এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

অতনু গঙ্গোপাধ্যায়



ছোট গল্প



এবং বিবর

                        পর্দাটা একটু সরিয়ে দিল নীল। মাথার কাছে পুবমুখো জানলাটা। একফালি রোদ এসে পড়ছে নিতার পিঠে। হলুদ হয়ে যাওয়া পিঠের দিকে মনে হল সরষে ক্ষেত। ও উল্টে দিইয়ে কাছে টেনে আনল নীতাকে। টিকালো নাকের ছোট্ট হীরের নাকছাবিটা ঝিকমিক করে উঠল। চোখ বুজেই নীতা বলে উঠল- উওম্ম, কাছে এসো না। নীল ঠোঁটে ঠোট ডুবিয়ে দেওয়ার আগেই আড়চোখে মোবাইলে টাইম দেখে নিল যে চেক আউটের এখনো তিনঘন্টা বাকি আছে ।
                              
-২-
অফিসে নিজের ঘরে বসে নীতা গত উইক এন্ডের আউটিং-এর আপলোড করা ছবি দেখছিল। সরষে ক্ষেতে সবুজ নীতা,নদীর জেটিতে বসে লাল কুর্তিতে নীতা- প্রায় দুই জিবি মেমোরি ভরপুর নীতা। নানা ভংগিমায়। একটি ছবিকে আলতো আদর করে বল্ল – তুই হবি আমার ফেসবুকের কভার। একটি আদুরে মুখের ছবিকে ঠোনা দিয়ে বল্ল- তুই হবে আমার হোয়াটসএপের ডিপি। নীল যে ছবিগুলিকে এক্সক্লুসিভ পাঠিয়েছে। এই সপ্তাহ জুড়ে হবে স্ট্যাটাস। স্ট্যাটাসের ভারি মজা। চব্বিশ ঘন্টা পরমায়ু। নীল ছবিগুলিকে দেখবে আর হোটেলের আদর সময়কে কল্পনা করবে। কত ভালবাসার গল্প শোনাবে হোয়াটসএপ জুড়ে। নীতা ঘড়ি দেখে বুঝল –এখন নীলের লাঞ্চ টাইম। ও একটা মেসেজ রাখল – lonely feeling honey। নীলের উত্তরবাক্সে লেখা ফুটে উঠলো – Typing…. । নীতা বেরিয়ে এসে আবার ওর ছবি দেখে যাচ্ছে। তখন শাড়ি পড়ে বেরিয়েছিল। বিকালের জেটিপারে লোক নেই। নদীর ধারে অশত্থের গাছের তলায় চায়ের দোকান। নীল ডাকল – চা খাবে ? নীতার আকাশি শাড়ির আঁচল উড়ছিল দামাল হাওয়ায়। অনেকটা দূরে চলে গেছিল ওখান থেকেই চিৎকার করে বল্ল –চলো নদী ডাকছে যদি সূর্য্যাস্ত হয়ে যায়। আগে হেটে আসি। নদীর জলে পা ভিজিয়ে শাড়ীটা গাছকোমর করে বেঁধে ছবি তোলা। একফালি কোঁকড়া চুল ঢেকেছে মুখের একপাশ। নাকছাবিটী উজ্জ্বল দিনশেষের গোধূলি আলোতে। ওরা যখন নদীর পাড় থেকে হোটেলে ফিরছিল অশ্বত্থ গাছটার তলায় ঝুপসি অন্ধকার।
নীতা মেসেজ বক্স খুলে দেখে নীল একটা বড়সড় লাল টুকটুকে হার্টের ছবি পাঠিয়েছে। তার তলায় ফুটনোট – still hang over, baby। একচিলতে হাসি ফুটে উঠল নীতার মুখে। তখনই জিএমের ঘরে কল- আসুন একটু।
-৩ -
সৌর ঘুম থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠল। এল্যার্ম সকালে বাজার পরও একটু ঘুমাতে গিয়ে বিপত্তি। এই দায়িত্ব পলাতক ঘুমটা অনেকটা আসলের উপর সুদের বিলাসিতার মত। এপার্টমেন্টের পরদা সরাতেই ঘর আলোয় ভরে গেল। এখন বেলা বারোটা। তার মানে মা-বাবার এখন মধ্যরাত। নীতাকে ফোনে ধরল – ঘুমিয়ে পড়েছো নাকি? না তো, তোমার ফোনের অপেক্ষা করছিলাম। কাল রাতে এত দেরিতে এসেছ। মা-বাবা কি ঘুমাচ্ছে? তুমি কাল কি পার্টিতে গেছিলে? আরে না না, অনেক কাজ ছিল। আমাদের সেক্টরে কি পার্টি চলে? চলমান পার্টি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে পার্টি হয়ে যায়। আজ যাব একটা প্রোজেক্ট দেখতে। তার রিপোর্ট পাঠাতে হবে। কাল আবার ম্যানহাটান। তুমি কি শুয়ে পড়েছ? নীতা একটা থ্রিলার পড়ছিল। এক টানটান মুহূর্তে গল্পটা। ও সৌরকে বলে দিল – যাক, বউয়ের খেয়াল রাখছ। আমি মাঝরাতে আবার কোথায় যাব? জানালার ধারে এসে সৌর কথা বলছিল। রাস্তার ওপারে ডিপার্ট্মেন্টাল স্টোরের
বাইরে সোনালি চুলের একটি মেয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে । ওর হটপ্যান্টের বাইরে রোদে ঝলসানো ক্রাশড উরু দেখতে দেখতে নীতাকে বল্ল- I will be the top, top and top। তুমি তো জানো, আমার কাজটা কেমন ? একটা বছরের মধ্যেই ত দেশে ফিরব। দোন্ট ওরি, বেবী। তুমি আমার একমাত্র সুইটহার্ট। মোবাইল সংযোগটা যে কিছু আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে ও নামিয়ে রাখার আগে বুঝল। যাই হোক সৌরের হাতে সময় নেই। কোম্পানীর গাড়ি এখুনি চলে আসবে। ওর একটু  ভালভাবে গোসল করা দরকার। কাল রাতে মার্গারিটার ফ্ল্যাটে ডোজটা একটু বেশিই হয়ে গেছে । মাথার ভারটা কাটানো দরকার বরং বাথটাবে শুয়ে ব্যালান্স শিটটা মেলানো যাক। এটা সৌরের প্রিয় খেলা। সিঁড়ির ধাপ গোনা অংক।

-৪-
সপ্তাহের আজ বৃহস্পতিবার। আবার একটা উইকএন্ড চলে এল। অফিস, শ্বশুরবাড়ি সারাদিনের কত ঝক্কি। গোটা সপ্তাহ একেবারে নিংড়ে নিয়েছে। আজ অফিস শেষে একবার মাকে দেখতে যাবে নীতা। কাল গ্রুপের সারাদিন সবার সাথে যোগাযোগ হয়নি। দামী এন্ড্রয়েডটা হ্যাং করে গেছে। আজ বিকেলে দেবে। ওটা ছাড়া ওর একমুহূর্ত চলে না। কতগুলি গ্রুপ। সারাদিন মেসেজ আর ছবি চালাচালি হচ্ছে। এর মধ্যে কিটি গ্রুপের বন্ধুদের ডুয়ার্স যাওয়ার প্ল্যান চলছে ছুটিতে। সোমবার ছুটি পরে যাওয়ায় পর পর দুদিন কে আর বোর হয়?  নীলের সাথে যোগাযোগ নেই মঙ্গলবার থেকেই । এর মধ্যে ফোন চলে এল সেঁজুতির। সবে স্নানে যাবে। হাই নীতা,কী করছিস ? আর বলিস না, বোর আর বোর। সারাদিন অফিস আর বাড়ি –নীতা আয়নায় মুখ দেখতে বলে।
শোন, সোমবার তো ছুটি, শান্তিনিকেতনে যাবি নাকি ?- ওপার থেকে বলে সেঁজুতি।  
না রে, আমার বোধহয় যাওয়া হবে না – নীতা অন্যমনস্ক হয়ে কানের দুলটা  ঠিক করতে করতে বলে।
-যাবি তো চল। একটা সারপ্রাইজ আছে  
-কীরকম ?
-আমার এড এজেন্সীর এক মস্ত ক্লায়েন্ট বুঝলি। আমি তো জানতামই না। -সেঁজুতি উত্তেজিত কল কল করে ওঠে– আমার সংগে নবনালন্দায় একস্ংগেই পড়েছে। তারপর একদিন ওর অফিসে কাজে গেছি। কথায় কথায় সব পুরানো কথা উঠে এল।
ইন ফ্যাক্ট, ওই আমাকে ক্লাস সেভেনে প্রথম লাভলেটার দেয় । কিন্তু দ্যাখ, এখনো মনে আছে বিচ্ছুটার। আমি ভুলেই গেছিলাম। তারপর থেকে আবার কি নম্বর এক্সচেঞ্জ। চলছে বাক্যালাপ – সেঁজুতি এক নিঃশ্বাসে বলে যায়।
-আরে থাম থাম। একটু জল খেয়ে নে তারপর বল। ডেটিং চলছে নাকি ?
- একদিন বেড়িয়েছিলাম ডিনার করতে তবে ব্যাটা খুব উঠছে রে। শালা বিএমডব্লু চড়ে এসেছিল। প্রস্তাবটা ওরই। শুক্রবার সন্ধ্যায় যাব গাড়ি নিয়ে। সোনাঝুড়ি হাটের ওখানে থাকব। সংগে এক ফটোগ্রাফার বন্ধুও যাচ্ছে। খুব হ্যান্ডসাম। আমি কিন্তু বলে দিয়েছি আমার এক বন্ধুও যাবে। চল। চল। ।
-আচ্ছা দাঁড়া, তোকে বিকেলে জানাচ্ছি তবে স্কচ, হুইস্কি কিন্তু একেবারেই চলবে না। লাস্ট ইয়ার সারা সন্ধ্যা কোপাইয়ের ধারে তোর হুইস্কি কিক খেয়ে পরদিন উঠতেই পারিনি ।             

                          - ৫ -
ট্যাবের গোটা স্ক্রীন জুড়ে পর্ণো নায়িকা তখন আস্ত কলাটা গোটা মুখে ঘসছে আর নীল রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর বাড়ির সোফা সেটে মিউট করে দেখে যাচ্ছে। বিন্দু বিন্দু ঘামতেল লোমকূপের আড়াল থেকে আসছে আর ঠোঁটের স্ফুরণে হানি হানি মাখো মাখো উল্লাস । নীল মন দিয়ে দেখছিল। পাশের ঘরে মা আর পিসী টিভি দেখছে। খাওয়া-দাওয়ার পরও বসেছিল কারণ মা-র কি নাকি জরুরি কথা আছে। বসে থাকল কিছুক্ষন ওদিকে মা আর পিসীতো সিরিয়ালে মজেই আছে। তারপর ওর ঘরে এসে মোবাইলটা খুলেছে কাজের বসার আগে মাথাটা একটু হাল্কা করে নেওয়া দরকার। এদিকে কোম্পানী আবার টার্গেট ধরিয়ে দিয়েছে এবছর টার্নওভার বাড়াতে হবে আর শেয়ার পলিসি নিয়ে ম্যানেজিং বোর্ডের সম্ভবত কিছু সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হবে। কাজ আজকাল অফিসেও শেষ হচ্ছে না। বাড়িতেও নিয়ে আসতে হচ্ছে। একটু পরেই ল্যাপটপে মেলগুলি চেক করে রিপ্লাই দেওয়া, কিছু মেল করে কাজের নির্দেশ দেওয়া। কাজ পিছু ছাড়ছে না। তবে নীলের একটা আনন্দের খবর আছে। সামনের সপ্তাহে নন্দিতা আসছে ইউকে থেকে। ওর এশিয়ান স্টাডিজের গবেষনার বিষয়টা খুব মজার – রোল অফ দ্য ফ্যামিলি ইন ইন্ডিয়ান সোসাইটি। কতদিন নন্দিতার সাথে দেখা হয় না। ও রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে বেরিয়ে তারপর ওর মেসের কাছে এলেই দারোয়ান নন্দিতাকে ডেকে দিত। তারপর দুজনার কত গল্প, ঘুরে বেড়ানো। আজ দুপুরে নন্দিতাকে ফোনে কথা হল। অনেক পুরানো কথার পর নন্দিতা জানাল – ও কিচ্ছুক্ষনের জন্য কলকাতায় থাকবে। নীল যেন ওকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে তারপরে একসংগে লাঞ্চ সেরে কিছুক্ষন একসঙ্গে কাটিয়ে রাতে ও আবার বাংলাদেশের ফ্লাইট ধরবে।

-৬-
নীল যখন কাজ শেষ করে উঠে টয়লেটে গেল তখন শুনশান মাঝরাত। ওর মনে হল এখন একটু ঘুম দরকার। আজ তো শনিবার। সন্ধ্যায় গাড়িটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লে হয়। ও হোয়াটসএপে দেখে নীতা অনলাইন হয়ে আছে। ও একটা ম্যাসেজ ছাড়ল- হাই বেবি, হোয়াটস অন টুডে? উইল ইউ জয়েন? টুপ করে অনলাইন লেখাটি চোখ বুঁজে অফলাইন হয়ে গেল আর ম্যাসাজে একটা মাত্র টিক । নীল তাকিয়েই আছে এখনো ।

অতনু গঙ্গোপাধ্যায়

Puratan Collegehostelpara
Chakbhabani,P.o - Balurghat
Dakshin Dinajpur
pin-733101
mbl.no. 7908613735


No comments:

Post a Comment