এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

মৈনাক চক্রবর্ত্তী



ছোট গল্প



বসন্তের পলাশ
                   
               বাড়ির পলাশ গাছটা বেশ বড় হয়েছে, এবার বোধয় ফুল ফুটবে গাছে। গাছটা আজকের নয়, তা প্রায় বছর দশেক হল, গাছটা বুবু পুতে ছিলো। বুবু আমার পিসততো বোন। বুবু এখন আর আমাদের সাথে থাকেনা। বুবু তখন কলেজে পড়ত, দ্বিতীয় বর্ষ। কলেজে এডুকেশনাল এক্সকার্সনে বুবুদের পুরুলিয়া নিয়ে গেছিল সেবার। সেখান থেকেই ও গাছটা নিয়ে আসে। দিনটা এখনও মনে পড়ে, কী একটা পূজো ছিলো বড়িাতে, বুবু দৌড়ে আমার ঘরে ঢুকে
-দেখ দাভাই তোর জন্য কী এনেছি...
-কী আনলি? কই দেখা?
-কী বলত এটা?
-পলাশ.....,কোথায় পেলি এটা?
-পুরুলিয়া থেকে এনেছি, একজন দিয়ে বলল খুব কাছের কাউকে দিতে।
-ও কাছের কেউ আমি নাকি ....
-তুইতো আমার সোনা দাভাই। তোর জন্যই এটা।
-ন্যাকামো করিস না।  আমি সব জানি, ট্রুরে যাবার আগে কার সাথে হেসে হেসে ঘুরছিলিস সেদিন? আমি দেখিনি ভাবছিস।
-আরে ও নীলান্তন। খুব ভালো ছেলে, আমার খুব ভালো বন্ধু।  আমার সাথে এক কলেজে পড়ে।
-তাইনা রে। তুই ও তো ভালো মেয়ে; একদিন পরিচয় করা।
-তুই পারিস ও দাভাই, ওর একটা প্রেমিকা আছে। তার জন্যই একটা কানের দুল কিনতে গেছিলাম আজ
-যা কি হবে তালে....
-কিসের আবার কি হবে?
-আমি ভাবলাম হেব্বি একটা ব্যাপার চলছে তোদের মধ্যে। সব ভেসতে দিলি....
-শোন দাভাই আমার পিছনে লাগলে আমিও কিন্তু তোর সব কথা বলে দেবো....
-কী আর বলবি?
-তাইনা। কি বলব শুনবি? সৃজিতা নামে একটি মেয়ে আছে। যাকে আমি দিদি বলে ডাকি। তার সাথে আমার এক মাত্র দাভাই গভীর প্রণয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। এটা মামি কে বলে আসি যাই। মামি.... ও মামি....
-এই বুবু কি করছিস দাড়া দাড়া, আচ্ছা আমি আর বলবো না। এই কান মুলছি, নাক মুলছি দাড়া...
-হাহাহাহা কানমোল ভালো করে তাহলে বলবোনা।  
-তবেরে দাড়া দেখাচ্ছি তোকে........
           বুবু এক দৌড়ে পালিয়ে গেল। সৃজিতা আমার বান্ধবী, বুবুর থেকে বছর ছয়েকের বড়, ওকে পড়াতে আসত, সেই সূত্রে আমার সাথে পরিচয়। সৃজিতা যে শুধু আমার বান্ধবী তা বললে ভুল হবে। আমার আর সৃজিতার সম্পর্কটা তেমন কেউ জানেনা, এক মাত্র জানে বুবু। দিনকতক হলো ও এতো শয়তান হয়েছে সুযোগ পেলেই আমাকে আর সৃজিতাকে নিয়ে ইয়ার্কী করবে। দুর্ভাগ্যের বসে ও যে কার সাথে প্রেম করে বা কার সাথে ওর মনের টানাপোড়েন শুরু হয়েছে সেটা জানিনা। সেটা যদি জানতে পারতাম, তাহলে প্রতিদিনের ইয়ার্কীর মধ্যে নিজেকে অসহায় মন হতো না।
            বুবু প্রেম করে কি করেনা তা স্পষ্ট জানা নেই। তবে কারোর প্রতি মনে একটা টানাপোড়েন আছে সেটা বিলক্ষন খেয়াল করি। ওর বয়স এখন কুড়ি, ওর বয়সে জীবন প্রেম আসাটা অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু ছেলেটা কে সেটা বুঝে উঠতে পারিনা। বুবু আমার থেকে বছর আটের ছোট, তবুও ওর উপস্থিত বুদ্ধি প্রচুর, ওর বুদ্ধির কাছে এখনও আমাকে মাঝে মাঝে নাস্তানাবুদ হতে হয়। অসলে একটা প্রেমের গল্প শুনতে ভালো লাগে। কার না একটা প্রেমিক প্রেমিকার খুনশুটি দেখতে ভালো লাগেনা। আর সেই তাগিদেই ওর প্রেমিকের অস্তিত্বের সন্ধান করা। এই নিয়ে আমাদের জীবন ভালোই চলে যাচ্ছে। আমরা পিঠপিঠী ভাইবোন না, কিন্তু তাতে আমাদের ইয়ার্কীর কোন ভাটা পড়ত না। সৃজিতা আর আমার সম্পর্কের সূচনায় ছিলো বুবু। আমাদের যখন ঝগড়া হয় তখন সেই ঝগড়া মিটিয়ে মিলমিশ করায় বুবু। আসলে বুবু সৃজিতাকে ভীষণ ভালোবাসে, ভীষণ ভাবে চায় আমার আর সৃজিতার সম্পর্কটা এগিয়ে চলুক। বুবুর মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি আছে, ও মানুষকে সুখী হতে দেখলে এক অকৃত্তিম আনন্দে ওর মনটা নেচে উঠত।
         বেশ কিছু দিন হলো বুবুর দেখা নেই। কী যে করছে বাড়িতে বসে বসে কে জানে। ওকে ফোন করলাম। ফোনটা দু-তিনবার ধরে বেজে গেলো, কেউ ধরলো না। ফলে ওকে একটা মেসেজ পাঠালাম
-তোর দেওয়া চারাটা পুঁতেছিলাম, মন হয় গাছটা বেঁচে গেছে। এসে দেখে যাস গাছটাকে।
সন্ধ্যে হয়ে এলো।  এখনও বুবুর কোন উত্তর পেলামনা। অনেক দিন ধরেই কেমন যেন রহস্যময় হয়ে পড়েছে বুবু। প্রেমে পড়েছে বোধয়, এবার দেখা হোক একবার যেভাবেই হোক জানতে হবে কী ব্যাপার। এত দিন খুব ইয়ার্কী মেরছে এবার আমার পালা।
বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল বুবুর ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারিনা। ব্যাপারটা এবার একটু সিরিয়াস মনে হচ্ছে, একদিন বুবুর সাথে দেখা করতে হবে। দিন দুয়েক পরে বিকেলের দিকে ঠিক করলাম বুবুর বাড়ি যাই। এই ভেবে সবে বাড়ি থেকে বের হয়েছি হঠাৎ দেখি বুবু, আমাদের বাড়ির দিকেই আসছে। আমি অনেকক্ষন বুবুর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলাম। এটা কী বুবু নাকি অন্য কেউ, ফুলের মতো মেয়েটার এ কী অবস্থা হয়েছে; চোখে কালসিটে, মুখ শুকিয়ে গেছে, দেখে মনে হচ্ছে অনেক দিন ধরে ঘুমোয়নি। বুবু তখন ও বাড়ির কাছে আসেনি তখনই আমি উদগ্রীব হয়ে বলে উঠলাম ...
-কিরে বুবু কি হয়েছে তোর? চোখ মুখের এ কি হাল করেছিস?
বুবু কোন উত্তর দিলনা। এতটাই অন্যমনস্ক ভাবে হেটে আসছিলো আমার কথাটা শুনতে পেল কিনা বুঝতে পারলাম না। আমি আর বুবু এক সাথেই বড় হয়েছি; খাওয়া-নাওয়া-ঘোড়া সব ক্ষেত্রেই বুবু আর আমি ছিলাম চির সঙ্গী, ওর প্রতি একটা অসীম স্নেহ কাজ করত আমার। যে মেয়েটা সবার মুখে হাসি ফোটায় তার এই অবস্থা দেখে নিজেকে খুব অসহায় লাগল। বুবু কাছে আসতেই বুবুর হাতটা বেশ জোড়ে নাড়া দিয়ে, বেশ ধমক দিয়েই বললাম...
-কিরে কি হয়েছে? নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিস নাকি?
ওর চোখটা ছলছল করছে আমি বুঝলাম সিরিয়াস কিছু, ওর হাতটা ধরে বললাম
-আয় ঘরে আয়....
ঘরে ঢোকার মুখে ছোট্ট এক টুকরো বাগান আছে, সেখানেই পালাশের চারাটা পুঁতেছিলাম। ঘরে ঢুকতে গিয়ে বুবু অনেক্ষন গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে আমি বলে উঠলাম
-দেখ তোর দেওয়া গাছটা, বেঁচে গেছে, ছোট ছোট দুটো নতুন পাতা গজিয়েছে দেখ।  
-হম, যে বেঁচে উঠতে চায় তাকে কী আটকানো যায়....
-মান টা কী? কে আবার বেঁচে উঠল....
-না কেউ না।
কথাটা বলেই বুবু ঘরের দিকে হাটতে হাটতে চলে গেল। আমার ঘরটাতে ঢুকে, আমার বিছানার একটা ধারে বসল বুবু। হতাশা আর অন্য মনস্কতায় মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে আছে। আমি ওর কাছে এসে বললাম
-বলত এবার কি হয়েছে তোর? কিরে চুপ কেন, কি হয়েছে?
-হ্যাঁ দাভাই বল কি বলছিস?
-এই কি হয়েছে রে তোর? তখন থেকে দেখছি অন্যমনস্ক।
-আমিই কেন বলত সব সময় ভুল করি দাভাই, সবাইকে ভালো রাখতে চাই সবাইকে খুশি রাখতে চাই তবুও আমার হাতেই অন্যকেউ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কেন আমার সাথেই এমনটা ঘটে সব সময়। কেন এমন অবস্থার সম্মুখীন হই আমি যার নিয়ত্রন আমার জানা নেই।
এতক্ষন পর বুবুর মনের মেঘ গুলো যেন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়ল। আমি এবারে বেশ কিছুটা ভয় পেলাম, কিন্তু বুবুকে বুঝতে দিলাম না। শুধু বললাম
-কেনরে কি করলি তুই আবার? বাড়িতে কিছু হয়েছে? নাকি কলেজের ঝামেলা।
-এই ঝামেলা অনেক দিনের, তোকে বলা হয়ে ওঠেনি। মনের মধ্যে পুষে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম ঠিক নিজেকে সামলাতে পারবো কিন্তু পারছি নারে। তোর নীলান্তনকে মনে পড়ে?
-নীলান্তন...নীলান্তন...হ্যাঁ মনে পড়েছে। ঐতো সেই ছেলেটা যার সাথে তোকে দেখেছিলাম। হম মনে পড়েছে ওর একটা প্রেমিকা আছেনা..
বুবুর দু চোখ বেয়ে অনবরত জল ঝড়ে পড়ছে। দু হাত দিয়ে চোখের জল মুছে বুবু বলে উঠল,
-হ্যাঁ, আছে, সেই নীলান্তন।
-কেনরে? কি করল সে?
-ঘটনাটা অনেক দিনের, এবার কলেজের এক্সকার্সনে পুরুলিয়া গেলাম মনে পড়ে।
-হ্যাঁ, ওখান থেকেই তো গাছটা এনে দিলি।
বুবু গাছের কথাটা এরিয়ে গিয়ে বলল-
-ওখানে কখনো গেছিস দাভাই।
-না, কেন?
-ওখানের বাতাসে একটা অনৈতিক মাদকতা আছে জানিস। কেমন একটা মতাল করা গন্ধে, মন অনৈতিক আবদারে সারা দয়ে। মন যেন কীসের এক প্রহর গোনে।
-তা সেখানে তোর মন কোন অনৈতিক আবদারে সারা দিলো?
-জানিস দাভাই চাইনি এটা হোক। একটা মেয়েকে ঠকাতে মন সায় দেয়নি।
-মানে? কী বলছিস? কেন মেয়ের কী করলি তুই?
-নীলান্তরের প্রেমিকার কথা বলছি।
-কেন কি হলো ওর? আর তাতে তোর সম্পর্ক কি?
বুবুর মুখটা কেমন শুখনো হয়ে উঠল, মনে হলো সারাটা আকাশ ওর মুখে ভেঙে পড়েছে। নাক টানতে টানতে আবারও বলতে শুরু করল বুবু
-বললাম না ঐ জায়গায় মনটা মাতালের মতো হয়ে পড়ে। কোন স্বাভাবিক জ্ঞান থাকেনা। চারাদিকে শাল মহুয়া আর পলাশের বন। জানিস দাভাই বনটার একটা গন্ধ ছিলো, শাল মহুয়ার গন্ধ। সেই গন্ধে সব ইন্দ্রিয় গুলো প্রখর হয়ে ওঠে। নিজেকে আর আটকাতে পারিনিরে আর তাই নীলান্তনকেও আর বাধা দিতে পারিনি।
-মানে? মানেটা কী? কী বাধা দিতে পারিসনি...
-সেদিন কেন জানিনা ভুলে গেলাম নীলান্তনের অন্যকারোর প্রতি দায়বদ্ধতা আছে।
-শোন বুবু আমার মাথায় কিছু ঢুকছেনা, সোজা কথায় বলবি কি হয়েছে....
-দাভাই তুই আমায় ভুল বুঝবিনাতো। তুই পাশে থাকবিতো আমার।
বুঝলাম প্রচন্ড কোন আঘাত পেয়ে একটা হতাশায় ভুগছে। ওকে ভরসা দেবার জন্য বলে উঠলাম
-আমি আছি, বল কী হয়েছে..
কাঁদতে কাঁদতে বুবু যা বলল-
-একটা পুরুষ আর নারী ঠিক যতটা কাছাকাছি আসতে পারে ঠিক ততটা কাছে এসেছিলাম আমরা। আমি আর নীলান্তন।
-মানে.....কী যা তা বলছিস? তুই জ্ঞানে আছিসতো। মাথা ঠিক আছেতো তোর।
-হ্যারে দা ভাই, জ্ঞানেই আছি। কেন জানিনি সেদিন এমন হলো, তীব্র সর্বনাসের মুহুর্ত ছিলো সেদিন। পঞ্চভূত যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছিলো। চারিদিকে বন আর বন মাঝ খানে আমি আর নীলান্তন, দিনের বেলাতও সেখানে ঝিঁঝিঁ ডাকছিলো। জানিনা কী করে এত কিছু করে বসলাম...
-ওর প্রেমিকা জানে কিছু?
-সেখানেই তো সমস্যা আরো বেড়েছে। নীলান্তন একটা তীব্র অপরাধ বোধে কিছু বলতে পারছে না, সেই এক আবস্থা আমারও। কী বলবে ও মেয়ে টাকে। আর সবে জেনে মেয়েটাইবা ওকে কেন মেনে নেবে।
-দেখ বুবু শান্ত হয়ে আমার কথাটা একটু শোন।
-পারছি নারে দাভাই। নিজের দিকে তাকাতেও ঘেন্না লাগছে। ইচ্ছা করছিলো মরে যাই কিন্তু পারিনি। ভেবেছি তুই বুঝবি আমার মনের আবস্থা। তোর একটা কথা খুব কানে বাজে রে 'মরে গিয়ে কোন লাভ নেই, এই সমাজ তোমার মৃত্যুতে তোমার উপর ফুল ছেটাবে কিন্তু দুদিন পর আবার সব আগের মত হয়ে যাবে'
-কি চাইছিস তুই? তুই কি নীলান্তনকে নিয়ে বাঁচতে চাইছিস...
-তোকে মিথ্যা বলবনা দা ভাই, প্রথম দিকটায় যে তা চাইনি সেটি নয়। তবে পরে অনেক ভাবলাম ঐ মেয়েটিকে কাঁদিয়ে আমি কখনো সুখী হবো নারে দাভাই।
-শোন বুবু তুই যদি মনে করিস এই কথা গুলো জানলে ওর প্রেমিকা কষ্ট পাবে, ওদের সম্পকর্টা ভেঙে যাবে তবে এই স্মৃতি ভুলে যা। অন্যায় করেছিস ঠিকই, তুইও এবং নীলান্তনও, কিন্তু যে ভুল ব্যক্ত হলে তিনটে জীবন নষ্ট হবে তার থেকে সেই ভুল মনে না করাই ভালো। শোন বুবু আমাদের শরীর যন্ত্র নয়। মাথা আর মন দুটো এক সাথে চলেনা। তাই মাথা হয়ত ভুলে সারা দেয়নি কিন্তু মন দিয়েছে। ভুলে যা বুবু...
-কিন্তু দাভাই ভুলতো বেড়েই চলছে...
- কেন আবার কি?
-আমি এখন না পারছি নীলান্তনকে ভুলতে না পারছি ওর কথা ভাবতে। যখন সেই দিনের কথা মনে পড়ছে তখনই ওর প্রেমিকার মুখটা মনে পড়ছে। আবার নীলান্তন যখন ওর প্রেমিকার সাথে দেখা করছে বা সময় কাটাচ্ছে আমি অসম্ভব ঈর্শায় ভুগছি। মনের ভেতরটা কেমন উথাল পাতাল খাচ্ছে...
-দেখ বুবু বাস্তবে ফিরে আয়। কী সব বলছিস পাগলের মতো। তুই শ্রেফ যৌনঈর্শাতে ভুগছিস বুবু। ভুলতো তুই একা করিসনি, ও নিজেও এই ভুলের অংশীদার। তোর জীবের সম্পূর্ণটা পড়ে আছে, কত রঙীন স্বপ্ন দেখবি তুই, কেন এত উল্টোপাল্টা ভাবছিস। শোন বুবু সময় এক মুল্যবান বন্ধু, একটু অপেক্ষা কর সময় সব ঠিক করে দেবে।
-ঠিক কিছুই হবেনা দাভাই...
-সব ঠিক হবে। আমি বলছি, আমাকে ভরসা করিসতো নাকি, আমার উপর একটু ভরসা রাখ।
বুবু খুব ফর্সা কাঁদতে কাঁদতে ওর নাকটা লাল হয়ে গেছে। আবারও কাঁদো গলায় বলল-
-জানিস দাভাই খুব চাইতাম একটা ভালো ছেলো আমাকে প্রপোজ করুক। তার সাথে জমিয়ে প্রেম করব। কিন্তু দেখ প্রেম যেদিন এলো সেদিনই চলে গেল...
-সৃজিতা জানে কিছু..
বুবু বলল-
-না।
-আমি জানাব কিছু..
বুবু কোন উত্তর দিলোনা। দুই হাত দিয়ে চোখটা ডলতে লাগল। আমি এই মুহুর্তে সৃজিতার উপস্থিতি খুব প্রয়োজন মনে করলাম। বুবুর এখন যা অবস্থা তাতে ওর মানষিক বলের প্রয়োজন। তার জন্য একটা মেয়ের উপস্থিতি প্রয়োজন। ফোনটা হাতে নিয়ে সৃজিতাকে ফোন করলাম। বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হলোনা, কয়েকবার রিং হবার পরেই ফোন ধরল সৃজিতা। ওকে সংক্ষেপে যতটা বলা যায় বললাম, সৃজিতা আসবে বলাতে ফোন কেটে দিলাম। আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয় কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল
-ঐ পলাশ গাছটা ও দিয়েছিলো জানিস....
-শোন বুবু আমার মনে হয় এই মুহুর্তে ওর সব চিহ্ন মুছে ফেলা প্রয়োজন। নইলে এই এক চিন্তা তোকে তারা করে বেড়াবে।
-তুই আর সৃজিতা দি কখনও ঘনিষ্ট মুহুর্ত কাটিয়েছিস?
আমি বেশ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। আমার উত্তরের প্রতীক্ষা না করেই ও বলে উঠল
-তাহলে কখনও ভুলতে পারবিনা। পলাশ যেমন প্রকৃতিকে বসন্তের সাজে সাজায় তোমনি দেখ এই পলাশ আমার সব বসন্ত কেড়ে নিলো
-আমি যদি আগে জানতাম বুবু কোন দিন এই গাছটা পুঁততাম না। ফেলে দিতাম। আমি আজই গাছটা ফেলে দেবো।
-না দাভাই আমাকে ছুঁয়ে কথা দে তুই এটা করবিনা। আমাদের সম্পর্কের প্রথম চিহ্ন ও। ওকে নষ্ট করবিনা তুই।
-কিন্তু বুবু এতে তোর কষ্ট বাড়বে বই কমবে না...
-না দা ভাই এই গাছটা যদি থাকে তালে আমিও ভালো থাকবো...
বুবুর মানসিক অবস্থা খুব খারাপ, সৃজিতা এখনো এলনা, ও আসলে বুবু একটু বল পেত..ওর মানষিক অবস্থা বুঝে  বললাম-
-আচ্ছা কথা দিলাম গাছটার কোন ক্ষতি হতে দেবোনা।  
এর মধ্যেই সৃজিতা ঘরে ঢুকলো,
-কি হয়েছে,
-আয় ঘরে আয় বস এখানে..
এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে বুবু। সৃজিতা ওর পাশে বসল, সমস্থটা আমার মুখ থেকে শোনার পর বুবুকে অনেক বোঝাল। সৃজিতার মধ্যে একটা পরিনত সত্তা আছে যা এতদিন চোখে পড়েনি আমার, ও বুবুকে বুকে জাপটে ধরে, চোখের ইশারায় আমাকে শান্ত হতে বলল, আমার উৎকন্ঠা যাতে কিছুটা দুর হয়। উৎকন্ঠা দুর হয়নি তবে সৃজিতা আসাতে বেশ নিশ্চিন্ত হয়েছি। অনেকক্ষন পর বুবু জড়ানো গলায় বলে উঠল
-দাভাই যেদিন পলাশ গাছটায় ফুলফুটবে সেদিন ভাববি আমার নীলান্তন আবার আমার কাছে ফিরে আসবে।
সঙ্গে সঙ্গে সৃজিতা বলে উঠল-
-এখন এসব থাক। চলো বুবু তোমাকে বাড়ি পৌছে আমিও বাড়ি যাই। রাত হচ্ছে চলো..
তারপর অনেকটা সময় কেটে গেছে, বুবু এখন ব্যাঙ্গালুরুতে থাকে, এখনো বিয়ে করেনি। এখনো নীলান্তনের স্বপ্নে ডুবে থাকে। এখনো ভাবে ও ফিরে আসবে। আমার আর সৃজিতার বিয়ে হয়ে গেছে। বুবুর সাথে কথা হয় রোজ, টেলিফোনে। নীলান্তনের কোন খোজ নেই। জানিনা কোথায় আছে; হয়ত বুবুও ওর খবর কিছু জানে না..
          এত বছর হয়ে গেল পলাশ গাছটা অনেক বড় হয়েছে, কিন্তু এক কাকতালীয় ব্যপার গাছটায় ফুল ফোটেনি এখনো। প্রতি শীতের শেষে যখন সব পাতা পড়ে যায় তখন ভাবি এবার হয়ত ফুল ফুটবে গাছে, বুবু হয়ত দৌড়ে এসে বলবে; 'দেখেছিস দাভাই, আমি বলেছিলাম না ও আসবে'। কিন্তু ফুল ফোটেনি কোন বসন্তে। গাছটার বসন্ত যেমন চুরি হয়ে গেছে, তেমনি আমার বুবুর বসন্তও চুরি হয়ে গেছে। কবে ফিরবে বসন্ত বুবুর জীবনে। আবারও এক অধীর প্রতীক্ষা আরো এক বসন্তের। এখন শুধু কিছু মুহুর্তের অপেক্ষা বুবুর জীবনের চুরি হওয়া বসন্ত ফিরিয়ে দেয় কিনা এই পলাশ গাছটা। শুধু প্রতীক্ষা, সেই প্রতীক্ষায় সারাটা দিন গাছটার দিকে চেয়ে থাকি কবে আসবে সেই বসন্ত।

মৈনাক চক্রবর্ত্তী

( গণিত স্নাতকোত্তর বিভাগের ছাত্র, দমদম মতিঝিল কলেজ, পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়)
ঠিকানা: ১৯১|৪ অশোকনগর, পোষ্ট অশোকনগর, থানা অশোকনগর, উত্তর চব্বিশ পরগনা, পিন:৭৪৩২২২

3 comments:

  1. মুগ্ধ হলাম

    ReplyDelete
  2. বসন্তের স্পর্শে অনবদ্য

    ReplyDelete
  3. খুব সুন্দর !

    ReplyDelete