এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

মুরারি সিংহ


কবিতা : সাধারণ বিভাগ


ও মুসাফির

হলুদ-নদীর ট্র্যাফিক-জ্যাম থেকে বলছি
কোনো পাতাবাহারের মনোরঞ্জনের জন্যেই হয়ত
              এত খনিজ আলিফ

প্রেসার-কুকারে সেদ্ধ হচ্ছে আমার বিদেহী আত্মা
            ও মুসাফির একটু দাঁড়াও আর
আমার জন্যে একটা আয়না আনো
একবার দেখে নিই
আমার যে লাফিয়ে ওঠা বুকব্যথা
তার হাসির সঙ্গে
ফ্যারাওয়ের ভেদবমির রিলেশনটি
এখন ঠিক কতখানি আহ্লাদের জন্ম দিচ্ছে

ও মুসাফির একটু দাঁড়াও একবার দেখে যাই
গোধূলির পাখি-সাঁতারে পুরোন কাঁথাস্টিচে জারি
আমার মনকেমনরা
এখন কেমন আছে

দাঁড়াও ঘৌড়দৌড় লতিয়ে ওঠার আগেই
শর্ট-প্যান্ট না-পরা ঈশ্বরকে
আরো কিছু নিমপাতা সাপ্লাই করি



অঙ্কখাতা

নতুন নায়িকার সন্ধানে দু-পা এগোতেই
উড়ে এল একটা গোলাপি খাম
তার ভিতর মাস্তুন-ওড়ানো দুপুর

এইভাবে চৈত্রমাসের প্রতিপদে কিছু বৃষ্টি এল
গঙ্গাবক্ষে ভেসে যাওয়া সারি সারি নৌকায়
একটাতে ওথেলো -ডেসডিমোনা
        একটাতে দুষ্মন্ত-শকুন্তলা
            তো আরেকটাতে
ডোমনি ও ব্রাহ্মণ-বালক

অতসিফুলের সশস্ত্র-হানায় লণ্ডভণ্ড হল বসন্তকাল
প্যারাডিম ফাটিয়ে পটলভাজারা উঁকি না দিলেও
বাস্তিল-দুর্গ কিছুটা কেঁপে উঠল বৈকি  

মাথায় বাসতেল মেখে শালবনের ঝরাপাতারা বলল
            বিমানসেবিকাদের ফুটনোট যা বলে বলুক
এবার তোমার অঙ্কখাতায় অনায়াসে লিখে নিতে পারো
ভালোবাসা/সার্ফএক্সেল
                            =
কানাবেগুন/ঝালচানাচুর


**********

মুক্ত গদ‍্য


যখন প্রথম ফুটেছে কলি

সেই যে রবীন্দ্রনাথ একদা তাঁর একটি জনপ্রিয় গানে বলেছিলেন –
অমল ধবল পালে লেগেছে     মন্দ্রমধুর হাওয়া -
                     দেখি নাই কভু দেখি নাই      এমন তরণী বাওয়া।।
আজ এই উত্তর-পঞ্চাশে কিশোরকাল নিয়ে লিখতে বসে এই গানটির কলিটিই আমার প্রথমে মনে এল। আমার মাথার ভিতর যে সার্চ-ইঞ্জিন আছে কেন জানি না তা এই মুহূর্তে টিন-এজ সম্পর্কে এর থেকে ভালো উপমা আর খুঁজে পাচ্ছে না।    
অবশ্য এই মতামত একেবারেই তার ব্যক্তিগত। কারণ বয়ঃসন্ধির এই সময়কে নিয়ে আরো অনেক চমৎকার কবিতা বা গান লেখা হয়েছে। যেমন ছাত্রদলের গান বা আঠারো বছর বয়স। সেই সব কবিতা বা গান নিজস্ব বিভায় ভাস্বর। সেদিক দিয়ে দেখলে রবি ঠাকুরের গানটি প্রত্যক্ষভাবে ঠিক নবযৌবন সম্পর্কিত নয়। সেটি প্রকৃতি পর্যায়ের ১৪৫ সংখ্যক গান। তবু গানটি শুনলে আমার কিশোরবেলার কথাই মনে পড়ে যায়। ওঃ! কী অসাধারণ সেই সৃষ্টি। যেমন কথা তেমনি তার সুর -
         কোন সাগরের পার হতে আনে  কোন সুদূরের ধন –
            ভেসে যেতে চায় মন,
         ফেলে যেতে চায় এই কিনারায় সব চাওয়া সব পাওয়া।।
পিছনে ঝরিছে ঝরো ঝরো জল, গুরু গুরু দেয়া ডাকে
        মুখে এসে পড়ে অরুণকিরণ ছিন্ন মেঘেরে ফাঁকে।
           ওগো কাণ্ডারী, কে গো তুমি, কার হাসি কান্নার ধন
                ভেবে মরে মোর মন –
           কোন সুরে আজ বাঁচিবে যন্ত্র, কী মন্ত্র হবে গাওয়া।।
গানটির পরতে পরতে জড়িয়ে আছে এক অনাবিল ভালোলাগা এবং ভালোবাসা। যা কানের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করে  সমস্ত মনপ্রাণ ভরিয়ে দেয়।   
কিশোরবেলাও তো তাই।
আমার মতে, এই বয়েস হল মানবজীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়। প্রকৃতিও চিরযৌবনা । সব সময়েই সে সবুজ ও চঞ্চল। বসন্তের সমাগমে ঝরে যায় পুরোন ও হলুদ পাতারা। সুতরাং সেখানে বার্ধক্যের কোনো জায়গা থাকে না। ঠিকঠাক বিচার করলে শেষ-পর্যন্ত কিশোরবেলাও তো সেই এক প্রাকৃতিক ঘটনাই।   
বাংলায় বলা হয় বয়ঃসন্ধি-কাল। ইংরেজিতে তার নাম adolescence বা puberty।  
প্রকৃতির নিজস্ব নিয়ম মেনেই যথাসময়ে মানবশরীরে তার আগমন। ছোট্ট মানুষের দেহ-মনে তার অমোঘ বিকাশ ও অসীম প্রভাব প্রতিপত্তির বিস্তার। আহা কী মনোরম, কী চমৎকার এই বয়স। মনের ভিতর আঁকা হতে থাকে এক কল্পরাজ্য, এক স্বপ্ন-মদির দেশ। যেখানে সবকিছুতেই সম্ভব-অসম্ভব নানান রঙের ছোঁয়া। কত হই-হুল্লড়, কত হাসি-গান-গল্প, কত মজা। কত রকমের সেই সব ছবি। ক্ষণে ক্ষণে বদলে যায় তাদের রঙ। স্বপ্ন দেখা দু-চোখে চারপাশের সবকিছুকেই ভীষণ সুন্দর লাগে। আর যা যা সুন্দর সবকিছুকেই বড়ো ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। আদর করতে ইচ্ছে করে। তাদের কাছে পেতে, বা ছুঁয়ে-ছেনে দেখতে ইচ্ছে করে।
শৈশবের পরেই আসে কৈশোর। এই যে শৈশব থেকে কৈশোরে পৌঁছানে। মানে একটা সুন্দর পোশাক ছেড়ে আরেকটা সুন্দর পোশাক গায়ে চাপানো। তার ক্যানভাসে আঁকা হয়ে যায় এক দিকে সদ্য ফেলে আসা শৈশবের দামাল-দস্যিপনার স্মৃতি, অনাদিকে সামনে নতুন যৌবনের হাতছানি। চঞ্চল কিশোর থেকে গোঁফের রেখা দেখা দেওয়া সদ্য যুবক বা দু-বেণী দোলানো এক্কা-দোক্কা খেলা কিশোরী থেকে ডাগোর যুবতি হবার অপেক্ষা। সেখানেও কত অ্যাডভেঞ্চার, কত রাগ-অনুরাগ, কত রোমাঞ্চ, কত উন্মোচন, কত শিহরণের ইঙ্গিত। বুকের ভিতর ছলাৎ ছলাৎ বয়ে চলা কত অচেনা অজানা অনুভূতি।
এই যে খুব অল্প-সময়ের মধ্যে পর পর জীবনের দু-দুটো বড়ো সন্ধিক্ষণ। মানুষের জীবনে কৈশোর বড়ো বেশী জীবন্ত। বড়ো বেশি সবুজ। যখন সব বাধা-নিষেধ অগ্রাহ্য করে প্রাণ এক অফুরন্ত আকাশে ডানা মেলে উড়ান দিতে চায়।
আমাদের মতো যাদের কাছ থেকে এই দুষ্টু-মিষ্টি সময়টা বহুদিন আগে টা-টা বাই-বাই করে চলে গেছে বহু দূরে, তাদের পক্ষে আবার সেই কৈশোর নিয়ে লেখালিখি করাটা খুব সহজ কাজ নয়। মনে পড়ে যাচ্ছে সুপরিচিত কিশোর-সাহিত্যিক দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার তাঁর একটি উপন্যাসের ভূমিকা লিখতে গিয়ে বলেছিলেন – ‘কিশোরদের উপন্যাসের অক্ষর লিখতে কালিটে নিতে হয় সবজে’। এখন যদিও প্রযুক্তি-নির্ভরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের হাতে লেখার অভ্যাস কমে আসছে, কমছে কালির ব্যবহার। সব কাজই এখন অল্প আয়াসে ডিটিপি-পেজমেকারে করে নেওয়া যায়। তবে কিশোরদের জন্য প্রকাশিত প্রায় সমস্ত পত্র-পত্রিকা বা গল্প-উপন্যাসে রঙিন ছবি ও রেখার কাজ লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে গেছে, উদ্দেশ্য একটাই, সেগুলিকে কিশোরদের উপযোগী করে পরিবেশন করে তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করা। আসল কথা কিশোরদের কথা ভাবতে বা লিখতে হলে নিজের মনটাকে সবুজ ও তরতাজা রাখতে পারা চাই।  
এই প্রসঙ্গে আবার রবি ঠাকুরের কবিতার কথা উল্লেখ না করে পারা যায় না। সেই বিখ্যাত কবিতাটি, যেখানে কবি সেই নতুন যৌবনকেই আহ্বান করেছেন।–‘আয় রে সবুজ, আয় রে আমার কাঁচা আধ-মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’। মনে পড়ে যায় বিদ্রোহী-কবি হিসেবে পরিচিত নজরুলের সেই আগল-ভাঙার ডাক বা আঠারো বছরের জয়ধ্বনি দিয়ে কিশোর-কবি হিসেবে চিহ্নিত সুকান্ত ভট্টাচার্যের দুরন্ত কামনা এদেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।
এতো গেল কবিদের উপলব্ধির কথা।
কবিরা একটু বেশি বেশি কল্পনা-প্রবণ। কবিরা নতুন প্রজন্ম সম্পর্কে ইতিবাচক ছবি উপহার দিলেও বয়স্কদের ধ্যান-ধারনা কিন্তু অন্য রকম। কম বয়সীদের সম্পর্কে বেশিরভাগ সময়েই অগ্রজরা একটু নাকউঁচু মনোভাব পোষণ করেন। তাঁদের কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা যে বার্তাগুলি ছড়িয়ে দেয় তা এই রকম- আজকালকার ছেলেমেয়েরা বড্ড বেয়ারা। তারা বড়োদের কথা শোনে না, বড়োদের মানে না। তারা সব সময় মত্ত। যেন সাপের পাঁচ-পা দেখেছে। এক কথায় তারা সব উচ্ছন্নে গেছে। গোল্লায় গেছে।
আর সব চেয়ে মজার কথা এই যে, আজ যাঁরা তরুণ-তুর্কিদের সম্পর্কে এই মতামত ব্যক্ত করছেন, একদিন তাঁদের বয়স যখন কম ছিল, সেদিন তাঁদের অগ্রজ বা অভিভাবকরাও কিন্তু নবীনদের অর্থাৎ আজকের মন্তব্যকারীদের সম্পর্কে এই রকম মনোভাবই দেখিয়েছিলেন।
তার মানে সময় বদল হলেও ধারা বদলায়নি। প্রথা বদলায় না। চিন্তা-ভাবনা বদলায় না। শুধু মুখগুলো বদলে যায়। সেই আদিকাল থেকেই আমদের সমাজ এই রীতিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এই যে গোল্লায় যাওয়া, অধঃপাতে যাওয়া, বারোটা বেজে যাওয়া, এঁচোড়ে পাকা, রেঙাটে, বখাটে, ফোর-টোয়েন্টি, চার-শো বিশ, ফক্কড়, ডেঁপো, ফচকে, ত্যাঁদোড়, অকাল-কুষ্মাণ্ড ইত্যাদি-প্রভৃতি বিশেষণের প্রয়োগ, তারা চিরকালই একই রকম রয়ে গেছে।

যখন প্রথম ফুটেছে কলি 0 মুরারি সিংহ  (২)

এইভাবে বৃহত্তর সমাজের কাছে নতুন প্রজন্ম বরাবর কিছুটা উপেক্ষিত ও অবহেলিতই থেকে যায়। সভ্যতার আদিকাল থেকেই সমাজ কমবয়সীদের সম্পর্কে চরম নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে আসছে।     
কেমন ছিল সেই সব উপলব্ধি, তার কিছু নমুনা দেখুন। -
আজ থেকে ৫০০০ বছর আগে এক ব্যাবিলনবাসী বলেছিলেন – ‘যুবারা তাদের হৃদয়ের দিক দিয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ। যুব-সম্প্রদায় কুকর্ম ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য-পরায়ণ। তারা কখনোই প্রাচীনকালের যুবকদের মতো হতে পারবে না। আজকের নতুন প্রজন্ম আমাদের সভ্যতাকে রক্ষা করতে পারবে না’। এই উক্তির প্রায় আর এক হাজার বছর পরে একজন মিশরদেশীয় পুরোহিত মন্তব্য করেছিলেন – ‘এই পৃথিবী এক সংকটের মধ্যে হাজির হয়েছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা-মায়েদের আর শ্রদ্ধা-ভক্তি করে না। মনে হচ্ছে পৃথিবীর শেষদিন আর বেশি দূরে নয়’। এই প্রসঙ্গে মিশরীয় পুরুত-ঠাকুরের এই সু-ভাষণের বারো-শো বছর পরে অর্থাৎ ৭২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হোমারের সমসাময়িক গ্রিক কবি হেসিয়োডের অনুভূতিটিও উল্লেখযোগ্য। সেটি ছিল এই রকম – ‘আমি আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সব আশা হারিয়ে ফেলেছি কারণ আজকের যুবসম্প্রদায় যারা অসহিষ্ণু, যাদের নিজেদের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই, সোজা কথায় যারা ভয়ংকর, তারাই আগামীকাল দেশের শাসনভার গ্রহণ করবে’।(যদিও অনেকেই মনে করেন এটি হেসিয়োডের কথা নয়, পরে তার উপর আরোপিত হয়েছে)। এমনকি প্রথাভাঙার কাণ্ডারী বলে বিখ্যাত হলেও সক্রেটিস(খ্রিপূ ৪৭০-৩৯৯)-এর মতো মহান দার্শনিক, শোনা যায় যিনি কম-বয়সীদের সঙ্গে মিশতে বেশি ভালোবাসতেন, তিনি পর্যন্ত একদা মন্তব্য করেছিলেন – ‘‘আমাদের যুব-সম্প্রদায় চায় বিলাসি জীবনযাপন করতে, তারা সব কুসন্তান, তারা কত্তৃত্বকে উপহাস করে এবং বয়স্কদের সম্বন্ধে কোনো শ্রদ্ধা নেই। আজকের ছেলেমেয়েরা অত্যাচারী হয়ে উঠেছে, বয়স্করা যখন ঘরে ঢোকে তারা উঠে দাঁড়ায় না, বাবা-মায়ের বিরুদ্ধাচারণ করে। সোজা কথায় বললে তার অত্যন্ত বাজে।’’
এ তো গেল বিদেশি জ্ঞানী ও পণ্ডিতদের কথা। এবার এ দেশের দিকে একবার তাকানো যাক।  
আমরা জানি, ভারতবর্ষের সমাজ বরাবরই একটু বেশি সাবধানী। প্রাচীনকাল থেকেই সমাজের মুরুব্বিরা উপযাচক হয়ে সমাজরক্ষীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তাদের কাছে যৌবন মানে ছিল এক অতি বিষম কাল। এক ভয়ংকর সময়। তাদের মতে সদ্য-যুবকেরা যা করে তা কেবল বিশৃঙ্খলা, বিপৎপাত, অশান্তি। সুতরাং এই বয়স সবসময়ে সন্দেহজনক।
বৈদিক-ব্রাহ্মণ্য সমাজেও কম বয়সীদের নিয়ে বড়োদের মধ্যে সবসময় একটা আতঙ্ক্‌, একটা উৎকণ্ঠা, একটা গেল গেল রব কাজ করে গেছে। সেই সঙ্গে বড়োদের মধ্যে নিজেদের সম্পর্কে কাজ করেছে একটা সুপিওরিটি কমপ্লেক্স। তাই বয়স্করা চেয়েছিল ছোটোদের উপর নানান নিষেধাজ্ঞা ও সংস্কার চাপিয়ে দিতে। তরতাজা মনগুলোতে একটা দাসসুলভ মানসিকতা ঢুকিয়ে দিতে। তারা চেয়েছিল তাদের মতো কচিকাঁচারাও জ্যাঠামশাইয়ের চশমা দিয়েই জগতটাকে দেখুক।    
সব বাবা-মা-ই সন্তানকে নিজেদের মনোমতো মানুষ করতে চায়। সাদা চোখে তাতে দোষের কিছু নেই। আপত্তিও কিছু নেই। কিন্তু যে রীতিতে আমরা আজো অভ্যস্ত তা হল নিজেদের মুদ্রাদোষ আগলে আমরা বড়োরা, ছোটোদের স্বাভাবিক বিকাশে পদে পদে বাধা সৃষ্টি করি। আপত্তিটা সেইখানেই।  
এই প্রথার সূত্রপাত অবশ্য সেই প্রাচীন ভারতেই।
প্রথমে যদি মেয়েদের কথা ধরি, তাহলে বলতে হয় প্রাচীন ভারতের তথাকথিত মুনি-ঋষিরা তাঁদের তৈরি করা সামাজিক নিয়ম-বিধিতে মেয়েদের বিশেষ পাত্তাই দিতে চাননি। মহিলাদের জন্যে তারা বাড়ির অন্দরমহলকেই একমাত্র জায়গা হিসেবে বরাদ্দ করে নিদান দিয়েছিলেন যে মেয়েরা বিয়ের আগে পিতার অধীনে এবং বিয়ের পরে স্বামীর অধীনে থাকবে। স্মরণ করুন কী ভয়ংকর ছিল সেই দিন, যখন সমাজে বাল্যবিবাহের প্রথা চালু করে বালিকাদের স্বাভাবিক বিকাশকে শায়েস্তা করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মেয়েদের বলা হত সুপত্নী হতে। বলা হত সীতা-সাবিত্রীর মতো হতে। তা এখনো বলা হয়। মানুষের মতো মানুষ হবার শিক্ষা তাদের কখনোই দেওয়া হয়নি। আসলে আদিকালে শিক্ষার ব্যাপারটাই মোটেই মেয়েদের জন্য উন্মুক্ত ছিল না।
এবার ছেলেদের দিকে তাকালে দেখা যাবে তাদের অবস্থাও অথৈবচ। মানুষের মতো মানুষ হবার শিক্ষা তাদেরও দেওয়া হত না। অথাকথিত ধ্যানী-জ্ঞানী বৈদিক-সমাজে জাতিভেদ প্রথা জারি করে প্রথমেই সমবয়সী অন্যান্যদের সঙ্গে মেলামেশা রদ করা হয়েছে, শিক্ষার অধিকারকেও করা হয়েছে খর্ব। তার উপর প্রাচীন শাস্ত্রে উচ্চবর্ণের ছেলেদের জন্যে সমাজকর্তাদের নির্দেশ হল কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন এবং গুরুগৃহ বাস। যেখানে তাদের একমাত্র কর্মটি হল পড়াশোনা - ছাত্রনাং অধ্যয়নম তপঃ।  
তখনকার সংসারে ছেলেদেরও বলা হত সুপুত্র হতে। বোঝানো হত পুত্রদের কাছে শুধু পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম, আর জননী স্বর্গাদপি। তাদের মনে গেঁথে দেওয়া হত জন্মসূত্রে ছেলেদের অনেক ঋণ আছে। যেমন - পিতৃঋণ ঋষিঋণ, দেবঋণ। বোঝানো হত ছেলেদের কাজ পরিবারের জাতি-কুল-বিত্ত-প্রতিপত্তি রক্ষা করা। তাদের দায়িত্ব পরিবারের বড়ো তথা অভিভাবকদের সুখ-সম্মান সুবিধার দিকে নজর দেওয়া।  
এইভাবে প্রাচীন সমাজে যে প্রথা লাগু ছিল স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে সেখানে ব্রহ্মচর্য শেষ হবার আগেই বালক-বালিকার উপর গার্হস্থ্যকে চাপিয়ে দেওয়ার কী প্রবল প্রচেষ্টা। তার উপর ছিল ওই যে এক নির্মম ও নৃশংস প্রথা। জাতিভেদ ও ছোঁয়াছুয়ির বাধ্যবাধকতা। জন্মের দোহাই পেড়ে মানুষের মধ্যে ছোটো-বড়ো ভেদাভেদ তৈরি করা।
সুতরাং আদিকাল থেকেই সমাজ ও সংসারকে নিরাপদ ও নিশ্চিত রাখতে তার চারপাশে একটা সুরক্ষা বলয় তৈরি করা হয়েছে। নতুন কিছু করার উদ্যোগ ও প্রতিভাকে কার্যত সেখানে অবদমিত করে রাখা হয়েছে।
আপত্তিটা সেইখানেই।
আসলে খোলা চোখে দেখলে সমাজ নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের মতো সেও তার সদস্যদের উপর আধিপত্য জাহির করতে চায় এবং নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চায়। তাদের কাছ থেকে পেতে চায় চরম আনুগত্য ও দাসত্ব। আর যেহেতু সমাজের মাথায় থাকে বড়োরা, সুতরাং তারাই কর্তা সেজে বসে। অন্যদিকে অস্তিত্ব, নিরাপত্তা ও স্বনির্ভরতার দিক দিয়ে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা সেখানে একেবারেই দুর্বল। তাই রক্ষণশীল সমাজ ও সংসারের খবরদারির প্রকোপটা তাদের উপরেই বেশি এসে পড়ে। ফলে অন্যদের তুলনায় তাদের সংকটও বেড়ে যায়।    
ছোটোদের প্রতি বিরূপ মনোভাবের জন্য অবশ্য বড়োদের তেমন কোনো দোষ নেই। তবে বড়োদের কিছু সমস্যা আছে। বড়োরা ছোটোদের সংকট বুঝতে চায় না। তারা অল্পবয়সীদের মেরুদণ্ডটাকে তৈরি হতে দেয় না। তারা চায় ছোটোদের থাক একটা ‘গোপাল অতি সুবোধ বালক’ টাইপ-এর চরিত্র। তারা চায় ছোটোরা যেন কখনোই রাখাল হয়ে না যায়। তাই বালকদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় যাবতীয় নীতিকথা, তত্ত্ব, উপদেশ। তাদের চারপাশে তৈরি করা হয় বিধি-নিষেধের ভয়ংকর বেড়াজাল।




যখন প্রথম ফুটেছে কলি 0 মুরারি সিংহ  (৩)

কিন্তু যৌবনের বৈশিষ্ট্যই হল বাড়াবাড়ি। সেটা নিয়েই বড়োদের মাথাব্যথা। চিরকেলে প্রথা মেনে বয়স্করা সমাজে স্থবিরতন্ত্র কায়েম করতে চায়। অতঃপর প্রবীণ বনাম নবীনের এই  লড়াই চলতেই থাকে। ছোটদের সমস্যা নিয়ে বড়োদের মাথা ঘামানোর সময় হ্য় না।      
এসবের কারণে নিন্দা-মন্দ করার জন্য আসামি সাজিয়ে শুধুমাত্র বিশেষ কিছু মানুষের দিকে আঙুল তুলে লাভ নেই। কাঠগড়ায় যদি কাউকে দাঁড় করাতেই হয় তাহলে তা হল মান্ধাতা-গন্ধী সমাজের প্রচলিত রীতি-নীতি। সামজিক হতে চাওয়া মানুষ-জনের চিরকেলে বদভ্যাসগুলি।
আবার বলছি, এখানেই আবার যত মজা তত রহস্য। মানুষের মনের গতি এমনি সেই প্রাচীন প্রবাদটাই সত্য হয়ে ওঠে। যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। আজ যে ছোটোরা তাদের অগ্রজদের বাঁকা চোখে দেখছে, তারা যখন বড়ো হবে তখন তারাও ভুল মেরে বসবে যে তারা একদিন ছোটো ছিল। নিজেদের পরবর্তী প্রজন্ম সম্পর্কে তখন তাদের মনোভাবও হয়ে যাবে আজকের বড়োদের মতো একই রকম উন্নাসিক।      
ছোটোদের পক্ষ নিয়ে দেখলে, এমনিতেই খুব অল্পসময়ের মধ্যে দু-দুটো বয়ঃসন্ধির কারণে নব্য যুবক-যুবতিদের শরীরে ও মনে যেসব প্রাকৃতিক পরিবর্তনের উথাল-পাতাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে, তার ধাক্কায় এই বয়সের ছেলেমেয়েদের অবস্থাটা বেশ বেসামাল হয়ে থাকে। তার উপর পড়াশোনার প্রবল চাপ এবং সমাজ ও পরিবারের নানা রকম অনুশাসন। ফলে বেশির ভাগ সময়ে স্বাভাবিক ভাবে এদের মন হয়ে ওঠে বেপরোয়া ও বিদ্রোহী। তারা হতে চায় ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম ও ঝর্নার মতো চঞ্চল। তারা আদতে বনের পাখি। বাধাহীন আকাশে মনের আনন্দে ডানা মিলে দিতেই তাদের আগ্রহ বেশি। কিন্তু প্রতিষ্ঠান তাদের বশ মানিয়ে খাঁচার পাখি বানাতে চায়।
ছোটোদের অভিজ্ঞতা কম। কাজ করতে গিয়ে তারা ভুল করতেই পারে। মাঝে মাঝে পদঃস্খলন হতে পারে। অবশ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় নিজেরাই সেই ভুল সংশোধন করে মাথা উঁচু করে ফিরে এসেছে লড়াইয়ের ময়দানে। নিজেদের এই সংগ্রামে তারা বড়োদের পাশে পেতে চায়। তাদের কাছ থেকে আশা করে সহানুভূতি। কখনোই নিন্দা-মন্দ বা সমালোচনা নয়।   
প্রসঙ্গত স্মরণ করুন নেতাজি সুভাষচন্দ্র তাঁর ‘তরুণের স্বপ্ন’-তে যুবসমাজের এই তোলপাড় ও ওঠাপড়াকে কী সুন্দর করে বর্ণনা করে লিখেছিলেন-
‘‘অনন্ত আশা, অসীম উৎসাহ, অপরিমেয় তেজ ও অদম্য সাহস লইয়া আমরা আসিয়াছি – তাই আমাদের জীবনের স্রোত কেহ রোধ করিতে পারিবে না। অবিশ্বাস ও নৈরাশ্যের পর্বতরাজি সম্মগখে আসিয়া দাঁড়াক অথবা সমবেত মনুষ্য-জাতির প্রতিকূল শক্তি আমাদের আক্রমণ করুক, - আমাদের আনন্দময়ী গতি চিরকাল অক্ষুণ্ণই থাকিবে।
আমাদের একটা ধর্ম আছে- সেই ধর্মই আমরা অনুসরণ করি। যাহা নূতন, যাহা সরস, যাহা অনাস্বাদিত – তাহারই উপাসক আমরা। আমরা আনিয়া দিই পুরাতনের মধ্যে নূতনকে, জড়ের মধ্যে চঞ্চলকে, প্রবীণের মধ্যে নবীনকে এবং বন্ধনের মধ্যা অসীমকে। আমরা অতীত ইতিহাসলব্ধ অভিজ্ঞতা সব সমত মানিতে প্রস্তুত নই। আমরা অনন্ত পথের যাত্রী বটে কিন্তু আমরা অচেনা পথই ভালোবাসি – অজানা ভবিশ্যৎই আমাদের নিকট অত্যন্ত প্রিয়। আমরা চাই “the right to make blunders” অর্থাৎ ‘ভুল করিবার অধিকার’। তাই আমাদের স্বভাবের প্রতি সকলের সহানুভূতি নাই, আমরা অনেকের নকট সৃষ্টিছাড়া ও লক্ষ্মীছাড়া।
ইহাতেই আমাদের আনন্দ; এখানেই আমাদের গর্ব। যৌবন বর্ষাকালে সর্বদেশে সৃষ্টিছাড়া ও লক্ষ্মীছাড়া।  অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার উন্মাদনায় আমরা ছুটিয়া চলি – বিজ্ঞের উপদেশ শুনিবার পর্যন্ত অবসর আমাদের নাই। ভুল করি, ভ্রমে পড়ি, আছাড় খাই, কিন্তু কিছিতেই আমরা উৎসাহ হারাই না বা পশ্চাদপদ হই না। আমাদের তাণ্ডবলীলার অন্ত নাই, কারণ – আমরা অবিরাম গতি।
আমরাই দেশে দেশে মুক্তির ইতিহাস রচনা করিয়া থাকি। আমরা শান্তির জল ছিটাইতে আসি নাই। বিবাদ সৃষ্টি করিতে, সংগ্রামের সংবাদ দিতে, প্রলয়ের সূচনা করিতে আমরা আসিয়া থাকি। যেখানে বন্ধন, যেখানে গোঁড়ামি, যেখানে কুসংস্কার, যেখানে সংকীর্ণতা – সেখানেই আমরা কুঠার হস্তে উপস্থিত হই। আমাদের একমাত্র ব্যবসায় মুক্তির পথ চিরকাল কণ্টকশূনা রাখা, যেন সেপথ দিয়া মুক্তির সেনা অবলীলায় গমনাগমন করিতে পারে।’’   
এতক্ষণ ছোটোদের পক্ষ নিয়ে এত কথা বললাম বলে কেউ যেন ভেবে না বসেন ছোটোদের বড়ো করার সব দায়িত্ব একা বড়োদের। বড়োদের প্রতি ব্যবহারের বিষয়ে ছোটোদের মধ্যেও আরো সচেতনতা গড়ে তোলা দরকার । কারণ আলোচনার শুরুর দিকে উদ্ধৃত ছোটোদের সম্পর্কে করা বড়োদের মন্তব্যগুলোরো কিছু বাস্তবতা থেকে যায়। বয়স্কদের সম্পর্কে ছেলেছোকরাদের টীকা-টিপ্পনিগুলিও সবসময় শ্রুতি-সুখকর হয় না। আড়ালে-আবডালে বড়োদের সম্পর্কে ছোটোদের মধ্যেও বুড়ো-হাবড়া, সেকেলে-অচল, বাতিল, old fools, ঘাটের মড়া এইসব বিশেষণও খুব চলে। নিয়ম-ভাঙার প্রতিযোগিতায় সময়ে সময়ে ছোটোদের মধ্যে একটা কালাপাহাড়ি মনোভাব কাজ করে। এখানেও ছোটোদের খুব একটা দোষ নেই। কারণ তাদের বয়স অল্প। সমালোচনার মুখে মাথা গরম হতেই পারে।
তবে ছানাপোনাদেরও বুঝতে হবে যতই সমালোচনা করুক, বা যতই কুকথা বলুক, বড়োরা কিন্তু তাদের শত্রু নয়। নেহাৎ কিছু প্রাচীন প্রথা ও সংস্কারের ঝোঁকেই তাদের মুখ থেকে মন্দ কথা বেরিয়ে আসে। বড়োরা আদতে তাদের ভালোই চায়। সুতরাং মাথা গরম করলে চলবে না। বড়োরা জ্ঞান দিতে বা উপদেশ দিতে ভালোবাসে। তাতে অনেক সুপরামর্শও থাকে। সুতরাং অধৈর্য হলে চলবে না, যারা বলতে চাইছে তাদের বলতে দিতে হবে। মন দিয়ে তাদের কথা শুনতে হবে। তবে শোনা মানেই মেনে চলা নয়। তাই কোনো ব্যাপারে যে যা বলবে তা শুনে নিয়ে যখন কাজ করতে যাবে তখন নিজের বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ করে যেটা ভালো মনে হবে সেটাই করবে। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেকেই নিতে হবে। সিদ্ধান্ত নিতে পারার মতো করে নিজের ব্যক্তিত্বকে বিকশিত করতে হবে। তা করতে গিয়ে যদি বড়োদের সঙ্গে কোনো মতপার্থক্য হয়, তাহলে নিজের সিদ্ধান্তর পক্ষের যুক্তিগুলিকে সুষ্ঠভাবে তাদের সামনে পেশ করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে। নিজের সপক্ষে আনার চেষ্টা করতে হবে। দরকার হলে তাদের যুক্তিগুলিকেও গুরুত্ব দিতে হবে এবং সময়ে সময়ে মনমতো না হলেও বড়োদের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। মতান্তর কখনো যেন মনান্তরের পর্যায়ে না চলে যায়।
এই সমাজ ও সংসারে যখন আমাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এবং সেখানেই যখন আমাদের বসবাস করতে হবে, তখন পছন্দ হোক বা না হোক তার কিছু নিয়ম-কানুন আমাদের মেনে নিতেই হয়। পাঁচজনকে নিয়ে মিলেমিশে পথ চলার নামই সংসার। সংসারে প্রত্যেকটা মানুষই আলাদা। স্বতন্ত্র। সেখানে প্রত্যেকের নিজস্ব মতামত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। থাকবে আলাদা আলাদা মেজাজ, স্ফূর্তি ও মুদ্রাদোষ। আর যেটা বিশেষ করে বলার তা হল সব মানুষেরই থাকে নিজস্ব অহং ও তাকে তৃপ্ত করার বাসনা। সুতরাং একই সঙ্গে থাকবে সংঘাত। কিন্তু কলহ দিয়ে তো সমাজ-সংসারে শান্তি বজায় থাকে সুতরাং বিবির্তনের স্বাভাবিক নিয়মেই থাকবে আড়ির সঙ্গে ভাব। ভাব মানে সমন্বয়, ভাব মানে সমঝোতা। ভাব মানে মানিয়ে নেওয়া।
অন্যদের সঙ্গে এই মানিয়ে নিতে পারাটা একটা আর্ট। কারণ যে মানিয়ে নিবে তারও আছে আলাদা ইগো। সেও চাইবে নিজের অহংকে তৃপ্ত করবে। কিন্তু তাতে তো সংঘাত চলতেই থাকবে, কোনোদিনই শান্তি আসবে না। অতএব, মানিয়ে নেবার অন্যতম কৌশল হল ্তার জন্য নিজের অহংকে গোপন করতেও জানতে হবে ও শিখতে হবে। এই অহংকে গোপন করতে জানার মধ্যেও কিন্ত আলাদা সুখ ও আনন্দ আছে। কারণ তাতে নিজের কার্যসিদ্ধি হয়। এই জন্যেই ওই যে আগে বললাম না, অন্যদের সঙ্গে এই মানিয়ে নিতে পারাটাও একটা আর্ট।
মনে রাখবে, ভিড়ের মধ্যে থাকবে ঠিকই তবে ভিড়ের মানুষ হিসেবে নয়। ভিড়ের মধ্যে মিশে থেকেও, জীবন সম্পর্কে নিজস্ব দৃষ্টিভিঙ্গি তৈরি করে, সবার কাছে আপন মতামত পেশ করে, শ্বাস-প্রশ্বাস নেবার নিজস্ব পরিসর তৈরি করেই, বেঁচে থাকার জন্য নিজস্ব পৃথিবী বানিয়ে নেওয়া যায়। নিজের ভিতরের মানুষটিকে সর্বাঙ্গীনভাবে বিকশিত করা যায়।  
এবার নিশ্চয় পরিষ্কার হল যে এই লেখার মূল উদ্দেশ্য নবীন বনাম প্রবীণ বলে তাদের মধ্যে ঝগড়া লাগানো বা কলহের আবহ তৈরি করা নয়। আলোচনার আসল কথাটা সমালোচনা বা সংঘাত নয়। বরং এক্ষেত্রে যেটা দরকার সেটাই বোঝানো, তা হল দুই প্রজন্মের মধ্যে সমন্বয়, সহযোগিতা ও উপযুক্ত বোঝাপড়া।
সেই সঙ্গে এটাও বলা যে, এ ব্যাপারে বড়োদেরই এগিয়ে এসে বেশি দায়িত্ব নিতে হবে। ঐতিহ্যের ব্যাপারেই যদি জোর দেওয়া হয় তাহলে বড়োদের মনে রাখতে হবে যে, যে সমুদ্র মন্থন করে গরল উঠেছিল, সেই মন্থনের শেষেই পাওয়া গিয়েছিল অমৃত। সুতরাং মতের যতই গরমিল হোক, ছোটোদের নিয়ম মানতে না-চাওয়া নিয়ে অযথা ভয় বা হতাশার কিছু নেই। ছোটোদের ব্যাপারে বড়োদের ইতিবাচক মানসিকতা রাখা চাই।
বড়োদের বুঝতে হবে পুরোন প্রজন্মের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের ফারাক কখনোই ঘুচবে না। কারণ সময় কখনোই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। আর সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চারপাশে সব কিছুই বদলাতে থাকে। সাম্প্রতিক কালে উচ্চ-প্রযুক্তির মহাবিপ্লবের ফলে এই পরিবর্তনের গতি যেমন অসম্ভব রকমে বেড়ে গেছে পরিবর্তনের মাত্রাও তেমনি ছড়িয়ে গেছে নানান অভিমুখে। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে যারা কিশোর ছিলেন তাদের চেয়ে আজকের কিশোর-কিশোরীদের এই বিশ্বায়নের পৃথিবীতে অনেক বেশি তথ্য ও জ্ঞানের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, নিজেদের মতো করে তার মোকাবিলাও করতে হচ্ছে। তার জন্য আজকের ছানাপোনাদের দ্রুত আয়ত্ব করতে হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার।

যখন প্রথম ফুটেছে কলি 0 মুরারি সিংহ  (৪)
আজকের কিশোর-কিশোরীদের একদিকে ঘর অন্যদিকে বিশ্ব। এই দুইয়ের টানাপোড়েনে তাদের সংকটও যথেষ্ট বেড়ে গেছে। সেই সব অতিক্রম করেই তাদের তৈরি করতে হচ্ছে জীবনের চলার পথ। সুতরাং আমাদের বোঝা দরকার, আমরা সন্তানদের জন্ম দিয়েছি ঠিকই, কিন্তু তাই বলে আমাদের সন্তানেরা কখনোই তাদের বাবমায়ের পুনর্মুদ্রণ নয়। তারা অবিকল তাদের মতো। তারা নতুন সময়ের নতুন ফসল। তাদের বাঁচা মানে struggle for existence বা কোনো রকমে কায়ক্লেশে বেঁচে থাকা আর বাপ-ঠাকুর্দার বংশ-রক্ষা করা নয়। তাদের গন্তব্য তার চেয়ে অনেক বেশি। তাদের বাঁচা মানে মনুষ্যত্বের আরো বেশি উন্মেষ। আরো বাঁচার বেশি পরিসর নির্মাণ। জীবনের আরো অনেক দেশ-মহাদেশের আবিষ্কার।          
নানান ভাষণে বা রচনায় যে আপ্তবাক্যটি প্রায়ই ব্যবহার করা হয় থাকে যে আজকে যাদের বয়স অল্প তারাই দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক। আজকের শিশুরাই আগামী দিনের পিতা। একটি শিশুর মধ্যে থাকে বিকাশের অনন্ত সম্ভাবনা। সুতরাং যথাযথ বেড়ে ওঠার জন্য, নিজেদের ঠিকঠাক গড়ে তোলার জন্য সেই শিশুকিশোরদের যথেষ্ট পরিসরের ব্যবস্থা করতে হবে। অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় ও সামজিক অনুশাসনে ছোটোদের যে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তা তাদের নিজেদের ভাবতে দেওয়া নয় বরং একটা নিদির্ষ্ট ফরম্যাটে তাদের জন্য আগে থেকেই ভেবে রাখা বা প্রোগ্রামিং করা বড়োদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা। বড়োদের সামগ্রিক প্রচেষ্টার অভিমুখ ছোটোদের নিজের পথে চলতে দেওয়া নয়, বরং বড়োদের পথে তাদের চালানো। এতে করে কচিকাঁচাদের না হচ্ছে উপকার, না হচ্ছে স্বপ্রকাশ। তাদের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে কর্তাভজা মানসিকতা।   
আশার কথা গত কয়েক দশকে এই মান্ধাতা-আমলের মানসিকতাতেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। কারণ এই উত্তর-ঔপনিবেশিক সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক ধ্যান-ধারনার মূলেও ব্যাপক নাড়া পড়েছে। সুদূর অতীত থেকে ঔপনিবেশিক সময় পর্যন্ত চলে আসা কেন্দ্রীয় আধিপত্যবাদের কুফলটা মানুষ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে। ফলে সংসার নামের প্রতিষ্ঠানটিও আর আগের মতো নেই। কারণ বিগত দিনগুলিতে সংসার ছিল একান্নবর্তী এবং পুরো-দস্তুর অভিভাবক-কেন্দ্রিক। সেখানে বাড়ির ছোটদের অধিকার ছিল একেবারেই সংকুচিত। বড়োদের কাছে তাদের মতামত বা দাবি-দাওয়ার কোনো মূল্যই ছিল না। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর দেশে এই ছবিটাই এখন অন্য রকমের। এখন যেমন সংসারের বহর কমেছে, সংসারের সদস্য বলতে মা-বাবা ও তাদের একটি-দুটি সন্তান, তেমনি সেখানে মনোযোগের কেন্দ্রটিও চলে গেছে ছোটোদের দখলে। সঙ্গে সঙ্গে কচি-কাঁচাদের পছন্দ ও মতামতের গুরুত্বও অনেক গুণে বেড়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী যোগাযোগের ব্যবস্থাগুলি যত উন্নত হচ্ছে, বাবা-মায়েরা অনেকেই চাইছেন সন্তানদের সঙ্গে নিজেদের communication gap কমাতে। আবার নিজেদের বাব-মা বা সংসারের বয়স্কদের প্রতি তাদের উপেক্ষা ও অবহেলা বাড়ছে। তার থেকেও কচিকাঁচাদের কাছে একটা ভুল বার্তা যাচ্ছে। ফলে সংসারে ভারসাম্যের একটা অভাব থেকেই যাচ্ছে।  
আমরা যত তাড়াতাড়ি নিজেদের এই সংকটগুলি বুঝতে পারব, তাদের সমাধান করতে সচেষ্ট হব, সমাজ ও সংসারের পক্ষে ততই মঙ্গল।  
তবে আমার কথাতেও এই যে এত উপদেশ বা পরামর্শ এসে যাচ্ছে তা কিন্তু এই আলোচনার একটা দিশা নির্দেশ করার লক্ষ্যে। তা কোনো আপ্তবাক্য নয়। কারো উপর চাপিয়ে দেবের জন্যও নয়। প্রয়োজনীয় মনে হলে তাকে ভেবে দেখবেন, নাহলে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করবেন।     
শেষের কথা বলার আগে, অন্নদাশংকর রায় এই বয়স নিয়ে তাঁর ‘সৃষ্টির দিশা’ নামের এক লেখায় যে মূলাবান মতামতটি পেশ করেছেন প্রাসঙ্গিক মনে করে সেটি এখানে তুলে দিলাম -
‘‘যে মানুষ হয়, সে নিজেই নিজেকে গড়ে, সে সব প্রভাব অতিক্রম করে। যাকে মানুষ করা হয়, গড়ে তোলা হয়, স্পষ্ট প্রভাবিত করা হয় সে একটি পোষা বাঘের মতো স্বভাবভ্রষ্ট, সে একটা breeding farm-এর ফসল, তাকে দিয়ে সমাজে শান্তিরক্ষা হয়, কিন্তু সৃষ্টিরক্ষা হয় না, সৃষ্টি যে কেবলি আঘাত খেয়ে কেবলি চেতনালাভ, কেবলি অপ্রত্যাশিতের সাক্ষাত, কেবলি প্রত্যাশিতের গাফিলি। যারা বলে ভাবী বংশধরদের আমরা উন্নত করবো তাদের শুভাকাঙ্ক্ষার তারিফ করতে হয়, কিন্তু তাদের সত্যিকারের কর্তব্য নিজেদেরি উন্নত হয়। ভাবী বংশধরেরা নিজেদের ভার নিজেরা নিতে পারবে এটুকু শ্রদ্ধা তাদের পরে থাক। সত্যকে পথের শেষে পাবার নয় যে বয়সের যারা শেষ অবধি গেছে তারাই পেয়েছে। পথের শেষ নেই, বয়সের শেষ নেই, সত্যকে পদে পদে পাবার, দিনে দিনে পাবার। শিশুর কাছে শিশুর অভিজ্ঞতাই সত্য, যতদিন না সে বৃদ্ধ হয়েছে ততদিন তার পক্ষে বৃদ্ধের অভিজ্ঞতা হচ্ছে অকালবৃদ্ধতা।’’    
উপসংহার পর্বে এসে বলি, শৈশব বলি, কৈশোর বলি, অথবা যৌবন বা বার্ধক্য, সবই আসলে প্রকৃতিকে মেনে, প্রাকৃতিক নিয়মেই আসে যায়। কিন্তু মুশকিল হল বিঞ্জান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রকৃতির থেকেই আমরা দূরে চলে যাচ্ছি এবং প্রকৃতিকে অস্বীকার করে নাগরিক কৃত্রিমতার স্রোতে গা ভাসাতে চাইছি। ফলে সমাজ ও সংসার ক্রমবর্ধমান জটিলতার শিকার হচ্ছে। আজকের কম-বয়সীদের এসব নিয়ে আরো বেশি করে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। ভেবে দেখতে হবে বিঞ্জান, প্রযুক্তি, শিক্ষা ও সভ্যতার চোখ-ধাঁধানো উন্নতির কথা এত ঢাক-ঢোল বাজিয়ে প্রচার করা সত্ত্বেও কেন আজো এত দারিদ্র্য, এত গরিবি। কিছু মানুষের মধ্যে কেন আজো এত দখলদারির মানসিকতা। কেন এত মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, যুদ্ধ ও অশান্তি।
মনে রাখতে হবে, নয়া-উপনিবেশবাদীদের দ্বারা পোষিত বাজার-সংস্কৃতি কিন্তু নানা অছিলা তথা ভোগবিলাসের অজস্র প্রলোভন দেখিয়ে এসবই ভুলিয়ে ও গুলিয়ে দিতে চাইছে। নতুন নতুন কায়দা-কানুন প্রয়োগ করে এই অদৃশ্য শক্তি চাইছে নতুন প্রজন্মকে বিপথে চালিত করতে, বিভ্রান্ত করতে। নিজেদের ভবিষ্যৎ কিছু চিন্তা বা কেরিয়ার গঠনের চেষ্টাকে কোনো রকম অবহেলা না করেও, আজকের ছেলেমেয়েদের এই সমস্ত ব্যাপার ভেবে দেখতে হবে। তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পৃথিবীকে গড়ে তুলতে হবে আরো সুন্দর করে।  
তাই নতুন যৌবনের উন্মাদনায় জীবনকে যতই গোলাপি ও ফুরফুরে মনে হোক, সদ্য যুবক-যুবতিদের সামনে চ্যালেঞ্জ কিন্তু বিস্তর। ‘শাহবাগ স্কোয়ার’-এর আন্দোলন বা ‘হোক কলরব’-এর মিছিল আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে তারা সে চ্যালেঞ্জ নিতে পিছ-পা নয়।  

ঋণ-স্বীকার –
১। রবীন্দ্রগান- কবিতাপাক্ষিক। ২০০২।
২। তরুণের স্বপ্ন ০ তরুণের স্বপ্ন – সুভাষচন্দ্র বসু । নবম সংস্করণ, ১৩৬২। শ্রীগুরু লাইব্রেরি।
৩। সৃষ্টির দিশা ০ তারুণ্য – অন্নদাশংকর রায়। দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৩৫৫। ডি এম লাইব্রেরি।   
৪। Child Psychiatry & You – Michail Buyanov (Eng. Trans. – Michail Burav), 1989, Mir Publishers, Moscow

মুরারি সিংহ
কবি ও গদ‍্যকার

No comments:

Post a Comment