ছড়াক্কা-গাথা
‘টুনটুনি আর নাপিতের কথা’
(উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী)
টুনটুনিটার জাগল খেয়াল, অমনি নাচন জোড়া—
বেগুন গাছের পাতায় ব’সে
জুড়ল সে নাচ বেদম ক’ষে।
হঠাৎ বেগুন-কাঁটার খোঁচায়
চিকণ ব্যথায় টুনি চ্যাঁচায়!
তাই থেকে তার গায়ে হল মস্ত বড় ফোঁড়া।
কী জ্বালাতন! সারবে কীসে! টুনি তা ভাবতে থাকে
যাকেই সে পায়,তাকেই শুধায়,
সবাই বলে, আছে উপায়।
নাপিত ডাকো। হল কী শুনি?’
অমনি গিয়ে বলল টুনি,
নাপিতদাদা, দাও না কেটে আমার ফোঁড়াটাকে।’
ঘাড় বেঁকিয়ে নাক উঁচিয়ে বলল নাপিত, ‘ইস্!
আমি কামাই রাজার দাড়ি।
তুই এলি সেই আমার বাড়ি!
অবাক হচ্ছি সাহস দেখে,
যা ভাগ! আমার প্রাসাদ থেকে।’
ওমনি রেগে ঠুকল টুনি রাজার কাছে নালিশ।
‘রাজামশাই,রাজামশাই,আপনি দেশের রাজা।
ফুটেছে আমার গায়ে কাঁটা।
দেখুন প্রভু, নাপিতব্যাটা
করল না সে কাঁটাটি বার,
বলল—ওটা কাজ নয় তার।
আচ্ছা করে রাজামশাই দিন ব্যাটাকে সাজা।
’রাজা তখন রাজশয্যায় গড়াচ্ছিলেন সুখে।
শুনেই বোঝেন—এও বাহ্য।
করলেন না মোটেই গ্রাহ্য।
বলেন, ‘থামা ঝালাপালা।’
কিন্তু টুনির ফোঁড়ায় জ্বালা।
ইঁদুর ভায়ার কাছে গিয়ে বলে সে কাতর মুখে,
‘ইদুরভায়া! ইদুরভায়া! এলাম তোমার স্থান।
ইদুর বলল, ‘কে ভাই?
টুনটুনি? এস ভাই।
বস ভাই। খাট পেতে দি,
ভাত বেড়ে দি,খাবে ভাই?’
টুনি বলল,’আপ্যায়নে জুড়িয়ে গেল প্রাণ।
কিন্তু আমি এসেছি এক ছোট্ট আর্জি নিয়ে।
গিয়ে বললাম রাজার কাছে,
‘ নাপিতের নামে নালিশ আছে।
কিন্তু সেটা শুনেও রাজা
নাপিতটাকে দিল না সাজা।
রাজার ভুঁড়ি করতো ফুটো ধারালো দাঁত দিয়ে।’
ইদুর শুনেই জিভ কাটল, দু’কানে দিল হাত।
‘একী বললে টুনিভায়া!
নাই কি তোমার প্রাণে মায়া?
পারব না ভাই করতে ও কাজ,
আমায় তুমি মাপ কর আজ।
যে রাজার প্রজা আমি,তাঁর ভুঁড়িতেই দাঁত?’
টুনি গিয়ে বিড়ালকে কয়,’এলাম তোমার স্থান।
বিড়াল বলল, ‘কে ভাই?
টুনটুনি? এস ভাই।
বস ভাই। খাট পেতে দি,
ভাত বেড়ে দি,খাবে ভাই?’
টুনি বলল,’আপ্যায়নে জুড়িয়ে গেল প্রাণ।
কিন্তু তুমি বাড়াও যদি সাহায্যেরই হাত।
খুব বিপদে পড়েছি ভাই,
গিয়েছিলাম ইদুরের ঠাঁই।
দিল না সাড়া আমার ডাকে।
তুমি যদি ইদুরটাকে
মারো,তবেই তোমার বাড়ি খাব মাছ আর ভাত।’
টুনির কথা শুনে বিড়াল তোলে মস্ত হাই।
তারপরে কয়, ‘দূর!দূর!দূর!
আমার দ্বারা ইদুর-টিদুর
মারা হবে না। শোন টুনি,
জানি তুমি শিল্পী,গুণি।
কিন্তু আমার ঘুম পেয়েছে। যাই,ঘুমুতে যাই।’
এবার টুনি লাঠিকে বলে, ‘এলাম তোমার স্থান।’
লাঠি বলল, ‘কে ভাই?
টুনটুনি?এস ভাই।
বস ভাই। খাট পেতে দি
ভাত বেড়ে দি,খাবে ভাই?’
টুনি বলল,’আপ্যায়নে জুড়িয়ে গেল প্রাণ।
কিন্তু দাদা,দয়া করে এবার একটু জাগুন।
আমার কথা রাখেনি লাঠি,
সব অনুনয় হয়েছে মাটি।
আপনি দাদা,আগুন,
একটু কাজে লাগুন।
পুড়িয়ে দিন ওই লাঠিটাকে। ভাইয়ের জন্য রাগুন।’
বলল আগুন, ‘লাঠিটাকে আসকারা কেউ দিচ্ছে।
কিন্তু আজকে,
বলব কীরে,
অনেক কিছুই
পুড়িয়েছি রে।
নতুন কিছু তাই পোড়াতে করছে না আর ইচ্ছে।’
টুনি তখন সাগরকে কয়, ‘এলাম তোমার স্থান।’
সাগর বলল, ‘কে ভাই?
টুনটুনি? এস ভাই।
বস ভাই। খাট পেতে দি
ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’
টুনি বলল,’আপ্যায়নে জুড়িয়ে গেল প্রাণ।
কিন্তু আমার কী যে বিপদ,বোঝাই তা কী দিয়ে!
আগুনকে সব বলেছিলাম।
বলেছিলাম—তোমার তো নাম
আছে ভোজনরসিক বলে,
খানিক আদর করার ছলে--
একটি ঢেউয়ের ঝাপট মেরে দাও আগুন নিভিয়ে।’
সাগর বলে বুক ফুলিয়ে—‘দ্যাখ কেমন বিশাল।
জানিস না তুই কোন হালচাল।
দেখিস না তুই আয়নাতে মুখ,
বুঝিস না তোর কত ছোট বুক।
করিস এমন তাই ভুলচুক।
কোন্ হিসেবে আমাকে দিয়ে মেটাতে চাস ঝাল?’
হাতিকে তখন বলল টুনি, ‘এলাম তোমার স্থান।’
লাঠি বলল, ‘কে ভাই?
টুনটুনি? এস ভাই।
বস ভাই। খাট পেতে দি
ভাত বেড়ে দি,খাবে ভাই?
টুনি বলল,’আপ্যায়নে জুড়িয়ে গেল প্রাণ।
কিন্তু সাগর করল যা আজ,পাবেই উচিত ফল।
বলেছিলাম শুধু তাকে
নিভিয়ে দিতে আগুনটাকে
কিন্তু বলল—পারব না তা।
দেখব ধড়ে ক’টা মাথা।
তুমি হাতি এক চুমুকে খাও সাগরের জল।’
বলল হাতি, ‘তোমার কথায় বুদ্ধি গেল ঘেঁটে।
কী করে বললে এমন কথা?
বোলো না এমন যথা তথা।
আমার পেট আর সাগরের জল!
যার নেই কুল,যার নেই তল!
খাই-ই যদি সবটুকু জল, পেটটাই যাবে ফেটে!’
তখন টুনি মশাকে কয়, ‘এলাম তোমার স্থান।’
মশা বলল, ‘কে ভাই?
টুনটুনি? এস ভাই।
বস ভাই। খাট পেতে দি,
ভাত বেড়ে দি,খাবে ভাই?’
টুনি বলল,’আপ্যায়নে জুড়িয়ে গেল প্রাণ।
কিন্তু হাতি মারো না আগে। বলল মশা,’আছি আমরা।
ঘাবড়িও না। কোন ভয় নাই।’
ডাকলো মশা, ‘আয়তো রে ভাই।
সবাই মিলে হুল ফোটাব,
হাতির গায়ের রক্ত খাব।
চলতো সবাই দেখবো হাতির শক্ত কত চামড়া।’
অমনি শুরু পিন-পিন-পিন কান-ধাঁধানো আওয়াজ।
রাজ্যে যত ছিল মশা
করল হাতির করুণ দশা।
ফেলল ঢেকে আকাশটাকে,
কাঁপল সূর্য ঝড়ের ডাকে!
বলল হাতি, ‘বাঁচাও টুনি। করছি তোমার কাজ।
ভুল করেছি স্বভাবদোষে; আর না, তাড়াতাড়ি।
সাগরটাকে শুষতে যাই।’
সাগর বলে, ‘আগুন নেবাই।’
আগুন বলে, ‘লাঠি পোড়াই।’
লাঠি বলল, ‘বিড়াল ঠেঙাই’
বিড়াল বলল, ‘দাঁড়াও দাঁড়াও,এখুনি ইদুর মারি।’
দেখলো ইদুর—আসছে বিড়াল তার দিকেই তেড়ে।
বলল, ‘থামাও ঝগড়াঝাটি,
যাচ্ছি-- রাজার ভুঁড়ি কাটি।’
রাজা কয়,’কী বকিস যা তা,
কাটছি নাপিত ব্যাটার মাথা।’
নাপিত বলে, ‘টুনি এসো, ফোঁড়া দচ্ছি ফেড়ে।
সারলো ফোঁড়া। নাচল টুনি আনন্দে ধেই! ধেই!
লেজ নাড়িয়ে টুনি বলে,
‘সোজা পথে কাজ না হলে,
একলা কিম্বা সদলবলে
করতে হয় তা ছলে বলে।
যতক্ষণ কাজ হাসিল না হয়, হাল ছাড়তে নেই।’
টুনটুনি?এস ভাই।
বস ভাই। খাট পেতে দি
ভাত বেড়ে দি,খাবে ভাই?’
টুনি বলল,’আপ্যায়নে জুড়িয়ে গেল প্রাণ।
কিন্তু দাদা,দয়া করে এবার একটু জাগুন।
আমার কথা রাখেনি লাঠি,
সব অনুনয় হয়েছে মাটি।
আপনি দাদা,আগুন,
একটু কাজে লাগুন।
পুড়িয়ে দিন ওই লাঠিটাকে। ভাইয়ের জন্য রাগুন।’
বলল আগুন, ‘লাঠিটাকে আসকারা কেউ দিচ্ছে।
কিন্তু আজকে,
বলব কীরে,
অনেক কিছুই
পুড়িয়েছি রে।
নতুন কিছু তাই পোড়াতে করছে না আর ইচ্ছে।’
টুনি তখন সাগরকে কয়, ‘এলাম তোমার স্থান।’
সাগর বলল, ‘কে ভাই?
টুনটুনি? এস ভাই।
বস ভাই। খাট পেতে দি
ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’
টুনি বলল,’আপ্যায়নে জুড়িয়ে গেল প্রাণ।
কিন্তু আমার কী যে বিপদ,বোঝাই তা কী দিয়ে!
আগুনকে সব বলেছিলাম।
বলেছিলাম—তোমার তো নাম
আছে ভোজনরসিক বলে,
খানিক আদর করার ছলে--
একটি ঢেউয়ের ঝাপট মেরে দাও আগুন নিভিয়ে।’
সাগর বলে বুক ফুলিয়ে—‘দ্যাখ কেমন বিশাল।
জানিস না তুই কোন হালচাল।
দেখিস না তুই আয়নাতে মুখ,
বুঝিস না তোর কত ছোট বুক।
করিস এমন তাই ভুলচুক।
কোন্ হিসেবে আমাকে দিয়ে মেটাতে চাস ঝাল?’
হাতিকে তখন বলল টুনি, ‘এলাম তোমার স্থান।’
লাঠি বলল, ‘কে ভাই?
টুনটুনি? এস ভাই।
বস ভাই। খাট পেতে দি
ভাত বেড়ে দি,খাবে ভাই?
টুনি বলল,’আপ্যায়নে জুড়িয়ে গেল প্রাণ।
কিন্তু সাগর করল যা আজ,পাবেই উচিত ফল।
বলেছিলাম শুধু তাকে
নিভিয়ে দিতে আগুনটাকে
কিন্তু বলল—পারব না তা।
দেখব ধড়ে ক’টা মাথা।
তুমি হাতি এক চুমুকে খাও সাগরের জল।’
বলল হাতি, ‘তোমার কথায় বুদ্ধি গেল ঘেঁটে।
কী করে বললে এমন কথা?
বোলো না এমন যথা তথা।
আমার পেট আর সাগরের জল!
যার নেই কুল,যার নেই তল!
খাই-ই যদি সবটুকু জল, পেটটাই যাবে ফেটে!’
তখন টুনি মশাকে কয়, ‘এলাম তোমার স্থান।’
মশা বলল, ‘কে ভাই?
টুনটুনি? এস ভাই।
বস ভাই। খাট পেতে দি,
ভাত বেড়ে দি,খাবে ভাই?’
টুনি বলল,’আপ্যায়নে জুড়িয়ে গেল প্রাণ।
কিন্তু হাতি মারো না আগে। বলল মশা,’আছি আমরা।
ঘাবড়িও না। কোন ভয় নাই।’
ডাকলো মশা, ‘আয়তো রে ভাই।
সবাই মিলে হুল ফোটাব,
হাতির গায়ের রক্ত খাব।
চলতো সবাই দেখবো হাতির শক্ত কত চামড়া।’
অমনি শুরু পিন-পিন-পিন কান-ধাঁধানো আওয়াজ।
রাজ্যে যত ছিল মশা
করল হাতির করুণ দশা।
ফেলল ঢেকে আকাশটাকে,
কাঁপল সূর্য ঝড়ের ডাকে!
বলল হাতি, ‘বাঁচাও টুনি। করছি তোমার কাজ।
ভুল করেছি স্বভাবদোষে; আর না, তাড়াতাড়ি।
সাগরটাকে শুষতে যাই।’
সাগর বলে, ‘আগুন নেবাই।’
আগুন বলে, ‘লাঠি পোড়াই।’
লাঠি বলল, ‘বিড়াল ঠেঙাই’
বিড়াল বলল, ‘দাঁড়াও দাঁড়াও,এখুনি ইদুর মারি।’
দেখলো ইদুর—আসছে বিড়াল তার দিকেই তেড়ে।
বলল, ‘থামাও ঝগড়াঝাটি,
যাচ্ছি-- রাজার ভুঁড়ি কাটি।’
রাজা কয়,’কী বকিস যা তা,
কাটছি নাপিত ব্যাটার মাথা।’
নাপিত বলে, ‘টুনি এসো, ফোঁড়া দচ্ছি ফেড়ে।
সারলো ফোঁড়া। নাচল টুনি আনন্দে ধেই! ধেই!
লেজ নাড়িয়ে টুনি বলে,
‘সোজা পথে কাজ না হলে,
একলা কিম্বা সদলবলে
করতে হয় তা ছলে বলে।
যতক্ষণ কাজ হাসিল না হয়, হাল ছাড়তে নেই।’
সতীশ বিশ্বাস
|
এক টুকু বাসা
৬/৫ ডিরোজিও পথ
দুর্গাপুর-৭১৩২১৬
No comments:
Post a Comment