এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

সুদীপা কুন্ডু


গল্প : ছোটগল্প



উত্তরাধিকার

উফ!রবিবার সকালেও এলার্ম ঘড়ি বাজছে কেন?সপ্তাহে একটা দিন আরাম করব তারও উপায় নেই?পাশ ফিরে পাশবালিশ জাপটে ধরে শুলাম।রমা বিছানায় নেই।আক্কেল দেখ!সকাল সকাল উঠেই যখন পড়েছে তখন এলার্মটা বন্ধ করে যেতে পারল না!সকালের ঘুমটাই মাটি করলে।চোখ বন্ধ করে আরেকবার নিদ্রা দেবীর চরণতলে নিজেকে সঁপে দিতে যাব এমন সময় পাশের ঘরে বোমা পড়ল-
-"অ্যাঁ!আবার করে ফেলেছেন?আবার?সকালে বাসী মুখ ধুয়ে চাও খাইনি এককাপ,এখন আবার গু পরিষ্কার করতে হবে!পেয়েছিল তো উঠে পায়খানা অবধি যেতে পারেন নি?আওয়াজও তো দিতে পারতেন আমাকে।কে দিনরাত আপনার নোংরা ঘাটবে?বলি,আর কত জ্বালাবেন?"
সেরেছে!মা মনে হয় আবার কাপড়েচোপরে করে দিয়েছে।তাই রমা চিৎকার করছে।অবশ্য ওকেও দোষ দেওয়া যায় না।গত আটমাস ধরে ক্যানসারের রুগীকে সামলাতে সামলাতে আমিও হতোদ্যম।রমা একাই মায়ের দিনরাতের আয়ার কাজটা করে।একা হাতে রান্না,বাড়ির কাজ,রুগী সব সামলায়।না হলে আমার মত ছাপোষা কেরানির আয় কতটুকু যে এই রাজরোগের চিকিৎসা দিনের পর দিন চালাব।আয়া রাখবার মত বিলাসিতা আমাদের পোষায় না।অবশ্য  মায়ের রোগের যা অবস্থা কোন আয়া টিকবে কিনা সন্দেহ।মায়ের হয়েছে হাড়ের ক্যানসার।হাঁটুর ওই বিশাল ঘা পরিষ্কার করা যেমন তেমন কাজ নয়।ঘা তো নয় যেন এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি,সদা সর্বদা পেট থেকে পুঁজ রক্তের লাভা উদ্গীরণ করে চলেছে।এখন রোগ এমন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মার ঘরে সারাদিন ধুপকাঠি জ্বালিয়ে রাখতে হয়,নয়তো ওষুধ ফিনাইল আর পচে যাওয়া ঘায়ের গন্ধে ঘরে ঢোকা যায় না।
-"উঃ উঃ ...উঃ....."
যেন একটানা ঝিঁঝিঁর আওয়াজ।বুঝতে পারছি মা কাঁদছে।এককালের সুন্দরী,বর্তমানে বিছানার সাথে প্রায় মিশে যাওয়া ছোটখাট চেহারার আমার মা বড় বড় শিরা ওঠা,শতভাঁজযুক্ত চামড়া দিয়ে ঢাকা কঙ্কালসার হাতদুটো দিয়ে বিছানার চাদর খামচে একটানা কেঁদে চলে।কখনো বা ভাষাহীন চোখ মেলে নিশ্চুপে মৃত্যুর স্বপ্ন দেখে।মার কান্নার সাথে মাঝে মাঝে রমার রাগত কণ্ঠস্বরও ভেসে আসছে।উঠে পড়লাম।আজ শান্তি নেই কপালে।এখন সারাদিন ঘুরেফিরে রমার চোপা শুনতে হবে।গতকাল থেকেই ওর মেজাজ বিগড়ে আছে।কালই ওর মাসিক শুরু হয়েছে।বড় আশায় ছিল বেচারি!এবারে অন্তত আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় কিছু ফল হবে।কিন্তু এবারেও হল না।প্রতিমাসে গর্ভধারণে ব্যর্থকাম হওয়ার জের রমাকে কয়েকটা দিনের জন্য পাগল করে দেয়।মা পাশের ঘরে ওর এই হিংস্র আচরণ সহ্য করে আর এই ঘরে আমি।কাল রাতেও রমা আমাকে আঁচড়ে কামড়ে ফালাফালা করেছে আর হিসসিসে গলায় আমার মায়ের মৃত্যু কামনা করেছে।বলেছে,
-"মরেও না বুড়ি!আমার হাড় জ্বালিয়ে খাবে।প্রতি মাসে আমার পেটেরটাকে গিলবে।ওই ডাইনিইতো আমাদের বাচ্চা আসার পথটাকে আগলে রেখেছে।খাবে!আমাদের সব্বাইকে খেয়ে তবে ওর খিদে মিটবে।"
প্রথম প্রথম বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করতাম।এখন আর ধৈর্য্য কুলায় না,চড়চাপড় মেরে বসি।দিন আসে,দিন যায়।প্রতি মাসের গল্প এক।
-"এই শুনছ।বাজারে যাও।আজ একটু ইলিশ মাছ এনো না!ভাপা ইলিশ খেতে ইচ্ছে করছে।"
-"টাকা নেই।এখন মনোজবাবুর কাছে যাচ্ছি।ওনার মাধ্যমে যদি এম এল এ সাহেবকে ধরতে পারি তো কোন এনজিও থেকে মার এমাসের ওষুধটা জোগাড় করা যায়।ফেরার পথে দুশো মুরগির মাংস কিনে আনবখন।"
-"ওই কর!সারাজীবন লোকের পায়ে তেল দিয়ে বেড়াও গে যাও।"
-"হ্যাঁ, তাই করব।পা ধরা ছাড়া আজকের যুগে গরিবের জন্য আর কোন উপায়টা বাকি আছে শুনি?"
          বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম।নোনাধরা স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়ালের ঘেরাটোপ থেকে বেরোতেই সকালের সোনাঝরা রোদ ঝাপিয়ে পড়ে আমাকে স্বাগত জানাল।আমাদের বাড়ির সাথে  রোদের সম্পর্ক তো কবেই চুকেবুকে গেছে।বাড়িটা বাবার তৈরি করা।ভিতরটা যাও বা শেষ করতে পেরেছিল,বাইরে পলেস্তারা পড়েনি একেবারেই।আমিও বাড়িটা মেরামত করে উঠতে পারিনি।এখন দুপাশে টুবলু আর নিলয়দের বাড়ি দোতলা হয়ে যাওয়ার পর আমাদের বাড়িটা লজ্জায় গুটিয়ে যেন আরো সঙ্কুচিত হয়ে গেছে।চারিদিকের বৈভব আর প্রাচুর্যের মধ্যে বাড়িটা নিজের অসম্পূর্ণতার জ্বালা বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে যেন স্তব্ধ,মূক এক অস্তিত্ব।
-"রমা,বাজার নিয়ে যাও।আর আমার জন্য এক কাপ কড়া চা নিয়ে এসো তো।"
চায়ের হুকুম করে সিগারেট ধরিয়ে চেয়ারে আয়েশ করে বসলাম।ডান পায়ের ডিমে খিঁচ ধরেছে।টানা দুঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়েও এমএলএ সাহেবের দেখা পেলাম না।জানি না,এমাসে মায়ের ওষুধের দাম বাবদ টাকার জোগাড় কিভাবে হবে!
                                        ২
রোববার দুপুর।খাওয়া শেষে বিছানায় আধশোয়া হয়ে খবরের কাগজ পড়ছি।মোটা হরফের খবর বা হরেক কিসিমের বিজ্ঞাপন আমাকে টানে না।চার নম্বর পাতার ডানদিকের কোণে ছোট ছোট বাক্সে লটারি খেলার বিজয়ী নম্বরগুলোর দিকেই আমার মূল আকর্ষণ।লটারি টিকিট কাটা ও নম্বর মেলান আমার বড় নেশা।ভবিষ্যতের সোনালী স্বপ্ন প্রতিনিয়ত বুনে চলা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় বিনোদন।প্রতিবার টিকিট কাটি আর আশায় আশায় থাকি,এবার যদি কপাল খোলে আমার!
-"হ্যাঁগো শুনছ?"
রমা হাতখোঁপা ঠিক করতে করতে আমার পাশে এসে বসল।
-"ওবাড়ির মাসিমা এসেছিলেন।"
আমি খবরের কাগজ ভাঁজ করতে করতে জিজ্ঞাসা করি,
"কোন মাসিমা?"
-"আরে নিলয়ের মা গো।"
রমা এবার আমার পাশে শুয়ে পড়ল।এটা ওর একটু গড়িয়ে নেওয়ার সময়।মস্ত একটা হাই তুলে বলল,
-"নিলয়ের বউ পোয়াতি।মাসিমা পুজো দিতে গেছিলেন কালিমন্দিরে।ফেরার পথে প্রসাদ দিয়ে গেলেন।"
-"আর সাথে কি দিয়ে গেলেন?কবিরাজ না তান্ত্রিক!কার ঠিকানা?"
-"আজ্ঞে না মশাই।নিলয় ওর বউকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে  রীতিমত ডাক্তার দেখিয়েছে ছমাস ধরে।হ্যাঁ গো-"
রমা আমার বুকের কাছে ঘনিয়ে এল,
-"আমরাও চল না ওই ডাক্তারের কাছে একবারটি যাই।"
আমার গলার কাছে আলগোছে রাখা রমার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে সস্নেহে বললাম,
-"টাকা কোথায় পাগলী?সবই তো জান।মায়ের চিকিৎসার যা খরচ!"
মুহূর্ত মধ্যে হাত সরিয়ে নিল রমা।একটু আগের স্বাভাবিক দাম্পত্য ঘনিষ্ঠতার ওম এক মুহূর্তে জমে বরফ।
পাশ ফিরে শুলাম।এই একটা ব্যাপারেই রমা বড্ড অবুঝ।অবশ্য ওকেই বা দোষ দেব কি করে!সন্তানের জন্য আকুল আকাঙ্খা আমার মধ্যেও তো সমান কার্যকর।আমিও চাই নিজের সক্ষম পৌরুষের উত্তরাধিকার পৃথিবীতে রেখে যেতে!কিন্তু রক্তের ঋণ শোধ না করে যাই কোথায়?নিজের সর্বস্ব পণ করেও আমাকে এই ঋণ শোধ করতে হবে,এটাই ভবিতব্য।

উফ!ছটা কুড়ির লোকালটা আজ মিস করেছি।পৌনে সাতটার লোকালে কোনক্রমে নিজেকে গুঁজে দিতে পেরেছিলাম।বনগাঁ লাইনের লোকাল ট্রেনে যারা কোনোদিন চড়েনি তারা লোকাল ট্রেনের ভিড় জিনিসটা কি মারাত্মক বস্তু কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবে না।এর মধ্যে আবার ফোন বাজছে!পাশের জনের কোমরে কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে,পেয়ারাওয়ালার ঝুড়ির ধাক্কা বাঁচিয়ে নানা কসরত করে ফোনটা কানে লাগলাম।সস্তার চাইনিজ মাল।তবে সাউন্ড খুব বেশি।না হল চতুর্দিকের হট্টগোলের মধ্যে  রিংটোনের আওয়াজ কান অবধি পৌঁছাত না।
-"হ্যালো।কে বলছেন?" অচেনা নম্বর।
-"আজ্ঞে দাদা।আমি কিশোর।এটা আমার নতুন নাম্বার।"
কিশোরের গলার স্বরে চাপা উত্তেজনা ঠিকরে বেরোলো।হঠাৎ আমার গলা শুকিয়ে গেল।মনে হচ্ছিল একটু জল হলে ভালো হয়।ঠোঁটটা জিভ দিয়ে একবার চেটে নিয়ে ঢোঁক গিলে বললাম,
"হঠাৎ ফোন করছ,কোনো খবর আছে নাকি ভাই?"
-"হ্যাঁ, দাদা।টিকিটটা উঠেছে।এইমাত্র খবর পেলাম।কাল খবরের কাগজে রেসাল্ট বেরোবে।মিলিয়ে নেবেন।"
খানিকক্ষণ নিজের মধ্যে কোনো সাড়া পেলাম না।অতিরিক্ত উত্তেজনা যেন বোধশক্তিকে অবশ করে দিয়েছে।তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে জিজ্ঞাসা করতে গেলাম।গলা দিয়ে বহুকষ্টে একটা ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজ বেরোলো,"কত টাকা ভাই?"
-"দশ লাখ।"
ছোট্ট দুটো শব্দ।এই শব্দ দুটো মাথার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল বহুক্ষণ ধরে।চারপাশের আর সব আওয়াজ যেন ভোজবাজির মত মিলিয়ে গেল।"দাদা সরুন","আঃ!এরা যে কেন গেটের মুখে দাঁড়িয়ে থাকে!","নামতেও দেবে না দেখছি" জাতীয় কোনো শব্দই আর আমাকে স্পর্শ করল না।আমার দুনিয়ার রংটাই পাল্টে গেছে।সবুজ আর গোলাপি নোটের স্বপ্নে হেসে উঠেছে আমার দুনিয়া।
স্টেশনে নেমে যন্ত্রচালিতের মত সাইকেল গ্যারেজ থেকে সাইকেল বার করছি তখনো কানে কিশোরের বলা কথাগুলোই বাজছে।
অন্যদিন নিত্যর দোকানে বসে এককাপ চা খেয়ে দশ মিনিট নির্ভেজাল আড্ডা মেরে তারপর বাড়ির পথে রওয়ানা হই।আজ আর ইচ্ছে করল না।বলা যায় না,যদি আনন্দের আতিশয্যে মুখ ফস্কে কিছু বলে ফেলি!কিশোরের নির্দেশ মনে পড়ল।কাল কাগজে নম্বর মিলিয়ে না দেখা অবধি ও কাউকে কিছু বলতে নিষেধ করেছে।তার মানে আজ সারা রাত পূর্ণগর্ভা আসন্নপ্রসবা নারীর মত খবরটাকে নিজের মধ্যেই আত্মস্থ করে ধরে রাখতে হবে।
বাড়ি ঢুকে হাতপা ধুতে বাথরুমে ঢুকলাম।টাইম কলে জল আসে,চৌবাচ্চায় ধরে রাখা হয়।মগে জল নিয়ে পায়ে ঢালতে ঢালতে ভাবলাম এবার একটা পাম্প মেশিন বসাব।বাথরুমে টাইলস বসবে,শাওয়ার বসবে।অফিস ফেরত ক্লান্ত শরীরে শাওয়ারের তলায় দাঁড়ালে লক্ষ লক্ষ বৃষ্টি কণার মত আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে জলের ধারা।সারাদিনের ক্লেদাক্ত পরিশ্রম সব ধুয়ে নিয়ে যাবে।বাড়িটার অল্পবিস্তর মেরামতিও এইবেলা করিয়ে নেব।সিঁড়িঘরের টিনটা দুজায়গায়  ফুটো হয়ে গেছে,পাল্টে ফেলতে হবে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে মায়ের ঘরে এসে বসলাম।প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে মায়ের কাছে এসে একটু বসি।মা ঘুমোচ্ছে।রমা চা দিয়ে গেল।বলল আজ সারাদিন নাকি মায়ের চোখ দিয়ে নিঃশব্দে জল পড়েছে।ক্যানসার!ছোট্ট শব্দ কিন্তু একজন সতেজ সবল মানুষের অস্তিত্বকে কুরে কুরে খেতে এই রোগের জুড়ি নেই।রোগ ধরা পড়ার পর টাকা জোগাড় করে মায়ের চিকিৎসা শুরু করতেই লেগে গিয়েছিল মাস তিনেক।ফলে রোগ অনেকটা ছড়িয়ে পড়ে।রেডিওথেরাপির কোর্স সবে শেষ হয়েছে,ডাক্তার কেমোথেরাপি শুরু করেছেন।দুটো হয়েছে কোনক্রমে।আরো ছটা বাকি।টাকার জোগাড় করতে করতে আমার নাভিশ্বাস উঠে গেছে।এবার হয়তো টাকার সুরাহা হল।বুকের মধ্যে নানা ইচ্ছে রঙিন প্রজাপতির মতো ওড়াউড়ি করছে।একটা দীর্ঘশ্বাস অজ্ঞাতসারেই বেরিয়ে এল আমার মুখ দিয়ে।কখন যে সকাল হবে।অপেক্ষার অবসান ঘটবে!

রবিবার বাদে সপ্তাহের বাকিদিনগুলোতে বাড়িতে খবরের কাগজ আসে না।অফিসে কাগজ পড়ে নিই।ফলে মাসে অন্তত খবরের কাগজের খরচটা বেঁচে যায়।কিন্তু আজ আর খরচ বাঁচাব না।সাইকেল নিয়ে সকালে স্টেশনের দিকে রওয়ানা হলাম।পকেটে লটারির টিকিট।পথে জাতীয় সড়কটা পড়ে।সেটা পার করে বাবুপাড়া ঢুকতেই মন্টুর মুখোমুখি।মন্টু খবরের কাগজের হকারি করে।ওর কাছ থেকেই বাংলা খবরের কাগজটা কিনে নিলাম।তারপর বকুলগাছতলায় সাইকেল স্ট্যান্ড করে পকেট থেকে লটারির টিকিটটা বার করলাম।

তিন তিনটে সিগারেট পুড়ে গেল।হাত কাঁপছে।বুকের বাঁদিকটায় বেসামাল অবস্থা।এতটা উত্তেজনা ভালো নয়।নিজেকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে অতিকষ্টে শান্ত করলাম।দশ লাখ টাকা কম নাকি?এবার টাকার জন্য মায়ের চিকিৎসা আটকাবে না।রমাকেও কলকাতা নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখাব।আমাদের সন্তানহীনতার দুঃখ ঘুচে যাবে।বাড়িটা প্লাস্টার করব।উফ!আনন্দে চোখে জল আসছে।আবার পরমুহূর্তেই হো হো করে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হেসে উঠতে ইচ্ছে করছে।নিজেকে আর সামলাতে পারছি না।কখন বাড়ি পৌঁছব তার তর সইছে না।রমা তো খবরটা শুনে আনন্দে পাগল হয়ে যাবে।আর মা!মা কি আদৌ কিছু বুঝবে!নাকি সন্তানের মুখের হাসিটুকুই মাকে শেষবারের মত সুখী করবে!সে যাকগে!বাড়ি যাওয়ার পথে একবার বরং বাজারটা ঘুরে যাই।সাইকেলের প্যাডেল ঘোরালাম।একটু ইলিশ মাছ কিনে নিয়ে যাব আজ।সেদিন রমা ভাপা ইলিশ খেতে চেয়েছিল-

ছোট্ট শহরের বুক চিরে যাওয়া জাতীয় সড়কপথে নিমেষে ভিড় জমে গেল।বাজারের দোকানগুলো তখন সবে একে একে ঝাঁপ খুলছে।সবাই ছুটে এল।প্রচুর মানুষ,অনেক কৌতূহলী দৃষ্টি।কারোর দৃষ্টি আতঙ্কে বিস্ফারিত,কারোর চোখে সহানুভূতি টলটল করছে।কিছু মানুষ আসামী লরিটাকে পুড়িয়ে দিতে হাত লাগিয়েছে,কেউ    মানুষটাকে চিনতে পেরে বাড়িতে খবর দিতে ছুটছে।শুধু রাস্তার মাঝখানে পড়ে থাকা লরির চাকায় পিষে যাওয়া মৃতদেহটা আশ্চর্যরকম শান্ত।পাশে ছিটকে পড়ে থাকা সাইকেলটার পিছনের চাকা ভরবেগের নিয়মে তখনো ঘুরে চলেছে।পেটের দলা পাকিয়ে যাওয়া মাংসপিন্ড থেকে রক্তের ঢল নেমেছে।সেই রক্ত স্রোতে পাঞ্জাবির পকেটে রাখা লটারির টিকিটটা একটু একটু করে ভিজছে।সাত অংকের সংখ্যার ছটা শূণ্য এক এক করে মুছে যাচ্ছে,মিলিয়ে যাচ্ছে,তলিয়ে যাচ্ছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অন্ধকার গহ্বরে।মৃতদেহের হাতে তখনো খবরের কাগজটা ধরে রাখা।চোখ খোলা,সে চোখে তখনো এক আত্মপ্রসাদী স্বপ্নীল দৃষ্টি সজীবতা হারায়নি।শুধু তাজা রক্তের গন্ধে ছুটে আসা মাছিগুলো মৃতদেহের উপর ভনভন করে উড়ছে।আশাপূরণের সোনালী বর্তমান হঠাৎ অতীত হয়ে ভবিষ্যতের গর্ভে রেখে যাচ্ছে দুঃখ,হতাশা আর বেদনাময় সাদাকালো জীবনের গড়পড়তা উত্তরাধিকার।।
                            সমাপ্ত
সুদীপা কুন্ডু

পেশা-শিক্ষকতা
ঠিকানা-সুদীপা কুন্ডু
প্ৰজত্নে-অসিত কুমার কুন্ডু
২২৬,শ্রীনাথপুর রোড,কোর্ট পাড়া
পোস্ট অফিস-রানাঘাট
জেলা-নদীয়া,রাজ্য-পশ্চিম বঙ্গ
পিন-৭৪১২০১

*****


No comments:

Post a Comment