এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

শ্যামাপদ মালাকার


কবিতা : সাধারণ বিভাগ



আমি সেই পাখিটা

আমি সেই পাখিটা, যার
ডানার শব্দে রাতের গা' মেপে বেড়াও দেখি!।

আরো দেখি,-দীপের সলতেপোড়া গন্ধ তার হিসেবি আঙ্গুলে নরম হৃতপিণ্ড চটকায়- -
ধীরে ধীরে জমাটি লোভের থাবা- দমবন্ধ দেহের স্বাদ কুড়িয়ে যায়- -

শিউরে উঠে কে! বাঁচার শেষ আর্তনাদে ক্রুদ্ধ অন্তর- টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে মা'য়ের বুক!
ডুকরে উঠে জননী- আপনার দুগ্ধহীনাছাতি বাকি রাতের কালোয় দেখে!।

--ইচ্ছে করে,-বাবুদের সংসার-সোপানের ফুলদানিটা ছুঁড়ে খুন করে ফেলি ধর্মটা।

পারিনা। শুধু ডানার ঝাঁপটে চুরমার করে দিই  বেণুবনে শালিখের ঝাঁক!

আমি প্রহরঘোষক নই,-
ঝাঁপটা দিলে মর্মজ্বাল অনেক লাঘব করে!।




শোধ

ক'দিন যে মাথায় তেল পড়েনি- সে খবর আর রাখনি
আজ কিছুদিন হল, টের পেয়েছি-
আমার প্রতি অযত্ন করছো।

রাতের তৃতীয় প্রহরের দিকে-
মন ও কালের সংঘর্ষে, বুকের ভেতরের কিছু অংশ ঝলসে দিয়ে যায়- -
উঠোনের আমলকী ডাল হতে নিশিযাপনকারী বিহগের দল উড়ে যায়,-
পিঁজরদেশ হতে চাঁঙড় খসে পড়ার শব্দে!

মরণের গতি গুরুপাকে মজেছে প্রিয়- শোধ নেবে বলে
--ভেঙ্গেপড়া বুকের সব ক'টি টুকরো তুলে দিয়ে যাবে-- যে হতভাগী পেয়ে, "অভাগীকে" ত্যাগ করিলে!!।




বাংলার মাঝি

চল্ ওরে মাঝি নগরে মোরাজি
জীর্ণপল্লী ভুলিয়া-
রয় যদি ভূমি বেচে তাড়াতাড়ি
এক্ষীণ কর্ম ত্যজিয়া।

মৃদু কহে মাঝি- পল্লীজননী
পল্লীর বেণী বাঁধিয়া-
দুঃখযামিনীর হয়ে প্রহরিণী
রয় সে' অন্ন বাড়িয়া।

গুরু নয় কাজ পরিয়া সুসাজ
গোয়ালেতে গাভী রুধিয়া-
দহনের শেষে শিবাজীর বেশে-
য'কড়ি নিবি গুনিয়া।

পারিবোনা বাবু ঢাল যত মধু
মা'য়ের জ্যোতি ভুলিতে-
খরা দিবসেও ভরায় তরণী
পল্লীর নবগীতিতে!

কতবার তারে দেখিছি সু-দূরে
ঘুঁটে কড়োনীর বেশে-
আবার কখন জেলেনীর রুপে
ক্ষয়া-তটিনীর কূলে!

কত ধেণুমাঝে পাহড়ি অঙ্গে
রাখালের বাঁশী শুনেছি-
রাখালী-লাজুক বাঁকা অঞ্জনে
সবুজ বাংলা দেখেছি!

যেদিন এতরী বেয়ে যাব আমি
সরিতের শিরদেশে-
আরেক তরণী রহিবে সাহেব
পল্লী-মায়ের খুটে

সেদিন চাহিয়া দেখিবে সাহেব
ভাঙ্গা তরণীর পাশে-
আমায় ঘিরিয়া করিয়াছে ভীড়
পল্লীর বড় ঘাটে!!।



অধিকার

বহুকাল চর্চিত বহুমুখ নিঃসৃত-
'কলঙ্কিনী' শব্দটি শুনতে আর ভাল লাগেনা- তাই নিশি রেখে ওপারগাঁঙে দিলাম ঝাঁপ!

মনে হয়,--কত যুগ পরে কূল তোমার ছুঁল আমার তরী।

ওপারে যে গড়লো জীবন-- এপারে কি দারুণ গাঁথলো মরণ! কি জানি,-যার নিয়ম "সেই " জানে।

অধিকার কি ভাবছো, সে তো উপার্জন করে নিতে হয়!--একবার ছুঁয়ে দেখো! অনেকের কলঙ্ক তো রয়, আমাদের রউক অল্প।
শুধু একবার স্পর্শ করে দেখো!।। -




প্রবন্ধ


বিড়ি

সকালে ঘুম হতে জেগে প্রথমেই বিড়ি ধরাতাম।
টানতে টানতে মনে পড়ে যেত,-বাইরে না বেরো পর্যন্ত আর পাওয়া যাবে না, তাই- হাফ্ খেয়ে হাফ্ নিভিয়ে রাখতাম, কারণ --ব্রাস করার পরে আবার ধরাতে হবে বলে।

বাড়িতে অধিকাংশ দিনেই ব্ল্যক-টি হতো।
সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে বলে,--চা কাপটি তুলে নিয়ে নিজের বেডরুমে এসে জানালাদিয়ে ফেলেদিতাম কারণ,-চায়ে আমার ভক্তি নেই।
বেডরুমের তলাটা নুই-য়ে দেখতাম-- গতরাতে কোনো বিড়ি খেতে খেতে ভুল করে হাফ্ ফেলেদিয়েছি কিনা, কোনো দিন পেতাম- কোনো দিন পেতাম না।

বাড়িতে সর্বদা ছম্-ছম্ একটা ভাব, আমাকে নিয়েই যত আপত্তি। আর আপত্তি হবেই বা না কেন,-আমি তো "উদম খুড়ে ভূতম্ শেওড়া" প্রথমত,-বাংলা নিয়ে পড়বো বলায় কম ঝামেলা হয়নি। বাবার ইচ্ছে ছিল,-ভাল কিছু একটা নিয়ে পড়াশুনা করে,-সংসারে যেন একটু সাহায্য করি। বাবার সীমিত আয়ে ঘর যেন আর চলে না, আগে --দীনা, হীনা, ক্ষীণা, পিনা, অনেক বন্ধুই বলেছিল,-অামি যেন বাংলা নিয়ে না পড়ি।

আমিও জানতাম- বাংলায় ঘড়ার ডিম হবে।
কিন্তু উপায় তো নেই, ক্লাস ফোর থেকে বিড়ি ধরেছি। আমাদের প্রাইমারি স্কুল, খাস্ চাষীর ক্ষেতের মাঝে অবস্হিত। টিফিনে যতটুকু সময় পেতাম সবটাই কাজে লাগিয়ে দিতাম।
মনে পড়ে,-আমনের তখনও ধানের ভিতরে চাল গতেনি, সাদা দুধেভরা সবুজ শীষ ক্যারিব্যগে নুচে গ্রামের পিছনে পিছনে প্রায় চারশো মিটার হেঁটে শেষ মাথায়-- মধু কুমারের দোকানে উঠতাম।
আগামী কাল আবার ধান এনে দেবো বলে,-রাতের বিড়িটাও এডভান্স নিয়ে নিতাম।
সেই সুযোগে মধুদোকানিও অঙ্কেভরা মগজে তার মুনাফা তুলে নিত।

ফেরার একি পথ। কোনো কোনো দিন, চট্-বই স্কুলেই রয়ে যেতো।
মাস্টার মশাইরাও আমাকে কনসিডার করত,-স্কুল ছুটিদিয়ে চাবি দেওয়ার সময় চট-বই দেখে বুঝতে পারতেন,--আমি বিড়ির সন্ধানে মধুর দোকানে।

যাই হোক, বাংলায় অনেকের অমত থাকলেও আমি জানতাম, বাংলা বুঝতে না পারলেও- রিডিং পড়তে তো পারবো।
শেষমেশ-- বিড়ি-গাঁজার ধোঁয়ায় কেঁদে-হেঁছে বাংলা অনার্সের সঙ্গে বিড়ির অনার্সটাও কমপ্লিট করেছিলাম।

মনে মনে কি শান্তি, কি তৃপ্তি! যাক্, বাড়ির লোকের হাত হতে এক রকমের মুক্তি।
মাঠে-গোঠে একা থাকলে মনে মনে নিজেই গর্ববোধ কারতাম,-"আমি বাংলা অনার্স!"।

মা, বাবার সীমাহীন একটা অাশাছিল,--আমার কিছু একটা হবেই!-- কিন্তু আমি তো জানি-
আমি যতই বিড়ি টানিনা কেন, ধোঁয়োছাড়ার ফাঁকে ফাঁকে টের পেতাম, এদেশে কিছুই হবে না।
এই ভেবে এখন আর অতটা গর্ব করিনা, তার একটা কারণ আছে-- আমার বিড়ি খাওয়া নিয়ে বাড়িতে কম যুদ্ধ হয়নি।

আমার যে একটা দাদা আছে, সে মেয়েদের সাথে ধাপ্পাবাজি খেলে, শুধু তাই নই- সে আরো অনেক মন্দকর্মে যুক্ত।
আমি প্রতিবাদ করলে,-সবাই আমাকে মাতাল বলে।
আর বলবেই বা না কেন,-হাজারবার মা'য়ের পায়ে হাত রেখে প্রতিশ্রুতি করার পরেও--কারু কাছ হতে এঁঠো বিড়ি বা সিগারেট খাওয় ছাড়তে পারলাম না।
শুধু কি তাই!--বাবার হাতে আগে অনেক মারও খেয়েছি, কারণ,-বাবা বিড়ি খেতে খেতে কাজের ভীড়ে নামিয়ে রাখা,-- পোড়া-বিড়িটাও আমি চুরি করে খেয়েছি।

দাদার অপমান, মা বাবার নিকটে অবহেলা, আর বেকারত্বের নির্যাতন আজ আমাকে একেবারে একা করে দিয়েছে।
বেকারত্বের যন্ত্রণা যে কি! সেই বোঝে,--যার পোকেটে বিড়ি পড়ে না থাকে- - হতভাগা দেশের চেয়ে আধপোড়া বিড়িটাই ভাল,-- আবার বাঁচার প্রেরণা যোগায়!।

আমার মামাবাড়ি শালকাপে।
ছোটোমামার ছোটোছেলে,-অচিন্ত, ওদের গ্রামে বছরের অন্নপূর্ণাপূজোয় প্রতিবারেই হাঁক দেয়। শুধু হাঁক দেয় বললে মিথ্যে বলা হবে,--সময়ে অসময়ে ফাঁক পেলেই পোকেটে দশ-বিশটাকা গুঁজে দেয়।
কিন্তু সে বারে আমায় কালে টানল।

রিতিমতো পৌছিলাম। পূজোর সন্ধ্যেবেলায় রাস্তার ধারে অচিন্ত, আর এক দূর সম্পর্কীয় জয়ন্ত মামার সাথে জাস্ট সিগারেটটা টানতে যাবো,--সহসা তোমার সঙ্গে দেখা!।
হঠাৎ ধরানো সিগারেটটা ফেলে দিলাম!
তুমি কয়েকটা মেয়ের সঙ্গে আমার পাশ দিয়ে চলে গেল।
কিছু সময়ের জন্য আমি অসাড় হয়ে গিয়েছিলাম, মনে হাজার প্রশ্ন,-- কে তুমি! তোমাকে দেখে কেনই বা ধরানো সিগারেটটা ফেলে দিলাম!? আমার আগাগোড়া বেপরোয়া জীবনটা যেন কে মুহূর্তে শাসন করে দিল!--
এই সব ভাবতে ভাবতে তিনদিন তিনরাত কতো যে বিড়ি,---তর্জ্জনী - মধ্যমা ও বৃদ্ধানুষ্ঠের সহযোগিতায় দুমড়ে মুচড়ে কেন যে ভেঙ্গে ফেলে দিয়েছিলাম, তার হিসেব আমি আজও মেলাতে পারিনি!।

আর মাত্র একটা রাত।
এর মধ্যেই বোঝা-পড়া সেরে নিতে হবে-- যাই হোক ভাল-মন্দ একটা রেজাল্ট হাতে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে।
সময় আর সুযোগ পেয়ে দুম করে ভাল লাগার কথাটা বলে ফেললাম!
তার পরিপ্রেক্ষিতে তুমি বললে,--"আমার জন্যে কি করতে পারবে!"?
ভাবনা চিন্তা না করে বলে ফেললাম,-আমার আপন বলতে কেউ নেই, সম্পূর্ণ বেকার, তবে তোমার জন্যে বিড়ি খাওয়াটা  আমি একেবারে ত্যাগ করে দেবো।
এই কথা শুনে তুমি, ব্যঙ্গবিদ্রুপমিশ্রিত ঠোঁটের কোনে মৃদু হেসে,--শিকারী যেমন শিকারকে জখম করে আড়নয়নে চায়,-তুমি ঠিক সেভাবেই চেয়ে বললে,-" বা - বা,-পৃথিবীর কিছু আশ্চর্য্য জিনিসের মাঝে- তোমার এই বিড়ি ত্যাগের কারণটাও জায়গা করে নেবে!"।

বিশ্বাস করো বা না করো, আমার সেদিন কোনো কষ্ট হয়নি, কারণ,-আমি সেদিন সত্য কথা বলেছিলাম।

এখন ভাবি,- আর পাঁচটা লোফারের মতো সেদিন যদি বলতাম,-তোমার জন্যে আকাশের চাঁদটা পেড়ে এনে দেবো,-- যেটা কেউ কারু জন্যে এনে দিতে পারেনি,- -
আরো যদি বলতাম,-পৃথিবীর সব সুখ এনে তোমার পায়ে ঢেলে দেবো,- - যা কেউ কোনদিন কারু জন্যে এনেদিতে  পারেনি!

একদিকে বেকারত্বের নির্যাতন,- আর একদিকে তোমায় না ভুলতে পারার যন্ত্রণা, যখন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, তখন মনে হয়,--মন্দিরের মধ্যে বিগ্রহটা খুন করে পৃথিবীর সকল ধর্মগ্রন্হগুলো পুড়িয়ে ফেলি!

মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে সহজে আর ঘুম ধরে না।
বাবার দেহ ক্রমশই ক্ষীণ  হতে ক্ষীণতর হচ্ছে, মায়ের কণ্ঠে আগের মতো সে রকম আর জোর নেই, বোঝা যায়,-দারিদ্র তার ভৌগোলিক সীমারেখা ক্রমাগত বৃদ্ধি করে চলেছে!
"ওরা" এখন আর আমায় বকে না, ওরা হয়তো জেনে গেছে,--আমি  আর বিড়ি খাই না--আমার মধ্যে আত্মসম্মানবোধ জেগে উঠেছে।

এখন শুধু মনে হয়,-- শরৎচন্দ্রের "মহেষ" গল্পের শেষ ক'য়েকটা লাইন!--
গফুর জোলার মতো-- কোনো এক রাতের অন্ধকারে মা ও বাবাকে সঙ্গে নিয়ে-- কোনো এক  দেশে ----পালিয়ে যায়!।।
-----------------সমাপ্ত।।




গল্প


অরণ্যস্বাদ

শ্যামাপদ মালাকার
আজ আমি এমনই এক হতভাগী দিদির কথা বলতে চলছি,--যা সহজে বিশ্বাস করার কথা নয়।
সময়টা ছিল- ২০০১সালের ১২ জানুয়ারী- সেই দিদি ব্যাক্তিগতভাবে আমাকে একটি পত্র লিখে গেছেন।
উনার সঙ্গে কি ভাবে আমার সাক্ষ্যত বা উনার আশ্রয়স্হলই বা কোথায়, এই পরিচয় দিতে আজ আমার কোনো লজ্জা বা সংকোচ নেই। তবে উনার পরিচয় দেওয়ার আগে,--আমার দু'একটা কথা বলা আবশ্যক।

কিছুদিন আগে বাঁকুড়া জেলার ঝিলিমিলির প্রাকৃতিক-বন্যরুপদর্শনের সুযোগটি আমার নিকটে এসে পড়ে। আমিও  বিলম্ব না করে সুযোগটি গ্রহণ করি, সঙ্গে কলম ও ডাইরীটা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম--সেই অজানা অপরিচিত ঝিলিমিলি বনঞ্চালের রুপ-রস উপভোগের উদ্দেশ্য।

আমার যাওয়ার একটাই কারণ ছিল,- স্হানে স্হানে অরণ্যবেষ্টিত বাবুই বা বিচুলিনির্মিত ছোটো ছোটো পিছিয়ে পড়া বস্তি, আমাকে আজও আকৃষ্ট করে।

একশো দশ কি,মি রাস্তা অতিক্রম করে, এক সময় সকলকে বাস থেকে নেমে পড়তে হল।
জঙ্গলমধ্যস্ত কিছু বস্তির সমন্বয়ে নিত্য কেনাকাটার যে বাজারটি গড়ে উঠেছে-
এটা যে ঝিলিমিলি তা জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন হল না, কারণ,-রাওতড়া নিবাসী জগন্নাথবাবু, তিনি আগে থেকেই ওখানে আমাদেরকে তদারকি করার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন।

ঝিলিমিলি হাইস্কুল সংলগ্ন শচীমাইতির মুর্ত্তির নিকটস্হ কোনো এক জায়গায় আমাদের থাকার বন্দোবস্ত পূর্ব হতেই প্রস্তুত ছিল।

প্রাকৃতিক মাধুর্য উপভোগ করা আমার নিকটে বড় কথা নয়, আমার ইচ্ছে- যতটুকু সময় ব্যয় করব, বস্তির পরিবারস্হ প্রতিটি মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে- ওদের এক অজানা মনের আদিম রসটি আস্বাদন করা।
আমি চিরকালই একটু ডাঁহারপিণ্ডে ধরণের, যাকে সরলভাবে বলা হয়-'কুলাঙ্গার'।
জীবনে অধিকাংশ সময়েই একা একা কাটিয়েছি, এমন কি বাড়িতেও তাই। আসলে একা থাকার বেশ একটা মজা আছে,--ইচ্ছেমতো ভাবার অবকাশ পাওয়া যায়। এই কারণে দ্বিতীয় দিনে ভাবলাম,--আজ একাই বেরিয়ে পড়ব, কিন্তু এই সিদ্ধান্ত ফাঁস হয়ে যেতেই- বন্ধুরা চেপে ধরল, বলল,-"অসম্ভব! তুই বাড়িতে গিয়ে যা পারিস করবি, এখানে নয়।"
ভেবে চিন্তে দেখলাম, উপায় নেই- - -। আবার নদী- পাহাড়- অরণ্যের স্বাদ আস্বাদনে বেরিয়ে পড়লাম।

এক সময় আলাপে বিলাপে যেতে যেতে একেবারে বস্তির শেষ প্রান্তে পৌছিলাম।
এমন সময় একব্যক্তি, একটি বাড়ির দিকে আঙ্গুলী নির্দেশ করে বলে উঠলেন,--"বাবু! ঐ যে দূরে আমলকীর ছায়ে যে মাটির বাড়িটি দেখা যাচ্ছে, ঐ বাড়িতে সবার যাওয়া মানা।"
এখানেই আমি একটু বেঁকে বসলাম। কারণ,-যে উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে আমি এসেছি, তার পরিতৃপ্তি ঘটানোর জন্য এখনও তেমন কিছু পাইনি!
খুব আনন্দ হল,- মনে মনে ভাবলাম, --যাক,  এবার হয়তো পেয়েছি।

কিন্তু বন্ধুরা যেন থমকে দাঁড়াল!
একে অপরের মুখে চাওয়া-চাওয়ির পর,-- অতি সন্তর্পণে একজন বলে উঠল,--"ফিরে চল্!"
আমি বললাম,-অসম্ভব! আজই শেষ দিন, তাছাড়া এতদূর যখন এসেছি, রহস্য উন্মোচন করেই ফিরব,-না হয় মরব!--শেষ পর্যন্ত কুলাঙ্গারের জয় হল।

তখন প্রায় সূর্য লাল আসন টানি পশ্চিমদিগন্তে সবেমাত্র বসার উদ্যোগ করছে, গর্বের লেশমাত্র নেই- ঘণ্টা দুই'য়ের মধ্যে যে কোনো মুহূর্তে অন্ধকার নেমে আসতে পারে! এই ভাবনা করেই হয়তো সঙ্গীরা আপন ডেরার অভিমুখে হাঁটতে শুরু করেছে।
এখন আমি একা! সম্পূর্ণ একা। ভিতরে স্নায়ুযুদ্ধ চলছে অবিশ্রান্ত,- রহস্যের দ্বারোদ্ঘাটন করব- না হয় মরব! কেন ঐ বাড়িতে সবার যেতে মানা?-- আমি ঈশ্বরের অবাধ্য, এমন কি জন্মদাত্রী মা'য়েরও অবাধ্য।

ঐ ব্যক্তির নিশেধ অগ্রাহ্য করে--ঐ বাড়িতে যে আমাকে যেতে হবে,- তা একপ্রকার নিশ্চিৎ করে ফেললাম।
দিনমণি সম্পূর্ণ অরণ্যের আড়ালে,--পার্শ্বস্হ পরিস্হিতি গুমোট-রুদ্ধশ্বাস! দূর-পাহাড়ের কোল হতে নাম না জানা পাখির ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর জানন দিচ্ছে,-- সাবধান! জন্ত-জানোয়ারের চরিত্র যে  বদলায় না, এবিষয়ে আমি নিশ্চিৎ, অনিশ্চৎ শুধু মানুষের ক্ষেত্রে।

সরাসরি বাড়ির উঠোনে গিয়ে উঠলাম। দেখি,-ধ্বসে যাওয়া বিচুলির দাওয়ায় এক ষাটোর্দ্ধা বৃদ্ধা- আঁঙিনা হতে বেরিয়ে যাওয়া ম্রিয়মান পথটির পানে চেয়ে শুয়ে আছে! এক বিস্ময় ধূসর অপাঙ্গে চেয়ে, গৃহস্হকে সাবধান করে যেন বলে উঠলেন,--"আবার এসেছে ক্ষুধার্ত শেয়ালের দল!--অঞ্জলী, তুই এখনও গলায় দড়ি নিসনি!-- এবার আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,--"মেয়েটার গা'য়ে যে এখনও রক্ত পড়ছে-- তোরা কি বাঁচতে দিবিনি!।"
আমি যেমন হতবাক, তেমনেই বিস্মৃত! কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম---মাসিমা, আমি একটু জল চাই ছিলাম,--- কিছু সময় পরে --আমার এই- জল চাওয়ার মধ্যে কিছু সত্যতা রয়েছে এই বোধ করে-- গৃহমধ্যস্হ আর একটি মানুষ হয়তো বা টের পেলেন আশা করি।

বাড়ির ভেতর হতে একটি মেয়ে ঘোমটা নেওয়া কোনো বধূর মতো-- জলগ্লাসটি নিয়ে দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আমার সম্মুখে তুলে ধরলেন।

--বৈশাখীর দারুণ দাপটে ভেঙ্গে যাওয়া কোপোতীর বাঁসার মতো দেহখানা যেন একেবারে নিথর হয়ে গিয়েছে!

আমি আমার পরিচয় দিলাম।
হঠাৎ মে যেন অস্হির হয়ে উঠল!-আমি অবাক হয়ে গেলাম!--তাহলে সে কি আমায় চেনে?- সহসা, বাড়ির ভিতরে গিয়ে পুনরায়, সাদা খড়িজাতীয় কিছু একটা এনে-- মসৃণ দাওয়ার উপর যা লিখল, তা অবিশ্বাস্য! আমি যতটুকু পড়ে উদ্ধার করলাম তার অর্থ এই--"আমি যেন তার রিকিউয়েষ্ট গ্রহণ করি!"
এই লিখে- সে যে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলেন-- শতবার হাঁক দেওয়ার  পরেও-- আর বাইরে এলেন না।

আমার নিকটে সবকিছু যেন অসামঞ্জস্য ঠেকতে লাগল, তাই আর বিলম্ব না করে--সেদিনের মতো অরণ্যাস্বাদন সেখানেই সমাপ্ত করে, আপন ডেরার দিকে পা চালালাম।
যে উৎসাহ নিয়ে গিয়েছিলাম--তা কয়েক মুহূর্তে দুমড়ে মচড়ে নির্জন রহস্যময় প্রন্তরে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিল।

চট্-জলদি সফর সেরে, এবং -মনে হাজার অজানা শঙ্কা নিয়ে কোনো রকমে বাড়ি ফিরলাম।
দু'চার দিন বিশ্রাম নিয়ে যখন ফেসবুকটা খুললাম,- দেখি সেই মেয়ের একটি পত্র!
-----
দিদির পত্র।
---------------
ভাই, আমি তোমাকে এই পত্র কেন লেখলাম, বা আমার বন্ধুত্ব গ্রহণের কেনই বা অনুরোধ করে ছিলাম,--তার উত্তর দিতে বসেছি---

--"আমি নির্বাক! জন্মথেকে কোন অপরাধে ঈশ্বর আমার বাকশক্তি কেড়ে নিয়েছেন--তার উত্তর আজও আমি কারু কাছে পাই নি!
হ্যাঁ,-- যা বলতে চেয়েছি,-
তুমি জান,-সেদিন কার হাতে জল পান করেছ!? সহায়-সম্বলহীনা সর্বদিকবঞ্চিতা এক ধর্ষিতা নারীর হাতে!
জান ভাই!--ঐ বস্তির কয়েকটা পুরুষ, আমার নির্বাক কণ্ঠের সুযোগ নিয়ে- জীবনে স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার অধিকার টুকুও কেড়ে নিল!
যারা অপরাধ করল, সমাজ তাদের কোনো বিচার করল না--যে বাকহীন সহায়হীনা পাশবিক লালসার শিকার হল,-শুধু তার শিয়রে নেমে এল- হাজার বিচারের ধারালখাঁড়া!
জান ভাই-- তোমাকে জল দেওয়ার পরক্ষণেই নিরব সন্ধ্যারবুকে আমাকে নিয়ে সেদিন আর এক বিচারের সভা বসল।
স্হীর হল,-অবিবাহিতা ও ধর্ষিতা নারী সমাজে বা বস্তিতে থাকলে- প্রতিমুহূর্তে মর্য্যাদা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা! তাই-
-----আমি সেই রাতেই, সিদ্ধান্ত নিলাম- প্রভাত হওয়ার আগেই মা'কে সঙ্গে নিয়ে বস্তি ত্যাগ করলাম।
আমি অনেক দূরে চলে যাচ্ছি!

যেখানে অরণ্যবেষ্টিত পাহাড়ের চুড়ায় যেমন--লাবণ্যটুকু বিরাজ করে, তেমনি সেখানে- নির্বাক-ধর্ষিতা নারীর নিরব কান্নাটিও অরণ্যের বুকে ধ্বনিত হয়ে বেড়ায়!
-----
ভাই,--আর কতকাল আমরা ধর্ষিতা হয়ে আপনার জন্মভমি ত্যাগ করে বেড়াবো!??
------------------------ইতি
------------------------দিদি।।

স্মৃতির আকাশে সহস্র নক্ষত্রের ভীড়ে,- দিদি যেন সবার বড় একটি তারা! --যখনি সেই দিদির কথা মনে পড়ে, বারবার বলতে ইচ্ছে করে,--যাবার আগে এই হতভাগা ভাইটিকে একটি প্রণাম করার সুযোগও দিলে না!!

শ‍্যামাপদ মালাকার
পরিচিতি:-
পিন নাং:-৭২২১৭৩
ফোন নাং:-৯৬৩৫৬৩৭১৭১
গ্রাম:-চন্দনপুর
পোষ্ট:-জোড়দা
থানা:- ইন্দপুর।
জেলা:- বাঁকুড়া।

No comments:

Post a Comment