এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

সোমনাথ ভাদুড়ী



মুক্ত গদ‍্য




প্রথম ভালোবাসা

ছেলেটা নিজের বাড়ির ছাদে খুব করুণ মুখ করে এপার থেকে ওপার পায়চারি করছে, চোখে, মুখে বিস্তর চিন্তার রেখা, আজ যে তার ফলাফল বেরোবে...না এ ফলাফল স্কুলের পরীক্ষার নয়, এ ফলাফল জীবনের এক পরীক্ষার, ভালোবাসার পরীক্ষার। ছেলেটির প্রথম প্রেম ক্রিকেট, সেই ক্রিকেটের ক্লাব সিলেকশনের রেজাল্ট বেরোবে আজ। বন্ধু খবর নিয়ে আসবে। বাড়ির কেউ জানে না যে ছেলেটি এতটা প্রেমে পড়েছে যে, সেই ক্রিকেটের কথাই দিনরাত চিন্তা করছে। ওর বাড়ির কাউকে না জানিয়ে তার সিলেকশনে নাম দিয়েছে, কারণ তারা জানলে তো বারণ করতো। কারণ ছেলেটির এখন শিরে সংক্রান্তি। সামনে যে উচ্চমাধ্যমিক, জীবন নির্ভর করছে যার ফলাফলের ওপর সেই পরীক্ষা...ছেলেটির সেসব দিকে কোনো মাথা নেই ছেলেটি শুধু অধীর আগ্রহে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে কখন বন্ধু খবর নিয়ে ফিরবে, আর ভাবছে যদি সিলেকশন হয়ে যায় তা হলে কী ভাবে বাড়িতে না জানিয়ে নিজের প্রথম প্রেমকে সময় দেবে।

না, কেন জানাবো না? আমি তো কোনো অন্যায় করছি না..আমি পড়াশোনাও করবো, আবারর খেলাধুলাও সাথে সাথে চালিয়ে যাবো, একটার জন্য অন্যটা কেন থেমে থাকবে? একটা আমার ভালোবাসা আর অন্যটি আমার প্রয়োজনীয়তা, কর্তব্য। ভালোবাসার কাছে থাকলে আমি অক্সিজেন পাবো যা দিয়ে আরো নতুন উদ্দম পাবো নিজের পড়াশোনা ঠিক ঠাক করার, দুটোই দরকার জীবনে। এই সব নানাবিধ চিন্তা করতে করতে হঠাৎ দেখতে পেল তার বেস্ট ফ্রেন্ড রাজা তাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে, ছেলেটি ছাদ থেকে ইশারা করে বন্ধুকে ওপরে আস্তে বললো, সেখানেই তার ফলাফল শুনবে সে বন্ধুর মুখ থেকে, এই মুহূর্তে ছেলেটার মনে হচ্ছে তার সারা শরীর কেমন অবশ হয়ে যাচ্ছে, যদি সে এই পরীক্ষায ফেল করে তাহলে কি হবে, সে আর ভাবতে পারছে না....এর মধ্যে রাজা ছাদে এসে হাজির..। কী রে রাজা বল কি হলো? ওই রাজা বল না.. বলছিস না কেন বল...ছেলেটা তার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে কাকুতি মিনতি করতে লাগলো। রাজা তার বন্ধুর কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বললো, হয়নি তোর হয়নি। ছেলেটা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অস্ফুটে জিজ্ঞেস করলো, কেন রে কি বললো সৰুদা?? রাজা বললো, ওদের ক্লাবের কোনো পুরনো খেলোয়াড় যে ওদের খুব ভালোবাসার সে হঠাৎ ফিরে এসেছে তাই ওদের এখন নতুন প্লেয়ার দরকার নেই....ছেলেটা সব শুনে কিছু বললো না, শুধু দু চোখ দিয়ে জল ঝরতে লাগলো। এরপর বেশ কিছু দিন কেটে গেল, ছেলেটা আস্তে আস্তে সামলে উঠলো, নিজেকে বোঝালো যে, যে যখন যাকে বা যেটাকে ভালোবাসে তারমানে কি সেটাকে পেতে হবে না হলে কি সেই ভালোবাসা বৃথা, ভুল, তা তো নয়, ভালোবাসা মানে তো শুধু পাওয়া নয়, ভালোবাসার কাছে থাকতে চাই তো আমি সেট অন্য ভাবেও হয়, বন্ধু হয়েও তো ভালোবাসার পাশে থাকা যায়, সেটা কি ভাবে? সে সেই ক্লাবের মাঠে যেতে লাগলো, খেলা দেখতো, বল বয় হিসেবে কাজ করতো কখনো কখনো, আর ভাবতো আমার হয়তো সেই যোগ্যতা নেই তাই আমি মাঠের মাঝে নেই, তাতে কি হলো মাঠের ধারে তো আছি, ক্রিকেট এর কাছে তো আছি, নিজের ভালোবাসার কাছে তো আছি...এই ভাবে অনেকগুলো বছর কেটে গেল। ছেলেটা ভালো চাকরি করে এখন, খেলা ধূলা থেকে অনেকদিন কোনো সম্পর্ক নেই, নিজের জীবনে খুশি...হঠাৎ একদিন তার কাছে একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন...হ্যালো কে বলছেন? ওদিক থেকে ভেসে এলো একটা কথা, খেলবি? ছেলেটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো কে বলছেন? ওপর দিক থেকে উত্তর এলো পাড়ার ক্লাব থেকে সৰুদা বলছি...ছেলেটা অবাক হলো সৰুদা এতদিন বাদে!!! হা সৰুদা বলো....সব ঠিক আছে তো? সৰুদা বলতে লাগলেন প্রাথমিক কিছু সৌজন্য বিনিময়ের পর, যে দেখ ভাই খুব মুশকিলে পড়েছি, সামনের সপ্তাহে রবিবার পাশের পাড়ার ক্লাবের সাথে ম্যাচ আছে, কিন্তু একজন প্লেয়ার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে তুই তো এক কালে ক্রিকেট খেলতিস তা তুই একটু সামলে দে না ভাই ....শুনে তো ছেলেটি অবাক এতদিন বাদে ক্রিকেট তাকে ডাকছে, তার প্রথম ভালোবাসা, যখন সে সেটার কল্পনাও করেনি, তার থেকে অনেকদূরে!!! তার মাথা বলছে কি করে সে এতদিন বাদে সামলাবে, সেতো এসবের থেকে অনেকদূরে অনেকদিন হলো, কিন্তু মন বললো পারবো, কেন পারবো না? দূরে আছি ঠিক কিন্তু ভালোবাসা তো আছে, সেটাতো মরেনি মন থেকে....ভালোবাসার হাতছানি যখন একবার এসেছে তখন তাকে না আমি কিছুতেই বলবোনা, যে ভাবে হোক তাকে নিজের সবটুকু দেবার চেষ্টা করবো......উল্টো দিক থেকে কথা ভেসে এলো কি রে লাইন এ আছিস? কিছু বললি না তো? ছেলেটি আর কিছু না ভেবে রাজি হয়ে গেল সৰুদার প্রস্তাবে.....ফোন এ কথা হবার পর ছেলেটির চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো অনেক বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই সব দিনগুলো, সেই চোখের জল গুলো, বিনিদ্র রাত্রি গুলো...যাই হোক পুরোনো কথা আর ভাববো না এবার নতুন কমিটমেন্ট এর পালা....এরপর দু এক দিন কেটে গেল সবুদার সাথে রোজ কথা হয় খেলা নিয়ে, পুরোনো কথা, এটা সেটা...ভালোই কাটছে ছেলেটার, ভাবছে অফিস এ ছুটি নিতে হবে, ছুটির কথা বলতে হবে ম্যাচ এর জন্য....এর মধ্যে হঠাৎ একদিন সকালে ফোন, উল্টো দিকে সৰুদা, ছেলেটি ফোন তোলাতেই তার প্রথম কথা, ভাই আমি সরি আমি পারবো না...ছেলেটি অবাক হয়ে বললো কি হয়েছে সৰুদা? কি পারবে না? খানিক চুপ থেকে সৰুদা বললো তোকে টীমে নিতে....ছেলেটা তো অবাক কি হলো হঠাৎ করে!!!! কেন সৰুদা কি হলো? না রে টীম ম্যানেজার মানছেনা ওদের সাথে আমি আর লড়াই করতে পারছি না। এবার তারা যা বলবে আমাকে শুনতে হবে আমায় ক্ষমা করিস....ছেলেটা অবাক, কিছু বলার ভাষা নেই...সেই বহুবছর আগে পাওয়া ব্যাথাগুলো যেন আবার সে কিছুটা অনুভব করতে পারছে...সে খানিক চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বললো, কেন এমন করলে সৰুদা..আমি তো ক্রিকেট থেকে দূরে চলেই গিয়েছিলাম তুমি আমাকে ডাকলে আর দুদিনে আবার তোমার মত পরিবর্তন হয়ে গেল?? কেন এমন করলে কেন? উল্টো দিক থেকে উত্তর ভেসে এলো, সরি আর কোনোদিন ফোন করবো না..কেটে গেল ফোনটা ...সত্ত্যিইই আর কোনোদিন ফোন আসেনি....ক্রিকেট তার আপনজনদেড় নিয়ে সুখে আছে...ছেলেটিও তার আপনজনদের নিয়ে সুখে আছে...কিন্তু তার প্রথম প্রেম ক্রিকেটকে কোনোদিন ভোলেনি...তার শুধু একটাই প্রার্থনা তার প্রথম প্রেম আরো বড়ো হোক তার স্বমহিমায়....কারণ ছেলেটির কাছে প্রেম মানে শুধু সবটুকু পাওয়া নয়..........অনেকখানি হারানো..........



*****

No comments:

Post a Comment