এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

প্রভাত চৌধুরী



কবিতা (সাধারণ বিভাগ)




শাল্যদানী-র একটি কবিতা পড়ে

সবুজের কথা উঠলেই 'সবুজপত্র '-র পাশে
আমার পানপাতা
আর বনাঞ্চল থেকে যে পাখিটি বেরিয়ে আসে
তাকে আমরা টিয়া নামে চিনি
সব চিনি-ই মানসকুমার হয় না
কেউ কেউ ডালিমকুমার নামেও
শিশুপাঠ্যে বিরাজ করে
আর সবুজ-এর পাশে এসে বসে পড়ে অবুঝ
এই অবুঝকে বোঝার কিছু নেই
আমাদের যাবতীয় বোঝাবুঝি
কেবলমাত্র একটি বোঝাকে কেন্দ্র করে
আর ভারবহনের জন্য
গর্দভ নামক একটি
নিরীহ প্রাণীকে টেনে আনতে পারলেই
যাবতীয় ভুল বোঝাবুঝিরও অবসান
হয়ে যাবে, কেবলমাত্র এটুকু বলে
থেমে যাবো, থেমে যেতে হয় বলেই

২৪.০৩.২০১৮ | ১৯:৩৫






সুন্দরের দিকে
(দ্বিতীয় পর্ব )




৫২

সুন্দরের দিকে-কে পর্ব বিন্যাস করলাম। এতদিন ছিলাম সাম্প্রতিক কবিপত্র পরিচয় ইত্যাদি পত্রপত্রিকার  সাজঘরে । ওখানের ড্রেসিংরুমে যা দেখেছিলাম তার সবটুকু লেখা হয়নি । চেষ্টা থাকবে সেই ফাঁক ফোকরকে পরবর্তী কোনো সময়ে ভর্তি করার । বললেই যে সবটা ভরাট করা যাবে, তার গ্যারান্টি দেওয়া সম্ভব নয়।এখন এসব নিয়ে ভাবতে যাবো কেন ? এখন শ্যামলে শ্যামল আমি নীলিমায় ঠিক কোন রং ছিল  আমার, তা দ্যাখার চেষ্টা করা যাক ।

শ্যামলদার সঙ্গে ঠিক কবে দ্যাখা হয়েছিল, তা মনে করতে পারছি না । তাহলে তারিখ হিসেবে বসিয়ে দিলাম পয়লা বৈশাখ ।
নতুন শুরুর জন্য পয়লা বৈশাখ একটি  উপযুক্ত তারিখ । কেননা সেদিনের গতকালের সঙ্গে সেদিনের আজকের  পার্থক্যটা বোঝানোর জন্য এর থেকে ভালো তারিখ আমার জানা নেই ।
ওই পয়লা বৈশাখের সকালে পবিত্রদার ২২ বি, প্রতাপাদিত্য রোডের বাড়িতে  আড্ডা চলছিল । হঠাৎই বিনা নোটিশে হাজির হলেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। হলুদ রঙের পাঞ্জাবি, পাটভাঙা সাদা ধুতি । বলতে দ্বিধা নেই  আমার তখন শ্যামলদার সঙ্গে পরিচয়ও ছিল না । সেটা যে কোনো সমস্যা নয় তা শ্যামলদারই অবদান । শ্যামলদার কাছে পরিচিত এবং অপরিচিত -র কোনো ব্যবধান ছিল না । এটা দিয়েই শুরু করলাম শ্যামল -চর্চা । একজন বড়ো মাপের মানুষ যে বড়ো মনের মানুষ হয়, তা শ্যামলদাকে কাছ থেকে না দেখলে জানতেই পারতাম না । পরবর্তীতে সুনীলদা বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়েরও ক্ষেত্রেও এমনটাই দেখেছি ।
আমাদের কবিপত্রর আড্ডায় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাজির হওয়ায় আমরা বেশ খুশি । আগেই শুনেছিলাম শ্যামলদার আনন্দবাজার থেকে যুগান্তর হাউসে চলে  আসার রোমহর্ষক ঘটনাবলি । এবং এটাও কানে এসেছিল যে শ্যামলদাকে অমৃত পত্রিকার পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হবে । আমরা সকলেই উদ্বেলিত । কিছুক্ষণ শ্যামলদা তাঁর বর্তমান  অবস্থান সম্পর্কে আমাদের বিশদে জানালেন ।পরে প্রায় বগলদাবা করে নিয়ে গেলেন তাঁর বাড়িতে ।
বলে রাখা ভালো,  আমার বইয়ের আলমারিতে তার আগেই জায়গা করে নিয়েছে কুবেরের বিষিয়ে আশয়। আমি জেনে গিয়েছিলাম শ্যামলদার ক্ষমতা । কৃত্তিবাস -এ প্রকাশিত বিদ্যুৎচন্দ্র পাল  - কে নিয়ে অনবদ্য গল্পটি পড়া ছিল আমার । সেই শ্যামলদার বাড়িতে আমার মতো একজন তরুণ কবিতালেখকের উপস্থিতি ছিল এতটাই অকস্মাৎ যে আমি অনেকটাই বিহ্বল ।
পরে  আমার জন্য  অপেক্ষা করছিল আরো অনেক বিহ্বলতা ।
শ্যামলদা অর্ডার করলেন বোতল এবং গ্লাসের। ইতি বউদি স্বয়ং দিয়ে গিয়েছিলেন সেসব।
জলযাত্রা শুরুর কিছুক্ষণ পরেই বাজখাঁই গলায় আমার  উদ্দেশ্যে বললেন, প্রভাত তুই নাচতে পারিস?
আমি তো পার্ক হোটেলের ইনস  অ্যান্ড আউটে তখন নিয়মিত নাচি। নাচ  আমার তখন নিত্য চর্চা বা নিত্যকর্ম । পেটে তখন তন্দ্রা  আসতে শুরু করেছে ।
বললাম -নাচতে পারবো না কেন ।
উত্তরে শ্যামলদার স্নেহের হুঙ্কার ---মলিমা একটা রেকর্ড চাপিয়ে দাও তো মা, প্রভাত নাচবে।
মলি বা মল্লিকা শ্যামলদার বড়োমেয়ে। পিতৃ - আজ্ঞা পালন করলো মুখ বুঝে।
নৃত্য -বিশারদ প্রভাত চৌধুরী শুরু করে দিন তার নাচ।
কেমন নেচেছিলাম তার উত্তর  আমার কাছে নেই । মলি সম্ভবত বলতে পারবে।
তবে এই নাচ দেখেই শ্যামলদা আদেশ লিখেছিলেন, পরদিন বিকেলে অমৃত দপ্তরে যেতে।
আমি ভেবে নিয়েছিলাম,  আমাকে হয়তো ওখানে গিয়ে নাচ দেখাতে হবে।




৫৩

হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট থেকে বাগবাজার স্ট্রিট । দূরত্ব  অনেকটা । তবু যেতে তো হবেই । আর যাবার জন্য আছে ৩ নম্বর বাস। দোতলা বাস, লাল রঙের ।বাসের গায়ে বাঘের মুখ। অর্থাৎ কিনা সরকারি বাস।কলকাতা রাষ্ট্রীয় পরিবহন নিগমের । খিদিরপুর থেকে বাগবাজার । তো চেপে গেলাম ।সেদিন  উত্তেজনায় অফিস যাইনি। দোতলার জানালার ধারে বসে কলকাতা এবং তার মহার্ঘ রূপ দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম বাগবাজার ।সেখান থেকে অমৃত দপ্তর । যুগান্তর -এর উল্টো দিকে । একতলার ৩-৪ টি ঘর নিয়ে দপ্তর । ভেতরের ঘরে একটা বড়ো টেবিলের পেছনে শ্যামলদার চেয়ার। আমি সোজা ঢুকে পড়লাম ঘরে।
এসে গেছিস, বসে পড়।
টেবিলের এদিকে বেশ কয়েকটি চেয়ার। তার একটি দখল করে বসে পড়লাম ।
শ্যামলদা পরিচয় করিয়ে দিলেন কমল চৌধুরী এবং বিদ্যুৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে । ওনারা দুজন  অমৃত-র স্থায়ী কর্মচারী ছিলেন । মণীন্দ্র রায়ের আমলেও ছিলেন। ছিলেন বেশ দাপটের সঙ্গে ।
শ্যামলদা এসে যাওয়ার পর এদের অবস্থা কী দাঁড়াবে তা তখনো জানা যায়নি।
শ্যামলদার লক্ষ্য ছিল তাঁর মনের মতো করে পত্রিকা প্রকাশ করার । অর্থাৎ আগে অমৃত যেভাবে বা যে ফরম্যাটে পাঠকের হাতে পৌঁছে দেওয়া হত, শ্যামলদা চেয়েছিলেন সেই ফরম্যাট বদলে দিতে । কারণ শ্যামলদা তাঁর পুরোনো কর্তৃপক্ষকে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তাঁর সম্পাদনা সম্পর্কে জ্ঞান কারো থেকেই কম নয়। পরিকল্পনা তৈরি করতে তিনি দক্ষ ।
তার শুরু হল পরিকল্পনা ।
প্রথমেই স্থির হল--প্রতি সংখ্যায় থাকবে কভারস্টোরি। বাংলা সাহিত্যপত্রে শ্যামলদাই প্রথম ব্যক্তি, যাঁর মাথা থেকে বের হয়েছিল কভারস্টোরির কনসেপ্ট । এটা কোথাও উল্লেখিত হয়েছে কিনা জানি না তবে আমার পড়ার  অভ্যেস চিরদিনই কম।
কভারস্টোরির বিষয়-নির্বাচন শ্যামলদা নিজেই করতেন। অন্যের পরামর্শ মন দিয়ে শুনতেন । পছন্দ না হলে মুখের ওপর বলে দিতেন ।
ঠিক হয়েছিল পবিত্রদা প্রতি সংখ্যাতে এক পৃষ্ঠার সাহিত্য -বিষয়ে একটি গদ্য লিখবেন।বিষয় নির্বাচনে পবিত্রদা স্বাধীন । তার অর্থ হল পবিত্রদা নিজের মতামত প্রকাশের  একটা বড়ো প্ল্যাটফর্ম পেলেন । আমরা সকলেই খুব খুশি । ভাবলাম, যাক আমাদের একটা হিল্লে হয়ে গেল।
আমার পেলাম সমালোচনা বিভাগের কাজ। কোনোদিন নাটক, কোনোদিন সিনেমা, কোনোদিন বা চিত্র প্রদর্শনী । দেখে এসো, লেখা জমা দাও। এভাবে কোনো সপ্তাহে তিনটি । আবার কোনো সপ্তাহে চারটি ।
কিছুদিন পর আমাকে বললেন একটা ব্রিফকেস কিনতে।
নতুন একটা ব্রিফকেস কিনে নিয়ে দেখালাম শ্যামলদাকে।শ্যামলদার ব্রিফকেসটি পছন্দ হয়েছিল বলেই বলে দিলেন ---আজ থেকে তুই আমাদের প্রভাতবন্ধু। তোর কর্মস্থল হল চিৎপুর।




৫৪

সেই নতুন কেনা ব্রিফকেসটিতে। কী ছিল, তা জানার অধিকার তো পাঠকের থাকবেই।এমনকি  আমারও তা জানানোটা বাধ্যতামূলক । জানাবো অবশ্যই । তবে তা সময় মতো জানানো যাবে। ব্রিফকেস খোলার  আগে জানাতে যাবো কেন। আগে পৌঁছতে হবে চিৎপুরের যাত্রা পাড়ায়। যাত্রা কোম্পানিগুলির অফিসে ।
আগে বাগবাজার থেকে ফেরার কথাটা জানিয়ে রাখি । আমাকে শ্যামলদার কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত । তেমনই  আদেশ ছিল । এটা কোনো লিখিত সার্কুলার ছিল না, অথচ যা ছিল তা লেখার ওপরে। কোনো নড়চড় হবার জায়গা ছিল না । এটা সকলেই জানতেন।
অমৃত থেকে সোজাসুজি বাড়ি ফেরা হত না । সেটা নির্ভর করতো শ্যামলদার মর্জিমাফিক । আমি তখন জড়বস্তুর মতো। এটা কিন্তু কখনোই পরাধীনতা বলে মনে হয়নি।
আসলে শ্যামলদা ঠিক  আমার মতো একজনকে চেয়েছিলেন, যা আর কারো মধ্যেই ছিল না । আমি কি তাহলে শ্যামলদার  ইয়েস ম্যান ছিলাম ? এই প্রশ্ন যে কেউ করতেই পারেন, কিন্তু আমি এর উত্তর দিতে বাধ্য নই । উত্তর দেবার দায়িত্ব শ্যামলদার । ক্ষমতা থাকলে শ্যামলদার কাছে প্রশ্ন করে জেনে নিতে পারেন ।

অধিকাংশ দিন , অন্য কোনো কাজ না থাকলে প্রেস ক্লাবে যেতাম । প্রেস ক্লাবে শ্যামলদার আধিপত্য ছিল । আমরা বাগানে বসতাম । একটা টেবিল, আর সেই টেবিলকে ঘিরে খানকয়েক চেয়ার।টেবিল এবং চেয়ার বলাবাহুল্য প্ল্যাস্টিকের। চেয়ারের সংখ্যা নির্ভর করতো সেদিনের হিসেব মতো।অর্থাৎ কতজন শ্যামলদাকে কেন্দ্র করে বসতে চাইতাম তার ওপর নির্ভর করতো চেয়ারের সংখ্যা । আমার প্রিয় ব্রিফকেসটি তখন প্রেস ক্লাবের ঘাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জাবর কাটতো।
শ্যামলদার ছোটো ভাই তাপস গঙ্গোপাধ্যায় মাঝেমধ্যে তাঁর সঙ্গীসাথী সমেত আমাদের টেবিলে যুক্ত হতেন।তাঁদের মধ্যে একজন অদ্ভুত একটা কল্পলোকে বিচরণ করতেন । এসেই তাঁর প্রথম কথা ছিল --- আজ তিনটি।তিন আঙুলের সাহায্যে তিনকে চিহ্নিত করতেন। এই ইঙ্গিতময়  আঙুলের সাহায্যে বা অঙ্গুলিহেলনে তিনি বোঝাতে চাইতেন , আজ তিনি তিনজনকে খতম করে এসেছেন।যেদিন তিনি আঙুল ব্যবহার করতেন না, সেদিন আমার মন খারাপ হয়ে যেত।ভাবতাম, আহা, আজ দিনটা যেন ফাঁকা হয়ে গেল। কী একটা হবার ছিল, অথচ হল না ।
আর এক জন ছিলেন পিনাকী, যিনি বিভিন্ন  অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন । নৌকোতে দাঁড় বেয়ে আন্দামান পারি দিয়েছিলেন ।
শ্যামলদাকে এরা সকলেই একশো পার্সেন্ট শ্রদ্ধা করতেন । শ্যামলদার ভাই তাপস বারাণসী নিয়ে একটি অমূল্য লেখা লিখেছিলেন । বার্ধক্যে বারাণসী -র ওপর সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা বা প্রতিবেদন ছিল ওই লেখাটি । একজন সাংবাদিক কীভাবে সংবাদ পরিবেশন করবেন, তার প্রকৃত উদাহরণ এই লেখাটি । জানি না এই লেখাটি জার্নালিজমে পাঠ্য আছে কিনা ।
আমাদের আড্ডার কোনো ধরাবাঁধা গত ছিল না, অথচ বিষয়ের অভাব হত না । অন্তরিক্ষ থেকে উঠে আসতো বিষয়। সেই বিষয়ের ডাল ধরতে সক্ষম হলেই চালিয়ে যাওয়া যেত।
শ্যামলদা মনেপ্রাণে জাতীয়তাবাদের সমর্থক ছিলেন । কিন্তু আমার মার্কসবাদী চিন্তাচেতনার সঙ্গে কখনোই বিরোধ ঘটেনি । হলে এত দীর্ঘ সময়ের জন্য একান্নবর্তী থাকতে পারতাম না ।





৫৫

একান্নবর্তী শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল --একসঙ্গে রান্না -খাওয়া হয় যে - পরিবারে / যৌথপরিবারভুক্ত।
আমি শ্যামলদার সঙ্গে  আমার একান্নবর্তী পরিবারের কথা লিখেছিলাম । এই শব্দটি  অভিধান থেকে উড়ে এসে সুন্দরের দিকে ঢুকে পড়েনি । অভিধানে ঠিক যেমনটি লেখা আছে ঠিক তেমনটাই ছিল এই যৌথপরিবারটি। এটা কোনো অতিশয়োক্তি নয়। আবেগঘন স্মৃতিচারণ নয়। যাঁরা দেখেছেন তাঁদের মধ্যে জীবিত  আছেন । তাঁদের কেউ কেউ অস্বীকার করতে পারেন, কিন্তু সকলেই অস্বীকার করবেন এমনটা আমি বিশ্বাস করি না ।

শ্যামলদার সঙ্গে সঙ্গে  অবশ্যই বলা উচিত ইতি বউদির কথা । ইতি বউদি ছিলেন শ্যামলদার পরিপূরক । প্রকৃত অর্থেই পরিপূরক । আমার দ্যাখা এবং জানা শ্রেষ্ঠ দম্পতি --শ্যামলদা এবং ইতি বউদি ।
পরিবারের বাইরের মানুষজনকে কীভাবে বা কী কৌশলে আপন করে নিতে হয় তার একমাত্র উদাহরণ ইতি বউদি ।
অনেকেই খুবই ভালো রান্না করেন। কিন্তু ভালো রান্নার ভালো ভাবে খাওয়ানোর যে অমোঘ বিদ্যাটি বউদি জানতেন, তা কোনো বিদ্যায়তন থেকে শেখা যায় না । শেখার জন্য ব্যবহার করতে হয় অন্তঃকরণ নামক একটি শব্দ । এই শব্দটি দ্যাখা যাই না, অনুভব করতে হয়। আর তা অনুভবের জন্য প্রয়োজন একটি বিশেষ অর্গানের। আমার মতো প্রায় নিরক্ষর মানুষ যেটা বুঝতে পারতো , জ্ঞানী-গুণী মানুষজন যে সেটা বুঝতে  সক্ষম হতেন, এটা ধরে নিতেই পারি ।
প্রায় প্রতিদিনই শ্যামলদার বাড়িতে খাওয়াটা আমার বাধ্যতামূলক ছিল । এমনকি সকাল -সন্ধে দুবেলা। এসব ভুলে যাবো কীভাবে ? এসব কি ভোলা যায়? না, ভুলে যাওয়াতে কোনো পুণ্যার্জন করা যায়? গেলেও আমি সেই পুণ্য কে বর্জন করি । শ্যামলদা কিংবা বউদির কাছে যে ঋণ করেছি, তা শোধ করার জন্য  আমাকে একশো বার জন্মাতে হবে। আর আমি তো পুনর্জীবন শব্দটিকে কোনোদিনই চোখভরে দ্যাখার সুযোগ পাইনি ।
এই সুযোগ যে কেবলমাত্র আমিই পেয়েছিলাম এমনটাও নয়। অনেকেই ছিলেন । নাম ঘোষণা কি খুবই জরুরি ? জরুরি নয়--এই সিদ্ধান্তটি আমাকেই নিতে হল।
খাবার ফিরিস্তি দেওয়ার থেকে বলে রাখি যেসব খাবার বাঙালিদের পছন্দের তালিকার মধ্যে মুদ্রিত আছে তার থেকে দু-চার টি অবশ্যই বেশি হবে । যাঁরা হিংসে করবেন, তাঁদের জানিয়ে রাখি, এই ধরণের মানুষ খুব বেশি কপি ছাপা হয় না । এজন্যই  এঁদের জন্য দুর্লভ শব্দটি অভিধানে স্থান পেয়েছে ।এটা একতরফা ছিল না । আমার ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়ে আমিও চেষ্টা করতাম শ্যামলদার প্রিয় কিছু পদ রান্না করার। যত খারাপ রান্না হোক শ্যামলদার খাবারের ভিডিও দেখেও বোঝার উপায় থাকতো না, রান্নার গুণাবলি।
শ্যামলদাকে যাঁরা কিছুটা চিনতেন, তাঁরা সকলেই স্বীকার করবেন শ্যামলদা বাজার করতে ভালো বাসতেন। শ্যামলদা বাজার করার সময়ে যেমন সবজি -মাছ-মাংস-ফল-মিষ্টি ইত্যাদি কিনতেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলেন বিক্রেতার হৃদয়টিও কিনে নিতেন।
শ্যামলদাকে অনুকরণ করি আমি বিভিন্ন ক্ষেত্রে, তার মধ্যে বাজার করাটা এক নম্বরে । আমি যার কাছ থেকে কাঁচালঙ্কা কিনি, তার বাড়ি কোথায় বাড়িতে কে কে আছে, সবকিছু জানা হয়ে গেছে আমার। এটা শ্যামলদার শিক্ষা । শ্যামলদার স্কুলে না পড়লে এটা সম্ভব হতো না । আমি ছাড়াও তরুণ কবি রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ও শ্যামলদার কাছে এই বিদ্যা রপ্ত করেছিল। তার পরিচয় আমরা অনেকেই পেয়েছি।

নতুন কেনা ব্রিফকেসটিতে এবার তো নজর দিতে হবে।




৫৬

শ্যামলদা যেমন আমাকে প্রভাতবন্ধু  বানাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শ্যামলদা সম্ভবত জানতেন না, প্রবোধবন্ধু- র অনুকরণে প্রভাতবন্ধু বানানোটা খুবই কঠিন কাজ । এখনকার প্রজন্মের লেখক কিংবা পাঠকেরা জানেন না এবং চেনেনও না প্রবোধবন্ধু অধিকারী নামক একজন বিশিষ্ট লেখককে ।তাঁরা পড়ার সুযোগ পাননি বলেই ধলেশ্বরী নামের মহান উপন্যাসটি । বাংলাভাষার একটি কালজয়ী  উপন্যাস ধলেশ্বরী। আমার বিনীত অনুরোধ এই উপন্যাসটি আপনারা পড়ুন এবং সিদ্ধান্ত নিন, আমি পাঠকদের ভুল পথে চালিত করতে চাইছি কিনা। এখন একটা নতুন প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি, তাহল কোন ওয়েবসাইট -এ পাওয়া যাবে । এর উত্তর আমার ঝুলিতে নেই । কারণ আমি এখনো হার্ডকপি তেই পড়তে জানি । সফট কপি পড়তে দক্ষ নই । এটা আমার ব্যক্তিগত  অক্ষমতা । এখানে আমি নিজেকে আপডেট করতে পারিনি । এটা উল্লেখ করা আমার কর্তব্য । আমি আমার নিজস্ব অক্ষমতাগুলিকে কখনোই আড়াল করতে চাই না ।
প্রবোধবন্ধু সম্পর্কে যে তথ্যটি এই প্রসঙ্গে জরুরি তা হল , তিনি ছিলেন সেই সময়ের আনন্দবাজারের যাত্রা -বিভাগের প্রধান ব্যক্তি। দুটি কথা জানানো আমার দায়িত্ব ।
১< তিনি এমন একজন লেখক যিনি যাত্রাশিল্পকে এবং যাত্রাশিল্পী দের শরীর থেকে  মফসসলের (প্রথম স-র পরে হস্ চিহ্ন দেওয়া গেল না ) গন্ধ মুছে দিয়েছিলেন প্রায়  একক চেষ্টায়। মহানগরীতে তখন যাত্রাশিল্প অচ্ছুত ছিল । আমরা গ্রুপ থিয়েটারের শিল্পীদের যে সম্মানের চোখে দেখতাম, যাত্রাশিল্পী দের কখনোই সেই চোখে দেখতে অভ্যস্ত  ছিলাম না । প্রবোধবন্ধুর জন্য যাত্রাশিল্পী রা নাগরিক জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল ।
২ < প্রবোধবন্ধু  অধিকারী -র প্রচেষ্টা এবং দক্ষতার জন্য  আনন্দবাজার পত্রিকা যত টাকার বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করতো যাত্রাশিল্প থেকে সে পরিমাণ টাকা  অন্যকোনো শিল্প থেকে সংগ্রহ করার কথা ভাবতেও সাহস পেত না।
ঠিক এরকম পরিস্থিতির মধ্যে আমি যাত্রাপাড়া বা চিৎপুরে উপস্থিত হলাম ।
হাতে নতুন কেনা ব্রিফকেস ।
প্রথম ঢুকলাম সত্যম্বর  অপেরার ঘরে। আমি জানতাম সবথেকে ঐতিহ্যবাহী যাত্রাদল হল সত্যম্বর অপেরা । আমার জানাটা সঠিক ছিল । আর একটা কথা বলতে কোনো দ্বিধা নেই, এই সত্যম্বর অপেরার সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির একটা পুরোনো যোগসূত্র ছিল। সেটাও আমার আগ্রহের কারণ হতে পারে ।
সত্যম্বর অপেরার অফিসঘর ছিল দোতলার একটা  ঘরে । খুঁজে পেতে কোনো সমস্যা হয়নি। মালিক শৈলেন বাবুকে পাইনি । যিনি অফিসের দায়িত্ব সামলাতেন,তাঁর নাম বিমানবাবু, খুবই সাদাসিধে ভদ্রলোক । প্রথমেই তাঁর কাছে সারেন্ডার করে আমার উদ্দেশ্য জানালাম। বিমানবাবু সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। আমি খুশি মনে ফিরে গেলাম বাগবাজার, শ্যামলদার কাছে । সমস্তটা রিপোর্ট করলাম। শ্যামলদার কাছে বাহবা পেলাম । বললেন, চালিয়ে যা প্রভাতবন্ধু।
আমি সেদিন থেকে নিজেকে প্রভাতবন্ধু ভাবতে শুরু করে দিলাম ।




৫৭

যাত্রা পাড়ার দৈনন্দিন বিবরণ লিখে রাখা হয়নি। সেকারণে সবটা জানাতে পারছি না । সত্যম্বর অপেরার বিমানবাবুর সৌজন্যে আমার লেখা চলতে লাগলো সাবলীল ভাবে । দুটি উল্লেখ করার মতো ঘটনার কথা এখনো বেশ মনে আছে ।
একবার বাচ্চুদা বা অরুণ রায় বললেন যাত্রার রিহার্সাল  আছে একটা রাজবাড়িতে।আমি পরিচালক । জ্যোৎস্না দত্ত আর গুরুদাস ধাড়া দুজন মূল শিল্পী । এই দুজন তখন স্টার । অতএব সুযোগটা যে গ্রহণ না করাটা যে ভুল হবে , সেটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি ছিল । গাড়ি করে উত্তর কলকাতার এক ফাঁকা রাজবাড়িতে নামলাম বাচ্চুদার পেছন পেছন। দোতলার একটা বিশাল ঘরে রিহার্সাল শুরু হয়ে গেছে ।প্রথমেই  আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন বাচ্চুদা । কে যেন এক প্যাকেট লম্বা দামি সিগারেট এগিয়ে দিলেন। এসে গেল মিষ্টির প্লেট। আমরা তার সদ্ব্যবহার শুরু করে দিলাম।
এদিকে রিহার্সাল চলছে পুরোদমে । বাচ্চুদা এবং আমার সিগারেটের প্রতি মনোনিবেশে কোনো ঘাটতি ছিল না ।
এদিকে প্রত্যেক অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রতিটি ডায়লগ কেমন করে বলতে হবে তা দেখিয়ে দিচ্ছেন  জ্যোৎস্না দত্ত । কীভাবে বলতে হবে সহ কীভাবে চলতে হবে, তার সবটুকু শিখিয়ে দিচ্ছেন জ্যোৎস্না দত্ত । এই  মহান অভিনেত্রীর দক্ষতা দেখে আমি স্তম্ভিত । আমরা যারা গ্রুপ থিয়েটারের ভক্ত, তাদের কোনো ধারণাই নেই, যাত্রাশিল্পী দের অভিনীত দক্ষতা সম্পর্কে । সেদিন যা বুঝেছিলাম আজও তা ভুলে যাইনি। আমরা কত কম জানি,  সেই কমজানাটাকে প্রতিষ্ঠা করতে চাই সর্বত্র ।
এখন অকপটে বলতে কুণ্ঠিত হচ্ছি না, যে জ্যোৎস্না দত্তের সমতুল্য অভিনেত্রী একজনও নাটকের এরিনায় খুঁজে পাওয়া যাবে না ।
ফেরার পথে বাচ্চুদার কাছে জানতে চেয়েছিলাম --ডিরেক্টর আপনি আর নির্দেশ দিচ্ছেন জ্যোৎস্না দত্ত,  এটা কেমন নীতি ?
বাচ্চুদা বলেছিলেন ----জ্যোৎস্না দত্ত পঞ্চাশ বছর যাত্রার সঙ্গে যুক্ত আছেন, আর আমার পাঁচ দিনও হয়নি। তাহলে কে যোগ্যতম। আমি না জ্যোৎস্না দত্ত । এই একটি স্বীকারোক্তি তে অরুণ রায় বা বাচ্চুদার মহত্ব প্রকাশ পেয়েছিল ।
এই রিহার্সালের রিপোর্ট অমৃত পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল । সগৌরবে জানিয়ে দিই ---অমৃত পত্রিকাই প্রথম যাত্রা -রিহার্সালের রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। তা লিখেছিলাম আমি বা প্রভাতবন্ধু, প্রবোধবন্ধু নয়। এটাই শ্যামলদার অবদান ।
দ্বিতীয়টি আগামীকাল ।




৫৮

একজন মানুষের যেমন আঙুল আক্রান্ত হয়ে থাকে  ঠিক তেমনই একজন কবিতালেখকের আঙুলও আক্রান্ত হতে পারে । কবির আঙুল বলে সেই আঙুল কোনো ছাড় পায় না ।কারণ যিনি কবিতা লেখেন তিনিও একজন মানুষ ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি রোগ ব্যাধি থেকে মুক্ত নন।
এত কথা বলার অর্থ হল  আমার আঙুল আমাকে সুন্দরের দিকে  আসতে বাধা দিয়েছে।
এখন আমাকে যেতে হবে চিৎপুরের যাত্রা পাড়ার সত্যম্বর অপেরার ঘর, যেখানে আমার জন্য  অপেক্ষা করে আছেন বিমানবাবু। যিনি আমার বা প্রভাতবন্ধু -র পথপ্রদর্শক ।
ব্যাপারটা ঠিক  এমনটাই ছিল । বিমানবাবু ব্যবস্থা করে রাখতেন কবে কোথায় কার সঙ্গে দ্যাখা করতে হবে । আমি সেমতো তাঁর কাছে ঠিক সময়ে পৌঁছে যেতাম ।
এভাবেই কোনোদিন শান্তিগোপাল বা কোনোদিন বীণা দাশগুপ্তের সঙ্গে দ্যাখা হয়েছে। তো  একদিন একযাত্রাপালার প্রথম রজনি উলুবেড়িয়ায়। আমাকে যেতেই হবে। কোনো মুক্তি নেই । আমার  অফিসের সহকর্মী আমার বিশেষ বন্ধু মহম্মদ জিন্নুরের বাড়ি উলুবেড়িয়া। আমার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ রইল না । অতএব যাওয়াটা কনফার্ম  করে দিলাম ।
গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে  একটা বড়ো থালায় একটা মাত্র টাটকা রসগোল্লা । সাইজ দেখে আমি বোবা হয়ে গেলাম। অবস্থা দেখে কে যেন বলল-- এটা আর এমন কী, এতো কেজি রসগোল্লা । তিনি বুঝিয়ে দিলেন মাত্র  এক কেজি ছানা দিয়ে এই রসগোল্লা টি বানানো হয়েছে ।
এরপর আর কোনো প্রশ্ন বা সংশয় থাকার কথা নয়। ওরা তো আর জানতো না যে আমার রসগোল্লা খেলে খুব ঘুম পায়।
সেই কেজি রসগোল্লাটি ধীরেসুস্থে খাওয়ার পর পেটে যতটুকু জল ধরা সম্ভব সেটুকু জলপান করেই জিন্নুরের বাড়ি ।
পরদিন জিন্নুরের মাছভাত খেয়ে একসঙ্গে  অফিস ।বিকেলে বেশ ভালো একটা নিউজ করে জমা দিয়ে এলাম অমৃত দপ্তরে বা শ্যামলদার হাতে ।
শ্যামলদা বললেন , তোর এলেম আছে প্রভাতবন্ধু ।কোথাও যাস না ।আজ গ্রান্ডে একটা পার্টি আছে,  তোকেও যেতে হবে। পোল্ট্রি সংগঠনের প্রেসমিট।শুনেছি তুই মুরগি-বিশেষজ্ঞ।তোকে যেতেই হবে।
আসলে শ্যামলদা জানতেন যে এই প্রেসমিটে ভালো খানাপিনার ব্যবস্থা  আছে, আমাকে না নিয়ে সেখানে যেতেন না। এমনকি একারণে আমাকে কখনো হ্যান্ডলুম কখনো গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার বিশেষজ্ঞ হতে হয়েছে।কখনোই শ্যামলদার কোনো আদেশ অমান্য করিনি, কোনো অভিপ্রায় অপূর্ণ রাখিনি।
মুরগি-কেন্দ্রিক প্রেসমিট -র ঘটনার ধারাবিবরণী  আগামীকাল ।
শুভ রাত্রি ।

প্রভাত চৌধুরী

No comments:

Post a Comment