এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

সুফিয়া নাসরিন


গল্প : ছোট গল্প



" যিশু "

মায়ের বুকের কাছে গলা জড়িয়ে শুয়ে আছে দশ বছরের ছেলেটা ৷ ডিসেম্বরের শেষ হতে চলল , বেশ ঠান্ডা পড়েছে ,  শত ছিন্ন কাঁথাটায় ঠিক মত ঠান্ডা কাটে না মা ব্যাটার ৷ ছেলেটা  বেশি ঠান্ডা লাগলে মায়ের বুকের কাছে  গুটি সুটি মেরে ঢুকে যায় ৷ মা জড়িয়ে ধরে থাকে তাকে  নিজের দেহের সমস্ত উষ্ণতাটুকু দিয়ে ৷ বাচ্চাটার  তখন আর ঠান্ডা লাগে না ৷ মায়ের তেল চিটচিটে ময়লা কাপড়ের গন্ধটাও তখন মায়ের বুকের মা মা গন্ধের কাছে হার মেনে যায় ৷  ছেলেটার বড় ভাল লাগে এই গন্ধটা  , নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে ছেলেটা ৷

     বস্তির ঝুপড়িতে যিশু নামটা বড় বেমানান ৷ তবুও পূর্ণিমা ছেলের নাম যিশু রেখেছে কারণ ওই বড়দিন না কি বলে , ওই দিনই জন্ম নিয়েছে তার এই বাপের নাম না পাওয়া  ছেলে ৷ কাজের বাড়িতে সে যিশুর জন্ম কাহিনী শুনেছে , আস্তাবলে নাকি জন্ম হয়েছিল ওই যিশুর , আর তার যিশুর জন্ম হয়েছে  বস্তির ছিটে বেড়ার ওই ঘরটাতে ৷

পূর্ণিমার জন্ম এই বস্তিতেই ৷ যে বছর বণ্যায় ভেসে গিয়েছিল বস্তিটা , সে বছর পুরো বস্তিতে কলেরা দেখা দিয়েছিল ব্যপকভাবে ৷ কলেরায় মারা যায় তার বাপ মা , সেই সময়  ৷ তারপর থেকেই জীবন যুদ্ধেই একলাই সৈনিক ছিল পূর্ণিমা ৷ দেখতে শুনতে মন্দ ছিল না ৷ ভরা যৌবনে  সেটাই কাল হল একদিন ৷ ছিটে বেড়া ভেঙে তুলে নিয়ে গেল বছর পনের ষোলোর পূর্ণিমাকে চারজন মিলে ৷ যাদের শারিরীক ক্ষুধা মেটানোর ফসল হল এই ছেলে ৷ কিন্তু মা হয়ে ছেলেকে দূরে ঠেলে সরাতে পারে নি ৷ কুমারী মা হলেও ফেলে দিতে পারে নি ছেলেটাকে ডাস্টবিনের গাদায় ৷ বরং তাকে বুকে আগলে নিজের একাকিত্ব জীবনের সম্বল করে বেঁচে আছে পূর্ণিমা ৷

বড়দিনের দিনই জন্ম হয় ছেলের , তাই সাধ করে নাম দেয় যিশু ৷ ছোট্ট যিশুকে নিয়েই পূর্ণিমার সব স্বপ্ন ৷ বস্তির কাছে সরকারি স্কুলে ভর্ত্তি করেছে ছেলেকে ৷ একটা বাড়িতে ঠিকে  কাজ করে পূর্ণিমা , তাছাড়াও ঘরের কাজ কাম সেরে সন্ধ্যাবেলায় বসে বসে বিড়ি বাঁধে , বেশ কিছু টাকা আসে হাতে ৷ এই করেই কোন রকম চালিয়ে নেয় দুটো পেট ৷

তাছাড়া স্কুল থাকলে সেখান থেকেই ছেলেটা দুপুরের খাবারটা পেয়ে যায় ৷ যেদিন যেদিন স্কুলে গোটা ডিম দেয় , লুকিয়ে পকেটে ভরে নেয় যিশু মায়ের মুখটাকে মনে করে ৷ বাড়ি ফিরে মাকে বলে তুমি খাও তো ! আমি চেয়ে দেখি ৷ মায়ের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে ছেলের ভালবাসা পেয়ে ৷ বুকের কাছে টেনে আদর করে খানিক , তারপর ডিমের অর্ধেকটা নিজের দাঁতে কামড়ে নিয়ে বাকিটা গুঁজে দেয় ছেলের মুখে ৷

"মা , কাল একটা কেক কিনে দেবে ? " ছেলের কথায় চোখ মেলে তাকায় পূর্ণিমা ৷ "দেব রে দেব , তোকে টাকা দেব বাপির দোকান থেকে একটা বাপুজি কেক কিনে নিস ৷ "
ওই কেক খাব না ৷ "বড় রাস্তার উপরে যে দোকানটা আছে সেখানে কাঁচের বাক্সোর ভিতরে  কত সুন্দর সুন্দর কেক সাজানো থাকে মা , জানো ! এবার আমি ওই রকম একটা কেক কিনতে চাই ৷"
পূর্ণিমা জানে ওই দোকানে কেক কেনার মত টাকা নেই তার কাছে কিন্তু ছেলেকে আপাতত ঘুম পাড়াবার জন্য মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয় ৷
ছেলেও বিশ্বাস করে নেয় মায়ের কথা , ঘুমিয়ে পড়ে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে ৷

সকাল হতেই পূর্ণিমাকে বেড়িয়ে পড়তে হয় কাজে ৷ রাতের কথা সে ভুলেই গেছে সব ৷ ছেলের স্কুলে বড়দিনের ছুটি থাকায় তাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ঘরেতে রেখে বের হয় কাজে ৷
কাজের বাড়িতে আজ বেশ হৈ চৈ ৷ বড়দিন পালন চলছে ৷ কত আলো দিয়ে সাজিয়েছে গোটা বাড়িটা ৷ গিন্নিমা কেক বানাচ্ছে বেশ বড় সড় ৷ পূর্ণিমার মনে পড়ে যায় রাতের কথা ৷ তাই তো ! আজ ছেলের জন্য একটা কেক কিনে নিয়ে যেতে হবে ! গিন্নিমার কাছে মাইনের কিছু টাকা চাইবে ভাবছে , আর ক দিন পরই তো মাস পড়বে  , যদি আগে ভাগে দেয় !

পূর্ণিমা চেয়েছিল গিন্নিমার কাছে মাসের মাহিনেটা , কিন্তু নতুন মাস না পড়লে টাকা দেবে না সাফ জানিয়ে দিল তাকে ৷ কাজ শেষ করে খালি হাতেই ফিরে এল ঘরে সে ৷ অধীর প্রতীক্ষায় বসেছিল ছোট্ট যিশু  বাড়িতে মায়ের আসার পথ চেয়ে ৷

মা কে খালি হাতে আসতে দেখে ছোট্ট মনটা ভরে গেল একরাশ অভিমানে ৷ কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকল বিছানার উপর ৷ পূর্ণিমা বুঝতে পেরে একটু আদর করে দিয়ে গেল ছেলেকে ৷ মাথার ঘন চুলে আঙুল চালিয়ে একটু পরিপাটি করে দিল ছেলের মাথাটার চুলগুলো  ৷ কপালে একটা চুমু এঁকে বলল , আজ একটা কেক কিনে দেব বাপির দোকান থেকে ৷ বুঝলি সোনা ?যিশুর মনটা মোটেই ভাল নেই , তার মন পড়ে আছে কাঁচের বাক্সটার ভিতরের কেকগুলোর প্রতি ৷ মা চলে গেল ঘরের কাজ সারতে ৷

উঁকি দিয়ে দেখে মা কাজে ব্যস্ত , পা টিপে টিপে বেড়িয়ে আসে যিশু  ঘর থেকে ৷ ছুটতে ছুটতে চলে আসে বড় রাস্তায় কেকের দোকানটার সামনে ৷ কি সুন্দর করে আলো আর কাঁচের সুন্দর সুন্দর পুতুল দিয়ে সাজিয়েছে দোকানটা ৷  কত ভীড় আজ দোকানে ৷ কেক কিনছে সবাই , কত সুন্দর তাদের জামা কাপড় ৷

নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখল যিশু  , মা আজ সব চেয়ে ভাল জামাটাই তাকে সকালে পরিয়ে দিয়েছে , তবু কেমন যেন পুরানো পুরানো জামাটা ৷  গায়েও বেশ আঁটো সাঁটো বসে গেছে ৷ গত বছর মায়ের কাজের বাড়ির গিন্নিমা দিয়েছিল তার ছেলের গায়ে আর হয়নি বলে ৷ খালি পা ,  এক পা এক পা করে এগিয়ে এল দোকানের সামনে , বড় বড় চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকল রং  বে রঙের কেকগুলোর দিকে ৷ কোনটা ফুলের মত দেখতে , কোনটা আবার গাড়ির মত , আবার পুতুলের মত দেখতেও আছে ৷ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সে ৷
"আমাকে একটা কেক দেবে ? ওই ছোট্ট কেকটাই দাও না ! "হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে চায় যিশু ৷
"যা , যা এখান থেকে ৷ যতসব বস্তির ভিখারি ৷" দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল দোকান দার ৷ দোকানের সামনে একজন সুট বুট পরা লোক একটা কেক হাতের তালুর উপর নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে , কিনবে হয়ত ! যিশু দৌড়ে গিয়ে তাকে নাড়িয়ে বলল " কাকু আমাকে একটা কিনে দেবে ? " কিন্তু তার মুখের কথা শেষ হবার আগেই তার হঠাৎ নাড়ানোর জন্য ভদ্রলোকটির হাত কেঁপে  ওঠে , পড়ে যায় কেকটা মাটিতে ৷ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনেরা হৈ হৈ করে ওঠে ৷ দোকানি আর নিজের রাগ সামলে পারে না ৷ কাঁচের বাক্সটার উপরে রাখা কাঁচের শো পিসটাকে হাতে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারে যিশুর দিকে ৷ মাথায় লাগে সেটা ৷ ফেটে যায় মাথা , মাথার আঘাতে কাঁচের শো পিসও ভেঙে যায় ছোট ছোট টুকরোয় , টুকরোগুলো কাঁটা তারের মত মুখে গায়ে বিঁধে যায় ছোট্ট যিশুর , রক্ত ঝড়তে থাকে কাঁচ বেঁধা জায়গাগুলো থেকে ৷ কিন্তু যিশুর সেদিকে খেয়াল নেই , মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে সে তখন রাস্তার উপর পড়ে থাকা ভেঙে যাওয়া  কেকটাকে  কুড়িয়ে নিতে ব্যস্ত।

সুফিয়া নাসরিন
আমি সুফিয়া নাসরিন ৷
বর্ধমানে জন্ম হলেও বর্তমানে হুগলীর চন্দননগরের বাসিন্দা ৷
সাম্মানিক বাংলা নিয়ে কলেজের গন্ডী পার করেই বিয়ের পিঁড়িতে বসা ৷
অতি সাধারণ গৃহবধূ , হাতা খুন্তি ধরার ফাঁকে ফাঁকে কলম নিয়ে খাতার উপর আঁকিবুকি কাটতে ভালবাসি ৷
ভালবাসি বৃষ্টিতে ভিজতে , গল্প - উপন্যাস , কবিতা পড়তে , আর হেড ফোনে গান শুনতে ৷
" অর্ধেক পৃথিবীর রোজনামচা " নামক আমার প্রথম গল্প সংকলনটি  প্রকাশ পেল  নভেম্বর মাসে বর্ধমান লিটিল ম্যাগাজিন মেলায় ৷

No comments:

Post a Comment