এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

পদ্মাবতী রায় চৌধুরী




মুক্ত গদ‍্য





বিশ্বাসের গন্ধ...

রূপকথার থালার মত গোল চাঁদের নিচে দাঁড়িয়ে কালো রাতের হাওয়া গায়ে এসে লাগতেই বুঝতে পারছি জীবনটা আসলে ভাঙা কাঁচের মত...আঁচড় খাওয়া,টুকরো টুকরো ৷ আনমনে টুকরোগুলি ছড়িয়ে দিয়েছি বারান্দার লাল মেঝেতে ৷ রাতে কি লাল বোঝা যায় ? বুক চলকে উঠছে যে রক্তের স্রোত...ওর রং কি ? লাল না কালো ? পৃথিবীর আসল রং সাদা-কালো ৷

মেঝেময় ছড়িয়ে আছে কুচি কুচি কাঁচ...বসন্তের অন্ধকার আর কাঁচের কুচি থেকে গড়িয়ে পড়ছে স্মৃতিজলের ছিটেফোঁটা আলো ৷ মাধ্যমিকের সময় তুমি প্রথম জানলে মানুষ চলে যায়...সবথেকে কাছের মানুষ ঠাম যেদিন রাতে লেলিহান আগুনের বিছানায় শুয়ে প্রথম বৃষ্টিধারার ট্রেন ধরেছিল ৷ তারপর আদিগঙ্গায় কত স্রোত দমবন্ধ হয়ে মরে গেল ৷
এখন মার্চ...এই বসন্তে আগের বছর হারিয়ে গেছেন সুপ্রতিমদা...শেষ যেদিন দেখা হল আমাকে রাত এগারোটা অব্দি লুচি বেলা শেখাতে শেখাতে আমার আফ্রিকার ম্যাপ দেখে ওরা স্বামী-স্ত্রী হাসছিল...ওবাড়ির বাতাসে এখনও ছড়িয়ে আছে আমাদের হাসির গুঁড়ো ৷ আগামী বসন্তে হয়ত ওবাড়ি...গাড়িবারান্দার তেরছা রোদ...আর খোলা ছাদের হাওয়া ইতিহাসে মিশে যাবে, একটা ঝকঝকে ফ্ল্যাটবাড়ি আকাশে মাথা তুলে দাঁড়াবে ৷ তবুও দেবী আর আমার মনে জেগে থাকবে মুক্ত একটা মানুষের স্মৃতির গন্ধ ৷

জীবনকে কখনও মুঠিতে লুকিয়ে রাখতে পারবে না তুমি ৷ ওকে কাঁচের বোতলে পুরে ছড়িয়ে দাও...ছেড়ে দাও স্রোতের সাথে ৷ হয়ত তিনশো একুশ বছর পরে সাগরে ভাসতে ভাসতে তোমার চিরকূট পৌঁছে যাবে প্রিয় ছায়ামানুষটার কাছে ! টাকা নয়,মেধা নয়,সংঘাত নয়...বুকের আড়ালে লুকিয়ে থাকা স্মৃতিটুকু ছাড়া তুমি মৃত ৷ সারাজীবন লড়তে থাকা প্রিয়জন যখন স্মৃতিহারা স্হবির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে হাসে...আমি তখন মৃত্যুর গন্ধ পাই বাতাসে ৷

স্কুলের টানা বারান্দা থেকে ছিটকে পড়ছিলে তুমি উঁচু সিঁড়ি দিয়ে ৷ মাসের বিশেষ একটি সময়ে, যখন গড়িয়ে গড়িয়ে পাতালের দিকে চলে যাচ্ছিলে,গভীর কিছু ক্ষত...সিঁড়িভাঙা টাটকা রক্তের গন্ধ ছাড়া জীবন একবারও বুঝতে দেয়নি...তুমি দুর্বল হয়ে গেলে আজীবনের জন্য ৷ যে বাড়িটার খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে প্রতিবছর কোজাগরী চাঁদের সাথে গল্প করতে করতে তুমি স্পর্শ করতে প্রথম মেয়েবেলার নিষিদ্ধ রাত...বাতাসের শিহরণ...সেই বিশাল বাড়িটা যেদিন তোমার নাকের ডগায় বুট নাচিয়ে অন্য লোকের হয়ে গেল...সেই বিকেলের তালা তুমি নিজে হাতে বন্ধ করে করেছিলে...মনে পড়ে ? ও তালা তুমি আর এজীবনে খুলতে পারবে না...ওবাড়ির রং এখন কটকটে কমলা...অথচ তোমার রাতের স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসছে ওর দেওয়ালের দুধসাদা গন্ধ...সিঁড়িতে চুনের গন্ধ...স্কুলফেরত একছুটে চারতলা পনিটেল দুলিয়ে এখনও শ্বাস টানছে সদ্যযৌবন...মামারবাড়ির রান্নাঘরে কয়লার উনুনে জ্বলন্ত গুলের গন্ধ...একলা দুপুরে মিটসেফে লুকোনো গুঁড়ো দুধের গন্ধ...লেকের জলে নিজের ছায়া দেখে লজ্জা পাওয়া স্বপ্নের গন্ধ..."মহারাণী"তে বিকেল গড়িয়ে সদ্য ফুলকো কচুরীর গন্ধ...চশমাছাড়া বৃষ্টিভেজা কলকাতার গন্ধ...ট্রামলাইন এঁকেবেঁকে চলেছে,আর প্রাগৈতিহাসিক হলুদ বইপাড়ার বুকজলের গন্ধ...কফিহাউজের সাদা অ্যাপ্রন পরা অন্য জগতের ওয়েটার আর ইনফিউশনের গন্ধ...আমার ঝাপসা চোখে ডুবুরীর মত কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে জন্মাচ্ছে অগ্নিগ্রাসীর শরীরের কবিতারা...তোমার অনায়াস দক্ষতায় ৷ বইটা এখনও থাকে আমার মাথার কাছে ৷ আমি খুলি না ওর একটাও পাতা...ধূলো ধুয়ে রোদে শুকোই আদরে...আমি দেখি তুমি চলে যাচ্ছ নতুন জীবনে আর আমার হাতে অগ্নিগ্রাসীর প্রতিটা কবিতার কালো কালো অক্ষর রোদের আগুনে পুড়ছে ...বাতাসে তখন রোদপোড়া গন্ধ ৷

প্রথম যেদিন তুই বইমেলার ভীড় সরিয়ে এগিয়ে এসে বই কিনতে কিনতে বললি...পরশু চলে যাচ্ছি...নতুন চাকরি...অবাক হচ্ছিল মন ৷ আমাদের পরিচয়ের বয়স তখন মাত্র তিন মিনিট চব্বিশ সেকেন্ড ! তাও তুই বললি...হাসলি আর বছর তিনেক যুদ্ধ করতে করতে আমার চোখের সব জল মুছতে মুছতে আমাকেও হাসালি মন থেকে ৷ আজ যখন তুইও ভুল বুঝে চলে যাচ্ছিস আমার জীবনের চোরাবালি থেকে ...আবারও মুছে যাচ্ছে লাল মেহগনি আবির ৷ বুকে রয়ে যাচ্ছে অফিসফেরত তোর পারফিউমে মেশা ঘামের গন্ধ...শ্রমের গন্ধ...তোর কবিতা আর বিশ্বাসের গন্ধ...ভালোবাসার গন্ধ ৷ গুঁড়ো কাঁচে রূপো চাঁদ আর সাদা-কালো রাত কুচি কুচি হয়ে যেতে যেতে কানেকানে বলছে ...

"যে-ভালোবাসা, আমার সামান্য সঞ্চয় এই জীবনে, তা শুধু তোমার, তোমারই।"

পদ্মাবতী রায় চৌধুরী 

সম্পাদক "সময়...23:59"সাহিত্য পত্রিকা
দীর্ঘ দশবছর ধরে লেখালেখির নানা ফর্মের চাতালে চারাগাছ বোনা আমার নেশা,বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনই চারণক্ষেত্র ৷ ঝুলিতে দেড়খানা স্নাতকোত্তর ডিগ্রীও আছে যদিও ৷ আপনারা আমার লেখা পড়ে মন্তব্য জানালে ভালো লাগবে ৷

No comments:

Post a Comment