এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

রিয়া ভট্টাচার্য



ছোটগল্প


ছিন্নপত্রাভাস


--"এতোদিন কিছু একা থেকে শুধু খেলেছি একাই,
পরাজিত প্রেম তনুর তিমিরে হেনেছে আঘাত
পারিজাত হীন কঠিন পাথরে।....."


তালসারির নির্জন সৈকতে বসে চোখ বুজে একমনে আবৃত্তি করে চলেছে রিমি। গোশাবকের ক্ষুরস্থ ধূলিকণাকে সাক্ষী রেখে গোধূলি পেরিয়ে ঘনাচ্ছে সন্ধ্যাধাঁর। ফেনায়িত তরঙ্গ বালুবুকে ভেঙে পড়ছে প্রবল উচ্ছ্বাসে, একরাশ ঝিনুকের উপহারদান করে ফিরে যাচ্ছে নির্লিপ্ত উদাসীনতায়।
--"বাহ!! রুদ্র মহম্মদ শহিদুল্লাহের কবিতা!! আপনি তো বেশ রোমান্টিক চরিত্রের মানুষ ম্যাডাম।" পেছন হতে ভেসে আসা কণ্ঠস্বরে চমকে মুখ ঘোরায় রিমি, হাসিহাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ছয় ফুট লম্বা এক অবয়ব। রিমলেস চশমার অন্তরালে শান্ত ভাবুক দুচোখে মাঝে মাঝেই খেলে যাচ্ছে উৎসাহিত চকিত বিদ্যুৎ, মৃদু বঙ্কিম স্মিতহাস্য রূপোলী ঝালরসম সেঁটে আছে ঠোঁটে।
--"আচ্ছা এই ভরা বসন্তে মুখে শ্রাবণের মেঘ ঘনিয়েছে কেন জানতে পারি? আর একা একা অজানা সমুদ্র সৈকতে বসে আছেন যে সুন্দরী? ভয়-ডর নেই নাকি!!" বালির ওপর রিমির পাশে থেবড়ে বসে জোড়া ভ্রুলতায় বিভঙ্গ তুলে জানতে চায় সে।
--"আচ্ছা আপনার সমস্যাটা ঠিক কোথায় বলবেন? প্রথমত সুন্দরী আমি নই, আর দ্বিতীয়ত কখন কি করি তার জবাব আমি কাউকে দিই না।" যথাসাধ্য মুখ গম্ভীর করে অন্যদিকে চেয়ে জবাব দিল রিমি।
--"বাব্বা!! শান্ত চেহারার আড়ালে তো হিংস্রা বাঘিনী লুকিয়ে আছে দেখছি!! তা আমায় কামড়ে দেবেন না তো?" হো হো করে হেসে গড়িয়ে পড়ে অবয়ব, মুখে কালবৈশাখীর আঁধার ঘনিয়ে ছিটকে উঠে দাঁড়ায় রিমি।
--"হয়েছে আপনার? না চাইতেই উড়ে এসে জুড়ে বসে তখন থেকে যা নয় তাই বলে চলেছেন, অসহ্য!!"
--"আরে, আরে রাগছেন কেন? আপনি না বড্ড তাড়াতাড়ি রেগে যান! বড্ড ছেলেমানুষি স্বভাব আপনার। কবিতা শুনে ভালো লাগল বলেই তো এলাম আপনার কাছে, আজকাল এত গভীর কবিতা পড়ে কজন!! সবটাই উপলব্ধির খেলা বুঝেছেন?বসুন বসুন।" অবাক হয়ে বালির ওপর ফের বসে পড়ে রিমি, সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে অবয়বের দিকে।
--"এই দেখেছেন!! এতক্ষণ কথা বলছি আপনার সাথে, একে অপরের নামটাই জানা হয়নি। আমি অনিক, অনিক রায় কাপূর, আপনি??"
--"রিমি, ইয়ে মানে রম্যাণী সেন। আপনি তো অবাঙালি? তাও এত ভালো বাঙলা বলেন কিভাবে? "উৎসুকভাবে জানতে চায় রিমি।
আকর্ণবিস্তৃত হাসিটিকে আরেকটু চওড়া করে জবাব দেয় অনিক,--"আসলে আমার মা বাঙালি আর বাবা জাঠ সম্প্রদায়ভুক্ত। বাবা ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন, মুর্শিদাবাদ ভ্রমণে এসে প্রেমে পড়েন মায়ের, অতএব বিয়ে এবং আমি......।"
---"ও আচ্ছা, আপনারা তবে এখানেই থাকেন?"
--"নাহ নাহ, বাবা এবং পরিবারের বাকি সকলে হরিয়ানায় থাকেন, আমি রামকৃষ্ণ মিশনে পড়াশুনো করেছি। মা কবি ছিলেন, ওনার সূত্রেই এই ভাষার প্রতি আগ্রহ জন্মায়।"
--"ও আচ্ছা, বুঝলাম।"
--"দেখুন, তখন থেকে নিজের কথা বলে চলেছি, আপনার সম্পর্কেও জানতে ইচ্ছে করে নাকি!! বলুন কিছু।"
--"আমার সম্পর্কে কিছুই জানার নেই।পরিবার পরিজন পরিত্যক্তা, ছোটোখাটো কাজ করে অন্ন সংস্থান করি। সমুদ্রের অগুনতি ঢেউয়ের মাঝে চলমান জীবনের ছন্দ খুঁজতে এখানে আসি প্রতিবার। ব্যাস এটুকুই।"
--"বাব্বাহ, এ যে ঠিক দুই নম্বরের প্রশ্নের উত্তর হলো। মুখে প্রেমের কবিতা মুখ জুড়ে বিদিশার অন্ধকার, সত্যি আপনি বড্ড রহস্যময়ী।"
--"সেরকম কিছুই নয়, কবিতা ভালো লাগে, তাই পড়ি। প্রেমে বিশ্বাসী নই।"
--"মানতে পারলাম না ম্যাডাম। ওই শূন্য চোখে অন্য কিছু দেখতে পাচ্ছি আমি।বয়সে আপনার চেয়ে কিছু বড়োই হবো, অভিজ্ঞ চোখ পড়তে পারছে কিছু অব্যক্ত বেদনার ভাষা।"
--"আমায় পড়ে কাজ নেই, মুখোশের অন্তরালে থাকা আসল চেহারার সন্ধান কোনোদিন কেউ পাবে না।" অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নির্লিপ্তভাবে জবাব দিল রিমি।
--"আচ্ছা আপনি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা "বিবাদ" পড়েছেন? না পড়লে পড়ে দেখুন, কেন জানিনা মনে হয় আপনাকে উদ্দেশ্য করেই লেখা বোধহয় কবিতাটি, শান্ত মুখ আর কোঁকড়ানো চুলের আড়ালে ধ্বংস পুষে রাখেন আপনি। আমি কবিতা লিখতে চাই আপনাকে নিয়ে, পোড়া ছাইয়ে মিশে থাকা মৃত্যুসম কবিতা; লিখতে দেবেন?" রিমির চঞ্চল চোখের তারায় নিজ শান্ত দৃষ্টি অর্পণ করে বলে অনিক।
--"অনেক হয়েছে!! তখন থেকে যা মুখে আসছে বলে চলেছেন। কতবার বলব ভালোবাসায় বিশ্বাস করিনা আমি!! লিখবেন না আমায় নিয়ে কিচ্ছু, বলে দিলাম আপনাকে। আমায় নিয়ে লেখা অভিশাপ বয়ে আনবে, শান্তি নয়।" রক্তবর্ণ মুখে হিসহিসিয়ে ওঠে রিমি, উঠে এগিয়ে চলে নিজ হোটেল অভিমুখে।
--"আরে শুনুন তো!! বড্ড বেশি রাগ আপনার। পুরো কথা না শুনেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন আপনি। আচ্ছা যে কবিতাটি এখুনি আবৃত্তি করছিলেন আপনি, আপনাকে দেখে তারই কয়েকটা লাইন মনে পড়ে গেল,

"এতো ক্ষয়, এতো ভুল জমে ওঠে বুকের বুননে
এই আঁখি জানে, পাখিরাও জানে, কতটা ক্ষরণ
কতোটা দ্বিধায় সন্ত্রাসে ফুল ফোটে না শাখায়।"

--"হয়েছে আপনার কাব্য শোনানো? আমায় ফিরতে হবে হোটেলে। কাল সকালের বাস আছে, ফিরে যেতে হবে কর্মস্থলে।" বিরক্ত মুখে বলে রিমি।
---"আচ্ছা একবারও জিজ্ঞেস করলেন না!আমি এখানে কি করছি? আচ্ছা বেশ, আমিই বলে দিই, আমি প্রতিবছর এখানে আসি, মায়ের মৃত্যুদিনে।" আকাশের দিকে চেয়ে বেদনাহত স্বরে বলে অনিক।
--"আপনার মা!!! মানে তিনি....এখানে???" বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে রিমি।
--"মা অন্য সম্প্রদায়ের হওয়ায় মেনে নেননি আমার ঠাকুরদা ও পরিবারের অন্য সদস্যেরা। তাঁদের রোষের হাত থেকে মাকে বাঁচাতে বাবা তাকে নিয়ে এখানকার এক গ্রামে বাসা বাঁধেন। আগেই বলেছি আমার মা কবি ছিলেন, একদিন পূর্ণিমারাতে আচমকাই বৈষ্ণব পদাবলী আওড়াতে আওড়াতে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি, আমার বয়স তখন মাত্র দুই। বাবা আমায় নিয়ে গিয়েছিলেন হরিয়ানায়, কিন্তু ঠাকুরদা মেনে না নেওয়ায় তিন বছর পর মিশনে রেখে যান। খরচাপত্র দিতেন অবশ্য, তিনি এখন একটি জাঠ স্ত্রী রত্ন ও তৎসূত্রে তিনটি সন্তানের জনক।" বালির ওপর হাতের আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি কাটছে অনিক, শব্দ করে পাড়ে আছড়ে পড়ছে জোয়ারের ফলে ফুলেফেঁপে ওঠা বঙ্গোপসাগরের ঢেউ। অন্ধকারে রিমির মুখ এখন প্রায় অস্পষ্ট, নিস্পন্দ বসে রয়েছে সে হাঁটু মুড়ে।

--"পরাজয় এসে কণ্ঠ ছুঁয়েছে লেলিহান শিখা, চিতার চাবুকে মর্মে হেনেছ মোহন ঘাতক। তবুতো পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে মুখর হৃদয়, পুষ্পের প্রতি প্রসারিত এই তীব্র শোভন বাহু।"
অনিক যে মৃত মায়ের স্মৃতিতে প্রতিবছর ছুটে আসো এখানে, তার নামটাও জানোনা তুমি? তবে শোনো! তোমার মায়ের নাম ছিল রম্যাণি সেন। আত্মহত্যা করেনি সে, পাগলও হয়নি, তাকে মেরেছিল তোমার বাবার নির্লিপ্ত উপেক্ষা। বিয়ের একবছরের মধ্যেই আকর্ষণ হারিয়েছিল সে, শুধু দেওয়া কথার তাগিদে বয়ে নিয়ে চলছিল এক জটিল সম্পর্ক,আমি মুক্তি দিয়েছিলাম তাঁকে বেনামি সে হৃদিসম্পর্ক থেকে।অনিক তুমি আমার গর্ভজাত নও,এমনই কোনো এক সান্ধ্য প্রহরে সমুদ্রতটেই পেয়েছিলাম তোমায় দুজনে,সেই থেকে তুমি আমাদের সন্তান।তোমার বাবা আমার বিবাহিত স্বামী নন,ছিলেন আত্মার আত্মীয়,আর আমি!! নামহীন এক পাণ্ডুলেখ্য।"
ঠকঠক করে কাঁপছে অনিক, রাতের অন্ধকারের সাথে প্রতিমুহুর্তে ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে রিমি। শব্দগুলো হয়ে আসছে ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর। নক্ষত্রময়ী নিঃশব্দ রজনীপাতে দূর হতে শোনা যাচ্ছে অজানা পাখির ডাক।সম্মুখে সুনীল জলরাশিবক্ষে তখন হাজার আলোকবিন্দু।
---"কিছুটা আঘাত অবহেলা চাই
প্রত্যাখ্যান সাহস আমাকে প্ররোচনা দেয়
জীবন কিছুটা যাতনা শেখায়,
ক্ষুধা ও খরার এই অবেলায়
অতোটা ফুলের প্রয়োজন নেই।"

আর এসো না অনিক এখানে, শান্তিতে ঘুমাতে দাও সমুদ্রবক্ষের ফেনিল শুভ্রতায়, যেথা সম্পর্কের পিছুটান নেই, নেই আবেগের টানাপোড়েন, ভালো থেকো।"
অন্ধকার কাটিয়ে আকাশে ফুটে উঠেছে হালকা আলোর রেখা, একটু একটু করে জেলেরা আসতে শুরু করেছে এদিকে, সাগরপানে চেয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে অনিক, দূরে কোথাও ভেসে আসছে গান----
"ভালো আছি ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো"........আজ দোলপূর্ণিমা।।

(সমাপ্ত)

No comments:

Post a Comment