গদ্যকবিতা
কথার পাওরুটি
বিকট বাকযন্ত্রের পাড়ায় আমরা থাকি; আর বলি মানুষের শক্র একমাত্র ‘মন খারাপের গল্প’। কেননা, মানুষেরা কথার পাওরুটি খায়, নোতুন সবুজ ফল দেখলে হামলে পড়ে। ধূসর চিরুণী দেখে ঘেউ ঘেউ করে কিংবা অমীমাংসিত হাসির মত ঘুমের ভেতর সৌভাগ্য আর দুর্ভাগ্যেও কালো দাগ দেখতে বেরোই। এই সব কথা ভেবে একদিন, বিকেলকে ধরে ‘চুমু’ গুলিকে তিন ভাগ করি; তোমাকে বলি- তুমি আমাকে একটা, ঘুম ধার দিও আর সঙ্গে দিও মোরগ কিনার কুড়ি টাকা, না হলে বিষণ্ণ চাঁদ দেখে আমি, মধ্যেরাতে খুন হয়ে যাবো। আমদের বিরহের মহলার যারা বিখ্যাত লোক, তারা তালগাছ থেকে আমাদের জন্য পেড়ে আনবে হৃদযন্ত্রের পোকা, শরীর বাকা হয়ে যাওয়া গোলাপ; মানুষের বড় হওয়ার নামে উন্মাদ ডুমুরের রতিবিলাপ। তারপরও আমরা জানি, শহরের পুব পাশে জামগাছে জমা থাকা কথারা মানুষের শত্র“। সেখানকার পিঁপড়েরা মানুষের মত, নিজেকে গলা ছেড়ে পাঠ করে আর হয়ে উঠে মানুষ; মানুষের মত পৃষ্ঠাহীন।
শব্দের পরিবর্তে বটফল
অপ্রকাশিত কীটাক্ষরে আজ প্রাকাশিত আমার পাতাহারা কবিতারা। যে কবিতার ঝাউবনে আমার জন্য অপেক্ষা করছে ধূসর বাগানের পাখিটি। পত্রপত্রিকা হয়ে যা প্রকাশ করছে স্বপন পারের ধ্রুবতারা। এইসব কথা হিতোপদেশে লিখবো বলে আজ কবিতা লিখি, কিন্তু আমার শব্দের পরিবর্তে জন্ম নেয় বটফল। তারপরও একদিন পালকের ভাষা শিখবো বলে যৌনভাবুকথা আমায় পেয়ে বসে, আর তুমি ভাবো কবিতার বর্ণ বলে কিছু নেই; কেবল শব্দের বিছানায় শুয়ে থাকে চাঁদ। আমি যতটুকু ভাষা নিয়ে তোমার কাছে পৌঁছাতে পারি, আমি ততটুকু অ্যাক্রেলিকে আঁখি ধুতুরা ফুলের ছবি। আর সেইসব সমাসবদ্ধ পদের পাঠোদ্ধারে আমি ব্যর্থ, তারপরও তুমি আর আমি দিয়ে ‘আমরা’ নামক সমাসবদ্ধ পদ রচনা করি; আর দেখি বিছানায় কেমন শব্দের মতো জড়াজড়ি করে পড়ে আছে পাঠকের মৌমাছি। যদি বলো, গাছপালাদের ছটফটে আত্মা আমি, যদি গান ও গরম ছাই; যদি বলো গোলাপের কুঁড়ির কাল তারপরও সবকিছু ছেড়ে আমি ধ্বনিগুঞ্জনমালার বাঁকা হাসি। তুমি বলো, আজি জগতের পুষ্পবাহক আর আমাদের যৌনতা কাশবনে মধ্যযুগীয় সাহিত্যে শরীর হয়ে উঠে।
অষ্টধাতুর আংটি
তুমি আমার কাছে পাকা গাব ফলের মতন বসে আছো শব্দ ঝুলি নিয়ে। যখন এ কথা ভাবি আর কেন লিখি, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে এইসব কথা মনে হয় আমার। আমি ভাষার জঙ্গল থেকে অনুভবের বায়োস্কোপ, খ্যাতিলিপ্সা সবকিছু এড়িয়ে ছুটে যাই তোমার কাছে। তুমি আমাকে খোঁজ দিয়েছ পাঠকের মনোবিকলনের আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কথা বলে আমাকে নিয়ে যাও মসলাবাস্কের মধ্যে। আমি জানি কবিতার নামে তুমি আর আমি বহুকাল ধরে এভাবে ধ্রুবতারার পৃষ্ঠে খালি পায়ে পায়চারি করছি। এইসব কোন কিছুর মধ্যে যখন তুমি দেখতে পাও জামফলের মতো ডালে ডালে ঝুলে আছে যৌনআয়নার ডাকঘর। তখন গমন পথ জুড়ে আমি কেবল রচনা করি কবিতার পরিত্যক্ত কামান। একদিন এভাবেই পৃথিবীর না পড়া পাঠ নিতে নিতে আমরা হাঁটি ভূট্টাপোড়া ক্ষেত ধরে। যদিও শব্দের মধ্যে, বক্রোত্তি ঠেলে ভেতরে ঢুকি, অষ্টধাতুর আংটি পরি; তারপরও লাইব্রেরির বইগুলো আজও আমাদের কাছে রয়ে যায় বোধগম্যতার বাইরে কেননা, বইয়ের তাকের উপর বাঘিনীর দুধ পান করে চলেছেন ইমরুল কায়েস।
এপ্রিলের বসন্তপুর
গত এপ্রিলে বসন্তপুর পার হয়ে মূর্ছিত ফুলের দেশের গিয়েছিলুম। পশ্চিমবাংলায় গেলে নদীয়ার কূটভাষা আমার মুখ গড়িয়ে আসে। তুমি আমাকে বলো ‘রে মরণ’ দারুচিনির গদ্ধ পাই তোমার কথার ভেতর। আমরা এসব কথা বলি আর কবি অর্থাৎ কূটশিক্ষক বন্ধুদের সাথে ক্রমশ ঘনিষ্ট হই এভাবে। আর শব্দ নিয়ে নৈঃশব্দের ব্যাখ্যা বুঝবার চেষ্টা করি। ধরো, এক টুকরো মেঘ নিয়ে আমরা যাই সপ্তর্ষীমণ্ডলে, খুঁজি আকাশে সাধুদের যৌনজীবন। কাকদ্বীপে কবি সামসুল হকের কবরের ক্রিস্টালসমাধির উপরে অষ্টভুজাকৃতি গানের বাক্স থেকে বের করে আনি বিভ্রামের ব্যাকরণ নামক বই খানি। একজন ডুমুর চাষি আমাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি আবার কবে আসবে কাকদ্বীপে। আমি একথা শুনে রোদ পোহাবার ভান করে কুমির শিকারীর সন্ধান করি। ভাবি, নক্ষত্র গণনার সময় হলে একদিন বিকেলে ছাতিমের গাছের কাছে যাবো। তুমি বললে, ভালবাসার দেহখণ্ডগুলো পানিফলের মতো। যা অলাতচক্র পার করে পাখিদের জন্য আনবে ব্যাকুল প্রশ্নমালা আর বামনের হাতে চাঁদ ধরার মতো আমাদের মিলিত সংলাপ সামসুল হকের কবিতার নির্জন ভূমিকা হতে পারবে।
কলকাতাগামী ডাউনট্রেন
দমদম স্টেশনে একটা সাপের বাক্সের উপর দশখণ্ড কবিতার ঘুম আর শার্ল বোদলের এই দুটি পড়ে থাকতে দেখে আমি বায়ুদেবতাদের হাহাকার আর কাঁঠালচাঁপার গন্ধ পাই। ভাবি, আজকাল ধুলিকণায়ও জন্ম নিচ্ছে জ্ঞানপদ্মফুল; অযৌক্তিকপুকুরে ভেসে উঠছে চারুবাক্যের প্রশ্নব্যাংক। তারপরও স্বার্থপর কবির কাছে কলকাতাগামী ট্রেন আর গোপন অসুখ একই শব্দবিভ্রম হয়ে উঠে। মাঝে মাঝে এসব নিয়ে চিন্তা করি আর কালিদাসের মেঘ হয়ে পাহারা দেই বিরহের গোলাপঝাড়। হয়তো একদিন যক্ষের বার্তামৈথুনের ধ্বনি ভেসে আসবে ধূসর শেফালী ফুলে। এভাবে একদিকে চাঁদ আর অন্যদিকে তেজপাতা হয়ে যৌনকর্মীরা ঢুকে পড়ছে শব্দ ঘরে। এইসব নিয়ে আধুনিক অধিকবিতা পাঠ অযোগ্য হয়ে উঠে তবু আমরা কলকাতাগামী ডাউনট্রেন থেকে নামি; যদি হতে পারি কোনদিন শোকসক্ষম রিক্তপুষ্প অথবা অনার্থক পরাবিদ্যার পাতা।
গল্পবিক্রেতার খাতা-১
তোমার কথা ভাবতে ভাবতে একদিন পাঁচ আর তিনের অঙ্ক ভুলে যায়। আসলে পৃথিবীটা বড় হিশেবের- কেননা এখানে কুকুর, চাঁদ ও মানুষের বসবাস। এসবের মধ্যে আমি ঠিক কি হিশাবে চিহ্নিত হবো জানিনা। তারপরও, শুধু এতটুকু জানি, এই অচেনা শহরের পৃথিবীতে তুমি ছাড়া আমি অনার্থক, বারবার বাড়ি ফেরার রাস্তা ভুলে যাই। লোকে বলবে এ কবিতা জীবন থেকে পলাতক মানুষের কিন্তু আমি জানি বেদনার যে ছায়ামূর্তি- যেখানে তোমার নাম লেখা হবে, সেখানেই লেখা আছে ভালোবাসা- ক্রোধ, চুরুট ও গুমরে ওঠা গান। তোমার কথা ভাবতে ভাবতে এই পৃথিবীর অঙ্কখাতা আমি ফেলে আসি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে...
গল্পবিক্রেতার খাতা -২
আমি নিশ্চিত কোন এক হীম যুগে তোমার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল আমার তারপর থেকে পৃথিবীর যে ইতিহাস আমরা লিখেছি- তাই পৃথিবীর ভবিতব্য এছাড়া ইতিহাস বলে কিছু নেই। আমরা ইতিহাসের নামে ভালোবাসার নামে সেই সব গুহগাত্রে লিখেছি শোকার্ত ফুলের আকুতি। ফুলগুলির জিহ্বায়, দাঁতে, ত্বকের আগুনে লেখা ইমরুল কায়েসের নাম। যে পৃথিবী আমরা রচনা করতে চাই তার অন্যতম নির্মাতা তিনি। আমরা ওনাইজার বক্ষের নীচে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করলাম। পৃথিবীতে আবার চুতর্থ হীমযুগ আসুক- আমারা বন্দনা করবো, যেন সেইনারী, যেন সেই শোকার্ত ফুল, যেন সেই ভালোবাসার ইতিহাস- গোষ্ঠী-অগ্নিকুণ্ডে পুড়িয়ে আত্মা করে তুলি।
গল্পবিক্রেতার খাতা-৩
আমি যে থানার অধিবাসী সেখানে বাস করে চাঁদ, শকুন আর বনমানুষ। যে গ্রামে আমার ঘর সেখানে থাকে প্রজাপতির এ্যান্টেনা। আমার বুকের ভেতর আড়ি পেতে থাকে পুঁটি মাছের গান ও সূর্যদেব। তোমার কাছে আমার প্রার্থনা আমার সখিকে নতিভুক্ত কর টিকটিকির মধুর বিচ্ছেদে। আমি যে থানার অধিবাসী সেখানে শুঁয়ো পোকার ভেতরে থাকে স্বপ্ন। মেঘের ভেতরে সাইনবোর্ড, বজ্রের ভেতরে শিশুর জন্ম। ভালোবাসার স্নায়ুকোষ জুড়ে থাকে নোতুন আবিষ্কৃত পথ। প্রতিদিন এখানে ফুল ফোটে, মাছ পাখিরা গান গায় আর বেদনার কথা বলে- গাছ কেটে ফেলার শোকার্ত চিঠি...
ইতিহাসে বিষণ্ণ মানুষের ঠিকানা
পৃথিবীর আদি মানুষের রক্তে লেখা আছে সবুজ এক ইন্দ্রিয় বেদনা। তোমরা যাকে ভালোবাসা বলো- কিন্তু আমি জানি সে ভালোবাসায় অধিক- হিজল গাছে বসা ডুমো মাছি। অথচ মানুষ প্রেমকে মুণ্ডহীন গাছ ভেবে, আগুনের পাখি ভেবে- শুয়োপুকার গুটি দিয়ে টুপি বানায়। তার গায়ে থাকে পোকার দংশন, রাজহাঁসের পাখনা আর হৃদপিণ্ডের নামে ছড়ানো কথা কেনা বেচার হাট। পৃথিবীর আদি মানুষের রক্তে লেখা আছে কবিতা চাঁদের অমাবশ্যা। যখন মানুষ বোঝে, ভালোবাসা তার কাছে এসেছে- তখনই সে বোকা আর নির্বোধ হয়ে ওঠে। অথচ বোকা হলেই মানুষের পুনর্জন্ম হয়, মানুষ জলের গভীরে গিয়ে দেখে, আছে আকাশের ঠিকানা। মানুষ হৃদয় খুঁড়ে তুলে আনে মানুষের দীর্ঘতম ইতিহাসে বিষণ্ণ মানুষের ঠিকানা। পৃথিবীর আদি মানুষের রক্তে কি খেলা আছে তা জানার জন্য আমি ইতিহাসের খাতায় তোমার বুক চিরে গুণ্ডুষে লিখি কাম, আগুন আর বৃষ্টির কাহিনী
সরোদ বাদক
মৃত্যুকে পাঁজাকোলা করে ভীড় ও সভ্যতার মধ্যে ছুঁড়ে দেবো আমি। দেখবো জীবাশ্ব থেকে, জীবনের ধোঁয়া তেকে করোটির ব্যাকরণ থেকে কিভাবে বুড়ো সূর্যটা ভালোবাসার নামে মৃত্যুকে ভয় দেখায়। তখন দেখবো, আমার গায়ের নশ্বর গন্ধ কিভাবে অদ্ভুত গলায় ভয়ের কথা বলে। আজ যারা পৃথিবী নামক গোলাপ কুড়ানো রাক্ষসীর কাছে জমা দেয় ফিঙে ও পতঙ্গেরলীলা, তাদেরকে আমি বলি- আমি রাধা ও কৃষ্ণের যুগলবন্দি। কেননা আমি কাশবনে কুড়িয়ে পাই- মেঘের ডাক, সবুজ বেড়ালের চোখ ও হারিয়ে যাওয়া মরালগ্রীবা আর জানি এ পৃথিবীতে মৃত্যু মানে দুই চোখে ফোটা লক্ষ বছর, টবে ঝারে যাওয়া ফুল অথবা ভালোবাসা। আমি তাই মৃত্যুকে পাঁজাকোলা করে ছুঁড়ে দেই ফুল ও পতঙ্গের মাঝে, সরোদ বাদকের আঙুলের ডঙায়।
জড় জগতের ইতিহাস
মানুষের অপরিচয়ের চিহ্ন মুছে যায়। যখন দেখি তার নাভি বিন্দুতে ঢুকে গেছে চাঁদ, শরীরের রুদ্ধশ্বাস, কঙ্কালের স্মৃতি; শুয়োপোকার মতো গুটিগুটি অথচ অবিশ্বাস্য রূপান্তর এই তো প্রাণীজগতের ইতিহাস। আদিম মানুষের বুকে যদি তুমি দেখো মমির প্রাণ দীর্ঘশ্বাস আর যে সব গাছেদের প্রাণ আছে- তারা যদি তোমাকে জিজ্ঞাসা করে- ‘কেমন আছেন’ -তখন মাটি ও সূর্যের মধ্যে তুমি খুঁজে পাবে আমাদের হিশাব না মেলা অঙ্ক। মানুষের রক্ত মাংসের শরীরে দেখো কেমন ফুলের বদলে কাঁটা ধরে আর বৃক্ষের সবুজ অভিব্যক্তি লৌকিক গাছের মতো আমাদের বক্ষে বেজে চলে অলিখিত ব্যাক্তিবিচ্ছেদ বিদ্যার সংবিধান। মানুষের অপরিচয়ের চিহ্ন বক্ষ জুড়ে ভেঙে পড়া মেঘের মতো যার মধ্যে আছে মানুষের মুণ্ডু ও মুণ্ডহীন জড় জগতের ইতিহাস।
**********
চিত্রাঙ্কন
********
পাবলো শাহি |
বিএ অনার্স,এম এ,পিএইচ ডি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।
জন্ম-১৯ আগষ্ট ১৯৬৫ যশোরের উপশহরে।
প্রকাশিত গ্রন্হ- ২৬টি কবিতাগ্রন্থ,০৫টি প্রবন্ধ,গবেষণাগ্রন্থ-০২টি,সম্পাদন গ্রন্হ ০২ টি।
মোট গ্রন্থ সংখ্যা ৩৫ টি।
এরমধ্যে ০৫ কলকাতা থেকে প্রকাশিত।
আশির দশকের কবি।
আশির লিটলম্যাগ মুভমেন্টের অন্যতম যোদ্ধা।
কবিতার পাশাপাশি প্রবন্ধ,গবেষণ,গল্প ও চিত্রকলায় বিশেষ ভাবে পারদর্শী।
যোগাযোগ: মোবাইল:0088-01711283813 ই -মেল:pablo.shahi1965@gmail.com
No comments:
Post a Comment