এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

দেবশ্রী চক্রবর্তী



উপন‍্যাস (ধারাবাহিক)





চাটনি


কত ছবি কত কথা বলে যায়। এক একটা ছবির পেছনে থাকে এক একটা ইতিহাস। এই ছবিটা যেমন, লোকটা এক মনে টেবিলের ওপর রাখা কাগজের ওপর কিছু একটা লিখে চলেছে । কাগজটা খুব ছোটো । একটা চারচৌকো কার্ডের মতন , এর মধ্যে কি লিখছে লোকটা ? না কি শুধুই ছবি তোলার জন্য এই ভাবে পোশ দিচ্ছে । তবে কি কেউ সঙ্গে আছে, যে ছবিটা তুলে দিচ্ছে ?
নকশী  মনটা যেন কেমন করে উঠল । মাথা পেছন দিক থেকে একটা ব্যথা শিরদাঁড়া বেয়ে নিচের দিকে নামছে । মানুষের যখন খুব হিংসা হয় তখন শরীরে এরকম হয় । কানের পাশটা জ্বালা দিচ্ছে । পৃথিবীতে কোন সম্পর্ককে এত গুরুত্ব দেওয়া ঠিক না । অনেক ক্ষণ ধরে মোবাইলের দিকে একটানা তাকিয়ে থাকার জন্য হয় তো এরকম হচ্ছে । নিস্তব্ধ ঘরে ঘড়ির কাটার টিকটিক শব্দ কানে আসছে ।

নকশী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সন্ধ্যা সাড়ে ছটা বাজে । মোবাইলটা বালিশের পাশে রেখে জানালার সামনে এসে দাঁড়াল সে । সারা বাগানে হলুদ বড় বড় আলো জ্বলছে । সেই আলো এসে পরছে মশলা গাছ গুলোর ওপর । আজ সারা দিন বৃষ্টি হবার পর একটু আগে বৃষ্টি থেমেছে । বৃষ্টির জল পরে গাছের পাতা গুলো আরও বেশি জীবন্ত হয়ে উঠেছে । এই গাছ গুলোও একেকজন এক একটা স্বয়ং সম্পূর্ণ গল্প,
এক ভাবে তাকিয়ে থাকলে অনেক কিছু বোঝা যায়, যা বোঝার জন্য একটা অন্য রকম মন দরকার হয়, যা শুধু নকশী কাঁথার আছে । মনের ভেতর সে সারা দিন একে চলে নানা রঙের জলছবি । ঠাণ্ডা বাতাস মশলার গন্ধ বয়ে নিয়ে আসছে ঘরে । বাজারের কেনা চাটনি কোন দিন পছন্দ না তার, তাই জৈব সার দিয়ে নিজের বাগানে নানা রকম মশলার বাগান সে করেছে , জৈব সারে পুষ্ট গাছ দিয়ে তৈরি চাটনির স্বাদই আলাদা ।
মনে যখন খুব চাপ লাগে নকশী চাটনি বানাতে চলে যায় রান্না ঘরে । আজও মনের ভেতর খুব চাপ লাগছে, সে চলে গেলো রান্না ঘরে । লেবু কাটার সময় লেবুর হলুদ রঙ দেখে তার মনে হল ছবিটার কথা, মরীচ যে  কাগজের ওপর লিখছিলেন তার রংটা অবিকল এরকম হলুদ । পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ, প্রতিটা বস্তু একে অপরের সাথে কতটা সংযুক্ত , এই সত্যটা সবাই না বুঝলেও সে বোঝে ।

গত তিন দিন হল বকুল কাজে আসে না, এখন বকুলের কথাও খুব মনে পড়ছে । বকুল কাজে এলে সময় কিভাবে কেটে যায় সত্যি বোঝা যায় না । বকুলকেও সে খুব বোঝে, তাই  হয় তো বকুল নির্ধিদায় সব কথা এই ভাবে তাকে বলে দেয় । কিন্তু বকুলের কি হল তিন দিন কোন দেখা নেই । নকশীর মনে যারা দাগ কাটে , তারা এই ভাবেই হারিয়ে যায় । কথা গুলো ভাবতে ভাবতে দরজার কলিং বেলটা বেজে উঠল ।
নকশী চাকুটা ধুয়ে রেখে এগিয়ে গেলো দরজা খুলতে । এই সময় কে আসতে পারে ? রামের ফিরতে রাত ৯ টা বেজে যায় । রামের এত তাড়াতাড়ি আসার কথা না । নকশী আই হোলে চোখ রেখে দেখল একটা বেঁটেখাটো চেহারার লোক দাঁড়িয়ে আছে । অন্ধকারে লোকটার মুখটা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না । বারান্দার আলোটা কেটে গেছে কবে চোখে পরে নি । কাল রাতেও তো জ্বলছিল , হ্যাঁ, রামকে কাল আই হোল দিয়ে ও দেখেছে । রামের মুখটা কাল খুব বিমর্শ লেগেছিল ।

নকশী খুব ধীরে একবার বলল ,
কে ?

কোন উত্তর এলো না । লোকটা মনে হয় শুনতে পায় নি । অন্ধকারে মনে হচ্ছে লোকটা গা চুলকাচ্ছে । এখানে খুব মশার উপদ্রোপ তো , লোকটাকে মনে হচ্ছে মশা কামড়াচ্ছে । নকশী এবার একটু উঁচু গলায় বলল,

কে ?

দরজার পেছন থেকে উত্তর এলো,

আজ্ঞে, আমি শ্যামাচরন । সাহেব পাঠালেন ।

নকশী এবার বুঝতে পাড়ল তাদের বাগানের মালী শ্যামাচরন এসেছে ।

দরজা খুলতেই ঘরের ভেতরে ঠাণ্ডা হাওয়া এসে ঢুকল । টিউব লাইটের আলো শ্যামার চোখে এসে পড়ায় ওর খুব অস্বস্তি হল, লোকটা চোখ ডোলতে ডোলতে বলল,

সাহেব জ্যাকেটটা দিতে বললেন । থানায় যাবেন ।

এত রাতে থানায় যাওয়া মানে কোনমার্ডার  কেশ আছে নিশ্চয় । না হলে এত রাতে সচরাচর রাম অফিসের বাইরে বের হয় না ।

নকশী জ্যাকেটটা শ্যামার হাতে তুলে দিলো । শ্যামা তখনও দাঁড়িয়ে আছে । বাইরে ঠাণ্ডা হাওয়া এসে নকশীর মুখের চুল গুলো উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে । শ্যামার শ্বাস দিয়ে বিড়ির গন্ধ আসছে । বিড়ির গন্ধ শুকতে খুব ভালো লাগে  নকশীর । বিড়ির গন্ধের মধ্যে তার ছোট বেলার কিছু সুখ স্মৃতি লুকিয়ে আছে । শ্যামাকে বাগানে লুকিয়ে বিড়ি খেতে দেখেছে সে ।
নকশীর সামনে কোন দিন খায় না । লোকটা মনে হয় কিছু বলতে চাইছে ।

নকশী বলল, কিছু বলবেন  ?

লোকটা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, ম্যাডাম, বকুলকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ।

নকশী  মনে হল সে  এরকমই একটা খবরের জন্য অপেক্ষা করছিল ।তার  মনে হল সে  এই খবরটা অনেক আগে থেকেই জানত আর এর পর তাকে  কি কি করতে হবে তাও সে জানে  । সে  শ্যামা বাবুকে বলল,  

আপনি চেনেন বকুলদের বাড়ি ?

শ্যামা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, ম্যাডাম, আমাদের পাশাপাশি ঘর ওদের । বাপ মাটা কেঁদে কেঁদে অস্থির হয়ে পড়ছে । বকুলের বাবাই তো বলল , আপনাকে খবরটা দিতে ।

নকশীর মনে হল একে কিছু প্রশ্ন করা অবান্তর হবে, তার থেকে একবার বকুলদের বাড়ি ঘুরে আসলে খুব ভালো হয় । শ্যামাকে জ্যাকেটটা দিয়ে তাড়াতাড়ি আসতে বলে নকশী তৈরি হতে গেলো । রাতের বেলা একা একা বেড়িয়ে পড়তে বেশ লাগে । ডুয়ার্সে রামের পোস্টিং হবার পর বেশ কয়েকবার সে রাতের অন্ধকারে বেড়িয়ে পরেছে সে । বেশ কয়েকবার বকুলকে সঙ্গে নিয়েছে , আবার কখনো কখনো একাও গেছে । রাতের অন্ধকারে পাহার আর জঙ্গলের সাথে নিজেকে
একাত্ম মনে করেছে সে  । রাম বহুবার তাকে না করেছে, বলেছে এই অঞ্চলে চিতা বাঘের খুব উপদ্রব , এই ভাবে একা বেড়িয়ে পড়া ঠিক হচ্ছে না তার । কিন্তু নকশী মতন মেয়েকে  তো এই ভাবে আটকে রাখা যায় না । মরীচ তার একটি কবিতায় নকশী বন্য হরিণীর সাথে তুলনা করেছে । নকশীর মনে হয় তাকে হরিণীর সাথে তুলনা করে মরীচ তার অপমান করেছে । তাকে একমাত্র বাঘিনীর সাথেই তুলনা করা চলে ।

অফিসের গেটের বাইরে হাইওয়ে । তবে রাতের বেলা বাইরের গাড়ি সেরকম চলে না । বন্য পশুদের অসুবিধা হয় বলে বাইরের গাড়ি এই অঞ্চলে ঢুকতে দেওয়া হয় না । স্বামীর অফিসের বোর্ডটা গাড়ির সামনে লাগিয়ে নিলে আর কোন অসুবিধা হয় না নকশীর । নকশী হেটে আসতে চেয়েছিল । কিন্তু শ্যামাচরন তাকে বলেছে গত সপ্তাহে তাদের গ্রামের একটা মেয়েকে বাঘে তুলে নিয়ে গেছে , তাই হেটে যাওয়া ঠিক হবে না । মেয়ে মানুষের গায়ের গন্ধে
ওরা বেশি আসে ।



হাইওয়ে দিয়ে কিছুটা গিয়ে ডান দিকে জঙ্গলের মধ্যে যে রাস্তাটা চলে গেছে  সেই রাস্তা দিয়ে গাড়িটা চলল টিংলু গ্রামের দিকে । খুব আস্তে গাড়ি চালাচ্ছে নকশী , গাড়ির জানালাটা খোলা থাকার জন্য বাইরে থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া এসে ঢুকছে ভেতরে । এই হাওয়ায় আছে এক বন্য গন্ধ । খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হয় , যেমন একটু আগে একটা হরিণ রাস্তা পার করতে গিয়ে একবার থমকে দাঁড়াল, তারপর ধীরে সুস্থে রাস্তা পার করল । গাড়ি এবং তার আলোর সাথে এরা পরিচিত হয়ে গেছে, তাই আর ভয় পায় না । হরিণের চোখ দুটো অবিকল বকুলের মতন, বকুলের চোখ এরকম গভীর ছিল । রাতের অন্ধকারে হরিণটা মিলিয়ে গেলে নকশীর মনটা ছ্যাঁত করে ওঠে । পেছনের সিটে বসে শ্যামাচরনেরও যেন কিছু একটা মনে হল । শ্যামা খুব ধীর গলায় বলল প্রতি বছর টিংলু গ্রাম থেকে কত মেয়ে হারিয়ে যায় , আর তারা ফিরে আসে না । বকুলেরও হয় তো তাই হয়েছে । দূরে জঙ্গলের ভেতর কোথাও যেন হাতি ডেকে উঠল । নকশী ডান দিকে একটা পলাশ গাছের নীচে গাড়িটা দাড় করাল । এখান থেকে বকুলদের বাড়িটা দেখা যাচ্ছে । বকুলদের বাড়ির জানালা থেকে হালকা আলো আসছে । চারদিকে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে, শ্যামা গাড়ি থেকে নেমে টর্চ জ্বালিয়ে নকশীকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে চলল ।

দেওয়ালে ঘড়ির কাঁটা শব্দ করে এগিয়ে চলেছে, সবাই চুপ করে আছে । নকশী তাকিয়ে আছে জানালার পাশে রাখা চাটনির বোতলের দিকে , কোন কোম্পানির বোঝা যাচ্ছে না , তবে বাজার চলতি এই সব চাটনি খেতে ভালো হয় না । বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে, সবাই তাকিয়ে আছে নকশীর দিকে । বকুলের বাবা বলল,

-কি যে হল কিছুই তো বুঝতে পারলাম না । আপনাদের বাড়ি থেকে রাত আটটার মধ্যে ঢুকে যায় । দেড়ি হচ্ছে দেখে বলুকের মা আর আমি টর্চ নিয়ে বেরলাম, পথে শ্যামা দার সাথে দেখা । সে বলল এক ঘণ্টা আগে বেড়িয়ে গেছে ।

কথা শেষ হবার আগেই বকুলের বাবা কেঁদে ফেলল । বকুলের মা বলল,

-আজ তিন দিন মেয়ে ঘরে ফেরে নি ।

ভোল্টেজ খুব কম , অন্ধকারে বোতলের গায়ের লেখা পড়া যাচ্ছে না । নকশী জোড়ে জোড়ে পা নাড়াচ্ছে । কোন কিছু বুঝতে না পারলে ওর পা দুটো খুব জোড়ে জোড়ে নড়ে । নকশী খুব আস্তে বলল, পুলিশে খবর দিয়েছেন ?

বকুলের বাবা বলল, কি করব , বুঝতে পারছি না । বকুলকে আপনারা খুব ভালোবাসেন, তাই আপনাদের অনুমতি না নিয়ে কিছু করতে চাইছি না ।

নকশী বলল, পুলিশে খবর দিয়ে কোন লাভ হত না । কাড়ন, কোন নরখাদকের পেটে আপনার মেয়ে যায় নি, গেলে এতক্ষণে খবর এসে যেত । আর অন্য কোন কারুর খপ্পরে পড়লে পুলিশের টেবিলে এতক্ষণে ভাগ এসে গেছে , তাই তাদের কাছে গেলে কোন লাভ হত না ।

ঘড়িতে রাত সাড়ে আটটা বাজে । নকশী উঠে দাঁড়াল । বকুলের মা অনেক শক্ত প্রকৃতির মহিলা উনি এতক্ষণে এক ফোটা কাঁদেন নি, বকুলের বাবা সেই কখন থেকে কেঁদে চলেছেন । তারাও উঠে দাঁড়ালেন । নকশী ঘর থেকে বেরোনোর আগে একবার পেছন ফিরে চাটনির বোতলের দিকে তাকি বলল, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, যদি কিছু মনে না করেন ।

বলুকের মা অবাক গলায় বলল, বলুন ।

এই চাটনিটা কোন কোম্পানির যদি বলেন ।

বকুলের মা বলল, গত দু মাস ধরে বকুল রবিবার সকালে এই আচার, জেলি এইসব বানাতে যায় , এই চাটনি বকুলের বানানো ।

নকশী বকুলদের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে । চারদিক থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আসছে । নকশীর মাথার ভেতরটা ঝিমঝিম করে উঠল । শ্যামা, বকুলের বাবা মা সবাই গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, নকশী গাড়ির ভেতরে বসে দরজা বন্ধ করলে শ্যামা বলল,

-ম্যাডাম , আমাকে আবার যেতে হবে ?

নকশী বলল, শ্যামা বাবু আচারের ফ্যাক্টরিটা কি মেটিলি বাজারে ?

শ্যামে, বলল আজ্ঞে ম্যাডাম ।

নকশী গাড়িতে স্টার্ট দিলো । নকশীর মাথার ভেতরে যেন হাজার হাজার ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে উঠল । গত দুমাস ধরে বকুলের কাছে সে চাটনি বানানো শিখছে, জৈব সারে তৈরি গাছ থেকে বানানো চাটনি । বকুল বলেছিল এর স্বাদই আলাদা । নকশী গাড়ি নিয়ে হাইওয়েতে উঠল । মনের মধ্যে বারবার খটকা লাগছে , বোতলের গায়ে কি লেখা ছিল, অন্ধকারে দেখা যায় নি । লেখা গুলো পড়া খুব দরকার । নকশী একবার ভাবল বকুলদের বাড়ি ফিরে গিয়ে একবার ভালো করে সে দেখবে বোতলটা । কিন্তু এই ভাবে ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না । বকুলের বাড়ির লোক
অন্য কিছু ভাবতে পারে । রাস্তার এক কোনে গাড়িটাকে কিছুক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখল সে । গাড়ির জানালা খোলা , একটা হাল্কা বিড়ির গন্ধ এসে ঢুকল গাড়িতে । বিড়ির গন্ধ খুব প্রিয় নকশীর । এর সাথে ছোটবেলার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে । এত রাতে জঙ্গলে বিড়ির গন্ধ , ব্যাপারটা ঠিক ঠেকলো না তার কাছে । নকশী গাড়ি স্টার্ট দিলো । কিছুটা গিয়ে গাড়ির আলো গিয়ে পড়ল মেটিলি বিডিও অফিসের গেটে । নকশী কাঁথা গাড়ি নিয়ে ঢুকে গেলো ।



সত্যি রাতের অন্ধকারের এক রহস্যময় মহিমা আছে , কত কিছু বলে দেয় এই অন্ধকার । রামের ফিরতে দেড়ি হচ্ছে, ডিম-লাইটের নীল আলো দেয়ালের ওপর এসে পড়েছে । টিকটিক করে ঘড়ির কাঁটা এগারোটার ঘর ছুঁল । বাগানের চন্দন গাছটার থেকে একটা প্যাঁচা ডাকতে ডাকতে ছুটে গেলো ডালিম গাছটার দিকে । নকশী একটা স্টিলের ছোট বাটিতে আচার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জানালার সামনে । বাইরের বাগানের আলো ওর বাটির ওপর এসে পড়ে বাটিটা চকচক করছে । নকশী মুখে আওয়াজ করে লংকার আচার খাচ্ছে  আর মনে মনে ভাবছে প্যাঁচাদের কথা । কি
সুন্দর এদের জীবন যাত্রা, রাতের অন্ধকারে কি সুন্দর জীবনকে উপভোগ করে এরা, দিনের বেলায় সূর্যের আলো বড় তীব্র, বড় কঠোর , এই তীব্রতা পছন্দ না তার । বাটি থেকে একটা লাল লঙ্কা হাতে তুলে সে একবার ভাবল মানুষতো কখনো কখনো পেঁচার মতন হতে পারে , লুকিয়ে চুরিয়ে কত কাজ করতে পারে । লাল লঙ্কায় কামড় দিতেই দরজার মেলটা বেজে উঠল । নকশী লংকাটা ভালো করে চিবোতে চিবোতে চলল খাবার ঘরের দিকে । তারপর সিঙকে বাটি রেখে টাওয়ালে হাত মুখ মুছে সে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে । সে জানে কে বেল বাজিয়েছে , অন্য কেউ হলে এর মধ্যে আরো দুবার বেল বাজিয়ে ফেলত ।


রাম জানে তার স্ত্রী একটু ভাবুক ধরনের মহিলা, হয় তো কিছু লিখছে কিংবা ভাবছে, তাই দরজা খুলতে দেড়ি হচ্ছে , বেশি বেলের শব্দ নকশীকে উত্তেজিত করে তোলে, নকশী খুব চীৎকার করে, একটানা বকবক করে, তাই একবারই যথেষ্ট ।


দরজা খুলে নকশী কাঁথার মনে হল রামের মুখটা আজ আরো বেশি ফ্যাঁকাসে । কালকের থেকেও আজ এই মুখ যেন আরো বিবর্ণ ।


বাড়ি ফিরে রাম কোন কথা বলে নি । কথা না বলাই, রামের স্বাভাবিক চরিত্র, কিন্তু তা বলে একেবারে কথা না বলা  এ বড় বেমানান । রাম পাশ ফিরে শুয়ে আছে, সারা ঘরে নীল আলো, ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে এগিয়ে চলেছে । শোবার সময় জানালা বন্ধ রাখা থাকে,  নকশী একবার বাগানের জানালার বন্ধ কপাটের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল , রাম ঘুমোয় নি , কাড়ন ঘুমলে সে নাক ডাকতো । নকশী রামের পিঠে হাত রেখে বলল, কি গো কিছু বললে না তো । কিছু হয়েছে ?


রাম কিছু বলে না । রামের এই নিস্তব্ধতা আর ঘড়ির টিকটিক শব্দ শরীরটা বড় অস্থির করে তোলে । নকশী দরজার দিকে একবার তাকায়, পাখার হাওয়ায় পর্দা উড়ছে, পর্দার নিচ দিয়ে খাবার ঘরটাকে বড় অন্ধকার দেখাচ্ছে । নকশীর মনে হল খাবার ঘরে কেউ চলাফেরা করছে, সে ভালো করে তাকিয়ে দেখল, দরজার দিকে , মনে হল কেউ যেন সরে গেলো । নকশী এবার উঠে বসল , ডান আঙ্গুলের নখ গুলো খুব বড় হয়েছে, নখের ভেতর লঙ্কার আচারের গন্ধ । নকশী নখ দিয়ে নাকের ফুটোয় ঘোরাতে থাকল । কিছুক্ষণ চুপচাপ । ঘড়ির কাটার শব্দ । কেউ যেন কথা বলল । নকশী নাক খুটতে খুটতে বলল, হুম ।


এবার রাম কথা বলল, তাকিয়ে দেখা যায় না , কি ভয়ঙ্কর । সারা দেহ পুড়ে দগদগ করছে । তার ভেতর থেকে কিলবিল করে পোকা বেড়িয়ে আসছে ।


নকশী তাকিয়ে দেখল রাম তার দিকে তাকিয়ে বসে আছে, অন্ধকারেও রামের চোখ দুটো খুব উজ্জ্বল । নকশী মুখোমুখি তার সাথে ।


কতদিনের পুড়নো ?


মেয়েটাকে হরিয়ানায় বিক্রি করে দিয়েছিল ওর বাড়ির লোকজন ।


কথা গুলো বলার সময় রামের গলা কাঁপছে, রাম একটানা বলে চলেছে ।  কিন্তু, রামের সারা শরীরে ঘাম দিচ্ছে, নকশী দেশতে পাচ্ছে রামের শরীরটা একটা তৈলাক্ত জলপাইয়ের আচারের মতন লাগছে । রাম কোন দিকে তাকিয়ে আছে বোঝা যাচ্ছে না ।


রাম বলে চলেছে, মেয়েটাকে পুড়িয়ে ট্রেনে তুলে দিয়েছিল, তখনো মেয়েটা বেচে ছিল । একজন এসে দিয়ে যায় । হাসপাতালে তিন মাস মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে আজ মেয়েটা মাড়া গেলো ।


নকশীর মনে হল ডাইনিং টেবিলের চেয়ার কেউ টেনে বসল । নকশী বলল, তুমি একটু চা খাবে রাম ? চা খেলে শরীরটা ভালো লাগবে ।


রামের মনে হল এত রাতে চা খাওয়াটা ঠিক হবে না, এত রাতে  চা খেলে ঘুম চোটে যাবে, তাছাড়া কাল ভোরে ওকে মেয়েটার ইনকোয়েস্ট করতে হবে ।


রাম বলল , তুমি একটু বসো আমার কাছে, এত রাতে চা বানাতে হবে না ।


নকশীর মনে হল পাশের ঘরে এই মূহুর্তে একবার যাওয়া খুব দরকার । না গেলে অনেক কিছুর উত্তর তার কাছে অজানা থেকে যাবে ।


নকশী রামকে বলল, তুমি বুঝতে পাড়ছ না, চা খেলে তোমার মাথার দুশ্চিন্তা গুলো দূর হয়ে যাবে, একটু শান্তিতে ঘুমতে পারবে । আমি চায়ে একটু তুলশী পাতার রস দিয়ে দেবো, যা তোমার নার্ভ গুলোকে শান্ত করবে ।


রাম জানে, নকশী একবার মাথার ভেতরে যা ঠিক করে নেয়, তা সে করেই ছাড়ে । তাই ওর সাথে তর্ক করে কোন লাভ নেই , বরং ওর সাথে দুদণ্ড কথা বললে ও শান্তি পাবে ।


রাম বলল, আমি যাবো তোমার সাথে ?


নকশী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, না , তোমার যেতে হবে না । তুমি একটু শান্ত হয়ে বসো, উত্তেজনার মধ্যে বেশি চলাফেরা করা তোমার ঠিক না । এতে আরো শরীর খারাপ হতে পারে । তুমি শান্ত হয়ে বসো , আমি যতক্ষণ না ফিরছি নতুন কিছু ভাবার চেষ্টা করো যা তোমাকে আনন্দ দেবে ।


রামেরও মনে হল অন্ধকার ঘরে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকাই ঠিক হবে, এক বিষয় নিয়ে কথা বেশিক্ষণ চললে তা মনের ওপর খুব চাপ ফেলবে ।


নকশী পর্দা তুলে খাবার ঘরের দিকে তাকাল । ঘরটা খুব অন্ধকার , দেওয়ালের ডান দিকে সুইচ বোর্ড । দু পা ডানদিকে গিয়ে দেওয়ালে হাতড়ে সুইচ বোর্ডটা কিরকম যেন ঠাণ্ডা মৃতদেহের মতন লাগল । এই বাড়িতে আসার পর থেকেই নকশীর  জীবনযাত্রা কিরকম যেন পেঁচার মতন হয়ে গেছে । পেঁচাদের জীবন যেমন রাতে বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে , নকশীর জীবনও রাতে জীবন্ত হয়ে ওঠে । এই বাড়ি রাতের বেলায় এক বিচিত্র খেলায় মেতে ওঠে তার সাথে । নকশীর মস্তিষ্কের প্রতিটি অংশ যেন নিয়ন্ত্রিত হয় অন্য কারুর দ্বারা । কোন কিছু যেন ইচ্ছা থাকলেও করার কিংবা বোঝার উপায় আর থাকে না তার । নকশীর মনে হল একটা ঠাণ্ডা, নরম শরীরের ওপর দিয়ে হাত বুলিয়ে চলেছে সে । শরীরটা এতটাই নরম যে তার হাতের আঙ্গুল বসে যাচ্ছে কিছু কিছু জায়গায়, আর তার থেকে রস বেড়িয়ে তার আঙ্গুলে লেগে যাচ্ছে । নকশী হাতটা নাকে ঠেকাতেই একটা আমতেলের গন্ধ তার নাকে এসে ঢুকল । দু তিন মাসের তেলে মজা আমের গন্ধ । নকশী আবার দেওয়ালে হাত দিতেই এবার সুইচ বোর্ডটা সে হাতে পেলো । গুনে গুনে তিন নম্বর সুইচ টিপতেই সারা ঘর আলোময় হয়ে উঠল । নকশী তাকিয়ে দেখল ডাইনিং টেবিলের চেয়ারটা একটু সরানো । রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যেতেই সে একবার তাকিয়ে দেখল চেয়ারটার দিকে , মনে হল যেন কেউ বসে আছে,গদিটা কিছুটা নিচের দিকে নেমে আছে । রান্না ঘরে ঢুকে নকশীর মেয়েটার কথা মনে হল , মেয়েটা কত কষ্টকরে মাড়া গেছে । ফুটন্ত চায়ের জলের দিকে তাকিয়ে নকশীর মনে হল মেয়েটার দগদগে চামড়ার ভেতর থেকে পোকা বেড়িয়ে আসছে । চাপাতা দিতেই জলের রঙ লাল হয়ে গেল , মনে হচ্ছে পোকাগুলো কিলবিল করছে, আর শরীরের ঘা থেকে রক্ত বেড় হচ্ছে । সেই রক্তের রঙ কিছুটা কালচেটে লাল । অনেক দিনের জমে থাকা পচা রক্তের রঙ যেমন । লিকার চায়ে একটু দুধ দিতেই রঙটা চামড়ার মতন হয়ে গেলো । এরকম রঙের মেয়েরা সাধারণত সুন্দরী হয়, ডুয়ার্স অঞ্চলের মেয়েদের গায়ের রঙ এরকম উজ্জ্বল হয়, সেই মেয়েটারও হয় তো তাই ছিল । ওভেন বন্ধ করে নকশী একটা প্লেট চাপা দিলো তারপর ডাইনিং এ এসে একটা চেয়ার টেনে বসল । নকশীর মনে হল তার সামনে কেউ বসে আছে, সে কিছু ভাবতে বলছে তাকে , কিন্তু কি ভাববে সে কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না । এই মুহূর্তে ওর মনে হচ্ছে মেয়েটার কথা ভাবতে । বকুল একবার বলেছিল এই অঞ্চলের বহু মেয়ে অন্য রাজ্যে চালান হয়ে যায়, যাদের জীবন গুয়ে পোকাদের থেকেও বীভৎস হয় । এমন একটা পরিস্থিতি, যেখানে মানুষের দম বন্ধ হয়ে যায় । কি এরকম পরিস্থিতি হতে পারে ? অনেক কিছু মাথায় আসলেও কিছু আবছা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে , কেউ যেন বলল চা খেলে সব মনে পড়ে যাবে । নকশী চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রান্না ঘর থেকে বেড়তে যাবার সময় তার বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল । দরজার সামনে রাম দাঁড়িয়ে আছে । নকশী বলল,


তুমি না মাঝে মাঝে ভয় ধরিয়ে দাও ।


রাম বল , না , অন্ধকার ঘরে বসে থাকতে ইচ্ছা করছিল না, একই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল , তাই চলে এলাম ।


নকশী দেখল যে চেয়ারটা সরানো ছিল রাম সেখানে গিয়ে বসল । রাম বলল, এসো এখানে বসে চা খাই ।


সারা দিন অফিসে এত কথা বলতে হয় যে বাড়ি ফিরে কোন কথা বলা হয় না । আমি বুঝতে পারছি এর প্রভাব খুব ভয়ঙ্কর ভাবে পড়ছে মনের ওপর , যা ঠিক হচ্ছে না । আমাদের কথা বলা দরকার ।


নকশী টেবিলের ওপর কাপ গুলো রাখতে রাখতে একবার ভাবল সে কি বিষয়ে কথা বলবে । বহু দিন কথা না বললে এই ভাবেই সব কথা যেন ফুরিয়ে যায় ।


নকশী চেয়ারে বসে বলল, একটু চায়ে চুমুক দিয়ে কথা বলি । চা সুইচের মতন কাজ করে জানতো , সব কথা ঠিকঠাক বেড়িয়ে আসবে ।


দুজনে চায়ে চুমুক দিলো । তারপর রাম বলল, এত ভয়ঙ্কর মৃতদেহ আমি সত্যি দেখি নি । ঠিক যেন একটা পোড়া বেগুন ।


নকশী চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভাবল সে কি বলবে । সে অনেক ভেবে বলল, যখন আগুন লাগে শরীরে তার আগে দম বন্ধ হয়ে আসে তাই না ?


রাম বলল, হুম, কিন্তু যন্ত্রণা কিরকম হয় তা ভেবে দেখেছ একবার । কি ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা মেয়েটা সহ্য করেছে এই তিন মাস ভাবলে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে ।


নকশী চায়ে চুমুক দিয়ে বলল , বুঝতে পারছি । অনেক আগুন সারা জীবন মানুষকে বয়ে বেড়াতে হয় । তার যন্ত্রণা আরো ভয়ঙ্কর ।


আজকাল নকশীকে খুব অদ্ভুত লাগে । অনেক অদ্ভুত কথা সে বলে , যার যুক্তি খোঁজা সম্ভব না । বাচ্চাটা নষ্ট হবার পর থেকে ওর মধ্যে অদ্ভুত এক পরিবর্তন । ওয়াস করার সময় ওকে অজ্ঞান না করায় এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে সে গেছে , তাই হয় তো মাথার গণ্ডগোল হয়ে গেছে । বাচ্চাটা পেটে আসার পর বইয়ের তাক থেকে একটা বই বারকরার সময় নাকি একটা টিকটিকির ডিম  মাটিতে পড়ে গেছিল, তার থেকে ভ্রুনটা কিছুক্ষণ মাটিতে কিলবিল করতে করতে মাড়া গেছে । সব কিছুই নকশীর চোখের সামনে ঘটেছে । এই পাপের শাস্তি তার এই মিসক্যারেজ । এই নিয়ে ছয় মাস সে অনেক যুক্তি দেখিয়েছে । এক কথা শুনতে শুনতে সত্যি রামেরও এক ঘেয়ে হয়ে গেছে । সারা দিন অফিস সামলে বাড়ি ফিরে একজন মানসিক রুগীর সাথে বেশিক্ষণ ভালো লাগে না । তাছাড়া বৌকে দোষ দিয়ে আর কি হবে , এখানে আসার পর থেকে একের পর এক সমস্যায় জর্জরিত সে , অনেক সময় সমাধানের পথ থাকলেও পলিটিকাল প্রেশার এত বেশি যে কিছু করে ওঠা যায় না । নকশীর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেবার পর থেকে নকশীও যেন খুব চুপচাপ হয়ে গেছে । নিজের মতন করে পরিস্থিতিকে গুছিয়ে নিয়েছে সে । তার চারপাশের কোন কিছুই যেন আজকাল তাকে আর প্রভাবিত করতে পারে না । সকাল থেকে বেশিরভাগ সময় সে বাগান নিয়ে ব্যস্ত থাকে সে । এই কয়েক মাসে এত সুন্দর মশলা বাগান করেছে যা সত্যি ভাবা যায় না । প্রথম প্রথম নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করে উঠতে পারে নি ।


ঘড়ির কাঁটা রাত দুটোর ঘর ছুঁল । নকশী ঘড়ির থেকে চোখ সরিয়ে রামের দিকে তাকাল । তারপর বলল, রাম আমি তোমাকে অনেক কথা বলি নি , যে কথা গুলো বলি নি তার মধ্যে অন্যতম একটা কথা আমি বলতে চাই ।


রামের চা খাওয়া হয়ে গেছে সে চায়ের কাপ সরিয়ে রেখে নকশীর দিকে তাকাল । সে জানে সে যা শুনতে চলেছে তা খুব সাধারণ কোন ঘটনা, কিংবা এমন কোন ঘটনা যা সে আগেও শুনেছে । তবু সে নকশীর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে দেখল ।


কথাটা ভেতরে পুষে রেখে আমি খুব যন্ত্রণা পাচ্ছিলাম । কারুকে যে বলবো তাও এত দিনে বলে উঠতে পারি নি ।


রাম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, কাল ভোরে আমাকে ইনকোয়েস্ট করতে যেতে হবে, যা বলার তাড়াতাড়ি বল ।


রামের এই স্বভাবের জন্য তাদের দুজনের মধ্যে এই দূরত্ব তৈরি হয়েছে । রামের সব কথা সে মন দিয়ে শোনে । অথচ , সে যখন তার জীবনের এত বড় একটা গোপন কথা বলতে চলেছে, তখন রামের কাছে শোনার সময় নেই । এত বড় একটা কথা যা সে কারুকে বলে নি । রামকে সে কত বড় জায়গা দিলো আর রাম তা বুঝতে পাড়ল না ।


রাম সোজা হয়ে বসে বলল, কাল অফিস থেকে এসে শুনি, এখন ঘুম পাচ্ছে যে ।


নকশী বলল, রাত ছাড়া আমার যে কোন কথা বলতে ইচ্ছে করে না । রাত যত গভীর হয় আমার তত গোপন কথা বলতে ইচ্ছে হয় যে । আজ না বললে আর যে বলা হবে না ।


রাম ঘড়ি দেখে বলল দু মিনিটের মধ্যে বলো ।


নকশীর মনে হল এই দু মিনিট তো অনেক দীর্ঘ , এক মিনিটই যথেষ্ট ।


সে বলল, আমার তখন তিন বছর বয়স । আমার এক দাদা বৌদি আসে আমাদের বাড়ি , সেই দাদা আমার বাবার বয়সী । আমরা সবাই মিলে সিনেমা দেখতে গেছিলাম । সিনেমার নাম আমার মনে আছে , অভিমান । সবাই সিনেমা দেখছিল , আমি তখন ঘুমচ্ছিলাম । সিনেমা শেষে হলে আমার বাবা আমাকে আর আমার দাদাকে বাবার এক বন্ধুর বাইকে তুলে দিয়ে ওরা তিনজন ভ্যান রিক্সায় ফিরছিল । আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তো , ছোটবেলায় সিনেমা দেখলেই যে আমার ঘুম পেতো । একটা যন্ত্রণা নিয়ে আমার ঘুম ভাঙ্গে, মনে হচ্ছিল আমার মতন আরেকটা বাচ্চা যেন আমার দুটো পায়ের মাঝখান দিয়ে কেউ ঢুকিয়ে দিচ্ছে । আমি তাকিয়ে দেখলাম আমার দাদা আমার ওপর , তার চোখ দুটো লাল । মুখ থেকে জিভ বেড়িয়ে আছে, সেই জিভ দিয়ে সে আমার শরীরটা চাটছে । আমি কেঁদে উঠলাম , আমার কান্না কারুর কানে পৌছাই নি । বাবা, মা যখন বাড়ি ফেরে তখন অনেক দেড়ি হয়ে গেছিল । আমার দু পায়ের মাঝখান দিয়ে লাল আচারের তেলের মতন রঙ বেরচ্ছিল । মা সব দেখেও বাবার কাছে পুরো ঘটনাটা চেপে গেছিল ।


রাম কি বলবে ভেবে উঠতে পারছিল না । মনে হচ্ছিল মাথা খারাপ হয়ে গেছে বলে এই সব কাল্পনিক গল্প নকশী বলছে । এ কখনো সত্যি হতে পারে না ।


রাম বলল, একটা গল্প লিখে ফেলো , সময়োপযোগী গল্প হবে । আমি ঘুমতে গেলাম ।


নকশী দেখল রাম হাই তুলতে তুলতে ঘুমতে গেলো ।

নকশীর নাকে একটা তীব্র বিড়ির গন্ধ আসতে থাকল । নকশীর মনে হল সিঁড়ি বেয়ে কেউ হয় তো নেমে আসছে , তার পায়ের শব্দ সে শুনতে পেলো । চেয়ার সরিয়ে সুইচ বোর্ডে হাত দিয়ে সে আলো নিভানোর সময় হাতে চটচটে মতন একটা কিছু লাগল । নকশী দেওয়ালে হেলান দিয়ে মেঝের ওপর দু পা ছড়িয়ে বসল । অন্ধকার ছাঁদে জোনাকির মতন আলো জ্বলে উঠল । ছোট্ট নকশী গান ধরল, টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার । পাশের ঘর থেকে রামের নাক ডাকার আওয়াজ আসতে থাকল ।

(ক্রমশ)

দেবশ্রী চক্রবর্তী
কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে আধুনিক ইতিহাসে স্নাতকোত্তর। লেখিকা সমাজের বাস্তব সমস্যা এবং মানুষের মনস্তত্ত্বের অন্ধকার দিক নিয়ে লিখতে ভালোবাসে। দুই বাংলার পত্রিকা সহ গুয়াহাটি,দিল্লি এবং ত্রিপুরার বেশ কিছু পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ: শ্রীর খোলা জানালা, উমার আত্মকথা, মনবনির কাব্যকথা, খোজ, লাল চিনার পাতা, ধর্ষনের সেকাল ও একাল,  সত্যই সরাই (বাংলাদেশ এর অমর একুশে বইমেলা থেকে প্রকাশিত)।

No comments:

Post a Comment