এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

ধীমান পাল


চিত্রাঙ্কন


গল্প : ছোটগল্প



ফসিল
(ধীমানের গল্পগুচ্ছ)

আবার বৃষ্টি নামবে আজ। আকাশটা গোমড়া মুখো হয়ে আছে গতকাল থেকেই। রুপাইকে স্কুল বাসে তুলে দিয়ে এসে শমিতা আবার শুয়ে পরে বিছানায়। শরীরটা আর চলছেনা। গত তিন দিন ধরে যে ভাবে টানা লড়াই করে চলেছে, শরীর আজ তাঁর শোধ তুলছে বোধহয়। একটু চোখটা লেগে এসেছিল, এমন সময় কলিং বেলের কর্কশ আওয়াজ। অনেকবার ভেবেছে এটাকে পালটানোর কথা, কিন্তু হয়ে ওঠেনি। ধর্‌ফরিয়ে বিছানা ছেড়ে ওঠে শমিতা। ড্রয়িং রুমের দিকে যেতে যেতে আবারও বেজে ওঠে বেলটা।

গ্রিলের ওপাড়ে দাঁড়িয়ে আছে সিদ্ধার্থ, গেটটা খুলে সিদ্ধার্থকে ঘরে ঢুকতে দেয় শমিতা। চোখে মুখে রাতজাগার স্পষ্ট চিহ্ন। ছেলেটা গত তিন দিন ধরে এক নাগাড়ে হসপিটালে কাটিয়েছে। ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে শমিতা চলে যায় রান্নঘরে, চা এর জল বসাতে। ড্রইং রুমের লাগোয়া এল টাইপ রান্নঘর থেকে লক্ষ্য করে শমিতা, সিদ্ধার্থ মাথাটা সোফার ব্যাক রেস্টে এলিয়ে চুপ করে তাকিয়ে আছে পাখার দিকে।

চায়ের ট্রে আর বিস্কুটের কৌটো নিশ্চুপে সেন্টার টেবিলের উপর রেখে শমিতা এসে বসে দেওয়ালের লাগোয়া বসার কৌচে। সোফার সাথে লাগানো মাথাটাকে একই রকম রেখে সিদ্ধার্থ বলে –

- মামি, আর কতক্ষণ বাকি!

- এখনও আট ঘণ্টা প্রায়। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দেয় শমিতা ।

- তুমি কি যাবে এখন, আমার সাথে ?

- হম্‌, আমি রেডি হচ্ছি, তুই স্নানটা সেরে নে তাড়াতাড়ি। বাসন্তি ভাত বসিয়ে দিয়েছে, দুটো খেয়ে নে চট করে ।     



৭২ ঘণ্টাটা আর কাটল না। কুশল হাসতে হাসতে, হাত নাড়তে নাড়তে আই সি সি ইউ থেকেই চলে গেলো। খবর পেয়ে একে একে সবাই এসেছিল। কুশলের অফিসের কলিগরা, আত্মীয় স্বজন, সবাই। তারপর মহাসমারোহে ফুলে সাজানো খাটে ধুপ জ্বলিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেলো চুল্লির ভিতর। নাহঃ চোখের জল ফেলেনি শমিতা, এক বারের জন্যও না। গত ৭২ ঘণ্টা যে যুদ্ধটা করেছে শমিতা একা, কুশল তাঁর এক বিন্দুও করেনি। কাউকে কিছু কৈফয়েত না দিয়ে পরোয়ানা জারি না করেই চলে গেলো সে। নাহঃ এক বারের জন্যও কাঁদেনি শমিতা।



দুই –

কেটে গেছে আরও ৭২ ঘণ্টা । পারিবারিক নানাবিধ স্তোত বাক্য, সন্তাপ, করুনার কথা মুখ বুজে শুনে গেছে। কাউকে কিছু বলবার নেই, কাউকে নেই কোন অভিযোগ জানাবার। রুপাই কেঁদে চলছে তার বাবার জন্য মাঝে মাঝে, ক্ষণে ক্ষণে। শুকনো জলের দাগ গালে মেখে ঘুমিয়ে পড়েছে রুপাই। রাত দশটার কাছাকাছি সময়। শোবার ঘরের আলমারিটা খোলে শমিতা। তাদের বিয়েতে ছোট মামার দেওয়া উপহার, গড্রেজ স্টোরওয়েল। আলমারির নিচের দুটো তাক কুশলের। থাকে থাকে সাজানো জামাকাপড়, পাঞ্জাবি পাজাম, জিন্স, টি শার্ট ; শমিতা একটা একটা করে নামাতে থাকে সব। একেবারে নিচের তাকে একটু আড়াল করে রাখা চারটে কভার ফাইল। একটা ফাইলে কুশলের সমস্ত সার্টিফিকেট, মাধ্যমিক থেকে শুরু করে ইঙ্গিনিয়ারিং পর্যন্ত, অরিজিনাল ও জেরক্স কপি। বিভিন্ন সময়ের তোলা কুশলের নানা রকম পাসপোর্ট ফটোগ্রাফ। কলেজের ও লাইব্রেরির আই ডি কার্ড। কয়েকটা গ্রুপ ফটো, কলেজের বন্ধুদের সাথে তোলা, মোহন বাগান ও ইস্ট বেঙ্গলের ১৯৯৫ সালের অর্ধেক ছেঁড়া একটা খেলার টিকিট। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকে শমিতা। একাডেমিক মার্কস লাইন কি অসম্ভব ভালো ছিল কুশলের। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে শমিতা। দ্বিতীয় ফাইলটা অফিসের। এপয়েন্মেন্ট লেটার, দীর্ঘ দশ বছরে চাকরিজীবনের নানান উন্নতির সমস্ত নথিপত্র। তৃতীয় ফাইলটা এল আই সি ও ব্যাংকের সম্মস্ত দস্তাবেজ। ফাইল দুটো আলাদা করে সরিয়ে রাখে শমিতা। কুশলহীন তাঁর পরবর্তী জীবনের আর্থিক সহায়তার সোপান।      

শেষ ফাইলটা খোলে শমিতা। বেশ কিছু রঙিন চিঠি লেখার কাগজ, কয়েকটা রঙিন লিফাফা আর শমিতার লেখা কুশলকে সমস্ত চিঠি। যত্ন সহকারে একটা একটা করে গোছানো। সাকুল্যে ১৮ টা চিঠি। তাদের নানা সময়ের নানা ঘটনার সাক্ষী। চিঠিগুলো পড়ে না শমিতা। হাত বুলিয়ে রেখে দেয় শুধু। ফাইলের একদম নিচে রাখা একটা সাদা খাম, কুশলের অফিসের ঠিকানা লেখা, ব্লু ডার্ট কুরিয়ারের ষ্ট্যাম্প মারা, এক মাস আগের ডেটের, কেপ টাউনের। খামটা হাতে তুলে নেয় শমিতা। একটা নীল মিনি স্কার্‌ট আর সাদা টি শার্ট পরা মেয়ের ছবি। হাতে ব্যাডমিন্টনের র‍্যাকেট নিয়ে এলোমেলো চুলে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। উজ্জ্বল নীন দুটি চোখ, আর ততোধিক উজ্জ্বল গায়ের রঙ। অবাক হয়ে যায় শমিতা । ছবিটার সাথে স্টেপেল করা একটা চিঠি । স্পষ্ট গোটা গোটা বাংলায় লেখা কয়েকটা লাইন –

কুশল – তুমি তো আর খোঁজ নিলেনা আমি কেমন আছি। তোমার ঘরের ঠিকানায় পাঠাতে বারণ করেছ, তাই তোমার অফিসের ঠিকানায় পাঠালাম চিঠিটা। আমি আর বেশীদিন থাকবো না কুশল। ভীষণ জ্বর হয় আজকাল। জানো, ডাক্তার বলেছে লাস্ট স্টেজ। তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। আসবে একবার আমার কাছে! তুমি যদি না আসো, আমি তোমাকে আমার কাছে টেনে নিয়ে আসবো – তুমি তো জানোই আমি কিরকম জেদি ।   

তোমার নীলা ।


চিঠিটা হাতে নিয়ে লাফ দিয়ে ওঠে শমিতা। কি মনে করে জানি চেস্ট ড্রয়ার থেকে বার করে অন করে কুশলের ফোনটা। সোজা চলে যায় ম্যাসেজ বক্স-এ। লাস্ট মেসেজ রিসিপ্ট – একটা আন্‌ নোন নাম্বার থেকে।

“নীলা ইজ্‌ নো মোর – টেক কেয়ার – জন”। মেসেজ ডেটটা দেখে আঁতকে ওঠে শমিতা, ছদিন আগের পাঠানো এস এম এস। যেদিন সন্ধ্যে বেলা কুশলের হার্ট এটাক হয়।

পাগলের মতন ক্রমাগত নাম্বারটায় ডায়াল করতে থাকে শমিতা – কিন্তু অপর দিক থেকে শুধু মাত্র একটাই যান্ত্রিক উত্তর –

“ দা নাম্বার ইউ হ্যাভ ড্যায়াল্‌ড, ইজ সুইস্ট অফ রাইট নাউ ; প্লিস কল আফটার সাম টাইমস্‌ ”

ধীমান পাল
পেশায় চিত্র শিল্পী ও সাংবাদিক। ছেলেবেলা থেকেই ক্যানভাস রঙ তুলির সাথে বই আর কলমের যৌথ খামার। মূল্যবান সময়গুলকে কলম বন্দী, আর প্রিয় দৃশ্যগুলকে ক্যানভাস বন্দী করে রাখাতেই আনন্দ। প্রথম প্রকাশিত বই ‘আবার কথোপোকথন’ ২০১৩ তে, কোলকাতা বইমেলায়। বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে বিশেষ গবেষণা। প্রবন্ধ লিখতেই মূলত কলমের চলাচল। পাশাপাশি কবিতা, গল্প, রম্য ও উপন্যাসের ভাণ্ডার। রাজনৈতিক কলমে সংবাদপত্রের নানান পাতায় অসংখ্য লেখা। পুণ্ডরীকাক্ষ পুরকায়স্ত নামে বিশেষ পরিচিত রাজনৈতিক ও সামাজিক কলম ও রম্য রচনা। উপন্যাসের পাতায় নাম – পরীক্ষিৎ।

******


No comments:

Post a Comment