বিষয় : মুক্ত গদ্য
ছায়াপথে ছাতা হাতে কয়েকটি মানুষ
ও
একটি চলমান ইনফিনিটি
প্রশ্ন এটা নয় যে, ছায়াপথে মানুষগুলো কেন?
প্রশ্ন এটাও নয় যে, ইনফিনিটি’টি কেন চলমান…..?
প্রশ্ন এটাই যে, আচ্ছা, মানুষগুলো ছাতা হাতে কেন?
ছায়াপথের শূন্যতায় মানুষগুলোর হঠাৎ ছাতার প্রয়োজন হলো কেন?
তারা কি পারতোনা,
ভিজতে।হঠাৎ।বৃষ্টিতে ???
প্রশ্নের উত্তর আমি পাইনি, খুঁজছি…..
আচ্ছা, আপনারাও কি পারেন না, খুঁজতে ?
আমাকে একটু সাহায্য করতে? হয়তো পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়া পথেই পেয়ে যাবো উত্তরটা।
এই দেখেছেন, একদম ভুলে গেছি, আপনাদের তো বলাই হয়নি, না-পাওয়া উত্তরের পিছনে লুকিয়ে থাকা যে প্রশ্ন, সেই প্রশ্নের পিছনেও লুকিয়ে থাকা মূল প্রশ্নটাই, সেটা না বললে আপনারাই বা কিভাবে খুলিতে খুলি ঠুকবেন, হাতে রাখবেন হাত……?
তাই, আসুন, ব্যপারটা একটু (না)খুলেই বলা যাক।
একটা নতুন ছেলে হঠাৎ ছিটকে এসে পড়লো কবিতার জগতে, নিরাপদ ও নিরপেক্ষ দূরত্ব থেকে গোগ্রাসে চাখতে ও গিলতে লাগলো
না-দেখা অদ্ভুত সুন্দর একটা জগত, বদ-হজমের ভয় না করেই, এবং (না)শেষে ছাতাহাতে মানুষগুলোকে দেখে থমকে গেল, সে তো বৃষ্টিতে ভিজতে এসেছিল, তাহলে এই মানুষগুলোর হাতে ছাতা কেন?
দেখছেন আবার রহস্য করছি, কি করবো বলুন, জাতে তো কোবি (‘ক’-এর ঢাকনাটা এখনো খুলতে পারিনি), তাই রহস্য রক্তে। না, আর রহস্য নয়, এবার সরাসরি সহজ গদ্যেই বলি।
ছেলেটি আমি, এই বছরের গোড়ার দিকে পার্বতীদির (পার্বতী রায়) হাত ধরে ঢুকে পড়লাম কবিতার জগতে, যখন উনি আমাকে জুড়ে দিলেন ‘কবিতা পাক্ষিক’-এর Whatsapp group-এ,
এবং একটি সুন্দর অঘটন…….
‘কবিতা পাক্ষিক’ বা সিরিয়াস কবিতার জগতটা ঠিক কী ? এটা না জেনেই ফেবুকবির লাইক, কমেন্টের দম্ভে জুড়ে দিলাম তর্ক, সরাসরি প্রশ্ন করলাম, এগুলো কি কবিতা নাকি? যতসব খটাং-খটাং…..আপনারা কবিতা লিখতেই জানেন না, এবং আপনারা বোঝেন না কবিতা কী…...দেখুন আমি কতো সুন্দর কবিতা লিখি…...কি সুন্দর মন ও গাল ভরানো কবিতা……
তাদের উত্তরটা হওয়া উচিত ছিলো আমাকে দুষ্ট গরু জ্ঞানে দূর করে দেওয়া, তাঁরা যে সেটা করেননি, তাঁর প্রমাণ তো আপনারা ‘ছাতা’-র কারণ অনুসন্ধানেই পেয়ে গেছেন। তাঁরা যেটা করলেন সেটা হলো, আমাকে বদলে ফেললেন, ঠিক আমাকে নয়, আমার চিন্তা-ভাবনাকে, কবিতাকে দেখার একটা চোখ তৈরী করে দিলেন। হ্যা, আমি নির্দিদ্ধায় স্বীকার করছি, আমি ‘কবিতা পাক্ষিক’-এর প্রোডাক্ট, ভবিষ্যতে যদি আমি কখনো এটা অস্বীকার করি তাহলে জানবেন সেটা আমার দম্ভ, সত্যভাষন নয়। ‘কবিতা পাক্ষিক’ নতুনদের হাত ঠিক কতোটা শক্ত করে ধরে, কতোটা space দেয় নতুনদের, তার অগনিত উদাহরণের মাঝে একটি উদাহরণ, আমার প্রথম কবিতা প্রকাশ ‘কবিতা পাক্ষিক’-এ ১৫ ই জুলাই। এবং আজো ‘সুন্দরের পথে’ খুঁজে চলেছি কবিতা ও কবিতার জগতের আপাত কলুষিত পথে কবিতার সৌন্দর্যটা।
‘কবিতা পাক্ষিক’ মূলত চর্চা করে ‘আপডেটেড কবিতা’র। আপডেটেড কবিতাটা ঠিক কী?
প্রশ্নটা করলাম নিজেকে এবং খুঁজতে লাগলাম উত্তর,
দেখলাম, বাঙালি নারী কাপড় ছেড়ে টপ্-প্যান্ট পড়েছে,
লাবন্যময়ী বাঙালি নারীর ঝকঝকে স্মার্ট উপস্থিতি। এবং টপ্-প্যান্ট গায়ে চড়াতে গেলে যা অবশ্য করণীয়, অতিরিক্ত মেদ ঝড়িয়ে জিরো ফিগারের বাঙালি তন্বী।
হ্যা, এটাও ঠিক, পোশাক ভেদ করে কখনো কখনো উঁকি মারে যৌনতা, মেদহীন শরীরে, হাড়ের খটখটানি শোনা যায় কানে, কখনো কখনো সে বড্ডো হৃদয়হীনা, শুষ্কং-কাষ্ঠং…..কিন্তু এটাই সত্যি এবং এটাই বাস্তব, এটাই আপডেটেড বাঙালি নারী, এবং এটাই ‘আপডেটেড কবিতা’।
‘আপডেটেড কবিতা’য় আবেগসর্বস্ব বহিঃপ্রকাশ, অন্তমিল, পংক্তিতে যুক্তহীন যতিচিহ্নের প্রয়োগ বর্জনীয়, এবং এই যুক্তিটা ব্যকারণের মধ্যে খুঁজলেও হবে না, কারণ কবিতার ব্যকারণ বা আরো ভালো করে বললে কবিতা কায়া নির্মাণের ব্যকারণ সম্পূর্ণ আলাদা। তবে, বানানের সূচিতা এখানে সযত্নে রক্ষিত। ভাষা হবে এই সময়ের, যে ভাষায় আমি এই মূহুর্ত্তে কথা বলছি, সেই ভাষাতেই লেখা হবে কবিতা, কবিতার ভাষা ও দৈনন্দিন জীবনের ভাষা আলাদা হবে না, কবিতার কাঠামো নির্মাণে কবির স্বাধীনতা আছে এবং প্রতি মূহুর্তে নির্মাণ-বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত হবে কবিতার কায়া। এবং শব্দের শক্তিকে ভীষন ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, জোর দেওয়া হয়েছে শব্দের inertia ভাঙার। ভাব নয়, শুধুমাত্র শব্দের প্রয়োগের মধ্যে দিয়েও নির্মাণ হতে পারে কবিতা, যার tenacity অর্থহীনতার দিকে। অর্থহীন কিছু শব্দের সারির শক্তিশালী ও যুক্তিপূর্ণ বিন্যাসও একটি কবিতা।
বাকি সব ঠিক ছিল, ‘আপডেটেড কবিতা’র এই অর্থহীনতার ছোঁকটা তখন আমার মন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলনা, কবিতার কোনো কেন্দ্রীয় ভাব বা বক্তব্যে থাকবে না, অর্থহীন কিছু শব্দের দৃষ্টিনন্দন উপস্থিতিও একটা কবিতা ?
একটামাত্র ইন্দ্রিয়(চোখ) দিয়ে কবিতাকে গ্রহণ করতে হবে এবং বোধটাকেও অবরুদ্ধ করে বোধগম্য করতে হবে কবিতাকে ?! এটা আমার চিন্তা-ভাবনার সাথে সেই মুহূর্তে ঠিক খাপ খাচ্ছিলনা, একটা দ্বন্দ্ব বয়ে বেড়াচ্ছিলাম, এখান থেকেই মুক্তি পেলাম আফজলদার (আফজল আলি) ‘জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্ট’-এ। বুঝতে পারলাম জিবাকেই কবি ও কবিতার মুক্তি, কবিতার উৎকর্ষতার পথে ও সাথে প্রাণেরও আরাম।
জিবাক নিয়ে এর আগে বিস্তারিত ভাবে লিখেছি আমার পর্যবেক্ষণ, তাই এখানে আর বিস্তারিত অনুসন্ধানে যাবোনা, কিন্তু যে ব্যপারটা একেবারেই না বললে নয়, সেটাই এখানে বলবো।
‘আপডেট কবিতা’র পরবর্তী পর্যায়ে আসছে জিবাক, তাই ‘আপডেটেড কবিতা’র যে বৈশিষ্ট্যগুলি এতোক্ষন বললাম, তার অনেকগুলিই গ্রহণ করেছে জিবাক, শুধু এই অর্থহীনতার ঝোঁকটা গ্রহণ করেনি
এবং তন্বীর টপ্-প্যান্টের ফাঁকে আকর্ষণীয় ও মোলায়েম ‘পেটি’র আয়োজন।
জিবাকে যে জিনিসটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, অপরিশীলিত কবিতা থেকে পরিশীলিত কবিতার যাত্রাপথের প্রতিটি ধাপ বা ক্রমপর্যায়কে গুরুত্ব দিয়ে ধরা ও স্বীকৃতি দেওয়া। এই সিঁড়ির গুরুত্ব অন্য কোথাও সেভাবে পাওয়া যায় না, সবাই গুরুত্ব দিয়েছে লক্ষ্যকে বা ছাদকে, জিবাক গুরুত্ব দিয়েছে সিঁড়িকে, কারণ জিবাকের সিঁড়ি আসলে ‘স্বর্গের সিঁড়ি’, সিঁড়ির অন্য প্রান্তে কোনো ছাদ বা প্লাটফর্ম নাই, সিঁড়িটা চলে গেছে
এঁকে বেঁকে একটি তারার খোঁজে।
এই খোঁজটাই জিবাক, প্রতিমুহূর্তে নতুনত্বের অন্তহীন অন্বেষণটাই জিবাক, তাই সফলতা বা ব্যর্থতা এই কথাগুলো জিবাকের কাছে অর্থহীন, জিবাক সফল হতে পারে না, জিবাক ব্যর্থও হতে পারে না, জিবাক শুধু কাজ করে যেতে পারে এবং কাজের আনন্দে।
“কর্ম্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন”
মা কর্ম্মফলহেতুর্ভুর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্ম্মণি।।
মা কর্ম্মফলহেতুর্ভুর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্ম্মণি।।
জিবাকের ‘জিরো’ আসলে সিঁড়ির অপরপারের এই অন্তহীন শূন্যতাটা, তুমি প্রতিমুহূর্তে সিঁড়ি ভেঙে উঠে যাও, প্রতিটি ধাপের পরে তোমার সামনে খুলে যাবে আর একটা নতুন সিঁড়ি, তোমাকে কেউ থামতে বলবে না, তোমার ব্যর্থতারও ভয় নেই, কারন জিবাক তোমার প্রতিটি পদক্ষেপকে গুরুত্ব ও স্বীকৃতি দেয়।
এছাড়া, জিবাকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, জিবাক মেলাতে চায়, বিভেদ নয়, মিলনের শান্তিতেই জিবাক বাস করে এবং এটা শুধু কবিতা বা সাহিত্য জগতের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক, ধর্মীয় বিভেদের এই কোলাহলে জিবাক ছেটাতে পারে মিলনের শান্তি-জল। জিবাক স্পষ্ট করে বলতে পারে,
আগুন খেলা তো অনেক হলো/এবার ঘরকে চল
এটাই জিবাকের আসল শক্তি এবং জিবাকের গ্রহনযোগ্যতার মূল কারণ।
আফজলদার কাছে কবিতা বোঝার বা আমার অনেক কবিতার পরিশোধিত রূপের জন্য ভীষন ভাবে ঋণী এবং জিবাকের জন্যেও। জিবাক নিয়ে মৌলিক চিন্তা-ভাবনার সাহসও পেয়েছিলাম আফজলদার কাছেই, কিন্তু বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছে জিবাক পথভ্রষ্ট হয়েছে বা হচ্ছে, যদিও জিবাকের পথ চলা নতুন, সময় ও সুযোগ আছে সংশোধনের, তাছাড়া জিবাক কনসেপ্টেই এই সংশোধনের বীজ পোঁতা আছে, জিবাকে কোনো কিছুই স্থির বা নির্দিষ্ট নয়, প্রতিমূহুর্তে পরিবর্তনশীল, এবং জিবাক শুধুমাত্র একটি পত্রিকাকেন্দ্রীক গোষ্ঠী বা ক্রিয়াকলাপ নয়, জিবাক তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু হওয়ার দাবি রাখে, আমি আশা করবো, আফজলদা ও টিম জিবাক, জিবাকের শক্তির যথাযোগ্য মর্যাদা দেবে।
এরপর আমার প্রবেশ (পূর্ববর্তী কোনো জায়গা থেকে প্রস্থান না করে, প্রবেশ মানেই কি তার বিপরীতে আবশ্যিক একটি প্রস্থান?) i-sociaty-তে। যার হাত ধরে সেই রাহুলদার (রাহুল গাঙ্গুলী) বিস্তারিত অনুসন্ধান করবো অন্য কোন এক সময়, কারন এখনো আমি রাহুলদাকে এতোখানি বুঝে উঠতে পারিনি যে, তাঁকে নিয়ে কিছু বলার সাহস আছে। তবু ছোট্ট করে তাঁকে নিয়ে একটু বলতেই হবে, কারন আমার কবিতা ভাবনার বেশিরভাগটাই রাহুলদার তত্ত্বাবধানে, এই লেখাটা যখন লিখছি, তখনও জানি, কোথাও কোনো input এর প্রয়োজন হলে রাহুলদাকে ফোন করলে, সেটা রাত দুটো হোক বা তিনটে, ঠিক তার সাহায্য পাবো। ঠিক যেমন একটু আগে শাল্যদানীকে ফোন করে জেনে নিলাম হঠাৎ সম্পূর্ণভাবে মনে না আসা সংস্কৃত শ্লোকটা। এব্যাপারে সৌমিত্রদাও আমাকে ভীষন ভাবে সাহায্য করে চলেছেন।
‘কবিতা পাক্ষিক’-এ ঢোকার পর থেকেই দেখতাম, একজন কবিতা পোস্ট করছে, কিছু ‘অর্থহীন’ খটখটাং শব্দের সারি, নিচে লেখা,
শব্দরূপ : রাহুল।
মনে মনে ভাবতাম, বেশি বেশি, কবিতা লিখতে জানেনা, কিছু উল্টো পাল্টা কঠিন কঠিন শব্দকে পাশাপাশি বসিয়ে কবিতা বলে চালিয়ে দেয়, আবার style মেরে লিখছে শব্দরূপ এবং রাহুল, surname ছাড়া।
একদিন, সরাসরি একটা কবিতা পাঠিয়ে জিগ্যেস করলাম, আপনার এই কবিতাটির অর্থ বুঝিয়ে দিন তো।
(তখনও এই বোধটা আসেনি যে, একজন কবিকে তার নিজের কবিতার অর্থ বুঝিয়ে দিতে বলা ঠিক কতখানি অপরাধ, ভাগ্যিস বোধটা আসেনি তখন এবং ভাগ্যিস অপরাধটা করছিলাম, তাই তো ……)
বলা মাত্রই, নির্দিদ্ধায় উনি বুঝিয়ে দিলেন ওনার কবিতা এবং আমি বুঝতে পারলাম আমি একটি কতবড়ো ‘গর্ধব’।
কবিতাকে চেনা, বোঝা ও জানার একটা বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণ তৈরি হলো, এবং ‘শব্দরূপ’ এর অর্থ ও প্রয়োগের কারনটাও খুঁজে পেলাম। এখানে আমি রাহুলদার এই ‘শব্দরূপটা’ নিয়েই বলবো, বাকি কথা ‘কাল’ হবে।
আমি যতদূর জানি, বাংলা কবিতায় এই ‘শব্দরূপ’-এর ব্যবহার প্রথম ও একমাত্র রাহুলদাই করে। এই ‘একমাত্র’ শুনে চমকাবেন না, ভাবছেন তো, বেশ কিছু জনের দেখেছেন ‘শব্দরূপ’ ব্যবহার করতে, তাহলে কেন ‘একমাত্র’ বলছি, কারন তারা যেটা করে বা করেন, সেটা রাহুলদার নকল করে এবং না জেনে ও বুঝে।
যারা ‘শব্দরূপ’ কী, এটা জানে, তারা কারো লেখা পড়েই বলে দেবে, এটা ‘শব্দরূপ’ না ‘কবিতা’?
আবার চমকে গেলেন?
ভাবছেন, শব্দরূপ আর কবিতা এক নয়?
না, এক নয়তো।
তাহলে, রাহুলদা কবি নয়?
না, একদমই নয়।
তাহলে রাহুলদা কী?
ঠিক জানিনা, হয়তো ‘শব্দরূপী’ বা ‘শব্দরূপকার’,
নাম নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না, যাইহোক, তিনি একমাত্র।
কিন্তু কেন?
আমরা এখন সেটারই অনুসন্ধান করবো।
শব্দরূপের জন্য যেটা প্রয়োজন সেটা হলো একটা কবিতা যাপন, ব্যক্তিগত জীবনে একটা ‘বোহেমিয়ানতা’, সুখী সুখী গৃহকোণে শব্দরূপের কোনো স্থান নেই। অপ্রাপ্তির ‘হা।হা।কার’(সৌমিত্র রায়) শব্দরূপের মূল ভিত্তি।
শব্দরূপকার নির্দিদ্ধায় এবং ‘ঘোমটা না টেনে’ ব্যক্তিগত জীবন যাপন প্রোথিত করবেন শব্দের নিশ্চিত আশ্রয়ে। প্রতি মূহুর্তে ঘটে চলা তার চারপাশের ঘটনাবলী, তার ব্যক্তিগত জীবনের উত্থান-পতন, রাগ-হিংসা-প্রেম-যৌনতা-ঘৃণা কোনোরকম আড়াল না রেখেই ব্যক্ত করবেন শব্দের মধ্য দিয়ে এবং শব্দে থাকবে একটা দাপুটে অভিব্যক্তি বা force, আসলে শব্দরূপ হলো, শব্দের আশ্রয়ে মূহুর্ত যাপন বা ‘মূহুর্ত কবিতা’।
তাই শব্দরূপে কোনো surname ব্যবহারের সুযোগ বা অধিকার নেই, কারণ ব্যক্তিজীবন এখানে অবলুপ্ত,
ঢুকে পড়েছে সরাৎ করে শব্দের আশ্রয়ে, কবি ও কবিতা এখানে এক, কবিতা আসলে এখানে কবির প্রতিটি মূহুর্তের প্রতিকৃতি। তাই কবিতা নয় শব্দরূপ, কবি নয়, শব্দরূপকার। নামের উপস্থিতিটাও আসলে এখানে অতিরিক্ত, নামটা এখানে শুধু চিহ্নিতকরণের জন্য, ব্যক্তিপরিচয়ের জন্য নয়।
i-sociaty-তে ঢুকে আমি কবিতার মিসিং-লিঙ্ক গুলো খুঁজে পেলাম, আরো ভালো করে বললে, এই সময়ের কবিতার বিভিন্ন কনসেপ্ট বা যুগের উৎসটা দেখতে পেলাম স্পষ্ট করে। এই উৎসটি হলো ‘শব্দ-কবিতা’। এই উৎসেরও একটি উৎস আছে, আগে সেটাই বলেনি।
“রানার ছুটেছে তাই ঝুম্ঝুম্ ঘন্টা বাজছে রাতে
রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে,
রানার চলেছে, রানার !
………………
রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে,
রানার চলেছে, রানার !
………………
………………
রানার ! রানার !
জানা-অজানার
বোঝা আজ তার কাঁধে,”
রানার ! রানার !
জানা-অজানার
বোঝা আজ তার কাঁধে,”
এই বোঝাটি যখন রানার তাঁর কাঁধ থেকে নানামিয়েও ভাগ করে নিলো তথ্যপ্রযুক্তির সাথে, তখনই সাহিত্যের জগতেও খুলে গেলো একটি নতুন দরজা, সাহিত্যের ভাষাও গেলো বদলে, সাহিত্য বা কবিতা পেলো একটা নতুন রকমের ভাষা, স্পষ্টতই সে অনুভব করলো শব্দের শক্তিকে। এই পথটা প্রথম খুললো Ham radio-র হাত ধরে।
…...বিপ-বিপ/Calling-alfa-caliing/বিপ-বিপ……….
এইপথেই উঠে এলো এখনকার যাবতীয় কনসেপ্টের মূল ভিত।
যেখানে একটি শব্দ স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে আসলে একটি পূর্ণ কবিতা, এটাই এখনকার যাবতীয় কনসেপ্টের মূল কথা। যা ছিলো মূলত বার্তা প্রেরণের মাধ্যম, সেটাই
কবিতার জগতে একটি শক্তিশালী কবিতার ভাষার জন্ম দিলো, এবং কালক্রমে আমূল বদলে দিলো ‘কবিতার সহজ সমীকরণ’। শব্দের শক্তিকে এই প্রথম একটা নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা হলো, এবং এটা আস্তে আস্তে অনুভূত হলো, একটি বা গুটিকয়েক শব্দ দিয়ে যদি বার্তার আদানপ্রদান করা যায় তাহলে কবিতাতেও এর প্রয়োগ সম্ভব, পাঠকের সাথে আদানপ্রদানও সম্ভব ওই একটি বা গুটিকয়েক শব্দের মধ্যে দিয়েই। এই মূল কনসেপ্টটাকে সামনে রেখেই খুব দ্রুত গতিতে কবিতায় ভাঙচুর শুরু হলো।
আসুন এবার দেখি, ঠিক কতটা ভাঙচুর হলো এবং এখনো কতটা ভাঙচুর করা বাকি আছে আমাদের বা আমাদের পরবর্তী জেনারেশনের জন্য।
শব্দের শক্তিকে অনুভব করে উৎপত্তি যে শব্দ কবিতা, বিশ্বসাহিত্যে সেটা এলো জাপানি সাহিত্যের হাত ধরে, পৃথিবীর প্রথম শব্দ-কবিতা ‘হাইকু’।
তথ্য ঘেঁটে দেখতে পাচ্ছি, বাংলা সাহিত্যে এটা প্রথম করলেন সৌমিত্রদা (সৌমিত্র রায়), অবিকৃত ভাবে তথ্যটা তুলে দিচ্ছি,
“ ৩১ ডিসেম্বর, ২০০২
জাপানি হাইকু কবিতার রেকর্ড ভেঙে বাংলায় রচিত হল ক্ষুদ্রতম কবিতা - শব্দ’-১। প্রথম কবিতাটির নাম ট্রেকিং। প্রচারিত হল মস্কো থেকে, ভয়েস অফ রাশিয়ার অনুষ্ঠানে।”
- শব্দ’১।। পরিমিত শব্দ কবিতা
- ট্রেকিং
- পা-হাড়।
(‘পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম শব্দকবিতা-শব্দ’১ এবং অনান্য শব্দ কবিতা’, সৌমিত্র রায়, পৃষ্ঠা -১২)
শব্দ-কবিতা আসলে কী? ব্যপারটা আর কিছুই নয়, এটি আসলে একটি ‘অ্যাটম বোম্ব’
যে সূত্রে একদিন ধ্বংস হয়েছিল হিরোশিমা ও নাগাসাকি, ঠিক সেই একই সূত্রে জাপান ফিরিয়ে দিলো গোটা বিশ্বকে বিন্দুর/শূন্যের অসীম শক্তি
(এখানে e = mc2, সূত্রটা কাছে লাগাতেই পারতাম, এবং সেটাই উপযুক্ত হতো, ইচ্ছা করেই সুযোগটা নষ্ট করলাম, কারণ এই নিয়ে টুকটাক কিছু বিশ্লেষণ চোখে পড়েছে আমার, এবং প্রতিটি চিন্তন মনে দাগ কাটার মতো, এই মূহুর্তে তাই এটা ব্যবহার করতে গেলে, মৌলিক কোনো ভাবনা দিতে পারতাম না, অক্ষম নকল বা সোজা কথায় চুরি করা হতো, এই লেখাটা আমি লিখছি সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষ দূরত্ব থেকে, ব্যক্তি ‘আমি’ কে অবলুপ্ত করে, যদি কোনোদিন পারি, এই নিয়ে মৌলিক কিছু ভাববো)
এতোদিন শব্দকে দেখা হচ্ছিল পংক্তির অংশ হিসেবে,
(আমরা যে সময়ে এখন রয়েছি, তখন ‘পংক্তি কবিতা’র স্পষ্ট ঘোষণা হয়ে গেছে) একক শব্দের কোনো ভূমিকা নেই, সে পংক্তির অংশ বিশেষ, শব্দ কবিতায়, শব্দ, পংক্তির আশ্রয় ত্যাগ করলো, এবং একটি শব্দই একটি পূর্ণ কবিতা হয়ে উঠলো, উপরের উদাহরণটি লক্ষ্য করুন, একটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, ‘পাহাড়’, এবং শব্দটিকে ভাঙা হয়েছে যতিচিহ্ন দিয়ে, পা-হাড়, এবার শিরোনামটা লক্ষ্য করুন, ট্রেকিং। এবার পড়ুন….
কি? পায়ে টান ধরছে তো? হাড়ে টনটন করছে ?
ভাবছেন আর পাহাড়ে উঠে লাভ নেই বাবা,
হা।হা।কার রব তুলছেন কেন?
বেশ, ঠিক আছে, ছেড়ে দিলাম
(বিস্তারিত উদাহরণ দিয়ে ব্যখা অপ্রয়োজনীয় মনে করছি, এর প্রয়োগ এখন প্রায় প্রতি কবিতায়)
কিন্তু, একটু ভাবুন তো ব্যপারটা একটু অন্য ভাবে,
ধরুন, কবিতা = নদী
এতদিন বেশ কুলকুল করে বয়ছিল, কি সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বাধাহীন একটি অখণ্ড স্রোত,
হঠাৎ বাঁধ (শব্দ কবিতা, যতিচিহ্নের ব্যবহার)পড়লো, নদী আর তার জলের(কবিতার ভাব) ব্যবহার আর একমুখী রইলোনা,
খাল কেটে সেচের কাজে ব্যবহৃত হলো(কবিতার কেন্দ্রের বাইরে কবিতার অর্থ/অর্থহীনতার ঝোঁক), জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলো(শব্দে ফোর্স প্রয়োগ/শব্দের বহুমাত্রিক নির্মাণ),
মাছ চাষ (নতুন বা মিশ্র শব্দ সৃষ্টি),
পর্যটন (কবিতার কায়া নির্মাণে জ্যামিতি, বাস্তব ছবি, ইত্যাদির ব্যবহার/ স্মার্ট লুক/অবয়ব কবিতা)
এবং রাস্তা/যোগাযোগ (কবিতার সাথে পাঠকের জটিল চিন্তাসূত্র)।
প্রকৃতি প্রেমীরা(বিশুদ্ধ কবিতাবাদী/সিলেবিক) এই নিয়ে বেশ আপত্তি তুললো, আরে এরা করছেটা কি? বাঁধ দিয়ে নদীটাকে নষ্ট করে ফেললো, কি সুন্দর সহজ জলের স্রোত ছিলো, আর এখন, কখনো দূকূল ভাসিয়ে উদ্দাম বন্যা, আর কখনো শুখনো রুক্ষ বালির চড়া। কিন্তু, কি করা যাবে বলুন, বাঁধের ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তাকে তো অস্বীকার করতে পারিনা, আর নদীটা তো আসলে নদী নয়, কবিতা, তাই, অস্বীকারের প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া একটা জিনিস খেয়াল করুন, বাঁধ দিয়ে নদীর জলের বহুমুখী ব্যবহারিক প্রয়োগ হয়েছে, নদীর ধারাকে কিন্তু নিরবিচ্ছিন্ন রেখেই।
এবার আসুন রূপকের রূপকথা ছেড়ে সরকারি ঢুকে পড়ি কবিতায়। শব্দ কবিতার মূল লক্ষ্য, কবিতার মূল সরলরৈখিক গতিকে স্তব্ধ না করে, একই কবিতার মধ্যে শব্দের নিজস্ব শক্তিকে কাজে লাগিয়ে একাধিক কবিতা সৃষ্টি বা কবিতার বহুমাত্রিক রূপদান। কবিতা এখানে বহুগামী। এবং এই বাঁধ নির্মাণের বা যতিচিহ্নের সঠিক ও সাবলীল প্রয়োগের উপরই নির্ভর করছে শব্দ কবিতার স্বার্থকতা।
যেভাবে বাস্তবের বিজ্ঞানসম্মত নদী-বাঁধ কল্যানকর, বাঁধের নকশায় ভুল হলে তা ধ্বংস ডেকে আনে। একইভাবে, কবিতায় যতিচিহ্নের কুশল প্রয়োগ না ঘটলে কবিতাটির অপমৃত্যু ঘটবে।
তাই সাধারণভাবে, বর্তমান কবিতা হবে যতিচিহ্নহীন, যতিচিহ্নের প্রয়োগ তখনই হবে যখন শব্দের শক্তিকে কাছে লাগিয়ে কবিতাকে multy dimentional করা হবে।
অর্থাৎ, সোজা কথায় ভাঙচুর করা হবে।
এই যতিচিহ্নের প্রয়োগের হাত ধরেই কবিতায় ঢুকছে ‘চ্যাট মোড’, তথ্য ঘেঁটে দেখতে পাচ্ছি বাংলাকবিতায় এটাও ঢুকছে সৌমিত্রদা বা iSociety-র হাত ধরেই। নামকরণটাও ওনার। এবং এর সাথে সাথেই ‘ব্রাউজ মোড’, m-কোলাজ।
(m-কোলাজ নিয়ে এখানে আলোচনা করবো না, স্লাইস পোয়েট্রি নিয়ে আমার পূর্ববর্তী একটা লেখায় কিছু ভুল আছে বা তথ্যের ঘাটতি। সেটা সংশোধন করতেই হবে আমাকে, এবং এব্যাপারে আই-সোসাইটির প্রাপ্য সম্মান স্পষ্ট ভাবে স্বীকার করতে হবে, তাই এই বিষয় নিয়ে, আলাদা ভাবে কিছু লিখবো ভবিষ্যতে)
আসুন আমরা প্রথম চোখ রাখি চ্যাট মোডে, চ্যাট মোডের কৌশলটা বর্তমান জেনারেশন খুব সহজেই বুঝতে পারবে তার chating experience দিয়ে, যেখানে একটি বা খন্ড শব্দ একটা পুরো অর্থ বহন করছে,
Gn8, hm, mrng, lol ইত্যাদি ইত্যাদি।
কবিতাতে এর প্রয়োগ ঘটছে দুভাগে, একটি এক শব্দের কবিতায়(যেটা আগেই আলোচনা হয়েছে) এবং দীর্ঘ কবিতার মধ্যেও। দীর্ঘ কবিতায় চ্যাট মোডের মূল কাজটা ওই বাঁধের যা কাজ, একদম ঠিক তাই, কবিতার মধ্যে যতিচিহ্নের প্রয়োগ এখানে বিরামকে সূচীত করেনা, সে ইঙ্গিত করে নতুন একটি চিন্তনের বা খুব কম সংখ্যক শব্দ প্রয়োগ করেও একটা বিস্তৃত চিন্তাস্রোত সৃষ্টির। একটা উদাহরণ দিই,
প্রকোষ্ঠে:বিসর্জনে
ঘুম মুদ্রায় চুরি ফ্যাকাশে
জল×পতঙ্গের
রক্ত।ইচ্ছা।ঘাম
লুনাটিক রেলিং টপকালে
@yes.boss
রক্ত।ইচ্ছা।ঘাম, লক্ষ্য করুন, আমি যদি এটা চিরন্তন কবিতার আশ্রয়ে লিখতাম তাহলে আমি এখানে যা বলতে চাইছি, সেটা বলতে হয়তো আমাকে এক বা একাধিক পংক্তি ব্যবহার করতে হতো, অথচ ব্যকারণের যতিচিহ্নের ব্যবহারকে অস্বীকার করে আমি এখানে পূর্ণযতির ব্যবহার করেছি শব্দতিনটির মধ্যে bonding করতে, পূর্ণযতি এখানে বিরামকে সূচিত করছে না বা বিভেদ সৃষ্টি করছে না, শব্দতিনটিকে সে জুড়ে দিচ্ছে, একটা অবিচ্ছিন্ন চিন্তস্রোতে। শব্দতিনটি মিলিত ভাবে যেমন একটা কেন্দ্রীয় বার্তা পাঠাচ্ছে, আবার একই সাথে, রক্ত, ইচ্ছা বা ঘাম আলাদা ভাবে পড়লেও আপনার চিন্তনে ভিন্ন ভিন্ন ছবিও সৃষ্টি হচ্ছে বা বিচ্ছিন্ন কিছু চিন্তন। অর্থাৎ বাঁধ এখানে দুভাগে কাজ করছে, পাশ করছে জলের ফ্লো ও একইসাথে জলটাকে কাজে লাগাচ্ছে বহুমুখী প্রকল্পে।
চ্যাট মোড নিয়ে আরো বিস্তারিত অনুসন্ধানে যাওয়াই যেতো, কিন্তু হাতে সময় নেই। সৌমিত্রদার কাছ থেকে, যে ইনপুট আমি পেয়েছি, যে নির্মাণ, বিনির্মাণ, নবর্নির্মাণের স্তর, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করলে চ্যাট মোড সবচেয়ে ভালো বোঝা যেতো, কিন্তু তাতে আমার লেখাটাও মৌলিক পর্যবেক্ষণ থাকতো না, এবং লেখাটির বহরও বেড়ে যেতো এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারতাম না, তাই এই বিষয়ে আগ্রহীদের বলবো, সৌমিত্রদা বা আই-সোসাইটির বইগুলো পড়ে ফেলতে।
চ্যাট মোড নিয়ে একটা খুব ভালো লেখা বা পর্যবেক্ষণ চোখে পড়লো হঠাৎ, অনুপম মুখোপাধ্যায়ের একটি সঠিক ও দাপুটে বিশ্লেষণ তুলে দিচ্ছি অবিকৃত ভাবেই,
[কবিতাতা পাক্ষিক-৩৪৪/২৬.১১.২০০৬
কথা ও কবিতা, কথাও কবিতা, কথাই কবিতা নয় / অনুপম মুখোপাধ্যায় /কবিতা পাক্ষিক-৩৪৪/২৬.১১.২০০৬
November 26, 2006, কথা ও কবিতা, কথাও কবিতা, কথাই কবিতা নয় / অনুপম মুখোপাধ্যায় /কবিতা পাক্ষিক-৩৪৪/২৬.১১.২০০৬
কথা ও কবিতা, কথাও কবিতা, কথাই কবিতা নয়
অনুপম মুখোপাধ্যায়
‘For there’s more enterprise / In Walking naked.’
অহংকে অতিক্রম করে যাওয়া সর্বজনীন ভাব একটি অভিজ্ঞানলব্ধ বহুরৈখিক বিষয় । এতেই কবির সার্থকতা । কবি বিনোদন খোঁজেন না, খোঁজেন আনন্দ । ছন্দ, যতি, অন্তমিলের সংকীর্ণ ঘরোয়া দেওয়াল তুলে স্বাতন্ত্র নামক মরীচিকার সন্ধান করা অর্থহীন । সীমারেখা ভেঙে দিতেই নির্দোষ শুদ্ধ ও পূর্ণ বাকপ্রতিমা উজ্জ্বল হয়ে উঠল – সৌমিত্র সৃষ্টি করল ‘চ্যাট মোড’।. সৃষ্টি করল কারণ তার থেকে বিযুক্ত কোনো কিছুর অস্তিত্বই হয় না ।
‘গোরুর গঁজ গাড়ার ডোবে ‘- এই উচ্চারণ সৌমিত্রর আগে বাংলা কবিতা পায়নি । শূন্যতায় যে স্পর্শ থাকে, মশার কামড়ে রোদ লাগার যে অস্বস্তি – সৌমিত্র আমাদের জানাল । ‘পোঁদা বিড়ি’ – এই প্রয়োগ কি আমাদের প্রজন্মের সাবালকত্ব ঘোষণা করে না ?
তেঁতুলগাছের ছায়া টক – এই তথ্য আমাদের প্লেটে ফেলে দিয়ে সৌমিত্র মনে করিয়ে দিল সুকুমার রায়কে, সঙ্গে একরাশ মুগ্ধতার স্যালাড । সৌন্দর্য তারিখে আটকে থাকে, কিন্তু আয়নাতে আটকায় না । আলপথের প্রতি একটা আবেশ সৌমিত্রর কবিতায় আমি লক্ষ করে থাকি । ‘লাল কেঁচো’ কবিতায় তা আবার ফিরে এল । আমার মতে ‘লাল কেঁচো’ এখনও পর্যন্ত সৌমিত্রর শ্রেষ্ঠ রচনা । তারপরই আমি স্থান দেব ‘তিথির পুতুল’ লেখাটিকে । টেবিল এবং বিছানার মধ্যে ফাঁক – তাকেও শূন্যতা বলা যায় ! ধন্যবাদ সৌমিত্র । রিক্ততা রোদ মাখল তোমার কবিতায় ।
‘চ্যাট মোড’ আমাকে জেন কবিতার প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দিয়েছে । তার হয়তো কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই; কিন্তু সৌমিত্রর কবিতাও ধ্যানের কবিতা, স্তব্ধতার কবিতা । জাপানি মঠের ঘন্টার আওয়াজের খুব কাছাকাছি । শব্দহীনতায় প্রয়োজন শূন্যতার বাজনাটুকুই বাজতে থাকে । একটি বাক্যহীন মুহুর্ত ধরা থাকে পতনোন্মুখ ঢেউ-এর বিপন্নতায় । দৃশ্য এবং দর্শকের ফারাকটুকুও কখন যেন ঘুচে যায় । পূর্ণচ্ছেদের ব্যবহার অসামান্য করেছে সৌমিত্র, কংক্রিট কবিতাকে মনে পড়ে যায় । এই লেখাগুলিতে সৌমিত্র আসলে ভাষার সেই এলাকাটি খুঁজতে চেয়েছে যেখানে কবিতা ছুঁয়ে থাকে না । আপাত কবিতাহীনতা এখানে আছে । একদিন আসবে পথ এবং পথিকরা গলে মিশে যাবেন । তখন – একহাতেই বেজে উঠবে তালি । সেই অলৌকিক হাততালির অপেক্ষায় থাকলাম ।
সংযোজন : সম্পাদকের কাছ থেকে জানা গেল কম্পোজের পরে পাতাটির কিছু অংশ সফেদ থেকে যাচ্ছে । আরো কিছু বলা যাক তাহলে । পূর্ণচ্ছেদ নিয়েই বলি । সৌমিত্র পূর্ণচ্ছেদের যে ব্যবহার করেছে, আমার মনে হয় তার ফলে এই ছেদচিহ্নটি এক নতুন মাত্রা পেল । শেষ যার নেই তার শেষ কথা বলার অধিকার কবির নেই । আমি নিজে কবিতাতে পূর্ণচ্ছেদের ব্যবহার নিয়ে খুব নিশ্চিত থাকি না । কিন্তু সৌমিত্র আমাকে বোঝাল পূর্ণচ্ছেদ মোটেই সমাপ্তির অন্য নাম নয়, সে সূচিত করে প্রারম্ভকে । আবার নতুন কিছু বলার সম্ভাবনা । ভাষা হয়ে উঠতে পারে শিশুর জিভের মতো অল্প লাল । ফলে সৌমিত্র আমাদের ক্রমাগত দিয়ে চলে নতুনের চেয়েও নতুন । ‘চ্যাট মোড’ এভাবেই অভিনব হয়ে উঠেছে সৌমিত্রর অনুভবের ছোঁয়ায় । হয়তো বাংলা কবিতার মোড় ফেরানো কোনো কাব্যগ্রন্থ এ নয়, কিন্তু তরুণতর কবিরা ইতোমধ্যেই সংক্রামিত হচ্ছেন তার কাব্যভাষায়, Infolit-এর সাম্প্রতিক সংখ্যাটি পড়লেই তা বোঝা যেতে পারে । এখান থেকে হাঁটতে শুরু করলে একটা নতুন দরজা খুলে যেতেই পারে । সম্ভবত যাবেই ।
চ্যাট মোড । সৌমিত্র রায় । কবিতা পাক্ষিক । ১০ টাকা ।
~: সৌমিত্র রায়-এর চ্যাট মোড প্রসঙ্গে অনুপম মুখোপাধ্যায় /কবিতা পাক্ষিক-৩৪৪/২৬.১১.২০০৬ :~]
কথা ও কবিতা, কথাও কবিতা, কথাই কবিতা নয় / অনুপম মুখোপাধ্যায় /কবিতা পাক্ষিক-৩৪৪/২৬.১১.২০০৬
November 26, 2006, কথা ও কবিতা, কথাও কবিতা, কথাই কবিতা নয় / অনুপম মুখোপাধ্যায় /কবিতা পাক্ষিক-৩৪৪/২৬.১১.২০০৬
কথা ও কবিতা, কথাও কবিতা, কথাই কবিতা নয়
অনুপম মুখোপাধ্যায়
‘For there’s more enterprise / In Walking naked.’
অহংকে অতিক্রম করে যাওয়া সর্বজনীন ভাব একটি অভিজ্ঞানলব্ধ বহুরৈখিক বিষয় । এতেই কবির সার্থকতা । কবি বিনোদন খোঁজেন না, খোঁজেন আনন্দ । ছন্দ, যতি, অন্তমিলের সংকীর্ণ ঘরোয়া দেওয়াল তুলে স্বাতন্ত্র নামক মরীচিকার সন্ধান করা অর্থহীন । সীমারেখা ভেঙে দিতেই নির্দোষ শুদ্ধ ও পূর্ণ বাকপ্রতিমা উজ্জ্বল হয়ে উঠল – সৌমিত্র সৃষ্টি করল ‘চ্যাট মোড’।. সৃষ্টি করল কারণ তার থেকে বিযুক্ত কোনো কিছুর অস্তিত্বই হয় না ।
‘গোরুর গঁজ গাড়ার ডোবে ‘- এই উচ্চারণ সৌমিত্রর আগে বাংলা কবিতা পায়নি । শূন্যতায় যে স্পর্শ থাকে, মশার কামড়ে রোদ লাগার যে অস্বস্তি – সৌমিত্র আমাদের জানাল । ‘পোঁদা বিড়ি’ – এই প্রয়োগ কি আমাদের প্রজন্মের সাবালকত্ব ঘোষণা করে না ?
তেঁতুলগাছের ছায়া টক – এই তথ্য আমাদের প্লেটে ফেলে দিয়ে সৌমিত্র মনে করিয়ে দিল সুকুমার রায়কে, সঙ্গে একরাশ মুগ্ধতার স্যালাড । সৌন্দর্য তারিখে আটকে থাকে, কিন্তু আয়নাতে আটকায় না । আলপথের প্রতি একটা আবেশ সৌমিত্রর কবিতায় আমি লক্ষ করে থাকি । ‘লাল কেঁচো’ কবিতায় তা আবার ফিরে এল । আমার মতে ‘লাল কেঁচো’ এখনও পর্যন্ত সৌমিত্রর শ্রেষ্ঠ রচনা । তারপরই আমি স্থান দেব ‘তিথির পুতুল’ লেখাটিকে । টেবিল এবং বিছানার মধ্যে ফাঁক – তাকেও শূন্যতা বলা যায় ! ধন্যবাদ সৌমিত্র । রিক্ততা রোদ মাখল তোমার কবিতায় ।
‘চ্যাট মোড’ আমাকে জেন কবিতার প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দিয়েছে । তার হয়তো কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই; কিন্তু সৌমিত্রর কবিতাও ধ্যানের কবিতা, স্তব্ধতার কবিতা । জাপানি মঠের ঘন্টার আওয়াজের খুব কাছাকাছি । শব্দহীনতায় প্রয়োজন শূন্যতার বাজনাটুকুই বাজতে থাকে । একটি বাক্যহীন মুহুর্ত ধরা থাকে পতনোন্মুখ ঢেউ-এর বিপন্নতায় । দৃশ্য এবং দর্শকের ফারাকটুকুও কখন যেন ঘুচে যায় । পূর্ণচ্ছেদের ব্যবহার অসামান্য করেছে সৌমিত্র, কংক্রিট কবিতাকে মনে পড়ে যায় । এই লেখাগুলিতে সৌমিত্র আসলে ভাষার সেই এলাকাটি খুঁজতে চেয়েছে যেখানে কবিতা ছুঁয়ে থাকে না । আপাত কবিতাহীনতা এখানে আছে । একদিন আসবে পথ এবং পথিকরা গলে মিশে যাবেন । তখন – একহাতেই বেজে উঠবে তালি । সেই অলৌকিক হাততালির অপেক্ষায় থাকলাম ।
সংযোজন : সম্পাদকের কাছ থেকে জানা গেল কম্পোজের পরে পাতাটির কিছু অংশ সফেদ থেকে যাচ্ছে । আরো কিছু বলা যাক তাহলে । পূর্ণচ্ছেদ নিয়েই বলি । সৌমিত্র পূর্ণচ্ছেদের যে ব্যবহার করেছে, আমার মনে হয় তার ফলে এই ছেদচিহ্নটি এক নতুন মাত্রা পেল । শেষ যার নেই তার শেষ কথা বলার অধিকার কবির নেই । আমি নিজে কবিতাতে পূর্ণচ্ছেদের ব্যবহার নিয়ে খুব নিশ্চিত থাকি না । কিন্তু সৌমিত্র আমাকে বোঝাল পূর্ণচ্ছেদ মোটেই সমাপ্তির অন্য নাম নয়, সে সূচিত করে প্রারম্ভকে । আবার নতুন কিছু বলার সম্ভাবনা । ভাষা হয়ে উঠতে পারে শিশুর জিভের মতো অল্প লাল । ফলে সৌমিত্র আমাদের ক্রমাগত দিয়ে চলে নতুনের চেয়েও নতুন । ‘চ্যাট মোড’ এভাবেই অভিনব হয়ে উঠেছে সৌমিত্রর অনুভবের ছোঁয়ায় । হয়তো বাংলা কবিতার মোড় ফেরানো কোনো কাব্যগ্রন্থ এ নয়, কিন্তু তরুণতর কবিরা ইতোমধ্যেই সংক্রামিত হচ্ছেন তার কাব্যভাষায়, Infolit-এর সাম্প্রতিক সংখ্যাটি পড়লেই তা বোঝা যেতে পারে । এখান থেকে হাঁটতে শুরু করলে একটা নতুন দরজা খুলে যেতেই পারে । সম্ভবত যাবেই ।
চ্যাট মোড । সৌমিত্র রায় । কবিতা পাক্ষিক । ১০ টাকা ।
~: সৌমিত্র রায়-এর চ্যাট মোড প্রসঙ্গে অনুপম মুখোপাধ্যায় /কবিতা পাক্ষিক-৩৪৪/২৬.১১.২০০৬ :~]
……...‘এখান থেকে হাঁটতে শুরু করলে একটা নতুন দরজা খুলে যেতেই পারে। সম্ভবত যাবেই।’
এই নতুন দরজা দিয়েই কি ‘পুনরাধুনিকের পথে’র যাত্রা শুরু ? তাছাড়া তো আমি আর কোন যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না, ‘পুনরাধুনিকের পথে একা’ হাঁটার শক্তি বা সাহসটা একমাত্র জোগাতে পারে শব্দের এই শক্তি, চ্যাট মোড। তাছাড়া তো আর কিছু নেই, বাকি তো সব গাছ-ফুল-পাখি…..
উত্তরটা অনুপম মুখোপাধ্যায় ভালো দিতে পারবেন বা আপনারা।
এবার আসি ব্রাউজ মোডে, ব্রাউজ কথাটির অর্থ অন্বেষণ বা খোঁজ, ব্রাউজ মোডে শব্দের বা পংক্তির আংশিক বা ভাঙা প্রয়োগ ঘটে, অনেকটা ‘ফাইন আর্টস’-এর মতো, তুলির কিছু আঁকাবাঁকা, ‘মাথামুন্ডু হীন’ আঁচড় এঁকে চলে ছবি, কোনো পূর্ণ অবয়ব নাই, সবকিছুই ভাঙা ভাঙা, অস্পষ্ট। এখানে কবি সম্পূর্ণভাবে লুকিয়ে ফেলে নিজেকে, শুধু ইঙ্গিত দেয়, পাঠককে বুঝে নিতে হবে, কেন্দ্রীয় অর্থ বা অর্থ খুঁজতে হবে কবিতার বাইরে, কবিতাটি পড়ে পাঠকের মধ্যে যে চিন্তা স্রোত, অর্থ খুঁজতে হবে তার মধ্যে। এটি একটি ‘ত্রিমাত্রিক রংবিলাস’, আরো ভালো করে বললে, ব্রাউজ মোড কবিতার abstract art. এবং এর tenacity অর্থহীনতার দিকে।
উপরের উদাহরণটির দিকে চোখ ফেরান,
লক্ষ্য করুন, ঘুম মুদ্রায় চুরি ফ্যাকাশে, এই লাইনটি, পংক্তিটি অপূর্ণ ও অস্পষ্ট, শুধু এই পংক্তিটি পড়লে কিছুই বোঝা যাবে না, একটি ভাঙা লাইন মাত্র, কিছু অর্থহীন শব্দের সারি। অথচ কবিতার সামগ্রিকতায় খুঁজে পাওয়া যায় এর অর্থ, দেখা যায় এগুলো মোটেই কোনো অর্থহীন শব্দ সারি নয়, এটা ইঙ্গিত করছে একটা বিস্তৃত ভাব বা চিন্তনের।
আমি এই কবিতায় mixed mode-এর প্রয়োগ করেছি, এখনকার কবিতার দিকে চোখ রাখলে দেখতে পাবেন এই মিক্সড মোডের ব্যবহার সর্বত্র।
এবং এটাই বাস্তব সত্য যে, গোষ্ঠীগুলি তার বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে পারেনি, আই-সোসাইটির হাত ধরে যার অনুপ্রবেশ সেটা ছড়িয়ে গেছে প্রতি পকেটে, এবং পকেটগুলি স্বাভাবিক ভাবেই শক্তিশালী হয়েছে।
লক্ষ্য করুন ‘বাক’এর দিকেই, পুনরাধুনিকের পথে কিনা জানিনা, দরকারও নাই জানার, কিন্তু নির্দ্বিধায় স্বীকার করছি, ‘বাক’ বাংলা সাহিত্যের একটি শক্তিশালী অধ্যায়। ‘বাক’-এর লেখা পড়া আমি জাস্ট চমকে যাই প্রতি সংখ্যায়, এতো স্বতঃস্ফূর্ত।দাপুটে।ঘোমটা হীন কবিতা খুব একটা দেখতে পাওয়া যায়না। হ্যা, স্বীকার করছি, এই জয়াগায় বাক একাকী হেঁটেছে দীর্ঘ পথ। কবিতা লিখতে গিয়ে কোনো ‘ঢাক গুরগুর’ নেই, ‘যোনি ছিঁড়তে’ তাদের হাত কাঁপে না, এবং সেই ‘রক্তাক্ত’ হাতেই লিখে ফেলে তারা ‘ঘৃণিত’ কবিতা। কবিতা যে শুধু ভালো লাগা বা খারাপ লাগা নয়, কবিতা মানে আমাদের আদিম বন্য অনুভূতিগুলোরও নগ্ন প্রকাশ, এটা ‘বাক’-এ খুব স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়েছে।
এই প্রসঙ্গে ‘মধ্যবর্তী’র কথা না বললেই নয়,
‘হ্যা, আমরা গোষ্ঠীতে বিশ্বাস করি’
বিশ্বরূপদার এই মুখোশহীন স্পষ্ট ও দাপুটে ঘোষণায় আমি প্রথম ‘মধ্যবর্তী’র দিকে আকৃষ্ট হই, তারপর পড়ে ফেলি ‘খারাপ কবিতা’। ব্রাউজ মোড জানা ছিলো বলে ‘খারাপ কবিতা’কে ধরতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি, কিন্তু স্বীকার করছি, যে একঝাঁক টগবগে ‘টাট্টু ঘোড়া’র কথা বিশ্বরূপদা বলেন তাদের উপর সত্যিই ভরসা করা যায় রেসের মাঠে এবং যুদ্ধেও। তারা সত্যিই এই অর্থহীনতার ঝোঁকটাকে নিয়ে গেছে একটা অন্য মাত্রায়, তাদের ‘abstract art’ নিঃসন্দেহে বাংলা কবিতায় এক দাপুটে ‘খারাপ’ উদাহরণ।
‘আপডেটেড কবিতা’র মধ্যে আমি যে, অর্থহীনতার ঝোঁকটা খুঁজে পেয়েছিলাম, ‘মধ্যবর্তী’তে সেটা একটু আলাদা, এখানে, যে একটি ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার হবে তা হলো কর্ণ বা কান। শব্দের শব্দকে এখানে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার যে ভাষা, ‘হোক কলরব’, সেই যন্ত্রণাদায়ক কলরবটা স্পষ্ট শুনতে পাই ‘মধ্যবর্তী’র কবিতায়। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মধ্য দিয়ে উঠে আসা ‘মধ্যবর্তী’ আজ তাই নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান। ‘যারা শুনেও শুনতে পায় না, তাদের শোনানোর জন্য ধামাকার প্রয়োজন’, চাই রূদ্র সঙ্গীত, গজলের কাজ নয় এটা।
ঠিক এইখানেই সৌমিত্রদা বা আই-সোসাইটির ব্যর্থতা।
তারা ব্যবহারিক প্রয়োগের ব্যপারে বা আরো ভালো করে বললে রুট-লেভেলে নেমে কাজ করার ব্যপারে ব্যর্থ। এই ব্যর্থতার ফাঁক গলেই পকেটগুলি শক্তি সঞ্চয় করেছে, সমৃদ্ধ হয়েছে।
এবং শুধু পকেটগুলি নয়, সামগ্রিকভাবে বাংলা কবিতার উন্নতি হয়েছে, আমার কাছে এটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আই-সোসাইটির ব্যর্থতার দোহাই দিয়ে বসে না থেকে এই কাজটিই করেছে বিভিন্ন পকেটগুলি। কিন্তু আই-সোসাইটি বা সৌমিত্রদার যে কৃতিত্ব পাওয়া উচিত ছিল সেটা পাননি এটাও ঠিক, এবং আমি মনে করি সেই সম্মান তাঁর প্রাপ্য। কিন্তু তার জন্য আমি সৌমিত্রদাকেই দায়ী করবো।
জনক = যে জন্ম দেয়???
যে, সন্তানের জন্ম দেয়, সেই সন্তানের সঠিক লালন-পালন করাটাও একটা পিতার কর্তব্য, সেখানে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই।
এই অবহেলাটাই আমি লক্ষ্য করেছিলাম জিবাকের মধ্যে কিন্তু একটু অন্যভাবে। তাছাড়া, এখানে আর একটা কথা উল্লেখ করতেই হয়, আই-সোসাইটির যে আনন্দের অন্বেষণ বাইরে থেকে ভিতরের দিকে, জিবাকে সেটাই ভিতর থেকে বাইরের দিকে। অভিমুখটা শুধু আলাদা। এবং আই-সোসাইটি যেমন শুধুমাত্র একটি সাহিত্য পত্রিকা নয়, জীবনের সাথে সম্পৃক্ত একটা বহুমুখী কর্মকাণ্ড, জিবাকের কাছেও সেই সুযোগটা আছে।
এবার চোখ ফেরানো যাক, একটু অন্য দিকে,
এই প্রসঙ্গে যার কথা না বললেই নয়, সে হলো মহাদেব (মহাদেব নাথ)। ওর যা কিছু বক্তব্য, ও প্রকাশ করে ওর কবিতার মধ্য দিয়েই, প্রতি মুহূর্তে ওর কবিতায় ভাঙচুরের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়, ও যেন কিছু একটা খুঁজছে, এবং অবশেষে মনে হয় ও পেয়েছে, ‘শূন্যতত্ত্ব’। এটা ঠিক কি এখনো আমি জানিনা, তত্ত্বটা এখনো ও প্রকাশ করেনি বা পুরোটা প্রকাশ করেনি। তবে ওর শূন্যতত্ত্বের কবিতাগুলো পড়ে মনে হয়েছে, শুন্যতত্ত্বের কায়া নির্মাণের মূলে আছে শব্দ-কবিতা বা শব্দ-শক্তি। কিন্তু ঠিক যে জায়গায়টায় আমার কৌতুহল সৃষ্টি করেছে সেটা হলো ওর কবিতার দর্শনে, এই জায়গাটাই মনে হয়েছে, মহাদেব নতুন কিছু ভাবছে, আমার যতটুকু মনে হয়েছে, ও এই দর্শনের জায়গাটাই পাশ্চাত্যমুখী নয়, ওর মুখ ঘরের দিকে, প্রাচ্যে বা আরো ভালো করে বললে ভারতীয় দর্শনের নিরাকারবাদ বা অদ্বৈতবাদ ওর শূন্যতত্ত্বের মূল চালিকাশক্তি। আমি ভুল হতেই পারি, কারন আমি এখনো ব্যপারটা জানিনা, আপনাদের সাথে আমিও অপেক্ষা করছি, কিন্তু ওর এই ভাঙচুরের স্পিরিটকে কুর্নিশ করি।
ভাঙচুর যখন আঁকছি তখন অনিন্দ্যদার (অনিন্দ্য রায়) কথা বাদ দেওয়ার সাহস আমার নেই, কিন্তু এই ব্যপারে আমি স্পিকটি নট, কারণ আমি এখনো অনিন্দ্যদাকে দূর থেকে খুঁটিয়ে লক্ষ্যে করে যাচ্ছি, অঙ্ক কবিতা, জ্যামিতি কবিতার খুঁটিনাটির খটখটানিতে আমার কলম থেকে এখনো কিছুই নিঃসৃত হয়নি যে এব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবো।
তাই অনিন্দ্যদাকে সশ্রদ্ধায় পাশ কাটিয়ে চোখ রাখি এখনকার পত্রিকাগুলোর উপর, বিশেষ করে, ওয়েবজিন বা ব্লগজিনের উপর, বিস্তারিত ভাবে এই ব্যপারে ভবিষ্যতে লেখার ইচ্ছা আছে, তাই সমস্ত পত্রিকাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি শুধু দুটি পত্রিকার কথা বলবো,
এক। অন্তর্বর্তী শূন্যতা। সাপ্তাহিক ব্লগজিন, প্রতি সপ্তাহেই নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে আসছে, কবি বা লেখককে বাধ্য করছে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে।
দুই। সিন্যাপস, বিজ্ঞাপনে স্পষ্ট ভাষন, experimental কবিতা পাঠান। এটাও সাপ্তাহিক।
কিন্তু, কেন আমি বিশেষ ভাবে এই পত্রিকাদুটির উল্লেখ করলাম, কারণ এরা শুধু ভাঙচুরের অপেক্ষায় বসে থাকছে না, শুধুমাত্র ভাঙচুরটাকে আঁকছে না, এরা বাধ্য করেছে ভাঙচুর করতে। এবং নিয়মিত। সিন্যাপসের একটাই criteria, শুধুমাত্র এবং একমাত্র ভাঙচুর।
এদের সম্পাদকরাও নতুন, এখানে যারা লিখছে প্রায় তারা প্রত্যেকেই নতুন, এদের লক্ষ্য কোনো গোষ্ঠী বানানো নয়, এরা নিজেদের মত চাপাতে চায়না, এরা দিতে জানে এবং নিতে জানে, এরা হাতে হাত রেখে কাজ করতে জানে। এই পত্রিকার সম্পাদক ওর পত্রিকার লেখা পাঠাচ্ছে এবং যেচে, কোনো ইগো নেই, এরা কোনো গোষ্ঠীরও নয়, এরা শুধু কবিতার, এরা শুধু সাহিত্যের। যদি কোনো গোষ্ঠী বা পত্রিকা পাত্তা না দেয়, don't worry, নিজের ফেসবুক আছে, প্রত্যেকের নিজস্ব পাঠক আছে, এবং ফেসবুকে দেখতে পাই, অনেকেই নিজের মতো করে একাকী কাজ করে চলেছে এবং ভালো কাজ, এরা প্রয়োজনে নিজেই একটা ব্লগজিন বা ওয়েবজিন খুলে ফেলতে পারে।
গোষ্ঠীপতিরা, আপনাদের আমরা সম্মান করি, স্বীকার করি, আপনাদের কাছ থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করেই আমরা আজ কিছু লিখতে পারছি, কিন্তু আমাদের কাছেও আপনাদের কিছু শেখার আছে, এটাই শেখার আছে যে, একসাথেও কাজ করা যায়, নিজস্বতা বজায় রেখেও।
আমার এই ছোট্ট কবিতাজীবনে আমি স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছি, এই গোষ্ঠীগুলির অসাড়তা, কেউ তার মৌলিকতা রক্ষা করতে পারেনি, পত্রিকার লেখাগুলো দেখলেই বুঝতে পারবেন কিভাবে একটার সাথে আর একটা মিশে গেছে এবং প্রত্যেকেই প্রত্যেককে সৃষ্টিশীলতার প্রশ্নে শ্রদ্ধা করে কিন্তু ব্যক্তিগত ইগো তাদের ঠেলে দিয়েছে অনেক দূরে,
কিছুটা ব্যক্তিগত পোর্টফোলিও
এবং
কিছুটা ব্যক্তিগত সংলাপে
গুলিয়ে গেলে কবিতার সহজ সমীকরণ
কিছুটা দেখাতে চায়
কিছুটা দেখতে
এবং
কিছুটা ব্যক্তিগত সংলাপে
গুলিয়ে গেলে কবিতার সহজ সমীকরণ
কিছুটা দেখাতে চায়
কিছুটা দেখতে
এতোক্ষনতো রূদ্র সংগীত অনেক হলো, এবার একটু গজল শোনা যাক, কি বলেন?
কবিতার স্পষ্টতই ভাগ আছে, এই যেমন আঙুর, আম, নারকেল, ঠিক তেমন, কোনটি টপ করে মুখে ফেলা যায়, কোনটির ছাড়াতে হয় ছাল, কোনটির আবার শক্ত খোলা, কিন্তু তিনটিই ফল, এবং তিনটেরই রস আছে। এই তিনটিই আমি খাই এবং খেতে আমি বাধ্য। আমার কাছে সব কবিতারই মূল্য আছে, এবং আমি মনে করি সমস্ত কবিতারই নিজস্ব পাঠক আছে এবং যেকোনো ভালো কবিতার আবেদন চিরন্তন।
কিন্তু প্রশ্ন এটা নয়, প্রশ্ন এটাই যে, গজলে কি ভাঙচুর নাই ? হ্যা, আছে তো, অবশ্যই আছে। এবং সেটা বলার দায়ও আমার আছে, কারন এতোক্ষণে আপনারা ভেবে নিয়েছেন, যে এই ‘উজবুক’টি শুধু রক মিউজিকে কান পাতে, গজলের হৃদয় ভেজা আবেদন বোঝার মতো কান ও মগজ কোনটাই এর নেই, কিন্তু সত্যিটা হলো,
আমার কাছে,
বৃষ্টি ও গজল
এক অসাধারণ রেসিপি
এবার আমরা খুঁজবো, ভাঙচুরের কবিতার বাইরে যে কবিতা, তার ভাঙচুরটা ঠিক কোথায়।
স্পষ্টতই এখানে শব্দের একক শক্তি অনুপস্থিত, তাই আমাদের খুঁজতে হবে কবিতার ভাবে, এখানে নদীতে কোনো বাঁধ নাই, ভাবের স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ আছে এবং একমুখী, এই একমুখী স্রোতের মাঝে বহুমাত্রিক কাজগুলো হচ্ছে ভাবের ঘু্র্ণীতে, শব্দের মোচড়ে, কবিতার স্বাভাবিক ফ্লো কে ক্ষতিগ্রস্ত না করে কবিতার মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে খুব সূক্ষ সূক্ষ কাজ, কখনো শব্দের মোচড়, কখনো ভাবের মোচড়। এবং এই কবিতা চোরাস্রোতে বিশ্বাস করে, উপরের নিস্তরঙ্গ কবিতার কায়ার নিচে লুকিয়ে থাকা ভাব গভীরে আরো গভীরে পৌঁছাতে চায়। কলরব নয়, শান্ত অথচ ভাবের গভীরতা, এবং সূক্ষ সূক্ষ ভাবের ও শব্দের মোচরে পাঠকের মন ছোঁয় এবং একই সাথে ভাবায়, একটা নরম, শান্ত ভালোলাগার রেশ ছড়িয়ে পড়ে পাঠকের মধ্যে, এটাই এই কবিতাগুলোর জনপ্রিয়তা এবং সার্বিক গ্রহনযোগ্যতার মূল কারণ। যেকোনো প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয় কবির কবিতা পড়ুন, আপনি ঠিক এই জিনিসটাই দেখতে পাবেন, তা সে অংশুমানদা হোক বা শ্রীজাতদা, সুধীরদা হোক বা তৈমুর দা, নাসের দা হোক বা আফজলদা ইত্যাদি ইত্যাদি। তাছাড়া আমরা তো সবাই জানি, স্রোতের এই ঘূর্ণি এবং চোরাস্রোত ঠিক কী, …. এক নিঃশব্দ মারণটান।
কিন্তু, এখন প্রশ্নটা হলো, আমি কোন পথে হাঁটবো এবং আমরা।
এই ব্যপারে আমার অন্যতম প্রিয় কবি রূদ্রদার (কবি রূদ্রপতি) একটা বার্তা আপনাদের সামনে অবিকৃত ভাবে তুলে ধরছি, ব্যক্তিগত বার্তা, কিন্তু সবার সামনে তুলে ধরছি এই কারনে যে, এটা শুধু আমার নয়, আমাদের পথনির্দেশ হতে পারে, এবং আমি আমার স্পষ্ট পথনির্দেশ এই বার্তার মধ্যেই খুঁজে পেয়েছি, (প্রায় একই কথা আমাকে একবার অনিন্দ্যদা বলেছিলেন এবং কী অদ্ভুত তাঁর কথার সূত্র ধরেই আমি কবি রূদ্রপতির খোঁজ পাই)
‘তোমার কবিতাগুলো পড়েছি। কিছু কিছু লাইন, চিত্র, ভালো লেগেছে। তোমার মতো এসময়ে আরো অনেকেই লিখছে দেখছি। কী করে বুঝব এটা জ্যোতির্ময়ের লেখা! সন্ধান চলুক। তোমাকে পারতেই হবে। কোনো পত্রিকার চরিত্র অনুযায়ী লিখবে না কিন্তু। নিজের ভালোলাগাগুলি লেখ। ঠিক পথ পেয়ে যাবে। যেদিন সকলে তোমার কবিতাতে কবির নাম লেখা না থাকলেও বলবে হ্যাঁ, এটা জ্যোতির্ময়ের কবিতা। শুভেচ্ছা।’
না-শেষে আমার চোখে ধরা পড়লো কবিতার একটি অখণ্ড রূপ, এতো নামও অপ্রয়োজনীয়, এতো ভাগের দরকারই বা কী? আমার চোখে পুরোটাই একটা কবিতা, কবিতা তার নিজের প্রয়োজনেই নিজেকে ভেঙে চলেছে প্রতি মূহুর্তে এবং এগিয়ে চলেছে। তাই আমার মনে হয় লক্ষ্যটা আমার এবং আমাদের হওয়া উচিত, just কবিতা যাপন। আমরা এই চলমান ইনফিনিটির একটি অংশ মাত্র। আমার চোখে কবিতার রূপ এটাই।
কিন্তু প্রশ্ন সেটা নয়, প্রশ্ন এটাই যে, মানুষগুলো ছাতা হাতে কেন? তারা কি পারতোনা ভিজতে।হঠাৎ।বৃষ্টিতে?
প্রশ্নের উত্তর কিন্তু আমি এখনো পেলাম না, আপনারা পেলেন কি?
(ক্রমশ)
[উপরোক্ত সমস্ত মত, আমার সৃষ্টিশীল ‘আমি’-টার। এর সাথে ব্যক্তি ‘আমি’ বা ‘এখন তরঙ্গ’ পত্রিকা বা ‘তরঙ্গ হাউস’ দায়ী নয়। যেকোনো রকম সমালোচনা কাম্য, এবং আমি আজ যা বিশ্বাস করি, কাল সেই বিশ্বাস পালটাবেনা এমন হতে পারে না, এবং না হওয়াটাই স্বাভাবিক। আপনাদের সমালোচনায় হয়তো আমাকে আরো অনেক অজানা কিছু জানাবে, আমি তার অপেক্ষায় থাকবো। কিন্তু, কোনরকম বিরূদ্ধতার উত্তর ব্যক্তি ‘আমি’ বা ‘এখন তরঙ্গ’ বা ‘তরঙ্গ হাউস’ দিতে বাধ্য নয়। এর উত্তর দেবে শুধুমাত্র এবং একমাত্র আমার সৃষ্টিশীল ‘আমি’ টা এবং অবশ্যই কলমের খোঁচায়।)
জ্যোতির্ময় মুখার্জিমাহাতা - গুসকরাপূর্ব বর্ধমান |
এমন সহজ সরল বিস্তারিত ব্যাখ্যা খুব ভালো লাগলো ...জানিনা কতটা কোথায় কখন কাজে লাগবে ...তবে যত্নে নিয়ে গেলাম যতটুকু বুঝেছি...ধন্যবাদ....
ReplyDeleteধন্যবাদ
ReplyDelete