটি করার দক্ষতা কারোর জন্মায়নি (রামায়নের আগে তা কারোর জন্মাবেও না)। ফলে লিপিকার গণেশের প্রয়োজন। এবার আপনি নিজেকে টেলিপোর্ট করে ওই সময়ে নিয়ে যান, লেখার ভাষা শব্দ জন্মেছে, তাতে কি আছে লক্ষ লক্ষ কিলবিল করা শব্দ, বাক্য, বাক্যাংশ। কানে শুনলে যেটা জাস্ট একটাই মন্ত্র, বিড়বিড় করে মনে রাখা যায়, লিখলে তার জন্য হাজার অক্ষর শব্দ বিভক্তি ইত্যাদি টুকরো টুকরো ভাগে মনে রাখতে হয়। ভাবুন দেখি কি আপদ!! অবিকল এ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন প্রথম দিকের মতো। আরে বাপ, ফোন ধরবো, ফোন করবো, ফোন কাটবো, তার মাঝে এত হাজার লক্ষ কাজ, এ্যাপ, উস্তুম ঝুস্তুম ঢুকে গেলে কেমন আকূল দশা হয়। ঠিক সেই অবস্থাই হলো মহাভারতে। এবং এই দশা থেকে নিজেকে মোটামুটি গুছিয়ে চলন্ত করার জায়গা হলো গদ্য। লেখা তো থাকছে, তাই আর মন্ত্রের মতো মনের রাখার কিউ দরকার নেই। তার চেয়ে এত সব জিনিসপত্র গুছিয়ে টুছিয়ে লোকের সামনে আনি। সর্টিং এ্যান্ড অর্গানাইজিং অফ ল্যাংগুয়েজ। বিউটিফিকেশান তখনো বহু দূর। উইন্ডোজ নাইন্টি এইট। ভিস্টা এক্সপি হয়ে সেভেন টেভেন স্বপ্ন। তো এই ভাষার যে অপারেটিং সিস্টেম তৈরী হলো সেটি হলো গদ্য বা গদ্যাকৃতি। অপারেটিং সিস্টেম শব্দটি কি অপূর্ব ফিট করেছে দেখুন মিনিং এর দিক থেকেও। তো আমরা গদ্য পেলাম। জানলাম গদ্যের কি ক্ষমতা? না ঘটনা ঘটার সময় বর্ণনা করা যায় হুবহু। আগে স্মৃতিতে রেখে তার থেকে শাস্ত্রে ঢুকিয়ে রাখতে হতো ঘটনাকে। এখন ঘটনা ঘটাটাকেই বর্ণনা করা যাচ্ছে। সঞ্জয়বাবু আস্ত একপিস চৌদ্দদিনের যুদ্ধের কমেন্ট্রি দিয়ে গেলেন!! এই জন্মজায়গাগুলো মাথায় রাখবেন পরে আসবো ফিরে।
তার বহু বছর পর এলো রত্নাকর ডাকাত। পড়লো পাপের ফাঁদে। নারদ তাকে বললো রামের আরাধনা করতে এবং উইঢিপি। পৃথিবীর প্রাচীনতম পোকাটি এখনো বাল্মীকি নামের মধ্যে বেঁচে আছে। রত্নাকর মহর্ষি বাল্মীকি হলেন। তাঁর চেলা হলেন ভরদ্বাজ। ভরদ্বাজকে নিয়ে বাল্মীকি ঘুরে বেড়াচ্ছেন তীর্থে। ইতিমধ্যে নারদ এসে রামের জীবনকথা শুনিয়ে গেছেন। তখনো কিন্তু জীবনকথা। নারদ বীনা বাজান, বীনা থামিয়ে জীবনকথা শোনান। শুনিয়ে আবার থেমে খানিকক্ষণ বীনা বাজান। বাল্মীকি রামজ্বর হলো (এই জ্বর মানে আক্রান্তের এক তীব্রতম দশা, জ্বরাসুর নামক এক রাক্ষসের থেকে উৎপত্তি)। ভরদ্বাজকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, রামের কথা ভাবেন সারাক্ষণ। জাহ্নবীর কাছেই তমসা নদীর ধারে ভরদ্বাজকে নিয়ে গেছেন। সেই স্বচ্ছ জল দেখে বাল্মীকি মুগ্ধ বললেন "অকর্দমমিদং তীর্থং ভরদ্বাজ নিশাময়..." - ভরদ্বাজ এই নদীতীর্থে দেখো কী চমৎকার জল। ঠিক যেন চরিত্রবান মানুষের মতোই স্বচ্ছ। বৎস তুমি কলসিটা রেখে আমায় বল্কলটা দাও তো, আমি চান করবো।
এটা কিন্তু পূর্ণ ছন্দে লেখা, তবুও এটি শ্লোকের মর্যাদা পাইনি। তখনো শ্লোক আবিষ্কার হয়নি।আপনাকে এই ধান ভানতে শিবের গীত শুরু করেছি। এর মধ্যেই সেই অপার রহস্য আছে লুকিয়ে। শ্লোকের সংজ্ঞা বাল্মীকি অল্প পরে দেবেন আর তার সাথে জন্ম হবে পৃথিবীর এক অপূর্বতম জিনিসের।
সেই বল্কল হাতে নিয়ে জলে নামলেন না বাল্মীকি, ইতঃস্ততঃ চারপাশের বনে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। পাখি ডাকছে, নদী বইছে কুলকুল। রামের কথাগুলি মাথায় ঢেউ তুলছে তাঁর। কিন্তু কি একটা যেন নেই। কি একটা যেন নেই। কি পাচ্ছেন না তিনি? কোথায় অসম্পূর্ণ। ভাবতে ভাবতে দেখলেন এক্টি গাছের ডালে এক কোঁচ-বক কোঁচ-বকীর সাথে মিথুন খেলায় মত্ত। কলকন্ঠ ক্রৌঞ্চ, বলেছেন বাল্মীকি। কলকন্ঠ শব্দটি বাল্মীকির সৃষ্টি। অপূর্ব এক শব্দ। যেখানে একটা পাখির গলা থেকে অনেক পাখির সুরেলা কলকাকলি অব্যক্ত হয়ে বেরোয়, তাই কলকন্ঠ। কোঁচ-বক সাঁত্রাগাছিতে গেলেই দেখতে পাবেন। সাদা, গলায় কালো স্ট্রাইপ থাকে, মাথায় তামাটে ঝুঁটি। ডাকটা শুনে দেখবেন, কেন আদিকবি বলা হয় বাল্মীকিকে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকবে না।
আর ঠিক সেই সময়ে একটা ব্যাধ, তার যা কাজ তাই করেছে, অর্থাৎ তির ছুঁড়েছে। তিরের ফলায় বিদ্ধ ক্রৌঞ্চ অর্থাৎ পুরুষ বকটি মাটিতে পড়ে ছটফট করছে রক্তাক্ত অবস্থায়। আর তার ভার্যা ক্রৌঞ্চী নীচে না নেমেই তার সহচর ওই তাম্রঝুঁটি ক্রৌঞ্চের জন্য ওই কলকন্ঠে আকূল কান্না কাঁদতে লাগলো। একটু আগেই তারা দু ডানা মেলে কি অপূর্ব মিলনের খেলা খেলছিলো।
বাল্মীকি এটা দেখতে দেখতে যা বললেন তাও কিন্তু ছন্দে। অথচ সেটা হচ্ছে ওই মহাভারতের মতো ঘটনার বর্ণনা।
তং শোণিতপরীতাঙ্গং চেষ্টামানং মহীতলে।
ভার্যা তু নিহতং দৃষ্ট্বা রুরাব করুণাং গিরম
বিযুক্তা পতিনা তেন দ্বিজেন সহচারিণা।
তাম্রশীর্ষেণ মত্তেন পত্রিণা সহিতেন।
- মানেটা আগেই লিখেছি, খেয়াল করে দেখবেন এখনো অবধি কিন্তু লেখা হচ্ছে একটা বাক্যের পর পূর্ণচ্ছেদ। তার পরের বাক্যে পূর্ণচ্ছেদ নেই। আবার তার পরের বাক্যে আছে। তখনো অবধি যা কিছু লেখা তাতে পূর্ণচ্ছেদের চেহারা একটাই। দাঁড়ি। এবং সেটি কোনোকিছু অন্তিম বা শেষ বোঝায়। আর কিছু না এক্সট্রা।
আর তার পর সেই অমোঘ উচ্চারণ। যা ঘটনা ফুরিয়ে গেছে, তার অনুভূতি পড়ে আছে, সেখান থেকে জন্ম নিলো আশ্চর্য এক্সপ্রেশান।
মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগম শাশ্বতী সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম।।
মানে বলা নিষ্প্রয়োজন। ওরে নিষাদ তুই চিরকাল প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারবি না (অভিশাপেও কি শব্দের চয়েস দেখুন বাল্মীকির, প্রতিষ্ঠা, অকল্পনীয়!!) কারন তুই কামমোহিত থাকা অবস্থায় ক্রৌঞ্চমিথুনের একটিকে বধ করেছিস।
এবং এই হলো কবিতার জন্ম। এরকম পদ আগেও লিখেছেন বাল্মীকি কিন্তু এটা স্পেশাল কোথায়? নিজেই বলছেন ভরদ্বাজকে যে,শোকে অভিভূত হয়ে ভরদ্বাজ, এই যে আমি চরণ-বাঁধা (পঙক্তি বা লাইন) সমান অক্ষরে তৈরী নারদের বীণা না থামিয়ে গাওয়ার উপযোগী বাক্য নির্মাণ করলাম এটি শোকাবেগ থেকে নিঃসৃত বলে "শ্লোক" নামে খ্যাত হবে।
তারপর হু হু করে কিছু আশ্চর্য ঘটনা, সেগুলি বলেই আমি আপনার প্রশ্নের উত্তরে ফিরে যাবো। ব্রহ্মা এলেন বাল্মীকির কাছে। বাল্মীকি তখনো সেই নিজ রচনায় ডুবে আছেন। ব্রহ্মা বললেন "দাঁড়িয়ে কেন? বোসো", বাল্মীকি আবার উচ্চারণ করলেন "মা নিষাদ..."। কি সুক্ষ্ম এই খেলা, ব্রহ্মাকে অসম্মান করলেন না, অন্যমনস্কও থাকলেন, অথচ সত্য উত্তরই দিলেন। ব্রহ্মা বললেন তুমি রামের জীবনকথা রচনা করো। তুমি এখন তার যোগ্য। এরপরেই আরেকটি অসাধারণ পর্ব যা কেউ খেয়াল করেননি রবীন্দ্রনাথ ছাড়া। রবীন্দ্রনাথের পরেও কাউকে দেখিনি স্পট করতে।
বাল্মীকি বললেন, রামের জীবন আমি তো নারদের মুখ থেকে ছেঁড়া ছেঁড়া শুনেছি। আমি তো সব জানিনা। টুকরো টুকরো ঘটনা ইত্যাদি, রাক্ষস, সীতা, রাবণ এইসব জানি। আমি তো পূর্ণাঙ্গ ঘটনা জানিনা। (মহাভারতে ঘটনার সময় লেখা হচ্ছে তাই এই সমস্যা নেই। কিন্তু রামায়ণে এখান থেকেই স্পষ্ট যে প্রকৃত ঘটনাবলীর বহু পরে বাল্মীকির আগমণ।)
ব্রহ্মা এর উত্তরে বাল্মীকিকে দিলেন সেই এক অমর আশীর্ব্বাদ যা আজো প্রতিটি লেখার মানুষ, কবিতার মানুষ বহন করে। বললেন, বাল্মীকি, আমার প্রসাদে তোমার অজানা কিছু থাকবে না। সবই তোমার জানা হবে। আর এই শ্লোকবদ্ধ মহাকাব্যের একটা বাক্যও মিথ্যে হবে না। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন এই মহাকাব্য থাকবে।
আপাতভাবে মনে হয় এটা বোধহয় বর। আসলে এটা এক ভয়ংকর দায়িত্বের বাঁশ দিয়ে গেছিলেন বাল্মীকিকে প্রজাপতি। অজানা জিনিস লিখবেন, অথচ তা মিথ্যে বা অনৃতভাষণ হবে না, এটা কি করে লেখা যায়?!!!! বাল্মীকি ধ্যানে বসলেন এবং দ্বিতীয় আবিষ্কার করলেন। গোটা রামায়ণ করতলে রাখা আমলকীর মতো দেখতে পেলেন। কি অপূর্ব উপমা। হাতের তালুতে আমলকীর মতো একটা মহাকাব্য দেখতে পাচ্ছেন। এটা কি জানেন? এটা হচ্ছে "কল্পনা" র জন্ম। যা মিথ্যা বা অনৃতভাষণ নয়। যা বর্ণনার গৌরব বৃদ্ধি করে অথচ মানুষের অজানা, তাই হলো কল্পনা। এবং এই কল্পনার জোরেই বাল্মীকি নিজেকে ঢুকিয়ে দিলেন রামায়ণে চরিত্র হিসেবে। ছয় কান্ড, ২৪,০০০ শ্লোক, ৫০০ সর্গে লেখা রামায়ণ।
রবীন্দ্রনাথ এই অনবদ্য অংশটির আসল রহস্য স্পট করেছিলেন। "ভাষা ও ছন্দে" রয়েছে
"জানি আমি, জানি তাঁরে, শুনেছি তাঁহার কীর্তিকথা
কহিলা বাল্মিকি, তবু নাহি জানি সমগ্র বারতা
সকল ঘটনা তাঁর - ইতিবৃত্ত রচিব কেমনে!
পাছে সত্যভ্রষ্ট হই, সেই ভয় জাগে মোর মনে।
নারদ কহিলা হাসি "সেই সত্য, যা রচিবে তুমি,
ঘটে যা, তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি,
রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়েও সত্য জেনো"
রবীন্দ্রনাথ এখানে ব্রহ্মাকে নারদ করে দিয়েছেন। কারন উনি আরো কঠোর ভাষায় বলে দিচ্ছেন যে কল্পনা একরকমের অসত্য, কিন্তু তার প্রয়োজন কোথায়। আহা, সাধে এই দেড়েল বুড়োর দিকে চোখ তুলে তাকানো যায়না?
(আমি নিজে একবার লিখছিলাম "উই আর দ্য ট্রুথমেকার্স। আমরা যা সত্যি তাই লিখছি এমন কিন্তু নয়। আমরা যা লিখছি তাই সত্যি। এটা বিরাট দায়িত্ব। দক্ষিণারঞ্জন যদি না লিখতেন কুলোর মতো কান, তার ভাঁটার মতো চোখ। আমরা কি জানতাম যে সত্যি সত্যি এমন হয়না?" ভেবেছিলাম দুরন্ত উপলব্ধি এক। পরে দেখি সেই একশো বছর আগে বুড়োটা এটা জলবৎ আল্পনার মতো লিখে গেছেন। হ্যাটস অফ। দাড়ি টেনে ছিঁড়ে দিতে ইচ্ছে করে শালার। হিহিহি)
জুনিয়রকে লেখা একটি বিপজ্জনক খোলা লেখা- দুই (কার্টসি সরিৎবাবু)
Sarit Chatterjee (Sarit Chatterjee)
লেখাটা একবার হাসপাতালে ফাঁকতালে পড়েছিলাম। তারপর বিকেলে আরেকবার পড়লাম। দুটো প্রশ্ন আছে।
এক, নন-ট্রুথ ব্যাপারটা নিশ্চয়ই কবিতার একটা আঙ্গিক, সমষ্ঠি নয়?
দুই, প্রচলিত ছন্দ আর নন-ট্রুথ, দুটোর কোনোটাই যদি না থাকে, তাহলেও কি কবিতা হতে পারে?
Amitava Praharaj
আঙ্গিক টাংগিক বলে কিছু নেই। সমষ্টিগত কনসেপ্ট। নন ট্রুথ বলতে কোনো দর্শন বলছি না। কল্পনা বা নন ট্রুথ এর জায়গা আসে কগনিটিভ হ্যাবিট থেকে। আমরা কল্পনা দিয়ে জুড়ি। যুক্তি বা যুক্তির অভাব রচনা করিউ। আপনি বোধহয় ওগুলো দার্শনিক মতামত বা আলোচনা ভেবেছেন। মোটেই না কিন্তু। আমি দর্শনে বিশ্বাস করিনা। তত্ত্বে তো নাইইই। আমি সাহিত্যকে বিজ্ঞান মনে করি। আর্ট অফ লিটারেচার মেড ফাইনেস্ট উইথ দ্য সায়েন্স অফ রাইটিং। লিটারেসায়েন্স। কবিতা ওরকমই বিজ্ঞানেরই জায়গা। দাঁরান। একটু টুকিটাকি হোক। আমার গবেষণার জায়গা সাইকোলিংগুইস্টিক্স আর নিউরো লিংগুইস্টিক্স। আপনি ডাক্তারবাবু জেনে সাহস করছি একটু এ্যাকাডেমিক হওয়ার। মার্জনা করবেন।
আসলে এগুলো অন্য জায়গা, এটা আপনি দর্শনে চলে যাচ্ছেন, সে নিয়ে আলোচনা বিস্তর হয়েছে এবং স্বাভাবিক ফিলজফি যা করে তা হলো ভেগোলজিকে শক্তিশালী করে। আমি যুক্তিতে বিশ্বাস করি। ঈশ্বরেও, ঈশ্বর হলো ব্রহ্মাণ্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ সবচেয়ে সুন্দর যুক্তি। আমি যে কথাগুলো বলেছি সেগুলো গদ্য বা কবিতার নন্দনতত্ত্ব নিয়ে নয় কিন্তু। একদম হাড় মাংস, এ্যানাটমি নিয়ে। আপনি ডাক্তারবাবু, আপনি জানেন। হার্ট সার্জারির সময় হৃদয় ইন্টারফেয়ার করে যখন মাথা থেকে করে। আর ওই কার্ডিওভাসকুলার মুভমেন্টকে তখন হৃদয়ের লাবডুব এর চেয়ে প্রাণের ধকধক বেশী মনে হয়। লোকে সত্যি কথা বলার সময় বুকে হাত রাখে, প্রেমের কথা বলার সময় বুকে কেন হাত রাখে জানেন? কারনটা কোনো দর্শন বা কবিতা বা নন্দনতত্ত্ব নয়। আমি একটা ধ্বনি ধ্বনিত করছি আর তার প্রম্পটার হলো প্রাণের ধ্বনি যেখানে ধ্বনিত হয়েছে। হৃদয় কনসেপ্টের উৎস এখানেই...... তো কবিতা কি করে হবে না হবে, এগুলো কিন্তু কমপ্লিট আলাদা প্রশ্ন, কবিতা হয় না। কবিতা ঘটে
Amitava Praharaj
আর তাও সারাক্ষণ, চতুর্দিকে, প্রতিমুহূর্তে। আপনার চারদিকে তাকান, যেখানেই চলমানতা আছে কবিতা ঘটে চলেছে। আমরা শুধু স্পট করে তাকে ভাষায় শব্দে বাক্যে অনবুবাদ করি
Amitava Praharaj
ভাষা নিয়ে বড়ো অবৈজ্ঞানিক কনসেপ্ট আমাদের। আমার আগের পেপার ছিলো ভাবনা ভাষা বা ল্যাংগুয়েজ অফ থট নিয়ে। তার জন্য প্রচুর ফাংশানাল এম আর আই স্টাডি করতে হতো। ওই একটা টেস্ট ১৯৯৭ সালে আবিষ্কার সমস্ত ধারণা বদলে দিয়েছে। ভাষা কোনো ব্রেণের স্পেশাল ব্রোকাজ রিজিয়ন থেকে উদ্ভুত হয় না। ভাষার সাথে ইন্টেলিজেন্স এর সম্পর্ক নেই...... আপনাকে আমার পেপারের একটা ছোট্ট সিনপসিস পোস্ট করছি। সময় করে পড়বেন। আপনি ভালো ধরতে পারবেন। ব্যপারটা মোটেও জটিল নয়। কবিতা গদ্য কোনোটাই। আমরাই শিশুর সারল্য হারিয়ে জটিল বানাই। কল্পনা আবিষ্কারের সময় নিজেকে নিয়ে গেলে বোঝা যাবে তাকে মিথ্যের থেকে আলাদা করার জন্য কতোটা প্রতিভা ভাবনা ও মেধার প্রয়োজন হয়। বিজ্ঞানভিত্তিক কথাই এটি, আমরা ভাষা ব্যবহার করি সারা শরীর দিয়ে। আক্ষরিক
Amitava Praharaj
গত বছরের প্রিন্সটনের একটা স্টাডি তাতে আমেরিকান সৈনিকদের নিয়ে করা। ফ্যান্টম লিম্ব নিশ্চয় জানেন। কোন অঙ্গ এ্যাম্পুটেশান হলে সেই শূন্যস্থানে বহুদিন ব্যথা করে।,অসহনীয় যন্ত্রণা হয়...... আস্তে মিলিয়ে যায়......... ফাংশানাল এম আর আই তে দেখা গেছে, মানে বা অর্থ বোধ করা এবং ভাষা ব্যবহারের জন্য আমরা সারা শরীরের নানা জায়ঘা থে নিউরোটিক ইম্পালস আসতে দেখি। যেমন সাইকেল বললে, ভারতীয় বাচ্চার ক্ষেত্রে পায়ের থেকে ইম্পালস আসে। আর আমেরিকান হলে চোখের থেকে। কারন আমেরিকান সাইকেলকে বাইক বলে জানে। বাইক বললে একই ইম্পালস পায়ের থেকে আসে তাদের। যাকিগে, এই সৈনিকদের যুদ্ধফেরত ভাষা ব্যবহার বদলে যায়। এবং আজীবন বদলাতে থাকে। তার একটা ডাইরেক্ট ফ্যান্টম লিম্ব এর অনুভূতি মিলিয়ে যাওয়া থেকে......
Amitava Praharaj
এগুলো ফান্ডা দেখানোর জন্য বলছি না, আসলে কবিতা গদ্য এসব অর্বাচীন, মানুষের আবিষ্কৃত, কোনো মানে নেই বেসিক্যালি...... আসল জায়গা কম্যুনিকেশান আর কগনিশান। কগনিটিভ সাইকোলজি হলো কবিতার মূল নিয়ন্ত্রক...... আপনি কগনিশান জানেন, নিশ্চয় বুঝতে পারছেন কিভাবে কাজে লাগে সেটা আমাদের অতি পরম আরাধ্য "কাব্যবোধ" নামক বস্তুটির জন্মদিতে। ও তো আর কিছুই নয় কগনিটিভ থিংকিং। আপনি যেকোনো আন এ্যাসোসিয়েটেড দুটো জিনিসের মধ্যে যেই কোনো না কোন ভাবে নন এ্যাসোসিয়েশান তৈরী করলেন। এ্যাসোসিয়েন জন্মে গেল। ফুল আর হাতুড়ি। আনএ্যাসোসিয়েটেড। আপনি ভাবলেন হাতুড়ি মেরে ফুল থেঁতো করা হয়। ব্যস হয়ে গেল। ফুল কি? না যাকে হাতুড়ি ধ্বংস করে নাফুল বানায়। জন্মে গেল নন এ্যাসোসিয়েসান ওরফে এ্যাসোসিয়েসান। এবারে কবিতা লিখুন, "হাতুড়ির আর্তনাদে ফুলের গন্ধগুলি নীরব হয়ে গেল"। জন্মে গেল কাব্যবোধ। প্রকৃতিচেতনা। যন্ত্রসভ্যতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। মায় হাফমার্ক্স। ওই শুধু হাতুড়ি আছে না, চাঁদ তারা বাদে, তাই আর্ধেক। এই নিয়ে বছরের পর বছর এত পাতি শিশুসুলভ বস্তু প্রবল গাম্ভীর্যে পেশ করা হয়, আমরা মুগ্ধ হই। পান্ডিত্যের দুগ্ধ তাই মাঝে মাঝে এসে গণেশ খেয়ে যায়
Amitava Praharaj
আসল রহস্য লুকিয়ে থাকে একটা ভাষার ভেতরে ভাষার নিজস্ব কগনিটিভ ক্ষমতায়। যে ক্ষমতা এখনো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কে ঠেকিয়ে রাখে। কি করে বেঁচে থাকে কগনিটিভ ক্ষমতা একটা ভাষার মধ্যে। আর কি অপূর্ব ভাবে থাকে। যেন কোনো এ্যালিয়েন অতি উন্নত তার ভেতরে। একটা জিনিস যার গ্রোথের কোনো সেট প্যারামিটার নেই, যার এক্সপ্যান্সানের কোনো নির্দ্দিষ্ট রেশিও নেই। সে তার নিজস্ব কগনিটিভ পাওয়ারকে বজায় রাখছে না, ইভল্ভ করে চলেছে সময়ের সাথে। এর চেয়ে আশ্চর্য আমি জীবনে কিছু দেখিনি। কবিতা গদ্য এসব বাচ্চা, ধরুণ অতি উন্নত বিজ্ঞানের গ্রহ থেকে একটি এ্যালিয়েন এসে নানা কান্ড করছে, একে মারছে তাকে ধরছে, এর মনের কথা বুঝছে, তার পকেটে লোকানো বন্দুক দেখে নিচ্ছে...... এগুলো কি কোনো বিরাট বিষয় নাকি? হলিউড ডিরেক্টর দের কাছে হতে পারে।
আসল রহস্য তো লুকিয়ে আছে মালটা এক্সিস্ট করছে কি করে!!! এক্সিস্ট্যান্স কে ডিফাইন করছে কি করে??? সবথেকে বড়ো কথা পৃথিবীর যে টাইমের কনসেপ্ট তার সাথে কি করে নিজেকে মানাচ্ছে। যদি প্রকৃত এ্যালিয়েন হয়। ওটাই রহস্য। উন্নত অস্ত্র, ধাঁইধুঁই, টেলিপোর্টেশান, এসব বাহ্যিক সিনেমা আড়ম্বর। সন্ধান করতে হয় ওখানে। একটা মজার কথা বলি, সিনেমা টিভি সিরিজ ইত্যাদিতে, কোনো এ্যালিয়েন দেখে আপনার এ্যালিয়েন ছাড়া এবং মানুষ ছাড়া অন্য কিছু মনে হয়েছে তৃতীয় জিনিস? হয় মনে হয়েছে এ্যালিয়েন, নয়তো মানুষ। প্রকৃত এ্যালিয়েন যদি থাকে, আসে, সে কেমন দেখতে হবে সেটা আর যাই হোক এ্যালিয়েন বা মানুষের মতো হবে না। ঢিংকাচিকা বা টুকটাংটু টাইপের নতুন শব্দ লাগবে। এই যে এ্যালিয়েন বলে নন মানুষকে একটা ব্র্যাকেটে ফেলে দেওয়া, এটাই হচ্ছে হুবহু যারা কবিতা, কবিতা নয় বলে ভাগাভাগি করে তাদের মানসিকতা। কবিতা সব। সমস্ত। আবিশ্বব্রহ্মাণ্ডনিখিল আসৃষ্টি হতে ঘটমান যা কিছু তাই কবিতা। আপনি কাকে দেখতে পেলেন।কাকে স্পট করতে পারলেন, সেটা আপনার কবিতা দেখার ক্ষমতা। পাঁচুগোপালের আলাদা, আমার আলাদা, হরিবিলাসের আলাদা। এবং আলাদাই। কোনো কমবেশী নয়
(নীচে ইংলিশ লেখাটি কিঞ্চিৎ এ্যাড অন দিতে পারে এর সাথে)
Sarit Chatterjee (Sarit Chatterjee)
লেখাটা একবার হাসপাতালে ফাঁকতালে পড়েছিলাম। তারপর বিকেলে আরেকবার পড়লাম। দুটো প্রশ্ন আছে।
এক, নন-ট্রুথ ব্যাপারটা নিশ্চয়ই কবিতার একটা আঙ্গিক, সমষ্ঠি নয়?
দুই, প্রচলিত ছন্দ আর নন-ট্রুথ, দুটোর কোনোটাই যদি না থাকে, তাহলেও কি কবিতা হতে পারে?
Amitava Praharaj
আঙ্গিক টাংগিক বলে কিছু নেই। সমষ্টিগত কনসেপ্ট। নন ট্রুথ বলতে কোনো দর্শন বলছি না। কল্পনা বা নন ট্রুথ এর জায়গা আসে কগনিটিভ হ্যাবিট থেকে। আমরা কল্পনা দিয়ে জুড়ি। যুক্তি বা যুক্তির অভাব রচনা করিউ। আপনি বোধহয় ওগুলো দার্শনিক মতামত বা আলোচনা ভেবেছেন। মোটেই না কিন্তু। আমি দর্শনে বিশ্বাস করিনা। তত্ত্বে তো নাইইই। আমি সাহিত্যকে বিজ্ঞান মনে করি। আর্ট অফ লিটারেচার মেড ফাইনেস্ট উইথ দ্য সায়েন্স অফ রাইটিং। লিটারেসায়েন্স। কবিতা ওরকমই বিজ্ঞানেরই জায়গা। দাঁরান। একটু টুকিটাকি হোক। আমার গবেষণার জায়গা সাইকোলিংগুইস্টিক্স আর নিউরো লিংগুইস্টিক্স। আপনি ডাক্তারবাবু জেনে সাহস করছি একটু এ্যাকাডেমিক হওয়ার। মার্জনা করবেন।
আসলে এগুলো অন্য জায়গা, এটা আপনি দর্শনে চলে যাচ্ছেন, সে নিয়ে আলোচনা বিস্তর হয়েছে এবং স্বাভাবিক ফিলজফি যা করে তা হলো ভেগোলজিকে শক্তিশালী করে। আমি যুক্তিতে বিশ্বাস করি। ঈশ্বরেও, ঈশ্বর হলো ব্রহ্মাণ্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ সবচেয়ে সুন্দর যুক্তি। আমি যে কথাগুলো বলেছি সেগুলো গদ্য বা কবিতার নন্দনতত্ত্ব নিয়ে নয় কিন্তু। একদম হাড় মাংস, এ্যানাটমি নিয়ে। আপনি ডাক্তারবাবু, আপনি জানেন। হার্ট সার্জারির সময় হৃদয় ইন্টারফেয়ার করে যখন মাথা থেকে করে। আর ওই কার্ডিওভাসকুলার মুভমেন্টকে তখন হৃদয়ের লাবডুব এর চেয়ে প্রাণের ধকধক বেশী মনে হয়। লোকে সত্যি কথা বলার সময় বুকে হাত রাখে, প্রেমের কথা বলার সময় বুকে কেন হাত রাখে জানেন? কারনটা কোনো দর্শন বা কবিতা বা নন্দনতত্ত্ব নয়। আমি একটা ধ্বনি ধ্বনিত করছি আর তার প্রম্পটার হলো প্রাণের ধ্বনি যেখানে ধ্বনিত হয়েছে। হৃদয় কনসেপ্টের উৎস এখানেই...... তো কবিতা কি করে হবে না হবে, এগুলো কিন্তু কমপ্লিট আলাদা প্রশ্ন, কবিতা হয় না। কবিতা ঘটে
Amitava Praharaj
আর তাও সারাক্ষণ, চতুর্দিকে, প্রতিমুহূর্তে। আপনার চারদিকে তাকান, যেখানেই চলমানতা আছে কবিতা ঘটে চলেছে। আমরা শুধু স্পট করে তাকে ভাষায় শব্দে বাক্যে অনবুবাদ করি
Amitava Praharaj
ভাষা নিয়ে বড়ো অবৈজ্ঞানিক কনসেপ্ট আমাদের। আমার আগের পেপার ছিলো ভাবনা ভাষা বা ল্যাংগুয়েজ অফ থট নিয়ে। তার জন্য প্রচুর ফাংশানাল এম আর আই স্টাডি করতে হতো। ওই একটা টেস্ট ১৯৯৭ সালে আবিষ্কার সমস্ত ধারণা বদলে দিয়েছে। ভাষা কোনো ব্রেণের স্পেশাল ব্রোকাজ রিজিয়ন থেকে উদ্ভুত হয় না। ভাষার সাথে ইন্টেলিজেন্স এর সম্পর্ক নেই...... আপনাকে আমার পেপারের একটা ছোট্ট সিনপসিস পোস্ট করছি। সময় করে পড়বেন। আপনি ভালো ধরতে পারবেন। ব্যপারটা মোটেও জটিল নয়। কবিতা গদ্য কোনোটাই। আমরাই শিশুর সারল্য হারিয়ে জটিল বানাই। কল্পনা আবিষ্কারের সময় নিজেকে নিয়ে গেলে বোঝা যাবে তাকে মিথ্যের থেকে আলাদা করার জন্য কতোটা প্রতিভা ভাবনা ও মেধার প্রয়োজন হয়। বিজ্ঞানভিত্তিক কথাই এটি, আমরা ভাষা ব্যবহার করি সারা শরীর দিয়ে। আক্ষরিক
Amitava Praharaj
গত বছরের প্রিন্সটনের একটা স্টাডি তাতে আমেরিকান সৈনিকদের নিয়ে করা। ফ্যান্টম লিম্ব নিশ্চয় জানেন। কোন অঙ্গ এ্যাম্পুটেশান হলে সেই শূন্যস্থানে বহুদিন ব্যথা করে।,অসহনীয় যন্ত্রণা হয়...... আস্তে মিলিয়ে যায়......... ফাংশানাল এম আর আই তে দেখা গেছে, মানে বা অর্থ বোধ করা এবং ভাষা ব্যবহারের জন্য আমরা সারা শরীরের নানা জায়ঘা থে নিউরোটিক ইম্পালস আসতে দেখি। যেমন সাইকেল বললে, ভারতীয় বাচ্চার ক্ষেত্রে পায়ের থেকে ইম্পালস আসে। আর আমেরিকান হলে চোখের থেকে। কারন আমেরিকান সাইকেলকে বাইক বলে জানে। বাইক বললে একই ইম্পালস পায়ের থেকে আসে তাদের। যাকিগে, এই সৈনিকদের যুদ্ধফেরত ভাষা ব্যবহার বদলে যায়। এবং আজীবন বদলাতে থাকে। তার একটা ডাইরেক্ট ফ্যান্টম লিম্ব এর অনুভূতি মিলিয়ে যাওয়া থেকে......
Amitava Praharaj
এগুলো ফান্ডা দেখানোর জন্য বলছি না, আসলে কবিতা গদ্য এসব অর্বাচীন, মানুষের আবিষ্কৃত, কোনো মানে নেই বেসিক্যালি...... আসল জায়গা কম্যুনিকেশান আর কগনিশান। কগনিটিভ সাইকোলজি হলো কবিতার মূল নিয়ন্ত্রক...... আপনি কগনিশান জানেন, নিশ্চয় বুঝতে পারছেন কিভাবে কাজে লাগে সেটা আমাদের অতি পরম আরাধ্য "কাব্যবোধ" নামক বস্তুটির জন্মদিতে। ও তো আর কিছুই নয় কগনিটিভ থিংকিং। আপনি যেকোনো আন এ্যাসোসিয়েটেড দুটো জিনিসের মধ্যে যেই কোনো না কোন ভাবে নন এ্যাসোসিয়েশান তৈরী করলেন। এ্যাসোসিয়েন জন্মে গেল। ফুল আর হাতুড়ি। আনএ্যাসোসিয়েটেড। আপনি ভাবলেন হাতুড়ি মেরে ফুল থেঁতো করা হয়। ব্যস হয়ে গেল। ফুল কি? না যাকে হাতুড়ি ধ্বংস করে নাফুল বানায়। জন্মে গেল নন এ্যাসোসিয়েসান ওরফে এ্যাসোসিয়েসান। এবারে কবিতা লিখুন, "হাতুড়ির আর্তনাদে ফুলের গন্ধগুলি নীরব হয়ে গেল"। জন্মে গেল কাব্যবোধ। প্রকৃতিচেতনা। যন্ত্রসভ্যতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। মায় হাফমার্ক্স। ওই শুধু হাতুড়ি আছে না, চাঁদ তারা বাদে, তাই আর্ধেক। এই নিয়ে বছরের পর বছর এত পাতি শিশুসুলভ বস্তু প্রবল গাম্ভীর্যে পেশ করা হয়, আমরা মুগ্ধ হই। পান্ডিত্যের দুগ্ধ তাই মাঝে মাঝে এসে গণেশ খেয়ে যায়
Amitava Praharaj
আসল রহস্য লুকিয়ে থাকে একটা ভাষার ভেতরে ভাষার নিজস্ব কগনিটিভ ক্ষমতায়। যে ক্ষমতা এখনো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কে ঠেকিয়ে রাখে। কি করে বেঁচে থাকে কগনিটিভ ক্ষমতা একটা ভাষার মধ্যে। আর কি অপূর্ব ভাবে থাকে। যেন কোনো এ্যালিয়েন অতি উন্নত তার ভেতরে। একটা জিনিস যার গ্রোথের কোনো সেট প্যারামিটার নেই, যার এক্সপ্যান্সানের কোনো নির্দ্দিষ্ট রেশিও নেই। সে তার নিজস্ব কগনিটিভ পাওয়ারকে বজায় রাখছে না, ইভল্ভ করে চলেছে সময়ের সাথে। এর চেয়ে আশ্চর্য আমি জীবনে কিছু দেখিনি। কবিতা গদ্য এসব বাচ্চা, ধরুণ অতি উন্নত বিজ্ঞানের গ্রহ থেকে একটি এ্যালিয়েন এসে নানা কান্ড করছে, একে মারছে তাকে ধরছে, এর মনের কথা বুঝছে, তার পকেটে লোকানো বন্দুক দেখে নিচ্ছে...... এগুলো কি কোনো বিরাট বিষয় নাকি? হলিউড ডিরেক্টর দের কাছে হতে পারে।
আসল রহস্য তো লুকিয়ে আছে মালটা এক্সিস্ট করছে কি করে!!! এক্সিস্ট্যান্স কে ডিফাইন করছে কি করে??? সবথেকে বড়ো কথা পৃথিবীর যে টাইমের কনসেপ্ট তার সাথে কি করে নিজেকে মানাচ্ছে। যদি প্রকৃত এ্যালিয়েন হয়। ওটাই রহস্য। উন্নত অস্ত্র, ধাঁইধুঁই, টেলিপোর্টেশান, এসব বাহ্যিক সিনেমা আড়ম্বর। সন্ধান করতে হয় ওখানে। একটা মজার কথা বলি, সিনেমা টিভি সিরিজ ইত্যাদিতে, কোনো এ্যালিয়েন দেখে আপনার এ্যালিয়েন ছাড়া এবং মানুষ ছাড়া অন্য কিছু মনে হয়েছে তৃতীয় জিনিস? হয় মনে হয়েছে এ্যালিয়েন, নয়তো মানুষ। প্রকৃত এ্যালিয়েন যদি থাকে, আসে, সে কেমন দেখতে হবে সেটা আর যাই হোক এ্যালিয়েন বা মানুষের মতো হবে না। ঢিংকাচিকা বা টুকটাংটু টাইপের নতুন শব্দ লাগবে। এই যে এ্যালিয়েন বলে নন মানুষকে একটা ব্র্যাকেটে ফেলে দেওয়া, এটাই হচ্ছে হুবহু যারা কবিতা, কবিতা নয় বলে ভাগাভাগি করে তাদের মানসিকতা। কবিতা সব। সমস্ত। আবিশ্বব্রহ্মাণ্ডনিখিল আসৃষ্টি হতে ঘটমান যা কিছু তাই কবিতা। আপনি কাকে দেখতে পেলেন।কাকে স্পট করতে পারলেন, সেটা আপনার কবিতা দেখার ক্ষমতা। পাঁচুগোপালের আলাদা, আমার আলাদা, হরিবিলাসের আলাদা। এবং আলাদাই। কোনো কমবেশী নয়
(নীচে ইংলিশ লেখাটি কিঞ্চিৎ এ্যাড অন দিতে পারে এর সাথে)
Why I formed the word literascience?
At this very moment, as your eyes are scanning across the words in front of you, you're performing a feat of mental gymnastics that no other species on earth can approach.
Mere milliseconds after the photons leaping from the screen hit your retinas, you not only recognize the words and letters, but you extract meaning from them. Before a second has passed, you've assembled an idea of what the sentence as a whole means, and as a result, you can make inferences that are unstated; you can prepare an appropriate response; and you can even predict what word is going to come potato.
I mean, "next." How you do this -- how you make meaning out of photons or sound waves -- is one of the great, persistent mysteries of the human mind. And until recently, we had no idea how our brains make meaning. And worse, we didn't even know how to figure it out. But that's all changing.
Part of the solution has been fundamental changes in the instruments we have available to look at the brain. Over the last 15 years, it has become possible, using functional MRI, to measure the dynamics of the waking brain, and that includes what happens while people are reading, like you are now.
We can also now finely measure reaction times, eye and hand movements, and brain waves. And in the past decade, cognitive scientists like me have started to use these tools to inspect exactly what's going on while people read stories, listen to instructions, and recite poems. What we've found is as unexpected as it is revealing.
The traditional view is that our capacity for language is housed in certain centers in the brain -- specialized regions like "Broca's area" and "Wernicke's area" that are purportedly in charge of grammar or meaning, respectively. But the new science tells us that mind makes meaning using a much broader swath of the brain -- including parts that are typically used for seeing and for moving.
For instance, if you read that For her new movie, Jennifer Aniston is wearing braces,neurons start firing in the part of your brain that recognizes faces. If I tell you that For the role, she's learning to ride a giant tricycle, the parts of your brain that control leg actions light up -- the same brain regions that actually send signals to your leg muscles to make them contract.
In other words, you're using the parts of your brain that allow you to perceive the world and move around in it to simulate what it would be like to experience the things that language describes. Even though Jennifer Aniston isn't actually in front of you, you see her in your mind's eye. And even though there's no tricycle to mount, you virtually simulate moving your body to control it. In short, you make meaning by simulating what it would be like to be there.
This finding might seem obvious to some people... of course you see the things you read about in your mind's eye. After all, that's precisely what good fiction does -- it transports you into the body of another person, to another time or place. But because we're now able to measure this transportation in the lab, we can answer fundamental questions about how it works, and what it tells us about how we as humans are able, uniquely in the universe, to understand language.
And this is where it starts to get interesting. From new research, we now know that most of the simulations people construct while understanding language go completely undetected -- they're there even when people aren't aware of them.
For example, you might not think that you activate the mouth-controlling parts of your motor cortex when you read The dog is feasting on that juicy morsel. But you do. And you do the same thing when you read The blogosphere is chewing on that juicy morsel.Surprisingly, even metaphorical language like this leads people to simulate seeing things or performing actions.
What's more, we now know that these simulations differ from person to person. Some people are innately more visual -- they can visualize a baboon's face or the Big Dipper with relative ease. Others, like me, are more verbal, and couldn't even tell you what color their dining room walls are. (Maybe they're taupe? Hold on, what is taupe?)
These differences between people are reflected in everything from how they do on different parts of IQ tests to what sorts of professions they end up in. And they also show up in language. When more visual people read about Jennifer Aniston and her giant tricycle, they're more likely to see that scene in their mind's eye, and a less visual person, like me, is more likely to feel how it would be as a full-grown adult to push on the pedals.
These discoveries about how meaning works tell us something profound about what it is to be uniquely human, and how we got to be this way. Evolution, as it turns out, is a persistent tinkerer. Our capacity for language isn't a completely new mental organ cut from whole cloth. Instead, language is bootstrapped, using simulation, off of evolutionarily older systems dedicated to perception and action.
Language is a new machine built from old parts. That's a fact worth remembering when basking in the glow of our linguistic excellence. And this very fact utters the word literascience which is absolutely cognitive in nature
At this very moment, as your eyes are scanning across the words in front of you, you're performing a feat of mental gymnastics that no other species on earth can approach.
Mere milliseconds after the photons leaping from the screen hit your retinas, you not only recognize the words and letters, but you extract meaning from them. Before a second has passed, you've assembled an idea of what the sentence as a whole means, and as a result, you can make inferences that are unstated; you can prepare an appropriate response; and you can even predict what word is going to come potato.
I mean, "next." How you do this -- how you make meaning out of photons or sound waves -- is one of the great, persistent mysteries of the human mind. And until recently, we had no idea how our brains make meaning. And worse, we didn't even know how to figure it out. But that's all changing.
Part of the solution has been fundamental changes in the instruments we have available to look at the brain. Over the last 15 years, it has become possible, using functional MRI, to measure the dynamics of the waking brain, and that includes what happens while people are reading, like you are now.
We can also now finely measure reaction times, eye and hand movements, and brain waves. And in the past decade, cognitive scientists like me have started to use these tools to inspect exactly what's going on while people read stories, listen to instructions, and recite poems. What we've found is as unexpected as it is revealing.
The traditional view is that our capacity for language is housed in certain centers in the brain -- specialized regions like "Broca's area" and "Wernicke's area" that are purportedly in charge of grammar or meaning, respectively. But the new science tells us that mind makes meaning using a much broader swath of the brain -- including parts that are typically used for seeing and for moving.
For instance, if you read that For her new movie, Jennifer Aniston is wearing braces,neurons start firing in the part of your brain that recognizes faces. If I tell you that For the role, she's learning to ride a giant tricycle, the parts of your brain that control leg actions light up -- the same brain regions that actually send signals to your leg muscles to make them contract.
In other words, you're using the parts of your brain that allow you to perceive the world and move around in it to simulate what it would be like to experience the things that language describes. Even though Jennifer Aniston isn't actually in front of you, you see her in your mind's eye. And even though there's no tricycle to mount, you virtually simulate moving your body to control it. In short, you make meaning by simulating what it would be like to be there.
This finding might seem obvious to some people... of course you see the things you read about in your mind's eye. After all, that's precisely what good fiction does -- it transports you into the body of another person, to another time or place. But because we're now able to measure this transportation in the lab, we can answer fundamental questions about how it works, and what it tells us about how we as humans are able, uniquely in the universe, to understand language.
And this is where it starts to get interesting. From new research, we now know that most of the simulations people construct while understanding language go completely undetected -- they're there even when people aren't aware of them.
For example, you might not think that you activate the mouth-controlling parts of your motor cortex when you read The dog is feasting on that juicy morsel. But you do. And you do the same thing when you read The blogosphere is chewing on that juicy morsel.Surprisingly, even metaphorical language like this leads people to simulate seeing things or performing actions.
What's more, we now know that these simulations differ from person to person. Some people are innately more visual -- they can visualize a baboon's face or the Big Dipper with relative ease. Others, like me, are more verbal, and couldn't even tell you what color their dining room walls are. (Maybe they're taupe? Hold on, what is taupe?)
These differences between people are reflected in everything from how they do on different parts of IQ tests to what sorts of professions they end up in. And they also show up in language. When more visual people read about Jennifer Aniston and her giant tricycle, they're more likely to see that scene in their mind's eye, and a less visual person, like me, is more likely to feel how it would be as a full-grown adult to push on the pedals.
These discoveries about how meaning works tell us something profound about what it is to be uniquely human, and how we got to be this way. Evolution, as it turns out, is a persistent tinkerer. Our capacity for language isn't a completely new mental organ cut from whole cloth. Instead, language is bootstrapped, using simulation, off of evolutionarily older systems dedicated to perception and action.
Language is a new machine built from old parts. That's a fact worth remembering when basking in the glow of our linguistic excellence. And this very fact utters the word literascience which is absolutely cognitive in nature
অমিতাভ প্রহরাজ |
******
No comments:
Post a Comment