বিষয় : সাক্ষাৎকার
কবি রুদ্র পতি’র কবিতা ভাবনা
(মুখোমুখি
রাহুল গাঙ্গুলী)
রাহুল : লেখার শুরুটা যদি বলেন একটু, আপনার জীবনে লেখা শুরু করার জন্য কী কোনো বিশেষ ক্ষেত্র বা উদ্দেশ্য ছিল ?
রুদ্র পতি : ভাবুন সেই সময়, যখন ইলেকট্রিসিটি ছিল না, ফোন ছিল না, প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলায় লন্ঠনের কাচ মুছতাম ন্যাকড়া দিয়ে আর মুখের বাষ্প দিয়ে, তারপর ফিতে’তে দেশলাই জ্বালাতাম, সময়টা ১৯৮৮, সেই সময় আমি 2nd year-এ পড়ছি, Chemistry-তে অনার্স, প্রথমে ভর্তি হয়েছিলাম বাঁকুড়া শহরের সম্মিলনী কলেজে, কিন্তু এক মাসের মধ্যে সরে আসি মফস্বলের বাঁকুড়া জেলার শালডিহা কলেজে। উদ্দেশ্য ওই, পর্যাপ্ত ফুটবল খেলার মাঠ। ভলিবল খেলা আমার ভীষন পছন্দের আর পুকুরে সাঁতার কেটে স্নান করার সুযোগ। এই সুবিধা নেওয়ার জন্য, শহর ছেড়ে গ্রামের কলেজে চলে আসি। অবশ্য, তখন গ্রামের এই কলেজটিতে Chemistry খুব Strong. বাঁকুড়া শহরের ছেলেরা এখানে প্রফেসর’দের কাছে tution পড়তে আসতো। আমি পড়াশোনাতে বরাবরই ভালো ছিলাম। ফলে স্বপ্ন বলতে এইটুকুই ছিল, কেমেস্ট্রির অধ্যাপক হবো। Simple living, high thinking-এ তখনও বিশ্বাসী ছিলাম। ভাববো, সমস্ত কিছুই খুঁজবো পরমাণু বা মৌলের ভিতর, যেমন মানুষের এই শরীর, প্রেমিকার শরীর, সেখানে কোষ-কলা এসবই কী কী দিয়ে তৈরি উত্তর খুঁজতাম। কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস ইত্যাদি ইত্যাদির ভিতর। এই শরীর নির্মাণে অপরিহার্য, এই বৃক্ষদের নির্মাণে অপরিহার্য কার্বন ও হাইড্রোজেন এই দুটো পরমাণু বা মৌল। জলকে ভাবতাম হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের
কম্বিনেশনে একটা অনুপাতে যারা জুড়ে আছে। অসম্পৃক্ত জৈব যৌগের ভিতর অ্যাসিটিলিনের গ্রামীণ আলোয় আমার গঞ্জের পথ উদ্ভাসিত হতো যেখানে রাতের মেলা বসতো, গাজনের ঝুমুর, ছৌ-নাচ হতো।
তেমনই সমুদ্রের জল, তাকে আমি খুব সম্মান করতাম, এখনো করি, কারণ সেখানেই প্রথম প্রাণের উপযোগী অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরী হয়েছিল, যা থেকে এককোষী প্রাণীর জন্ম, তারপর তা থেকে বহুকোষী প্রাণীর সৃষ্টি, এই আমাদের জন্মের ঋণ সেখানে। ঈশ্বরের থেকে জন্মেছি আমরা, একথা কখনো ভাবিনি।
ওহ্, বলা হয়নি, আসলে আমি ১৯৮৭ সাল থেকে প্রথম যে দুটো লিটল ম্যাগাজিনের গ্রাহক ছিলাম, তার প্রথমটি হল ‘উৎস মানুষ’ পত্রিকা আর দ্বিতীয়টি ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান’ পত্রিকা। কিন্তু কী হলো? বাঁকুড়া শহরে সপ্তাহে দুদিন যেতাম কেমেস্ট্রির টিউশন পড়তে, তখন বাঁকুড়ার মাচানতলার ‘সুনীল বুক স্টলে' পত্রিকা কিনতাম। ‘দেশ’ পত্রিকার সঙ্গে তখনই পরিচয়। তখন সাপ্তাহিক বেরোত। ‘চন্ডীদাস’ সিনেমা হলে কোনো কোনো রবিবারে টিউশনির পর সিনেমা দেখেও ফিরেছি আমরা প্রায় চল্লিশ কিমি. দূরের গ্রামীণ কলেজ হস্টেলে, আমাদের মধ্যে তখন লেখাপড়ায় তেমন সিরিয়াসনেস্ ছিল না। কিন্তু প্রফেসররা আপ্রাণ চেষ্টা করতেন আমাদের জন্য।
তো ওই ‘দেশ’ পত্রিকায় আনন্দ বাগচী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দিবেন্দু পালিত প্রভৃতি কবিদের কবিতা পড়তাম। খুব টানতো আনন্দ বাগচী’র কবিতা। গল্প ও উপন্যাসের’ও পোকা ছিলাম আমি। HS পরীক্ষা দেওয়ার পর ১৯৮৬ তেই প্রায় আমাদের গ্রামীণ লাইব্রেরীর সমস্ত উপন্যাস পড়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমার প্রিয় ঔপন্যাসিক মাত্র দু-তিন জন এখনো, শুনলে বোকা বোকা লাগবে, তবুও বলছি, ১), ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, ২) আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ৩) নিমাই ভট্টাচার্য্য। অর্থাৎ, আমার নরম মনে এইসব ঔপন্যাসিকদের লেখা প্রবলভাবে নাড়া দিত। খুব কেঁদেছি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’ পড়ে এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’, ‘পোস্টমাস্টার’, অর্থাৎ গল্পগুচ্ছের গল্পগুলি পড়ে, তখন আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি। কিংবা
‘মধু মাঝির ওই যে নৌকাখানা
বাঁধা আছে রাজগঞ্জের ঘাটে,
কারো কোনো কাজে লাগছেনা তো,
বোঝাই করা আছে কেবল পাটে।
আমায় যদি দেয় তারা নৌকাটি
আমি তবে একশোটা দাঁড় আঁটি,
পাল তুলে দিই চারটে, পাঁচটা, ছ’টা’......
এই ‘নৌকাযাত্রা’ কবিতাটিও খুব নাড়িয়েছিল আমাকে। পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার ভেতর আমি ওই শিশু কাব্যগ্রন্থ ও শিশু ভোলানাথ, এই দুটি থেকেই আমি আমার কাব্য রসদ সংগ্রহ করতাম। মাধ্যমিকে পর্যাপ্ত নাম্বার নিয়ে পাশ করি, HS এও ভালো নাম্বার ছিল। কিন্তু গোলমাল হলো, ওই কেমেস্ট্রি অনার্সে পার্ট ওয়ান পরীক্ষার দুমাস আগে, সব উলোটপালট হয়ে গেল। ভেবে দেখলাম, একজন কেমিস্ট বা অধ্যাপকের চাইতে একজন কবির অনেক বেশি বলবার আছে, প্রকাশ করবার আছে, আছে নির্মাণ, পরিব্যপ্ত হওয়ার অসীম ক্ষমতা। ফলে কবিতা লিখবার জন্য ভিড়ে গেলাম, মন সায় দিল। আমি তখন আমার বন্ধুদের হস্টেলে, অনেকেই যখন কোনো চ্যাপ্টারে আটকে যেতো আমি সাহায্য করতাম; তারা অনেকেই প্রবল আপত্তি করেছিল আমার এই লেখালেখি নিয়ে, আবার অনেকেই সমর্থন’ও করেছিল। তখনই শুরু হলো দেওয়াল পত্রিকা প্রকাশ। প্রতি ১৫ দিন অন্তর সেকী পাগলামি! সেখান থেকেই প্রিন্টেড পত্রিকা, নাম ‘আঘ্রাণ, সম্পাদক আমি, সহযোগীর অভাব নেই, অনেকেই জুটে গেল। আমাদের কলেজে থার্ড ইয়ারে ইকনমিক্স অনার্সে পড়তো শেখ আপ্তার আলি, গ্রাম থেকে সে আসতো সাইকেলে, সে তখন কোলকাতা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন কাগজে লিখছে, যেমন ‘দেবযানী’, ‘যুবমানস’ ইত্যাদি। আমার এক বন্ধু আফতারকে আমার হস্টেলে নিয়ে এলো, তার সঙ্গে লেখালেখি, লিটল ম্যাগাজিন বিষয়ে আলোচনা হলো, আপ্তারদা আমাকে পত্রিকাও দিল, এইভাবেই কবিতা লেখাটা শুরু হয়ে গেল।
শুদ্বসত্ত্ব বসু সম্পাদিত ‘একক’ পত্রিকার গ্রাহক হলাম, বর্ধমান জেলার কালনা থেকে প্রকাশিত ‘হোত্রী’ ও ‘সীমায়ন’ পত্রিকায় দুহাত ভরে লিখলাম গদ্য এবং পদ্য। এই দুটি পত্রিকা আমায় লেখার জন্য পুরস্কৃত’ও করলো রৌপ্য পদকে। শুদ্বসত্ব বসু নিয়মিত আমার কবিতা ছাপলেন ‘একক’-এ, তারপর আমাদের ছাত্র সংগঠনের এক বিশাল সমাবেশে যোগ দিতে কলকাতায় গেলাম, কলেজ স্কোয়ারে অবস্থান। সেখানে কামরুজ্জামানের স্টল থেকে সেই প্রথম দু’শো টাকার লিটল ম্যাগাজিন কিনেছিলাম। প্রায় বাইশ খানা টাটকা লিটল ম্যাগাজিন।
সেসব থেকে ঠিকানা পেয়ে যোগাযোগ, লেখালেখি। আর জানিনা কী অমোঘ টানে একদিন সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে কবিতাকেই পাথেয় করলাম। কারণ তখন বুঝলাম, একাডেমিক লেখাপড়া করা বন্ধুদের চাইতে আমি এগিয়ে রইবো। ভেসে রইবো আলো অন্ধকারে। হস্টেল ছেড়ে পালিয়ে গেলাম কবি কুমুদরঞ্জনের গ্রামে, বর্ধমানের ‘কোগ্রাম’-এ, ।
কাটোয়ার জুনিয়র বেসিক ট্রেনিং কলেজের চত্বরে তাঁর লাগানো কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে একবছরে লিখে ফেললাম ৪০০ টি কবিতা।
কৃষ্ণনগরের শতদল ঝর্ণার ধ্বনি অনুষ্ঠান অথবা বর্ধমানের বাকচর্চায় অনুষ্ঠান, কালনার সাহিত্য সম্মেলন গেলাম। নবদ্বীপে জলঙ্গী, কাটোয়ায় ভাগীরথী আর অজয়ের পাড়ে আমি কবিতা, গল্পের চিত্রকল্প, থিম ও আবেগ খুঁজে পেলাম। জেবিটি পড়েও পেলাম শ্রেষ্ঠ নাম্বার প্রাপকের সম্মান। সেখানেই নন্দন সিংহের কাছে আবৃত্তি শিখলাম। তাঁর কাছেই শামসুর রাহমান, অমিতাভ দাশগুপ্ত, শঙ্খ ঘোষের কবিতার আবৃত্তি শিখি। একদিন পুরনো বই বিক্রির ঠেলা(রিক্সা ভ্যান) থেকে ভবতোষ শতপথী এবং চারণকবি বৈদ্যনাথের বই পেয়েছিলাম খুব অল্প দামে, সেই আনন্দ কখনো ভুলবোনা। সেই সব কবিতা কাটোয়ার হস্টেলে আমরা বন্ধুরা আবৃত্তি করতাম মহানন্দে, প্রফেসররাও খুব উৎসাহ দিতেন। সময়টা হলো১৯৮৯ থেকে ১৯৯০।
ভোরে বৈষ্ণব ও বৈষ্ণবী এসে হস্টেলে আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে যেতো। আমরা ধুতি ও পাঞ্জাবি পরতাম। প্রার্থনা দিয়ে শুরু হতো সকাল। তারপর ক্লাসরুমে মেঝের ওপর বসে চৌকিতে বই ও খাতা রেখে পাঠাভ্যাস। আগামীতে শিক্ষক হওয়ার প্রশিক্ষণ।
রাহুল : লেখা শুরুর উদ্দেশ্য বা কোনো বিশেষ ক্ষেত্র
রুদ্র পতি : হ্যা, লেখা শুরুর বিশেষ ক্ষেত্র অবশ্যই ছিল, মিথ্যা বলবোনা, কারণ অমরত্বের লোভ ছিল, আমার তখন মনে হয়েছিল একমাত্র কবিতা লিখেই তা সম্ভব। গল্প, উপন্যাস বা প্রবন্ধ লিখেও নয়। বিজ্ঞানীর চেয়েও কবি বড়ো তখন মনে হতো। আসলে মরণশীল এই নশ্বর জীবনে আজ আছি কাল নেই, কিছু কবিতা যদি মহাকালের কাছে রেখে যেতে পারি, তাহলে দাগ রেখে গেলাম, এই আর কী। আসলে আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা আমার গ্রামে। চোখের সামনে আমার জন্মান্ধ জ্যেঠা ও পিসিকে দেখেছি। সেখান থেকেই অন্ধজনে দেহ আলো, মৃতজনে দেহ প্রাণ, কবিতা যদি দিতে পারে, কোনো ডাক্তার তো পারলোনা। আধুনিক বিজ্ঞান’ও তো পারলোনা। ছোট থেকে খুব কাছ থেকে দারিদ্র্য দেখেছি, যে দারিদ্র্যের শেকল ছিঁড়তে পারতাম কেমেস্ট্রি পড়ে, কোথাও ভুল বোঝা বুঝিতে সেই শেকলেই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেলাম। বড়ো হওয়া কাকে বলে…..আমার সেই সব বন্ধুরা, কলেজের বন্ধুরা, কেউ ভারতের NIT তে অধ্যাপনা করে, কেউ বিদেশে। আমি তাদের চেয়ে এগিয়ে ছিলাম পড়াশোনায় তবুও কবিতায় শ্রেষ্ঠ সময়টুকু দিয়ে দিলাম, ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৬ দীর্ঘ নয় বছর। শুধুই কবিতার জন্য, মৃত্যুর পরেও নামের প্রত্যাশায় আর লিখে আনন্দ পাওয়া, সেটা তো বাড়তি পাওনা। কবিতার সংখ্যা এই পর্বে প্রায় তিন হাজার। প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা প্রায় দুহাজার, পৃথিবীর প্রায় সমস্ত বাংলা কাগজে ও পত্রিকায়। এইসময় কবিতা পাঠানোর মাধ্যম ছিল একমাত্র ভারতীয় ডাক বিভাগ। এই পর্যায়ের সমস্ত কবিতা লেখা হয়েছে, লন্ঠনের আলোয়, কেরোসিনের ব্যবহারে। তখন গ্রামীণ কলেজ হস্টেলেও ইলেকট্রিসিটি ছিল না।
দ্বিতীয় পর্যায়ে, অর্থাৎ ২০০০ সাল থেকে ২০০৮ সাল, দীর্ঘ নয় বছর, এই পর্যায়ে কবিতার সংখ্যাও প্রায় তিন হাজার, গল্পের সংখ্যা ১২ টি, প্রবন্ধ/নিবন্ধ পাঁচটি, সমস্তই প্রায় প্রকাশিত। কবিতাগুলো লেখা হয়েছে ইলেকট্রিকের আলোয়, এবং ফোন ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছি ২০০৪ সাল থেকে। কুরিয়ারের সুযোগ পাইনি, সেই ভারতীয় ডাক বিভাগ, যারা আমার কিছু মূল্যবান লেখা ঠিক স্থানে পৌঁছেও দেয়নি, হারিয়ে ফেলেছে। মন খারাপ হয়ে গেছে, কপি না থাকা সেইসব লেখার জন্য অনুশোচনা হয় এখনো।
রাহুল : কখনো কি মনে হয়নি, যা লিখছি কেন লিখছি?
একজন কবির কাছে এই প্রশ্নটি নিজেকে করা কতটা জরুরী?
রুদ্র পতি : প্রথম থেকেই এই ব্যপারে আমি সচেতন ছিলাম, সেই নয়ের দশকের শুরুতেই আমি প্রান্তীয় অঞ্চলের কবিতা লিখি এবং সেইসব কবিতার নির্মাণ, স্টাইল ছিল ছোট ছোট। ‘প্রান্তিক চাষা’ এবং ‘অসম্পৃক্ত হাইডোকার্বন’ গ্রন্থে তার নমুনা রয়েছে। দুটোরই প্রকাশকাল ১৯৯৩, রচনাকাল ১৯৯০-৯২ এবং এই দুটি কাব্যগ্রন্থই প্রকাশকরা প্রকাশ করেছিলেন নিজেদের খরচে, আমার কোনো টাকা-পয়সা লাগেনি। ওই পর্বে লেখা ‘এবছর শ্রাবণ ভালো’ এবং ‘বেকারের কবিতা’য় আমি যেমন লোকজ শব্দ ব্যবহার করেছি তেমনি লেদ, সিঙ্গেল-ফেজ মোটর, থ্রি-ফেজ মোটর, হ্যান্ড্রিল, প্রোটোপ্লাজম থেকে শুরু করে, e = mc2, ফিশান, ফিউশন ইত্যাদি ব্যবহার করেছি একদম নিজস্ব স্টাইলে।
আমার আগে বাংলা কবিতায় কেন সম্ভবত ইংরেজিতেও কেউ এভাবে e = mc2 সূত্র কবিতায় প্রয়োগ করেনি। আমিই প্রথম। যেমন আমার তৈরী ‘সালফার-বালিকা’ এর আগে কেউ এমন শব্দ লেখেননি। ভারী শিল্পে আর তেজস্ক্রিয় অস্থিরতায় আর মুখোমুখি বেশ্যালয় ও প্রসূতিসদনের মাঝে ওই ‘সালফার-বালিকা’র কথা লিখেছিলাম সেই নয়ের দশকের গোড়ায়। বাংলা কবিতা আমি দুহাতে লিখেছি, বাঁহাতে গ্রামীণ লোকজ কৃষিভিত্তিক প্রান্তীয় মালভূমির কবিতা, দারিদ্রবিক্ষত, ঊষর, তাঁত ও কুটির শিল্প, বিশ্বাস, সরলতা, লম্ফের কাঁপা আলো, সাপে কাটা গ্রাম।
আর ডানহাতে মফস্বল, শহর, নগরকেন্দ্রীকতা, শিল্পাঞ্চল, ফার্নেস, ভারী শিল্প, অবিশ্বাস, প্রতারণা, ক্রুড়তা, তেজস্ক্রিয়তার কবিতা। সেখানেও তবু বাঁচবার দ্যোতনায় ল্যেলান্ড ইঞ্জিন ছুটে যায় কিংবা স্টিম ইঞ্জিনের পিস্টনের সরলরৈখিক গতি, কীভাবে চাকার বৃত্ত গতিতে কনভার্ট হয়, তা দেখিয়েছি। কিংবা সমস্ত তেজস্ক্রিয় মৌল, অস্থিরতায় রশ্মি বিকিরণ করে করে শেষে শান্ত ও সুস্থির হচ্ছে সীসায়।
আসলে সরকার প্রদত্ত দুবছরের আইটিআই ট্রেনিং আমার মেশিন-মানুষের পরিচয় নয়, আমি ছোট থেকেই উড়িষ্যার রাউড়কেল্লার সামনেই লাঠিকাটায় ‘ওড়িশা ইন্ড্রাস্টিজ লিমিটেডে’র কারখানার ধুলো ও ধোঁয়ার ভিতর, এখানে মারুতচুল্লী বানানোর ইঁট তৈরী হতো, সেইখানে মিনি ভারতবর্ষে খেলে বড়ো হয়েছি শৈশবে। গুজরাট, মহারাষ্ট্র, আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ সবজায়গার লোকেই এই কারখানায় কাজ করতো, আমি সকলের ভাষা কি বুঝতাম? তবু আমরা সমবয়সীরা কতো খেলা খেলতাম একসাথে, ভাষা ভিন্ন কিন্তু খেলাতে কোনো আনন্দের ঘাটতি হতোনা কোনো। তখন আমার বয়স আট বছর, পরেরবার আমার বয়স তেরো বছর, মাঝের সময়টুকু গ্রামে বসবাস। আমার বাবা ওই কারখানার সুপার ভাইজার, পরে ফোরম্যান হয়েছিলেন। সেইথেকেই আমাকে কেমিস্ট বানানোর স্বপ্ন। কারণ ওই কারখানায় কেমিস্টদের তখন দারুণ কদর ও মাইনে। আর আমার নরম মনে কবি হওয়ার স্বপ্ন ; ফলে সংঘাত ও বিপর্যয়। স্টিল প্লান্টের মারুতচুল্লি(ফার্নেস) কাছ থেকে পরে দেখেছি বার্ণপুরে লৌহ-ইস্পাত কারখানায় ১৯৯১ তে আইটিআই পড়ার সময়। সে এক বিস্ময় । লোহার গলনাঙ্ক প্রায় ১৫৩৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, সেটা সহ্য করার মতো, অর্থাৎ তার চেয়েও বেশি গলনাঙ্ক সম্পন্ন মাটি ও রাসায়নিক দিয়ে মেশিনের সাহায্যে তৈরী হতো এই ইঁট। সেখানেই প্রথম লেদ ছাড়াও নানান মেশিনের ব্যবহার দেখেছি শৈশবে, সবই বিদ্যুৎ চালিত। Lathe is the mother of all machines. এবং কী আশ্চর্য! লেদের লোহা অন্য লোহাকে কাটে, খায়, ফুটো করে, আকৃতি দেয়, ঘর্মাক্ত করে। আমার অগ্রজ কবি ও ঔপন্যাসিক বর্ধমানের চিত্তরঞ্জনের কবি মানব চক্রবর্তী ‘ফার্নেস’ নামে একটি দারুণ পত্রিকা করতেন। তিনি আবার লৌহ-ইস্পাত কারখানায় চাকরিও করতেন। আমার কবিতা খুব পছন্দ করতেন তিনি। নিয়মিত তাঁর ফার্নেস পত্রিকায় কবিতা ছাপতেন আর বলতেন তোমার কবিতা পড়ে আমি লেখার শক্তি পাই।
অনেকে আনন্দে সমুদ্রের কবিতা লেখেন, ট্রেস কমানোর জন্য, তিনি আনন্দের জন্য, বিনোদনের জন্য লেখেন। আর হোলটাইমার কবিদের প্রচুর পড়াশোনা ও চিন্তা ভাবনার মাধ্যমে নতুন আঙ্গিক খুঁজে, শব্দ খুঁজে, নতুন ভাবনায় তাকে কবিতায় প্রতিস্থাপন করতে হয়। এটা হোলটাইমার কবির দায় ও দায়িত্ব। এই প্রতিস্থাপন যদি অনুকূল হয় তাহলেই কবিতায় তা বাজবে, কার্যকরী হবে, পরবর্তী প্রজন্ম গ্রহণ করবে। আমি ওই ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত প্রায় তিন হাজারের বেশি কবিতা লিখেছিলাম, সেই স্টাইল, ভাবনা, শব্দের ব্যবহার এবং ঢং দেখে, পাঠকেরা আমার নাম না থাকলেও বলতে পারতেন এটা রুদ্র পতি’র লেখা কবিতা। তারপর হঠাৎ কবিতা লেখা ছেড়ে দিলাম, অসুস্থ হয়ে পড়ার জন্য। হোলটাইমার কবিদের অসুবিধা এই, কবিরা দিন দিন শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে, কারণ মনের চাপ শরীরকে প্রভাবিত করে উপর্যুপরি, ফলে তাদের শরীরে ঔজ্জ্বল্য, বুদ্ধীদীপ্ত, চকচকে স্মার্টনেস খুঁজে পাওয়া যায় না এবং মনে রাখতে হবে, চোখের দেখায় অর্থাৎ অবয়বে, দেখতে আনইমপ্রেসিভ কবিরাই কালজয়ী হয়। উদাহরণ জীবনানন্দ দাশ, উদাহরণ বিনয় মজুমদার। অর্থাৎ কবিতার জন্য শহীদ হওয়া যাকে বলে। আর পিছনে ফিরে দেখলে দেখা যাবে, এই হোলটাইমার কবিদের লেখা যেহেতু একটু অন্যরকম হয় সেজন্য তাঁদের লেখা বানিজ্যিক কাগজ ছাপাতে চাননা তেমন। এ এক বিরাট আবহমানের সংকট।
রাহুল: কবিতার আর্কাইভ যদি করা হয় তা আমাদের সাহিত্যকে কতটা বিকশিত করতে পারে? এরকম কিছু চিন্তা-ভাবনা কি কখনও আপনার মনে হয়, যা সাহিত্যকে আরও এগোতে সহায়তা করবে?
রুদ্র পতি : কবিতার আর্কাইভ কবিতার পক্ষে এবং কবির পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কত কবির কত ভালো কবিতা যেগুলো প্রায় হারিয়ে গিয়েছে কারণ সেসব কাব্যগ্রন্থ এখন দুষ্প্রাপ্য , কবিতার আর্কাইভ হলে সেগুলো পড়ার, কপি করার সুযোগ মিলবে ।
লিটল ম্যাগাজিনের কবি ও কবিতা কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যেটা জরুরী ছিল সে কথা আমি নয়ের দশকে বলেছিলাম তা আবার রিপিট করছি : স্নাতক স্তরে বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ছাত্রীদের সিলেবাসে লিটিল ম্যাগাজিন এবং সমকালীন কবিতা' শীর্ষক একটি chapter বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তরফ থেকে জুড়ে দেওয়া, এটা বাধ্যতামূলক অর্থাৎ তা থেকে প্রশ্ন আসবে উত্তর লিখে ছাত্রছাত্রীদের নম্বর পেতে হবে । তা হলে কি হবে? একাডেমিক পড়াশোনা করা অধ্যাপকেরাও লিটল ম্যাগাজিন এবং সমকালীন কবিতা সম্পর্কে আগে জানবেন তারপর ছাত্রছাত্রীরাও জানবে । এটা হলে কবিতা কেন্দ্রিক লিটিল ম্যাগাজিন গুলো এবং সমকালীন কবিদের প্রচার ও প্রসার যেমন হবে তেমনি পাঠকও বাড়বে । কবিতার প্রচার-প্রসারে টিভির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে ,কারণ এটি একটি দৃশ্য শ্রাব্য মাধ্যম। ইউটিউব এর ভূমিকাও রয়েছে । ওয়েবmagazine , facebook, whatsapp groupএর সাহায্যে কবিতার আদান-প্রদান , মত বিনিময় দারুণ কার্যকরী হচ্ছে । এবং নতুন লিখতে আসা অনেক কবি তার প্রথম লেখা কবিতাও অন্যের কাছে পৌঁছে দিতে পারছে আবার পরীক্ষামূলক লেখালেখি যেগুলো ছাপা কাগজে হয়ত আলোর মুখ দেখত না কোনদিন সেসব প্রকাশিত হচ্ছে অনলাইন পত্রিকার মাধ্যমে কারণ ছাপা ম্যাগাজিনের সম্পাদক এর অর্থনৈতিক চিন্তা তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা মূল লেখা ছাপাতে উৎসাহিত করে না। অনলাইন পত্রিকায় সে খরচ নেই তাই স্বাধীনতাও প্রচুর।
(ক্রমশ)
No comments:
Post a Comment