ছোট গল্প
ফেলা
গোল্ডেন ব্রাউন চুলে চিরুনি দিতে দিতে পূর্ণিমার মনে পড়ে যায় মায়ের কথা। গ্রিলের ওপাশে ফুল মুন।
এই রকম কোনো এক রাত্রিতেই পূর্ণিমার জন্ম। প্রথমে দাদা তারপর তিন দিদি, মেজদি গল্প করত, রাত্রি বেলা, দাদা তখন ওপরের ঘরে পড়ছিল, নিচের বাঁ পাশের ঘরে মায়ের নাড়ী ছিড়ে গোপালপুরের আলো দেখার জন্য আমার তখন গুহা পথে ছটফটানি, মা কাতরাচ্ছে সঙ্গে দাইমায়ের হিমসিম, মা বলত দাইমা তোমাদের আর একটা মা। পুজো, নবান্ন এইসব উৎসবের দিন গুলিতে ঘরের উঠানে এসে আঁচল পেতে বলত " কই গো মায়েরা দাইমা এসেছে" আমরাও মাকে ডাক দিতাম, মা দাইমা এসেছে" ওই গ্রামে দাইমায়ের কতো কতো সন্তান । আমার মায়ের পাঁচ নম্বর সন্তান জন্ম নেবে। সবই শোনা কথা,মেজদিই গল্প গুলো বেশি করত কারণটা খুব পরিস্কার, মেজদির বুদ্ধি একটু কম ছিল, ভীষণ সাদাসিধে ও, বুঝতই না ওসব শুনে আমার কষ্ট হত, কেঁদেছি ও বহুবার। বড়দির অনুভূতি অনেক বেশি ছিল, বারবার বারণ করা সত্তেও লুকিয়ে ও বলে ফেলত আর ছোড়দির তো তখন জ্ঞানই হয়নি ঠিকমতো তাই মেজদিই। ছেলে না মেয়ে হবে সেই চিন্তায় অধির আগ্রহে বারান্দায় পায়চারি করছিল বাবা, দাদামশাই আর দিদিরা। দিদিদের মনে মনে আশা ছিল একটা ভাই হবে, বাবার পুত্র সন্তানের আর দাদা মশাইয়ের নাতির।
"মেয়ে হয়েছে " দাইমা দরজায় মুখ বাড়িয়ে বলায়, কোনো কথা না ভেবেই বাবা বলেছিল, যা যা কুলিতে ফেলে দিয়ে আয়। মেজদি ওপরে গিয়ে দাদাকে বলেছিল,
-দাদারে আবার বোন হয়েছে, বাবা বলছে কুলিতে ফেলে দিয়ে আসতে!
-সৌম্য তখন ক্লাস টেনে পড়ে । সেই সময়ে ক্লাস টেন মানে অনেক বড় হয়ে যাওয়া , পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে সংসারে অনেক দায়ভার । পড়ছিল, পড়া তো কতো হচ্ছিল! মায়ের দিকে মন পড়েছিল, মায়ের কষ্টের কথা ভাবছিল। দাদা রেগে গিয়ে ধমকদিয়ে বলেছিল । কী ? কে বলছে একথা ?
- সবাই চুপ । বাবা বুঝেছিল, যেভাবেই বলুক ওকথা বলা তার অন্যায় হয়েছ। সেই থেকে ডাক নাম ফেলা আর ভাল নাম হয়ে গেল পূর্ণিমা।
- সারাদিন চলে যায় চুলে চিরুনি দেওয়ার সময় টুকু বার করতে পারেনা পূর্ণিমা। সূর্য লুকিয়ে পড়লে ছোটবেলায় মাথায় চিরুনি দেওয়া মানা ছিল। কাজ নেই অবসরও নেই। বুড়ো বুড়ির সংসার আর সারা দিনের কাজের মেয়ে বর্ষা। বর্ষাই এখন পূর্ণিমার সন্তান ছাত্রী ও। একটা ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে অনেকটা সময় কাটানোর ফলে মিস্ হওয়ার লোভ ছাড়তে পারেনি ।
- অষ্টমঙ্গলার দিন দাদা ফেলা বলে ডাকা নিয়ে নাকে কান্না কেঁদে ছিল, ফেলা নামটি সেই দিনই বর জেনেছিল , সঙ্গে বাড়ির লোকেরা ফেলা বলা বন্ধ করেছিল খানিকটা হলেও । দাদা মাঝেমধ্যে ফেলা বলে ডাকত আড়ালে । চিঠির শেষে লিখত "আমার আদরের ফেলা" । সেই পোস্ট কার্ড আর নেই ইনল্যান্ড লেটার নেই আর ফেলা বলার ও কেউ নেই। সেইসব কথা মনে পড়লে হাসি পায় । ফেলা নামটা ভীষণ মিষ্টি ভীষণ আনকমন লাগে আজকাল। ইচ্ছে করে ফেলা বলে একবার কেউ ডাকুক , একটিবার অন্তত ।
মোবাইলে দাদার ছবি সহ রিং টোনে রবি ভেসে উঠত মাঝেমধ্যেই, এখন আর সে ফোন আসে না । সব দাদার জন্য সব, রবীন্দ্রসংগীত ,স্কুল ফাইনাল,আই এ, কলেজে পড়া, স্কুলের চাকরি । আই এ পড়ি বাবা মা চায়নি , বিয়ের পরে কলেজ শেষ করা দাদার সাহায্য না থাকলে এগুনো অসম্ভব ছিল । স্বামী সেলের কর্মকর্তা, দাদার অনুরোধ কোনোদিন ফেলতে পারেনি । স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে বিয়ে, বাবার যাবতীয় কর্তব্য দাদা করেছে।
-কুলি রাস্তায় পরিণত হয়েছে বহুদিন, সেই ছোটবেলায়। এক সময় ঝকঝকে বালির তারপর কালো পিচের বাস রাস্তা
- এখন বাবার বাড়িতে পূর্ণিমাই সব চেয়ে সিনিয়র । নিউটাউনের "অনিমিখা" ফ্ল্যাটের সঙ্গে আগেকার বাবার বাড়ির অনেক মিল। ছতলার বারান্দায় দাঁড়ালে ধু ধু রাস্তা বহু দূর। সেই সময় শুধু এত গাড়ি ছিল না । পূর্ণিমা ছুটন্ত গাড়ির চাকায় ছেলেবেলা দেখতে পায়।
একমাত্র ছেলে সে তো সুদূর বসটন শহরে, ছবিতে দেখা হয়। একবছর হল স্কুল থেকে অবসর নিয়েছে । জানুয়ারী মাস টা তার জীবনের স্মরণীয় মাস, রাখা ফেলা রাখার মাস। গ্রিলের ওপাশে হিমেল হাওয়া স্মৃতিকে নাড়িয়ে ঝাঁকিয়ে জমিয়ে দিচ্ছে
-মাসি কঅঅফিফি রেএএডিডি এসো
-হ্যাঁ রে বর্ষা,সারে আটটা বেজে গেছে, তোকে কফি কে করতে বলল ?
-খাবার বানিয়ে জল ঘেঁটে কেঁপে গেলাম যে মাসি, ঠান্ডাটা দেখো! ডিনার তো এখন দেরি আছে
-মেসো এসোসো
-পূর্ণিমার এখন সব থেকে বেশি প্রয়োজন ছিল এক মাগ কফির। বর্ষা বড় আদরের
জয়শ্রী ঘোষ |
জন্ম ১৯শে জুন১৯৭৩,মেমারি ।
বাবার রেলের ট্রান্সফারের চাকরি।
খুব ছোট্ট বেলার মেমারি স্টেশন অঞ্চল আজও চোখে ছবির মতো ভাষে।
বড় হয়ে ওঠা বর্ধমানে, বর্তমানে বর্ধমানেই।
প্রিয় বন্ধু একমাত্র কন্যা রিমঝিম।
চারপাশের যা কিছু তাই নিয়ে লেখার চেষ্টা মাত্র যা পারিপার্শ্বিকের সাপেক্ষে নিজেকেই খুঁজে পাওয়ার জার্নি।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ প্রিয় ( অভিযান, ২০১৫)
মেঘেদের বায়োপিক ( কবিতা পাক্ষিক, ২০১৭)
No comments:
Post a Comment