এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

দীপেন ভূঞ্যা


প্রবন্ধ


—আমার টুসু—
==========
বাঙালির 'বারো মাসে তের পার্বণ' এর খুব কম অংশ জুড়ে রয়েছে 'টুসু' পূজা বা টুসু'উৎসব! মূলত রাঢ় অঞ্চল, বিশেষ করে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, বীরভূম প্রভৃতি নির্দিষ্ট কয়েকটি জেলার মানুষদের মধ্যে এই টুসু'পুজার প্রচলন লক্ষ করা যায়৷ তথাকথিত শিক্ষিত এবং স্বঘোষিত সভ্যসমাজের কাছে এই উৎসব এখনও ব্রাত্য৷ তবু টুসু'উৎসব টিম টিম করে টিকে আছে বা বলা ভাল যে টুসু তার কৌলীণ‍্য বজায় রেখেছে গ্রামীন কিছু খেটে খাওয়া এবং জীবন সংগ্রামে প্রতিনিয়ত লড়তে থাকা মানুষের অন্তরে৷
টুসু সে অর্থে কোন নির্দিষ্ট দেবদেবী নয়৷ তাই এ পূজার নির্দিষ্ট কোন মন্ত্র নেই, নেই কোন নির্দিষ্ট বিধি বিধান, আচার অনুষ্ঠান৷ এটি একটি অব্রাহ্মনিক, অপৌরানিক উৎসব৷ কোন পাঁজিপুঁথিতে এই পুজো সম্পর্কে বিশদে কিছু পাওয়া যায়না৷ বিভিন্ন লোকগাথা এবং লোকশ্রুতি থেকে যেটুকু পাওয়া যায় সেখানে টুসু কে শস্যের দেবী হিসেবে কোথাও কোথাও বর্ননা করা হয়েছে৷
গ্রামের কৃষিজীবি সম্প্রদায় জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক অর্থনৈতীক পরিস্থিতি সম্পূর্নভাবে নির্ভর করে ক্ষেতের ফসলের ওপর৷ যদি প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট কারনে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয় তাহলে ঐ মানুষগুলোর অসহায়তা চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়৷ তাই যাতে মাঠের ফসল ঘরের মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটাতে পারে সেই জন্যই টুসু দেবীর আরাধনা৷ এই আরাধনায় না থাকে কোন আড়ম্বর আর না থাকে কোন অহঙ্কার৷ দেবীর আরাধনায় গ্রামের কুমারী মেয়েরা মুখে মুখে 'টুসুগান' করে দেবীকে সন্তুষ্ট করার প্রয়াস রাখেন৷
আবার কিছু কিছু স্থানে টুসুপূজার ইতিহাস অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে! গ্রামের গরীব বাড়ির কুমারী মেয়ে টুসু প্রণয়াবদ্ধ হয় অপর এক পুরুষের সাথে৷ কিন্তু কালের ফেরে তাদের মিলন অনিশ্চিত হলে সেই যুবক সন্ন্যাস নিয়ে হারিয়ে যায়৷ এদিকে টুসুও তার হারানো প্রেমিকের খোঁজে দেশ দেশান্তরে হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকে৷ তারপর একদিন সূবর্ণরেখার তীরে দুই প্রেমিক প্রেমিকার সাক্ষাত হয়! যদিও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি সেই প্রণয়! অনাহার আর ভগ্নশরীরে টুসু ও তার প্রণয়ী মৃত্যূবরন করেন৷
এইরুপ আরও অনেক লোকশ্রুতিতে টুসু বিভিন্নভাবে সাধারন মানুষের আবেগ এবং অনুভূতির প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে, পূজ্যদেবী হয়ে উঠেছে৷
টুসু আসলে মানব এবং প্রকৃতির মেলবন্ধনে সৃষ্ট একটি কাল্পনিক দেবীমানবী৷ আর তাকে সামনে রেখেই সৃষ্টি হয় একের পর এক গান, 'টুসু গান'৷ কোল, মুন্ডা, ওরাওঁ, সাঁওতাল, কুর্মি, মাহাতো ,বাউরী, বাগদী সম্প্রদায়ের কুমারী মহিলারা এই পুজো করেন। অবশ্য বিবাহিতা মহিলা বা কিছুক্ষেত্রে পুরুষদেরও সরাসরি অংশগ্রহন করতে লক্ষ করা যায়৷
হেমন্তে নতুন ধান তোলার সময় মেয়েদের ‘তুষতুষালী’ ব্রতের গানগুলো টুসুগান নামে পরিচিত। আঞ্চলিক ভাষায় রচিত গানগুলির সেভাবে কোন লিখিত দলিল পাওয়া যায়নি, যদিও বর্তমানে এই গানগুলি সংরক্ষনের প্রচেষ্টা চলছে৷ সাধারনত মুখে মুখেই এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে গানগুলি তার ঐতিহ্য বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন৷ আর এই বিবর্তনের পথে কিছু গান যেমন হারিয়েছে, তেমনি নতুন শব্দ নতুন ছন্দও যোগ হয়েছে৷ টুসুগান আসলে মানুষের মনের কথা, মনের ভাষা, আবেগ অনুভূতি, চাওয়া পাওয়া, প্রেম বিরহ এই সবকিছু, যা ফুটে ওঠে কিছু কথা আর সুরের মাধ্যমে৷
টুসু সত্যাগ্রহ ছিল মানভূমের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম বড় হাতিয়ার। প্রাক্তন সাংসদ ভজহরি মাহাতোর লেখা টুসুগান-
'শুনো বিহারী ভাই,
তরা রাইখতে লারবি ডাং দেখাঁই'
এই গান আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। কিছুদিন আগে টেট পরীক্ষার্থীরাও টুসু ও চৌডল নিয়ে পুরুলিয়া শহরে পদযাত্রা করেছিলেন। তাঁরাও জানিয়েছিলেন, টুসুর মাধ্যমে আন্দোলন অন্য শক্তি পায়। অন্যান্য জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব আবহের মাঝে মানভূমের জাতীয় উৎসব অবশ্যই টুসু। মকর সংক্রান্তির দিন গ্রামাঞ্চল জুড়ে পালিত হয় টুসু উৎসব৷
সাধারনত অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি থেকে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত এক মাস ধরে পালিত হয় এই টুসুপুজা৷ প্রতিদিন গ্রামের মেয়েরা মাটির ছোট্ট টুসুঠাকুরের প্রতীমাকে নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে টুসুগান গেয়ে বেড়ায়৷ সেখান থেকে প্রাপ্ত অর্থ বা চালডাল পুজোর নৈবেদ্য হিসেবে কাজে লাগে৷ এদিকে মাঠজুড়ে সোনার ফসল ধান কাটার পর এক গোছা নতুন ধান পরিবারের বয়োজৈষ্ঠ পুরুষ সদস্য মাথায় করে এনে খামারে পিঁড়িতে অথবা কখনও গাছের ডাল বা বাড়ির ঠাকুরমন্ডপে রেখে দেওয়া হয়। এরপর অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের কুমারী মেয়েরা টুসু আরাধনায় মেতে ওঠে৷
এভাবেই প্রতি সন্ধ্যাবেলায় কুমারী মেয়েরা দলবদ্ধ হয়ে টুসু দেবীর নিকট তাঁদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও অর্থনৈতীক অভিজ্ঞতা সুর করে নিবেদন করেন৷ এরপর দেবীর উদ্দেশ্যে চিঁড়ে, গুড়, বাতাসা, মুড়ি, ছোলা ইত্যাদি ভোগ নিবেদন করেন।
পৌষ সংক্রান্তি বা মকরের দিন ভোরবেলায় মেয়েরা দলবদ্ধভাবে গান গাইতে গাইতে, টুসু দেবীকে রঙিন জামাকাপড় পরিয়ে নদী বা পুকুরে নিয়ে যান। সেখানে প্রত্যেক টুসু দল একে অপরের টুসুর প্রতি বক্রোক্তি করে গান গাইতে গাইতে টুসুদেবীকে পুকুর বা নদীর জলে বিসর্জন করে থাকেন। টুসু বিসর্জনের পরে মেয়েরা নদী বা পুকুরে স্নান করে নতুন বস্ত্র পরেন। মকর সংক্রান্তির দিন এই ডুব দিয়ে স্নান করার রীতিকে 'মকরডুব' বলা হয়৷ এরপর স্ত্রী পুরুষ, বৃদ্ধ বালক নির্বিশেষে সকলেই আনন্দে মেতে ওঠেন৷
টুসুগান শুধুই গান বা পুজার মন্ত্র নয়, টুসুগান একটি হাতিয়ার৷ যার উপর ভর করে অসহায় মানুষগুলো, নিপীড়িত মানুষ গুলো তাদের অসহায়তার কথা বলে, কখনও বিদ্রোহ করে৷ কখনও প্রেম ভালবাসা অভিমান এর অব্যক্ত ভাষা হয়ে ওঠে টুসুগান৷ সব, সব কিছুই তারা টুসুগানের মাধ্যমে তুলে ধরে৷
প্রবল বন্যায় বাড়িঘর ভেসে যাওয়ার ঘটনা তাদের গানে ভেসে ওঠে৷ প্রচন্ড ক্ষরায় জ্বলে পুড়ে যাওয়া ফসলের কথা, ক্ষুধার্ত পেটের কথা তাদের সুরে ভেসে বেড়ায়—
'এই স্বাধীন দেশে।
মেয়েরা চইলবেনা আর স্বামীর বশে'।
তীব্র প্রতিবাদের ভাষা৷ মাতাল স্বামীর অত্যাচার অথবা তথাকথিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার গালে কষে চপেটাঘাত৷ নারীপুরুষের সমান অধিকারের ভাষা গানের মাধ্যমে প্রকাশ পায় তাদের গলায়৷
'এ বছরকে যেমন -তেমন
আইসছে বছর 'মোড় 'দিব।
হাজার টাকার গয়না আইনে
টুসুধনকে সাজাব৷'
অসহায়তার কথা ফুটে ওঠে৷ এবছরের দূর্দশার কথা ফুটে ওঠে৷ কন্যার প্রতি অপত্যস্নেহ যেমন ভর করে মাকে, ঠিক তেমনি টুসুর প্রতিও ভালবাসা প্রকাশ পায় গানের ভাষায়৷ পরের বছর আরও ভাল কিছু দেবার প্রতিশ্রুতি অর্থে আশা রাখে৷ আসলে টুসুর কাছে প্রার্থনা থাকে, যেন পরের বছরটা এবছরের চেয়ে ভাল যায়৷ আরও ভাল ফসল ফলে আরও সুখ স্বাচ্ছন্দ বৃদ্ধি পায়৷
টুসুগান কে হাতিয়ার করেই দৈনন্দিন জীবনে প্রাত্যহিক সম্পর্কের টানাপোড়নের কথা উঠে আসে৷ বিবাহিত অবিবাহিত মেয়েদের দৈনন্দিন ঝগড়া, কলহ, ইর্ষাপরায়নতা, প্রতিশোধস্পৃহা সব সব৷
সমসাময়িক রাজনীতির কথা, সাক্ষরতা, পণপ্রথা সম্বন্ধে সচেতনতা, বধূ নির্যাতন প্রতিরোধের মত সামাজিক দায়িত্বের কথাও বলা হয়।
'টুসু আমার গরবিনী
ওগো আমার টুসুমনি
মাথায় দিলো সোনার মুটুক
আর শাড়ি দিব জামদানি'
আক্ষরিক অর্থেই মাটির ছোট প্রতীমা অর্থাৎ টুসুঠাকুরও কন্যাসন্তান রুপে স্নেহলাভ করে৷ যেখানে বর্তমানে কন্যাভ্রূণ হত্যায় বহু কন্যারত্ন জন্মলাভের আগেই শেষ হয়ে যায়, সেখানেই গ্রামের মহিলারা কন্যাসন্তানকে মাতৃরূপে পূজা করে৷
আবার বড় হলে যেমন প্রতিটি মেয়েকেই বিবাহপরবর্তী সময়ে স্বামীর বাড়ি অর্থাৎ শ্বশুরবাড়ি যেতে হয়! সেই কঠোর বাস্তবতাও ফুটে ওঠে টুসুগানে৷ মেয়ে রূপে যাকে পুজা করা হয়, পূজাঅন্তে তাকে জলে ভাসিয়ে দেওয়ার মধ্যেও পিছুটান কাজ করে৷ নিজের মেয়েকে কি আর জলে ভাসিয়ে দেওয়া যায়, তাই এই জলকেই টুসুর শ্বশুরবাড়ি হিসেবে কল্পনা করে মেনে নিতে হয়৷ বিবাহের পরেও যেমন মেয়েরা বাপের বাড়ি আসে ঠিক তেমনই ফিবছর টুসুও ফিরে আসে, পূজা পায় এবং তারপর আবার শ্বশুরবাড়ি অর্থাৎ জলে ফিরে যায়৷
তবু কখনও কখনও বাস্তবকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকেনা! বুকের কষ্টটাকে পাথর চাপা দিয়েই আটকে রাখতে হয়
'টুসু ধনকে জলে দিব না
মাকে ছাড়ি যাব যদি মাওসী ছাড়ি যাব না!
ও মাওসী তোর পায়ে পরি,
তোকে ছাড়া যাব না!
টুসু মাকে জলে দিব না,
আমদের মনে বড় বেদনা,
টুসু ধনকে জলে দিব না৷
জল জল কর টুসু ধনকে জলে দিব না'৷
আবার গ্রাম্যজীবন ধারার পারস্পরিক হিংসা বিদ্বেষের কথাও ফুটে ওঠে! আমার মেয়ে যেন আরও ভাল থাকে আর ওদের মেয়ের দূর্দশা যেন আরও বৃদ্ধি পায়—
'ওদের টুসু লাইতে গেল
পচা ডোবার ঘাটেতে,
আমার টুসু পা ডোবালো
দুধপুকুরের ঢেউএতে৷
আমার টুসু পান চিবিয়ে
রাজরানীর মত রাঙা হয়
ওদের টুসুর ভিখিরির দিন
যেন কখনও শেষ না হয়'৷
অবশ্য পারস্পরিক সৌহার্দ্যের কথাও ফুটে ওঠে
'আমার টুসু ফুল তুলিবে
চুড়ি ঝমঝম করেগো৷
ওদের টুসু ফুল তুলিবে
জুতো মসমস করেগো'৷
পিছিয়ে পড়া মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে পুজিতা দেবী টুসু যতই আধুনিক সমাজের কাছে গ্রহনযোগ্য না হোক! কিন্তু কিছু মাটির মানুষের কাছে তিনি মন প্রাণ থেকেই আরাধ্যা হয়ে চলেছেন৷
হয়ত সেই মানুষগুলোর প্রভুত ক্ষমতা তা সেটা আর্থিক হোক বা সামাজিক কিংবা রাজনৈতীক, নেই৷ কিন্তু একটা পারস্পরিক ভালবাসার এবং আত্মীক টান, অনুভব আছে৷
মাটির মানুষগুলোর একটা গ্রাম আছে আর একটা বড়পুকুর আছে৷ তার একটা পাড় আছে৷ সেখানে ত্রিপলের ছাউনি, তার নীচে রাতজাগা কয়েকটা মানুষ আছে৷ তাদের সবথেকে বড় মন আছে৷ তাদের টুসু আছে৷ আর আছে টুসুগান৷

(তথ্যসূত্র— উইকিপিডিয়া এবং লেখার টুসুগান গুলি পশ্চিম মেদিনীপুরের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল থেকে সংগৃহীত)৷


—সমাপ্ত—

দীপেন ভূঞ্যা
সহশিক্ষক,
রামজীবনপুর বাবুলাল বিদ্যাভবন৷
চন্দ্রকোনা, পশ্চিমমেদিনীপুর
প্রকাশিত বই : ছোটগল্পের একক সংকলন— 'অসমাপ্ত গল্প'

No comments:

Post a Comment