এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

পৃথা রায় চৌধুরী


মুক্ত গদ‍্য



মা-য়েলিপনা

"আমাকে রোজ আপনারা কিচু দেবেন না... একটা দুটো টাকা দিয়ে যান, দাদারা দিদিরা... আমার পা কাটা গেচে, তাও নিজের কিডনির অসুকের জন্য সাহায্য চাইচি..." ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে এগিয়ে আসে ঘ্যানঘ্যানে বছর দশেকের কাটা পা। চিটচিটে হাফপ্যান্ট, আধছেঁড়া সোয়েটার। হাতের তোবড়ানো বাটি বলে ঝন ঝন ঝন ঝন...। এর ঝন পড়লো, ওর ঝন পড়লো, সাঁঝবাতিরও একখানা ঝন পড়লো। কি গর্ব, কি গর্ব, সবাই একটাকা দুটাকা ঝন, তার দশটাকা ঝন। ঘাবড়ে যাওয়া ঘ্যানঘ্যান ফের ঘ্যানঘ্যান করেই মেলাতে না মেলাতেই, ঝালমুড়ি, সাথে প্যান্ট্রির সাহেবিয়ানা, আহা সাথে ঝোড়ায় চপ-সিঙ্গাড়া-কাসুন্দি। কতো বুভুক্ষা, গাঁ গাঁ করে সর্বস্ব গিলে ফেলা। চা কফি ডিম সেদ্ধ... এই যে, কোন স্টেশন এটা? ওই তার সাথে ঢুকে পড়ে শীতেও খালি গায়ে, একমাত্র জামা দিয়ে কামরা পরিষ্কার করা কেল্টে দুটো। একটু করে ছেঁড়া ঠোঙা, ফেলা কাপ সরায়, আর এর তার বিরক্ত হাঁটু ঠোকে, "দাও না..." দুচ্ছাই নে, যাঃ, পালা, কি না কি হাত! গাব্দা গোব্দা শিশু ভোলানাথেদের শিশুসুলভ বজ্জাতি, গর্বিত মা বাবার মাথায় সর্বদা আসন পাতা। শাসন কারে কয়? মনুষ্য প্রজাতি পূর্বপুরুষদের ফিরিয়ে আনতে ইচ্ছুক। তা একদিকে ভালোই হবে, এই সব বুঝি টুঝি না টাইপ সন্ত্রাসবাদ, ইয়ে 'রাজ'নীতি, ইয়ে ওই হাড়ে দুব্বো গজানো ইঁদুর দৌড় সব ব্যাপারে, রেপ টেপ না কি যেন বলে, সে সব আবার মুছে যাবে। "কি আনন্দ, কি আনন্দ, কি আনন্দ..." যাহ বাবা, সেই এসেই পড়লো কোত্থেকে রবি দাদুকে। কাচের বাইরে অন্ধকার, ভেতরে এসি, মৃদু ঝিকঝিক, তার মধ্যে অয়... অয় আবার ঢুকে পড়েছে এক অন্ধ "হরিগুণ রাধেরাধে" ঝনঝন। পেরিয়েও গেলো। এদিকে বোঝা যায়, পৃথিবীর বহু নর পূর্বে নারী প্রজাতিকে নিরীক্ষণ করেনি। করেনি যখন ভালোই, তাদের নিয়ে কিঞ্চিৎ গবেষণা সেও শুরু করলো। কিন্তু এরা কি ভীষণ স্বার্থপর, তাদের দিকে এই এট্টুস দিস্টি দিতেই যে যার চোখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে নেয়। ইয়া বড়ো পাঠান যাচ্চে যে একই কামরায়! ব্যাটা কি অসাধারণ দেখতে, কিন্তু ভয় ভয় করলো বেশ। চারিদিকে যা সন্ত্রাসী। এদিকে ডাক পাল্টে গেছে। "গরম চা" থেকে "চায় গরম"। কানে কানে নীল দাঁতের কামড়, হাজার চলভাষ, আহা কতোশত রূপ তাদের, কতোশত রং। নিজের হাতের খানায় খুটুর খুটুর করতে করতে আর সবার হাতের গুলোয় বেশ লোভ টোভ দিতে দিতেই, "কুলি লাগেগা দিদি, কুলি লাগেগা?" “না ভাই, দুম করে বেরিয়ে পড়েছি মেয়েকে নিয়ে, মন খারাপ করেছে মা'র জন্য।” টিকিটের ব্যবস্থা... হয়ে গেছে ১ ঘন্টায়। ছুট ছুট মা’র কাছে। লাগেজ বওয়ার দরকার হয় না এখানে আসার থাকলে। স্টেশনে ড্রাইভার গোপাল দা, "জ্বর নাকি গো দিদি?"

"দেখলে মাম্মি, সকালেই বললাম তোমার ফিভার। কোনো কথা শোনো না তুমি। এবার হলো তো?..." শুরু বারো বছরের মা'র বকুনি। পাল্টা ধমক,"এই ফিভার কি? জ্বর বলতে পারিস না?"

আহ, আজ কোলে মাথা দিয়ে শুতে দেবে মা আবার, কতোদিন পরে। আর সে জানে, এই বারোর মা তখন ঠাট্টা করবে, "মাম্মি আবার বাচ্চা হয়ে গেছে..." এখানে শুধুই মেয়ে মেয়ে যাপন, দূরে অনেক মুখোশ পুড়ছে... মুখোশপোড়া গন্ধে মিশে যাচ্ছে লিট্টি-চোখা'র ঘ্রাণ...।

পৃথা রায় চৌধুরী
জীবনী -
ভারতবর্ষ, পশ্চিমবঙ্গ নিবাসী, কলকাতা শহর। জন্মস্থান ভারতবর্ষের ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ শহরে। সাহিত্য চর্চা শুরু, ছোটবেলা স্কুলে থাকতেই। প্রাণীবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ও পরিবেশ বিজ্ঞানে ডক্টরেট।এপার ওপার বাংলার বিভিন্ন প্রিন্ট পত্রিকা ও অনলাইন ওয়েবম্যাগ ও ব্লগে নিয়মিত লেখালিখি করি ২০১২ সাল থেকেই।
নিজের একক কাব্যগ্রন্থ দুটি... "মন্দ মেয়ের সেলফি" ও "জন্মান্তরে সিসিফাস"।
এ ছাড়া এপার ওপার বাংলার বিভিন্ন কবিতা সংকলনে স্থান পেয়েছে আমার কবিতা।
কিছু কাব্য সঙ্কলনের সম্পাদনা করেছি ও ক্ষেপচুরিয়াস নামক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর মধ্যেও আছি। সহ-সম্পাদক : 'শহর' পত্রিকা
২০১৬ সালে “শব্দের মিছিল” সাহিত্য গোষ্ঠীর তরফ থেকে “আত্মার স্পন্দন” ১৪২৩ সম্মানপ্রাপ্ত হয়েছি।)

No comments:

Post a Comment