এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

সম্পাদকীয়



অতঃপর এক অন্তর্লীন দ্রোহ
.
অভিসার। সাজানো বাগান
.
স্বাগত। ফুলে ও কাঁটায়
.
নিবিড়তর স্পর্ধায় কলম ছুঁয়ে আমাদের প্রাত্যহিক পাপ

আর, ধানাইপানাই না করে প্রথমেই দুটি কথা স্পষ্ট করে ঘোষণা করে দিই,
এক, আমরা প্রাতিষ্ঠানিক হয়েও প্রতিষ্ঠান বিরোধী।
দুই, 'এখন তরঙ্গ’ লিটল ম‍্যাগাজিন নয়।

খুব অদ্ভুত লাগছে তাই না ? কীভাবে সম্ভব একই সাথে দুটি পরস্পর বিরোধী অবস্থান ?
কীভাবে ও কীভাবে এবং কীভাবে ???
আসুন এবার খুঁজি সেটাই এবং এই খোঁজের পথে আমাদের প্রথমেই হেঁটে যেতেই হবে ‘এখন তরঙ্গে’র মধ্যে দিয়ে আড়াআড়ি, চোখ রাখতেই হবে ‘এখন তরঙ্গে’র চরিত্রে,
‘এখন তরঙ্গ’ কী ও কেন, এই প্রশ্নের উত্তরে।

খুব স্পষ্ট করে একটা কথা আমরা আগেই ঘোষণা করেছিলাম, ‘এখন তরঙ্গ’ হতে চায় বাংলা সাহিত্যের এমন একটি সাহিত্য পত্রিকা যেখানে সবাই স্বাগত।
সব গোষ্ঠী, সব ইজম্, সব ধারার কলম অনায়াসে মিলবে ও মেলাবে, ঢেকে দেবে সেই সমস্ত ফাটল, যা বাংলা সাহিত্যের গায়ে পুরনো ক্ষতের মতো যন্ত্রণা এবং যন্ত্রণার ইতিহাস লিখে চলেছে প্রতি মুহূর্তে। সোজা কথায় ‘এখন তরঙ্গ’ হতে চায় বাংলা সাহিত্যের একটি Open platform। অবশ্য আর চায় নয়, আমরা চেয়েছিলাম এবং পেরেছি। আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি একটি মাত্র সাহিত্য পত্রিকা অনায়াসে বেঁধে ফেলতে পারে সাহিত্যের সমস্ত ধারা, ভেঙে ফেলতে পারে আমি-তুমি, আমরা-তোমরার দীর্ঘ ধূসর ইতিহাস।

ভয় ছিল, চিন্তায় ছিলাম পারবো তো? কিন্তু বিশ্বাস ছিলো আমাদের নিজেদের উপর, আর বিশ্বাস ছিলো আপনাদের উপর।
হ‍্যাঁ, আপনাদেরই উপর।

কিন্তু প্রশ্ন হলো এমন পত্রিকার প্রয়োজন কেন? কী প্রয়োজন সাহিত্যের সব ধারাকে ধরার ? তা করতে গিয়ে এই যে এতো লেখা একটা সংখ‍্যায়, তা কী একমাসে কেউ পড়ে ফেলতে পারবে?

পারবেনা তো, জানি তো। তবু দরকার আছে, কেন? আচ্ছা বইমেলার প্রয়োজন কী? কারো যদি প্রয়োজন হয়, বইয়ের দোকান থেকে পছন্দের বইটি নিয়ে পড়ে ফেলতেই পারে। তাহলে বইমেলার দরকার কোথায়? একসাথে এতো বই ! এত্তো বই ! এতো ধরনের বই,
পাশাপাশি।কাছাকাছি।মুখোমুখি।কোলাকুলি
কেন? প্রয়োজন কী? একজনের পক্ষে কী সব বই হাতে তুলে নিয়ে দেখাও সম্ভব?
না, সম্ভব নয়, তবু বইমেলার প্রয়োজন ঠিক যে কারণে, ‘এখন তরঙ্গে’র প্রয়োজন ঠিক সেই কারণেই।

ধরা যাক, ‘ক’ বাবু লেখেন আপডেটেড কবিতা, আর ‘খ’ বাবু ছড়া। এই দুই বাবুর মুখোমুখি তো দূরের কথা, কানাকানি হওয়াও অসম্ভব কোন পত্রিকায়, এমন কোনো পত্রিকাই প্রায় নেই। কেউ পড়েনা, দেখেনা, শোনেনা নিজের গন্ডির বাইরে অন্য কিছু। নিজের মত ও পথটিকেই ঠিক এভারেস্টের মাথায় চাপিয়ে ঢাক, ঢোল কাঁশির হুঙ্কারে মহোৎসব। ঠিক এইখানেই প্রয়োজন পড়ে একটি আয়নার, মুখোমুখি নিজের সাথে….

‘এখন তরঙ্গ’ আসলে সেই আয়নাটি।
এখন তরঙ্গ’ প্রতিটি কলমের সামনে ঝুলিয়ে দিয়েছে একটি প্রশ্ন,
তুমি শ্রেষ্ঠ? তুমিই শ্রেষ্ঠ? এবং তুমিই শ্রেষ্ঠ?
তুমি যা বলো, যা করো, সেটাই একমাত্র ?
তুমি ছাড়া বাংলা সাহিত্য কানা? খোঁড়া?
ভাবো, একটু ভাবো, আর একবার ভাবো, চোখ মেলে চেয়ে দেখো তোমার চারপাশের কলমদের, তাঁরাও নিজেদের মতো এঁকে চলেছে ছবি, যেমন তুমি আঁকো। এবার বলো তো তুমি আদতে কী ও কেন?
উত্তর একটাই তুমি একটি কলম মাত্র। অন্য অনেক কলমের মতো তুমিও এঁকে চলেছো কিছু ছবি। এই টুকরো টুকরো ছবির কোলাজেই গড়ে উঠেছে বাংলাসাহিত‍্যের পূর্ণ একটি রূপ। তোমার ছবিটি একটি টুকরো মাত্র। না তুমি, না তোমার কলম নিয়ন্ত্রন করতে পারে বাংলা সাহিত্য। তোমার ধারাটিও বাংলা সাহিত্যের নিয়ন্ত্রক নয়।

এখান থেকেই শুরু হয় আমাদের যাত্রা, আমরা মাথা নুয়েছি শুধুমাত্র বাংলা ভাষার কাছে। কোনো একটি পত্রিকা, যা সাহিত্য পত্রিকার মুখোশের আড়ালে আদতে একটি রাজনৈতিক পত্রিকা, তার দাদাগিরির শেষের শুরু হয়ে গেছে। বাংলা সাহিত্যের নিয়ন্ত্রক হবে একমাত্র বাংলা সাহিত্য নিজে, প্রত‍্যেকটি কলম স্বীয় ক্ষমতায় লিখে যাবে নিজের মতো করে, কারো বলার অধিকার নেই, এটা ঠিক বা এটাই ঠিক এবং এইভাবেই ঠিক। কলম নিজেই খুঁজে নেবে তার পথ এবং সে যে পথে চলবে সেটাই সঠিক। এভাবেই ভিন্ন ভিন্ন ধারার কলমের কোলাজেই উৎকৃষ্ট হবে বাংলা সাহিত্য তথা বাংলা ভাষা।

আমরা নির্মূল করতে চাই ‘দাদাবাদ’ (‘ডাডা’ নয়)। চাই নয়, করব এবং করবই,
কথা দিলাম।

আমাদের কোনো ভাড়াটে কলম থাকবে না কোনদিন। খুব স্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করছি,
‘এখন তরঙ্গ’ তৈরী করবেনা কোনদিন কোনো কবি/লেখক গোষ্ঠী।

আমাদের সহযোগী, সহমর্মী বা আমাদের অফিসিয়াল মেম্বারদের লেখাও যে ‘এখন তরঙ্গে’ ছাপা হবেই এমন নিশ্চিত শর্তে বিশ্বাস রাখিনি আমরা, রাখবোও না।(এই নিয়মটি যাতে অনিয়মে পরিণত না হয় তার জন্য প্রধান সম্পাদক হিসাবে আমি কখনো 'এখন তরঙ্গে' লিখবনা)।

‘এখন তরঙ্গে’ লেখা প্রতিটি কলম থাকবে স্বাধীন, পূর্ণ স্বাধীন। কলম যা চায় তাই লিখবে, পত্রিকার জন্য বদলে ফেলতে হবে না কলমের নিজের ভাষা।
‘এখন তরঙ্গ’ কোনদিন কোনো কবি/লেখকের সাথে এমন কোনো শর্ত ঝোলাবে না যে, ‘এখন তরঙ্গে’ লিখতে গেলে অমুক পত্রিকায় লিখতে পারবেনা বা ‘এখন তরঙ্গে’ লিখতে গেলে ঢাক, ঢোল, কাঁসি নিয়ে নেমে পড়তে হবে ‘এখন তরঙ্গে’র নাম সংকীর্তন করতে।
এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘এখন তরঙ্গে’র লেখা কলমের পূর্ণ অধিকার আছে ও থাকবে পত্রিকাটির সমালোচনা করার এমনকি বিরোধিতা করারও, তার জন্য কখনও তার লেখা বাতিল হবে না। (যদিও কোনো লেখা ঠিক বাতিল হয়না, আমাদের কোনো অধিকার বা যোগ্যতা নেই, কোনো লেখাকে বাতিল বলে দেগে দেওয়া। কিন্তু পত্রিকার জন্য আমাদের লেখা বাছাই করতেই হয়, লেখা বাছাইয়ের একটিই মাত্র সূত্র হতে পারে, তা হলো, সবচেয়ে বেশি ভালোলাগা লেখাগুলোকে বেছে নেওয়া। 'এখন তরঙ্গ' সেই সূত্রই মেনে চলে ও চলবে।)

এখানেই আমরা প্রাতিষ্ঠানিক হয়েও প্রতিষ্ঠান বিরোধী। এখানেই আমরা একই পথের পথিক ‘লিটল ম্যাগাজিনে’র সাথে। তবু ‘এখন তরঙ্গ’ লিটল ম্যাগাজিন নয় কেন ? আমরা এবার সেই উত্তরটিই খুঁজবো।

আচ্ছা, লিটল ম্যাগাজিন আদতে কী?
লিটল ম্যাগাজিন একটি দ্রোহ, একটা আওয়াজ, কিছু বলতে চাওয়া, কিছু শোনাতে চাওয়া, লিটল ম্যাগাজিন আদতে একটি আন্দোলন। লিটল ম‍্যাগাজিন আদতে আপাত দূর্বলের হার নিশ্চিত জেনেও, নিজ শক্তিকে স্বীকার ও শ্রদ্ধা জানিয়ে আপাত শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক অচলায়তনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। প্রতিটি লিটল ম্যাগাজিনের নিজস্ব এবং নির্দিষ্ট একটি বক্তব্য আছে, সাহিত্য যাপন নিয়ে আছে নিজস্ব এক রূপ রেখা, আমাদের নেই। আমরা কিছু বলতে চাইনা আমরা শুনতে চাই। আমরা শুনতে চাই প্রতিটি কলমের নিজস্ব ভাষা। আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইনা কলমকে, কলম নিয়ন্ত্রণ করুক ‘এখন তরঙ্গ’কে। যেহেতু আমাদের নিজস্ব কোনো ভাষা নেই, যেহেতু আমাদের নিজস্ব কোনো বক্তব্য নেই, যেহেতু আমরা ঝুলিয়ে দিইনি কোনো মূলো, যেহেতু আমরা কখনো বলিনি, ‘এখন তরঙ্গে’ লিখতে গেলে এইভাবে লিখতে হবে এবং এইভাবেই লিখতে হবে, তাই ‘এখন তরঙ্গ’ লিটল ম্যাগাজিন নয়।

অতঃপর, নিশ্চিত হার জেনে যুদ্ধ করার ইচ্ছা আমাদের নেই, আমরা যুদ্ধে নেমেছি জিত নিশ্চিত জেনে, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাই আমরা সম-শক্তির সূত্রে আস্থা রেখেছি।


জ‍্যোতির্ময় মুখার্জি
Chief editor at 'এখন তরঙ্গ'

No comments:

Post a Comment