এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

পবিত্র চক্রবর্তী


প্রবন্ধ


পূজিতা ও লাঞ্ছিতা এক মেয়ে নদী এবং দেবী সরস্বতী –

[ চিত্র ১ ]
হিন্দুদের বারোমাসের তেরো পার্বণের মত প্রায় তেত্রিশ কোটি দেব-দেবীকে নিয়মিত নানা আকারে তথা নানা ভাবে পুজো করে থাকি । তা যে যাই করুক তা নিয়ে বর্তমানের আলোচ্য প্রবন্ধটি নয় । এখানে উঠে এসেছে এক মেয়ের জীবন গাঁথা । সময়ান্তরে সে কখনো লাস্যময়ী আবার কোন না কোন ভাবে হয়েছেন দেবতার দ্বারা লালসার শীকার । বর্তমানে , আমরা নানা ভাবে দেখি নারী নির্যাতন , প্রতিবাদ করি । কিন্তু ভাবলে অবাক হই , হিন্দু শাস্ত্রেও নারী যত  না পূজিতা হয়েছেন , তার থেকেও বেশী দগ্ধ হয়েছেন আদিম রিপু কামনার বহ্নিশিখায় ।
নানা পুরাণ , উপপুরাণ , লোক মান্যতা ঘেঁটে এমন এক দেবীর জীবন কথাকে লিপিবদ্ধ করা হল । যে নারী তথা দেবী আমাদের প্রায় সকলেরই পরিচিত - শ্বেত শুভ্রা বীণাপাণির আলেখ্য । বহমানতা থেকে পূজিতা । বহমানতা শব্দটিকে কেন ব্যবহৃত করা হল তা ক্রমে বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারব । এর জন্য যেটি প্রয়োজন সেটি হল , গোঁড়া ধর্মান্ধতা ভুলে যুক্তির নিরিখে আত্মস্থ করা ।

একথা স্বীকার্য যে পুরাণ বা উপ-পুরাণ কেবলমাত্রই গল্পমালা ; তাই সময় ও পুরাণ ভেদে একই বা একাধিক ব্যক্তি-দেব-দেবী-অসুর ইত্যাদির বর্ননা নানারকম পেয়ে থাকি । সুতরাং , যে বীণাপাণিকে দেবী হিসাবে কিংবা বহুবিধ রূপে আলোচনা করা হবে তার প্রামাণ্যের টিকিটি কিন্তু পুরাণের মূলেই বাঁধা আছে । এ নিয়ে তর্ক চলতেই পারে তবে নাস্তিকতা-আস্তিকতা প্রসঙ্গ টেনে আনা অবান্তর হবে । এবারে আসা যাক মূল আলোচনায় । নীরসতার আড় ভাঙার জন্য প্রবন্ধটিকে কয়েকটি পর্বে সাজানো হল ।  


নানা পূরান মতে বর্ণনা

স্কন্দপুরাণ

ব্রহ্মা তাঁর কন্যা সরস্বতীর প্রতি দুর্ব্যবহার করলে শিব তাঁকে শরবিদ্ধ করে হত্যা করেন । তখন ব্রহ্মার পত্নী গায়ত্রী কন্যা সরস্বতীকে নিয়ে স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনার জন্য গন্ধমাদন পর্বতে তপস্যা শুরু করেন । তাঁদের দীর্ঘ তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে শিব ব্রহ্মার প্রাণ ফিরিয়ে দেন । সেই থেকে শিবের নির্দেশে গায়ত্রী ও সরস্বতীর তপস্যাস্থলে দুটি প্রসিদ্ধ তীর্থ সৃষ্টি হয় ।

জগতে সকল দেবতা তীর্থ আছে , শুধু ব্রহ্মার তীর্থ নেই – একথা ভেবে ব্রহ্মা পৃথিবীতে নিজের তীর্থ স্থাপনে উদ্যোগী হলেন । তিনি একটি সর্বরত্নময়ী শিলা পৃথিবীতে নিক্ষেপ করলেন । সেটি চমৎকারপুরে এসে পড়ল । ব্রহ্মা সেখানেই নিজের তীর্থ স্থাপন করবেন বলে ভাবলেন । ব্রহ্মার নির্দেশে সরস্বতী পাতাল থেকে উঠে এলেন । ব্রহ্মা তাঁকে বললেন, “তুমি এখানে আমার কাছে সব সময় থাকো । আমি তোমার জলে ত্রিসন্ধ্যা তর্পণ করব ।” সরস্বতী ভয় পেয়ে বললেন, “আমি লোকের স্পর্শ ভয় পাই বলে সব সময় পাতালে থাকি । কিন্তু আপনার আদেশ আমি অমান্যও করতে পারি না । আপনি সব দিক বিচার করে একটি ব্যবস্থা করুন ।” তখন ব্রহ্মা সরস্বতীর অবস্থানের জন্য একটি হ্রদ খনন করলেন । সরস্বতী সেই হ্রদে অবস্থান করতে লাগলেন । ব্রহ্মা ভয়ংকর সাপেদের সেই হ্রদ ও সরস্বতীর রক্ষক নিযুক্ত করলেন ।

দেবীভাগবত পুরাণ

দেবীভাগবত পুরাণ অনুসারে , দেবী আদ্যাপ্রকৃতির তৃতীয় অংশে দেবী সরস্বতীর জন্ম । তিনি কৃষ্ণের জিহ্বাগ্র থেকে উৎপন্ন হয়েছেন । সরস্বতী বাক্য , বুদ্ধি, বিদ্যা ও জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ; সকল সংশয় ছেদকারিণী ও সর্বসিদ্ধিপ্রদায়িনী এবং বিশ্বের উপজীবিকা স্বরূপিনী । ব্রহ্মা প্রথম তাঁকে পূজা করেন । পরে জগতে তাঁর পূজা প্রতিষ্ঠিত হয় । সরস্বতী শুক্লবর্ণা , পীতবস্ত্রধারিণী এবং বীণা ও পুস্তকহস্তা । তিনি নারায়ণের অন্যতম পত্নী হয়েছিলেন । তারপর কৃষ্ণ জগতে তাঁর পূজা প্রবর্তন করেন মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে ।

অন্যদিকে আবার গঙ্গা , লক্ষ্মী ও সরস্বতী ছিলেন নারায়ণের তিন পত্নী । একবার গঙ্গা ও নারায়ণ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসলে , ফলে তিন সতীনের মধ্যে তুমুল বিবাদ উপস্থিত হয় । এই বিবাদের পরিণামে একে অপরকে অভিশাপ দেন । গঙ্গার অভিশাপে সরস্বতী নদীতে পরিণত হন । পরে নারায়ণ মধ্যস্থতা করে বিধান দেন যে , সরস্বতী এক অংশে নদী , এক অংশে ব্রহ্মার পত্নী ও এক অংশে তাঁর সঙ্গিনী হবেন এবং কলিযুগের পাঁচ হাজার বছর অতিক্রান্ত হলে সরস্বতী সহ তিন দেবীরই শাপমোচন হবে । বিষয়টি অদ্ভুত তথা একবিংশ যুগের নারী নির্যাতনের কী অপূর্ব উধাহরণ , তবে দেবতা তো তাই সব দোষের উর্ধে !

যাইহোক , নারায়ণের বিধান এবং গঙ্গার অভিশাপে সরস্বতী মর্ত্যে নদী হলেনে এবং ব্রহ্মার প্রিয়তমা পত্নী ব্রাহ্মী হলেন ।

শুক্ল যজুর্বেদ

"শুক্ল যজুর্বেদ" অনুসারে, একসময় ইন্দ্রের শরীরের শক্তি চলে যাওয়ার ফলে তিনি মেষ আকৃতি গ্রহণ করেন । সেসময় ইন্দ্রের চিকিৎসার দায়িত্ব ছিল স্বর্গের অশ্বিনীদ্বয়ের উপর এবং সেবা-শুশ্রুষার ভার ছিল সরস্বতীর হাতে । সংগীত ও নৃত্যপ্রেমী ইন্দ্র সরস্বতীর গানবাজনা ও সেবায় সুস্থ হওয়ার পর তাকে মেষটি দান করেন । এটি কিন্তু বর্তমানের মিউজিক থেরাপির নামান্তর ও উজ্জ্বল প্রমান ।

রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকি যখন ক্রৌঞ্চ হননের শোকে বিহবল হয়ে পড়েছিলেন , সে সময় জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী তার ললাটে বিদ্যুৎ রেখার মত প্রকাশিত হয়েছিলেন । তার পরের কাহিনী আমরা কম বেশী অনেকেই জানি । সূত্রপাত হয়েছিল , শোক থেকে শোলক > শ্লোক ।

বৈয়াকরণ শংকরনাথ ভট্টাচার্য সরস্বতী শব্দটিকে ভেঙেছেন , সরস+বতী=সরস্বতী অর্থ জ্যোতিময়ী । ঋগ্বেদে এবং যর্জুবেদে অনেকবার ইড়া , ভারতী , সরস্বতীকে একসঙ্গে দেখা যায় । বেদের মন্ত্রগুলো পর্যালোচনায় প্রতীতী জন্মে যে , সরস্বতী মূলত “ সূর্যাগ্নি ”।
ঋগ্বেদে বাগ্দেবী ত্রয়ীমূর্তি - ভূ: ভুব: স্ব: , জ্ঞানময়ীরূপে সর্বত্রব্যাপিনী । বিশ্বভূবন প্রকাশ তারই জ্যোতিতে । হৃদয়ে সে আলোকবর্তিকা যখন প্রজ্বলিত হয় , তখন জমাট বাধা অজ্ঞানতারূপ অন্ধকার যায় দূর হয়ে । অন্তরে, বাইরে সর্বত্র তখন জ্বলতে থাকে জ্ঞানের পুণ্য জ্যোতি । এই জ্যোতিজ্ঞানই ব্রহ্মজ্ঞান , এই জ্যোতিই সরস্বতী । আলোকময়ী , তাই তিনি সর্বশুক্লা । তিন গুণের মধ্যে তিনি সত্ত্বগুণময়ী , অনন্ত জ্ঞানময় ঈশ্বরের বাক-শক্তির প্রতীক বাগ্দেবী ।

গতিময় জ্ঞানের জন্যই ঋগ্বেদে তাঁকে নদীরূপা কল্পনা করা হয়েছে , যিনি প্রবাহরূপে কর্মের দ্বারা অনন্ত সমুদ্রে মিলিত হয়েছেন । কল্যাণময়ী নদীতটে সাম গায়কেরা বেদমন্ত্র উচ্চারণে ও সাধনে নিমগ্ন হতো । তাদের কণ্ঠে উদ্গীত সাম সঙ্গীতের প্রতীকী বীণা দেবীর করকমলে । সরস্বতী বিধৌত ব্রহ্মাবর্ত ভূমি বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত আশ্রয় করে সাধনা করতে আশ্রমবাসী ঋষিগণ । সেই ভাবটি নিয়েই দেবী ‘পুস্তক হস্তে ', গ্রন্থ রচনার সহায়ক লেখনীটিও তাঁর সঙ্গে ।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য , ব্রহ্মজ্ঞান যে কারোরই হতে পারে বা সকলেরই কুক্ষিগত হতে পারে না । বর্নাশ্রমের মাধ্যমে চতুরাশ্রম হতে পারে কিন্তু বেদের প্রকৃত বিশ্লেষণ অনুসারে শূদ্রও ব্রহ্মজ্ঞ্যানের দ্বারা ব্রাহ্মণ হতেই পারেন । এতে গুটিকয়েক সুতোর আশ্রয় না নিলেও চলে ।

মার্কণ্ডেয় পুরাণ

শ্রীশ্রীচণ্ডী উত্তরলীলায় শুম্ভ নিশুম্ভ নামক অসুরদ্বয়কে বধ করার সময় দেবীর যে মূর্তির কল্পনা করা হয়েছিল তা ছিল মহাসরস্বতী । বেদের আরেক গল্পানুসারে , শুম্ভ ও নিশুম্ভ অসুরদ্বয়কে বধ করার সময় দেবী দুর্গার শরীর থেকে যে কৌশিকী দেবীর উৎপত্তি হয়েছিল , তাঁর অপর নাম সরস্বতী ।

এ মূর্তি অষ্টভূজা [ চিত্র ১ ] – বাণ , কার্মূক , শঙ্খ , চক্র , হল , মুষল , শূল ও ঘন্টা ছিল তাঁর অস্ত্র । তাঁর এই সংহারলীলাতেও কিন্তু জ্ঞানের ভাবটি হানি ঘটেনি , কেননা তিনি ‘একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়াকা মমাপরা ' বলে মোহদুষ্ট শুম্ভকে অদ্বৈত জ্ঞান দান করেছিলেন । নারী মাত্রই ধরা হয় শক্তি-আশ্রয় । এর অন্যথা কী হয় না , সেটি অবশ্য অন্য আলোচনা ।

স্কন্দ পুরাণ , গরুড় পুরাণ , পদ্মপুরাণ  ও বায়ু পুরাণের তুল্যমূল্য বিশ্লেষণ এবং তন্ত্র মত

স্কন্দ পুরাণের “প্রভাসখণ্ডে” দেবী সরস্বতীর নদীরূপে অবতরণের কাহিনী বর্ণিত আছে । আবার , বায়ু পুরাণ অনুযায়ী কল্পান্তে সমুদয় জগৎ রুদ্র কর্তৃক সংহৃত পুনর্বার প্রজা সৃষ্টির জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজ অন্তর থেকেই দেবী সরস্বতীকে সৃষ্টি করেন । সরস্বতীকে আশ্রয় করেই ব্রহ্মার প্রজা সৃষ্টির সূচনা ।

গরুড় পুরাণে সরস্বতী শক্তি অষ্টবিধা । শ্রদ্ধা , ঋদ্ধি , কলা , মেধা , তুষ্টি , পুষ্টি , প্রভা ও স্মৃতি । তন্ত্রে এই অষ্টশক্তি যথাক্রমে যোগ , সত্য , বিমল , জ্ঞান , বুদ্ধি , স্মৃতি , মেধা ও প্রজ্ঞা । তন্ত্র শাস্ত্রমতে সরস্বতী বাগীশ্বরী - অং থেকে ক্ষং পঞ্চাশটি বর্ণে তাঁর দেহ।

আবার পদ্মপুরাণ-এ উল্লিখিত সরস্বতীস্তোত্রম্-এ বর্ণিত হয়েছে -
“ শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেতপুষ্পোপশোভিতা
শ্বেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতগন্ধানুলেপনা
শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চিতা
শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারভূষিতা...।”
- এর অর্থ , দেবী সরস্বতী শ্বেতপদ্মে আসীনা , শ্বেতপুষ্পে শোভিতা , শ্বেতবস্ত্র-পরিহিতা এবং শ্বেতগন্ধে অনুলিপ্তা । অধিকন্তু তাঁর হস্তে শ্বেত রুদ্রাক্ষের মালা ; তিনি শ্বেতচন্দনে চর্চিতা , শ্বেতবীণাধারিণী, শুভ্রবর্ণা এবং শ্বেত অলঙ্কারে ভূষিতা ।

ভারতের বাইরে তুল্য সচিত্র দেবী সরস্বতী

ভারতবর্ষে দেবী সরস্বতী বিদ্যা ও ললিতকলার দেবী হিসেবে পূজিত হচ্ছেন সেই আদিকাল থেকে । কিন্তু ভারতবর্ষের বাইরেও দেবী সরস্বতীর পূজা হয়ে থাকে। চীনে শস্যদেবী কুয়ানজিনের [ চিত্র ২ ] সঙ্গে দেবী সরস্বতীর তুলনা করা যেতে পারে ।

[ চিত্র ২ ]
কেউ কেউ আবার মধ্যপ্রাচ্যের মাতৃকাদেবী ইসতার বা ইনান্নার [চিত্র ৩] সঙ্গে দেবী সরস্বতীর তুলনা করেছেন ।
[চিত্র ৩]
গ্রীক দেবী এথেনির [ চিত্র ৪ ] সঙ্গে দেবী সরস্বতীর সাদৃশ্য অনেকে কল্পনা করে থাকেন ।
[ চিত্র ৪ ]
আবার রোমের দেবী মিনার্ভার [ চিত্র ৫ ] সঙ্গেও সাদৃশ্য আছে বলে মনে করা হয়।
[ চিত্র ৫ ]
রোমের দেবী মিনার্ভা ও কেলটিক দেবী [ চিত্র ৬ ] বিঘ্রিদের সঙ্গে প্রকৃতিগত দিক থেকে সরস্বতীর সাদৃশ্য রয়েছে ঠিকই, তবে এ দুই দেবীর সঙ্গে ভারতবর্ষীয় সরস্বতী দেবীর সম্পর্ক নির্ণয় করা সম্ভব নয় ।
[ চিত্র ৬ ]
কেবল জাপানের বিদ্যাদেবী বেনজিয়াতেন [ চিত্র ৭ ] যে ভারতবর্ষীয় সরস্বতী দেবীর বিদেশে আতিথ্য গ্রহণের সাক্ষ্য , এটুকুই নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
[ চিত্র ৭ ]


দুই সরস্বতী

ঋগ্বেদে দুই ধরনের সরস্বতীর উল্লেখ আছে । একটি ত্রিলোক্য ব্যাপিনী সূর্যাগ্নি ,অন্যটি নদী । সরস্‌ ধাতু তদুত্তরে অস্থর্থে বতু এবং স্ত্রী লিঙ্গে ঈপ্‌প্রত্যয় যোগে নিষ্পন্ন হয়েছে সরস্বতী-এ মত স্বামী নির্মলানন্দের । ভৃগুপনিষদে জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী ও জলময়ী সরস্বতীর সমীকরণ করা হয়েছে । এই উপনিষদে জলে জ্যোতি প্রতিষ্ঠিত , জ্যোতিতে জল প্রতিষ্ঠিত । কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী বিরচিত “ সারদামঙ্গল ” কাব্যে জ্যোতির্ময়ী সরস্বতীর আবির্ভাব বর্ণনা করেছেন ।


সরস্বতী কি দেবী ? তিনি কি নদী ? নাকি গণিকামাত্র ?-এক নারীর প্রতারণা

রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকি যখন ক্রৌঞ্চ হননের শোকে বিহবল হয়ে পড়েছিলেন সে সময়জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী তার ললাটে বিদ্যুৎ রেখার মত প্রকাশিত হয়েছিলেন । ঋগ্বেদে ইন্দ্রের সঙ্গে সরস্বতীর সম্পর্ক যেমন ঘনিষ্ঠ তেমনি ঘনিষ্ঠ মরুদ ও অশ্বিনীদ্বয়ের সঙ্গে । সরস্বতী কখনো ইন্দ্রের পত্নী আবার কখনো শত্রু, কখনো-বা ইন্দ্রের চিকিৎসক । শুক্লযজুর্বেদে তিনি চিকিৎসক রুপে রুদ্র অশ্বিনীদ্বয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততা । সরস্বতীর রোগ নিরাময় শক্তির কথা পরবর্তী সময়েও জনশ্রুতিতে ছিল ।

একটি অতীব ঘৃণ্য কথার উল্লেখ আমরা পাই হিন্দু পুরাণেই । হিন্দু পুরাণে বলা হয়েছে , ব্রহ্মা তাঁর কন্যার সঙ্গে যৌন সংসর্গে লিপ্ত হন । এহেন বিষয়ে কলকাতার জাদুঘরের একটি প্রস্তর মূর্তি থেকে তার যথেষ্ট প্রমাণ মেলে । এই মূর্তিটি ব্রহ্মার বামজানুর উপর সরস্বতী বসে আছেন , তাঁর এক হাতে ব্রহ্মার স্কন্ধবেষ্টিত । সরস্বতীর সঙ্গে ব্রহ্মার এই সম্বন্ধের সন্ধান ঋগ্বেদেও পাওয়া যায় । এখানে ব্রহ্মার সঙ্গে বাক্ দেবীর একটি ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ সূচিত হয়েছে । বাক্ই যে সরস্বতী তা নিয়ে তো কোনো দ্বিমত নেই । ব্রাহ্মণ যুগে এই সম্বন্ধ আরও ঘনিষ্ঠতর । এখানে দেখা যাচ্ছে -

“প্রজাপতি ব্রহ্মা পুনরায় নিজেকে আপ্যায়িত করিলেন, বাক্ তাহার দিকে ফিরিয়া আসিলেন । তিনি বাক্-কে আত্মবশ করিলেন ।এখানে তিনি বাক্য দ্বারা আপ্যায়িত হইলেন, বলবান হইলেন”।

এইভাবেই বোধহয় আমরা সরস্বতীকে ব্রহ্মার স্ত্রী হিসাবে পাই । বেদের উষাই পরবর্তীতে সরস্বতী রূপে পাই । তাই উষার মতো সরস্বতীও শুভ্র এবং জ্ঞানের প্রতীক । সেই কারণে সরস্বতী একদিকে সূর্যের কন্যা ও অন্যদিকে স্ত্রী ।

। শ্রীকৃষ্ণকেও স্বামী হিসাবে কামনা করেছিলেন তিনি – “ ইয়েষ কৃষ্ণং কামেন কামুকী কামরূপিনী ” ।

‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ’-এ শ্রীকৃষ্ণ-সরস্বতীর কেচ্ছাকাহিনি যথাযথভাবেই বর্ণিত আছে । ডঃ শ্যামল চক্রবর্তী ‘নারী’ প্রবন্ধে বলেছেন, সরস্বতী গণেশেরও স্ত্রী । মহারাষ্ট্রের কোনো কোনো পূজারী মনে করেন, গণেশের পত্নী সরস্বতী কিংবা সারদা । হয়তো সরস্বতী এবং গণেশ দুজনই বিদ্যা ও সংগীতের অধিষ্ঠাতা দেবতা বলেই এই পতি-পত্নীর কল্পভিত্তি ।

অন্য-এক তথ্য অনুসারে জানা যাচ্ছে , দুর্গার কন্যা এই সরস্বতী দুর্গার কুমারী সত্তা । আবার বাঙালিরা মনে করেন গণেশ ও সরস্বতী ভাইবোন , দুর্গার সন্তান । অথচ চিরকুমারী (!) সরস্বতীকে স্বর্গের দেবতারা কখনও স্ত্রী , কখনও সেবাদাসী, কখনও গণিকা , আবার কখনও অসুরদের রূপে ভুলিয়ে কাত করাবার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে ।

আবার ভাবলে আশ্চর্য হই পত্নীত্বর দাবী আরেকজন করেছেন , তিনি হলেন স্বয়ং বৃহস্পতি । বৃহস্পতি হচ্ছেন জ্ঞানের দেবতা , বৃহস্পতি পত্নী সরস্বতীও জ্ঞানের দেবী । সরস্বতী নদীর তীরে যজ্ঞের আগুন জ্বেলে সেখানেই ঋষি লাভ করেছিলেন বেদ বা ঋগমন্ত্র।  

কী কিম্ভুতকিমার বিষয় ! ভাবলেও অবাক যত হই তার থেকেও শিহরিত হই এক নারীকে নিয়ে কী মজার ঘৃণ্য খেলা ।

ব্রহ্মাকে অভিশাপ ! কিন্তু কেন ?
আদি পুরাণ বলছে , সরস্বতী ব্রহ্মার মুখজাত । মুখজাত – এর অর্থ জ্ঞান । মুখ নিঃসৃত কথাই তো বেদ । ফলে ব্রহ্মার মুখজাত সৃষ্টি সরস্বতী জ্ঞানেরই । আবার শিবপুরাণ তো অন্য কথা বলছে । বলছে –ব্রহ্মা কামপরবশ হয়ে সরস্বতীর পিছনে পিছনে গিয়েছিলেন ছেলেদের বাধায় ব্রহ্মা দেহত্যাগ করেছিলেন । এখানেই আছে ব্রহ্মার এই কুপ্রস্তাবে সরস্বতী ব্রহ্মাকে অভিশাপ দেন , ফলে তার একটি মাথা খসে পড়ে। সেই থেকে ব্রহ্মা চতুরানন । ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেও সরস্বতী বিষ্ণুর মুখজাত ,কিন্তু ব্রহ্মার স্ত্রী । বিষ্ণু ব্রহ্মাকে গোলকে পাঠাচ্ছেন । প্রকৃতির অংশরূপী ভারতীকে সেখানে মানে , গোলকে দেখতে পাবেন এবং তাকে দেখার পর তার সঙ্গে যৌন মিলনে ব্যস্ত হবেন । এও আছে , ব্রহ্মা ভারতীর সঙ্গে রতিক্রিয়া করেছেন নির্জনে । যিনি ভারতী, তিনিই সরস্বতী বা সাবিত্রী ।

আবার কিছুটা সাদৃশ্য মূলক কিঞ্চিৎ ভিন্ন পুরাণ কাহিনী আছে । সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা ধ্যানে বসেছিলেন । ব্রহ্মার কপাল থেকে নির্গত হয়েছেন দেবী সরস্বতী । অপরূপ সুন্দর বললেও কম বলা হয় এমনই তাঁর সৌন্দর্য । চোখ মেলে তাকালেন ব্রহ্মা । প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়লেন তিনি দেবী সরস্বতীর । কামনা করে বসলেন দেবীকে ।  দেবী সরস্বতী ব্রহ্মার শরীরসঞ্জাত— সেই অর্থে দেবী তাঁর মানসপুত্রী আর সেই দেবীকেই কিনা অঙ্কশায়িনী করতে চান তিনি ! তীব্র বিরোধিতায় দেবীর মুখমণ্ডল আরক্ত হয়ে উঠল । দেবী পালাতে চাইলেন ব্রহ্মার কামপূর্ণ দৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য । কিন্তু যে দিকেই দেবী গমন করেছেন, সে দিকেই ব্রহ্মার একটি করে মস্তক সৃষ্টি হয়েছে । সরস্বতীর দিক থেকে এক বারের জন্যও দৃষ্টি সরাননি তিনি । এমনকী দেবী ওপরে গমন করলেও ঊর্ধ্বেও আর একটি মস্তক তৈরি হয়েছে দেবীকে চোখের আড়াল না করার নিমিত্ত । অবশেষে সফল হয়েছেন ব্রহ্মা । সরস্বতীকে বিবাহ করেছেন তিনি দেবীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও । দেবীর প্রভাকে ছাপিয়ে গিয়েছে ব্রহ্মার কামনা ।

উক্ত গল্পদ্বয় আমরা হয়তো গোগ্রাসে পড়তে পারি , কিন্তু বর্তমান যুগেই যে কেবল নারী পণ্য-ভোগ্য হয়েছে ? তা নয় , এ ঘৃণ্য বহমানতা আজ থেকে হাজার হাজার জুগের অন্ধকারেও ছিল লুকিয়ে । যা সময় পেলেই থাবা থেকে নখ বার করে ।


লক্ষ্মী নয়, সরস্বতী কেন পূজা পান গণিকালয়ে ?

উপপত্নী বা গণিকাদের লক্ষ্মীপুজো থেকে বঞ্চিত করা হলেও সরস্বতী পুজো করতে পারেন । সরস্বতী কেন ? সরস্বতী জায়গা কী তবে গণিকালয়ে ? তা না-হলে লক্ষ্মী নয় কেন ? দক্ষিণ ভারতে যে ময়ূরবাহন সরস্বতীর মূর্তি পাওয়া গেছে সেটা কৌমারীর সঙ্গে অনেকটা মিল আছে । কৌমারী কার্তিকের পত্নী । তাই বোধহয় গণিকাদের দেবতা কার্তিকের পাশাপাশি সরস্বতীর পুজোও গণিকালয়ে হয়ে থাকে । যুগে যুগে ইতিহাসবিদরা জানিয়েছেন উপাসনালয় থেকে গণিকালয়-- সর্বত্র পুজো পায় সরস্বতী । সরস্বতী তাঁর কৌমার্য হারিয়েছে বহু পুরুষের বাহুডোরে ।

নেপালে চতুর্দশ শতকের পাওয়া শিলালিপিতে লেখা আছে – “সারদা তুমি মাতৃরূপী, তুমি কামমূর্তি”। তাই হয়ত উচ্চারিত হয় –

“ ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে ”।

তিব্বতে এমন অনেক সরস্বতী পাওয়া গেছে যাঁর উর্ধ্বাঙ্গে কোনো বসনই ছিল না । একটি কথা বলতেই হয় সরস্বতী , লক্ষ্মী , কার্তিক , গণেশ – এরা কেউ কারোর ভাই-বোন নয় , এটা বাঙালিদের গৃহস্থালির যেন চালচিত্র । যার ভিত্তি নেই , সমর্থনও নেই ।


সরস্বতী তুমি কি নদী ?

ভৌগোলিক দিক থেকে নিশ্চিতভাবেই বলা যাবে কি সরস্বতী নদী শতদ্রু ও যমুনা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল ? অনুমান করা যায় যে বৈদিক সরস্বতী (আঞ্চলিক নাম সরসুতী) হরিয়ানার থানেশ্বর অঞ্চলে প্রবাহিত । ঋগ্বেদে (VIII, 36.6 সূক্ত) বলা হয়েছে সপ্তথি সরস্বতী নদীগুলির মাতা (সিন্ধুমাতা) একসাথে দুগ্ধ ও স্রোতস্বিনীদের নিয়ে বিপুল গর্জনে তীব্র স্রোতে প্রভূত জলধারায় স্ফীত হয়ে প্রবাহিত ।

সরস্বতী তুমি এবার হলে নদী- জীবনদায়িনী

‘ কথা সরিৎসাগর ’-এ সোমদেব (একাদশ শতক) জানিয়েছেন,পাটলিপুত্রের নারীরা রুগ্ন ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য সরস্বতীর ঔষধ ব্যবহার করতেন । নিরুক্তকার যাস্কের মতে, সরস্বতী শব্দের অর্থ যাতে জল আছে । সৃ ধাতু নিস্পন্ন করে সর শব্দের অর্থ জল । অর্থাৎ যাতে জল আছে তাই সরস্বতী । নদী সরস্বতী আর্য ভূমির অন্যতম নদীরূপে ঋগ্বেদে বহুবার কীতির্ত হয়েছে । ঋগ্বেদে সরস্বতী-সিন্দু ও তার পাঁচটি উপনদী নিয়ে সপ্তসিন্ধুর বারংবার উল্লেখ আর্যভূমিতে-এদের অপরিসীম গুরুত্ব প্রমাণ করে ।

‘অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী’ – অর্থাৎ নদী হিসাবে সরস্বতীকে ।

অদৃশ্য কেন তুমি সরস্বতী ?

বৈদিক যুগের পরবর্তীকালে মহাভারত , পুরাণ , কাব্যে পূতঃসলিলা সরস্বতীর মহিমা বর্ণিত হয়েছে । সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল ছিল হিমালয়ের সিমুর পর্বতে , এখান থেকে পাঞ্জাবের আম্বালা জেলার আদবদ্রী নামক স্থানে সমভূমিতে অবতরণ করেছিল । যে প্রসবণ থেকে এই নদীর উৎপত্তি তা ছিল প্লক্ষ্ণা বৃক্ষের নিকটে , তাই একে বলা হতো প্লক্ষ্ণাবতরণ । এটি হিন্দুদের তীর্থস্থান । ঋগ্বেদের যুগে গঙ্গা যমুনা ছিল অপ্রধান নদী , পক্ষান্তরে সরস্বতী নদী ছিল সর্বপ্রধান ও সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় । এর তীরে ছিল প্রসিদ্ধ তীর্থভূমি । সরস্বতীও দৃষদ্বতীর মধ্যস্থান দেবনির্মিত স্থান হিসেবে বিবেচ্য হত ।

ব্রাহ্মণ ও মহাভারতে উল্লেখিত সারস্বত যজ্ঞ এই নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হত । মহাভারত রচনা হওয়ার আগেই রাজপুতনার মরূভূমিতে সরস্বতী নদী অদৃশ্য হয়ে গেলেও কয়েকটি স্রোতধারা অবশিষ্ট ছিল । এই স্রোতধারা হল চমসোদ্ভেদ , শিবোদ্ভেদ ও নাগোদ্ভেদ । রাজস্থানের মরূভূমির বালির মধ্যে চলুর গ্রামের নিকটে সরস্বতী অদৃশ্য হয়ে ভবানীপুরে দৃশ্য হয় । আবার বলিচ্ছপুর নামকস্থানে অদৃশ্য হয়ে বরখের নামক স্থানে দৃশ্য হয় । তান্ডমহাব্রাহ্মণে সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল হিসাবে প্লক্ষ্ণপ্রস্রবণ ও বিনাশস্থল হিসেবে বিনশনের নামোল্লেখ আছে।
[ চিত্র ৮ ]
ভারতের বর্তমান উদয়পুর , মেওয়াড় ও রাজপুতনার পশ্চিমপ্রান্তে মরূ অঞ্চলে সিরসা অতিক্রম করে ভূটানের মরূভূমিতে সরস্বতীর বিলোপস্থানই বিনশন । লাট্যায়ণের শ্রৌত সূত্র মতে , “ সরস্বতী নামক নদী পশ্চিম মুখে প্রবাহিত,তার প্রথম ও শেষভাগ সকলের প্রত্যক্ষ গোচর ,  মধ্যভাগ ভূমিতে নিমগ্ন হয়ে প্রবাহিত, সে অংশ কেউ দেখতে পায় না,তাকেই বিনশন বলা হয় ”। অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের মতে , বৈদিক সরস্বতীর লুপ্তাবশেষ আজও কচ্ছ ও দ্বারকার কাছে সমুদ্রের খাড়িতে গিয়ে মিলিত হয়েছে । সরস্বতী নদীর বিনাশ ঘটেছিল অবশ্যই বৈদিক যুগের শেষভাগে । আচার্য যোগেশচন্দ্র রায়ের মতে, খ্রিস্টের দেড় হাজার বছরেরও আগে । মহাভারতে আছে যে নিষাদদের চোখের আড়ালে থাকার জন্য বিনাশণ নামক স্থানে মরুভূমিতে অদৃশ্য হয়েছে । নদীর স্থানীয় নামই এই ঐতিহ্য বহন করছে । অনেকেই বলেন, সিন্ধুনদই সরস্বতী । সরস্বতী ও সিন্ধু দুটি শব্দের অর্থই নদী । [ চিত্র ৮ ] –এ কিঞ্চিৎ চিত্রিত করা হল ।

নদী সরস্বতীর মহিমা ভারতবাসীর মনে এত রেখাপাত করেছিল যে পরবর্তীকালে গঙ্গা-সরস্বতীর স্থান দখল করলেও তারা তাকে ভুলতে পারেনি । প্রয়াগে অন্তঃসলিলারূপে গুপ্ত ভাবে গঙ্গা-যমুনার সঙ্গে সরস্বতীর সঙ্গম, পশ্চিমবঙ্গে হুগলি জেলার ত্রিবেণীতে গঙ্গার স্রোত ধারা থেকে সরস্বতীর মুক্তি হিন্দুদের প্রিয় ও পবিত্র বিশ্বাস । সরস্বতী নিয়ে নানা ব্যাখ্যা নানা বিশ্লেষণ প্রচলিত আছে । তাই সঠিক সিদ্ধান্তে যাওয়ার চেষ্টা করা বৃথা, তবে অসম্ভব নয় ।

বৈদিক সংস্কৃতির উদ্ভব ও দেবীতে রূপান্তর

সম্ভবত সরস্বতী নদীর তীরেই বৈদিক এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উদ্ভব । তাই হয়তো শিক্ষার সঙ্গে সরস্বতীর অচ্ছেদ্য বন্ধন এবং এর জন্যই পৌরাণিক যুগে সরস্বতী বিদ্যার দেবী হয়ে উঠেছেন । সরস্বতীর আর-এক নাম ভারতী । তিনি ‘ব্রাহ্মণ’-এ বাক্ নামে পরিচিতা । দেবী সরস্বতীর সঙ্গে নদী সরস্বতীর এই একাত্মতা সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত থাকলেও সরস্বতীকে ব্রহ্মার মানসকন্যা হিসাবে কল্পনা করা হয়।

দেবী রূপী সরস্বতীর বাহন ( গুলি )এবং কী লজ্জা !!

সরস্বতীর বাহন হাঁস ছাড়াও মেষ আর বরাহকে পাওয়া যায় । প্রত্নতাত্ত্বিক এন.এস ভট্টসারি একটি লেখায় বলেছেন , “একসময় ইন্দ্রের শরীরের শক্তি চলে যাওয়ার ফলে তিনি মেষ আকৃতি গ্রহণ করেন । সেসময় ইন্দ্রের চিকিৎসার দায়িত্ব ছিল স্বর্গের অশ্বিনীদ্বয়ের উপর এবং সেবা-শুশ্রুষার ভার ছিল সরস্বতীর হাতে । সংগীত ও নৃত্যপ্রেমী ইন্দ্র সরস্বতীর গানবাজনা ও সেবায় সুস্থ হওয়ার পর তাকে মেষটি দান করেন । সেই থেকেই সরস্বতীর সঙ্গী এই মেষ । মনে প্রশ্ন জাগে তাহলে কি সরস্বতী স্বর্গের সেবাদাসীও !

সরস্বতীর বাহন বরাহ (শুয়োর), কারণ তিনি নাকি বিষ্ণুরও স্ত্রী ছিলেন । অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ রচিত ‘সরস্বতী’ গ্রন্থটিতে এ তথ্য পাওয়া যায় ।
[ চিত্র ৯ ]
দেবী আবার কোথাও ময়ুরকে বাহন করেছেন , যার প্রমান দক্ষিণ ভারতের মন্দিরে দেখতে পাওয়া যায় [ চিত্র ৯ ] ।

বর্তমানে সরস্বতীর বাহন হাঁস । পণ্ডিত কলহনের মতে , সরস্বতী দেবী হংসের রূপ ধারণ করে ভেড়গিরি শৃঙ্গে দেখা দিয়েছিলেন । এ ধরনের ধারণা সঙ্গত কারণ হংসবাহনা সরস্বতীর মূর্তি তো প্রচুর পাওয়া যায় । তিনি এ বাহন ব্রহ্মার কাছ থেকে পেয়েছিলেন কিন্তু ব্রহ্মা বা সরস্বতী দেবীর বাহন কিন্তু পাখি নয় । বেদে এবং উপনিষদে “ হংস ” শব্দের অর্থ সূর্য । সূর্যে সৃজনী শক্তির বিগ্রহাম্বিতরূপ ব্রহ্মা এবং সূর্যাগ্নির গতিশীল কিরণরূপা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব শক্তি সরস্বতী দেবীর বাহন হয়েছেন হংস বা সূর্য একেবারেই যুক্তিসঙ্গত কারণে । তবে বৈদিক সাক্ষ্য থেকেই জানা যায় সিংহ ও মেষ সরস্বতী দেবীর আদি বাহন ছিল । কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেবী দুর্গা সরস্বতী দেবীর কাছ থেকে সিংহ কেড়ে নিলেন আর কার্ত্তিক কেড়ে নিলেন ময়ূর । পরবর্তী সময়ে সরস্বতী দেবী হংসকেই তাঁর চিরস্থায়ী বাহনের মর্যাদা দিলেন । আর সরস্বতীর এ বাহন সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সর্বত্রই তাঁর সমান গতি ঠিক যেমনভাবে জ্ঞানময় পরমাত্মা সব জায়গায় বিদ্যমান । মজার ব্যাপার হলো হংস জল ও দুধের পার্থক্য করতে সক্ষম। জল ও দুধ মিশ্রিত থাকলে হাঁস শুধু সারবস্তু দুধ বা ক্ষীরটুকু গ্রহণ করে আর জল পড়ে থাকে। জ্ঞান সাধনায় হাঁসের এ স্বভাব যথেষ্ঠ তাৎপর্য বহন করে।

দেবীর পূজা বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মে

হিন্দুদের দেবী হওয়া সত্ত্বেও বৌদ্ধ ও জৈনদের কাছেও পুজো পেয়েছেন । গান্ধারের পাওয়া বীণাবাদিনী সরস্বতীর মূর্তি থেকে বা সারনাথে সংরক্ষিত মূর্তিতে এর প্রমাণ মেলে । পাথরের একটি ছোটো মূর্তি আছে তাতে সরস্বতী বীণা বাজাচ্ছেন , এর সঙ্গে হিন্দুদের সরস্বতীর কোনো পার্থক্য নেই।

মথুরায় জৈনদের প্রাচীন কীর্তির আবিষ্কৃত নিদর্শনে সরস্বতীর যে মূর্তি পাওয়া গেছে সেখানে দেবী জানু উঁচু করে একটি চৌকো পীঠের উপর বসে আছেন , এক হাতে বই । শ্বেতাম্বরদের মধ্যে সরস্বতী পুজোর অনুমোদিত ছিল । জৈনদের ২৪ জন শাসনদেবীর মধ্যে সরস্বতী একজন এবং ১৬ জন বিদ্যাদেবীর মধ্যে অন্যতম হলেন সরস্বতী । শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর জৈন সম্প্রদায় উভয়েই সরস্বতীকে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম থেকে গৃহীত একজন প্রধান দেবীরূপে স্থান হয়ে গেল । জৈনদের প্রাচীন একটি সরস্বতী মূর্তির চিত্র [ চিত্র ১০] দেওয়া হল ।
[ চিত্র ১০]

লৌকিক কথায় বালক শ্রীকৃষ্ণের সরস্বতী পূজা

কেউ কেউ বলেন , মর্ত্য ধামে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে প্রথম বারের মতো শ্রীশ্রী সরস্বতী দেবী পূজার প্রচলন করেন । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর শৈশব কাল থেকেই সরস্বতী পূজা প্রচলন করে সমগ্র পৃথিবীর শিক্ষার্থীদের সরস্বতী পূজার গুরুত্ববহ বিদ্যার্জন ও বিদ্যালয় সমূহে সরস্বতী পূজার প্রচলন করে গেছেন, যা এখনও পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত রয়েছে । সরস্বতী পূজা স্বর্গ মর্ত্যে, উভয়লোকে দেবতা, গন্ধর্ব, কিন্নর, ঋষি, মহর্ষি, রাজা-প্রজা সবাই শ্রদ্ধার সাথে করে আসছে । সরস্বতী পূজার অঞ্জলী দেওয়ার সময় পলাশ ফুলের ব্যবহার ভগবান শ্রীকৃষ্ণই প্রচলন করেন । ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বয়স তখন ৭ বছর ।

বৈদিক সাহিত্য থেকে ক্রমান্বয়ে আধুনিক বাগদেবী

নদী সরস্বতী বৈদিক সাহিত্য থেকে পুরোপুরি বাগ্ দেবী হয়ে দাঁড়ান ব্রাহ্মণ গ্রন্থে । সরস্বতী বৈদিক দেবী হলেও সরস্বতী পূজা বর্তমান রূপটি আধুনিক কালে প্রচলিত হয়েছে । তবে প্রাচীন কালে তান্ত্রিক সাধকেরা সরস্বতী-সদৃশ দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করতেন বলে জানা যায় । ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ধোয়া চৌকির উপর তালপাতার তাড়ি ও দোয়াত-কলম রেখে পূজা করার প্রথা ছিল । শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ছাত্রেরা বাড়িতে বাংলা বা সংস্কৃত গ্রন্থ , শ্লেট , দোয়াত ও কলমে সরস্বতী পূজা করত । ইংরেজি ম্লেচ্ছ ভাষা হওয়ায় সরস্বতী পূজার দিন ইংরেজি বইয়ের পূজা নিষিদ্ধ ছিল । গ্রামাঞ্চলে এই প্রথা বিংশ শতাব্দীতেও প্রচলিত ছিল । শহরে ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই সরস্বতীর প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করতেন । বর্ধমান মহারাজার পূজায় বিশেষ সমারোহের আয়োজন করা হয় । দূর দুরান্ত থেকে মানুষ এই পূজার বিসর্জন দেখতে আসত । পূজা উপলক্ষে দুই ঘণ্টা আতসবাজিও পোড়ানো হত ।

আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার প্রচলন হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে । ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে সরস্বতী দেবী হলেও মেয়েরা অঞ্জলি দিতে পারত না । কিছু পণ্ডিতের মতে সমাজপতিরা ভয় পেতেন হয়তো এই সুযোগে ধর্মের নামে মেয়েরা দাবি করে বসেন লেখাপড়ার স্বাধীনতা ।

শাস্ত্রে আমরা অনেকরকম সরস্বতীর পরিচয় পাই ।

মহা সরস্বতী — দেবী মাহাত্ম্য অনুসারে ইনি মহা কালী , মহা লক্ষ্মী ও মহা সরস্বতীর মিলিত রূপ । অষ্টভুজা এই দেবী শ্বেতপদ্মাসনা ও বীণাবাদনরতা । ঘণ্টা, ত্রিশূল, লাঙ্গলের ফলা, শাঁখ, মুষল, চাকতি, ধনুক ও তীর (শর) তাঁর হাতে ধরা । শারদ পূর্ণিমার চন্দ্রর মতো তাঁর দীপ্তি । গৌরীর শরীর থেকে তাঁর জন্ম এবং তিনি শুম্ভ ইত্যাদি অসুরদের বধকারিণী [ চিত্র ১১ ]
 [চিত্র ১১ ]
মহা বিদ্যা নীল সরস্বতী — ইনি মহাবিদ্যা তারার আর এক রূপ [ চিত্র ১ ] । তন্ত্র অনুসারে তাঁর ধ্যানমন্ত্র পাওয়া যায় । কথিত আছে — বিদ্যাবতীর কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বনের মধ্যে এক জলাশয়ে কালিদাস যখন প্রাণ বিসর্জন দিতে যান তখন নীল সরস্বতী আবির্ভূত হয়ে তাঁকে আত্মহত্যায় নিরস্ত্র করেন । এরপর কালিদাসের প্রার্থনায় তুষ্ট হয়ে তিনি কালিদাসের জিহ্বার অগ্রভাগে সদা বিরাজ করতে থাকেন । এরই ফলে মূর্খ কালিদাস হয়ে ওঠেন মহাপণ্ডিত ।

আর আমরা সাধারণত যে দেবী সরস্বতীকে জানি তিনি চতুর্ভুজা , শ্বেত বস্ত্রাবৃত, শ্বেত পদ্মাসনা , যা পরম সত্যের প্রকাশক । স্বল্পালংকারা এই দেবী ত্রিভুবনের জ্ঞানদাত্রী । তাঁর চার হাত মন, বুদ্ধি, সচেতনতা ও অহমের দ্যোতক । অন্যভাবে বলা যায় তাঁর চার হাত চার বেদের প্রকাশক । এখানে বেদ বলতে তিন প্রকার সাহিত্য — পদ্য , গদ্য ও সঙ্গীতকে বোঝানো হয়েছে । তাই তাঁর হাতের পুস্তক (পবিত্র বেদ) — বিশ্বজনীন , স্বর্গীয় ও পরমসত্যের আধার । অক্ষসূত্রের মালা — ধ্যান ও আধ্যাত্মিক শক্তির প্রকাশক । কাঁখে পবিত্র জলের ঘট — সৃষ্টি ও পবিত্র শক্তির প্রতীক , আর বীণা — কলা ও বিজ্ঞান জ্ঞানের প্রতীক ।

বৈদিক যুগে বহুধা গুণে দেবী (কৃষি ও পশু-পালন )

দেবী সরস্বতীকে আমরা জানি শুধুমাত্র বিদ্যাদায়িনী হিসেবে । কিন্তু বৈদিক যুগে আরো অনেক গুণের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন । ' প্রণো দেবী সরস্বতী বাজেভির্বাজিনীবতী ' -- তিনি বাজিনীবতী অর্থাৎ অন্নদায়িনী । সূর্যকরের সাহায্যে জল মেঘরূপে বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীতে ঝরে পড়ে । পৃথিবী শস্যশালিনী হয় । এভাবেই দেবী সরস্বতী কৃষি ও পশুবৃদ্ধির সহায়ক হয়ে অন্নদাত্রী হয়ে ওঠেন । ঋষিদের বারবার প্রার্থনা, সরস্বতী যেন তাঁদের ধন দান করেন । নদী সরস্বতীর জলে সিক্ত উর্বর মাটিতে আর্যদের কৃষিভিত্তিক সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল ; নদীর জল তাঁদের বাণিজ্যিক সম্পদেও বৈভবশালী করেছিল । তাই দেবী হলেন ধনদাত্রী । পরবর্তী কালেও সরস্বতীর এই গুণের কথা মুছে যায়নি । তন্ত্রশাস্ত্রে দেবীর ধ্যানমন্ত্রে তাঁর কাছে ঐশ্বর্য প্রার্থনা করা হয়েছে ।

উল্লেখ্য সূর্যের তেজোরূপা হবার দরুণ সূর্যের সমস্ত বৈশিষ্ট্যকে তাঁকেই দান করা হয়েছিল । শুধু তাই নয় যখন যে দেবতা প্রাধান্য পেয়েছেন , তখন তাঁর গুণগুলিও সরস্বতীতে আরোপ করার প্রবণতা দেখা যায় । তাই তিনি কখনও শত্রুদলনী, কখনও চিকিৎসকও । দেবী সরস্বতীকে আমরা সবচেয়ে বেশি জানি বিদ্যার দেবী বলে ।

পরবর্তী বৈদিক যুগে সরস্বতী অন্য পরিচয় মুছে কেবলমাত্র বাগদেবী হিসেবে স্বীকৃতা হলেন । অথর্ব বেদে ও ব্রাহ্মণে তিনি বাগ্‌রূপা। 'বাক্‌ হি সরস্বতী / বাক্‌ বৈ সরস্বতী ।' তিনি যজ্ঞরূপাও। এই হিসেবে , এখন থেকে তিনি ব্রহ্মা বা বৃহস্পতির স্ত্রী বলে মান্যা হলেন ।

অন্য সমস্ত গুণ সত্ত্বেও পরবর্তী কালে শুধুমাত্র বাক্‌ বা বাণীদেবী হওয়াকে পণ্ডিতেরা খুব অস্বাভাবিক মনে করেন না । বাক্য সমস্ত জ্ঞানের উৎস, জ্ঞানলাভে অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর হয় । তমসাবিদূরক বলতে, প্রাকৃতিক ও মানসিক দুই অন্ধকারই দূরকারী বলে সূর্যকে বন্দনা করা হত ।

সরস্বতীর রূপ বর্ণনা

এবার আসি সরস্বতীর রূপ-কথায় । যেখানেই সরস্বতীর কথা বলা হয়েছে , তাঁকে সর্বশুক্লা বলে অভিহিত করা হয়েছে । মনে হয় , সূর্যের শুভ্রজ্যোতির প্রতীক ও নদীর জলের স্বচ্ছতাই এই ধারণা তৈরী করতে সাহায্য করেছে । যদিও বৈদিক যুগে তাঁর চেহারা কেমন , সে সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি । তাঁর প্রাচীনতম মূর্তি দেখা যায় খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয় শতাব্দীতে তৈরী ভারহুত রেলিঙের গায়ে । এই রেলিংটি কলকাতা জাদুঘরে রক্ষিত আছে ।

মূর্তি কল্প নির্মাণ ও ছয়টি ধ্যান মন্ত্র

বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থে দেবীকে ' সকল-কলাত্মিকা ' বলে বর্ণনা করা হয়েছে । তাই যখন তাঁর মূর্তি তৈরীর প্রশ্ন আসল , তখন কলাবিদ্যার প্রতীক হিসেবে তাঁকে একটা বীণা দেওয়া হল । বিখ্যাত তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ সমস্ত শাস্ত্র ঘেঁটে সরস্বতীর যে ছয়টি ধ্যানমন্ত্রের উল্লেখ করেছেন, তাতে দেবীর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। ১) তাঁকে তুলনা করা হয়েছে কুন্দ, চন্দ্র ও তুষার অর্থাৎ বরফের সঙ্গে । মানে তাঁর বর্ণ এদের মত শুভ্র; সঙ্গে তাঁর পোষাক সাদা, তিনি বসে আছেন সাদা পদ্মফুলের উপর । এমনকি তাঁর বাহনও শ্বেতহংস ।

২) বেশির ভাগ জায়গায় তিনি চতুর্ভুজা , পদ্ম , বীণা , বই , অক্ষমালা , কমণ্ডলু ও বরাভয় মুদ্রায় তাঁকে সাজানো হয়েছে ।

৩) তিনি ত্রিনয়নী । এই তন্ত্রশাস্ত্রেই কোথাও তাঁকে দ্বিভুজা বলেও দেখানো হয়েছে । সরস্বতীর এক নাম সারদা । সাধারণতঃ তাঁর একটাই মুখ হলেও এই নামের পূজাতে তাঁর পাঁচটা মুখ এবং দশটা হাত ।

মজার কথা হল, বৌদ্ধধর্মেও পরে যখন বুদ্ধ ছাড়াও অন্যান্য দেব-দেবীর প্রবেশ ঘটলেও , দেখা গেল সরস্বতী সেখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছেন ।
[ চিত্র ১২ ]
অবশ্য তখন তাঁর নাম হল বজ্রতারা [ চিত্র ১২ ] ও জাঙ্গুলীতারা [ চিত্র ১৩ ]
[ চিত্র ১৩ ]
এছাড়াও ছিলেন সরস্বতীর আদলে কল্পিত বিদ্যার অধিষ্ঠাতা মঞ্জুশ্রী [ চিত্র ১৪ ]
[ চিত্র ১৪ ]


প্রবন্ধটির একেবারে অন্তিম লগ্নে এসে কয়েকটি কথা মনে হয় । কেন এই প্রবন্ধটি আলোচনা করা হল বিস্তৃতভাবে ? শুধু কী জ্ঞ্যানের দেবীর মাহাত্য তথা লাঞ্ছনার কথা পাঠক মহলকে জানানোর জন্য ? উত্তরে বলি , আমরা জ্ঞ্যান কেবলমাত্র অজ্ঞ্যান থেকেই নিয়ে থাকি ।  অনেক সময় বছরের পর বছর না জেনেই , না বুঝেই শুধুমাত্র বলা বা করার জন্য করে থাকি , এই আলেখ্যটি সেই না জানা বিষয়টিকে যুক্তির দ্বারা কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা হল । যাতে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে জেনে উত্তর দিতে পারি । জানা ও শেখার নিরিখে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যেতে পারি । দ্বিতীয়ত , নারী কেবলমাত্র ভোগ্য নয় , তাদের হাতেই জগত ও প্রকৃতির বিকাশ । পুরুষ ও স্ত্রী কেবল লিঙ্গের নামান্তর নয় , এ দুই সত্ত্বার সুস্থ মিশ্রণেই সমাজ পথ মসৃণ হয় ।।

পবিত্র চক্রবর্তী

এস -৩৪ , শ্রমিক মঙ্গল কো- অপ
সেক্টর -২এ, বিধান নগর ,
জেলা – বর্ধমান
দুর্গাপুর -৭১৩২১২ ,
পশ্চিম বঙ্গ, ভারতবর্ষ
দূরভাষ - +৯১ ৮৯৭২৬৬০৮০৫

1 comment:

  1. it's really helpful to know the truth of the devi saraswati

    ReplyDelete