বিভাগ : বই/সিনেমা/পত্রিকা আলোচনা
‘পদক্ষেপ’ পত্রিকার আলোচনায় রাহুল গাঙ্গুলী
পদক্ষেপ (চুঁচুড়া) রথযাত্রা সংখ্যা : পাঠপ্রতিক্রিয়া
--------------------------------------------------------------------
শেষ করলাম পদক্ষেপ (চুঁচুড়া) পত্রিকাটির প্রকৃতি বিষয়ক রথযাত্রা সংখ্যা।প্রথমেই একটি সৎ সম্পাদকীয়।ঠিকই তো প্রকৃতি আমাদের বেচে থাকার শক্তি দিচ্ছে,অথচ তার প্রতি বিশ্বস্ত না থেকে আমরা সেই শক্তিকে আগ্রাসনের কাজে নষ্ট করছি।ধ্বংস করছি প্রকৃতিকে,ভুলে যাচ্ছি নবনির্মানের কথা।আর এসব কথা তুলে ধরেই শুরু হলো সার্থক একটি সম্পাদকীয়।
শুরুতেই বড়ো প্রাপ্তি : মুর্শিদাবাদের প্রবীণ সাহিত্যিক হরিশঙ্কর দত্তের একটি সাক্ষাতকার।জানা গেলো সময় ও তার জীবনের বেশ কিছু অজানা কথা।
এরপরই পেলাম প্রবন্ধ 'নদীপুরাণ '।রচনা মৌ দাশগুপ্ত।ভালো লাগলো।পুরাণে কিভাবে নদীকে ব্যখা করা হয়েছে,সাথে রেফারেন্স হিসেবে রামায়ণ ও মহাভারত বা ফকিরি তত্ত্ব অন্য মাত্রা দেয়।তবে 'ইরা' না 'ইড়া' এনিয়ে ব্যক্তিগত বিভ্রান্তি থাকছে।
পরবর্তী ব্যক্তিগত গদ্য 'একটি বৃষ্টিবৃক্ষের আত্মকাহিনী',রচয়িতা রফিকুল হক আখন্দ।সুন্দর উপস্থাপনায় দেখা যায় সাম্প্রতিকতম যশোর রোডের উপর কেটে ফেলা গাছেদের আর্তি।
পরবর্তী পর্ব শুরু হয় কবিতা দিয়ে।আগের সংখ্যায় কবিতার মান নিয়ে একটু বলেছিলাম।ভালো লাগলো সম্পাদকমন্ডলীর সেকথা আত্তীকরণ করেছে দেখে।অজিত বাইরি (সলতের যেমন আয়ুক্ষয় হয় নিঃশব্দ দহনে : সন্ধ্যা নামলো),সমীরণ ঘোষ (বরফের আগেও ছিল / বরফের পরেও থাকবে / ভিনদেশ : কোটর),সুবোধ সরকার (পেরেক),দীপ রায়,সর্ভানু দাশগুপ্ত (আস্তানা : কবিতাটি নিয়ে বলতে চাই যা,ডট চিহ্নের পরিবর্তে যদি এম্পটি স্পেস ব্যবহৃত হতো,ব্যক্তিগত মতে কবিতাটিকে দারুন না বলে অনবদ্য বলতে পারতাম),আফজল আলি(আতসকাচ),পিন্টু পাল (গাছ),তৈমুর খান (দিঘী),মেঘ শান্তনু (বন্ধুরা ঘুমালে সূর্যগ্রহণ হয় / আমি ফুল কুড়াবার ছলে মাটি ছুঁয়ে দেখি : ঘুম), অমিতাভ দাস (যখন চল্লিশ ডিগ্রী ঝলসে দিচ্ছে হৃদয় হাড় : সভ্যতার মৃত্যু), অনুপম ভট্টাচার্য (শুধু যার খোঁজার কথা ছিল আমাদের / দেখতে পেয়েও / পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে বারবার : খেলা),বিকাশ দাশ (গল্পের ভেতর একটি সত্য ছিল / রাতভর সঙ্গমের পর / চুম্বনের দাগ লিখেছে প্রিয় নাম : ক্লেদজ কুসুম),সৌরভ মুখার্জী (নদী ভেঙে গেলে ওরা ভেসে যায় / আমরা খবর শুনি / খবর শুনি তার বাবা-মা মারা গেছে : শিরোনামহীন),শুভ্রাংশু সামন্ত (দুরপাল্লার গাড়ি),যুগান্তর মিত্র (সন্ত্রাসবাদীদের প্রতি),
সুজিত মান্না (নীচু পুকুরের শরীর আলগা হচ্ছে ধীরে ধীরে / শহুরে রাস্তার উপর জলের মুখগুলো / ধীরে ধীরে সাময়িক হয়ে উঠছে : বাহাত্তরের শেষ ইচ্ছেতে), চয়ন দাশ (সনাতনী মৃতবায়ুরা শরীরের ভিতর ঢুকেই জীবন্ত হয়ে উঠছে : ছিটমহল),বলাকা সেন (সাদা বিরাট হল ঘরটায় সবাই বেছে নিচ্ছে / নীল খামের স্বপ্ন পুড়ে রাখা মেঘ : বিনামূল্যের স্বপ্ন), অনিরুদ্ধ দাস (যে পথ হেটেছি ম - ত্যো ঘাসের সাথে / রাতের নিভুনিভু তারাদের নীচে / সে আমার একমাটি জন্মের ভাষ্য নয় : প্রকৃতি ও আমি), শুভ্র সরকার (একপ্রস্থ দুপুর খুন হতে দেখেছিলাম পাখির চোখে : অরণ্য এঁকে রাখো),বৈশাখী রায়চৌধুরি (হাইওয়ের ধূলো শুষেই ঘুমিয়ে পড়ি / সালোকসংশ্লেষের অভাব : অলিখিত অধ্যায়) প্রত্যেকেই নিজমানে স্বতন্ত্রতার দাবি রাখে।কবিতা সাজানোটাও বেশ ভালো,যা আগের সংখ্যায় কিছুটা অপূর্ণ ছিল।
এরপর গল্প বিভাগটি শুরু হয়।প্রথমেই অনুগল্প বিভাগ : শক্তিশঙ্কর সামন্ত,দীপঙ্কর বেরা,সুজয় চক্রবর্তী,শাঁওলি দে,জয়তী অধিকারী,দিপ্তেন্দু বিকাশ ষন্নিগ্রহী,অনিন্দ্যসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়, এদের রচনা দিয়ে শুরু।সকলেরই লেখা ভালো,তবে শেষের ৫জন বিশেষ অনুভূতির দাবি রাখে।
বড় গল্প বিভাগে অংশুপ্রতিম দে রচিত : ইমান, রাজকুমার ঘোষের রচনায় : নিশা বেশ।ভালো লাগলো প্রতিতী চৌধুরীর মুক্তির আলোয়, নির্মলেন্দু কুন্ডু রচিত বনসাই।
তবে প্রণব ঘোষের রহস্যময় কৃষ্ণকণা এবং পূজা মিত্র রচিত ম্যানিকুইন অন্য মাত্রার।স্যালুট পূজা আপনাকে।
দারুণ লাগলো অনুবাদ রচনা ফায়ারিং স্কোয়াড ও বিবেক : ভাস্করজ্যোতি ঘোষ।
রম্যরচনা বিভাগে সুজন ভট্টাচার্যের টুংটাং আরো বেশী বিস্তীর্ণতা দেখাতে পারতো।
মুক্তগদ্য বিভাগে সায়ন্ন্যা দাশদত্ত রচিত উল্লাসের ক্ষনে যদিও অবান্তর এবং দেবারতি ঘোষ রচিত মায়ের কোলে, দুটোই বেশ ভালো।তবে শৈলিগত ভাবে প্রথমটি একটু হলেও এগিয়ে।
পরবর্তী পর্যায়ে কবি ফল্গু বসুকে নিয়ে অভিমন্যু পালের প্রতিবেদন খুবই ভালো লাগে।
নিবন্ধ বিভাগের সবকটি লেখাই বেশ ভালো।রামামৃত সিংহ মহাপাত্র লিখিত লোকসংস্কৃতির উপর প্রাকৃতিক প্রভাব, কাকলি ঘোষ লিখিত দ্য লেগুন : প্রকৃতি যেখানে কেন্দ্রবিন্দু, সুকন্যা ব্যানার্জীর রবীন্দ্রনাথ ও প্রকৃতি, পবিত্র চক্রবর্তীর পাশ্চাত্য রূপকথায় প্রাণী ও প্রকৃতি : প্রত্যেকটি অনেক তথ্যসমৃদ্ধ।
সর্বশেষ বিভাগটি যেখানে দুটি পত্রিকা (আলাপন ও দর্পণ) ও একটি কাব্যগ্রন্থ (প্রথম পদক্ষেপ : মৌমিতা পাল) আলোচিত হয়েছে,বেশ সুন্দর সমাপ্তির রেশ টানে।
কিছু কথা সবশেষে বলতে চাই।হয়তো এই পর্বটুকুতে সমালোচনাই করছি,তবু তা আগামী উত্তরণের কথা ভেবেই।লিটিল্ ম্যাগাজিন মূলতঃ সৎ সাহিত্যের আঁতুড়ঘর।আর এটাই তার মেরুদণ্ডের একক্ বৈশিষ্ট্য।প্রবন্ধ কেবলমাত্র সময় বিশেষ ডকুমেন্টেশন, যা আমাদের কিছু তথ্য ও তথ্যের বৈশিষ্ট্য দেয়।সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কবিতা বিভাগ (গল্প বা গদ্যের প্রতি যথেষ্ট সম্মান রেখেই বলছি)।আর এত ভালো কবিতার ভিতরেও ব্যক্তিগত ভাবে আরো বৈচিত্র্য আশা করি।আর এবিষয়ে ভার্চুয়াল দুনিয়াকে আরো গুরুত্ব দিতে হবে,কারণ এই সময়ে ওটাই সাহিত্যের বহমান সাপ্লাই রুম।নির্বাচনে যেন সব কবিতাই ফর্ম বা দর্শনগত দিক থেকে একই ধাঁচের না হয়ে যায়।ছন্দমুক্তির ছন্দ থাকবে,বিনির্মাণ থাকবে,নবনির্মাণ থাকবে,থাকবে নিউরোটিক্ হাতুড়ির বাড়ি, ইত্যাদি।আর এসবের ভিতরেই পত্রিকার প্রকৃত উত্তরণ।যাই হোক, আগামী দিনের জন্য আসুক নানা বৈচিত্র্য।সৃষ্টি করতে হবে শব্দের ল্যাবরেটরি।না হলে পূর্বোক্ত সময় থেকে পাওয়া কবিতারা কবিতা হবে এই সময়টুকুর জন্য,আগামীর জন্য কি রাখবো।
আগামী সময়ে পদক্ষেপ (চুঁচুড়া) বাংলা সাহিত্যের দিশাকরনে আরো গভীরভাবে অংশগ্রহণ করুক,এই শুভকামনা রইলো।
No comments:
Post a Comment