এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

আফজল আলি


প্রবন্ধ (ধারাবাহিক)



কবিতার ল্যাব এবং রূপান্তর কবিতা :

কবিতার সাথে অনুভব মিশে থাকে খুব স্বাভাবিক নিয়মে কারণ শব্দ হল অনুভবের বা কিছু নির্দিষ্টকরণের দ্যোতক। যে কোনো শব্দের বা শব্দ সমূহের সাথে সাথে কিছু কিছু ভাব উঠে আসে ,  উঠে আসে ছবি  ,  অনুভব যা মস্তিষ্ক হয়ে হৃদয়ে ক্রিয়া করে । আমরা দেখতে পাই বা বুঝতে পারি সেই ধুন। তাই কবিতার সাথে অনুভূতি বোধ এ সব কাজ করে,   চলে আসে । অনুভব বোধকে বাদ দিয়ে কবিতা নিছক ই একটি ছিবড়ে হওয়া উচ্ছিষ্ট ।

কেন আজ পর্যন্ত কবিতার কোনো ল্যাবরেটরি তৈরি হয়নি। আমাদের পূর্বের কবিকুল  কি অত্যন্ত মূর্খ ছিলেন  ?  বিষয়টা কিন্তু তা নয় । ল্যাবরেটরি হল একটি instrumental পর্যায় যা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে বা ফলাফলে আসার মধ্যবর্তী অবস্থান বা পরীক্ষাকেন্দ্র । মানুষের  চেতন বা ব্যবহারিক আধারে এই মধ্যবর্তী পর্যায়কে সাধারণত প্রয়োগ করা হয় না । তা হয় চৃড়ান্ত অবস্থান গৃহীত হবার পর এবং মানব কল্যাণে । যদিও তা ধ্বংসাত্বক কাজে ব্যবহৃত হয়েছে । কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী পর্যায় নেই  ;  মধ্যবর্তী পর্যায়টি চলে কবির বা স্রষ্টার মানসশরীরে । কিন্তু কবিতা বা শিল্প যখন লিখিত আকার পায় এবং প্রকাশ পায় তখন তা চূড়ান্ত । তাই কবিতার বা সাহিত্যের ল্যাব যদি  থেকেই থাকে তা হল কবির হৃদয়,  চিন্তা এবং চেতনায় । শিল্পে মধ্যবর্তী পর্যায়ে নেই অর্থাত্ আমার বলার উদ্দেশ্য কোনো কবিতা বা গল্প যখন প্রকাশ পায় তা চৃড়ান্ত অবস্থাতেই থাকে কবি বা শিল্পীর নিরিখে ।

তরুণ কবিরা চিরকালই বিভিন্নভাবে লিখেছেন বা লিখবেন । কিন্তু তাই বলে তো কবিতা একইরকম বয়ে যায়নি। কবিতা বদল হয়েছে । কবিতা বদল হয়েছে কবির নিজস্ব মানসিকতা,   ইচ্ছা অভিপ্রায় অভিজ্ঞতা মনোনিবেশ,   পূর্বের রেখে যাওয়া সৃষ্টি তথা দলিল এবং কবির প্রতিভা  -  এ সবের উপর ভিত্তি করে ।  কোনো ল্যাবরেটরিতে সার্বিক ভাবে বা দশ বিশ জন কবির কারিগরিতে নয় । হ্যাঁ এ কথাটা সঠিক যে কোনো পত্রিকা বা গোষ্ঠীকে দেখতে পাই কবিতাকে একটু অন্য রকম ভাবে বা অন্য রকম structure বা শব্দ ব্যবহারে প্রকাশ করতে ;  তারজন্য তরুণ কবিরা লেখেন সেই ভাবে   এটা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য এবং আশাব্যঞ্জক কারণ এর মধ্য দিয়েই কবিতা নতুন রূপ এবং ভাব পরিগ্রহ করে  ,  আসে ভিন্ন স্বাদ এবং স্বতন্ত্রতা ,  কিছুটা একঘেয়েমিতার থেকে মুক্তি ও পাওয়া যায় । তবে এই প্রচেষ্টাকে বা পত্রিকা বা গোষ্ঠীকে কোনো মতেই ল্যাবরেটরি বা পরীক্ষাগার বলা যাবে না বা এই ধরনের কবিতাগুলোকে experimental poetry বলা সঙ্গত নয় । যদি বলতেই হয় তা অন্য substitute নামে ডাকা যেতে পারে । কারণ experiment হয় কোনো কিছুর সত্যতা বা মান যাচাই করার জন্য । নতুন কোনো ওষুধ বা কোনো বিজ্ঞানের প্রচেষ্টা সঠিক কিনা তা যাচাই করার জন্য experiment করা হয় । এবং সেই experiment এর লব্ধ বিষয় ই হল experimental.   কবিতার ক্ষেত্রে ঠিক এভাবে কিছু যাচাই করা হয় না । কারণ কবিতার ব্যবহারিক প্রয়োগ বাচিকশিল্পের ক্ষেত্রে বা তার নাট্যরূপে বা চিত্র রূপে প্রকাশ হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে তাদের সুনির্দিষ্ট নাম থাকে । কিন্তু একটি কবিতা কতখানি সত্য বা মিথ্যা বা বাস্তব প্রয়োগ হবে কিনা তা তো কখনওই যাচাই করা হয় না কোনো ল্যাবে বা নতুন কোনো product তৈরির মতো হয় না ল্যাবে বা নির্ণায়ক কোনো কিছুর দ্বারা ।  Laboratory এবং experiment   একটি বিজ্ঞানজাত  নাম বা technical  ব্যাপার । বিজ্ঞানের উক্ত term গুলো সাহিত্যের ক্ষেত্রে সরাসরি প্রয়োগ করা ঠিক যুক্তিযুক্ত নয় কারণ  সাহিত্যের বা কবিতার  (  বিশেষ করে )  পরীক্ষা নিরীক্ষাগুলো ঠিক যাচাই পর্যায়ের নয় । যা হয় তা হল রূপান্তরমূলক । কারণ কবিতা সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন রূপে পরিবর্তিও হয় বা হয়ে আসছে এবং আগামী দিনেও হবে । কবিতা তার ভিতরের দশা ,  structure,  বিন্যাস,  discourse পরিবর্তন করে এবং এই পরিবর্তন হয় কবির দ্বারা । কবিতায় পরীক্ষা নিরীক্ষা হয় কবিতার পরিবর্তনের জন্য,   নতুন কিছু উদ্ভাবনের জন্য  -  নতুন শব্দ বিন্যাস ,  শব্দ চয়ন ,  শব্দ ব্যবহার এবং শব্দ ব্যবহারের কাঠামোগতও হতে পারে ।
প্রায় 70-80 বছর আগে experimental poetry র নামে এরকম কবিতা লেখা হতো যেখানে কবিতার সাধারণ pattern এর বাইরে শব্দ সাজিয়ে বিভিন্ন রূপ দেওয়া হতো -  কখনও বৃত্তের আকারে,   কখনও জিজ্ঞাসা চিহ্নের আকারে,   কখনও পাখির অবয়বে বা অন্যান্য । এই ধরনের কবিতা মূল ধারায় অন্তর্ভুক্তি না হলেও ,  কবিতা হিসেবে কিছু কেমন স্বীকৃতি পেয়েছে এ বিষয়ে সন্দেহ নাই । কিন্তু এ গুলো আসলে এক ধরনের রূপান্তর । কবিতার রূপান্তর । এদেরকে experimental poetry নাম দেওয়া হলেও আসলে তা experimental  নয় । এগুলো রূপান্তর কবিতা । কবিতারই বিভিন্ন form  যেমন  সময়ের বিবর্তনে কবিতা পাল্টে গিয়েছে এবং বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন নামে । কিন্তু কোথাও কোনো ভাবে কবিতাকে যাচাই করা হয়নি । কারণ কবিতা যাচাইয়ের জন্য সৃষ্টি হয় না । কবিতা প্রাকৃতিক সৃষ্টির মতো  সৃষ্টি হয়েই থাকে । তার গুণাগুণ যাচাই করার জন্য কোনো experiment  বা laboratory  নেই বা প্রয়োজন হয় না । পাঠক বা মানুষ ইচ্ছে হলে গ্রহণ করবে ,  না ভালো লাগলে গ্রহণ করবে না ;  কিন্তু এক্কেবারে বাতিল কোনো দিন হবে না যা experiment এর ক্ষেত্রে হতে পারে । ভালো বা সঠিক হলে গ্রহণযোগ্য, না হলে বাতিল । কবিতা হল শিল্প -  শিল্পের বাতিল বাতিল হয় না । গ্রহণযোগ্যতার তারতম্য হতে পারে । তাই কবিতার ক্ষেত্রে experimental poetry র পরিবর্তে রূপান্তর কবিতা নাম দেওয়াই শ্রেয় এবং সঠিক । ইংরেজিতে TRANSFORMATION POETRY নাম দেওয়া যেতে পারে । কবিতা এক রকম থেকে অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে । এবং এই রূপান্তর কবিতা যেখানে কবিতার চরিত্র বৈশিষ্ট্য গুণাগুণ এবং গঠন বেশ লক্ষণীয় ভাবে পরিবর্তন হতে হবে তবেই এই নাম প্রযোজ্য । না হলে মূলস্রোতের আশপাশের সমস্ত কবিতাকে এই শ্রেণীতে না আনাই শ্রেয় । চিন্তার সঠিক নিরূপণ না হওয়ার বা স্পষ্টতা না থাকার জন্য এদের experimental poetry  বলে ভুল দিকে চালিত করা হয়েছে বা ভুল নাম দেওয়া হয়েছে  । তা সংশোধন করা প্রয়োজন ।

তরুণ কবিরা চিরকালই নতুন চিন্তা নতুন সৃষ্টি করে এসেছেন এবং এটাই স্বাভাবিক । যে কবিতাগুলো এক্কেবারেই আলাদা তার বিন্যাসে গঠনে তাদের রূপান্তর নামটাই সুপ্রযোজ্য এবং poetic ও linguistics corner থেকে  দেখলে সঠিক । এই ধরনের কবিতাগুলোকে experimental কবিতা বলে পাঠকের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে । এটি যে হচ্ছে তা কিছুতেই উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে নয় ;  নিছকই সঠিক নির্ণয়ের বা জানকারির অভাবে । তাই বিষয়টি নতুন করে ভাববার সময় এসেছে । পুরাতন চলে আসা কোনো  ধারণা বা বিষয় ,  ঠিক সেভাবেই বর্তমান সময়ে তুলে আনার মানে তা repeat করা,   নতুনত্ব খোঁজা নয় । তাই পুরাতন সেই কাজগুলোকে নতুন এবং সঠিক  নামে নথিভুক্ত করার মধ্য দিয়ে কবিদের নতুন করে উত্সাহ উদ্দীপনা থাকবে এবং তার প্রয়োগও সঠিক হবে ,  নিয়ে আসবে নতুন দিশা।

জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্ট সব সময় নতুনত্বের খোঁজ এবং আহ্বান করে ।  post modern এর উত্তর সময়টিতে দাঁড়িয়ে এই concept এর মধ্যে নিহিত আছে নতুন নতুন উন্মেষের পথ । কনসেপ্টের মধ্যেই ছিল কবিতার রূপান্তরকামিতার ধারণা । সেটারই পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করা হল । তরুণ কবিরা নতুন উদ্যমে লিখতে পারবেন কবিতা এবং নতুন পথের সন্ধান আসবে সঠিক নিরূপণের ভিত্তিতে ।

সঠিক জিনিসের ভূল নামকরণ বা সংজ্ঞায়িত হলে তার যেমন দ্রব্যদোষ দেখা দেয় ,  তেমনই তার মধ্যে জমে থাকা সুস্বাদ মানুষ গ্রহণ বা নিতে পারবে না । ফলে তা সংশোধন দরকার । তাই ভুল নামে চলতে থাকা কবিতার একটি সুন্দর দিককে পরীক্ষা নিরীক্ষা বা experiment এর নাম দিয়ে তার নান্দনিক এবং সজীবতা নির্ণয় করা হয়নি । উল্টে পাঠক সন্দেহ করতে আরম্ভ করেছে -  আদৌ এগুলো কবিতা কিনা ।

কোনো কবিই আসলে পরীক্ষা নিরীক্ষা বা experiment করেন না তাঁর কবিতায় ;  কবি যা করেন তা হল নতুন সৃষ্টি ,  তাঁর পূর্বসূরিদের থেকে আলাদা করার চেষ্টা করেন ,  কবিতার নতুন নতুন রূপ দেন । তাঁর নতুন সৃষ্টি কেন পরীক্ষা নিরীক্ষা বা experiment হবে । প্রতিক্ষেত্রেই তিনি নতুন সৃষ্টি করেছেন এবং কবিতা যখন এক রূপ থেকে অন্য রূপে যাচ্ছে তখন পৃথক হচ্ছে পথ । কবিতার কোনো গন্তব্য নাই । কবিতা একটি জার্নি যা শেষ হয় না । কবির পুরস্কার বা স্বীকৃতি কবিতার গন্তব্য নয় । কবিতার গন্তব্য কবিতা,   আরো কবিতা,   উত্তীর্ণ কবিতা  ,  রূপান্তর কবিতা । কবির এই পথটি তার চিহ্ন নিয়ে বেঁচে থাকে । এটিই কবিতা । এখানে কোনো experiment নাই ।    Experimental বলে চলে আসা ধারণাটি আসলে কবিতার রূপান্তর ।

কেন experiment নয় :    কবিতা লেখার সঙ্গে যুক্ত থাকে অনুভব কল্পনা দেখা পর্যবক্ষেণ মেধা এবং এ সবের সমন্বয়ে এবং সমন্বয়ের ঊর্ধ্বে অন্য এক প্রকার রসায়ন । এই সমস্ত মিলিয়েই তৈরি বা প্রকাশ হয় কবিতা । অনুভব দেখা এবং কল্পনা এদের পরীক্ষা নিরীক্ষা হয় বলে মনে হয় না । এদের পর্যায় হতে পারে,   বা পর্বান্তর  হতে পারে ,  ভিন্নতা হতে পারে । কল্পনায় কবি কীসের পরীক্ষা দিতে বসেন ?  কবি তো থাকেন নিমজ্জিত দশায় -  তা ভাবের নিমজ্জতা ,  অনুভবের প্রকরণে এবং কবি সৃষ্টিকর্তা । লেখার আগের মুহূর্তে তাঁর ভিতরে যে মৌনমূখর দশা যা শরীরে এবং মনে রাসায়নিক তরঙ্গ তৈরি করে এবং যে পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে কবি লিখতে থাকেন কবিতা । সেই আচ্ছন্ন দশাকে যদি একটি মধ্যবর্তী পর্যায় বা সৃষ্টির পর্যায় ধরা হয় তাহলে কবিতা হল সেই পর্যায়ের ফলশ্রুতি বা outcome বা  result.   এই মধ্যবর্তী পর্যায়টিকে কীভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা বা experiment বলা যাবে  ?  
কবি যে খুব উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে একটি কবিতা লেখেন তা তো নয় ;  বরং অনেকটা নিরুপায় অবস্থার কাছাকাছি পৌছে লিখতে বাধ্য হন যার সাথে শব্দের স্বতঃস্ফূর্ততার যোগ আছে । কবিতা লেখা বা সৃষ্টির প্রাক্ মুহূর্তে  (  ছন্দের কবিতা লেখা ছাড়া )  সমগ্র প্রক্রিয়াটি কবির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়  ;  কবির মাধ্যমে শব্দ চলে আসে এবং তার বহিঃপ্রকাশ হয় । অনেকটা automatic দশা।
কবি যদি খুব সজ্ঞানে শব্দ সাজাতে থাকেন এক্কেবারে নতুনভাবে বিন্যস্ত করার জন্য ;  এবং এর ফলে যে কবিতা লেখা হয় বা নির্মাণ হয় ,  তার মধ্যে যদি কবিতার ব্যাপক পরিবর্তন চলে আসে তবে তা কবিতার অন্য বা ভিন্ন রূপ ;  কবিতা রূপ পরিবর্তন করল   এবং এই ধরনের কবিতা ই  হয়ে ওঠে রূপান্তর কবিতা । রূপান্তরের এই দশাটি কবিতা সজ্ঞানে নির্মাণের ফলেই বেশি হয় ,  আবার ভাবের মধ্যে বা ঘোরের মধ্যে দিয়ে বা automatic দশা থেকে আসবে না এমনটা নয়
আফজল আলি
 জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্ট ও কবিতা

No comments:

Post a Comment