এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

আর্যতীর্থ


কবিতা : সাধারণ বিভাগ



ঠোঁটকাটা

যেসব কথা বললে পরে নির্ঝঞ্ঝাট বন্ধু পেতাম
যেসব হাসি হাসলে পরে গড্ডলিকায় মিশে যেতাম
সে সব কথা তেমন হেসে বলায় ভারী খামতি ছিলো,
সুযোগ ছিলো শুধরে যাওয়ার ইচ্ছেটাতে কমতি ছিলো।

কাজেই এখন খন্দখানায় হোঁচট খেয়ে চলতে শেখা
যে সব কথায় পেট ভরে না হাত তুলে তাই বলতে শেখা।
সবাই যখন তেলা মাথায় তেল ঢেলে দেয় আগ বাড়িয়ে
আমি তখন সুযোগ পেলেই কলুকে যাই বাগড়া দিয়ে।

সংখ্যাগুরু বলছে যেটা তোতার মতন বলি না তা
দশচক্রে ভগবানও বনতে পারেন বলির পাঁঠা।
আমার মুখে সেটাই আসে যা ভেবেছি নিজের থেকে
চেঁচিয়ে বলি অন্ন কারা করছে আড়াল খিদের থেকে।

স্বভাবতই ঠাঁই মেলেনা আমার সবার সভার মাঝে
রাজপেয়াদার ভয়ডর তো ছাপোষাদের সবার আছে
এড়িয়ে চলাই ভালো ভাবে চলতি হাওয়ার পন্থী যারা
কামড় দেওয়ার সুযোগ খোঁজে রাজার নখী দন্তী যারা।

নাম কি আমার? কান পাতলেই শুনতে পাবে ফিসফাসে
আমায় চিনো ওয়াশিকুর , কিংবা বরুণ বিশ্বাসে।
সুতোয় ঝোলে জীবন আমার, গেছি তবু সার বুঝে
লংকেশদের যায় না মারা ছুরি বোমা কার্তুজে।


বিলুপ্ত

পিটিয়ে পিঠের ছাল তুলে নিলেও অভিভাবকরা যাঁদের বলতেন বেশ করেছেন,
পাশফেলের সাথে সাথে সেই মাস্টাররাও কেমন উধাও হয়ে গেলেন।
যাঁদের ভয়াল চাউনি একক্লাস কোলাহলকে স্তব্ধ করে দিতো,
পড়া না পারলে নিল ডাউন বা বেঞ্চে দাঁড় করাতেন যাঁরা নিয়মিত,
যাঁরা ধুতি পাঞ্জাবী পরে স্বচ্ছন্দে পড়াতে পারতেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ টেনিসন, শেলী, হেমিংওয়ে,
যাঁদের শাসনের মধ্যে স্নেহ থাকতো, যাঁরা চাইতেন গাধাগুলো ঘোড়া হোক বড় হয়ে,
সেই সব মাস্টারমশাই আর দিদিমণিরা ক্রমেই বিলুপ্ত হলেন ডায়নোসরের মতো।
যদিও এই পাশফেলহীন মারধোর ব্যতিরেকে সন্তান মানুষ করার যুগে,
তাদের না থাকাটাই বোধহয় যুক্তিসঙ্গত।
শুধু কি ধমকই সব, আদরও কি পাইনি ? অনাবিল  কিছু পিঠচাপড়ানি কঠিন অংক সমাধানে,
দশে আট দিয়ে সেই হেসে বলা এর থেকে বেশি আর দিই নি জীবনে,
তিনদিন না এলে কোনো বন্ধুকে দিয়ে ছিলো খোঁজ করা নিয়মমাফিক,
সেন্ট আপ হয়ে গেলে জড়িয়ে ধরাও ছিলো, বয়স্ক দুই চোখ জল চিক চিক।
গুগলের মতো হয়ে যাবতীয় নোটস আর তথ্যের ভাণ্ডার কাঁচিয়েকুঁচিয়ে যাঁরা আনতেন তুলে,
ভালো নম্বরের আগে ভালো মানুষ হও ,সে আজব কথা যাঁরা শেখাতেন স্কুলে,
কোথায় পাঠালে তাঁদের নির্বাসনে, ওহে 'নম্বরই সব 'বলা ব্রেকিংনিউজে বাঁচা সুশীল সমাজ?
এই খুনে নীল তিমি যুগে প্রজন্ম বাঁচাতে হলে, তাঁদের যে ছিলো বড় প্রয়োজন আজ।


জমানো কথা

রোজ আসা গোধূলির কোনো একটাতে
তোমার আমার কিছু কথা ভরে রেখে দেবো
কখনো একাকী হলে ষড় করা কোনো এক আগামীর হাতে
নিরালায় ঝাঁপি খুলে তোমায় আবার খুঁজে নেবো।
হয়তো তখন তুমি অন্য কোথাও গেছো এ হাত ছাড়িয়ে,
যে অচিন দেশে গেলে পৌঁছখবর দেওয়া নয় দস্তুর
খুঁটিনাটি কথাদের ঘরে ডেকে নেবো আমি দুহাত বাড়িয়ে,
দেখবো কেমন করে রোজনামচার থেকে যাও কদ্দুর।
অথবা রয়েছো তুমি অবয়বে অবিকল সামনে আমার
মগজের কোনো ব্যাধি আমাকে লোপাট করে দিলো বেমালুম,
কপালে ছোঁয়ালে হাত ঘোলাটে দৃষ্টি কোনো অপরিচিতার,
স্মৃতিহীন জীবনের নির্বাক দিনগুলো ঝিমায় নিঝুম।
তখন গোধূলি এলে পশ্চিমা জানলার পর্দা সরাবো,
অনাবিল রোদ্দুর অতীতযাপনকথা বলবে নিভৃতে,
এতাবত জমে থাকা স্মৃতির মোহরগুলো দুহাতে ছড়াবো,
দুজনের ভূমিকায় অভিনয় করে যাবো নতুন রীতিতে।
এসব কল্পকথা, এতদূর ভাবীকাল ভাবা ভালো নয়,
তার চেয়ে ভেবে রাখি ঘটমান সময়ের নানা গোলোযোগ,
তুমুল ঝগড়া শেষে ফোনেরা নিরুত্তর যেসব সময়,
তুমিহীন ঘরে ফিরে বেগতিক সংসারে ঘোর দুর্ভোগ।
তুমি ভাবো সে সময় আমি বুঝি মন থেকে ভালবাসা মুছি
কথারা গায়েব হলে মনগড়া ভেবে নিতে ব্যাপক সুবিধে,
ঝগড়ার যুক্তিতে জানি আমি পুরোপুরি উল্টো বলেছি
মোল্লার দৌড় জেনো হম্বিতম্বি শেষে থামে মসজিদে।
আমি তাই রোজকার নিপাট গোধূলি জুড়ে কথা ভরে রাখি
নিটোল মুহূর্ত কিছু কেটেছেঁটে রেখে দিই দুজনের মাপে
যদি কোনো আগামীতে ইচ্ছে অনিচ্ছায় দিতে চাও ফাঁকি
মঞ্চ জমিয়ে দেবো দুজনের ভূমিকায় একা সংলাপে।


ধৃতরাষ্ট্র

আর কত নত হবে ঈশ্বরভ্রমে রিপুঅবতার পায়ে, হে আঁধার দিশারী?
আর কত মগজের বন্ধকী কারবারে সম্ভ্রম সুদ নেবে ধর্মব্যাপারী?
আর কত ধর্ষণ হয়ে গেলে সারা, চোখ থেকে গান্ধারীপটি খুলে চোখের সামনে দেখবে ধৃতরাষ্ট্র ধর্মকে,
যার কৌরবকুল গায়ে বোমা বেঁধে উড়িয়ে দিচ্ছে বাচ্চাদের স্কুল,
আমিষের তফাতে পার্থক্য খুঁজছে ঈশ্বরের ,
পশ্চিম আর পুবদিক নিয়ে মারামারি করে সূর্যের কক্ষপথে চিরস্থায়ী দাগ করেছে রক্তের,
আর তিনি, পিতৃসুলভ বাৎসল্যের সাফাইয়ে ঢাকছেন সন্ততির যাবতীয় কুকর্মকে।
এক অদ্ভূত ধৃতরাষ্ট্র পর্ব আজ মানচিত্র জুড়ে সময় রাখছে লিখে,
এখানে কুশীলবরা নানান রঙের ফেট্টি পেঁচিয়ে দিচ্ছে চোখের চারদিকে,
যাতে  দ্যাবাপৃথিবী দৃশ্যমান হয় একটি মাত্র বর্ণে এবং  প্রশ্নাতীত আনুগত্য আসে ভক্তির নামে,
আর মাসুদ আজহার ও রামরহিমেরা, অজস্র ক্রীতদাসের বন্দনায় থাকে আরাধ্যিত আরামে!
একদিন, হয়তো এই আপাতঅন্ধের দল দৃষ্টি ফিরে পাবে।
অনভ্যস্ত আলো দেখে চোখ কচলাবে,
চারদিকে এত রঙ, তবু তারা আঁধারকে আলো ভেবেছিলো,
সে কঠিন সত্যতে লজ্জিত হবে।
আমি যেন সেইদিন দেখে যেতে পারি,
যেদিন চোখ থেকে আবরণ টেনে খুলে ফেলে আলোর ঠিকানা পাবে তাবত গান্ধারী…



পাঁচটি খুনের গল্প


১.
কিছু গাছ খুন হলো দিনেদুপুরে। চোখের সামনে ।
বিভৎস করাতের দাঁত, ছিঁড়েখুঁড়ে নিয়ে গেল পাতা সহ ডাল।
শিকড় যেটুকু ছিলো, খুঁচিয়ে মারলো তাকে প্রবল শাবল।
আমরা নিরুত্তাপ, দুয়েকটা আহা ইস পাড়াতুতো খুনের গল্পে।
শুধু, তারপর থেকে আর কোকিল ডাকেনি এখানে।

২.
গলিটা অপরিসর, বস্তুত গাড়ি ঢুকবে, পূর্বপুরুষেরা ভাবেনি কখনো।
যেমন ভাবেনি টালি টিন দরমার বেড়া, বড় হয়ে বহুতল হবে।
ভাঙাচোরা পলেস্তরাখসা এক দেড়তলা যে যেখানে ছিলো,
ভোল বদলিয়ে নিয়ে ঝক্কাস্ আধুনিক ফ্ল্যাট হয়ে গেছে।
জেঠিমা আর মেসোমশাইরা সময়ের ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে লুটিয়ে পড়েছেন।

৩.
চোদ্দ বছরে সিগারেট, সেটাও আবার স্কুলে। অশ্রুতপূর্ব নয়।
ধরা পড়ে শিক্ষকের ধমক ,স্কুল থেকে চিঠি। অভূতপূর্ব নয়।
পরের দিন মৃগীর খিঁচুনি। হাসপাতাল।মিডিয়ায় ইন্টারভিউ।
ব্রেকিং নিউজ।
কর্তৃপক্ষ  স্বীকার করেছেন শিক্ষকের দোষ। সাধারণ ঘটনা।
শুধু তালেগোলে এক শিক্ষক মারা গিয়ে চাকুরিজীবির জন্ম হলো। RIP.


৪.
কলেজের উদ্দাম বন্ধুত্বে দারু থেকে পর্ন, সবকিছু চলে।
ছেলে মেয়ের ভেদাভেদ থাকে না বিশেষ , কাম্যও নয় সেটা।
একসাথে পানশালা , সিগারেট ধোঁয়া আর আমিষ চুটকি।
মেয়েটা শুনতে পেলো তার বন্ধুরা আড়ালে তার দেহাংশ ব্যবচ্ছেদ করে।
স্বাধীন একটা পাখী ডানা মুড়ে ঝরে যায়, মরে দুম করে।

৬.
হাসপাতালে রোগীর শেষ দিন।
না না, ভাঙচুরের গল্প নয় এটা।
রোগী সুস্থ। বাড়ির লোক করজোরে ডাক্তারের সামনে। নিবেদন সহ।
টাকা কিছু শর্ট আছে।
আপনার পয়সাটা পরে দিয়ে যাই?
চেক আপে তো আসবোই এক সপ্তাহে। বর মঞ্জুর হয়।
সপ্তাহ পার হয়ে বছর গিয়েছে।
বিশ্বাস মরে গিয়ে চেম্বারে পড়ে আছে পোড়খাওয়া স্টেথোস্কোপ।

আর্যতীর্থ

1 comment: