এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

করণ দেবরায়


কবিতা : সাধারণ বিভাগ


রূপান্তর

গদ্যে, ছন্দ খুঁজে পাওয়া মুশকিল ! জানি ৷ তবে চেষ্টা করতে ক্ষতি নেই ৷ চেষ্টা ছাড়া গতি নেই ! আসলে মুশকিল'টা আমরাই তৈরি করেছি, রূপান্তরকে এখনও আমরা ভয় পাই ৷ গদ্যে অমিল, আর পদ্যে মিল খুঁজতে যাই ৷

গল্প আর কবিতার মধ্যে কি আদৌ কোনো লাইন টানা সম্ভব ? জানি না ৷ তবে ভাগাভাগি তো অনেক হল, আজ মিলন হোক না ৷ জল, স্থল, আকাশ, মন— সবই তো কাঁটাতাড়ে ঘেরা, আমার দোয়াত-কলম—কাগজ-খাতা, একসাথেই থাক না !

আজ আমার গল্প, কবিতা আর আমার কবিতা, গল্প হোক না !


গল্প


পয়লার পেয়ালা

- আর এক পেয়ালা হোক !

- না না, আর না !

- আরে নাও তো, কি আর আছে ! নাও নাও !

- আর না ৷ এবার বেরোই নাহলে দেরি হয়ে যাবে !

- আরে কিস্সু দেরি হবে না ! আর ওদিকে সবাই এমনিও দেরি করে ৷

- না না, দেরি করলে চলবে না !

- নিজের জন্মদিনের পার্টি থেকে, নিজেই সবার আগে কেটে পরছ ?

- না গিয়ে উপায় নেই "নিউ ইয়ার" ! চলি, আবার তোমার জন্মদিনে দেখা হবে ৷ টেক কেয়ার, হা হা !

পার্টি থেকে বাইরে বেরিয়ে ...

পয়লা - "সব ফন্দি বুঝি বাবা ! আমায় পরের পর পেয়ালা খাইয়ে দেরি করিয়ে দেবে, আর তারপর পাংচুয়ালিটির লম্বা স্পিচ ঝাড়বে ! কিন্তুু এইবছর আর তা হতে দিচ্ছি না ৷ এখন বাঙালিরাও পাংচুয়াল হয়ে গেছে ৷"



সন্তুর বারান্দা

সন্তুুর কথা :

আমার ফ্ল্যাটের বারান্দাটা দক্ষিন দিকে, কিন্তুু আমার সেখানে দাঁড়ানো হয় না ৷ না ! না ! সমস্যাটা বারান্দার নয়, আমার ৷ গত দেড় বছর ধরে আমি এক অদ্ভুত সমস্যার সম্মুখিন হয়েছি ৷ উঁচু ফ্ল্যাটের ছাদে বা বারান্দায় আমি দাঁড়াতে পারি না, কেন জানি না, আমার খালি মনে হয়, কেউ যেন আমায় ডাকছে ! নিচে থেকে ৷ সেই ডাকের শব্দ নেই, রুপ নেই, গন্ধ,বর্ণ,আকার কিচ্ছু নেই, তবে ডাক'টা আছে ৷ আর সেই ডাক আমায় পাগল করে দেয় ! আমি ধীর পায়ে বারান্দার রেলিং-এর দিকে এগিয়ে যাই, আর তারপর রেলিং'টা কাছে আসতেই খুব কষ্টে এক ঝটকায় নিজেকে টেনে নিয়ে পিছনে চলে আসি, আর তারপর এক ছুটে "ঘর" ৷

আগে আমি অফিসে সাত তলায় বসতাম, এখন অনেক বলে-কয়ে একতলায় বসার ব্যবস্থা করেছি ৷ অফিসের মধ্যে একটা ছোট্ট বাগান ছিল, এখন সেটা অযত্নে ঝোপঝাড়ে পরিনত হয়েছে ৷ ওই বাগান'টাকে ঘিরেই অফিসটা তৈরি হয়েছিল, তখন অনেক ঝকঝকে ছিল অফিসটা, এখন তো ম্যদা মেরে গেছে ৷ মাস ছয়েক আগে একদিন লাঞ্চ ব্রেকের সময় আমি অফিসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ অতিস'দা এসে আমার কাঁধে হাত রাখল ৷

- "কি রে সন্তুু, তোর কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি ?"

- "না তো ! মানে ?"

- "প্রায় পনের মিনিট ধরে তোকে দেখছি ৷ তখন থেকে একদৃষ্টে ওই মরা নিমগাছটার দিকে চেয়ে আছিস, চোখের পলক পরেছে কিনা সন্দেহ ! একবার করে এই নিচের বিটে পা তুলছিস, আর নামিয়ে নিচ্ছিস ৷ কি দেখছিস ওইভাবে ?"

এরপরের কথাগুলো আর লিখলাম না, সেদিন আমি অতিসদা'কে যেসব কথা বুঝিয়ে ছিলাম, কোনো সুস্থ মস্তিকের লোক তা বিশ্বাস করবে না ! অতিসদা আর কোনোদিন আমার সাথে কথা বলেনি ৷ অার আমিও এড়িয়ে যেতাম ৷

কি ভুল যে করেছিলাম, টপ ফ্লোরে ফ্ল্যাট কিনে সেটা এখন বুঝছি ৷ ছাদের গরম নামে সেটা ঠিক আছে, কিন্তুু এদিকে যে আমার ওপরে ওঠার পরিক্রম হয়েছে ৷ "সংসার" বলে আমার কিছু নেই, একাই থাকি, একা থাকতেই ভালোবাসি ৷ বারান্দার দরজাটা কাঁচের স্লাইডিং ডোর, তার সামনে একটা চেয়ার রেখেছি আড়াআড়ি ভাবে ৷ তিনদিন আগে লাস্ট গেছিলাম বারান্দায়, আর যাওয়া হয়নি ৷ আসলে যাওয়ার সাহস হয়নি ৷ আমার বারান্দা থেকে সামনেটা বেশ ফাঁকা, অনেকদূর অবধি দেখা যায় ৷ কম্পাউন্ড ওয়ালের বাইরেই একটা ডোবা অাছে, সেটা পেরোলে একটা ছোট্ট খেলার মাঠ আর তারপর আবার সারি-সারি বিল্ডিং হাঁ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ৷

রাতে বিছানায় যেতে বেশ দেরি হল আজ, ঝড় উঠেছে, সব জানলাগুলো ভালো করে বন্ধ করে তারপর এসে শুলাম ৷ একটু তদ্রা এসেছে কিনা সন্দেহ, খট্-খট্ অাওয়াজে বিরক্ত হয়ে উঠলাম ৷ বলতে লজ্জা নেই, আজকাল তেমন সাহস পাইনা, প্রতি নিয়ত এক ভয়ের আমেজ আমার চারপাশে দানা বাঁধতে থাকে ৷ উঠে বেডরুমের দরজা অবধি গেছি সবে, স্পষ্ট বুঝলাম আওয়াজ'টা বারান্দার কাঁচের দরজায় হচ্ছে ৷ ব্যাস ওখানেই আমার হয়ে গেল ! যেটুকু সাহস মুঠো ভরে এনেছিলাম, তাও জলের মতো চুয়িঁয়ে পরে গেল ৷ জলের ঝাপটায় কাঁচটা পুরো সাদা হয়ে গেছে, তবু খট্-খট্ অাওয়াজ হয়েই চলেছে ৷ একবার মনে হল ছাতা'টা নিয়ে আসি, হয় অস্ত্র না হয় ঢালের কাজে লাগবে ! দরজাটার একটা সাইড স্লাইড করতেই খুলে গেল ৷ দেখি বারান্দায় টাঙানো দড়ি'টা ছিঁড়ে গেছে একদিক থেকে, আর তাতে আটকানো জামা সুকোতে দেওয়ার, কাঠের ক্লিপ, হাওয়াতে দড়ি ওড়ার সাথে এসে দরজায় খট্-খট্ আওয়াজ করছে ৷ হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম যেন ৷ হঠাৎ নিচের দিকে চোখ গেল, আর কানে সেই মৃদু ডাক শুনলাম, কখন যে রেলিংয়ের এত কাছে এসে গেছি সেটা খেয়ালও করিনি, দড়িটা হাতে পাকিয়ে নিয়ে বারান্দা দিয়ে ঝুঁকে নিচে তাকালাম ৷ দেখি কিনা অতিসদা দাঁড়িয়ে আছে নিচে ৷ কোনো রেনকোট নেই, ছাতা নেই, মুসলধারে বৃষ্টির মধ্যে ভিজে যাচ্ছে, দৃষ্টি সোজা আমার বারান্দার দিকে, এক অদ্ভুত হাসি অতিসদার মুখে, আকাশের বিদ্যুতের সাথে আমার সর্বাঙ্গেও এক শিহরন খেলে গেল ...

অতিসের কথা :

- বসুন ৷

- হ্যাঁ ৷

- আপনার নাম টা ?

- অতিস সেন ৷

- ওহ আচ্ছা ! সন্তুু মিত্রের কেসটা তো ?

- হ্যাঁ ৷

- অনেক কথা অাছে আপনার সাথে ৷

- হ্যাঁ বলুন ৷

- আপনি কি জানতেন ব্যপারটা হবে ?

- হ্যাঁ, মানে আন্দাজ করেছিলাম ৷

- কোন ব্যপার থেকে এটা মনে হয়েছিল আপনার ?

- অফিসে বসার জায়গা সাত তলা থেকে একতলায় সিফ্ট করে নিয়েছিল, কারুর সাথেই তেমন কথা বলত না ৷ আর একটা ব্যপার ?

- কি ব্যপার ?

- একদিন অফিসের বারান্দায় দেখেছিলাম ওকে ! বারবার পা রাখার বিটে, পা দিয়ে উঠে দাঁড়াছিল, আবার নেমে পড়ছিল ৷ আমি জিজ্ঞেস করাতে কি সব ভুলভাল বকল, ওই আমার সাথে ওর শেষ কথা ৷

- ওটাই শেষ কথা ?

- হ্যাঁ ৷

- দেখুন পুলিশ স্টেশনে মিথ্যে বললে কিন্তুু খুব মুশকিলে পড়বেন ৷

- না না মিথ্যে কেন বলব !

- ২৯ শে এপ্রিল, রাত ১১টা, সন্তুু মিত্রের ল্যান্ডলাইন নম্বরে একটা কল এসেছিল, দেখুন তো নম্বরটা চেনেন কিনা ?

- এটা তো আমারই নম্বর !

- ওনার মৃত্যুর মাত্র কয়েক ঘন্টা অাগে, আপনি ওনাকে কল করেছেন, অার এইমাত্র আপনি বললেন যে আপনি শেষবার ওনার সাথে অফিসে কথা বলেছেন ৷

- আমি ভাবলাম আপনি সামনা-সামনি হওয়া কথার ব্যপারে বলছেন !

- আপনি প্লিজ এত ভাববেন না ৷ যেটুকু জানতে চাইছি তাই বলুন ৷

- আচ্ছা ৷

- কি কথা হয়েছিল সেদিন রাতে ?

- কথা তো হয়নি ?

- কথা হয়নি মানে ?

- ও, মানে সন্তুু ফোন রিসিভই করেনি ৷ ফোন বেজে বেজে কেটে গেছে ৷

- ওনার মোবাইলে ফোন না করে, ল্যান্ডলাইনে ফোন করার কি কারন ?

- মোবাইল সুইচড্ অফ্ আসছিল, তাই ঘরের নম্বরে করেছিলাম ৷

- তাহলে সেদিন রাতে আপনাদের মধ্যে কোনো কথাই হয়নি ?

- না হয়নি ৷

- ফোন করার কারনটা একটু বলুন ৷ রাত ১১টায়, দরকার না পড়লে তো কেউ ফোন করে না ?

- অফিসের একটা কাজের জন্য ৷

- তা, উনি তো চলে গেলেন আপনার ফোন না ধরেই ! কাজটা মিটেছে ?

- হ্যাঁ মিটেছে ৷

- গুড ৷ তা আপনার কি মনে হয় সন্তুু মিত্রের মৃত্যুটা, স্বাভাবিক না এর পেছনে কোনো রহস্য আছে ?

- দেখুন সন্তুু বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে মারা গেছে ৷ এতে রহস্য ...

- এক মিনিট ৷ এক মিনিট ৷ আপনাকে কে বলল সন্তুু মিত্র বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে মারা গেছে ?

- বারান্দা নয় ! তবে কি ছাদ থেকে ?

- সন্তুু মিত্র অাত্মহত্যা করেছে বটে ৷ তবে লাফ দিয়ে নয়, গলায় দড়ি দিয়ে ৷

- কি বলছেন আপনি ?

- ওনার বারান্দার জামা-কাপড় শুকতে দেওয়ার নাইলনের দড়ি দিয়ে, বেডরুমের ফ্যানের থেকে ঝুলে গেছেন উনি ৷

- যাহ্ সালা !

- শেষ পর্যন্ত উনি উচ্চতার ভয় কাটিয়ে ফেলেন ৷ তবে সন্তুুবাবু ঠিক মাঝামাঝি ঝুলে রইলেন, ওনার পা দুটো মেঝেতে ঠেকেনি ৷
করণ দেবরায়

*****

No comments:

Post a Comment